টাইটান, জিউস, প্যান্ডোরা ও অন্যান্য দেবতাদের কথা –
দেবতাদের পরিচয়
সৃষ্টির আদিতে ছিল বিশাল শূণ্যতা বা ক্যাওস। এরপরে একদিন সৃষ্টি হলো “গেইয়া“। গেইয়া ছিল ধরিত্রীদেবী। আদি জননী। তার সঙ্গে আরো জন্মালো-
স্বর্গ ও আকাশদেবতা ‘ইউরেনাস‘
রাত্রির দেবী ‘নিক্স‘
অন্ধকারের দেবতা ‘এরিবাস‘ এবং
প্রেমের দেবতা ‘এরস‘।
দেবতা এরিবাস ও দেবী নিক্সের মিলনে জন্ম নেয় বিশুদ্ধ বাতাসের দেবতা ‘ইথার‘ ও দিনের দেবতা ‘হেমেরা‘। পরে রাত্রিদেবী নিক্স আরো জন্ম দেয় ধ্বংস, ভাগ্য, মৃত্যু, নিদ্রা, স্বপ্ন, প্রতিহিংসা এরকম আরো বহু দেবীর।
গেইয়া ও ইউরেনাস এর মিলনে জন্ম হয় বারোজন টাইটান, তিনজন সাইক্লোপস ও তিনজন হেকাটনচেরির। টাইটানরা প্রথম প্রজন্মের দেবতা, সাইক্লোপসরা একচক্ষু বিশিষ্ট দানব এবং হেকাটনচেরিগণ শতহস্ত দানব। এদের মধ্যে টাইটানরা অধিক শক্তিশালী ছিল। তারা অন্য দুই জ্ঞাতিকে মাটির নিচে টার্টারাস নামের অন্ধকার প্রদেশে বন্দি করে রাখে।
গেইয়া আর ইউরেনাসের সাথে একসময় দ্বন্দ্ব বেঁধে গেলে, আদি মাতা তার পুত্রদেরকে আদি পিতার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুললেন। টাইটানদের সর্বকনিষ্ঠ ‘ক্রোনাস‘ ইউরেনাসকে ধারালো তলোয়ার দিয়ে কেটে ফেলে। দেবতা ইউরেনাসের রক্ত থেকে তিনজন করে এরিনি ও অ্যাশ জন্মায়। এরিনিরা হচ্ছে তিনজন প্রতিহিংসার দেবী- আল্লেক্তো, মেগাইরা ও তিসিফোনে। ইউরেনাসের কেটে যাওয়া একটা অংশ সমূদ্রে পড়লে সেখানকার ঢেউয়ের ফেনা থেকে জন্ম নেয় “আফ্রোদিতি“।
ইউরেনাস ক্রোনাসকে অভিশাপ দিয়ে যায় যে, ক্রোনাসের মৃত্যু তার পুত্রের হাতেই হবে। ক্রোনাস তার বোন রিয়াকে বিয়ে করে রাজ্যপাট গুছিয়ে শাসন করতে থাকে। তার সন্তান জন্মানো মাত্রই একেএকে তাদের সবাইকে ক্রোনাস গিলে ফেলতো। এভাবে বিপদ বুঝে রিয়া পরবর্তী পুত্র সন্তানকে জন্মানো মাত্রই ক্রিতি দ্বীপে পাচার করে দেয়। আর ক্রোনাসকে দেখালো যে সে একটি পাথর জন্ম দিয়েছে। ক্রোনাস সেই পাথরকেও গিলে ফেলে।
ক্রিতি দ্বীপে পরীদের আদর যত্নে বেড়ে ওঠা সেই সন্তান হলো জিউস। ক্রমেই জিউস বলশালী ও খুব বুদ্ধিমান হয়ে গেল। এভাবে একদিন ক্রোনাস বুঝতে পারে জিউসের কথা। ক্রোনাস শক্তির বিচারে পুত্রের সমকক্ষ ভাবছিল। কিন্তু জিউস বুদ্ধিমান ছিল, এক টাইটান নারী মেতিস তাকে একটা ওষুধ বানিয়ে দেয়। জিউস সেই ওষুধ নিয়ে ক্রোনাসের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে যায়। পানীয়ের সাথে জিউস সেই ওষুধ খাইয়ে দিলে ক্রোনাস গিলে ফেলা পাথরসহ পাঁচ সন্তানকে উগরে দেয়। জিউস এই ভাইবোনদের নিয়ে সাততাড়াতাড়ি অলিম্পাসের পর্বতের চূড়ায় আশ্রয় নেয় এবং সুরক্ষিত সাম্রাজ্য গড়ে তুলে।
জিউস ও অন্যরা
জিউস তো তার ভাইবোনদের নিয়ে অলিম্পাসে পালালো, এদিকে ক্রোনাস ক্রুদ্ধ হয়ে যুদ্ধযাত্রা করে। টাইটানদের মধ্যে প্রমিথিউস ও এপেমেথিউস এই দুই ভাই ছাড়া অন্যসবাই যুদ্ধে অংশ নেয়। যুদ্ধ শুরু হলো। পর্বতের উপরে সুবিধাজনক অবস্থানের জন্যে জিউসকে বাগে আনা সম্ভব ছিল না। তাই ক্রোনাস এক ফন্দি আঁটলো। পেলিওন নামের ছোটখাটো এক পাহাড় কাছেই ছিল। সেটাকে অলিম্পাসের সমান উচ্চতায় গড়ে তোলা শুরু হলো।
এদিকে ক্রোনাসের পত্নী রিয়া তার এই ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিলো জিউসের কাছে এবং পরামর্শ দিলো যে, মাটির নিচে সাইক্লোপস ও হেকাটনচেরিরা আছে; তাদের সাহায্য নিতে, আর সাইক্লোপসদের দিয়ে শক্তিশালী বজ্র তৈরি করে নিতে। জিউস বন্দি জ্ঞাতিদেরকে মুক্তির আশ্বাস দিয়ে কাজে লাগালেন। সাইক্লোপস আর হেকাটেনচেরিরা ভুমিকম্পের মাধ্যমে পুরো পেলিওন পাহাড়কে নাড়িয়ে দেয় আর সেই সঙ্গে জিউস শক্তিশালী বজ্র ছুড়লে ক্রোনাস ধ্বসে পরে পরাজিত হলো ও হার মেনে ক্ষমা চাইল। জিউস তাকে অন্ধকার রাজ্য টার্টারাসে বন্দি করে রাখলো।
বিপক্ষে যুদ্ধ করার জন্য টাইটান ‘অ্যাটলাসকে‘ চিরকালের জন্য পৃথিবীর ভার কাঁধে তুলে দিয়ে শাস্তি দিলো। সেই থেকে অ্যাটলাস পৃথিবীকে ঘাড়ে নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে! যুদ্ধে অংশ না নেওয়ায় টাইটানদের মধ্যে তিনজন- আয়াপেতাস এবং তার দুই পুত্র এপেমেথিউস ও প্রমিথিউসের শাস্তি হলো না। স্বর্গ মর্তের একচ্ছত্র অধিপতি হলো জিউস।
অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনী –
জিউস পৃথিবীতে ঋতু অনুসারে ভাগ করে দিলো এবং প্রমিথিউসকে বললো মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী তৈরি করতে। প্রমিথিউস কাদা থেকে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী তৈরি করে আর দেবী অ্যাথেনা সেই মাটির শরীরে প্রাণ সঞ্চার করে। প্রমিথিউস তার ভাই এপেমেথিউসকে দায়িত্ব দিলো মানুষ ও জন্তুদের মধ্যে বিচিত্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দিতে। এপেমেথিউস সেরা গুনগুলো জন্তুদের আরোপ করে বসেছিল! পরে প্রমিথিউস তা পালটে মানুষকে সৃষ্টির সেরা করে। প্রমিথিউস অলিম্পাসের চাইতে মানুষের প্রতি বেশি পক্ষপাত ছিল। মানুষ পশুর মাংসের একটা অংশ দেবতাদের উৎসর্গ করে, কোন অংশ দেবতার আর কোন অংশ মানুষের তা তিনি স্থির করেন। প্রমিথিউস পশুর অস্থিকে চর্বির ডেলা দিয়ে জড়িয়ে একটা স্তুপ তৈরি করে আর মাংসকে সেটার নিচে রাখে। জিউস অস্থিময় ঢিবিকে নির্বাচন করে প্রতারিত হয়। ক্রুদ্ধ হয়ে মানুষকে শাস্তি দেয়ার জন্যে তাদের কাছ থেকে আগুন সরিয়ে নেয়।
প্রমিথিউস স্বর্গ থেকে ঐ আগুন এনে দেয় বড়সড় চোঙ্গায় করে। আজকের দিনেও গ্রিসে মশাল বহনের রীতি আছে। প্রমিথিউসের এই কাজের জন্যে জিউস তার উপরে খুব ক্ষেপে যায় এবং তাকে ককেশাস পর্বতের চূড়ায় নির্বাসন দেয়। হেফাস্তাস একটি মজবুত শেকল তৈরি করে দেয় যেটা দিয়ে প্রমিথিউসকে বেঁধে রাখা হয়। জিউস একটা ঈগল ঠিক করলো যে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি প্রমিথিউসের কলিজা ঠুকরে ঠুকরে খেত। এই শাস্তি ত্রিশ হাজার বছরের জন্যে বরাদ্দ হলো। পরবর্তীতে কয়েকশ বছর পর বীর হেরাক্লেস ঈগলকে বধ করে তাকে মুক্ত করেন।
মানুষ আগুনের ব্যবহার শিখে দেবতাদের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারে এই আশঙ্কা থেকে জিউস হেফাস্তাসকে আদেশ দেন “দেবতাদের দান” রূপে এক নারীকে গড়ে তুলতে। হেফাস্তাস “প্যান্ডোরা“কে সবরকম মোহময়ী সৌন্দর্য রূপে তৈরি করে। প্যান্ডোরা, হার্মেসের কাছ থেকে ছলনা এবং আফ্রোদিতির কাছ থেকে শিখল প্রেমের কৌশল। দেবতারা তার হাতে একটা বাক্স দেয় এবং নির্দেশ দেয় সেই বাক্স না খুলতে।
হার্মেস তখন প্যান্ডোরাকে নিয়ে মর্ত্যে এসে প্রমিথিউসের সামনে হাজির করে। কিন্তু প্রমিথিউস বুঝে ফেলে যে এটা দেবতাদের চাল। হার্মেস তার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্যান্ডোরাকে নিয়ে যায় এপেমেথিউসের কাছে। ভাইয়ের নিষেধ সত্ত্বেও এপেমেথিউস প্যান্ডোরার জন্যে দিওয়ানা হয়ে বিয়ে করে।
প্যান্ডোরা
বিয়ের পরে প্যান্ডোরা কৌতূহলী হয়ে সেই বাক্সটি খুলে ফেলে। তখনই ঐ বাক্স থেকে ব্যাধি, মড়ক, দুঃখ, কষ্ট, মারামারি পৃথিবীতে বেরিয়ে আসে। প্যান্ডোরা হতচকিত হয়ে বাক্সের ডালা বন্ধ করে দিলে সবার নিচে পড়ে থাকা আশা ভেতরেই থেকে যায়! প্যান্ডোরার অসতর্ক কাজে জন্যে মানবজাতি এতটাই বিপথগামী হলো যে, জিউস ক্রোধে-ক্ষোভে মানবজাতিকে ধ্বংস করার চিন্তা করলো।
দেবতাদের ইচ্ছায় দক্ষিণা বাতাসে আকাশের ঝরনাগুলো খুলে গেল। ভূ-গর্ভস্থ কুয়োগুলোও সাগরের দেবতা পসাইডনের পরিচালনায় প্রস্রবণ বইয়ে চললো। জিউসের আক্রোশে সমূদ্র দেবতা সমর্থন দেওয়ায় বিশ্ব ডুবতে থাকলো। পৃথিবীর সকল প্রাণীসমূহ ডুবে মরলো। কেবলমাত্র প্রমিথিউসের পুত্র ডিউকালিয়ন পার্নাসাস পর্বতের চূড়ায় গিয়ে আশ্রয় নিল। সে হলো বিশ্বের একমাত্র পুরুষ; আর এপেমেথিউসের মেয়ে পিরহা। উত্তরের বাতাস জল সরিয়ে নিলে তারা ভূমিতে নেমে এসে দৈববাণীর জন্যে থেমিসের বেদিতে গেল। থেমিস হলো ইউরেনাসের টাইটান কন্যা এবং জিউসের আশ্রিত দেবী। দেবতাদের আদেশে তারা তাদের মুখ ঢেকে, পোশাক আলগা করে এবং পেছনে নিজেদের মায়ের অস্থি ছড়াতে আসতে। পিরহার ছড়ানো হাড় থেকে নারী এবং দিউকালিয়ন থেকে পুরুষ জন্ম নিল।
এইসব নারী পুরুষ থেকে মানবজাতির বিকাশ ঘটেছে। পিরহা ও দিওকালিয়নের এক পুত্র জন্মে হেলেন নামে। এই পুত্রের বংশধরেরা আইওনীয়, দোরীয় ও ইওলীয় জাতির উদ্ভব ঘটায়।