নার্সিসাস ও ইকোর গল্প
নার্সিসাস ছিল অত্যন্ত রূপবান এক যুবক। সে এতই সুন্দর ছিল, যেকোনো কুমারী মেয়ে তাকে দেখামাত্রই প্রেমে পড়ে যেত। কিন্তু সে কাউকেই পাত্তা দিত না। এমনকি সুন্দরী উপদেবিদেরকেও সে অবজ্ঞা করতো। একবার বনদেবী আর্টেমিসের সহচরী ইকো তার প্রেমে পড়লো। কিন্তু ইকোর ছিল এক অভিশপ্ত জীবন। হেরা তাকে অভিশাপ দিয়েছিলো যে, সে কখনোই প্রথমে কোন কথা বলতে পারবে না, শুধুমাত্র অন্যকারো কথার শেষ শব্দটি উচ্চারণ করতে পারবে। তো ইকো তাকে অনুসরণ করতো কিন্তু তার মনের কথা বলবার কোনো সুযোগ ছিলো না।
একদিন নার্সিসাস বনে হাঁটছিল। সেই মুহূর্তে ইকো তাকে দেখে ফেলে এবং পিছু নেয়। যুবক ঠিকই টের পেয়ে যায় যে কেউ তার পিছু নিয়েছে। সে তখন বলে উঠে-
”কেউ কি আছে এখানে?”
সাথে সাথে ইকো আনন্দিত হয়ে প্রতিধ্বনি করলো, “এখানে এখানে”।
সে তখনো ইকোকে দেখতে পায় নি বলে চিৎকার করে বললো, “এসো!”
ইকো তো এই ডাকেরই প্রতীক্ষায় ছিল, সানন্দে উত্তর দিল, “এসো!” এবং দুহাত মেলে বেড়িয়ে এলো বনের ভেতর থেকে।
কিন্তু সে ইকোকে দেখামাত্রই বিরক্তিতে দূরে সরে গেল এবং বললো,
“এটা কখনোই সম্ভব নয়, আমি মরে গেলেও তোমাকে আমার সঙ্গিনী করবো না।”
ইকো কিছু বলার আগেই সে চলে গেল। ইকো এরপর দুঃখ, বেদনায় এক অন্ধকার গুহার মধ্যে নিজেকে নির্বাসিত করলো। দিনে দিনে ইকো সেখানেই শীর্ণকায় হয়ে মরে গেল। তার হাড্ডিসার পাথরে পরিণত হলো। শুধুমাত্র তার কণ্ঠস্বর ছাড়া আর কিছুই রইলো না।
অন্যান্য কিছু পৌরাণিক গল্প-
নার্সিসাসের অহংকার এবং ইকোর এহেন দুর্দশা দেখে ক্রোধের দেবী নেমেসিস মর্ত্যে নেমে এলো। যুবক নিজেকেই শুধু ভালোবাসে কিনা, সেটা পরীক্ষা করার জন্য।
বনের মধ্যে ছিল স্বচ্ছ ফটিকের ন্যায় এক জলাশয়। এর পানি এতটাই স্বচ্ছ রূপালি ছিল যে, সেখানে রাখালেরাও তাদের পশু নিয়ে আসতো না। পাহাড়ি ভেড়ারাও কখনো জল খেতে আসে নি, না এসেছে অন্য কোনো প্রাণীরা। এমনকি গাছের পাতাও কখনো সেই জলে পড়ে নি। শুধুমাত্র সবুজ তাজা ঘাস ছিল চারপাশে।
একবার নার্সিসাস শিকার করতে করতে ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্ত অবস্থায় সেই জলাশয়ের পাশে চলে আসে। পানি খেতে উবু হওয়ার সময় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে ফেলে। সে ভাবল এ বুঝি কোনো জলদেবতা! সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে অপলকে সেই দেবতা প্রতিম চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে বুঝতে পারলো এ তার নিজের প্রতিবিম্ব ছাড়া আর কেউ নয়। সাথে সাথেই নিজেই নিজের প্রেমে পড়ে গেলো! সে চিৎকার করে বলে উঠলো,
“এখন আমি বুঝতে পারছি অন্যরা আমার কাছ থেকে কত যন্ত্রণা পেয়েছে, কারন আমি আমার নিজেরই প্রেমে পড়ে যন্ত্রণা পাচ্ছি।” সে আর তার প্রতিবিম্বকে ফেলে যেতে পারলো না। সেই জলাশয়ের উপর দিনের পর দিন পলকহীন তাকিয়ে থেকে সে ক্রমশ মৃত্যুরদিকে চলে গেল। শেষ মুহূর্তে সে উচ্চারণ করলো, “বিদায়”। ইকোর রেখে যাওয়া কন্ঠস্বর কেবল সেটার প্রতিধ্বনি করে বলতে পারলো, “বিদায় বিদায়”।
নার্সিসাসের মৃত্যুতে জলপরীরা হাহাকার করতে লাগল। তারা যুবকের দেহ সৎকারের আয়োজন করতে গেল। কিন্তু জলার পাশে তারা তার মৃতদেহ খুঁজে পেল না। সেটার বদলে সেই স্থানে তারা দেখতে পেল পার্থিব এক স্বর্গীয় ফুল। যুবকের নাম চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ফুলের নামকরণ করা হলো, “নার্সিসাস“, বসন্তের স্নিগ্ধ ফুল।