বিশ্বাস কী? প্রাচীনকালে মহাবিশ্বের সাথে মানুষের জানার আগ্রহের একটা সম্পর্ক ছিল, বিশেষত যে বিষয়গুলো তারা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারতো না। যেসকল বিষয় তাদের কাছে দুর্বোধ্য ছিল যেমনঃ বজ্র, জোয়ার-ভাটা, ভূমিকম্প, অগ্নুৎপাত, বন্ধ্যাত্ব, প্লেগ এমনকি ভালোবাসার রহস্যের সমাধান হিসেবে তারা দেব-দেবী বানিয়ে নিত।
গ্রিকদের কাছে সাগরের জোয়ার-ভাটা ছিল দেবতা পসাইডনের মন ভালো-খারাপের ফল। পার্সিফোনির পাতালে নিয়ে যাওয়ার কারণে শীত আসে। রোমানদের কাছে আগ্নেওগিরি ছিল কর্মকার ভলকানোর নিবাস, যার কাজের সময় আগুনের স্ফুলিঙ্গ বেড়িয়ে আসে।
মানুষ অসংখ্য কল্পিত দেব-দেবী বানিয়েছিল শুধু এই গ্রহের রহস্য ব্যাখ্যা করতেই নয়, নিজেদের দেহের রহস্য ব্যাখ্যা করতেও।
দেবী জুনোর কৃপা বঞ্চিত হলে বন্ধ্যাত্ব, দেবতা এরসের উস্কানিতে ভালোবাসা, এ্যাপোলোর রোষে মহামারি আসে। মোদ্দাকথা যখনই কোনকিছু বোঝার সময় বা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে একটা গ্যাপ তৈরি হতো, তখনই কল্পিত দেব-দেবী দিয়ে সেই গ্যাপ পূরণ করা হতো। অসংখ্য গ্যাপ এর জন্য অসংখ্য দেব-দেবী।
বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে পরবর্তীতে মানুষ এইসব ‘গ্যাপ’-গুলোর ব্যাখ্যা দিতে শুরু করলে একে একে মৃত্যু হতে থাকে সেইসব দেব-দেবীর! যেমনঃ আমরা যখন বুঝলাম যে চাঁদের প্রভাবেই সাগরে জোয়ার-ভাটা হয়, তখন পসাইডনের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল। তাকে আমরা পৌরাণিক যুগের এক নির্বোধ কাহিনী হিসেবে বাতিল করে দিলাম। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের ফলে একে একে বাকিসব দেব-দেবীরও একই পরিণতি ঘটেছে। বিজ্ঞানের এক একটি আবিষ্কার যেন ঈশ্বরের মৃত্য!
কিন্তু ইতিহাস বলে এইসকল দেব-দেবীর উৎখাত এত সহজ ছিল না। দেবতাদের পরিহার করা সমাজের কাছে এক জটিল ব্যাপার। ছোটবেলা থেকে সমাজ আমাদের মনে অন্ধ বিশ্বাস গেঁথে দেয়। যার ফলে যুগে যুগে ধর্মীয় পরিবর্তনের সময় চরম আশঙ্কাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে; হয়েছে রক্তপাত।
জিউস সব দেবতাদের দেবতা। প্যাগান দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও শ্রদ্ধেয়। জিউসের অনুসারীদের প্রতিরোধ এতটাই প্রবল ছিল যে খ্রিস্টানরা তাদের নতুন ঈশ্বরের মুখ হিসেবে জিউসের মুখটাকেই মেনে নিল!
আজকের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আমরা আধুনিক বুদ্ধিমত্তায় ও প্রযুক্তিগতভাবে আমরা আজ দক্ষ। আগ্নেয়গিরির তলায় বসা দেবতা কিংবা ঋতু বা জোয়ার-ভাটা নিয়ন্ত্রণকারী দেবতায় বিশ্বাস করি না। কিন্তু আসলেই কি আমরা আধুনিক হতে পেরেছি? মানব মস্তিষ্ক প্রখর যৌক্তিক বিশ্লেষণ করতে সক্ষম অথচ একই সাথে এমনসব ধর্মীয় বিশ্বাস মেনে নেয় যেগুলো সামান্য যুক্তির সামনেও টিকতে পারে না।
মানুষ কেন কোনো কিছু বিশ্বাস করে?
কম্পিউটারের মতই মানুষের ব্রেইনে একটা অপারেটিং সিস্টেম আছে। সারাদিন ধরে অভিজ্ঞতালব্ধ অসংখ্য বিচিত্র তথ্য ইনপুট হিসেবে আসতেই থাকে আর সেইসব তথ্যগুলো থেকে মস্তিষ্ককে মানে খুঁজে নিতে হয়। মস্তিষ্কের এইসব কার্যাবলীর কারণে আমরা বাস্তবতাকে সনাক্ত করতে পারি। আমরা যদি আমাদের মস্তিষ্কের অপারেটিং সিস্টেমের দিকে তাকাই তাহলে যা পাবো তা অনেকটা এমন –
DESPISE CHAOS, CREAT ORDER
(বিশৃঙ্খলতা ভেঙে শৃঙ্খলতা ফেরাও)
এটাই হলো মস্তিষ্কের মূল প্রোগ্রাম। এজন্যই আমাদের ব্রেইন বিশৃঙ্খলতার বিরুদ্ধে এবং শৃঙ্খলতার পক্ষে কাজ করে।
কেউ যদি পিয়ানোতে উলটাপালটা নোট বাজায় তাহলে তা আমদের কাছে বিরক্তিকর লাগে। কিন্তু নোটগুলোকে যদি গুছিয়ে বাজানো হয় তাহলে তা কত মিষ্টি লাগে। জিগসো পাজল সাজিয়ে কিংবা দেয়ালের ছবি সোজা করে আমরা একই আনন্দ পাই। গোছানো ব্যবস্থার প্রতি আমাদের এই টান আমাদের ডিএনএ-তে প্রোথিত।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
মানুষে সেরা উদ্ভাবন হচ্ছে কম্পিউটার। এর কাজই হচ্ছে এলোমেলো তথ্য থেকে সুবিন্যস্ত অর্থ বের করা। বা বলা যেতে পারে বিশৃঙ্খল তথ্যগুলোকে সুশৃঙ্খল করা। এই কম্পিউটারকে যদি মানবজাতির সবচেয়ে বড় দুটি প্রশ্ন করা হয় যা জন্মাবধি আমাদের মৌলিক জিজ্ঞাসা হয়ে টিকে আছে, “আমরা কোথা থেকে এসেছি এবং কোথায় যাচ্ছি?”; কম্পিউটারের জবাব হবে –
Insufficient Data For Accurate Response
(সঠিক উত্তরের জন্য পর্যাপ্ত তথ্য নেই )
কিন্তু আমাদের মস্তিষ্কের মত জৈব কম্পিউটারকে যদি প্রশ্ন করা হয় যে আমরা কোথা হতে এসেছি, আমাদের চিন্তায় কিছু ছবি ভেসে উঠবে। ঈশ্বর আদমের ভেতর প্রাণ সঞ্চার করছেন, প্রমিথিউস মাটি দিয়ে মানুষ বানাচ্ছেন, ব্রহ্মা তার নিজের শরীরের অংশ দিয়ে মানুষ বানাচ্ছেন, এক আফ্রিকান দেবতা মেঘ সরিয়ে দু’জন মানুষকে মাটিতে নামাচ্ছেন, নর্স দেবতা পানিতে ভেসে থাকা কাঠ থেকে মানুষ বানাচ্ছেন।
আর যদি জিজ্ঞেস করা হয় আমরা কোথায় যাবো তাহলে – স্বর্গ, নরক, মিশরীয় মৃত্যুর বইয়ের কিছু হায়ারোগ্লিফিক লেখা, গ্রিকদের ইলাইসিয়াম, ক্যাবালিস্টদের গিলগুল নেশামত, বুদ্ধ আর হিন্দু ধর্মের পুনর্জন্ম, সামারল্যাণ্ডের থিওসফিক্যাল বৃত্ত; দেখতে পাবো।
মানব মস্তিষ্কের জন্য কোনো উত্তর না থাকার চেয়ে কোনো না কোনো উত্তর থাকাটা শ্রেয়। ‘অপর্যাপ্ত তথ্য’ আমাদের জন্য অস্বস্তিকর। তাই অবশেষে আমাদের মস্তিষ্ক তথ্য বানিয়ে আমাদের পরিবেশন করতে শুরু করে। এই বিভ্রম জন্ম দেয় নতুন দর্শন, পুরাণ এবং ধর্ম যেগুলো আমাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে অদেখা ভুবন বলে কিছু আছে।
“বিশ্বাস” সংজ্ঞানুযায়ী হতে হবে অদৃশ্য আর অনির্দিষ্ট কিছুর উপর, এমনকিছু আছে বলে মেনে নিতে হবে যার কোন বাস্তব প্রমাণ নেই। তাই সার্বজনীন কোনো সত্য না থাকায় আমরা একেকজন একেক জিনিসে বিশ্বাস আনছি। বিশ্বাসের ভেদাভেদের জন্য একে অপরের প্রতি জাতিগত ঘৃণা-বিদ্বেষের জন্ম হয়েছে।
বিজ্ঞান বিশ্বাসের বিপরীত। বিজ্ঞান মানেই এখন পর্যন্ত অজানা অথবা অনির্দিষ্ট কিছুর বাস্তবিক প্রমাণ খুঁজে বের করা এবং চাক্ষুষ সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণা দূর করা। যখন বিজ্ঞান কোন উত্তর দেয়, সে উত্তর সার্বজনীন। মানুষ এ নিয়ে যুদ্ধে জড়ায় না বরং এর উপর নির্ভর করে।