১.১
থান মিন য়ু রচিত The River of Lost Footsteps: A Personal History of Burma এর কিছু অংশের ভাবানুবাদ –
১.২
গঙ্গাতীরের উর্বর ভূমিতে একদল তুর্কী আর আফগান ঘোড়সওয়ার সবার পয়লা ইসলামের পতাকা হাতে হাজির হয়। তাদের তরুণ নেতার নাম ছিল মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী, তার নেতৃত্বে সেই বাহিনী পথের সকল শহরপত্তন পায়ের তলায় মাড়িয়ে নির্দয়ভাবে এগোতে থাকে। বিহারের বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করে দেয় তারা, তীর্থশহর বেনারস জ্বালিয়ে দেয়া হয়। চলে লাগামছাড়া লুট।
বাংলার নদীয়া শহরে এসে তারা ঘোড়ার সওদাগর সেজে ফট করে অন্দরে ঢুকে পড়ে, তারপর সহসাই কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগে প্রহরীদের কল্লা নামিয়ে দিতে দিতে রাজার অন্দরমহল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। রাজামশাই মোটে ভাত খেতে বসেছিলেন, খবর শুনে তিনি দিলেন উল্টোদিকে ছুট! ছুটতে ছুটতে তিনি সেই যে কোন জঙ্গলে পালিয়ে গেলেন, আর তার কোন খবরই পাওয়া গেল না। ঐ থেকে বাংলায় তুর্কী আফগান মুসলিম শাসন শুরু হয়, যা টিকে ছিল পরবর্তী পাঁচশো বছরেরও বেশি।
আরাকান রাজা নরমিথলা যখন বাংলায় পালিয়ে গিয়েছিলেন তখন সেখানে তুর্কী আফগান সুলতানাত দুইশ বছর পুরোন। ১৪৩০ সালে, আত্মগোপনের প্রায় তিন দশক পরে তিনি দেশে ফিরেন বিরাট সিপাইদল নিয়ে, তাদের অধিকাংশই আফগান ভাড়াটে দস্যু। অতি সহজেই তারা শহরের দখল নিয়ে নিল। শুরু হল এক স্বর্ণালী সময়ের, ক্ষমতা ও সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ সেই সময়। গঠিত হল বৌদ্ধ-মুসলিম সমন্বয়ে এক চমৎকার দোআঁশলা দরবার, যেখানে পারস্য ও ভারতের ঐতিহ্যের সাথে এসে মিলল পূবের বৌদ্ধ চিন্তা।
রাজা পুরাতন রাজধানী ছেড়ে এক নতুন শহর পত্তন করলেন, তার নাম দেওয়া হল ম্রাওক-উ। আক্ষরিক অর্থে বানর ডিম। কেন যে এইরকম নামকরণ তা সঠিক জানা যায় না। রাজার জ্যোতিষেরা কইলেন এই শহর খুবই সুলক্ষণযুক্ত সন্দেহ নাই, কিন্তু তিনি সেখানে মুভ করলে অক্কা পাবেন। রাজা সেই ভাগ্য বরণে রাজি ছিলেন। ১৪৩৩ সালে মহা আড়ম্বরের সাথে শহরের জাঁকালো উদ্বোধন করা হয়, তার পরের বছর মারা যান রাজা।
ম্রাওক-ঊ ফুলেফেঁপে আন্তর্জাতিক শহরে পরিণত হয়, তার অধিবাসীর সংখ্যা এক লক্ষ ষাট হাজারে গিয়ে ঠেকে। সেখানে বাস করত আরাকান, বাঙালি, আফগান, বার্মিজ, ওলন্দাজ, পর্তুগীজ, পারসীয় এমনকি জাপানী খ্রিস্টান যারা নাগাসাকি থেকে শাসক হিদেয়োশি তোয়োতোমির অত্যাচার থেকে পালিয়েছিল। এদের কেউ কেউ ছিল সামুরাই যোদ্ধা, তারা আরাকানরাজের বডিগার্ডের কাজ শুরু করে। এই কসমোপলিটান দরবারে আকৃষ্ট হয়ে আসেন বাঙালি আরাকান সাহিত্যের দিকপালেরা। প্রথম বাঙালি প্রেমের কাহিনী লিখিয়ে দৌলত কাজি এখানে স্বতন্ত্র মৌলিক লিখায় মত্ত হন।
আবার আলাওল, যাকে কিনা সপ্তদশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ধরা হয়, তিনি ফার্সি হিন্দী ভাষা থেকে অত্যুত্তম সাহিত্য অনুবাদ করেন। অনেক রাজা মুসলিম টাইটেলের পাশাপাশি পালি পদবি নেন, পারস্য অনুপ্রাণিত জামাকাপড় ইস্ফাহান দিল্লীর অনুকরণে জমকালো পাগড়ি পরার পাশাপাশি প্রচুর বৌদ্ধ বিহার ও প্যাগোডাও তারা তৈয়ার করেন। তাদের মুদ্রায় ইসলামি কলেমা মুদ্রিত থাকত।
শহরটি ছিল ভেতরের দিকে, নানাবিধ কেল্লা পরিখা দ্বারা দুর্ভেদ্য করে রাখা হয় একে। সাথে ছিল ঘন জঙ্গল আর দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা। পর্তুগীজ পাদ্রী এ. ফারিনিয়া অসংখ্য নদীর মিলনক্ষেত্র এই শহরকে ডেকেছিলেন দ্বিতীয় ভেনিস নামে। অন্যান্য সমসাময়িক বিভিন্ন লিখকও একে লন্ডন আমস্টার্ডামের সাথে তুলনা করেছেন।
প্রায় একশ বছর ধরে আরাকান পাশের বাড়ির বাংলা সুলতানাতকে তেল দিয়ে চলতো। কিন্তু পরে যখন বাংলা বিভিন্ন আভ্যন্তরীণ গোলযোগে লিপ্ত হয়, তখন আরাকান তাদের অবস্থান থেকে সরে আসে। শত শত জাহাজ নিয়ে তৈরী হয় শক্তিশালী নৌবাহিনী, তারা রামু দ্বীপ দখল করে ১৫৭৮ সালে দখল নেয় চিটাগং বন্দর। পর্তুগীজ বজ্জাত আর নানান ভাড়াখাটা দস্যুর সাথে মিলে তারা পূববাংলার অধিকাংশ এলাকা বুঝে নেয়। আরাকানেরা পূর্বদিকেও গিয়েছিল, কিছুদিনের জন্য তাদের দখলে ছিল পেগু। ঐখানে তারা রাজপরিবারের লোকসহ প্রায় হাজার তিনেক লোককে লাথি দিয়ে বের করে দেয়। সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে আরাকান শাসন, কিছুদিনের জন্যে তাদের অধীনে থাকে ঢাকা থেকে মার্তাবান পর্যন্ত হাজার মাইলব্যাপী এলাকা।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
পর্তুগীজ সওদাগর দুয়ার্তে বারবোসা ১৬১০ সালের দিকে এই শহরে আসেন। তিনি লিখে গেছেন, রাজার জন্যে বারোটি অত্যাধিক সুন্দরী কচি মেয়ে দেশের বিবিধ প্রান্ত থেকে নিয়ে আসা হত। তাদের সটান রাজার কাছে নিয়ে যাবার বদলে খাড়া রোদে জামাকাপড় পরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হত। দিনের শেষে তাদের জামা খুলে তা পাঠানো হত রাজার কাছে। তিনি বসে বসে সেগুলি শুঁকতেন, আর যার ঘামের গন্ধ পছন্দ হত সেই মেয়ের ডাক পড়তো অন্দরে। বাকী মেয়েগুলিকে দরবারের আজাইরা মন্ত্রী মিনিস্টারের কাছে পাঠানো হত।
লুট আর শহর পত্তনির সাথে সাথে ম্রাওক-উ ধনী থেকে ধনীতর হতে থাকে। বাণিজ্য থেকেও তার ব্যাপক পয়সা আসে, বিশেষত দাস বাণিজ্য। বঙ্গোপসাগরের তীরে দাস ব্যবসা ছিল জমজমাট। এটা সপ্তদশ শতাব্দীর কথা যখন আফ্রিকার গাম্বিয়া, অ্যাঙ্গোলাসহ অন্যান্য স্থান থেকে লক্ষ লক্ষ ক্রীতদাস ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ভার্জিনিয়ায় পাঠানো হচ্ছে। পর্তুগীজ ও অন্যান্য নানাজাতের দস্যু আনন্দের সাথে দাস ব্যবসায় আরাকানরাজের সাথে হাত লাগাল, বাংলার তীরে তীরে তারা ঝটিকা আক্রমনে বন্দী করতে থাকল হাজার হাজার দাস। জনবহুল এলাকা পরিণত হল বিরানভুমিতে। কিন্তু ম্রাওক-উ এর জন্যে এর অর্থ আরো ধন আরো মুনাফা, আরো অনেক অনেক উজ্জ্বল শহর।
এই ব্যাপক ধনের দিকে নজর পড়ে ওলন্দাজের, তারাও এর মধ্যে নাক গলাতে চায়। ১৬০০ এর প্রথমদিকে পর্তুগীজ শক্তি কমে আসে, তার জায়গায় শুরু হয় অন্যান্য ইয়োরোপীয়ের আনাগোনা। ১৬০২ সালে গড়া হয় ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যখন নেদারল্যান্ডস স্টেটস জেনারেল পূর্বে বাণিজ্য করার জন্য একচেটিয়া সনদ দেয়। বাটাভিয়া (বর্তমান জাকার্তা) এ আঞ্চলিক হেডকোয়ার্টার বসানো হয়, তাদের পত্তন দ্রুত জাপান, পারস্য, বাংলা, সিংহল, শ্যাম আর চীনে ছড়িয়ে পড়ে।
সপ্তদশ সতাব্দীর মধ্যভাগে ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বা ভিওসি পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ধনী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তাদের ছিল ১৫০ সওদাগরি জাহাজ, ৪০ যুদ্ধজাহাজ, পঞ্চাশ হাজার কর্মচারি আর শক্তিশালী নিজস্ব মিলিটারি। আরাকানের ম্রাওক-উ তে তাদের প্রধান আগ্রহ ছিল দাস ব্যবসায়, নিয়মিত হারে হাজার হাজার আরাকান-ধৃত দাস তারা কিনত নয়া ওলন্দাজ কলোনির জন্য। কিন্তু অত্যাচার আর ক্ষুধায় মারা পড়ত তাদের অধিকাংশই জাভা পৌঁছানোর অনেক আগে।
পেগু আর অন্যান্য বার্মিজ বন্দরেও ওলন্দাজ বাণিজ্য বহাল ছিল, নতুন নতুন বাণিজ্যের সাথে বাড়ে বিলাসদ্রব্যের আমদানি। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে বিপুল ধনবান বার্মিজেরা সুদূর উত্তর আমেরিকার সেন্ট লরেন্স ভ্যালি থেকে আনানো বিভার-হ্যাট মাথায় দিত, যার মূল্য যেকোন হিসাবেই ছিল আকাশছোঁয়া। আমরা কল্পনা করে নিতে পারি পেগু, আভা, আর হয়তো ম্রাওক-উ এর লোকেও রেমব্রাঁ অথবা ভার্মিয়েরের ছবির মতই চওড়া ফ্যাশনেবল টুপি মাথায় দিত।