পোস্ট টপিকঃ
তাসের ইতিহাস ও উৎপত্তি
তাসের ইতিহাস নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলা যাক। তাস খেলার জন্ম হয় চীনে প্রায় এক হাজার বছর আগে। “ট্যাঙ” রাজবংশের রাজকন্যা “টংচ্যাঙ” এক ধরণের “Leaf Game” খেলতো। এই খেলার নাম ছিল “Yezi Gexi”। যদিও এই খেলাটি আজকের তাস খেলার মত ছিলো না। পাশা খেলার মত ছিল। পরবর্তীতে নিয়ম পালটে তাসের নতুন রূপ দেয়া হয়। ডাইসের বদলে শুধু কাঠের ব্লকে তাসের ছবি এঁকে খেলা শুরু হয়। তবে এই কার্ডে কোন নাম্বার-টাম্বার ছিল না। কিছু প্রতীক ব্যবহৃত হত। টাকা দিয়ে কার্ড খেলা হত বলে একে “Money Card” বলা হত। মোট ৩৮টি কার্ড ছিল চার সেটের।
এরপরে আরব ও পার্সীয়ানদের মাধ্যমে তাসে পরিবর্তন আসে। ৪৮টি কার্ড ছিল চার সেটের। প্রতি সেটে ১২টি কার্ড । প্রথম দুটি কার্ডে রাজাদের ছবি থাকতো। এদেরকে বলা হত “Court Card“। আর বাকি দশটিতে সাধারণত ডট বা ডাইসের চিহ্ন থাকতো।
পরবর্তীতে চার সেটে ব্যবহৃত হয় Coins, Clubs, Jugs, এবং Swords। এই নতুন রূপায়িত তাসই মিশরের “মামলুক“-এর আদি ভার্সন। প্রায় ৬০০ বছর আগে তাস খেলার অনুপ্রবেশ হয় ইউরোপে। খেলাটির নাম ছিল “Moorish Game”। এই মুরিস খেলাটি মিশরীয় বণিকদের হাত ধরে ইউরোপে প্রবেশ করে। পরবর্তীতে ইউরোপীয় ধারায় পরিবর্তিত হয়ে আজকের তাস খেলার জন্ম হয়।
মজার একটি ব্যাপার হলো, তাসের উপরে চলমান সমাজের একটা ছাপ থাকতো। যে জন্য দেখা যেত একেক সমাজে তাসের গঠন, রঙ, ক্যারেক্টার একেক রকমের। মোদ্দা ব্যাপার হলো, মানুষ তাসের মধ্যে তাদের স্ব-স্ব-সাংস্কৃতির ছাপ রাখতো। ইউরোপের বিভিন্ন সমাজের তাসের ডেকেও চার ধরণের তাস ছিল। এগুলো হলো- Chalice(পাত্র), Sword(তরবারি), Money(অর্থ) এবং Baton(আইন/হাতিয়ার)। জার্মানিক সমাজে আবার ছিল Hearts(হরতন), Acorns(ওক গাছের ফল), Bells(ঘন্টি) এবং Leaves(পাতা)। অন্যদিকে ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডে ছিল Hearts, Spades, Diamonds এবং Clubs, যেগুলো এখনও প্রচলিত আছে। এইগুলারে “ফ্রেঞ্চ প্লেয়িং কার্ড” বলে।
তাসের প্রতীক ও হিসাব-নিকাশ
তাসের ইতিহাস জানা গেল, এবার তাসের সংখ্যাগুলো নিয়ে বলা যাক। আমরা জানি এক প্যাকেটে মোট তাসের সংখ্যা ৫২টি সাথে ২/৩টি জোকার। মোট ৪টি সেট থাকে ১৩টি করে। ইস্কাপন(Spades ♠), হরতন(Hearts ♥), রইতন (Diamonds ♦) এবং চিরতন (Clubs ♣)। কালো ও লাল এই দুটি রঙের হয় সাধারণত। তবে অনেক দেশে চারটি আলাদা রঙেরও হয়ে থাকে।
⇒ ১। প্রথমে শুরু করি দুই রঙের হিসাব থেকে। এটি দিন ও রাত্রির প্রতীক।
⇒ ২। চারটি সেট হচ্ছে চারটি ঋতুর প্রতীক। ইউরোপে ৪টি ঋতু।
⇒ ৩। চার ধরনের তাস যেগুলো সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর প্রতীক। যেমন-
- (ক) ইস্কাপন(Spades ♠): এটি সৈন্যবাহিনীর প্রতীক।
- (খ) হরতন(Hearts ♥): এটি পাদ্রী বা ধর্ম যাজকদের প্রতীক। আবার অন্যভাবে বললে এটি রাজা-বাদশাদেরও প্রতীক।
- (গ) রইতন (Diamonds ♦): এটি সমাজের ব্যবসায়ীদের প্রতীক। আবার ভিন্নার্থে এটি সমাজের এলিট শ্রেণীর প্রতীক।
- (ঘ) চিরতন (Clubs ♣): ক্লাব শব্দের অর্থ হচ্ছে “মুগুর”। কৃষকেরা ব্যবহার করে। বোঝাই যাচ্ছে এটি কৃষকের তথা শ্রমিকদের প্রতীক।
⇒ ৪। প্রতিটি সেটে মোট ১৩টি কার্ড থাকে(যেমনঃ স্পেডের ১৩টি, হার্টেসের ১৩টি…)। তখন চন্দ্র বৎসরের প্রচলন ছিল। চাঁদের ১৩টি ফেইজ বা দশা। কাজেই তাসে এই হিসাবটি যুক্ত হয়েছে।
⇒ ৫। মোট ৫২টি তাস হচ্ছে ৫২ সপ্তাহের প্রতীক। এক বছরের হিসাব।
⇒ ৬। তাসের সেট কিভাবে সাজানো থাকে? Ace – 2- 3 – 4 – 5 – 6 – 7 – 8 – 9 – 10 – Jack – Queen – King. A থেকে King পর্যন্ত প্রতিটি তাসের ক্রম সংখ্যা যোগ করলে পাইঃ ১+২+৩+৪+৫+৬+৭+৮+৯+১০+১১+১২+১৩ = ৯১। তাহলে চার সেট তাসের মোট যোগফল ৯১+৯১+৯১+৯১ = ৩৬৪। আর জোকারের মান হচ্ছে ১, যেটি ডেকের সাথে দেয়া হয়। তাহলে মোট গিয়ে দাঁড়াল ৩৬৫। ৩৬৫ দিনে এক বছর আমরা সবাই জানি।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
সাহেব, বিবি, গোলামের পরিচয়
তাসের গায়ে যেসকল মুখায়বের ছবি দেখতে পাওয়া যায়, সেগুলো কিন্তু এমনি এমনিই দেয়া হয় নি। ইতিহাসের বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছবি এগুলো। জেনে রীতিমতো বিস্মিত হতে হয়! চলুন জেনে নেয়া যাক এদের নাম-পরিচয় —
♠ কিং অফ স্পেডসঃ বিবলিক্যাল বিখ্যাত রাজা ডেভিড যিনি ছিলেন দৈত্যাকৃতি ফিলিস্তাইন যোদ্ধা গোলিয়াথের হত্যাকারী। যাকে মুসলিমরা চিনে দাউদ নবী হিসেবে।
♥ কিং অফ হার্টসঃ ইনি হচ্ছেন ফ্র্যাংকিশ রাজা চার্লস দি গ্রেইট (শার্লামেইন)। রোমান সাম্রাজ্য পতনের পর ৮০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ইনিই প্রথম পশ্চিম ইউরোপের রাজা হোন। তাকে দ্যা ফাদার অফ ইউরোপ নামেও ডাকা হয়।
♦ কিং অফ ডায়মন্ডসঃ ইনি হচ্ছেন জুলিয়াস সিজার। রোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্রাট। লক্ষ্য করে দেখুন হার্টসের কিং এবং ডায়মন্ডের কিং দু’জনেরই পেছনে তরবারি এবং কুড়োল উদ্যোত অবস্থায় আছে, যেন কেউ পেছন থেকে তাদেরকে হত্যা করতে যাচ্ছে! এবং কার্ড দুটো লাল রঙের। এজন্য এই দুই রাজাকে সুইসাইডাল কিংস নামে ডাকা হয়।
♣ কিং অফ ক্লাবসঃ ইনি হচ্ছে জগৎবিখ্যাত আলেক্সান্ডার দি গ্রেট। যিনি সারাবিশ্ব জয় করেছিলেন।
♠ কুইন অফ স্পেডসঃ ইনি হচ্ছেন বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত ঐতিহাসিক গল্পের চরিত্র “জুডিথ“। কথিত আছে, এ্যাসেরিয়ান সেনাপতি যখন ইসরায়েল আক্রমনের করতে যাচ্ছে তখন জুডিথ শত্রু শিবিরে গিয়ে কৌশলে জেনারেলের সাথে সুসম্পর্ক করে এবং সুযোগে তাকে হত্যা করে ইসরায়েলকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে।
♥ কুইন অফ হার্টসঃ ইনি হচ্ছেন আব্রাহামের(ইব্রাহিম) ছেলে জ্যাকবের(ইয়াকুব) স্ত্রী “র্যাচেল/রাহেল“।
♦ কুইন অফ ডায়মন্ডসঃ ইনি হচ্ছেন গ্রীক দেবী “এ্যাথেনা“। প্রাচীন গ্রিক ধর্ম ও পুরাণে জ্ঞান, সাহস, অণুপ্রেরণা, সভ্যতা, আইন ও ন্যায়বিচার, যুদ্ধকৌশল, গণিত, শক্তি, কৌশল, চারু ও কারুশিল্প এবং দক্ষতার দেবী ছিলেন। কথিত ট্রয় যুদ্ধে তিনি গ্রীকদের পক্ষে ছিলেন!
♣ কুইন অফ ক্লাবসঃ ইনার নাম হচ্ছে Argine যেটা আসলে Regina শব্দের এনাগ্রাম। ল্যাটিন ভাষায় রেজিনা মানে “কুইন”। এজন্য কেউ কেউ মনে করেন Regina হচ্ছে বৃটেনের রানী প্রথম এলিজাবেথ। তবে যেহেতু এটি ফ্রেঞ্চ কার্ড ভার্সান, কাজেই অনেকেই মনে করেন Regina বলতে Jeanne -কেই বলা হয়েছে। ইনি হচ্ছেন পরাধীন ফ্রান্সের মুক্তিদাত্রী বীরকন্যা এবং রূপকথাতুল্য এক নেত্রী জোয়ান অফ আর্ক।
♠ জ্যাক অফ স্পেডসঃ ইনি হচ্ছেন কিং চার্লসের(শার্লামেইন) নাইট “ওজিয়ার দি ডেইন“।
♥ জ্যাক অফ হার্টসঃ ইনি হচ্ছেন লা হিরে যিনি ফ্রান্সের সামরিক বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন। “হান্ড্রেড ইয়ারস ওয়্যার” যুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন।
♦ জ্যাক অফ ডায়মন্ডসঃ ইনি আর কেউ নন, ট্রয়ের বীর যোদ্ধা হেক্টর। যিনি গ্রীসের আরেক বীর একিলিসের সাথে যুদ্ধ করে নিহত হয়েছেন।
♣ জ্যাক অফ ক্লাবসঃ ইনি হলেন রাউন্ড টেবিলের বিখ্যাত নাইট, স্যার ল্যান্স লট। তাকে মনে করা হত কিং আর্থারের প্রিয় সহচারী।
তাসের আরও অনেক রকমভেদ আছে। কাজেই সব ক্যারেক্টার একই থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। আর এইসব ক্যারেক্টারগুলো একেবারেই যে সত্যি, সেটারও ঐতিহাসিক কোন বিশ্বস্ত দলিল নেই। হিসাবগুলো মজার এবং চিন্তা করতেও রহস্যময় লাগে যে, এতসবকিছু একসাথে হাতের কাছেই লুকিয়ে আছে ভেবে! তাসের ইতিহাস, হিসাবনিকাশ এবং এর পেছনে যে চমৎকার আইডিয়াগুলো কাজ করেছে, সেগুলো এক কথায় অসাধারণ!
তথ্যসূত্রঃ