নিকোলা টেসলা – তাঁকে নিয়ে নানারকম মিথ প্রচলিত আছে। একটা জনপ্রিয় মিথ এরকম —
টেসলার একটা ভূমিকম্প মেশিন ছিল। সেই মেশিন চালু করে আশেপাশের এলাকায় ছোটখাটো ভূমিকম্প ঘটিয়ে দিতে পারতেন তিনি। আসলে সেই ভূমিকম্প মেশিনটি একটি হাই ফ্রিকোয়ানেসি অসিলেটর ছাড়া আর কিছুই নয়।
মার্ক টোয়েন ছিলেন বিখ্যাত লেখক। সেই সাথে টেসলার ভালো বন্ধু। টেসলা তাকে একদিন তার ল্যাবে দাওয়াত দিলেন। বললেন, মেশিনটার উপর দাঁড়াতে। টোয়েন প্লাটফর্মে দাঁড়াতেই টেসলা মেশিন চালু করে দিলেন। টোয়েনের ছিলো পেটে সমস্যা। তার পেটে পাক দিয়ে উঠলো। কোন রকম দুর্ঘটনা ঘটার আগেই তিনি রেস্টরুমের দিকে দৌড় দিলেন। বলা বাহুল্য, টোয়েনের পেটে সমস্যার কথা টেসলা ভালোভাবেই জানতেন। বন্ধুর সাথে তাই তার এই সামান্য রসিকতা। ইংরেজিতে যাকে বলে প্র্যাকটিক্যাল জোক।
টেসলার এইসব নানারকম পাগলামি ছিল। লোকটা বিজ্ঞান বুঝতেন, কিন্তু বাণিজ্য বুঝতেন না। তার অনেক দুর্দান্ত আইডিয়াই তাই আর বাস্তবে রূপ নিত না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যেমন নিকোলা টেসলা রাডারের আইডিয়া নিয়ে ইউএস নেভি’র কাছে যান। সেই সময়য় ইউএস নেভি’র R&D ডিপার্টমেন্টের প্রধান ছিলেন এডিসন। এডিসন ইউএস নেভি-কে বোঝান যে, যুদ্ধক্ষেত্রে এই রাডারের কোন প্র্যাকটিক্যাল এ্যাপ্লিকেশন নেই। কাজেই, রাডারের আইডিয়া বাদ। রাডারের সাথে আমাদের পরিচিত হতে অপেক্ষা করতে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত। এডিসনের সাথে অবশ্য টেসলার এসি-ডিসি যুদ্ধের সময় থেকেই খানিকটা গোলমাল চলছিল।
১৮৯৮ সালে টেসলার ল্যাবে রহস্যজনকভাবে আগুন লাগে। নিকোলা টেসলা সেসময় রেডিও ওয়েভ নিয়ে কাজ করছিলেন। তার সমস্ত কাজ পুড়ে ছাই হয়। সেকালের হিসেবে, টেসলার প্রায় এক মিলিয়ন ডলারের মত ক্ষতি হয়। মনের দুঃখে টেসলা নিউইয়র্ক ছেড়ে কলোরাডো চলে যান। অনেকে বলেন, এই আগুন লাগার পেছনে এডিসনের হাত থাকতে পারে।
আরেকটা ঘটনার কথা বলি। জেপি মরগ্যান ছিলেন সেই সময়কার নামকরা বিনিয়োগকারী। টেসলা যখন ট্রান্স-আটলান্টিক রেডিও নিয়ে কাজ করছিলেন, তখন মরগ্যানকে একটা আইডিয়া দেন। এমন একটা টেকনোলজি যা দিয়ে তার ছাড়াই প্যাকেট ডাটা পাঠানো যাবে, আর মুহূর্তের মধ্যেই তা রিসিভ-ও করা যাবে। তিনি সম্ভবত আজকের SMS টেকনোলজির কথা ভাবছিলেন।
‘ওয়ার্ডেন ক্লিফ’ নামে মরগ্যানের আরেকটা প্রজেক্টের প্রধান ছিলেন টেসলা। মরগ্যানের লক্ষ ছিল, গোটা এমন একটি টাওয়ার তৈরি করা যা দিয়ে সারা পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করা যাবে। অবশ্যই তার ছাড়া। টেসলার লক্ষ ছিল আরেকটু সুদূরপ্রসারী। তিনি চাইতেন পুরো পৃথিবীর মানুষ ফ্রি এনার্জি পাক। আলো, বাতাস আর পানি যেমন আমরা বিনা মূল্যে পাই, এনার্জিও আমাদের বিনা মূল্যে পাওয়া উচিত। ফ্রি এনার্জি ছিল তার সারা জীবনের স্বপ্ন। তার যুক্তি ছিল এই যে—ডাটা বা তথ্য যদি তার ছাড়াই দূর দূরান্তে পাঠানো যায়, তবে এনার্জি কেন যাবে না?
টেসলার এই বিশ্বাস তৈরি হয় আগে করা কিছু এক্সপেরিমেন্ট থেকে। নিউইয়র্কে থাকতেই টেসলা তার ছাড়াই বাতি জ্বালাতে পারতেন। এক পরীক্ষায় তিনি বাতিগুলোকে দুটি গ্রুপে ভাগ করা হল। দেখা গেলো, কোন একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে এক সেট বাতি জ্বলছে। আরেক ফ্রিকোয়েন্সিতে আরেক সেট।
কলোরাডোতে করা এক পরীক্ষায় টেসলা তার ছাড়াই বহু মাইল দূরের এক বাতি জ্বালাতে সমর্থ হন।
এইসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা অবশ্য তার নিজের মনেই এক ধরনের ভয় ঢুকিয়ে দেয়।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
শূন্যস্থানের মধ্য দিয়ে যদি এনার্জি পাঠানো যায়, তাহলে এর ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড নিয়ন্ত্রণ করে আরো অনেক কিছুই করা সম্ভব। সবচেয়ে বড় ভয় হচ্ছে এই যে এই ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে পৃথিবীর আবহাওয়া বদলে দেয়া সম্ভব। টেসলা যখন প্রথম এই কথা বলেছিলেন, তখন অনেকেই হেসেছিল। কিন্তু পরবর্তী গবেষণা বলে, এটা সম্ভব। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড বদলে কোথাও বন্যা, ঘূর্নিঝড়, জলোচ্ছ্বাস বা সুনামি ঘটানো অসম্ভব কিছু না।
ভবিষ্যতের যুদ্ধ তো আর অস্ত্র আর গোলাবারুদ দিয়ে হবে না। এই যুদ্ধ হবে জিওফিজিক্যাল ওয়ার। এক দেশ আরেক দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটানোর চেষ্টা করবে। ১৯৭৬ সালে যদিও আমেরিকা কয়েকটি দেশের সাথে এক চুক্তি স্বাক্ষর করছে কোন রকম জিওফিজিক্যাল ওয়ারে না জড়ানোর। কিন্তু এটা কয়দিন থাকে কে জানে।
মন্দ লোকের হাতে এই ফ্রি এনার্জি পড়লে কী হবে ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।
ঝামেলার এখানেই শেষ নয়। আমাদের পৃথিবীকে ঘিরে এক বিরাট গহবর রয়েছে। এই গহবরের নাম শ্যুমান ক্যাভিটি। শ্যুমান গহবরের ফ্রিকোয়েন্সি হচ্ছে ৬-৮ হার্জ। মানব মস্তিষ্কের আলফা ওয়েভের ফ্রিকোয়ান্সিও হচ্ছে ৬-৮ হার্জ। কাজেই, এই ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ন্ত্রণ করে আমরা মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড নিয়ন্ত্রণ করা গেলে মানুষের সুখ-দুঃখ, আবেগ-অনুভূতি সবই নিয়ন্ত্রণযোগ্য।
ফ্রি এনার্জি বা আবহাওয়া বদলে দেবার গবেষণাগুলোর তাই আপাতদৃষ্টিতে সেইখানেই ইতি ঘটেছে।
তাই বলে টেসলার লিগ্যাসী যে শেষ হয়ে গেছে এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। ১৯৩৪ সালে টেসলা এক ভয়ংকর পার্টিকেল বীম ওয়েপন আবিষ্কারের ঘোষণা দেন। এই বীমের নাম ডেথ রে। তিনি বলেন, এই অস্ত্র সমস্ত যুদ্ধের অবসান ঘটাবে। তিনি এর কাগজপত্র ব্রিটেন, আমেরিকা কানাডা ও রাশিয়া সরকারের কাছে পাঠান। কিন্তু কারো কাছেই তিনি পূর্ণাঙ্গ ডিজাইনটি পাঠাননি। সবার কাছেই টুকরো টুকরো করে পাঠিয়েছেন। জিগস পাজলের মত।
এর বহু বছর পর ১৯৭০ সালের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজস্ব পার্টিকেল বীম ওয়েপন এর স্কিমেটিক উন্মুক্ত করে।দেখা যায়, সেই স্কিমেটিক আর টেসলার স্কিমেটিক প্রায় হুবহু মিলে গেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আমেরিকা বলেকয়ে ঘোষণা না দিলেও নক্ষত্রযুদ্ধ করার মত ওয়েপন আমেরিকার কাছেও আছে। আর তা ডেভেলপ করা হয়েছে টেসলার ডিজাইনের ভিত্তিতেই।
টেসলার মৃত্যুর পর তার ল্যাবের সবকিছু আমেরিকান সরকার জব্দ করে। দশ বছর পর তা টেসলার জন্মস্থান যুগোস্লাভিয়ায় ফেরত দেয়া হয়। অবশ্য এর মধ্যেই কর্তৃপক্ষ সব কিছুর ছবি তুলে রেখেছে। অনেক কন্সপিরেসি থিওরিস্ট মনে করেন, টেসলার কাজের মধ্যে ফ্রি এনার্জি’র মূলনীতিগুলো লুকিয়ে আছে। এনার্জি কার্টেলরা কখনোই চাইবে না এগুলো প্রকাশিত হয়ে পড়ুক। আর আমেরিকান সরকার যেহেতু এই কার্টেলদের স্বার্থ রক্ষা করে চলে, তারা সবরকম চেষ্টাই করবে এগুলোকে ধামাচাপা দিয়ে রাখার। কে না জানে, অস্ত্র আর মাদক ব্যবসার মতই এনার্জি বিজনেস হচ্ছে সবচেয়ে লাভজনক সেক্টরগুলোর একটি।
১৯৯০ সালে HAARP (The High Frequency Active Auroral Research Program) নামে একটি প্রজেক্ট শুরু করে ইউএস সরকার। এই প্রজেক্টের মূল লক্ষ হচ্ছে আয়নোস্ফিয়ার নিয়ে গবেষণা করা। অনেকে অবশ্য বলে থাকেন, এর লং টার্ম গোল হচ্ছে, আয়নোস্ফিয়ারকে নিয়ন্ত্রণ করে পৃথিবীর আবহাওয়া বদলে দেয়া যায় কিনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটানো যায় কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা। এর পেছনেও টনিক হিসেবে কাজ করছে টেসলার কিছু পুরনো গবেষণা।
টেসলা ঠিক তার যুগের বিজ্ঞানী ছিলেন না। তিনি ছিলেন যুগের চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে থাকা বিজ্ঞানী। তার লিগ্যাসিগুলো তাই আমাদের কখনো স্বপ্ন দেখায় নতুন দিনের, কখনো বা ভয় দেখায় মহাদুর্যোগের।