ইতিহাসসত্যপীর

ভারতবর্ষের ইতিহাস – পর্বঃ ২

লিখেছেনঃ সত্যপীর

বাদশাহী সফর

 

পাঠ্য পরিচিতি

ইয়োস গমানস রচিত Mughal Warfare বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ের কিছু অংশের ছায়ানুবাদ।

মুঘলদের ব্যয়বহুল সফর

মোঘল বাদশাদের সবসময়ই ধারণা ছিল সফরের সময় পাত্রমিত্রসিপাইসান্ত্রী কাঁধে নিয়ে ঘুরলে বিপদেআপদে কাজে আসবে। সফরের মূলমন্ত্র ছিল গতি, থামা চলবে না। বলা হত এমনকি চমৎকার দিলখোশ নদীর পারের সূর্যাস্তের ভিউওলা স্থানেও এক রাতের বেশী দুরাত আরাম করে তাঁবু গেড়ে বসা যাবেনা অযথা। আওরঙ্গজেব বলেনঃ “সম্রাটের কখনোই আয়েসে গা ঢেলে আরামে মত্ত হওয়া যাবেনা। এভাবেই একের পর এক দুর্বল রাজ্য হার মেনেছে। সবসময় চলার উপর থাকতে হবে যথাসম্ভব। উত্তম রাজা বহমান পানির ধারার মতই, থেমে গেলে সর্বনাশ।”

আওরঙ্গজেব এই সর্বদা দৌড়ের উপর থাকার পলিসি খাটিয়ে নিজের বাপকেও কোণঠাসা করে এনেছিলেন, পিতা শাজাহান আগ্রা আর দিল্লীতেই ছিলেন গ্যাঁট হয়ে বসা।

মোগলেরাই দুনিয়ার সবার আগে দেশচালনায় সফরকে গুরুত্ব দিয়েছে তা মোটেই নয়। পুরান ভারতবর্ষে আমরা ঘোড়া বলি দেবার গল্পে দেখি তাগড়া ঘোড়াকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে আর রাজা তার পিছু পিছু চলেছেন যেন ঘোড়া সুরক্ষিত থাকে। সফর শেষ করে ঘোড়া ফিরে এলে তবেই তাকে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেয়া হত। সর্বদা চলার উপর থাকতে হবে এই তত্ত্বে মধ্য এশিয়ার যোদ্ধারাও বিশ্বাস করত, বিশেষত চেঙ্গিস খাঁ আর আমির তৈমুর। সেই দীক্ষায় দীক্ষিত উজবেক শাসক বুখারার সায়বানি খাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় তার রাজধানী কোথায়, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন আমাদের রাজধানী আমাদের ঘোড়ার জিন।

আকবর বাদশার সবকিছুই হত হিসেব করে, ঝোঁকের মাথায় ছক না কষে তিনি এগুতেন অল্পই। যেকোন মুহুর্তে যুদ্ধযাত্রার জন্য তার মজুত থাকত “পাঁচশত হাতি আর মালবহনের জন্য একশত সারি ঘোড়া আর উট, প্রতি সারিতে দশটি করে।” আবুল ফযল পাতার পর পাতা বকবক করে গেছেন বর্ণনা দিয়ে যে আকবর বাদশা ছিলেন এক অক্লান্ত নেতা যার অত্যন্ত পেয়ারের বিষয় ছিল শিকার করা আর যার “হৃদয় কখনই একস্থানে বাঁধা পড়ে থাকেনি”। মোগলাই ফৌজের গতি নিয়েও তিনি বিস্ময়কর দাবী করে গেছেন, ১৫৭৩ এর অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে আকবরের গুজরাট অভিযান নিয়ে। এই ব্লিৎজক্রিগে আকবর তিন থেকে চারশো সিপাই নিয়ে বিশ হাজারের ওপর বিদ্রোহী দমন করেন শোনা যায়, ফতেপুর সিক্রি থেকে ৮০০ কিমি দূরে যেখানে কাফেলা নিয়ে যেতে দুতিন মাস লেগে যাবার কথা সেখানে এই ফৌজ পথ পাড়ি দিয়েছিল নয় দিনে। তবে সেসব যুদ্ধের সময়ের কথা, সাধারণ সফরে ফৌজ মালপত্তর কাঁধে নিয়ে এগুত দিনে দশ থেকে বিশ কিমি।

চার বাদশা – আকবর, জাহাঙ্গীর, শাজাহান আর আওরঙ্গজেব মোটামুটি শতকরা ৬৫ ভাগ সময় থিতু অবস্থায় ছিলেন, রাজধানীতে বা অন্য কোথাও  বছরে ছয় মাসের অধিক (যুদ্ধকালীন দীর্ঘ অবস্থান ব্যতিত)। বাকি ৩৫ ভাগ সময় তারা ছিলেন সফরে। এই পরিসংখ্যান আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় মিলে যায় সাফাভিদ রাজা প্রথম শাহ আব্বাসের ওপর করা মেলভিলের পরিসংখ্যানের সাথে, আব্বাস এক তৃতীয়াংশ সময় রাজধানীতে, এক তৃতীয়াংশ সময় অন্য স্থানে স্থির আর এক তৃতীয়াংশ সফরে কাটাতেন। এই সাফাভিদ আর মোগল সফরের সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই অটোমান শাসকদের থেকে অনেক উপরে, অটোমানেরা রাজধানীতেই সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। তবে এস্থলে বলে রাখা দরকার, সাফাভিদদের মতই মোগলেরা ইচ্ছেমত রাজধানী পাল্টাতো, বা সঠিক করে বলতে হয় যেখানে বাদশা সেটাকেই রাজধানী ঘোষণা করে দিত।

মোগলেরা প্রায় চল্লিশ শতাংশ সময় কাটাত মধ্যভারতের রাজধানীতে (দিল্লী, আগ্রা বা ফতেপুর সিক্রি), দশভাগ সময় উত্তরের রাজধানীতে (লাহোর, কাশ্মীর, কাবুল আর হাসান আবদালঃ হাসান আবদাল বর্তমান পাকিস্তানের উত্তর পাঞ্জাবের ছোট শহর। মাথাগরম মুসলমান পীর ওয়ালী কান্দাহারী এইখানে এক পাহাড়ে ডেরা বেঁধে থাকতেন, তার অপর প্রচলিত নাম হাসান আবদাল নামে শহরের নাম রাখা হয়। শোনা যায় শিখ গুরু নানকের সাথে হাসানের ব্যাপক ভেজাল লেগেছিল পানি সাপ্লাই কে কেন্দ্র করে।) আর পনেরোভাগ সময় কাটত দক্ষিণের রাজধানীতে (আজমীর, মান্ডু, বুরহানপুর বা দাক্ষিণাত্যে আওরঙ্গজেবের বিভিন্ন “স্থায়ী” ক্যাম্পে)।

শাসনের শেষদিকে আওরঙ্গজেব প্রতিটি যুদ্ধে থাকতে পছন্দ করতেন, এই জিনিসটি দেখা গিয়েছিল তরুণ আকবরের মধ্যে। পরে অবশ্য আকবর যুদ্ধের অংশটা তার ছেলেপেলে আর জেনারেলদের মধ্যে ছেড়ে দিয়েছিলেন, আর তিনি প্রতিটা যুদ্ধে স্ট্র্যাটেজিক দূরত্ব বজায় রেখে নজর রাখতেন। এই দূরত্ব বজায় রেখে নেতৃত্বদানের ব্যাপারটা জাহাঙ্গীর আর শাজাহানও অনুসরন করতেন। যুদ্ধাভিযানের হাওয়া বুঝে রাজধানী নির্ণয় হত। দাক্ষিণাত্যের উপর নজরদারি রাখার উদ্দেশ্যে জাহাঙ্গীর আজমীর বা মান্ডুতে মাসের পর মাস কাটিয়ে দিতেন।

শাজাহানের চোখ ছিল উত্তরে, তিনি লাহোর বা কাবুলে নিয়মিত সময় কাটাতেন উত্তরভারতে মোগল প্রতাপ বাড়ানোর লক্ষ্যে। মোগল ফৌজের এইরকম উত্তর দক্ষিণে যাতায়াতের পথে চালু রুট ছিল কাবুল – লাহোর – দিল্লী – আগ্রা – আজমীর – মান্ডু – বুরহানপুর। আগ্রা থেকে পূর্বে বাংলা প্রদেশে যাবার পথ ছিল অত্যন্ত অল্প ব্যবহৃত, সম্ভবত স্থলপথের চেয়ে গঙ্গা যমুনা নদী বাহিত নৌপথে যাতায়াত সহজ ছিল বলে। পশ্চিমের তুলনায় এদিকে গ্রামেগঞ্জের লোকসংখ্যাও ছিল বেশি, ফৌজ মার্চ করে যাবার মত মাইলের পর মাইল ফাঁকা জমি ছিল পূবে কম।

মধ্যযুগে ইয়োরোপীয় ছোট বাহিনীর মতই মোগল ফৌজ খাবারের সন্ধান নিত স্থানীয় এলাকা থেকে। অল্প কিছু জায়গা (যেমন কাশ্মীর বা কাবুল) ছাড়া ভারতের যেকোন স্থানই মোগল রাজদরবার ও ফৌজকে ছয় মাসের অধিক সময় ধরে খাবার সরবরাহ করতে সক্ষম ছিল। মোগল সিপাই খেতও অল্প, ফরাসী পর্যটক তাভের্নিয়ে বলে গেছেনঃ

“আমাদের একশ সৈন্য এদের হাজার সিপাইকে চোখবুঁজে হারিয়ে দিতে পারবে সত্য কথা, কিন্তু এ ও খেয়াল করা প্রয়োজন যে এই পরিবেশে আমাদের সিপাই টেকার সম্ভাবনা কম। ঘোড়সওয়ার আর পদাতিক দুইজনেই অল্প চিনি ময়দা নিয়ে ঘোরে, আর ঐ দিয়ে বল বানায়। চালডাল যোগাড় হলেই এরা খিচুড়ি বসিয়ে দেয়, আর ঘিয়ের বাটিতে আঙুলের ডগা ডুবিয়ে পটাপট চালডালনুনের এরকম নিরামিষ খিচুড়ি মেরে দেয়।”

সফরের আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক পয়সাকড়ি। সওদাগরেরা নিয়মিতই ঘুরঘুর করত মোগল সফরে টাকার থলি হাতে। যুদ্ধযাত্রা ও অন্যান্য সফরে টাকার নিশ্চিত যোগান ঠিক রাখতে স্ট্র্যাটেজিক স্থাপনায় বসে রাজকোষ। আগ্রার দূর্গ ছিল মূল ধনভান্ডার, এছাড়া ট্রেজারি খোলা হয় গোয়ালিওর, নানওয়াড়, আসিরগড় (বুরহানপুর), রোহতা আর লাহোরে। বাদশা নিজেও অঢেল পয়সাকড়ি নিয়ে সফরে যেতেন, মানুচ্চির মত মেনে নিলে আওরঙ্গজেব ৩০০ উটের পিঠে ছাপ্পান্নো হাজার পাউন্ড রূপা আর আঠাশ হাজার পাউন্ড সোনা নিয়েছিলেন কাশ্মীর যাবার সময়। এই ধনসম্পদ পথে খরচ হত প্রচুর, তাই মোগল সফর উপলক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানের ব্যবসাবাণিজ্যও ফেঁপে উঠত।

ভারতবর্ষের ইতিহাস

মোগলাই সফর মোসুম মেনে চলত মোটামুটি। যদিও তাদের শীতগ্রীষ্ম যেকোন সময়ই সফর সম্ভব ছিল ভারতে, তবু তারা গরমে উত্তরে আর শীতে দক্ষিণে থাকতে পছন্দ করত। যেমন হুমায়ুনের পর সব মোগল বাদশাই কাবুল বাস করতেন মে থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে, ঐটে উত্তরের উপজাতিদের কাছ থেকে যুদ্ধের ঘোড়া খরিদ করার উত্তম সময়। সেরকম কাশ্মীর ছিল গরমের সময়ের পয়লা পছন্দ। সফর মানেই রাস্তা নির্মান আর পথে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। সফরের পূর্বেই পাই পাই হিসেব হত দূরত্ব আর সময়ের ব্যাপারে। ফৌজ যেহেতু প্রায়ই ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ি পথে যেত, সম্মুখের দলের প্রথম কাজ ছিল ঝোপঝাড় সাফ করে পাহাড় কেটে রাস্তা সমান করা।

১৫৮৫ সালে কাবুল যাত্রার সময় আকবর আগ্রা দূর্গের মূল ইঞ্জিনিয়ার কাশিম খাঁ কে হুকুম দেন সিন্ধু পর্যন্ত রাস্তা তৈরি করতে হবে, নদীর ওপর ফৌজি যাতায়াতের মতন পোক্ত সেতু গড়তে হবে আর খাইবার পাসের মধ্য দিয়ে যাবার মত পথ বানাতে হবে। আবুল ফযলের মতে এই অভিযান নাকি মধ্য এশিয়ায় এতই ব্যাপক ভয়ের জন্ম দিয়েছিল যে বলখের সদরফটক বন্ধ করে রাখা হয় ভয়ে। একই লোক পরে কাশ্মীর যাবার প্রশস্ত রাস্তা তৈরি করেন মোগলাই বাদশার সফরের উপযোগী করে। এই রাস্তার বিরাট প্রশংসা করে আকবর ইরানের শাহ কে চিঠি লেখেন।

বাদশাহি সফরে এত লোকলস্কর পাইকপিয়াদা চাকর নফর হাতি ঘোড়া থাকত যে এর গতি দ্রুত হবার সম্ভাবনা ছিলনা বললেই হয়। গড়ে ১৬ কিমি এগোত কাফেলা, কিছু কিছু দিন ছিল পূর্ণ বিশ্রাম তাই ঐটা হিসাবে নিলে দল এগোত দিনে গড়ে ৮ কিমি। অবশ্যই এলাকা আর মৌসুম অনুযায়ী এর বেশকম হত। আর মূল ফৌজের গতি ছিল এর চেয়ে অনেক দ্রুত, দরবারে সমন পাওয়া মনসবদারেরা এগোত দিনে প্রায় ৩০ কিমি। চিঠিবাহকেরা কখনো কখনো দিনে ১২৫ কিমিও দৌড়াত।

তাই সফর হত সাধারণত অবিশ্বাস্য সংখ্যক মানুষের ধীরলয়ের যাত্রা। দেশের দৈনন্দিন যাত্রার এতে কোন হেরফের হতনা। দরবারের কেরানীরা সফরে বাদশার সাথেই ঘুরতেন। মানুচ্চি বলে গেছেন এদের আশিটা উট আর ত্রিশ হাতি লাগত সরকারী কাগজপত্তর বহনের জন্য। এই সফর বিজ্ঞাপনও ছিল বটে। ধুলো উড়িয়ে ঢোলসহরত বাজিয়ে হাতি ঘোড়া জৌলুষ দেখিয়ে গ্রামকে কে গ্রাম এগিয়ে যাওয়া বাদশাহী সফর দেশের লোকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিত দেশটা কার শাসনে। এছাড়া এই কাফেলা সারা দেশের রঙবেরঙের মানুষের মিলনমেলাও বটে, বিদেশী মনসবদার এখানে মিশত দেশী জমিদারের সাথে।

এই মোগল তাঁবু এক নূতন পরিবেশ তৈরি করল যা না পারসীক না মধ্য এশিয়ান না ভারতীয় না মুসলিম না হিন্দু, সব মিলিয়ে এক অভূতপূর্ব অনন্যসাধারন ককটেল। এই পরিবেশ কেমন ছিল তার খানিক আঁচ পাওয়া যায় মোগল আমীরের বর্ণনায়ঃ “যদিও অনেক নামাজকালাম আর রোজা রমজান ছিল ক্যাম্পে; জুয়া, সমকাম, মদ আর ব্যভিচারও চলত অগাধ।”

মোগল ক্যাম্পে পড়াশোনারও ব্যবস্থা ছিল, ক্যাম্পের অধিকাংশ গুনতে আর লিখতে জানতেন একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত। তাঁবুর ভাষা ছিল এক জগাখিচুড়ি, জবান-ই-উর্দু-ই-মুয়াল্লা, সহজভাবে উর্দু। এই উর্দু ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানীয় ভাষার ককটেল, সাথে মিশেছে পারস্যের ফার্সি।

শিকার ছিল সফরের অন্যতম অংশ। প্রায়ই রাজাগজার শিকারের ছবি বা বর্ণনা আমরা দেখতে পাই। এই শিকার হত মূল কাফেলা থেকে সরে এসে, বাদশা পাত্রমিত্র উজিরনাজির যখন শিকারে ব্যস্ত মূল কাফেলা তখন কাছেই ধীরলয়ে এগিয়ে চলেছে। বাদশার নিজস্ব শিকার দলে সাধারণত এক হাজারের মত সিপাই থাকত, বাকিরা মার্চে। কঠিন নিয়মের গন্ডিতে বাঁধা দরবার জীবনের বাইরে হাল্কা পরিবেশে মেতে উঠতেন সম্রাট। শিকারে সম্রাট নিতেনও বাছা বাছা পেয়ারের লোক।

অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-

তবে শিকার শুধুই আনন্দের জন্য মনে করলে ভুল হবে, শিকার যোদ্ধার ট্রেনিংক্যাম্পও বটে। বন্য হিংস্র জানোয়ার ধরে বেঁধে ছোট বৃত্তে ছেড়ে দেয়া হত, আর শুরু হত শিকার। চতুর্দিকে হিংস্র জন্তু সামলে এদের শিকার করার অভ্যেস মোগলদের কাজে লাগত যুদ্ধক্ষেত্রে যখন শত্রু তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। শান্তিকালীন সময়ে শিকার তাই ছিল তাদের প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড।

তাই মোগলদের কাছে শান্তিকালীন সফর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে দেশের অর্থনীতি চাড় দিয়ে উঠত, রাস্তাঘাট সেতু তৈরি হত, প্রত্যন্ত অঞ্চলের শাসকের সাথে দেশের শাসকের দেখা হত আর মোগলাই জাঁকজমক সারাদেশে খোলতাই করে দেখানো হত। অগাস্টিন হিরিয়ার্ট জাহাঙ্গীরের কাফেলা নিয়ে বলে গেছেনঃ

“এই রাজার পয়সা কল্পনার অতীত। তিনি যখন সফরে যান সাথে থাকে পনেরো লক্ষ মানুষ, ঘোড়সওয়ার, পেয়াদা, অফিসার, নারী, শিশু। সাথে যায় দশ হাজার হাতি আর বিপুল গোলন্দাজের দল, যদিও অধিকাংশ সময়ই পয়সার চমক দেখানো ছাড়া এই এত কান্ড কারো কোন কাজে আসে না।”


পুরাতন খানাখাদ্য

 

পাঠ্য পরিচিতি

লিজি কলিংহ্যাম রচিত Curry: A Tale of Cooks and Conquerors এর কিছু অংশের ছায়ানুবাদ।

রকমারী খাবার

প্রতিদিন দুপুর বারোটায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুরাট কুঠির ইংরেজ অফিসারেরা বিরাট হলরুমে খেতে বসতেন লাইন ধরে। এক চাকর বদনা হাতে ঘুরে ঘুরে সকলের হাত ধুইয়ে দিত। ১৬৮৯ সালে জন অভিংটন নামে এক পাদ্রী খেতে বসেছিলেন ঐ খানাঘরে বাকীদের সাথে। ঝরঝরে চাউলের পুলাউ পরিবেশিত হয়েছিল, দানাগুলো একে অপরের সাথে লেগে ধরেনি আর তাতে মেশানো ছিল চৌদ্দরকম মশলা। টেবিলে আরো ছিল “দমপোখত”, মুর্গীর ভিতর কিসমিস বাদাম ঠেসে ভরে কড়াইয়ে ঘিতে চুবিয়ে রান্না হত এই খাবার। আরো ছিল কাবাব, নুন গোলমরিচ রসুন মাখা গরু আর খাসির গোস্ত তেলে ভাজা, যার “প্রতিটি টুকরার ভিতর মেশানো থাকত নানান মশলা।”

১৬৮৯ এ অভিংটন সায়েব যখন এই এলাহি খানাদানার আয়োজনে বিহ্বল, সুরাট তখন আওরঙ্গজেব বাদশার শাসনাধীন মোগল সাম্রাজ্যের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। ইয়োরোপীয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিগুলোও ঘুরঘুর করত ঐখানেই। পর্তুগীজ মসলার রমরমা একচেটে বাণিজ্য ততদিনে ওলন্দাজ, ইংরেজ আর ফরাসী থাপড়ে বাগিয়ে নিয়েছে, তারা যে যার মত কুঠিও গড়ে নিয়েছে শহরে। কোম্পানির অফিসারদের থাকার জায়গা আর চালানের মাল রক্ষণাবেক্ষণের গুদামঘর মিলিয়ে পুরো জায়গাটিকে ডাকা হত ফ্যাক্টর বা ফ্যাক্টরি, অর্থাৎ কুঠি।

সুরাট কুঠির দিনপঞ্জি লিখে গেছেন জার্মান ড্যুক অফ হলস্টাইনের পত্রবাহক আলবার্ট ম্যানডেলসো। ১৬৩৮ সালে ড্যুকসায়েব পারস্যে ম্যানডেলসোকে পাঠান সিল্ক ব্যবসার ধান্দায়, সেইখানে দুই ইংরেজ সওদাগরের মুখে ভারতের লোভনীয় বাণিজ্যের গল্প শুনে ওদিকেই হাঁটা দেয়া মনস্থ করেন, সাথে ছিল তিন জার্মান ভৃত্য আর এক পারসীক গাইড কাম দোভাষী। কুঠির মানুষ বোর্ডিং হাউসের মত বাঁধাধরা রুটিন মাফিক চলত। প্রত্যেক দিন দুইবার ঘড়ি ধরে গীর্জায় যেত সবাই, ভোর ছয়টায় আর রাত আটটায়।

রোববারে আবার মাহফিল হত তিনটে। ভোরের ধর্মকর্মের পরে লোকে কাজে লেগে যেত, ম্যানডেলসো দেখেছেন যে “প্রত্যেকেই কিছু না কিছু করছে, সকলেরই কাজ বাঁধা।” যার যার কাজের জায়গাও নির্দিষ্ট। কুঠির সকলেই ঘড়ি ধরে একসাথে খেত, আর পঞ্চাশ বছর পরের অভিংটনের মত তিনিও দেখেছেন যে খাওয়া হয় “একটি রুমে বিরাট গ্র্যান্ড টেবিলে, তাতে মিষ্টান্ন ছাড়াও থাকে কমপক্ষে পনেরো ষোল পদের মাংস।” প্রতিদিন রাতের খাবারের পর কুঠির কর্তা, তার পরেরজন, প্রধান সওদাগর আর গণ্যমান্য কেষ্টবিষ্টুরা সাগরের ধারে হাওয়া খেতে যেতেন।

অবসর সময়ে সওদাগরেরা মোগলদের মতই সময় কাটাতেন বাগানে বেড়িয়ে কি হুক্কা টেনে। চতুর্দিকেই ছড়ানো ছিল লালপানি আরক। এই আরক পাঞ্চ খেয়েই সর্বদা টাল হয়ে থাকতেন মাতাল বাদশা জাহাঙ্গীর। ইয়রোপীয়রা এই আরক খেত জালা জালা, এক ভোজের দিন ম্যানডেলসো খেয়াল করে দেখেন কুঠির সবাই খাচ্ছে “পেইলপান্টজ” নামে এক ড্রিঙ্ক, যা প্রস্তুত হত আরক, গোলাপজল, লেবুর রস আর চিনি মিশিয়ে। ইংরেজ এই ককটেল ড্রিঙ্ককে ডাকত “পাঞ্চ”। ১৮২০ সালের ইন্ডিয়ান আর্মির ল্যুটেন্যান্ট ম্যাথিউ ক্যাম্পবেল লিখে গেছেন মিল্ক পাঞ্চের রেসিপিঃ

তিরিশটি লেবুর খোসা দুই বোতল আরকে চুবিয়ে রাখ ১২ ঘন্টা। তারপর মদ ছেঁকে আলাদা কর আর তাতে দাও দশ বোতল আরক আর ছয় বোতল ব্র্যান্ডি কি রাম। তাতে ডুবাও আড়াই বোতল লেবুর রস, আটটা জায়ফল পেষা আর ১২ পাউন্ড চিনি। এছাড়া দাও আট কোয়ার্ট কাঁচা দুধ আর ১৪ কোয়ার্ট ফুটন্ত পানি, পুরোটা মেশাও বিরাট এক হাঁড়িতে। আধ ঘন্টা ধরে নাড় আর ঠান্ডা হয়ে এলে পরে ছেঁকে বোতলে ভর।

ভারতীয়দের কাছ থেকে তাদের পান খাবার অভ্যাস হয়েছিল। ভারতে নয়া আগতরা মাঝে মাঝে ব্যাপক ভয় পেত দেখে যে লোকে কফের সাথে থু থু করে রক্তের মত লাল কি একটা ফেলছে। তা ছিল পানের পিক, এই পান ভারতীয়রা সারাদিন চিবাত। মোগলেরা তাদের হিন্দুস্তানি প্রজাদের কাছ থেকে পান খাওয়া শেখে, পান খেলে নাকি দাঁতের মাড়ি শক্ত থাকে হজমবৃদ্ধি হয় ইত্যাদি।

ইশটিং পিশটিং করতেও পান সহায়ক ছিল বলে লোকে বিশ্বাস করত, এক পারসীক দূত বলে গেছেন যে বিজয়নগরের রাজার হেরেমের ৭০০ রাণী রাজকন্যে রক্ষিতার দৈনিক পান খাওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। রমরমিয়ে শাসন চালানোর পাশাপাশি খানাখাদ্যে মোগলেরা উত্তর ভারতে তাদের ছাপ যত সহজে রেখে গেছে দক্ষিণ ভারতে তা হয়নি। ষোড়শ আর সপ্তদশ শতাব্দীতে দক্ষিণ ভারত তাদের নিজেদের রান্নার কেতা চালু রাখে। বৈষ্ণব হিন্দু মন্দিরগুলোয় যেমন নিয়মিত রাঁধা হত তাদের নিজস্ব রেসিপির খাবার।

হিন্দু মন্দিরগুলো তাদের আশপাশের এলাকাগুলোর জন্য ছিল একাধারে জমির মালিক, কাজের মালিক, ব্যাঙ্ক, ইস্কুল, মিউজিয়াম, হাসপাতাল আর থিয়েটার। প্রায়শই এসব মন্দির গড়ে উঠত পাহাড়ের চূড়ায়, আর পাথরের সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে তাতে উঠত ভক্তের দল। পয়সাওলা ভক্তেরা দান করে আবার সিঁড়ির পাথরে খোদাই করে দিত তাদের উপহারের বর্ণনা।

মন্দিরের নিরামিষ আর মিষ্টান্ন রেঁধে প্রথমে দেওতার উদ্দেশ্যে রাখা হত, তারপর বিলিবন্টন হত এলাকার লোকদের মাঝে। দুধ আর তরল তরকারি যা বাঁটোয়ারা করা ব্যাপক ঝামেলার কাজ, তা যেত মন্দিরের পুরুতপান্ডার ভোগে। আজও মন্দিরে সেই পুরাতন রেসিপি ধরে রান্না করা হয়। দক্ষিণ ভারতের রেস্তোরাঁয় কার্যরত প্রচুর কুক রান্না শিখেছে মন্দিরের পাকশালা থেকেই। উদুপি মন্দিরে আজও ভক্তেরা ঘন ডাল খায় তেঁতুলটকে সিদ্ধ করা কুমড়া ফালি দিয়ে। সেই ডালে দেয়া হয় ঝাল মরিচ, মসুর ডাল, ধনেপাতা, মেথি, সর্ষেবিচি আর তেজপাতা ভাজা। বিশাল হাঁড়িতে রেঁধে কলাপাতায় পরিবেশিত হয় সেই খাবার, সবাই খেয়ে উঠে গেলে সেখানে গরু ছেড়ে দেয়া হয় সেই উচ্ছিষ্ট কলাপাতা খেয়ে সাফ করার জন্য।

মন্দিরের আরেক বৈশিষ্ট্য মিষ্টি। মোগল আমলে গেন্ডারি ছিল গুরুত্বপূর্ণ ফসল, মেলা পয়সা ছিল গেন্ডারি ব্যবসায়। ভক্তেরা নিজেদের উৎপন্ন গেন্ডারি দানও করত প্রচুর মন্দিরে মন্দিরে, তাই দিয়ে তৈরি হত অঢেল মিষ্টি। ডালের মত তরল পদার্থের বদলে মিষ্টি পরিবিহন আর বিতরন করা ছিল অনেক সহজ।

উত্তর ভারতও বিখ্যাত ছিল মন্দিরের প্রসাদের জন্য। ইংরেজ জাহাজের কাপ্তেন আলেক্সান্ডার হ্যামিলটন উড়িষ্যার জগন্নাথ মন্দিরে “দৈনিক শ পাঁচেক পান্ডাপুরুত ডাল আর ভাত রাঁধে ভগবানের জন্য। এছাড়া তৈরি হয় আটশ কেজি ওজনের পাঁচটি মিষ্টির চাঁই, তা দেবতার সামনে রেখে পুজোপাট সেরে পরে বড়লোক ভক্তদের কাছে বিক্রি হত কিছুটা, যা রয়ে যেত তা যেত গরীবের হাতে।”

ভক্তের কাছে মিষ্টি শুধুই খাবার ছিলনা, তা ছিল ঘরে বয়ে নিয়ে যাওয়া দেবতার আশির্বাদ। সেই মিষ্টিতে একগাদা চিনি আর তেঁতুল দেওয়াতে তা টিকেও থাকত অনেক দিন নষ্ট হবার বদলে। ধীরে ধীরে দক্ষিণেও মোগলাই খানা ঢুকে পড়ে। ১৬৩০ সালে শাজাহান হায়দ্রাবাদ জয় করেন, তবে বেশীদিন তা ধরে রাখতে পারেননি। এক শতাব্দী পরে মোগল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে থাকে আর গভর্নর নিজাম উল মুল্ক হায়দ্রাবাদের স্বাধীন নেতা হয়ে বসেন। ততদিনে মোগলাই খানা হায়দ্রাবাদে ঘাঁটি গেড়ে ফেলেছে।

লখনৌতে গল্প চালু আছে অযোধ্যার শেষ নবাব ওয়াজি আলি শা একবার দিল্লীর প্রিন্স মির্জা আসমান কাদেরকে দাওয়াত দেন। মির্জা সায়েব আবার ছিলেন ব্যাপক খাদ্যরসিক। তিনি খেতে বসে বেছে নিলেন মশলাদার মোরব্বা, কিন্তু কামড় দিয়ে তিনি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেন আরে এতো মোরব্বা নয় মাংসের কাবাব! ওয়াজি আলি শা তো ভারি খুশি মীর্জাকে জব্দ করে।

মির্জা দিল্লী ফিরে গেলেন মতলব আঁটতে আঁটতে যে কি করা যায়। পরে তিনি ওয়াজি আলিকে দাওয়াত দিলেন একদিন। ওয়াজি আলি মুখে দিয়ে অবাক হয়ে দেখেন সব খাবারঃ পুলাউ, বিরিয়ানি, মাংসের তরকারি, কাবাব চাটনি আচার সবই আসলে তৈরি করা হয়েছে চিনির ডেলা দিয়ে, দেখে বোঝার কোন উপায়ই নেই! অযোধ্যার নবাব হার মানলেন। তবে মোগলের বিদায় ঘন্টি ততদিনে বাজা শুরু হয়ে গিয়েছে, নবাব লখনৌকে দিল্লীর সমান সমান করতে মন দিলেন। প্রথম প্রথম লোকের তা পছন্দ হয়নি, দিল্লীর কবি মীর তকী মীর লিখে গেছেনঃ

“দিল্লীর ধ্বংসাবশেষও যেন দশগুণ ভালো লখনৌ এর চেয়ে, লখনৌ আসার পূর্বে আমার কেন মরণ হল না?”

তবে লখনৌ এর ব্যাপক পয়সাকড়ির টানে ঠিকই একে একে হাজির হয় গাতক বাদক কবি জাদুকরের দল, যেন মোগল দিল্লীরই আরেক সংস্করণ। পাচকেরাও হাঁটা দিল লখনৌর দিকে, ম্যালা মাইনের চাকরি জুটল তাদের। এক কুতুব তো নাকি তার পাচককে মাসে বারোশ রুপি দিতেন বেতন, ভারতের ইতিহাসে রান্না করে কেউ অত টাকা চোখে দেখেনি। এমনকি কবি মীর তকী মীরও তার মত পাল্টে পরে লিখেছিলেনঃ

“লখনৌ দিল্লীর চেয়েও চমৎকার, তাই আমার মন চলে সেই পানে।”

লখনৌবাসী ক্রীম প্রচন্ড ভালবাসত, তারা মোগলাই কুরামা বা কোরমা ক্রীম দিয়ে রাঁধল। কোরমাতে ব্যবহৃত হত অত্যুৎকৃষ্ট খাসির চাক, অথবা মুর্গি। মোগল কেতায় কোরমা রাঁধা হত পারসীক টেকনিকে, দইয়ে মাংস জিরিয়ে আদা রসুন পেঁয়াজ দিয়ে কষা। এতে পেস্তার গুঁড়োও দেয়া হত। লখনৌতে তারা এর মধ্যে ঢালল হাতাখানেক ক্রীম, এমনকি সামান্য ডালের মধ্যেও তারা ক্রীম দিয়ে জাফরান ছিটিয়ে এলাহি কারবার করত।

এছাড়া অযোধ্যা বিখ্যাত ছিল উত্তম চালের ভাতের জন্যে। লখনৌবাসীর জানের খাবার ছিল পুলাউ। দিল্লিতে বিরিয়ানি ছিল পয়লা পছন্দ, যা কিনা আসলে অধিক মশলাযুক্ত পুলাউ। লখনৌতে বলা হত “ভালো বিরিয়ানি হল মোটামুটি পুলাউয়ের সমান”। বিরিয়ানির ঝাঁঝালো মশলা সুগন্ধী ভাতের বাস সরিয়ে দিত বলে তারা এটাকে মোটেই ভালো চোখে দেখত না, লখনৌবাসীর মতে বিরিয়ানি হল পুলাউয়ের তুলনায় অযথা জবরজং খাবার।

বিশপ রেজিনাল্ড হেবারকে যখন অযোধ্যায় পুলাউ দেয়া হয় তখন তিনি আনন্দের সাথে লক্ষ্য করেন যে ঢাকার নবাবের পরিবেশিত বিরিয়ানির তুলনায় এই পুলাউ “অসম্ভব চমৎকার, সুস্বাদু এবং মোটেই তেল ঘি দিয়ে পরিপূর্ণ নয়”। হেবার লক্ষ্য করেন যে “এই অংশের উচ্চবর্ণের মুসলমানেরা বাঙালি আর হিন্দুর তেল চপচপে খাবার মারাত্মক নিচু নজরে দেখে, আর তাদের বরং পছন্দ অল্প মশলাযুক্ত শুকনো সুবাসিত খাদ্য”।

খাবার সুবাসিত করার উদ্দেশ্যে লখনৌ এর বাবুর্চিরা মুর্গিকে রাঁধার আগে শুধু কস্তুরি আর জাফরান খাইয়ে রাখত। এই প্রচন্ড ব্যয়বহুল পন্থা টিকে ছিল কারণ লখনৌ এর কুতুবেরা টাকা উড়াতে খুবই পছন্দ করতেন, খানাদানার টেবিলে তাদের ফুটানি দেখাতে ভাল লাগত। তারা চমকে দেয়া খাবার ও ভারি পছন্দ করতেন, বাবুর্চিরা রাঁধত পুলাউ কিন্তু প্লেট দেখে মনে হত হীরেমোতি রাখা আছে সেখানে। এই টেকনিক সুদূর বোগদাদ নগরী থেকে এসেছে, রাঁধার আগে চাউল লবন পানিতে জিরিয়ে নিলে ভাত ক্রিস্টালের মত চকচক করে। অন্যান্য চাউল কড়া লাল বা সবুজ করে রাঁধা হত চুনি পান্না বানানোর জন্য। এমনকি তারা সাধারন খিচুড়িরও খোমা পাল্টে দিল, দুর্দান্ত রকম মেহনত করে পেস্তা মসুর ডালের সাইজে কাটা হত আর বাদাম কাটা হত ভাতের সাইজে, ঐ দিয়ে রাঁধা হত খিচুড়ি যা নাকি একবার খাইলে মরিয়া গেলেও সুখ।

লখনৌ এর একটি বিখ্যাত রান্নার কায়দা বেরিয়েছিল সময়ের প্রয়োজনে। ১৭৮৪ সালে অযোধ্যায় বিরাট দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, নবাব আসফউদ্দৌলা করেন কি হাজারে হাজারে লোক নিয়োগ করেন শিয়া ইমামবাড়া মসজিদ তৈরিতে। শহরের সৌন্দর্যবৃদ্ধিও হল আবার লোকের খাবারও মিলল। বাজারের বাবুর্চি, যাদের নানবাই ডাকা হত, তাদের হুকুম দেয়া হল দিনরাত কাজ চলবে অতএব ২৪ ঘন্টার যেকোন সময় চাহিবামাত্র মজুরদের খাবারের ব্যবস্থা করা চাই। তারা মোগল দম-পোখতের ব্যবস্থা করল, যা কিনা মুর্গি দমে রাঁধতে হয়। আইন-ই-আকবরিতেও এর রেসিপি বর্ণিত আছে। সুরাটের ফ্যাক্টরিতেও জন অভিংটনকে দমপোখত দেয়া হয়েছিল। লখনৌতে নানবাইরা এইব্বড়া হাঁড়ির ভিতর মাংস সব্জী ঢুকিয়ে সিল করে দিল আর কয়লার আগুনে চড়িয়ে দিল। এইভাবে আস্তে আস্তে দমে খাবার রান্না হতেই থাকল আর মজুররা চাইলেই হাঁড়ি খুলে খাবার দিয়ে দেয়া সম্ভব হল। মাংস এতি ঝুরাঝুরা হত যে হাড্ডি থেকে মাংস খুলে ঝুলত। নবাব পরিদর্শনে গিয়ে সেই খাবারের গন্ধে এমনই উতলা হলেন যে নানবাইদের তলব করা হল তার প্রাসাদে সেই রান্না করার জন্য। কাশ্মিরি বাবুর্চিরা আবার দমপোখতের মধ্যে শালগম আর ভেড়ার মাংস ব্যবহার করতেন। দম পোখত রান্না হত সারারাত ধরে, আর সকালের নাস্তায় নবাব খেতেন সেই খাবার।

নবাব আসফউদ্দৌলা শামী কাবাবের জনক বলেও ধরা হয়, এইটি লখনৌ এর ট্র্যাডিশন। মোগল বাদশারা যেরকম অল্প অল্প করে খেতেন অযোধ্যার নবাবেরা তেমন নয়, এনারা ছিলেন বিরাট পেটুক। আসফউদ্দৌলা তো এমনই মোটারাম ছিলেন যে তার চড়বার মত ঘোড়াই পাওয়া যায়নি! তার দাঁতও পড়ে গিয়েছিল, চিবাতেও পারতেননা ঠিকমত। এই সমস্যা মোকাবিলার জন্যই শামী কাবাবের উদ্ভাবন। এই কাবাব তৈরি হত একবারে মিহি মাংসের কিমা থেকে।

ইয়োরোপীয়রা যেমন বাজে গোস্ত কিমা করে ভারতীয়রা তেমন নয়, তারা সাধারণত উচ্চপদের মাংসের টুকরাই কিমা করত। আবুল ফযলের আইন-ই-আকবরিতে কিমার উল্লেখ আছে পুলাউ এর উপকরণ হিসেবে। মোগলেরা গরুর মাংসের কিমা পছন্দ করত কিন্তু লখনৌবাসীর পছন্দ ছিল ভেড়ার গোস্তের কিমা, যা আরো নরম হয়। সেই নরম মাংস পেস্ট বানিয়ে তাতে দেয়া হত আদা রসুন, ধনে আর নানান মশলা। তারপর সেই মাংসের বল বা রোল বানিয়ে কাঠিতে গেঁথে আগুনে ঝলসানো হত। সেই কাবাব এতই নরম হত যে মোটকু নবাবের দন্তহীন মাড়ি গলেও তা চলে যেত পটাপট।

রুটিতে মাহমুদ নামে এক নানবাইয়ের অবদান স্মরণ করার মত। এই বাবুর্চি শিরমল রুটির আবিষ্কারক। এই রুটি হল ভারতীয় আর পারসিক রুটির মিলনের ফসল। ভারতীয়রা সবকিছুর মধ্যে ঘি দেয়, আর পারসীক বাবুর্চিরা লক্ষ্য করে স্থানীয়রা চাপাতি রুটি ভেজে খায়, যা ভাজার পরে ফুলে পুরির মত হয়। মুসলিম বাবুর্চিরা রুটি তাওয়ায় দেবার আগে তাতে ঘি মিশিয়ে দিল। সেই কাই তাওয়ায় ভেজে তৈরি হল পরোটা, আর তন্দুরের ভিতর দিয়ে তৈরি হল বাকরখানি। মাহমুদ মিয়া করলেন কি, ঐ বাকরখানির ময়দার কাইয়ের ভিতর ঘিয়ের সাথে যোগ করলেন দুধ আর ডিম। তারপরে তা কাগজের মত পাতলা করে তন্দুরে চালান করে দিলেন। সেই ঘিয়ে ভাজা অতুলনীয় রুটির নাম হল শিরমল, লখনৌবাসী তা দিয়ে সব্জী মাংস মিষ্টি ফির্নি সবই খেতে লাগল।

উচ্চবংশের লোকে ঐ দিয়ে রাতে খেয়ে লখনৌ এর রাস্তায় হাঁটতে বেরুত আর রাস্তার পাশের দোকান থেকে কিনে খেত ডালিম কি গোলাপজলের সুবাসিত শরবৎ। নানবাইরা আজো সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, এখনো লখনৌ এর লোকে রাস্তায় বেরিয়ে ভাজা শিরমল দিয়ে শামী কাবাব খেতে খেতে হেঁটে চলে।


জহরতি কারবার

 

পাঠ্য পরিচিতি

জঁ ব্যাপ্তিস্ত তাভের্নিয়ে রচিত “Travels in India” বইয়ের কিছু অংশের ভাবানুবাদ।

হিরে জহরতের কারবার

ঢাকার নবাব শায়েস্তা খাঁর সাথে যখন আরাকানের রাজার সঙ্গে যুদ্ধ চলছিল তখন আমি (ফরাসী পর্যটক ও জহরতওয়ালা জঁ ব্যাপ্তিস্ত তাভের্নিয়ে) ঢাকা যাই। শায়েস্তা খাঁ ছিলেন অতি চতুর ব্যক্তি, আরাকান রাজার অফিসারদের কোথায় কাকে কত টাকা ঘুষ দিতে হবে তা ছিল তার নখদর্পনে। এছাড়া আরাকানরাজের অধীনে কাজ করা পর্তুগীজদেরও তিনি ভাগিয়ে আনেন।

ভারতবর্ষের ইতিহাস

১৪ জানুয়ারি আমি নবাবকে সেলাম জানাতে তার প্রাসাদে যাই। তার জন্য ভেট নিয়েছিলাম সোনালি জরির কাজ করা রেশমি কাপড় আর বহুমূল্য একটি পান্না। সন্ধ্যায় আমি ওলন্দাজদের কুঠিতে ফেরত যাই, তাদের সাথেই আমি থাকছিলাম ঢাকায়। সেখানে নবাব পাঠালেন বেদানা, দুইটি পারস্যের তরমুজ আর তিন রকম আপেল।

পরদিন আমি তাকে আমার বিক্রয়ের মাল দেখালাম। তখন তার সাথে রাজপুত্র অর্থাৎ তার ছেলেও ছিল। আমি বিক্রির জন্য বের করলাম অন্যান্য জিনিসের সাথে একটা সোনার কেসওলা ঘড়ি, একজোড়া রূপার পাত বসানো পিস্তল আর একটা দূরবীণ। নবাব আর তার বছর দশেকের পুত্রের এসবই কিনে নিলেন, দাম পড়ল পাঁচ হাজার লিভে (Livre) এর মত।

১৬ তারিখ আমাকে উজির রসিদ লিখে দিলেন যেটা কাশিমবাজারে (মুর্শিদাবাদের বড় শহর কাশিমবাজার, কোলকাতা গঠনের আগে এই শহরের শক্ত বাণিজ্যিক গুরুত্ব ছিল) দেখালে আমি টাকা পেয়ে যাব। ঢাকার ওলন্দাজেরা আমাকে সাবধান করে দিল যে কাশিমবাজারের পথ মোটেই নিরাপদ না। সেখানে নদীপথে যেতে হয় কারণ স্থলপথ দুর্গম জঙ্গল আর জলকাদায় ভর্তি। পানিতে সমস্যা হল মাঝ দরিয়ায় ভারি বাতাস, আর ছোট নৌকা প্রায়ই ফট করে উল্টে যায়। মাঝেমধ্যে মাঝিরা যখন টের পায় যে প্যাসেঞ্জার ব্যাটা মালদার তখন ওরা নিজে থেকেই অনেক সময় নৌকা উল্টে দেয় পরে নদীর তল থেকে সোনারূপার পুঁটলি হাতিয়ে নেয়ার মতলবে।

আরো কয়টা দিন ওলন্দাজ, ইংরেজ আর পর্তুগীজদের সাথে দেখা করে আর কিছু মালসামান কিনে আমি ঢাকা ছাড়ি ২৯ তারিখ। ওলন্দাজ তাদের ছোট সশস্ত্র নৌকা দিয়ে আমাকে কিছুদূর এগিয়ে দিল। নদীতে কাটল ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ পর্যন্ত, তারপরে নৌকা একটা বড় গাঁয়ে ভিড়ল। সেখানে আমি একটা ঘোড়া কিনলাম নিজে চড়ার জন্য, কিন্তু মালপত্তরের জন্য আরেকটা ঘোড়া মিলল না। বাধ্য হয়ে ভাড়া করলাম দুইটি রমণীকে, তারা কাঁধে করে আমার মাল বইল। সন্ধ্যেবেলা পৌঁছালাম কাশিমবাজার।

ওলন্দাজ বড়কর্তা আর্নুল ফন ওয়াখটনডঙ্ক আমাকে ভারি আদরযত্ন করে তার বাড়িতে নিয়ে যান। পরদিনটা আমি তার সাথেই কাটাই, কারণ ১৪ তারিখ ওয়াখটনডঙ্কের তার হেড অফিস হুগলীতে ফিরত যাবার কথা। ১৫ তারিখ ওলন্দাজ আমাকে পাল্কি দেয় মুর্শিদাবাদ যাবার জন্য। মুর্শিদাবাদ বড় শহর, সেখানেই শায়েস্তা খাঁর রাজস্ব কর্মকর্তার অফিস। তাকে আমি আমার রসিদ দেখালাম। তিনি মনোযোগ দিয়ে পড়ে বললেন যে রসিদ ঠিক আছে এবং টাকাও প্রস্তুত, তবে কিনা ঠিক আগের দিন নবাব তাকে চিঠি লিখে পয়সা আটকে দেবার হুকুম দিয়েছেন। কোন কারণ বলা হয়নি।

মাথা চুলকাতে চুলকাতে আমি ঘরে ফিরে গেলাম। এটা কেমন হল! ১৬ তারিখে আমি নবাবকে পত্র দিলাম ঘটনার ব্যাখ্যা চেয়ে। পত্রবাহক চলে গেলে আমি হুগলির পথ ধরলাম, সেখানে অনেক ওলন্দাজের বাস। তাদের সাথে চমৎকার দিন কাটে আমার, ইয়োরোপীয় বাগানের মতই প্রশস্ত বাগানে বসে আমরা নানাবিধ সালাদ খেলাম, খেলাম বাঁধাকপি, অ্যাসপেরাগাস, মটরশুঁটি আর সিম। সিমের বীজ সুদূর জাপান থেকে আনা। ওলন্দাজেরা এইসব সব্জি ভারতে সাফল্যের সাথে উৎপাদন করলেও আর্টিচোক তারা কোন কারণে ফলাতে পারেনি। হুগলি ছিলাম আমি মার্চের দুই তারিখ পর্যন্ত, তারপরে ৫ তারিখে ফের যাই কাশিমবাজার।

এরপর মুর্শিদাবাদে গিয়ে সেই খাজাঞ্চিকে গিয়ে ধরলাম আর জিজ্ঞেস করলাম ওহে নবাব আর কোন চিঠি দিয়েছে নাকি? তাকে বললাম যে আমি শায়েস্তা খাঁকে চিঠি আগেই পাঠিয়েছি আর তার উত্তরের অপেক্ষায় আছি। এছাড়া ওলন্দাজ কুঠিসর্দারও নবাবকে আলাদা চিঠি দিয়েছে এ ব্যাপারে। খাজাঞ্চি সায়েব কইলেন হ্যাঁ চিঠি এসেছে বটে, তাতে লিখা তোমার রসিদের টাকা থেকে বিশটি হাজার রূপি কম পাবে। টাকা নেবে কিনা বল? নিলে এস সইসাবুদ করে দিচ্ছি টাকা নাও, নইলে ঢাকা গিয়ে নবাবের কাছ থেকে মাল ফেরত নিয়ে এস।

আমি সবই বুঝলাম। নবাবের এই অদ্ভুত হুকুমের কারণ বুঝতে হলে ফিরে তাকাতে হবে মোগল দরবারের দিকে। বলি শুনুন।

তখন আওরঙ্গজেবের আমল। তার দরবারে তিন জহুরির ভারি দাপট। তাদের দুইজন পারস্যের আর একজন ভারতীয় সওদাগর। তারা করত কি মোগল দরবারে ইয়োরোপীয় বা বিদেশী যেকোন ব্যবসায়ী হীরেজহরত বেচতে এলে সম্রাটের আগে তারা সেটা পরীক্ষা করত। মাঝে মাঝে জোর করেও পাথর কেড়ে নিয়ে যাচাই করা হত। দুই পারস্যের জহুরির একজনের নাম ছিল নবাব আকিল খাঁ, সে মূল্যবান পাথর যাচাই করত। পারস্যের অন্যজনের নাম ছিল মির্জা মহসিন, সে পাথরের উপর খাজনা নির্ধারন করত। আর ভারতীয় সওদাগর নায়েলচান্দের কাজ ছিল পাথরে কোন খুঁত আছে কিনা বা পাথর ঝুটা কিনা তা পরীক্ষা করা।

এই তিন সর্দার মিলে সম্রাটের পরোয়ানা বের করে আনে যে সকল পাথর সম্রাটের কাছে যাবার আগে তাদের হাতে পরীক্ষা হয়ে যাবে। এরা শপথ নিয়েছিল যে কখনোই কারো কাছ থেকে কিছু নেবেনা, তবে চান্সে এরা দুয়েকটা মণিমাণিক সরাতো ঠিকই। অথবা সরানোর বদলে মাঝে মাঝে দাম একবারে অর্ধেক কমিয়ে বলত যাতে সম্রাট আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আওরঙ্গজেব বাদশা হীরেজহরত তেমন পছন্দও করতেন না, তার আগ্রহ ছিল সোনা আর রূপায়।

বড় বড় উৎসবে মোগল বাদশাকে উপহার দেবার মত দামী পাথর না পেলে অনেক অভিজাত ব্যক্তি সোনার রূপি উপহার দিতেন। তবে সোনার রূপির চেয়ে মণিমুক্তা অধিকতর আভিজাত্যের প্রতীক ছিল। এইসব উৎসবের সময়েই সম্রাটের খাজাঞ্চিখানার মূল্যবান হীরে জহরত অভিজাতদের কাছে বিক্রয়ের জন্য খুলে দেয়া হত। সম্রাট জানতেন যে ঈদেচান্দে এই অভিজাতদের দল যখন বাদশাকে বাধ্যতামূলক ভেট দেবার জন্য পাথর তালাশ করবে তখন এগুলিই আবার উপহার হিসেবে বাদশার কাছে ফেরত আসবে। এভাবে টাকা আর পাথর দুইই বাদশার রইল।

তিন জহুরির সর্দারির আরেকটা খারাপ দিক ছিল। সম্রাট দেখে ফেরত দিলে অন্য কেউই সেই পাথর কেনার ঝুঁকি নিত না। এছাড়া তিন জহুরির অধীনে কাজ করত এক বিরাট জহুরি ব্যাটালিয়ন, তাদের কেউ হীরে জহুরি কেউ চুনি জহুরি কেউ পান্না জহুরি কেউ মোতি জহুরি। তারা মিলে বিরাট খাতায় পাথরের জাত ওজন আকার রং কাট সব নিখুঁতভাবে লিখে রাখত। পরে সেই পাথর যদি সওদাগর তিন জহুরিকে না দিয়ে অন্য কারো কাছে বেচতে নিয়ে যেত তখন এই জহুরির দল তাদের পাথরের সকল তথ্য দামসহ পাঠিয়ে দিত ক্রেতার ঠিকানায়। সেই কাগজে পাথরের নিখুঁত বর্ণনা থাকলেও দাম ইচ্ছে করে অর্ধেকের কম বলা হত। এইভাবে পাথরের মালিক ঠকতে বাধ্য হত। এই বেনিয়াদের ব্যবসা ইহুদিদের থেকেও হাজারগুনে খারাপ, বদবুদ্ধিতে এদের জুড়ি মেলা ভার। মানুষকে ঠকাতে এরা হেন কাজ নেই যা করতনা।

আমি যখন জাহানাবাদে যাই তখন এই তিনজনের একজন আমাকে এসে বলল সম্রাট নেই কিন্তু তারা পাথর পরীক্ষা করে দেখতে চায় সম্রাটের কাছে যাবার আগে। আমি রাজি হইনি। পরদিন তারা আবার আসে একে একে, আর তাদের চোখ নেচে ওঠে ষোল থেকে তিরিশ ক্যারেটের নয়টা মোতির একটা বড় কণ্ঠহার আর পঞ্চান্ন ক্যারেটের একটা বিরাট মোতি দেখে। আমি এই তিনজনকে কিছু বিক্রি করব না এইটা স্থির করেছি দেখে তিন জহুরি বাদশার আত্মীয় জাফর খাঁ কে খবর দেয় আর আমার মালগুলি জাফর খাঁ এর কাছে নিয়ে যাই দেখাতে। জাফর বড় মুক্তাটা দেখে অস্থির হয়ে পড়েন আর বলেন এটা তিনি উপযুক্ত দাম দিয়ে কিনে নেবেন আর এর কথা যেন সম্রাটের কানে না যায়। জাফর বলেন যে এটা তিনি সম্রাটকেই উপহার হিসেবে দেবেন।

যাই হোক জাফর খাঁ আরও বেশ কিছু মণিমাণিক আমার কাছ থেকে কিনে দেন আর আমার দামেই রাজি হন। কয়দিন পরে তিনি খবর পাঠান যে অন্যান্য কিছু ঠিক আছে কিন্তু মুক্তার জন্য তিনি দশ হাজার রূপি কম দেবেন। সেই তিন জহুরি তাকে বলেছে যে তারা আমার কাছ থেকে নাকি আরও আট/দশ হাজার রূপি কমেই কিনতে পারত, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। জাফর খাঁ বলে পাঠান যে ঐ দামই ফাইনাল, পছন্দ না হলে যেন আমি মোতি ফেরত নিয়ে যাই। আমি তাই করলাম, খামোখা কম দামে বিক্রি করার কোন অর্থ হয়না।

সেই তিন জহুরি পরে যখন খবর পায় যে আমি বাংলায় যাচ্ছি তারা শায়েস্তা খাঁকে লিখে পাঠায় হুঁশিয়ার সাবধান, এই ফরাসী এক মোতি নিয়ে আসছে যার দাম সে যা হাঁকছে তার হাজার দশেক রূপি কম। এই মোতি জাফর খাঁকে সে বেচার চেষ্টা করেছিল বেশী দামে কিন্তু হালে পানি পায়নি, এবার তোমাকে সেই মুক্তা বেচতে আসছে।

চিঠিতে আমার অন্যান্য পাথরের দামও কমিয়ে বলা হয়েছিল। সেই চিঠি শায়েস্তা খাঁর হাতে যায় আমাকে রসিদ লিখে দেবার পরে। সেইজন্য শায়েস্তা খাঁ রসিদের উপর স্টপ পেমেন্ট করে খাজাঞ্চিকে চিঠি পাঠান আর বলেন যে বিশ হাজার রূপি কম দেয়া হবে, নিলে নাও নইলে ভাগো।

উপায়ন্তর না দেখে আমি রফা করে দশ হাজার রূপিতে কমিয়ে আনি আর নবাবের খাজাঞ্চি আমাকে টাকা বুঝিয়ে দেন।


আরও পড়ুনঃ ভারতবর্ষের ইতিহাস – পর্বঃ ১

Related Articles

5 1 vote
Post Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
Back to top button
0
Rate & Give your feedback!x
()
x

পুলিন বকসী: প্রথমত শহীদ সাহেবের ডান পন্থার কারনে ভাসানী তার বিরোধীতা করেন নি। শহীদ সাহেবের তীব্র আমেরিকা প্রীতিই (সিয়াটো-সিন্টো চুক্তি) ন্যাপ গঠনের অনেকগুলো কারনের অন্যতম কারন।

দ্বিতীয়ত আপনি যেভাবে তাকে আইয়ুব খানের একজন প্রায় 'দালাল' বা 'চাটুকার' বানায়া দিলেন সেই ভাসানীই কিন্তু ৬৯ এ ব্যপক ভূমিকা রেখেছিল শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে। শুধু তাই না এই উনসত্তরের আন্দোলনের শুরুটাও ভাসানীদের হাত ধরে।

ধন্যবাদ।

Farid Ahmed: আমি বহু জনকে জিজ্ঞেস করেছি, কেউ আমাকে সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারে নাই কেনো মওলানা ভাসানী আইয়ুব খানের প্রতিনিধি হিসাবে চীনে গিয়েছিলেন। আশা করি আপনি আলোকপাত করতে পারবেন এ ব্যাপারে। তাঁর আইয়ুব প্রীতি আমার আবিষ্কার না। ষাটের দশকেই এ নিয়ে বিস্তর কথা উঠেছে। আমি আগের একটা লেখায় সব রেফারেন্স দিয়েছি। আমি ভাসানীকে এখনও দালাল কিংবা চাটুকার বলি নাই, যদিও বলা উচিত ছিলো আমার।

১৯৮৬-৮৭ সালে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন জালাল আহমেদ। ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি এরশাদের সাথে হাত মেলান। এরশাদ তাঁকে অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশ মিশনে সেকেন্ড সেক্রেটারি পদে নিয়োগ দেয়। জালাল আহমেদ সংগোপনে তাঁর গোপনে বিয়ে করা বউকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমান। এখন পর্যন্ত এই অপরাধে ছাত্রদল তাঁকে দালাল বলে। আমরাও তাঁকে এরশাদের দালালই বলতাম। দালালকে তো দালালই বলা লাগে, তাই না?

Marzia Prova: ফরিদ ভাই আইয়ুব শাসনের আমলে পাকিস্তানের জোরদার উন্নয়ন দেখা যাচ্ছিল৷ ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এর আগে তার উন্নয়নের দশক পালন করার প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছিল। ভাসানীর কথা ছিল, "পশ্চিম পাকিস্তান যদি পূর্ব পাকিস্তানের উপর শোষণ না বন্ধ করে, তবে পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম।" এখন তথাকথিত আইয়ুবের উন্নয়ন পূর্ব বাংলাতেও হয়েছিল। শোষণের বিপরীতে এই উন্নয়নকে যদি সফলতা হিসেবে দেখা হয়, তবে ভাসানী একজন পাকিস্তান নাগরিক হিসেবে সফল শাসক এর প্রতি মুগ্ধতা ছিলেন! তাই নয় কি?

আপনি জাস্ট এই বিষয়টা এখনকার বাংলাদেশের সাথে মিলান। উন্নয়ন দিয়ে সফলতাকে নির্ধারণ বাকি অনেক কিছুকে যখন আড়াল করা হয়, তখনও তো দেশের অনেক মানুষের সেই সফল শাসকের প্রতি মুগ্ধতা থাকে৷ সম্ভবত ভাসানীর আইয়ুব প্রীতি সে জায়গা থেকে। জাস্ট আপনার লেখা আর কমেন্ট পড়ে এইটা মনে হইল। এই মানসিকতা অবশ্যই দ্বান্দ্বিক এবং স্ববিরোধী কোন সন্দেহ নাই৷ হয়ত এই মানসিকতা না থাকলে ভাসানী অন্যভাবে স্মরণীয় থাকতেন।

Farid Ahmed: আইয়ুব খানের সাথে মওলানার ওই উন্নয়নমূলক মুগ্ধতার সম্পর্ক ছিলো না। উনি ৬৩-তে সরকারী একটা ডেলিগেশন টিমের প্রধান হিসাবে চিনে যান। আইয়ুব খান সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে তাঁর বিন্দুমাত্র বিবেকে বাধেনি, যেখানে ৬২-তে বিশাল এক ছাত্র আন্দোলন হয়ে গিয়েছিলো আইয়ুব খান সরকারের গণবিরোধী শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে।


মওলানা ভাসানী ৬৯ এ ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে। শুধু তাই নয়, এই উনসত্তরের আন্দোলনের শুরুটাও ভাসানীদের হাত ধরে। তাহলে তাকে আইয়ুব খানের একজন প্রায় 'দালাল' বা 'চাটুকার' হিসেবে দেখাটা কি যৌক্তিক?

এই বক্তব্যের মূল কারণ হচ্ছে আমি আমার লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে মওলানা ভাসানী আইয়ুব খানের প্রতি সহানুভুতিশীল ছিলেন, তাঁর সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে চীন গমন করেছিলেন এবং ১৯৬৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন দেবার প্রতিশ্রুতি দেবার পরেও মওলানা ভাসানী গোপনে আইয়ুব খানকে সমর্থন দিয়েছিলেন।

এই অভিযোগটির লজিক্যাল ফ্যালাসিটা আগে বলি। তারপর আমি আইয়ুবের সাথে ভাসানীর সখ্যতা ব্যাখ্যা করবো।

ঊনসত্তরে মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন, ঊনসত্তরের আন্দোলনের তাঁর দুর্দান্ত ভূমিকা ছিলো, এই তথ্য দিয়ে কি তাঁর অন্য কাজগুলোকে জাস্টিফাই করা যায়? যায় না। আমি গতকাল একটা অপরাধ করেছি, আর আজকে একটা ভালো কাজ করেছি। এখন যদি আমি যুক্তি দেই যে আমি তো আজকে ভালো কাজ করেছি, তারপরেও আমাকে আপনারা অপরাধী বানিয়ে দিলেন, সেটা কেমন লাগবে আপনাদের কাছে? তিনি তেষট্টিতে আইয়ুবের প্রতিনিধি হিসাবে চীনে গেছেন, এই অভিযোগ ঊনসত্তরের ভূমিকা দিয়ে আড়াল করাটা আর যাই হোক না কেনো যুক্তিসঙ্গত কোনো কাজ হতে পারে না। ঊনসত্তর নয়, মূলত আটষট্টি সাল থেকে আইয়ুবের সমালোচনায় নামেন মওলানা ভাসানী। কিন্তু তেষট্টি থেকে আটষট্টির আগ পর্যন্ত তাঁর ভূমিকা কী আইয়ুবের ব্যাপারে? আসুন, ইতিহাস থেকে দেখি আমরা তিনি কী করেছিলেন সেই সময়ে।

১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসের ৭ তারিখে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার মির্জা দেশে মার্শাল ল জারি করেন। তিনি যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং আইয়ুব খানকে সুপ্রিম কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ দেন। ইস্কান্দার মির্জার দুর্ভাগ্য, এর মাত্র তিন সপ্তাহ পরে অক্টোবর মাসের ২৭ তারিখে আইয়ুব খান তাঁকেই উৎখাত করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নেন। ইস্কান্দার মির্জা মার্শাল ল জারি করার পর ১২ তারিখে নিরাপত্তা আইনে মওলানা ভাসানীকে বন্দি করেন। দীর্ঘ চার বছর তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন।

১৯৬২ সালের ৩রা নভেম্বর তাঁকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর পরই তিনি আইয়ুব খানের সাথে দেখা করেন, যেটা প্রবলভাবে সমালোচিত হয়। দেওয়ান শামসুল আরেফিন তাঁর, “Bhashani, the maulana Bhashani, the comrade” বইতে লিখেছেন,

“After more than four years in prison, the Moulana was released on November 3 1962. A few days after his release, he met with President Ayub in Rawalpindi. The Ayub-Bhashani meeting created a mixed reaction among the left political circles.”

আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের সময় পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় মিত্র ছিলো যুক্তরাষ্ট্র। চীনের সাথে পাকিস্তানের সীমান্ত নিয়ে বেশ ঝামেলাই ছিলো বলা চলে। সীমান্ত বিরোধ নিয়ে ১৯৫৯ সালে চীনের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। দুই পাশে দুই শত্রু দেশ ভারত এবং চীনকে পুষে রাখাটা খুবই ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ এই বিবেচনা থেকে চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের দিকে অগ্রসর হয় পাকিস্তান। এর জন্য অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের রোষেরও শিকার হয় পাকিস্তান। কিন্তু, তারপরেও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীনকে প্রাধান্য দেবার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান। ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো চীন সফর করেন।

পঞ্চাশের দশক থেকেই মওলানা ভাসানীর সাথে চীনের সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো রাজনৈতিক কারণে। চীনের সাথে সম্পর্ক আরো দৃঢ় করার জন্য মওলানার সাহায্য কামনা করেন তিনি। ১৯৬৩ সালের অগাস্ট মাসে তিনি মওলানাকে রাওয়ালপিণ্ডিতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। পত্র-পত্রিকাতে আইয়ুব-ভাসানী আঁতাতের খবর প্রকাশিত হতে থাকে। ভাসানী এগুলোকে ‘স্বার্থান্বেষী মহলের ছড়ানো গুজব’ বলে উড়িয়ে দেন।

এই আঁতাত যে গুজব না, সেটা টের পাওয়া যায় পাকিস্তানের প্রেরিত ডেলিগেশন টিমের প্রধান হওয়ার মধ্য দিয়ে। জাতীয় স্বার্থে তিনি এই দলের প্রধান হিসাবে চীনে যাচ্ছেন বলে তিনি জানান।

সেপ্টেম্বর মাসের ২৫ তারিখে ঢাকা থেকে প্রথমে করাচি যান তিনি। সেখান থেকে রেঙ্গুন হয়ে চীনে পৌঁছান মওলানা ভাসানী। পিকিং এ উষ্ণ অভ্যর্থনা পান তিনি। চীনের প্রিমিয়ার চৌ এন লাই এর সাথে সাক্ষাতে আইয়ুবের সরকারের জন্য সমর্থন প্রত্যাশা করেন তিনি। তিনি বলেন,

“I am old, perhaps I will not have another chance to come to china; I hope you and your country’s government can fully work together with Ayub khan’s government and his representative General Raza.”

চীনের যাবার সুযোগ তাঁর আরেকবারও হয়েছিলো। যদিও পরবর্তী এই সফর খুব বেশি প্রচারণা পায়নি। দেওয়ান শামসুল আরেফিন তাঁর বইতে লিখেছেন,

“Abdul Hamid Khan Bhashani paid another low-profile visit to China in 1964. The second visit was, in fact, more significant than the first one. This time he had exclusive talks with Chairman Mao, Premier Chou and other leaders including Den-Tsiao-ping.”

অগাস্ট মাসে রাওয়ালপিণ্ডিতে আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাৎ, তার মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে সরকারী প্রতিনিধি দলের নেতা হয়ে চীন সফর অন্য দল এবং নিজের দলের মধ্যেও তীব্র সমালোচনার সুত্রপাত ঘটায়। ন্যাপ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পিকিংপন্থী অংশ ভাসানীর নেতৃত্বে থেকে যায়, অন্যদিকে মস্কোপন্থী অংশ কমরেড মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে আলাদা হয়ে যায়।

পিকিং থেকে ফিরে আসার পরে শুধু মওলানা ভাসানী একাই নন, চিনপন্থী কম্যুনিস্টদের একটা বড় অংশ আইয়ুব খানের ভক্ত বনে যায়। আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের মহিমা কীর্তন করা শুরু করেন তারা। বাষাট্টির এতো বড় ছাত্র আন্দোলনের পরে যেখানে আইয়ুবের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার কথা ছিলো তাঁর, সেখানে তিনি আইয়ুব খানকে বিরক্ত না করার সিদ্ধান্ত নেন। ডক্টর নুরুন নবী তাঁর “Bullets of ‘71: A freedom fighter’s story” বইতে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন,

“After that visit, Moulana Bhashani declared his infamous policy statement, “Don’t disturb Ayub”. Bengali people were stunned. That was the biggest mistake of Moulana Bhashani’s political career.”

তারিক আলী চীনপন্থী বাম ছাত্রনেতা ছিলেন। তাঁর একটা বই আছে। বইটার নাম “Pakistan, military rule of peoples power”। বইটা প্রকাশিত হয়েছে দিল্লি থেকে ১৯৭০ সালে। এই বইতে তারিক আলী পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সাথে মাওলানা ভাসানীর নিবিড় সখ্যের কারণ অনুসন্ধান করে তার পটভূমি আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি তাঁর বইতে লেখেন, ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইউব খান মাওলানা ভাসানীকে পাকিস্তানের সরকারী প্রতিনিধি করে চীনে পাঠাতে চাইলে মাওলানা রাজি হন। সেখানে চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুং এর সাথে তাঁর যে গোপন সলাপরামর্শ হয় তার একটা বিবরণ তিনি মাওলানার কাছ থেকেই গ্রহণ করেছিলেন টেপ রেকর্ডারে।

তারিক আলী মওলানাকে প্রশ্ন করেছিলেন, “When you went to China what did Mao discuss with you when you met him?” এর উত্তরে মওলানা বলেছিলেন,

“মাও সে তুং আমাকে বলেন, “আপনি যদি সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন তাতে রাশিয়া, আমেরিকা এবং ভারতের হাতই শক্তিশালী হবে। আপনার কাজে হস্তক্ষেপ করা আমাদের নীতি বিরুদ্ধ, তথাপি আমরা আপনাকে সাবধানে এবং ধীর গতিতে আন্দোলনে অগ্রসর হতে অনুরোধ করবো। আপনার সরকারের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব আরো গাঢ় করার সুযোগ দিন।”

আগেই বলেছি, চীন থেকে ফিরে আসার পরেই মওলানা এবং তাঁর অনুসারীরা আইয়ুব খানের ভক্ত হয়ে যায়। সাপ্তাহিক ‘জনতা’ ছিলো ন্যাপের মুখপত্র। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন আনোয়ার জাহিদ। তিনি তখন ভাসানীর ব্যক্তিগত সচিব। আনোয়ার জাহিদ নিজেও আশির দশকে সামরিক শাসক এরশাদের দালালি এবং গোলামি করেছেন। তাঁকে সবাই ঝাঁড়ুদার মন্ত্রী হিসাবেই চিনতো। কারণ, তিনি একবার প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, এরশাদ যদি বলে, তবে তিনি রাস্তা ঝাঁড়ু দিতেও আপত্তি করবেন না। এই আনোয়ার জাহিদ ১৯৬৫ সালে সাপ্তাহিক জনতায় লেখেন, “There were only two Imperialist voices in Pakistan – Ayub and Vashani.”

আনোয়ার জাহিদের বক্তব্য পরিষ্কার, তিনি তাঁর নেতা এবং আইয়ুব খানকে একই কাতারে দেখেছেন। মওলানা ভাসানীর এই সামরিক শাসকের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের ফলাফল কী হতে পারে, সে সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মফিদুল হক লেখেন,

“১৯৬৩ সালে কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর জেনারেল আইউব আয়োজিত চীন সফরের পর থেকেই মাওলানা ভাসানীর পদস্খলন ঘটতে থাকে। চীনা রাষ্ট্র-নেতাদের আত্মস্বার্থ-প্রণোদিত নীতির কাছে মাওলানা ভাসানীর আত্মসমর্পণ এদেশের বাম রাজনীতির জন্য বিরাট দুর্ভাগ্যের সূচনা করে। রাজনৈতিক বিভ্রান্তি থেকে তিনি যে পথে পা দিয়েছিলেন তা শুধু আইউবের শাসনের সহায়ক ভূমিকা পালন করেনি, মাওলানা তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে সামরিক শাসকচক্রের যে সংযোগ গড়ে ওঠে তা পরবর্তী সময়েও বহু দুর্ঘটনার কারণ হয়েছিল।”

মওলানার নিজের দলের লোক হাজী দানেশও মওলানার সাথে আইয়ুব খানের সমঝোতা ছিলো বলে মনে করেন। এ কারণে আইয়ুবের বিরুদ্ধে তিনি বাম শক্তিগুলোকে একত্রিত করেননি বলে অভিযোগ করেন তিনি। হাজী দানেশ ছিলেন ন্যাপের সহ-সভাপতি। মওলানার সাথে তাঁর কোন্দল এমন পর্যায়ে যায় যে তিনি সহ একটা বিরাট অংশ ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে ন্যাপ থেকে বের হয়ে যান। ১৯৭১ সালের ৮ই জানুয়ারি হাজী দানেশ এক খোলা চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে তিনি বলেন,

“আপনি বিশ্বাস করতেন যে ইস্কান্দর মির্জা ও আইউব খান দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করবে। আইউবের বিরুদ্ধে বামপন্থী শক্তিগুলোকে সংগঠিত করার ব্যাপারে আপনার অনীহা এটাই প্রমাণ করে যে, শোষক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে আপনার যোগ ছিল। আমি এটা বিশ্বাস করতে পারিনা যে, আপনার ও ন্যাপের এ ধরনের নীতির মাধ্যমে লাখ লাখ শোষিত মানুষের মুক্তি আসবে।”

 

Masudur Rahman: ১৯৭০-এর জানুয়ারিতে সন্তোষে কৃষক সম্মেলনে মাওলানা ভাসানী আরও বললেন, ‘আমাদের ভাগ্য আমাদেরই গড়ে নিতে হবে। পিন্ডির গোলামি ছিন্ন করতে হবে।’ ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বরের বঙ্গোপসাগরীয় সাইক্লোনের প্রেক্ষাপটে উনি আবার সরাসরি বললেন ‘স্বাধিকার স্বায়ত্তশাসন নয়, চাই স্বাধীনতা।’

ফরিদ, তোমার লেখা আমি গুরুত্ব সহকারে পড়ি; অনেক কিছু জানতে পারি, শিখতে পারি। কোন মানুষই ভুলের উর্ধ্বে নন, যেমন ভাসানী। কিন্তু, তাই বলে তাকে আইয়ুব ইয়াহিয়ার সহচর বানিয়ে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিলে! মওলানা ভাসানীকে নিয়ে তোমার লেখাগুলি পড়ে আমি সত্যি হতাশ!

Farid Ahmed: আমিতো কোনো সিদ্ধান্ত দেই নাই। সবই কোট করেছি আমি। তিনি আইয়ুবের সহচর ছিলেন, এই অভিযোগ তখনই উঠেছে।

আমার বিশ্লেষণ আমি বলতে পারি। যে আইয়ুব ক্ষমতা দখল করে তাঁকে কারাগারে পাঠালো, তিনি কারাগার থেকে বের হয়ে সেই আইউবের প্রতিনিধি হয়ে চীন যান ঠিক কী কারণে? কোন স্বার্থে? আপনি আমাকে একটা মাত্র যৌক্তিক কারণ বলবেন মাসুদ ভাই এ ব্যাপারে। আমি দ্বিতীয় যুক্তিও শুনতে চাইবো না।

তিনি সিআইএ-র রিপোর্ট ইয়াহিয়াকে দিয়েছেন? কেনো? যেখানে তিনি নিজেই বলছেন এই দলিলে দেখা যাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার ষড়যন্ত্র চলছে। উনি কি বিচ্ছিন্নতার বিপক্ষে ছিলেন? বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার একেকজনের একেক ধরনের কর্মপন্থা ছিলো, সেই পন্থা নিয়ে সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু এই দলিল হস্তান্তর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষেই তাঁকে দাঁড় করিয়ে দেয়।

ভাসানী একজন স্ববিরোধী মানুষ ছিলেন। উনি স্বাধীনতার পক্ষেও বহু কথা বলেছেন, আবার বিপক্ষেও বলেছেন। আপনারা শুধু পক্ষেরটা জানেন, বিপক্ষেরটা না। আমি উনি স্বাধীনতার বিপক্ষে কী কী বলেছেন সেগুলো নিয়েই আরেকটা লেখা লিখবো দুই একদিনের মধ্যেই।

Swapan Mahmud: "পাকিস্তান ওয়ালাইকুমআসসালাম" এটাই স্বাধীনতার প্রথম প্রতীকী ঘোষণা।

Farid Ahmed: ওই এক তথ্য নিয়েই পড়ে থাকেন। মোল্লাদের অন্ধত্ব এবং একদেশদর্শীতা আমাকে পীড়া দেয় না, কিন্তু, আপনাদেরটা দেয়। কারণ, প্রগতিশীল বলে দাবি করেন আপনারা। দাবি করেন, অথচ সব তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে আসেন না। পূর্বানুমান সিদ্ধান্ত নিয়েই বসে থাকেন।

১৯৬২ সালে ছাত্ররা আইউব খানের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করেছিলো শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে। ভাসানী কি জানতেন না যে এই দেশের ছাত্র এবং জনগণ আইউব জান্তাকে বাতিল করে দিয়েছে? সেই জান্তার প্রতিনিধি হিসাবে ১৯৬৩ সালে তিনি চীনে যান কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর আপনাদের মতো বায়াসড লোক কোনো দিনই দিতে পারবেন না, খালি ওই এক ওয়ালাইকুম সালাম নিয়েই পড়ে থাকবেন আপনারা।

Masudur Rahman: খন্ডিত বিশ্লেষণ করে প্রমান করা যাবে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য '৭০ এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন নাই। একটি বিষয় অন্তত আমার কাছে পরিষ্কার, ভাসানীর তুমুল জনপ্রিয়তা থাকা সত্যেও ক্ষমতার লোভ তার ছিল না। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে উনিও কষ্ট পেতেন ভাসানীর এই পোস্টমর্টেম দেখে কারন উনি জানতেন উনার বঙ্গবন্ধু হওয়া পিছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশী। বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা থেকে মুক্ত করার জন্য যে গন আন্দোলনের দরকার ছিল, তা ভাসানী ছাড়া আর কে করতে পারতেন? তুমি তো ১৯৬৩ সনেই আটকে থাকলা, ফরিদ!

Farid Ahmed: উনার সামরিক শাসক সখ্যতা নিয়ে বিস্তারিত আমি লিখেছি মাসুদ ভাই। শুধু ৬৩-তে আটকে থাকিনি। যদিও ওইটাই সবচেয়ে ভাইটাল মুহুর্ত। কোন কারণে তিনি আইয়ুবের প্রতিনিধি হয়ে চীনে গিয়েছিলেন, সেটা জানাটা খুবই জরুরী আমাদের জন্য। মওলানা বাদে অন্য কেউ হলে আমি এক বাক্যে তাঁকে আইয়ুবের দালাল বলে দিতাম। ব্যক্তিটা উনি বলে আমি এখনো এর একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা খুঁজছি।

১৯৭২-১৯৭৬

মওলানা ভাসানী ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক হক-কথা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করলেও মুজিব সরকারের জাতীয়করণ নীতি এবং ১৯৭২-এর সংবিধানের এর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। ১৯৭৩ সালে খাদ্যের দাবিতে ঢাকায় ১৫-২২ মে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ১৯৭৪-এর ৮ এপ্রিল হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি গঠন করেন। একই বছর জুন মাসে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলে টাঙ্গাইলের সন্তোষে গৃহবন্দি হন। ১৯৭৬-এর ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লং মার্চে নেতৃত্ব দেন। একই বছর ২ অক্টোবর খোদাই খিদমতগার নামে নতুন আর একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

— উইকিপেডিয়া থেকে

Supik Anwar: ৫০ বছর ধরে বহুমাত্রিক ভাবে গন মানুষ এর রাজনীতি করা একজনকে শুধু কয়েক বছরের রাজনীতি দিয়ে মুল্যায়ন কতটুকু যুক্তিযুক্ত!? ঐ সময়ে উনি হাসপাতালে ছিলেন।পরে ভাসানী হাসপাতালে থাকা অবস্তায় মোশতাক উনাকে একদিন দেখতে গিয়েছে। তখন উনি মোশতাককে বলেছিলেন "আমার মুজিবররে তোমরা মাইরা ফেললা"!

Farid Ahmed: আপনি আপনার রেফারেন্স দেন। আর আমি আমার রেফারেন্স দিচ্ছি।

Supik Anwar: একজন সাংবাদিক (নামটা মনে পড়ছে না) উপস্থিত ছিলেন অই সময়। পরে উনি সহ সবাইকে রুম থেকে বাইরে যেতে বলেন মোশতাক। মোশতাক বেশ কিছুক্ষণ ভাসানীর সাথে একান্তে কথা বলে।এগুলা ভাসানীকে নিয়ে লিখা একটা কলামে পড়েছিলাম।মনে হয় ইরফানুল বারীর। আর ৭৫ এর পর উনি অনেক অসুস্থ ছিলেন। এই সুযোগ এ মোশতাক তার লেজেটিমিসির জন্য উনাকে ব্যবহার করেছে। আর জাতির জনক কে উনি কথটা পছন্দ করতেন সেই কথা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আছে। এছাড়া উনি মোশতাক ১ং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক থাকার পর ও তাকে ডিঙিয়ে মুজিবকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করেন সামশুল হক এর অনুপস্থিতিতে। আর আগরতলা মামলায় তার প্রিয় মুজিবরকে জেল থেকে বের করার হুংকার এবং তার ফলাফল তো জানাই আছে।

Farid Ahmed: এটা কোনো রেফারেন্স হলো? আসেন এর বিপরীতে আপনাকে রেফারেন্স দেখাই। কয়েকটা পত্রিকার কাটিং দেখাচ্ছি। কারো মুখের কথার চেয়ে পত্রিকা অনেক বিশ্বাসযোগ্য।

doc

Supik Anwar: মওলানা ভাসানীকে নিয়ে কয়েকটা কৌতুহল জাগানো প্রশ্ন পেলাম, এমনকি আমার লেখা শেয়ার করা কিছু মানুষও এই সব মন্তব্য পেয়েছেন দেখলাম। একটা প্রশ্ন হলো, ভাসানী ১৫ অগাস্টের হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করেছেন। মোশতাককে সমর্থন দিয়েছেন। জিজ্ঞেস করলাম, জেনেছেন কোথায়?

— তখনকার দৈনিক পত্রিকায়। বড় করে ছাপা হয়েছে তো।

— কিন্তু তখন যে চারটা মাত্র পত্রিকা আমাদের খবরের উৎস, সেগুলো তো এর আগেই বাকশাল সরকার সরকারী মুখপাত্র বানিয়ে বাকি সবগুলো পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলো। মাওলানার প্রতিষ্ঠিত হক কথাকে নিষিদ্ধ করেছিল ১৯৭২ সালেই। ফলে মোশতাকের আমলে যে তথ্য আমরা খবরের কাগজ সূত্রে পেলাম, সেগুলোর নির্ভরযোগ্যতা কী? কিংবা, এইভাবে গণমাধ্যম কবজা করার পরিণাম যে মানুষের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের সুযোগ এবং অভ্যাস দুটোই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল বাকশালের মাধ্যমে, চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে, আরো নানান সব নিপীড়নমূলক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে, এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হলো যে দিনে-দুপুরে রক্ষীবাহিনীর হাতে খুন হলেও সে খবর আর পত্রিকায় ছাপা হবে না, যে হাতিয়ারগুলো ব্যবহার করেই মোশতাকের মন্ত্রীসভায় লীগের নেতাদের স্বেচ্ছায় কিংবা বলপ্রয়োগে অংশ নেয়ানো হলো, তার নিন্দা কখনো করেছেন? ৯৫ বছরের বুড়ো ভাসানী ১৫ অগাস্টের বহু আগে থেকেই গৃহে অন্তরীণ ছিলেন। এই বয়োবৃদ্ধ মানুষটিকে কারা গৃহবন্দি করে রেখেছিল? তার নিন্দা করেছেন? সেই ঘরে আটকে থাকা, দুনিয়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারিতে আটকে রাখা অসুস্থ মানুষটাকে হাসপাতালে মোশতাক দেখতে গিয়েছিলেন, আওয়ামী নেতাদের মত তিনি বঙ্গভবনে গিয়ে মোশতাককে সমর্থন জানান নাই। এই ছবিটিই ফলাও করে পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, এবং পত্রিকাতে বাকি সব যা জানি সেটাও বাকশালের সংস্কৃতিতে কবজা করা পত্রিকার ভাষ্য, ভাসানী কি বলেছেন তা সেখানে কিভাবে মিলবে?

অভিযোগ করার আগে অভিযোগের প্রেক্ষাপটা তাই মনে রাখলে বোঝা যায়, অভিযোগকারীই ভয়াবহ একটা পরিস্থিতির সমর্থক, যেখানে কারও মতামত জানারও উপায় ছিল না, এমনই ভয়াবহ ছিল বাকশালি শাসন। তবুও ভাসানী কী মনে করতেন, সেটা জানতে ভাসানীর ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বাসযোগ্য মানুষদের কাছেই যেতে হবে। তাদের অনেকের কাছেই শুনেছি, নিজের সমর্থকদের ওপর এত নিপীড়নের পরও, আওয়ামী লীগের এত গণবিরোধী অবস্থানের পরও ভাসানী ১৫ অগাস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে দারুণ ব্যাথা পেয়েছিলেন। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক বিরোধিতা তিনি যতই করুন না কেন, তাকে পুত্রের মতই দেখতেন। প্রতিহিংসাপরায়ণ তিনি ছিলেন না, যদিও জনগণের বলপ্রয়োগে গভীর আস্থা পোষণ করতেন। সেই বলপ্রয়োগের স্মরণীয়তম দৃষ্টান্তটার কথাই বরং বলি।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাতেই হয়তো শেখ মুজিবুর রহমানের ফাঁসি হয়ে যেতো বঙ্গবন্ধু উপাধি পাবার আগেই; কেউ তাকে উদ্ধার করার সাহস কিংবা স্পর্ধা দেখায়নি, বন্দি ছিলেন তিনি ঢাকা সেনানিবাসে। '৬৯ এর প্রবল অভ্যূত্থানের ওপর দাঁড়িয়ে ভাসানী হুমকি দিয়েছিলেন পাক সামরিক জান্তাকে: মুজিবকে না মুক্তি দেয়া হলে জনতাকে নিয়ে তিনি ক্যানটনমেন্ট থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসবেন। আগুন ঝরানো মাওলানা তার নাম এমনি এমনি হয়নি।

এই হলো ভাসানী। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ৫০ বছর পূর্তিতে তার প্রাবল্যকে বুঝতে হলে খুচরো খুচরো প্রশ্ন করে কাজ হাসিল হবে না। অনেক বড় অকৃতজ্ঞতা এবং নিমকহারামি থেকেই ভাসানীকে নিয়ে এই জাতীয় মিথ্যা গুজব মোসাহেবরা ছড়িয়ে থাকে।

— (ফিরোজ আহমেদ)

Farid Ahmed: এটা পড়েন। আগুণ ঝরানো মওলানার আসল পরিচয় পাবেন। মুদ্রার অপর পিঠের মওলানা ভাসানী : জাফর ওয়াজেদ ↑। অলি আহাদের একটা বই আছে। বইটার নাম হচ্ছে, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-১৯৭৫। সেই বইতেও শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডে ভাসানীর সমর্থনের কথা বলা আছে। ভাসানী হাসপাতালে ভর্তি হন নভেম্বরের ২১ তারিখে। তিনি তারবার্তা পাঠান শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরের দিনই। তখন তিনি সন্তোষে। হাসপাতালে তিনি খন্দকার মোশতাককে কী বলেছেন, সেটা কোনো পত্রিকায় আসেনি। তিনি যে খুনি সরকারকে অভিনন্দিত করেছেন, তাদের সমর্থন জানিয়েছেন, এগুলো সব পত্রিকাতেই এসেছে। তাঁর নামে এগুলো বানানো খবর হলে তিনি অবশ্যই আপসেট হতেন এবং এগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। এদেরকে সহযোগিতা দিতেন না। বাস্তবে কিন্তু তা হয়নি। ফারাক্কা লং মার্চের সামনের সারিতে তিনি ছিলেন। কিন্তু, এর পিছনের পুরোটাই সায়েমের অবৈধ সরকার তথা জিয়াউর রহমান ছিলো।

doc

Supik Anwar: শুধুমাত্র পত্রিকার কয়েকটি লিখার উপর ভিত্তি করে উনাকে বারবার কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন তাতে কি সঠিক ইতিহাস প্রতিফলিত হচ্ছে!? যেই মানুষ সারা জীবন এই অঞ্চল এর মানুষকে নিয়ে মুক্তি সংগ্রাম করেছেন সেই আসাম থেকে বাংলা। কংগ্রেস থেকে বের হয়ে চিত্তরঞ্জন দল, তার পর মুসলিম লীগ এর সাথে পাকিস্তান আন্দোলন, জমিদার বিরোধী আন্দোলন , ভাষা সংগ্রাম, কৃষক আন্দোলন, লাইনপ্রথা, আওয়ামীলীগ সৃষ্টি, যুক্তফ্রন্ট, পাকিস্তানকে ওলাইকুম বলা, কাগমারী সন্মেলন, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতা, ১৯ দফা,৬৯ এর গন-আন্দোলন, ৭০ এর প্রলয়কারী তুফান, ইলেকশন এ আওয়ামীলীগকে সমর্থন, স্বাধীনতা সংগ্রাম,লং মার্চ সহ আরো মাটি ও মানুষের জন্য অনেক সংগ্রাম করা মানুষকে ইতিহাস এর ক্রনলজিকাল পাঠ না করে শুধুমাত্র কয়েকটি ঘটনার খণ্ডিত পাঠ ইতিহাসকে অবজ্ঞা করার মতই।

রেফারেন্স —
মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডের খবর শুনে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ঘটনার কয়েক দিন পর তিনি চিকিৎসার জন্য পিজি হাসপাতালে ভর্তি হন। এ সময়ে খোন্দকার মোশতাক আহমদ তার সরকারী স্টাফদের সাথে নিয়ে হুজুরের সংগে দেখা করেন। সেই বহরে সাবিহউদ্দীন আহমদও ছিলেন। তিনি তখন তার পি আর ও ছিলেন। আমি হুজুরের কেবিন কক্ষেই ছিলাম। এর একটু আগেই ফনি ভূষণ মজুমদার তার কেবিনে ফিরে গেছেন। তিনি দিনে একবার হলেও হুজুরের শরীরের খবর নিতে আসতেন। হুজুরের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও ভক্তি দেখে অবাক হয়েছি। কেবিনে ফিরে যাবার সময়ে তিনি আমাকে হুজুরের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলতেন। হুজুরের শরীর তখন খুবই খারাপ ছিলো। এখানে আসার আগে তিনি কুমুদিনী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। খোন্দকার মোশতাক কেবিনে ঢুকলে হুজুর তার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকান। বসতেও বলেননি। এক সময়ে তিনি বলেই ফেললেন "আমার মজিবরকে তোমরা মেরেই ফেললে!" তিনি ক্ষোভের সঙ্গে তাকে আরো বলেন "দুই আনার মুড়ি খেয়ে সারাদিন দলের কাজ করেছে আর তোমরা নেতা হইছো!" রাগ ও ক্ষোভের মাত্রা বাড়তে থাকলে এক সময়ে মোশতাক আমাকে একটু বাইরে যেতে,বলেন। আমি হুজুরের ঔষুধ দিয়ে বরান্দায় এসে দাঁড়াই। চলবে... [একুশে পদক প্রাপ্ত ছড়াকার আবু সালেহ্ এর টাইম লাইন হতে]

মোস্তাককে সমর্থন দেয়ার বরাত সরকারী প্রচার মাধ্যম। তখন দেশের পত্রিকার সংখ্যা ছিল ৪টি এবং ৪টিই সরকারী। এ অবস্থায় ১৫ আগস্টের পরপর যখন বিবৃতিটি প্রকাশিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে, তখন সরকারি মালিকানাধীন দৈনিকের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে স্বাভাবিক কারণেই। শুধু তা-ই নয়, মওলানা ভাসানীর কথিত বিবৃতিটি উদ্ধৃত করা হয় ‘বিশ্বস্ত সূত্রের’ বরাত দিয়ে। সততা ও সদিচ্ছা থাকলে বিশেষ দৈনিকটি থেকে সরাসরিই বিবৃতিটি উদ্ধৃত করা সম্ভব ছিল এবং ইতিহাস গবেষণার দৃষ্টিকোণ থেকে তেমনটি করা প্রয়োজনও ছিল। কিন্তু সহজবোধ্য কারণে দৈনিকটির নাম পর্যন্ত বলা হয় না বরং আশ্রয় নেয়া হয় ‘বিশ্বস্ত সূত্রের'।
[শাহ আহমদ রেজা]

Farid Ahmed: আপনি ঝোপে ঝাড়ে বাড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছেন। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরেও মওলানা ভাসানী রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, রাজনীতির মাঠে ছিলেন। কারণ, ফারাক্কা মিছিলের মতো বিশাল এক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তাঁর মতো সাহসী লোক নিশ্চয় ময়দানে প্রতিবাদ করেছেন, মিছিল মিটিং করেছেন। জাস্ট, কোনো একটা পত্রিকার একটু কাটিং দেখান আমাকে এ ব্যাপারে। আমি সবই পাঠ করেছি। এই লোক শেষবেলায় একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করাতো দূরের কথা, বরং সেটাকে সমর্থন করেছেন। এটাও ইতিহাস পাঠেরই অংশ।

Adil Mahmood: ভাসানী যে রকম ফ্লিপ ফ্লপ স্ববিরোধী আচরণ পাকিস্তান আমল থেকে করে গেছেন ওনার পক্ষে ব্যাক্তিগত পর্যায়ে মোশতাককে এই ধরনের কথা বলা এমন কিছু অসম্ভব না। এতে কোন সন্দেহ নাই যে রাষ্ট্রপ্রধান মুজিবের প্রতি তার গভীর বিরাগ থাকলেও ব্যাক্তি মুজিবকে উনি আজীবনই স্নেহ করে গেছেন। ব্যাক্তি মোশতাককে তোমরা এইটা কি করলা বলা এবং একই মোশতাকের সরকারকে অভিনন্দন জানানও অন্তত মাওলানার পক্ষে অসম্ভব কিছু না। সরকার ষড়যন্ত্র করে বিবৃতি ছাপিয়েছে এই ধরনের যুক্তিতে ৭৫ এর পর রাতারাতি ভোল পালটানো সবাই সাফাই গাইতে পারে এবং গায়। যারা মোশতাক মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়েছিল সে সব লীগ নেতা দাবী করেছে তাদের বন্দুকের মুখে নেওয়া হয়েছিল। ভাসানী ছিলেন পরিষ্কার বঙ্গবন্ধু সরকার বিরোধী সোচ্চার কণ্ঠ এবং লক্ষণীয়ভাবে দিনে দিনে কট্টর দক্ষিণপন্থীতে বিবর্তিত। বঙ্গবন্ধু সরকারের পতনের পর ডানপন্থী মোশতাকের প্রতি তার রাজনৈতিক সমর্থন এমন কি অবাস্তব যে সেটাকে নানান ষড়যন্ত্র তত্ত্ব অমূকে এই শুনেছে সেইই শুনেছে যার ভিত্তিতে সত্য হতে পারে না এইসব দাঁড়া করাতে হবে সেটাই বুঝি না। ভাসানীর পূর্ন ব্যবচ্ছেদ করলে বরং আরও অনেক বিতর্কিত কাজকারবার পাকিস্তান আমল থেকেই দেখা যায় যেগুলির কাছে এই মোশতাক অধ্যায় এমন কিছু না।

বঙ্গবন্ধুর আরেক সিনিয়র রাজনৈতিক কলিগ ৫৬ সালের প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান যার কেবিনেটে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী ছিলেন সেই আতাউর রহমান খান বঙ্গবন্ধুর পতনের পর ১৫ই আগস্ট নাজাত দিবস ঘোষণা করেছিলেন। মজার ব্যাপার হল এই আতা খান সাহেবই মোটে ৪ মাস আগে বঙ্গবন্ধুর নানান গুণগান গিয়ে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। আমার তো মনে হয় বঙ্গবন্ধু আমলেও ওনার নামে সরকারী পত্রিকায় মিথ্যা বিবৃতি দেওয়ানো হয় আর মোশতাক আমলে তো আমরা জানিই যে পত্রিকায় যার নামে যা ছাপা হয়েছিল সবই বানানো।

Swapan Mahmud: ভাষাণী-মুজিব গুরু শিষ্য দুজনই নির্বিশেষে মানুষ।দুজনেরই ভুল ছিল। এখন তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় না রেখে এ বিষয়গুলো মোকাবেলা করতে গেলে বঙ্গবন্ধু কেও আওতায় আনতে হবে। ভিয়েতনাম দিবসে মতিউল-কাদের হত্যা (স্বাধীন বাঙলাদেশে রাজপথে প্রথম হত্যা), কমরেড সিরাজ শিকদার কে পুলিশি হেফাজতে হত্যা (বাঙলাদেশে প্রথম বিচার বহির্ভূত হত্যা),দিন দুপুরে জাসদ অফিস জ্বালিয়ে দেয়া (১৯৭৩)।এই বিষয়গুলোও সামনে নিয়ে আসলে কী জামাত-শিবির বলা শুরু হবে।(বিতর্ক করার জন্য কমেন্ট করছি না এবং এ প্রসঙ্গে আর কোন কথা আমি বাড়াব না)

Farid Ahmed: মুজিবের ভুল নিয়ে তো আমরা কথা বলি। এগুলোর কোনোটাতেই তো তাঁকে ছাড় দেওয়া হয় না। একটা অপরাধকে খণ্ডন করতে যখন আরেকটাকে আনা হয়, তখন আসলে সেই অপরাধকে ঢাকার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। আপনি মুজিবকে বাদ দিয়ে পরিষ্কার করে শুধু ভাসানীর অপরাধকে অপরাধ বলতে পারছেন না কেনো? মুজিবের অপরাধের আলাপ যখন আলাপ করা হবে, তখন না হয় মুজিবকে ধোলাই দেওয়া যাবে। অন্যের অপরাধকে এনে তুলনা কখন করা হয়, সেটা আপনার না জানা থাকার কথা না। তাঁর সরকারের সবচেয়ে কট্টর সমালোচক হবার পরেও, মওলানার ক্ষেত্রে শেখ মুজিব যে উদারতা এবং ভালবাসা দেখিয়েছেন, প্রতিদানে মওলানা তাঁর ধারে কাছেও যেতে পারেন নাই। অথচ বয়োজ্যেষ্ঠ হিসাবে উল্টো ভূমিকাটা নেবার কথা ছিলো তাঁর।

Adil Mahmood: বঙ্গবন্ধু বা মুজিব সরকারের ভুলের কারনে ভাসানীর ভুল যদি ব্যাখ্যা করা যায় তাহলে অবশ্যই স্বাধীন বাংলাদেশে ভাসানীর মূল্যায়নে তৎকালীন সরকারের ভুলগুলিও আমলে আনা উচিত; এতে সমস্যা নাই। কিন্তু তাই বলে ভাসানীর ভুল ব্যালেন্স করার জন্য মুজিব সরকারের ভুলও পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের খাতিরে আনতে হবে তাহলে সেটা যৌক্তিক বিশ্লেষণ বলা যায় ন। এটা হয়ে যায় এখনকার প্রচলিত "অমুক ঘটনার সময় আপনি কোথায় ছিলেন" জাতীয় এগ্রিসেভ ডিফেস। এই ধরনের আক্রমণাত্মক ডিফেন্স সাজানো হয় নিজের পছন্দের দল বা ব্যাক্তির সমালোচনা আড়াল করার লক্ষ্য নিয়ে - আমি হয়ত খারাপ কিন্তু অপরপক্ষ তো আরো খারাপ। সে নিয়ে বল না কেন!

Iftakhar Ahmed Babu: আপনার এই পেপার কাটিং এর সত্যতা পাওয়া যায়নি ৷ সেরকম কোন বিবৃতি পাঠান হয়নি ৷

Farid Ahmed: পেপার কাটিং এর সত্যতা মানে কী বাবু ভাই? পত্রিকায় ছাপা হয়নি এই বিবৃতি, নাকি পত্রিকাওয়ালারা উনার নামে মিথ্যা বিবৃতি লিখেছে?

Iftakhar Ahmed Babu: বঙ্গভবন থেকে কেউ মিস কোট করেছিল ইচ্ছাকৃত ভাবেই l এটা নিয়ে অনেক অনুসন্ধান হয়েছে ৷ যে কোন তারবার্তা রেকর্ড রাখা হয় ৷ খোঁজা হয়েছে , কোন প্রমান পাওয়া যায় নাই ৷

Farid Ahmed: উনি কি এর পাল্টা বিবৃতি দিয়েছিলেন কোনো? অনুসন্ধানটা কাঁরা করেছিলো? সেটার রেফারেন্স কী?

Swapan Mahmud: তারপর দেখা যাচ্ছে খবরটা জানাচ্ছে বাসস।বাসস তো রাষ্ট্রীয় সংস্থা এরা প্রপাগান্ডাও ছড়াতে পারে।

Farid Ahmed: ভাসানী বামপন্থী ছিলেন বলে কি আপনাদের এই অবিশ্বাস? সেটা হলে লজিক্যাল কিছু হলো না। এর পাল্টা বিবৃতি কোথায়, মুজিব হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা করে ভাসানীর কর্মকাণ্ড কী? তিনি কি এর বিরুদ্ধে কখনো কিছু বলেছেন? এগুলো আনতে হবে আপনাদের সামনে। শুধু বাসস, বলেছে বলে অবিশ্বাস করে গেলে পক্ষপাতিত্ব হয়ে যাবে।

Swapan Mahmud: বামপন্থী ব'লে সাত খুন মাফ হ'য়ে যায়না।আমি শুধু একটা সম্ভাবনার কথা বলেছি।অপ্রাসঙ্গিক হ'লেও বলি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথম মিছিল ক'রে ছাত্র ইউনিয়ন।এই কিছুদিন আগে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলছিলেন উনি তখন এক আওয়ামীলীগ নেতার সাথে এ বিষয়ে আলাপ করতে হেলে ঐ নেতা বলেন "সেলিম এখনি মিছিল টিছিল করার দরকার নাই শেষে আওয়ামীলীগ সরকারকেই (মোশতাক ক্যাবিনেট) নিষিদ্ধ করে দেবে।"

Farid Ahmed: আওয়ামী লীগের নব্বইভাগ নেতাই স্বেচ্ছায় কিংবা ভয়ে মোশতাকের সাথে ছিলো। এগুলো প্রমাণিত। এই কাপুরুষদের ডিফেন্ড করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। সেলিম সাহেব যেটা বলেছেন, সেটা যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য।শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে দুজন লোকের করার সামর্থ্য ছিলো। এর একজন হচ্ছে জেনারেল ওসমানী এবং আরেকজন হচ্ছেন মওলানা ভাসানী। এই দুই ব্যক্তির গ্রহণযোগ্যতা ছিলো সারাদেশব্যাপী। দুঃখজনক হচ্ছে, তাঁরা দুজনেই এই কাজটা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

আমি একটা জিনিস দেখাচ্ছি এখানে আপনাদের। এটা সরাসরি কোনো প্রমাণ নয়। কিন্তু, ঘটনাটা তাৎপর্যপূর্ণ। অনেক না বলা জিনিস এখান থেকে বের করে আনা সম্ভব। ২১ তারিখ দুপুরবেলা সন্তোষ থেকে অসুস্থ ভাসানীকে নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। ভর্তি করা হয় পিজি হাসপাতালে। সন্ধ্যাবেলাতেই মোশতাক তাঁকে দেখতে হাসপাতালে যায়। পরের দিন এই খবরটা প্রতিটা সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় গুরুত্বের সাথে ছাপা হয়। ভাসানী যদি এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতেন, মোশতাকের মতো একটা লোকের তাঁর প্রতি এই সৌজন্যতা দেখানোর কথা নয় এবং পত্রিকাগুলোতে এটাকে এভাবে হাইলাইট করারও কথা নয়। আমি শুধু দৈনিক বাংলার খবরটা দিচ্ছি।

mostaq-vasani

রেকর্ডের স্বার্থে আরেক তালেবর পাপা টাইগারের চরিত্রটাও এই সুযোগে তুলে ধরি।

zia-osman

Swapan Mahmud: গোটা আওয়ামীলীগ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একটা প্রতিবাদ মিছিল করলো না।সুর সুর করে মোশতাকপন্থী হয়ে গেল। ওসমানী তো বাকশাল বিরোধীতা করে আওয়ামীলীগ ছেড়ে দিয়েছেন। ভাসানী ও আওয়ামীলীগ এ নেই। দায়ী হয়ে গেলেন তারা। আওয়ামীলীগ বরাবরই নপুংসক ও বিট্রেয়ারদের নেতৃত্ব পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেন ও ভারতে গিয়ে সাহায্য চান কাদের সিদ্দিকী, লতিফ সিদ্দিকী,সুলতান মনসুর। সুলতান ভাই'র কাছে সেই সব দিনগুলোর কথা অনেকবার শুনেছি। আজ তাদের তিনজনকেই আওয়ামীলীগ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তবে আমি জাতীয় চার নেতা, রাজ্জাক, তোফায়েল, সামাদ, আজাদ সহ যারা জেলে ছিলেন তাদের কথা বলছি না।তারা প্রকৃতই দেশপ্রেমী ও বঙ্গবন্ধুর কর্মী ছিলেন।বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথম মিছিল করতে হল বামপন্থি ছাত্র ইউনিয়ন কে। (আপনারা যাদের ঠাট্টা করে বলেন বামাতি) যে দল নিজের প্রতিষ্ঠাতাই শুধু নন জাতির পিতার ও হত্যার প্রতিবাদ করার হিম্মত রাখেনা তাদের কাছে দেশ মাতৃকার কোন মূল্য থাকতে পারেনা!

Farid Ahmed: আপনার এই পুরো বক্তব্যটাই অযৌক্তিক, অপ্রাসঙ্গিক এবং অপরিসীম খেদোক্তির বহিঃপ্রকাশ মাত্র । আমরা আওয়ামী লীগ নিয়ে আলোচনা করছি না, বা আওয়ামী লীগের সাথে কারো তুলনাও করছি না। এখানে স্পেসিফিক ইস্যু হচ্ছে খুনি সরকারে প্রতি ভাসানীর সমর্থন দেওয়া। আওয়ামী লীগের লোকেরা তো সমর্থন দিয়েছেই। মোশতাকও আওয়ামী লীগেরই লোক ছিলো। সেগুলো বললে কি ভাসানীর অপরাধ কমে যাবে? আপনি বলেন আপনি মুক্তমনের মানুষ, কিন্তু বামদের বিরুদ্ধে গেলেই আর আপনার মুক্তমনে কোনো কিছুই ঢোকে না। এটা খুবই দুঃখজনক। এতখানি ব্রেইন ওয়াশড হওয়া ঠিক না।

Swapan Mahmud: আমি বলেছি সব দায়ভার ভাসানীর হয়ে গেল!

Farid Ahmed: ভাসানীর সব দায়ভার এটাওতো কেউ বলে নাই, আমিও বলি নাই। তিনি খুনে সরকারকে সমর্থন দিয়েছেন, তাদের সাথে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। এতো বড় একজন রাজনীতিবিদ হয়ে, শেখ মুজিবের গুরুস্থানীয় হয়েও, শেখ এবং শেখ পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি কী করেছেন? মোশতাক তাঁর শয্যাপাশে গেলে কি একবারও বলেছেন, আমি খুনির সাথে হাত মেলাই না। বলেন নাই। এমন একটা নিম্নস্তরের লোককে ডিফেন্ড করেন কীভাবে আপনি, সেটাই তো আমি বুঝি না। নারী, শিশু হত্যা যাকে সামান্যতম বিচলিত করে না। আমি আওয়ামী লীগ করেছি, এই সব আকাম করা কোনো আওয়ামী লীগারকে সমালোচনা করতে আমি তো দ্বিধায় ভুগি না সামান্যতমও। সেটা করতে গিয়ে অমুক তমুক কী করেছে, কার দায় বেশি কম সেটা বিবেচনায় নেওয়া হবে না।