একজন সুস্থ্য-সবল মানুষের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশ শক্তিশালী। আর এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় আত্মবিশ্বাসের একটা বিশাল ভূমিকা আছে! সাধারণ কোনো অসুখ-বিসুখ এমনিতেই কয়েকদিনেই সেরে যায়। এর সাথে আমাদের আত্মবিশ্বাসও থাকে “এ আর এমনকি অসুখ!”। কিন্তু যদি মানসিকভাবে কেউ দূর্বল থাকে, তাহলে হয়তো সাধারণ কোনো অসুখ যেটা এমনিতেই সেরে যেত, সেটাই বিশাল এক সমস্যায় পরিণত হতে পারে!
যেমন ধরুন, আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত একটা বিশ্বাস বা ধরণা হচ্ছে অমাবস্যা বা পূর্ণিমার দিনে পুরোনো ব্যাথা তীব্র হয়! এই দিনে অনেক মানুষই শারিরীক ব্যাথা অনুভব করতে থাকে! আদতে পূর্ণিমা বা অমাবস্যার সাথে শারিরীক ব্যাথার কোন সম্পর্ক আছে কিনা সেটার বৈজ্ঞানিক কোন তথ্য নেই। এইটা একটা মেডিক্যাল মিথ। অন্যান্য দিনেও আপনার হয়তো ব্যাথা হয়। কিন্তু “ধুর এ আর এমন কি ব্যাথা” বলে আপনি পাত্তাই দেন নি।
কিন্তু পূর্ণিমার দিনে আপনি ঠিকই তীব্র ব্যাথা অনুভব করলেন কারণ আপনি বিশ্বাস করেন যে এই দিনে ব্যাথা হবেই! এরকম আরও উদাহরণ দেয়া যাবে যেমন- সাপের বাতাস লাগলে ঝাড়ফুঁক দিলে ভালো হয়ে যাওয়া, বাতের ব্যাথা কমাতে ম্যাগনেট ব্রেসলেট পরা, যৌন শক্তি বাড়াতে সান্ডারের তেল ব্যবহার করা, দুঃস্বপ্ন দেখা বন্ধ করতে কবিরাজের দেয়া সাতরঙা সূতা হাতে বাঁধা বা তাবিজ-কবজ পরা ইত্যাদি ইত্যাদি।
এবার আসি প্লাসিবো(Placebo) ইফেক্ট এর প্রসঙ্গে। প্লাসিবো ল্যাটিন শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে- I shall Please, অর্থাৎ, ব্যাপারটা সন্তুষ্টির সাথে জড়িত। এটি এমন এক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি কিংবা ওষুধ, যার আসলে কোনো ঔষধী গুণাগুণ নেই। প্লাসিবো প্রয়োগ করা হয় সাধারণত, রোগীকে মানসিকভাবে আশ্বস্ত করার জন্য যে, তাকে ঔষধ প্রয়োগে চিকিৎসা করা হচ্ছে। সহজভাবে বললে, প্লাসিবো এমনভাবে মানসিক অবস্থা তৈরি করে যার ফলে রোগীর মনে হয় তার রোগ সেরে যাচ্ছে। যদিও এতে ঔষধি প্রভাব নয় বরং রোগীর মানসিক ইচ্ছেটাই কাজ করে। এই প্রভাবকে প্লাসিবো ইফেক্ট বা প্লাসিবো প্রভাব বলা হয়।[১]
বাস্তব জীবনে আমি নিজেও প্লাসিবো ইফেক্টের সাহায্যে আমার দাদির একটা চিকিৎসা(সমস্যার সমাধাধান) করেছিলাম। মাছ খেতে গিয়ে গলায় কাঁটা বিঁধেছিল। চার-পাঁচদিন পরেও গলার কাঁটা যায় না। যদিও আমরা সবাই বুঝেছিলাম উনার গলায় কাঁটা নেই। কিন্তু তার মাথায় ঢুকে গিয়েছে যে কাঁটা বিঁধে আছে। বারবার আমারে বলতেছিল ডাক্তার ডাকতে, ওষুধ আনতে। আম্মারে বললাম বাজার থেকে আসার পথে দুইটা গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ আনতে। যা ভেবেছিলাম তাই-ই হল। এন্টাসিড খাবার পরে উনার গলার কাঁটা আর নেই!
আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই মূলধারার চিকিৎসায় আস্থাশীল না। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় এরা প্রচলিত টোটকা প্রয়োগ করেন। ওষুধ না খেয়ে পানি পড়া, তেল পড়ার মাধ্যমে রোগ সারানোর চেষ্টা করেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, রোগী এই পানি পড়া খেয়েই সুস্থ হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে এখানে পানি পড়ার কোনো ভূমিকা নেই। রোগ সারিয়েছে প্লাসিবো ইফেক্ট। যে ব্যক্তি পানি পড়া বা তেল পড়া দিয়েছে, তার উপরে রোগীর অগাধ বিশ্বাসই এখানে প্লাসিবো ইফেক্ট হিসেবে কাজ করেছে।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা –
তাই বলে সকল রোগের ক্ষেত্রে প্লাসিবো দিয়ে কাজ হয়না। মূলত যে রোগগুলোতে শারিরীকের চাইতে মানসিক প্রভাব বেশি, সেসবে প্লাসিবো ইফেক্ট সাময়িকভাবে বা কিছুক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে কাজ করে। এই রোগগুলার মধ্যে আছে ব্যথা (পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা, কোমর ব্যথা ইত্যাদি), হতাশা, বিষন্নতা, দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দা ইত্যাদি। ক্যান্সার কিংবা জটিল সার্জারির কাজ প্লাসিবো দিয়ে কমপ্লিট করা যাবেনা কখনোই।
বিজ্ঞানীরা এই বিদ্যার খোঁজ পেয়েছেন ষোড়শ শতাব্দীতে। ওই সময় প্রচুর আছর হওয়া রোগীর সন্ধান পাওয়া যেত। খৃষ্টান পুরোহিতরা বাইবেল, ক্রুশ, আর হোলি ওয়াটারের সাহায্যে জিনের আছর হওয়া মানুষদের দেহ থেকে শয়তান তাড়াতেন। কিছু যুক্তিবাদী লোক আছর হওয়া লোকদের সামনে ভুয়া ক্রুস, ভুয়া বাইবেল আর ভুয়া হোলি ওয়াটার এনে জিন ঝাড়া শুরু করলো। দেখা গেলো, রোগীদের ঘাড় থেকে জিন বা ভূত চলে যাচ্ছে, রোগীরা সুস্থ হয়ে যাচ্ছে।
এখান থেকে ঐ বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করলেন যে ক্রুশ, বাইবেল, কিংবা হোলি ওয়াটার এর কোনো ভূমিকা নেই জিন তাড়ানোয়। পেচ্ছাপের পানি, অশ্লীল বই, কিংবা বাঁকাত্যাড়া যে কোনো লাঠি দিয়েই যদি রোগীর মনে সেই আমেজ বা অভিজ্ঞতা তৈরি করতে পারি, তাহলে তার ঘাড় থেকে জিন বা শয়তান চলে যাবে। প্রকৃতপক্ষে এই জিনের আছরগুলো মূলত হিস্টেরিয়া কিংবা সিজোফ্রেনিয়া রোগ।
১৬০০ সালের এই বিজ্ঞানীদের সাফল্যের পরে পরবর্তীতে প্লাসিবো নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, একেক মেন্টালিটির মানুষদের উপরে প্লাসিবো একেকভাবে কাজ করে। এছাড়া একেক ধরনের মানসিক বা শারীরিক অবস্থায় ব্যক্তিবিশেষের উপরে প্লাসিবোর কম বা বেশি প্রভাব থাকতে পারে। এই ওষুধগুলোর ক্ষেত্রে আমাদের মস্তিষ্ক নিজে ধোঁকা খায়; সে ভাবে যে আমাকে শক্তিশালী ওষুধ দেওয়া হয়েছে কাজেই আমি এখন সুস্থ।
এই ভেবে সে শরীরে স্বাভাবিক কিছু হরমোন, এনজাইম নিঃসরণ করে। মস্তিষ্ক সুস্থ থাকলে শরীর সুস্থ হয়ে যাবে। আর মস্তিষ্ক যেহেতু মনে করে যে সে সুস্থ, তাই কিছু ছোটখাট শারীরিক অসুখও সেরে যায় (অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাথা ব্যথা কিংবা পেট ব্যথা কিংবা অনিদ্রা পুরাটাই মানসিক রোগ। এখানে শারীরিক কোনো সমস্যা নেই। মস্তিষ্ককে বুঝ দিতে পারলেই রোগ সেরে যাবে পুরাপুরি)। বর্তমানে পাশ্চাত্যের ডাক্তারদের মধ্যে বিতর্ক হচ্ছে রোগীকে প্লাসিবো ওষুধ খাওয়ানো উচিত নাকি অনুচিত সেটা নিয়ে।
বাংলাদেশের মূলধারার ডাক্তাররা (এলোপেথিক ডাক্তার হিসেবে মানুষ যাদেরকে চিনে) খুব কম ক্ষেত্রেই প্লাসিবো প্রয়োগ করেন। অল্প কিছু ক্ষেত্রে কিছু সিনিয়র ডাক্তার রোগীকে সাময়িকভাবে শান্ত করার জন্য চিনির ট্যাবলেট কিংবা স্যালাইন ইঞ্জেকশন দিয়ে থাকেন।
তবে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যে ডাক্তাররা চিকিৎসা করেন (হোমিওপ্যাথি, ইউনানী, রেইকি, আকুপাংচার, হিজামা, রুকাইয়া, মেডিটেশন, পানি পড়া ইত্যাদি) তাদের পুরা চিকিৎসা পদ্ধতিই বলতে গেলে প্লাসিবো পদ্ধতিতে চলে। এই কারণে তারা রোগীদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক কিংবা পারিবারিক/সামাজিক গল্পগুজব করার দিকে খুব বেশি মনোযোগী হন।
অনেক সময় এই ডাক্তাররা পেশাগত পরিচয় ছাড়াও ধর্মীয় কিংবা অন্য কোনো সম্মানসূচক পরিচয় নেওয়ার চেষ্টা করেন (কারণ প্লাসিবোতে, রোগীর সাথে ডাক্তারের সম্পর্ক খুব গুরুত্বপূর্ণ। ডাক্তারের প্রতি রোগীর আস্থা থাকলে প্লাসিবো ওষুধে কাজ করবে। আর বিশ্বাস না থাকলে সেই ওষুধগুলা বুমেরাং বা হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে, অর্থাৎ রোগ আরো বাড়তে পারে। রোগ বাড়ার এই ঘটনাকে বলে Nocebo Effect)।
প্লাসিবো সম্পর্কে সচেতন হোন । অভিজ্ঞ ডাক্তারের দেওয়া প্লাসিবো কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগীর উপকারে আসতে পারে, কিন্তু টাকা পয়সা খরচ করে সত্যিকার চিকিৎসা না নিয়ে প্লাসিবোর মাধ্যমে দিনের পর দিন চিকিৎসা চালানো কোনো উপকারে আসবে না ।
প্লাসিবো ইফেক্টের উপরে TED-ED এর নির্মিত ভিডিওটি দেখতে পারেনঃ
তথ্যসূত্রঃ
২। The power of the placebo effect
৩। শেষোক্ত অংশটুকু কপি করা হয়েছে বিজ্ঞান যাত্রা ব্লগের- প্লাসিবো ইফেক্টঃ “এমনি এমনি” ওষুধ লেখাটি থেকে।