এক
যে স্বৈরশাসক বাতিস্তাকে উচ্ছেদ করে ফিদেল ক্যাস্ট্রো কিউবার ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিলেন, সেই বাতিস্তা কিন্তু ১৯৪০ সালে কিউবার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাঁর মেয়াদকালের শেষে তিনি একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দেন। সেই নির্বাচনে তিনি তাঁর বৈরী প্রতিদ্বন্দ্বী ডঃ র্যামোন গ্রাউ স্যান মার্টিন এর কাছে পরাজিত হন। ডঃ র্যামোনের পরে প্রেসিডেন্ট হন ডঃ কার্লোস প্রায়ো।
কার্লোস প্রায়োর মেয়াদের একেবারে শেষের দিকে, যখন তিনি পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য ইলেকশনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছেন, ঠিক সেই সময় ১৯৫২ সালে বিনা রক্তপাতের এক সামরিক অভ্যুত্থান করে কার্লোস প্রায়োকে উচ্ছেদ করেন বাতিস্তা। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নেন তিনি। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনিও একজন প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু তিনজন প্রার্থীর মধ্যে সবচেয়ে অজনপ্রিয় ছিলেন তিনি। নির্বাচনে জিততে পারবেন না, এই কারণেই হয়তো জোর করে ক্ষমতা দখল করেন তিনি।
বাতিস্তার এই হঠকারী আচরণে ধাক্কা খায় পুরো কিউবা। ক্ষমতা দখলের প্রায় সাথে সাথেই তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলন শুরু হয়ে যায় কিউবাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা,কার্লোস প্রায়োর অনুসারীরা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলো। কার্লোস প্রায়োর শিক্ষামন্ত্রী অরেলিয়ানো সানচেজ আরাংগোর নেতৃত্বে ট্রিপল-এ নামের একটা আন্ডারগ্রাউন্ড দলও সারা কিউবা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
এই সময় ফিদেল ক্যাস্ট্রো কিউবানদের কাছে অচেনা লোক ছিলেন। পুলিশের খাতায় অবশ্য তাঁর নাম ছিলো। সেটা সন্ত্রাসী হিসাবে। সেটা তাঁর ছাত্রজীবনের কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে অর্জিত নাম। হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাথা গরম, তেজোদৃপ্ত এক তরুণ হিসাবে ফিদেল ক্যাস্ট্রো পরিচিত ছিলো। এই সময়ই তিনি নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করা নানা গোপন সংগঠনের সাথে জড়িয়ে পড়েন, যা তাঁকে সন্ত্রাসী ছাত্রদের নানা গ্রুপের সাথে জড়িয়ে ফেলে।
১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা স্টুডেন্ট গ্রুপ কলম্বিয়ার বোগোটায় অনুষ্ঠিত ঔপনেবিশবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত ছাত্র কংগ্রেসে যোগ দিতে পাঠায়। তাঁর পুরো খরচ আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হুয়ান পিরোন সরকারের একটা ছাত্র সংগঠন বহন করেছিলো। একই সময়ে বোগোটাতে নবম ইন্টার-আমেরিকান কংগ্রেস চলছিলো। অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস (ওএএস) গঠনের খসরা রূপরেখা গঠনের কাজ চলছিলো।
কম্যুনিস্টরা এই মিটিং ভণ্ডুল করতে তারা আগে থেকেই পরিকল্পনা নিয়ে রেখেছিলো। সেটা করতে গিয়ে এর বিরুদ্ধে বোগোটাতে দাঙ্গা হয়। সেই রায়টে মূলত ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিলো। ক্যাস্ট্রোও এতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। কলম্বিয়ান এক পুলিশের কাছ থেকে একটা রাইফেলও ছিনিয়ে নেন তিনি। এই রায়টে অংশ নেবার ফলে অনেকেই এটাকে ক্যাস্ট্রোর সাথে আন্তর্জাতিক কম্যুনিস্টদের অনেক আগে থেকেই যোগাযোগের প্রমাণ হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করে।
আবার অনেকের কাছেই এটা নিছক একটা কাকতালীয় ব্যাপার। যারা কিউবার বিপ্লবকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হিসাবে দেখাতে চান, তাদের কাছে এই বোগোটা দাঙ্গাই প্রমাণ হিসাবে কাজ করে। বোগোটা দাঙ্গার কারণে কলম্বিয়ান পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করার আগেই ইন্টার আমেরিকান কনফারেন্সে থাকা কিউবান ডেলিগেশন তাঁকে একটা প্লেনে করে কলম্বিয়া থেকে কিউবাতে পাঠিয়ে দেয়।
বোগোটার এই দাঙ্গার পরেও কিউবানদের কাছে ফিদেল ক্যাস্ট্রো পরিচিতি ছিলো না। দেশ থেকে বহু দূরে হবার কারণে হয়তো এমনটা হয়েছিলো। এই অপরিচিতির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সিয়েরা মায়েস্ত্রাতে ছোট্ট একটা সৈন্য দল তৈরি করে ক্যাস্ট্রো। এদের প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৫৩ সালের ২৬শে জুলাই ফোর্ট মনকাডার উপর আত্মঘাতী হামলা চালায় ক্যাস্ট্রোর বাহিনী। পরিকল্পনা ছিলো যে খুব ভোরে মনকাডা আক্রমণ করা হবে। মিশন সফল হলে রেডিও স্টেশন দখল করে বাতিস্তার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া বৈপ্লবিক আন্দোলনে জনগণকে সমর্থন দেবার আহবান জানানো হবে।
মনকাডা আক্রমণের পরিণতি হয় ভয়াবহ। পেশাদার সৈনিকদের হাতে চরমভাবে পরাজিত হয় ক্যাস্ট্রোর অপেশাদার বাহিনী। বহুসংখ্যক ক্যাস্ট্রোর বিপ্লবী সেনা নিহত হয়, অনেকেই ধরা পড়ে, কেউ কেউ পালিয়ে যায়। ধরা পড়া বিপ্লবীদের হত্যা করা হয় বাতিস্তার নির্দেশে। ফিদেল এবং তাঁর ভাই রাউল কোনোক্রমে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় পাহাড়ে। স্যান্টিয়াগো দে কিউবার আর্চবিশপ এগিয়ে আসেন মধ্যস্থতা করতে। আর্মির কাছ থেকে তিনি এই প্রতিশ্রুতি নিতে সক্ষম হন যে, পালিয়ে যাওয়া বিপ্লবীরা স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করলে তাদের হত্যা না করে বিচারের সুযোগ দেওয়া হবে। এই প্রতিশ্রুতির উপর ভর করে ফিদেল এবং রাউল ধরা দেয় আর্মির কাছে
মনকাডা আক্রমণ ব্যর্থ হয়েছিলো চরমভাবে। কিন্তু, সফলতা আসে অন্য জায়গায়। ফিদেল ক্যাস্ট্রো এবং তাঁর বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচিত হয়ে ওঠে কিউবানদের কাছে। এর পর থেকে ক্যাস্ট্রোর বাহিনীকে ২৬শে জুলাইয়ের ফোর্ট মনকাডা আক্রমণের দিনের কারণে ২৬শে জুলাই আন্দোলন নামে ডাকা শুরু হয়।
গ্রামা ইয়াটে করে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কিউবা আক্রমণের আগে, আসুন দেখে নেই, ঠিক একই সময়ে অন্যেরা বাতিস্তার বিরুদ্ধে কী ধরনের প্রতিরোধ এবং আক্রমণ গড়ে তুলেছিলো। আমাদের অনেকেরই ধারণা যে, ফিদেল ক্যাস্ট্রোর একক নেতৃত্বেই কিউবাতে বিপ্লব হয়েছে, বাতিস্তার পতন ঘটেছে। বিপ্লবের শেষ পর্যায়ে গিয়ে এই কথাটা সত্য হলেও, শুরুর দিকে পরিস্থিতি ছিলো পুরোপুরি ভিন্ন ধরনের।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
প্রেসিডেন্ট কার্লোস প্রায়োর মেয়াদের একেবারে শেষের দিকে, যখন তিনি পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য ইলেকশনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছেন, ঠিক সেই সময় ১৯৫২ সালে বিনা রক্তপাতের এক সামরিক অভ্যুত্থান করে কার্লোস প্রায়োকে উচ্ছেদ করেন বাতিস্তা। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নেন তিনি। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনিও একজন প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু তিনজন প্রার্থীর মধ্যে সবচেয়ে অজনপ্রিয় ছিলেন তিনি। নির্বাচনে জিততে পারবেন না, এই কারণেই হয়তো জোর করে ক্ষমতা দখল করেন তিনি।
বাতিস্তার এই হঠকারী আচরণে ধাক্কা খায় পুরো কিউবা। ক্ষমতা দখলের প্রায় সাথে সাথেই তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলন শুরু হয়ে যায় কিউবাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এবং কার্লোস প্রায়োর অনুসারীরা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলো। এই আন্দোলনের জন্য প্রায়ো তাঁর সদরদপ্তর মায়ামিতে স্থাপন করেন। কার্লোস প্রায়োর শিক্ষামন্ত্রী অরেলিয়ানো সানচেজ আরাংগোর নেতৃত্বে ট্রিপল এ নামের একটা আন্ডারগ্রাউন্ড দলও সারা কিউবা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
এই সময় ফিদেল ক্যাস্ট্রো’ই বরং কিউবানদের কাছে অচেনা লোক ছিলেন। তিনি বিচ্ছিন্নভাবে তাঁর মতো করে আন্দোলন করে যাচ্ছিলেন। মনকাডা দুর্গের ব্যর্থ অভিযানের পরই ফিদেল ক্যাস্ট্রো ব্যাপক পরিচিতি পান কিউবানদের মধ্যে। তাঁর ‘২৬শে জুলাই আন্দোলন’ দলও তাঁর সাথে সাথে পরিচিত হয়ে ওঠে, যদিও এই দলের বেশিরভাগই তখন মারা গিয়েছেন। ফিদেল, রাউল বছর দেড়েক জেল খেটে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন মেক্সিকোতে।
মেক্সিকোতে ফিদেল ক্যাস্ট্রো যখন বিপ্লবের জন্য সৈন্য জোগাড়ে ব্যস্ত, যে সৈন্যদের নিয়ে তিনি পরবর্তীতে গামা ইয়াটে করে কিউবা আক্রমণ করতে যাবেন, সেই সময় অন্য কিউবানরা বাতিস্তাকে উচ্ছেদের পরিকল্পনা করে যাচ্ছিলো। এরকমই একটা গ্রুপ হচ্ছে মন্টিক্রিস্টি। এর প্রধান ছিলেন ডঃ জাস্টো ক্যারিলো। ইনি প্রেসিডেন্ট প্রায়োর প্রশাসনে কিউবান ব্যাংক ফর ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড এগ্রিকালচারাল ডেভেলমেন্টের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মন্টিক্রিস্টি গ্রুপ বাতিস্তার সেনাবাহিনীর তরুণ অফিসার অংশের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলো। এরা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাতিস্তা সরকারের পতনের পরিকল্পনা করেছিলো।
এই সামরিক পরিকল্পনাটা ১৯৫৬ সালের এপ্রিল মাসের ৪ তারিখে ব্যর্থ হয়ে যায়। এর নেতাদের সব গ্রেফতার করা হয়। সামরিক অভ্যুত্থান পরিকল্পনার প্রধান ছিলেন কর্নেল র্যামন বারকুইন। তিনি ওয়াশিংটনস্থ কিউবান এম্বাসির মিলিটারি এটাশে এবং ইন্টার-আমেরিকান ডিফেন্স বোর্ডে চীফ ডেলিগেট ছিলেন। বাতিস্তাকে উচ্ছেদের এই পরিকল্পনা তিনি শুরু করেছিলেন প্রেসিডেন্ট প্রায়ো যেদিন উচ্ছেদ হন, তার ঠিক পরদিন থেকে। কর্নেল বারকুইন এবং অন্যান্য সেনা অফিসাররা গ্রেফতার হয়ে যান। তাঁদের বিচার করা হয় এবং ছয় বছরের জেল দণ্ড দেওয়া হয়। পাইনস অন্তরীপের মিলিটারি জেলে পাঠানো হয় জেলদণ্ড ভোগ করার জন্য।
কর্নেল বারকুইনের পরিকল্পনা আবিষ্কৃত হবার কিছুদিন পরেই, ক্যাস্ট্রো’র মনকাডা আত্মঘাতী হামলার মতো একটা হামলা পরিচালিত হয়। এই হামলা চালানো হয় মন্তাঞ্জাস প্রদেশের রাজধানী মনতাঞ্জাসতে। হাভানা থেকে এই শহরের দূরত্ব মাত্র পঞ্চান্ন মাইল। ট্রাকের চারপাশে বালুর ব্যাগ লাগিয়ে তরুণদের ছোট্ট একটা বিপ্লবী দল হামলা চালায় মনতাঞ্জাসের মিলিটারি পোস্টের উপর। তরুণদের এই হামলা ব্যর্থ হয়ে যায়। আর্মি পোস্ট থেকে ধেয়ে আসা মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তারা। এই হামলার পরপরই কিউবার মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স মন্তাঞ্জাসে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। সব সন্দেহভাজন বিপ্লবীদের ধরে নিয়ে এসে হয় এবং এদের বেশিরভাগকেই হত্যা করা হয়।
এই সব ঘটনার সাথে ক্যাস্ট্রোর কোনো যোগসূত্র ছিলো না। কিন্তু, বাতিস্তার বিরুদ্ধে করা প্রতিটা বিপ্লবী প্রচেষ্টাই জনগণকে বাতিস্তার হাত থেকে নিজেদের বাঁচার এবং তাঁকে উচ্ছেদ করার আগ্রহ বৃদ্ধি করেছে। যার সুফল ভোগ করেছে পরবর্তী সময়ের বিপ্লবীরা, বিশেষ করে ফিদেল ক্যাস্ট্রো।
দুই
আর্চবিশপের মধ্যস্থতায় সেনাবাহিনীর হাতে ধরা দেবার পর স্যান্টিয়াগো দে কিউবার আদালতে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর বিচার শুরু হয়। কী কারণে বাতিস্তার বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছেন তিনি, সেটা বলতে গিয়ে তিনি বলেন বেকার লোকজন এবং কৃষি-শ্রমিকদের প্রতি ন্যায়বিচার হচ্ছে তাঁর চাওয়া। তিনি ভূমি সংস্কার করতে চান, ভাড়া কমাতে চান, শিল্পায়ন করতে চান এবং সম্পদের অধিকতর সুষ্ঠু বণ্টন করতে চান। একই সাথে তিনি উল্লেখ করেন যে, তাঁর প্রথম বৈপ্লবিক আইন হবে ১৯৪০ সালের সংবিধানকে দেশের সর্বোচ্চ আইনে প্রতিষ্ঠা করা। কিউবার এই ১৯৪০ সালের সংবিধানকে ল্যাটিন আমেরিকার সব দেশের মধ্যে সবচেয়ে প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক হিসাবে ধরা হতো।
ফিদেল এবং রাউল দুজনেরই পনেরো বছরের জেল হয়ে যায়। ভাগ্য ভালো তাঁদের। বেশি দিন জেল খাটতে হয় না। বছর দেড়েক পরেই বাতিস্তা তাঁর প্রতিপক্ষদের ঠাণ্ডা করার জন্য সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। তাঁর এই উদারতাই যে তাঁর পতনের অস্ত্র হয়ে আসছে, এটা বাতিস্তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি।
জেল থেকে বের হয়ে আসেন ফিদেল। কিন্তু, স্বস্তিতে থাকতে পারেন না। বাতিস্তার গুপ্তচররা পিছনে লেগে থাকা শুরু করে তাঁর। মনকাডা আক্রমণের মতো বড় কিছু করার স্বপ্ন তাঁর মনের মাঝে। একটা বাহিনী করতে হবে এর জন্য। কিন্তু, এই ফেউদের কারণে কিছু করতে পারছিলেন না। একটা রেডিও প্রোগ্রামে কথা বলার কথা ছিলো ক্যাস্ট্রোর। কিন্তু, সেটাতেও পুলিশ তাঁকে বাধা দেয়। এই ঘটনার পরেই দেশ ছেড়ে মেক্সিকো চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সেখানেই বিপ্লবী দল গঠন করবেন, তারপর তাদের কিউবাতে নিয়ে এসে আক্রমণ চালাবেন বাতিস্তার বাহিনীর উপর।
মেক্সিকোতে আসার পরেই সাগর দিয়ে কিউবাতে অবতরণযোগ্য একটা বাহিনী তৈরি করার জন্য লোক নিয়োগ করা শুরু করেন ফিদেল ফিদেল। এদের প্রশিক্ষণ দেবার জন্য মেক্সিকো সিটির পাশেই একটা খাবার কিনে নেন তিনি। এখানেই তাঁর ছোট্ট বাহিনীর সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়।
মেক্সিকোতেই ফিদেলের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার ঘটে। আর্জেন্টাইন বিপ্লবী চে গুয়েভারার সাথে পরিচয় হয় তাঁর। ফিদেল মেক্সিকো আসার বছর খানেক আগে গুয়াতেমালা থেকে রাতের আঁধারে নদী পার হয়ে মেক্সিকোতে ঢুকেছিলেন চে। তারপর থেকেই অবৈধভাবে সেখানে বসবাস করে আসছেন তিনি। গুয়াতেমালার বিপ্লবী রবার্তো কেসিরেসের সাথে একটা ছোট এপার্টমেন্ট ভাড়া করে থাকতেন তিনি। চে-র পরিচয় শুরুতে হয় রাউলের সাথে। রাউলই তাঁকে ফিদেলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। এ প্রসঙ্গে চে গুয়েভারা বলেছেন,
রবার্তো আমাকে নিয়ে গেছিলেন ফিদেলের ছোট ভাই রাউল ক্যাস্ত্রোর কাছে – তরুণ বিপ্লবী ত নয়, যেন একটুকরো তরল আগুন। রাউলের সংগে বন্ধুত্ব হতে দেরী হয়নি আমার। রাউল তার দাদা ফিদেলের সংগে আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। ফিদেল তখন কিউবায় বিপ্লবের আগুন জ্বালাবার পরিকল্পনায় ব্যস্ত। সারারাত ফিদেলের সংগে আলোচনা করলাম আমি আর কী আশ্চর্য, সকাল হবার আগেই আমি ওর ভবিষ্যৎ অভিযানের ডাক্তার হয়ে গেলাম।
ফিদেল ক্যাস্ট্রো তাঁর বাহিনীর প্রশিক্ষণের দায়িত্ব কর্নেল আলবার্টো বেয়োর উপর ছেড়ে দেন। বেয়ো হচ্ছেন স্পেনের গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন প্রাক্তন সেনাধ্যক্ষ। গৃহযুদ্ধের পর তিনি মেক্সিকোতে চলে আসেন এবং মেক্সিকো মিলিটারি একাডেমির প্রশিক্ষক নিযুক্ত হন। জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত র্যাঞ্চে চলতে থাকে সামরিক প্রশিক্ষণ। সামরিক প্রশিক্ষণ যারা নিচ্ছিলো, তাদের মধ্যে একমাত্র চে গুয়েভারা ছাড়া অন্য কেউ-ই সমাজতন্ত্রে দীক্ষিত ছিলো না, বরং ছিলো জাতীয়তাবাদী। চে গুয়েভারার বক্তব্য থেকেই এর প্রমাণ আমরা পাই। তিনি লিখেছেন,
ফিদেলের সংগে ছিলেন, একান্ত অন্তরঙ্গ অথচ গভীর দেশাত্মবোধে আপ্লুত মুষ্টিমেয় কজন বিপ্লবী। তাঁদের নিয়ে এই গভীর নিষ্ঠা এবং অসাধারণ কর্মক্ষমতার সংগে ফিদেল সংগঠন তৈরীর কাছে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তাঁর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো কিউবায় অবতরণযোগ্য একদল সৈনিক তৈরী করা।
এর মধ্যে ঝামেলা তৈরি হয়ে গেলো। মেক্সিকান পুলিশ খবর পেয়ে গেলো এই গোপন সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের। হামলা চালালো তাঁরা। ফিদেল ক্যাস্ট্রো, চে গুয়েভারাসহ বিপ্লবীদের অনেকেই বন্দি হয়ে গেলো মেক্সিকান পুলিশের হাতে। এই ঘটনা চে গুয়েভারার মুখ থেকেই বরং শুনি আমরা।
বাতিস্তার অর্থপুষ্ট মেক্সিকো সরকারের দুটি গোয়েন্দা বাহিনী ফিদেলকে গ্রেপ্তার করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল এবং এদেরই একটি দলের হাতে ফিদেল হঠাৎ বন্দী হলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এদের অতিরিক্ত অর্থলালসা এদের নিরস্ত্র করলো ফিদেলকে সংগে সংগে হত্যা করার পরিকল্পনা থেকে, এঁরা ভাবলেন বাতিস্তার হাতে ফিদেলকে জীবিত অবস্থায় তুলে দিতে পারলে প্রচুর লাভবান হবেন। তাঁর কয়েকদিন পরেই বিপ্লবীদের অনেকেই পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন, আমাদের সামরিক শিক্ষণ কেন্দ্র তছনছ করে দিয়ে মেক্সিকো পুলিশ আমাদের প্রত্যেককেই জেলে পুরলো।
চে গুয়েভারাসহ কয়েকজনকে প্রায় দুই মাস জেলে পচতে হয়েছিলো। ফিদেল শুরুতেই ঘুষ দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছিলেন। পরে অর্থ এবং সময় ব্যয় করে বাকিদেরও জেল থেকে বের করে নেন তিনি। জেল থেকে বের হয়ে এসে মোটামুটি সবাই আত্মগোপনেই থাকতো, মেক্সিকান পুলিশ যাতে আবার ধরে নিয়ে যেতে না পারে। এই অবস্থায় কিউবাতে দ্রুত আক্রমণ করা প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
শরৎ কালের মধ্যেই মেক্সিকো থেকে জলপথে গিয়ে কিউবা আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যান ফিদেল ক্যাস্ট্রো। কেনা হয় ইয়াট গ্রামা। খাদ্যদ্রব্য, সাজ সরঞ্জাম, অস্ত্রশস্ত্র, পোশাক-আশাক সব তোলা হয় এতে। অস্ত্রের মধ্যে ছিলো গোটা কয়েক বন্দুক এবং দুটো ট্যাংকবিধ্বংসী কামান। যদিও এগুলো চালাবার মতো কোনো মসলা তাদের ছিলো না।
১৯৫৬ সালের নভেম্বর মাসের ২৫ তারিখে মেক্সিকোর টাক্সপানে গ্রামা ইয়াটে চড়ে বসেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। সাথে চে গুয়েভারা এবং রাউল ক্যাস্ট্রোসহ বিরাশিজন সঙ্গী। গ্রামা ছুটে চলে কিউবার তটরেখার দিকে। গভীর আবেগে ফিদেল তাঁর সঙ্গীদের বলেন,
১৯৫৬ সালে হয় আমরা স্বাধীন বলে গণ্য হবো অথবা শহীদের মৃত্যু বরণ করবো।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটা সবার শেষে দেই। গ্রামা ইয়াট কেনা এবং এই অপারেশনের পুরো অর্থ এসেছিলো বাতিস্তা কর্তৃক উচ্ছেদকৃত প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট কার্লোস প্রায়োর কাছ থেকে।
অন্যান্য পর্বগুলো পড়ুন এখানে ⇑