এডিসনের তখন বৃহস্পতি তুঙ্গে। একটার পর একটা আবিষ্কার করে যাচ্ছেন আর একের পর এক পেটেন্ট বাগাচ্ছেন। এডিসন ছিলেন একাধারে সেরা বিজ্ঞানী, আবার সেরা ব্যবসায়ী। খুব কম বিজ্ঞানীর মধ্যেই এমন কম্বিনেশন দেখা যায়। তার আবিষ্কার করা বৈদ্যুতিক বাতি তখন অভিজাতদের অন্দর মহলের আর কর্পোরেট অফিসগুলোর শোভা বাড়াচ্ছে।
এই বৈদ্যুতিক বাতি চলে DC কারেন্টে। DC কারেন্ট মানে, সময়ের সাথে সাথে যেই কারেন্টের মান বা দিক, কোনোটারই কোন পরিবর্তন হয় না। অচিরেই DC কারেন্ট জনপ্রিয়তা পেয়ে গেলো। অভিজাতদের মহল থেকে বৈদ্যুতিক বাতি পৌঁছে গেলো সাধারণের কোঠায়। এডিসনও একের পর এক পাওয়ার প্ল্যান্ট ডিজাইন করতে থাকলেন।
কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দিল। এই কারেন্ট বেশিদূর পাওয়ার ট্রান্সফার করতে পারে না। দুই কিলোমিটার যেতে না যেতেই এডিসনের ডিসি কারেন্টের দম ফুরিয়ে যাচ্ছে। কাজেই, তার যারা ভোক্তা, তাদের সবার বাড়িঘরই পাওয়ার প্ল্যান্টের দুই কিলোমিটারের মধ্যে। ইলেকট্রিসিটি যখন তারের মধ্য দিয়ে যায়, তখন আস্তে আস্তে তার দম ফুরাতে থাকে। ইঞ্জিনিয়ারিং এর ভাষায় একে বলা হয় লাইন লস। এই লাইন লস P = I2R ফর্মুলা মেনে চলে।
P মানে পাওয়ার, I মানে কারেন্ট এবং R মানে রেজিস্ট্যান্স বা বাঁধা। তার মানে, যে পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রবাহিত হবে, তার বর্গাকারে লাইন লস হবে। আপনার বিদ্যুতের প্রবাহ যদি দুই গুণ বাড়ে, লাইন লস বাড়বে চার গুণ। বিদ্যুতের প্রবাহ তিনগুণ বাড়লে লাইন লস নয়গুণ। এডিসন জানতেন, কোনভাবে যদি বিদ্যুতের প্রবাহটা কমানো যায়, তাহলেই কেল্লা ফতে। লাইন লস কমে যাবে। সেই সাথে দূরে বহুদূরে ইলেকট্রিসিটিও পাঠানো যেত। কিন্তু তার মাথায় কোন সমাধান আসছিল না।
এডিসন যখন মাথা কুটে মরছেন, তখন সমাধান নিয়ে এলেন টেসলা। নিকোলা টেসলা। আর্গুয়েবলি ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।
ইলেকট্রিসিটির একটা বেসিক ফরমুলা হচ্ছে, P=VI, যেখানে P মানে পাওয়ার, V মানে ভোল্টেজ, আর I মানে কারেন্ট। টেসলা ভেবে দেখলেন, কোনভাবে ভোল্টেজ বাড়িয়ে দিয়ে, আর কারেন্ট কমিয়ে দিতে পারলে একই পাওয়ার আপনি বহুদূর পৌঁছাতে পারবেন। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি।
লেখকের অন্যান্য কিছু লেখা-
আপনি পাঠাতে চাচ্ছেন ১০০০ ওয়াট। তো আপনি যদি ১০০ ভোল্ট জেনারেট করেন, আপনাকে পাঠাতে হবে ১০ এ্যাম্পিয়ার কারেন্ট। কারণ, ১০০X১০=১০০০। এখন ১০ এ্যাম্পিয়ার কারেন্ট মানে কিন্তু অনেক কারেন্ট। আপনার লাইন লস হবে ভয়াবহ।
এখন আপনার হাতে যদি কারেন্ট কমিয়ে ১ এ্যাম্পিয়ার করতে চান, তাহলে আপনাকে জেনারেট করতে হবে ১০০০ ভোল্ট। কারণ, ১০০০X১=১০০০। আপনি কিন্তু একই পাওয়ার পাঠাচ্ছেন। কিন্তু লাইন লস কমে যাচ্ছে বহুগুণ।
কিন্তু ভোল্টেজ পাল্টানোর কাজটি করবে কে?
আজ আমরা জানি, যে ট্রান্সফর্মার এই কাজটা করে। টেসলা দেখলেন, কাছাকাছি দুটো কয়েল রেখে একটা কয়েলে এসি ভোল্টেজ দিলে সেটা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইনডাকশনের মাধ্যমে অন্য কয়েলে ভোল্টেজ ইনডিউস করে। এটা ফ্যারাডে’র ল। এডিসন বা অন্য কেউ এটা জানতেন না, এটা বিশ্বাসযোগ্য না।
টেসলার এঞ্জিনিয়ারিং এইখানেই যে, উনি এটার সম্ভাবনা ধরতে পেরেছিলেন। টেসলা কয়েলের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ডিসি-তে এটা কাজ করে না। করে কেবলে এসিতে। তার মানে দূর দূরান্তে ইলেকট্রিসিটি পাঠাতে হলে এসি’র কোন বিকল্প নেই।
টেসলা তখন এডিসনের ল্যাবে কাজ করছেন। টেসলা তার এই আবিষ্কারের কথা এডিসনকে বললেন। এডিসন সেটা পাত্তাই দিলেন না। মনক্ষুণ্ন হয়ে টেসলা চাকরি ছেড়ে দিলেন। টেসলার এই আবিষ্কার লুফে নিলেন ড. ওয়েস্টিংহাউস নামের একজন উদ্যোক্তা। ইনি নিজেও একজন একাডেমিশিয়ান ও বিজ্ঞানী। রত্ন চিনতে উনি ভুল করেননি। টেসলাকে পিটসবার্গে নিজের ল্যাবে কাজ করার সুযোগ দেন তিনি। বাকিটা ইতিহাস।
টেসলার আবিষ্কারের উপযোগিতা এডিসন বোঝেননি, এমনটা ভাবলে ভুল হবে। তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন। কিন্তু তার আগেই কেউ এই সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে, এটা তার কাছে ছিল অবিশ্বাস্য। কাজেই, তিনি এসি কারেন্টের বিরোধিতা করা শুরু করলেন।
এডিসন তখন সেকালের নিউটন। ওপরমহলে তার যথেষ্ট জানাশোনা আর প্রভাব। তিনি এই প্রভাব খাটিয়ে এসি’র বিরুদ্ধে প্রচারণায় নামলেন। বিজ্ঞানী মানেই যে ভালো মানুষ হতে হবে, এমন তো কোন কথা নেই।
শুর হল এসি-ডিসি’র দ্বন্দ্ব। এসি’র ক্ষতিকর প্রভাব বোঝানোর জন্য এডিসন একটা পরীক্ষা করলেন। এই পরীক্ষায় একটা কুকুরকে ১০০০ ভোল্ট ডিসি শক দেয়া হল। কুকুরটার কিছু হল না। এবার তাকে ৩০০ ভোল্টের এসি শক দেয়া হল। কুকুরটা মারা গেলো। এডিসন বোঝাতে চাইলেন, এসি কারেন্ট দুর্ঘটনা এমনকি মৃত্যুর কারণ হতে পারে। ডিসি সেদিক দিয়ে অনেক নিরাপদ। এইসব পরীক্ষা জনসম্মুখেই করা হত।
ফাঁসির আসামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য এডিসন ইলেক্ট্রিক চেয়ার চালু করলেন। আসামীকে এই চেয়ারে বসিয়ে তার শরীরের ভেতর এসি কারেন্ট চালিয়ে দেয়া হত। পুরো ব্যাপারটি ছিল খুব নৃশংস ও ভয়াবহ।
এসি কারেন্টের উদ্যোক্তাকে ব্যঙ্গ করে এডিসন এই প্রক্রিয়াটির নাম দিলেন ‘ওয়েস্টিংহাউজড’। উপর মহলে প্রভাব খাটিয়ে এসিকে ব্যান করার চেষ্টাও করলেন তিনি।
কিন্তু দূর দূরান্তের মানুষ ততদিনে এসি পাওয়ারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। এসির গ্রহণযোগ্যতা দিনকে দিন বেড়েই চলছিল। কাজেই, এইসব পরীক্ষা করে লোককে ভয় দেখানো গেল না। আর টেকনোলজির নিয়মই হচ্ছে – যা মানুষের কাজে আসবে, সহজ ব্যবহার উপযোগী তা টিকে থাকবেই। কোন সিণ্ডিকেটই একে দাবিয়ে রাখতে পারবে না।
১৮৯৩ সালে শিকাগোতে একটা মেলা হল। সেই মেলায় এডিসনের ডিসি ও টেসলার এসি শেষবারের মত মুখোমুখি হল। টেসলার স্টল এসি’র আলোয় জ্বলজ্বল করছিল। এডিসনের স্টল সেই তুলনায় অনেক নিষ্প্রভ।
এডিসন হেরে গেলেন। হেরে গেলো ডিসি। সেই মেলার পরপরই নায়াগ্রা ফলসে একটা হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টের কাজ শুরু হল। সেই কাজ দেয়া হল ওয়েস্টিংহাউজকে। কর্তারাও বুঝলেন, এসি-ই প্থিবীর ভবিষ্যৎ।
এসি-ডিসির যুদ্ধ ইতিহাসে Battle of Current নামে পরিচিত। আজ আমরা বাসাবাড়িতে, অফিস-কারখানায় যে ইলেকট্রিসিটি ব্যবহার করি তার প্রায় পুরোটাই এসি। ভেবে দেখুন, সেই যুদ্ধে এডিসনের জয় হলে আজ আমাদের রাস্তায় রাস্তায় পাওয়ারপ্ল্যান্ট বসাতে হত। ভাগ্যিস টেসলার পেছনে ওয়েস্টিংহাউসের মত শক্ত মানুষ ছিলেন।
ইলেকট্রিসিটির কথা বললেই আমাদের মনে এডিসনের চেহারা ভেসে ওঠে। এখন থেকে হয়তো টেসলার চেহারাও ভেসে উঠবে মাঝে মধ্যে।