১.১
দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ইংরেজের কামানের সামনে পলকা বাঁশের কেল্লা নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন আমাদের বাংলার তিতুমীর। তিনি ছিলেন একটি আস্ত মৌলবাদী, শুধু ইংরেজ নয় সকল কাফিরের বিরুদ্ধেই তার গুষ্টি কিলাই মনোভাব ছিল। তবে ইংরেজদের সাথে ঘাড় ত্যাড়ামি করার জন্য তাকে হাই ফাইভ দেয়া যায়।
আজকের লেখাটি ১৮৭০ সালে প্রকাশিত “The Calcutta review, Volume 51” গ্রন্থের “The Wahhabis In India” পরিচ্ছেদ অবলম্বনে।
১.২
বারাসাতের সৈয়দ আহমেদের অনুসারীদের মধ্যে চাঁদপুরের [আমাদের চাঁদপুর নয়, বর্তমান পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরগনার চাঁদপুর ] এক লোক নিসার আলী ওরফে তিতুমীর এর নাম উল্লেখযোগ্য। তার ছিল বনেদী বংশ, বিবাহসূত্রে মুনশী আমীর বলে এক ধনকুবেরের সাথে তার সম্পর্ক ছিল। সে ছিল খুবই একরোখা আর বদ স্বভাবের। ১৮১৫ সালে কোলকাতায় সে পেশাদার কুস্তিগীর ছিল। পরে সে নদেয়ার কিছু জমিদারের লেঠেল হিসেবে কাজ শুরু করে, ওখানে কিছু ঝামেলা পাকিয়ে সে কিছুদিন জেলের ভাতও খায়। ছাড়া পাবার পর কোনভাবে তার সাথে দিল্লীর রাজপরিবারের এক লোকের সাথে দেখা হয়, তারা দুজনেই মক্কায় যায় হজ্ব করতে। ওইখানে তার সৈয়দ আহমেদের সাথে দেখা হয়, আর তার অনুসারী হয় তিতুমীর।
ভারতে ১৮২৭ সালে ফিরে সে হায়দারপুর গ্রামে ঘাঁটি গেড়ে ওয়াহাবী ধর্মমত প্রচার করতে থাকে। ঠিক আহমেদ সাহেবের মত সে পীরবাবাজীদের পিছনে লাগে, মাজারব্যবস্থার প্রতিবাদ করে আর মৃত ব্যক্তির নামে সদকা দেওয়া গর্হিত অপরাধ গণ্য করে। তার অনুসারীদের সে দাড়ি রাখতে আদেশ দেয়, আর যেন লোকাল কাফেরদের থেকে তাদের আলাদা করে চেনা যায় সেজন্যে অদ্ভুত কায়দায় জামা পরার নির্দেশ দেয়। কাফিরদের সাথে সামাজিক মিলামিশা একদম হারাম করা হয়। দেখতে দেখতে কয়বছরের মধ্যে সে তিন চারশ লোকের আধ্যাত্মিক গুরু হয়ে বসে, ইছামতির তীরে নারিকেলবাড়িয়ার আঠেরো বিশ মাইলব্যাপী তার প্রভাব দেখা যায়।
এই অগ্রগতি অতি সন্দেহের চোখে দেখে চাষার দল যারা হানাফী সম্প্রদায়ভুক্ত আর হিন্দু জমিদাররাও। চাষারা ক্ষিপ্ত ছিল তাদের ধর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ করার জন্য, তারা গিয়ে জমিদারদের কাছে নালিশ ঠুকে দিল। জমিদাররাও তাদের উপর বিরক্ত ছিলেন ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার জন্য, তাই তারা ব্যবস্থা নেওয়ার পাঁয়তারা করতে থাকলেন।
১৮৩১ সালে কিষেন রায় বলে এক জমিদার ঘোঁট পাকানো আরম্ভ করেন। তিনি তার লোকেদের মধ্যে ওয়াহাবীদের জন্য ২-৮ রুপী ট্যাক্স বসান, তার উপর দাড়িওলা লোক দেখলেই ধরে ধরে ফাইন করা হতে থাকে। সরফরাজপুরে এই ট্যাক্স আদায়ের সময় তিতুমীরের অনুসারীরা হাউকাউ লাগিয়ে দেয়। জমিদার এই খবর পেয়ে তার দুতিনশ লোক নিয়ে গ্রামে ঢোকেন আর শুরু হয় রায়ট। ব্যাপক লুটপাট চলে, একটি মসজিদ জ্বালিয়ে দেয়া হয়। বসিরহাটের দারোগা এসে কৈফিয়ত তলব করলে জমিদারের লোক আর তিতুমীরের লোক একে অপরকে রায়টের জন্য দোষারোপ করে।
থানার মুহুরী তখন অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট জারি করলে জমিদার কিষেন গা ঢাকা দেয়, আর কয়দিন পরে বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়ে বলে যে রায়টের সময় সে গ্রামেই ছিলনা, সে ছিল কোলকাতা। বসিরহাটের দারোগার সোর্স অবশ্য অন্যকথা বলছিল। যাইহোক, রায় বেরুলো যে তিতুমীরের অনুসারীরা (মামলার বাদীও বটে) নিজেরাই নিজেদের গ্রাম লুট করেছে আর নিজেদের মসজিদ জ্বালিয়েছে জমিদারকে ফাঁসানোর জন্য।
এইবার তিতুমীরের লোকেদের পালানোর পালা। তারা দারোগাকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ করলো, কিন্তু কেউ তাদের পাত্তা দেয়নি। দিনের পর দিন মামলা টেনে নেয়া হল তাদের ছাড়াই, শেষমেষ মামলাই তুলে নেয়া হয়। ততদিনে ওয়াহাবীরা দারোগার উপর চরম চটা, মাসকয় পরে যখন তাদের হাতে দারোগা পড়ে তখন তার কল্লা তারা আনন্দের সাথে নামিয়ে দেয়।
তিতুমীরের লোকেরা গাঁয়ে ফিরে এলে তাদের ফের উত্যক্ত করা শুরু করে কিষেন। পালিয়ে থাকার সময় খাজনা দেয়নি বলে বকেয়া টাকার জন্য সে অস্থির করে তোলে তাদের। তিতুমীর ঠিক করলো এইবার জিহাদ স্টার্ট করার সময় হয়েছে। মিসকিন শা বলে এক ফকিরবাবাজীর সাথে তার দোস্তি হয়, মিসকিনের কিছু ভক্ত ছিল। এদের সহ নিজের অনুসারীদের ২৩শে অক্টোবরের দিকে নারিকেলবাড়িয়ায় জমায়েত করেন তিতুমীর, সবাই ছিল পেটি অস্ত্রধারী।
গ্রামের চারপাশে পোক্ত বাঁশের খুঁটি বসানো হল। খবর পেয়ে পূর্ণিয়ার জমিদার ভাবনায় পড়লেন, জানতেন তাদের উপরেই প্রথম বাঁশ যাবে। হলও তাই। ৬ই নভেম্বরের দিকে শপাঁচেক ধর্মান্ধ লাঠিসোটা নিয়ে পূর্ণিয়া আক্রমনে চললো। একটি ব্রাহ্মনকে পিটিয়ে মারা হল, দুইটি গরু ছিনিয়ে নিয়ে হিন্দুদের মন্দিরে জবাই করে গরুর রক্তে মন্দির ভাসিয়ে দেয়া হল। দেবতার মূর্তির গায়ে গরুর মাংস ঝুলিয়ে রাখা হল।
দোকানপাটে পাইকারি লুটপাট চললো, স্মিথ নামে একটি নিরীহ খ্রিস্টানকে অকারনে চড়থাপ্পড় মারা হল, হানাফি মুসলমানদের অপমান করা হল, আর মহান কোম্পানীর শাসনকে খোলাখুলি হুমকি দেয়া হল। বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং পুরো জিনিসটা ঠান্ডা মাথায় প্ল্যান করা মনে হয়। তারা মিলিটারিদের মত সুশৃঙ্খল বজ্জাতি করছিল কোন এক গোলাম মাসুমের নেতৃত্বে।
পরেরদিন ভোরে তারা নদেয়ার লাউঘাট গ্রামে ঢোকে। প্রচুর ওয়াহাবীর বাস সেখানে। সেখানেও তারা মন্দির গরুর রক্তে ভাসিয়ে দেবার ধান্দা করার সময় স্থানীয় হিন্দুর দল বাঁধা দেয়। শুরু হয় রায়ট। গ্রামের মাতবর তার ভাইসহ খুন হয়, নিহত হয় আরো অনেক গ্রামবাসী। এরপরে তারা নারিকেলবাড়িয়ার হেডকোয়ার্টারে ফিরে যায়। পরের কয়দিন কাটে রামচাঁদপুর আর হুগলীর গ্রামে তান্ডব করে, হিন্দুদের জোর করে ধর্মান্তরিত করে। ১৪ তারিখে তারা শেরপুরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলমান রইস আদমীর ঘর লুট করে, আর তার সুন্দরী কন্যাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।
এতদিন পর্যন্ত সরকার মহাজন এদিকে বেশি নজর দেয়নি। নদেয়া আর বারাসাত ভর্তি ছিল নীলকুঠি, অদূরেই বাগুন্দীতে ছিল লবণ এজেন্সী। তিতুমীরের নেতৃত্বে লোক সংঘটিত হবার খবর ম্যাজিস্ট্রেট আগেই পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি দুইটা বরকন্দাজ পাঠিয়েই ভেবেছিলেন ব্যাপার মিটে যাবে। পরে লুটপাট খুনাখুনির খবর পেয়ে তিনটে জমাদারের সাথে তিরিশ বরকন্দাজ পাঠানো হল বসিরহাটের দারোগার সাহায্যের জন্য।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
নীলকর পিরনসাহেব কোলকাতায় কমপ্লেন করে চিঠি লেখেন নারিকেলবাড়িয়ার তৎপরতা নিয়ে বিতং লিখে, তখন উপরমহল আরো নড়েচড়ে বসলো। বাগুন্দীর যশোর লবণ এজেন্সীতে মিলিশিয়া পাঠানো হল, আলেক্সান্ডার সাহেবের নেতৃত্বে তারা বিদ্রোহী দমনে এগিয়ে গেল। দারোগা আর বরকন্দাজ নিয়ে তিনি রেডি। একটি হাবিলদার, একটি জমাদার আর বিশ সেপাই নিয়ে তিনি ১৪ তারিখে রওনা দিলেন। পথে যোগ দিল দারোগা। পাইক বরকন্দাজ জমাদার চোকিদার মিলিয়ে প্রায় ১২০ জন লোক। শত্রুপক্ষ ছিল প্রায় পাঁচছয়শ লোক, নানাবিধ অস্ত্রধারী।
তারা নারিকেলবাড়িয়া গ্রামের সামনে উন্মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল, সবার সামনে ঘোড়ার পিঠে গোলাম মাসুম। আলেক্সান্ডার ঠিক এইরকম আশা করেননি, তিনি ভেবেছিলেন মিলিশিয়া আসার খবরে ওয়াহাবীর দল সিল্কের লুঙ্গিতে পেশাব করে দেবে। ঐ ভেবে তিনি বুদ্ধিমানের মতন পাইকদের বন্দুকে গুলি পর্যন্ত ভরেননি, তিনি ভেবেছিলেন রক্তপাত ছাড়াই যন্ত্রনা শেষ হবে।
তিতুমীরের দল ঢিল ও অন্যান্য ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপ শুরু করলো। তারপর নাঙ্গা তলোয়ার হাতে গোলাম মাসুমের নেতৃত্বে এগিয়ে গেল ওয়াহাবীরা। কোলকাতা মিলিশিয়ার জমাদার ও দশ বরকন্দাজের মুন্ডু কাটা পড়লো। বসিরহাটের দারোগা, কালিঙ্গা থানার জমাদার আর কিছু পেয়াদাকে গুরুতর আহত অবস্থায় বন্দী করা হল। দারোগার সাথে তাদের পুরান হিসেব বাকি ছিল, তাকে খুঁচিয়ে হত্যা করা হল। আলেক্সান্ডার পালিয়ে বাঁচলেন, একটি নৌকায় করে তিনি যশোর লবণ এজেন্সীতে ফিরে এলেন।
আলেক্সান্ডারের পরাজয়ের খবর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়েছিল কিন্তু ভাসা ভাসা। তিনি ঠিক ধরতে পারিছিলেননা বিদ্রোহের ব্যাপারটা কতটুকু সিরিয়াস। তাকে মিথ্যে সংবাদ দেয়া হল যে বিদ্রোহীরা সংখ্যায় বেশি না, তাদের অস্ত্রপাতিও কিছু নেই। ম্যাজিস্ট্রেট তার হাতিঘোড়া নিয়ে মাইল চারেক দূরে নারিকেলবাড়িয়ার পথ ধরলেন। গিয়ে দেখা গেল মাইলপোস্টের কিছু পাইক ছাড়া আস্ত গ্রাম বেবাক ফাঁকা, মাছিটিও নেই। ফিরে যাওয়ার পথ ধরতেই দেখেন এক হাজার সশস্ত্র অনুসারী পেছনে নিয়ে তেড়ে আসছে তিতুমীর।
ফৌজদারি আদালতের নাজির আর দুই বরকন্দাজ পিছিয়ে পড়ে মারা পড়লো, বাকিরা পড়িমরি করে ইছামতীতে নৌকা যোগাড় করে পালাতে থাকল। নদীর পাড় ঘেঁষে তিতুমীরের দল তাদের ফলো করছিল, আলেক্সান্ডারকে হারিয়ে তাদের ধারনা হয়েছিল আল্লা স্বয়ং তাদের প্রতি চরম ইম্প্রেসড। অসীমসাহসী আল্লার বান্দারা ঝাঁপ দিয়ে শত্রুর নৌকায় উঠে যেতে থাকল। পাইক বরকন্দাজের দল লাফিয়ে পানিতে পড়ে নদীর অপর পাড়ে ছুট দিল। তিতুমীরের হাতে পড়লো একটি হাতি, একটি পানসি, কয়েকটা বজরা আর কিছু ছোট নৌকা।
এইবার তারা হামলা করলো হুগলী কুঠি। ম্যানেজার আর তার পরিবারকে বাঁশের কেল্লায় নেওয়া হল, ম্যানেজার কানে ধরে বললেন ইংরেজ নয় তিতুমীরই দেশের রাজা। তিতুমীরের হয়ে নীলচাষ করার দৃঢ় শপথ ব্যক্ত করেন তিনি। খুশি হয়ে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়, আর ঘাটে ঘাটে খবর পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করা হয় যেন দেশের রাজা তিতুমীরকে সবাই মান্য করে চলে।
ইংরেজ ঘুমিয়ে ছিলনা। ১৬ই মার্চ আলেক্সান্ডার সাহেব কোলকাতা পৌঁছান, আর পরাজয়ের রিপোর্ট জমা দেন। কোম্পানী সর্বশক্তি নিয়ে প্রস্তুত হয়। ঘোড়াচালিত কামানবাহী দশম রেজিমেন্ট কিছু সৈন্যসহ বারাসাতে আলেক্সান্ডারের সাথে যোগ দেয়। গন্তব্য নারিকেলবাড়িয়া। ওখানে পৌঁছে দেখা যায় উন্মুক্ত মাঠে সাদা সৈন্যের লাশ সামনে ঝুলিয়ে ওয়াহাবীরা প্রস্তুত। তাদের দিক লক্ষ্য করে কামান দাগা হয়। তরবারি আর পাকা বাঁশের লাঠি সম্বল করে ওয়াহাবীরা ফাইট দিতে থাকে। তবে বেশিক্ষন নয়। ষাট সত্তুরজন মারা যায়, বাঁশের কেল্লার পতন ঘটে।
ভেতরে প্রচুর বন্দী উদ্ধার করা হয়, আর পাওয়া যায় প্রচুর লুটের মাল। তিতুমীরের সেনাপতি গোলাম মাসুমকে বন্দী করা হয় ও পরে আলীপুরে ফাঁসীতে ঝুলানো হয়। কেল্লার নবাব তিতুমীর ক্রসফায়ারে মারা যায়।
আরও পড়ুনঃ চিনসুরা