১.১
মোগল সাম্রাজ্যের সর্বশেষ প্রতাপশালী বাদশাহ আওরঙ্গজেব ওরফে বাদশাহ আলমগীর ছিলেন একটি এক্সপোর্ট কোয়ালিটি শয়তানের লাকড়ি। গদিতে বসার জন্য তিনি তার প্রতিটি ভাইকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হত্যা করেন, পিতা শাজাহানকে জেলের ভাত খাইয়ে মারেন। গদিতে বসে তিনি গণহারে হিন্দুদের খৎনা করে মুসলমান বানাতে থাকেন, ধর্মীয় বৈষম্যমূলক জিজিয়া কর পুনরায় চালু করেন, হাজার বছরের পুরোন মন্দির প্যাগোডা ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া হয়। তিনি ভন্ডামীরও বাদশা ছিলেন, সকাল বিকাল কুরান শরীফ মাথায় ঠেকিয়ে জিহাদি জোশ দেখালেও রাতে নিজেরই বিয়ে করা হিন্দু বউয়ের কোমল বুকের খাঁজে নাক ডুবিয়ে ঘুমাতে তার আটকাতো না। প্রখর বুদ্ধিমান, প্রতারক শিরোমণি ও চরম ধুরন্ধর মহীউদ্দিন মুহম্মদ আওরঙ্গজেব ছিলেন একটি ক্রিমিনাল মাস্টারমাইন্ড।
শাজাহান বেঁচে থাকাকালীনই তার চার ছেলের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে টেরম টেরম যুদ্ধ লেগে যায়, আমাদের গল্পের শুরু ওইখানে। আওরঙ্গজেব আরাম করে গদিতে বসার পরে গিয়ে আমরা থামবো। জেমস হুইলার লিখিত “Tales from Indian history” বই অবলম্বনে।
১.২
মরহুম তাজ মহলের গর্ভে শাজাহানের চারটে ছেলে। দারা, সুজা, আওরঙ্গজেব আর মুরাদ। বড় ছেলে দারা, অটোমেটিক সিংহাসনের দাবীদার। কিন্তু চার ভাইয়ের মধ্যে তার উপর আমজনতা সবচেয়ে ত্যাক্ত ছিল। কুরান নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলে সে মুসলমানদের খেপিয়ে রেখেছিল, রাজাদের নিয়ে তাচ্ছিল্যসূচক কথা বলা নিয়ে হিন্দুরাও কম বিরক্ত ছিলনা। খ্রিস্টান পাদ্রীর সাথে তার ছিল চরম মাখামাখি, তার অধীনে প্রচুর ইয়োরোপীয় কামান বন্দুক তৈরির কাজে নিযুক্ত ছিল।
শাজাহান বুড়ো হবার পর সরকারী কাজ দারার ঘাড়ে চাপিয়ে হেরেমে মন দিলেন। দারার লোভ বাড়তে থাকলো, সে সম্পদ জমানো আরম্ভ করলো। বিভিন্ন প্রদেশের শাসকদের সে ইচ্ছেমত প্রজা নিপীড়নের সুযোগ দিলো, একটাই শর্ত তাকে ভাগ দিতে হবে। সুজাকে বাংলায়, আওরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্যে আর মুরাদকে গুজরাট পাঠানো হল। এরকম দূরে দূরে থাকলে তারা এক হয়ে তার কল্লা কাটার ধান্দা করতে পারবে না এই আশায়।
দারা ক্ষমতার গন্ধে অস্থির হয়ে উঠছিলো, আশপাশের চাটুকারের দলও তাকে উৎসাহ দিচ্ছিল মুখে। মনে মনে তারাও কিন্তু দাম্ভিক দারাকে দেখতে পারত না। আওরঙ্গজেবের অনাড়ম্বর জীবনযাপনে দাক্ষিণাত্যে তার জনপ্রিয়তায় দারার মাথায় টংটং অ্যালার্ম বাজছিল, পিতা শাজাহানের কাছে সে আওরঙ্গজেবের নামে নালিশ করে দিল। শাজাহান কিন্তু আরেক খেলোয়াড়, তিনি দারার ধান্দাবাজীতে সন্দিহান হয়ে বরং আওরঙ্গজেবকেই দারার পিছনে লাগিয়ে দিলেন।
শাজাহানের চার ছেলের মধ্যে সবচাইতে বড় গুটিবাজ ছিল আওরঙ্গজেব। সে বিরাট ধার্মিক, সেই আকবরের আমলে বিতাড়িত মোল্লা আলেমউলামাদের সে কোথা থেকে আবার জোগাড় করলো। তার ছিমছাম গড়ন, স্বল্পাহারি, সাধারণ সুতীর কাপড় পরনে।
যেখানেই থাকুক না কেন নামাজ ওয়াক্তে সে ঠিক ঢিপঢিপ নামাজ পড়া শুরু করতো। সারাক্ষণ বগলের তলায় একটি কুরান শরীফ থাকত তার, রাজধানী আওরঙ্গাবাদের রাস্তাঘাটে সুললিত কন্ঠে সে মুনাজাত পাঠ করতো।
ঐ সময় দাক্ষিণাত্যের উত্তরভাগ মোগল কব্জায় ছিল, কিন্তু দক্ষিণাংশে বিজাপুর আর গোলকোন্ডা নামে দুইটি স্বাধীন মুসলমান রাজত্ব ছিল। ঐ দুই মুসলমান রাজা ছিল শিয়া, আর আওরঙ্গজেব কড়া সুন্নী। রাজ্য আক্রমন করার চরম বাহানা।
গোলকোন্ডায় এক বালক সুলতান রাজত্ব করছিল, তার উজির ছিল এক পারসিক পর্যটক আমীর জুমলা। জুমলা সাহেব টাকা ও নারীর লোভে গোলকোন্ডায় পড়ে ছিল, বালক সুলতানের মাতার সাথে তার আশনাই। এই বিপজ্জনক লাভ এফেয়ারের কথা প্রকাশ হয়ে পড়ায় আমীর জুমলা জীবনের জন্য ভীত হয়ে গোপনে আওরঙ্গজেবের সাথে যোগাযোগ করে গোলকোন্ডা আক্রমনে প্রস্তাব পাঠায়। আনন্দের সাথে প্রস্তাব গৃহীত হয়।
ঘটা করে প্রচার করা হয় আওরঙ্গজেব সুজার মেয়ের সাথে পুত্র মাহমুদের পানচিনি করতে বাংলা যাচ্ছে, কিন্তু তা না করে দুম করে তার বাহিনী নিয়ে গোলকোন্ডায় হাজির হয়। পালানোর পথ না দেখে বালক সুলতান ধরা দিতে যাচ্ছিল, এমন সময় দিল্লী থেকে আওরঙ্গজেবের কাছে হুকুম আসে গোলকোন্ডা ছেড়ে দিতে। দারার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে করতে আওরঙ্গজেব দিল্লীর পথ ধরে।
আওরঙ্গাবাদে ফিরে আওরঙ্গজেব কিছু দামী উপহার পাঠায় পিতার প্রতি, যেন বাদশা তাকে বিজাপুর আক্রমণের অনুমতি দেন। শাজাহান ঝপ করে রাজী হয়ে যান, তার আশা ছিল আওরঙ্গজেব আর আমীর জুমলার শক্তিশালী বাহিনী তাকে দারার হাত থেকে ভবিষ্যতে রক্ষা করবে। এই দেখে দারা নতুন হুকুম দিল, আমীর জুমলার আনুগত্যের মর্টগেজস্বরূপ তার বউ আর মেয়েদের তার দরবারে পাঠাতে বলা হল। আওরঙ্গজেবের প্রতি হুকুম হল বিজাপুর আক্রমনে সে যেন অংশ না নেয়। আমীর জুমলার পক্ষে আর দুই নম্বরী করার সুযোগ থাকলো না, আওরঙ্গজেবের সাথে মিলে বিদ্রোহ করে নিজের বউ মেয়ের ইজ্জত কি আর হানি করা যায়।
এই সময় হঠাৎ দুনিয়া কাঁপানো তিরিশ মিনিট মার্কা ব্যাপার শুরু হয়ে গেল। হাটবাজারে, মন্দির মসজিদে, বটগাছের তলে আর তেঁতুলগাছের ডালে, নদীর ধারে আর পুকুরের পাড়ে, আকাশে বাতাসে ফিসফিস আর ফিসফিস। বাদশা শাজাহান মৃত। অথবা অর্ধমৃত। অথবা অসুস্থ। অথবা কিছু একটা। হিন্দুস্তানের গদী নিয়ে চার ভাইয়ে টেরম টেরম যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। আগ্রায় সৈন্য নিয়ে আগানো শুরু করল বাংলার সুজা। হাতী ঘোড়া কামান বন্দুক নিয়ে সে যাত্রা শুরু করলো।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
বিরাট বুক চিতিয়ে সুজা বাংলা ছেড়ে যাচ্ছিল, আর প্রচার করছিল যে দারা শাজাহানকে বিষ খাইয়ে মেরেছে তাই প্রতিশোধ সে তুলবেই তুলবে। যাকে বলে এবসোলিউট মাস্ট। আওরঙ্গজেব একটু সময় নিল, ছক কষছিল তখন। নিখুঁত ছক। সে তার সৈন্যদের বলল যে দারা কুরানশরীফকে অপমান করেছে, তাই তাকে এর চরম শাস্তি পেতেই হবে। যাকে বলে এবসোলিউট মাস্ট। গুজরাটে ছোটভাই মুরাদকে সে লিখল,
“দারা একটি নাস্তিক। সুজা আরও খারাপ, সে হল শিয়া। আমি ফকীর সাধক, আমার ইচ্ছা তোমার মত ভাল সুন্দর ভাইটিকে গদীতে বসানো। এরপরে আমি মুক্ত, আল্লার সাধনায় আমি নিজেকে নিশ্চিন্তে সঁপে দিতে পারব। মুহম্মদের কবরের পাশে বসে ধ্যান করা ছাড়া আমার আর কোন কাজ রইবে না।”
শাজাহান বেঁচেই ছিলেন, কিন্তু ভয়ানক অসুস্থ। তাকে প্রাসাদে বন্দী করে রাখা হল। দারা তার ছেলে সুলেমানকে নিয়ে চিন্তায় ছিল, কোনদিন আবার দারার বদলে সুলেমানকেই বাদশা বানিয়ে দেয়া হয় ঐ চিন্তা। সুজার আগ্রা আক্রমনের খবরে দারা ঝামেলায় পড়েছিল, আর মন্ত্রীমিনিস্টারদের বারবার বলছিল বাদশা বেঁচে আছেন, তিনি খুন হননি বা সুইসাইডও খাননি। বাদশাকে এমনকি একদিন দরবারে ধরে ধরে হাঁটানোও হল, তবু লোকের সন্দেহ যায়না। যাহোক সুলেমানের নেতৃত্বে মোগল বাহিনী সুজাকে প্রতিরোধ করতে পাঠানো হল। সুজা সুলেমান যেটাই মরে দারার আপত্তি নেই, দরকারে দুটোই মরুক।
কয়দিন কোন আওয়াজ নেই, এরপর শোনা গেল আওরঙ্গজেব আর মুরাদের যৌথ বাহিনী রাজপুতানা দিয়ে রাজধানীর দিকে এগিয়ে আসছে। দারা আগ্রাতেই রইল, আর হিন্দু মুসলমান মিশ্রিত একটি বাহিনী পাঠালো প্রতিরোধের জন্য। মুসলমান জেনারেলদের আবার তলে তলে আওরঙ্গজেবের সাথে কানেকশন ছিল, তাই যুদ্ধের ময়দানে তারা সাইডে দাঁড়িয়ে বিড়ি খাচ্ছিল যখন আওরঙ্গজেবের বাহিনী হিন্দু রাজপুতদের কচুকাটা করছিল।
খবর পেয়ে দারা ব্যাপক ক্ষিপ্ত হল, সে ঠিক করল সুলেমান বাংলা থেকে ফিরে আসলেই দুই ভাইকে সে দেখে নেবে। সুলেমানের খবর নাই। দারা একাই রাগের মাথায় যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে গেল। তার অধীনস্থ অফিসারেরা এইবার পোল্টি খেল, দারার উপর তাদের রাগ বহুদিনের। মাঝমাঠে হঠাত দারা দেখে তার পাশে হাতেগোনা কয়টা অনুচর ছাড়া কেউ নেই, বেবাক ফাঁকা। কোনমতে সে পালিয়ে পাঞ্জাব গিয়ে বাঁচল।
আওরঙ্গজেব আর মুরাদ আগ্রার প্রাসাদ ঘিরে ফেলল। শাজাহান তাদের ক্ষমা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অন্দরে আসতে বললেন। কিন্তু আওরঙ্গজেব ঠিকই জানত ভেতরে গেলে শাজাহান তার দুর্ধর্ষ তাতার প্রহরীদের দিয়ে তাকে খুন করাবেন। এইবার শাজাহান আওরঙ্গজেবের পুত্র মাহমুদের পিছনে লাগলেন, আর বললেন পিতাকে ছেড়ে তার সাইডে এলে গদী কনফার্ম। মাহমুদও পিতার মত ত্যাড়া ছিল, লাভ হলনা। শাজাহানকে বন্দী করা হল। সেখানেই একসময় তার মৃত্যু হয়।
গদীর টেরম টেরম যুদ্ধ এইভাবে থামে। পুরো ব্যাপারটা ঘটে আওরঙ্গজেবের ছক অনুযায়ী। ভাই মুরাদ গদীর জন্য লাফালাফি করছিল, তাকে একদিন কৌশলে মদ খাওয়ার সময় পাকড়ানো হয়, আর মহান কুরানশরীফের নিয়ম ভঙ্গের অপরাধে তাকে আটক করা হয়। রূপার শিকলে বেঁধে তাকে গোয়ালিয়রের দূর্গে সাপের দংশনে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। দারা ধরা পড়ে যায়।
সারা দিল্লীর লোকের সামনে দারাকে ঘুরানো হয় ছিন্নবস্ত্রে, শহরের সবচাইতে উঁচু হাতীর পিঠে বাঁধা অবস্থায়। পরে একটি নির্জন কক্ষে তাকে হত্যা করা হয়, মারা যাবার পূর্বমুহুর্তে সে খ্রিস্টধর্ম গ্রহন করে। সুজা পরিবার নিয়ে আরাকান পালায়, কিন্তু তার পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় বলে শোনা যায়।
আওরঙ্গজেবের বড় ছেলে মাহমুদেরও কপাল মন্দ। সুজার মেয়ের সাথে তার পীরিত ছিল। সুজার সাথেই যুদ্ধ করতে মাহমুদকে পাঠানো হয়, ওইখানে মাহমুদের বহুদিন আগের পীরিত চাগাড় দিয়ে ওঠে। তাকে বিয়ে করে বসে মাহমুদ। পরে সে বুঝতে পারে কি বিরাট ভুল করেছে, তাই আবার পিতার কাছে ফিরে এসে ক্ষমা চায়। এই পিতা ক্ষমাশীল পিতা না। তাকে সোজা জেলে ঢুকানো হয়।
দারার বড় ছেলে সুলেমান অবস্থাও ছিল ব্যাপক করুণ। সে বাংলা থেকে পালিয়ে কাশ্মীর যায়, কিন্তু ওইখানের রাজা তাকে পাকড়ে আওরঙ্গজেবের কাছে ফেরত পাঠায়। সোনার শিকলে বেঁধে সুলেমানকে প্রাসাদে আনা হয়, আর তাই দেখে জেনানামহলের বেগমদের মাঝে চাপা কান্নার রোল ওঠে, বালক সুলেমান ঐ বেগমদেরই কোলেপিঠে মানুষ। বিষাক্ত পিস্তার শরবত, যা খেলে মগজ ফেটে মানুষ মারা যায়, তাই খেতে বাধ্য করা হল তাকে।
অতবড় জোয়ান মানুষটা পিস্তার কথা শুনে ভয়ে গুটিয়ে বারবার চিৎকার করে বলতে থাকে যেন তাকে এক কোপে মেরে ফেলা হয় তবু পিস্তা নয়। দরবারভর্তি লোকের চোখে পানি এসে যায় ঐ গগনবিদারী চিৎকারে, আওরঙ্গজেব পিস্তা দিতে নিষেধ করে। তাকে গোয়ালিয়র দূর্গে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সুলেমানের কথা আর কখনো শোনা যায়নি।