বাদশাহী সফর
পাঠ্য পরিচিতি
ইয়োস গমানস রচিত Mughal Warfare বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ের কিছু অংশের ছায়ানুবাদ।
মুঘলদের ব্যয়বহুল সফর
মোঘল বাদশাদের সবসময়ই ধারণা ছিল সফরের সময় পাত্রমিত্রসিপাইসান্ত্রী কাঁধে নিয়ে ঘুরলে বিপদেআপদে কাজে আসবে। সফরের মূলমন্ত্র ছিল গতি, থামা চলবে না। বলা হত এমনকি চমৎকার দিলখোশ নদীর পারের সূর্যাস্তের ভিউওলা স্থানেও এক রাতের বেশী দুরাত আরাম করে তাঁবু গেড়ে বসা যাবেনা অযথা। আওরঙ্গজেব বলেনঃ “সম্রাটের কখনোই আয়েসে গা ঢেলে আরামে মত্ত হওয়া যাবেনা। এভাবেই একের পর এক দুর্বল রাজ্য হার মেনেছে। সবসময় চলার উপর থাকতে হবে যথাসম্ভব। উত্তম রাজা বহমান পানির ধারার মতই, থেমে গেলে সর্বনাশ।”
আওরঙ্গজেব এই সর্বদা দৌড়ের উপর থাকার পলিসি খাটিয়ে নিজের বাপকেও কোণঠাসা করে এনেছিলেন, পিতা শাজাহান আগ্রা আর দিল্লীতেই ছিলেন গ্যাঁট হয়ে বসা।
মোগলেরাই দুনিয়ার সবার আগে দেশচালনায় সফরকে গুরুত্ব দিয়েছে তা মোটেই নয়। পুরান ভারতবর্ষে আমরা ঘোড়া বলি দেবার গল্পে দেখি তাগড়া ঘোড়াকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে আর রাজা তার পিছু পিছু চলেছেন যেন ঘোড়া সুরক্ষিত থাকে। সফর শেষ করে ঘোড়া ফিরে এলে তবেই তাকে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেয়া হত। সর্বদা চলার উপর থাকতে হবে এই তত্ত্বে মধ্য এশিয়ার যোদ্ধারাও বিশ্বাস করত, বিশেষত চেঙ্গিস খাঁ আর আমির তৈমুর। সেই দীক্ষায় দীক্ষিত উজবেক শাসক বুখারার সায়বানি খাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় তার রাজধানী কোথায়, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন আমাদের রাজধানী আমাদের ঘোড়ার জিন।
আকবর বাদশার সবকিছুই হত হিসেব করে, ঝোঁকের মাথায় ছক না কষে তিনি এগুতেন অল্পই। যেকোন মুহুর্তে যুদ্ধযাত্রার জন্য তার মজুত থাকত “পাঁচশত হাতি আর মালবহনের জন্য একশত সারি ঘোড়া আর উট, প্রতি সারিতে দশটি করে।” আবুল ফযল পাতার পর পাতা বকবক করে গেছেন বর্ণনা দিয়ে যে আকবর বাদশা ছিলেন এক অক্লান্ত নেতা যার অত্যন্ত পেয়ারের বিষয় ছিল শিকার করা আর যার “হৃদয় কখনই একস্থানে বাঁধা পড়ে থাকেনি”। মোগলাই ফৌজের গতি নিয়েও তিনি বিস্ময়কর দাবী করে গেছেন, ১৫৭৩ এর অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে আকবরের গুজরাট অভিযান নিয়ে। এই ব্লিৎজক্রিগে আকবর তিন থেকে চারশো সিপাই নিয়ে বিশ হাজারের ওপর বিদ্রোহী দমন করেন শোনা যায়, ফতেপুর সিক্রি থেকে ৮০০ কিমি দূরে যেখানে কাফেলা নিয়ে যেতে দুতিন মাস লেগে যাবার কথা সেখানে এই ফৌজ পথ পাড়ি দিয়েছিল নয় দিনে। তবে সেসব যুদ্ধের সময়ের কথা, সাধারণ সফরে ফৌজ মালপত্তর কাঁধে নিয়ে এগুত দিনে দশ থেকে বিশ কিমি।
চার বাদশা – আকবর, জাহাঙ্গীর, শাজাহান আর আওরঙ্গজেব মোটামুটি শতকরা ৬৫ ভাগ সময় থিতু অবস্থায় ছিলেন, রাজধানীতে বা অন্য কোথাও বছরে ছয় মাসের অধিক (যুদ্ধকালীন দীর্ঘ অবস্থান ব্যতিত)। বাকি ৩৫ ভাগ সময় তারা ছিলেন সফরে। এই পরিসংখ্যান আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় মিলে যায় সাফাভিদ রাজা প্রথম শাহ আব্বাসের ওপর করা মেলভিলের পরিসংখ্যানের সাথে, আব্বাস এক তৃতীয়াংশ সময় রাজধানীতে, এক তৃতীয়াংশ সময় অন্য স্থানে স্থির আর এক তৃতীয়াংশ সফরে কাটাতেন। এই সাফাভিদ আর মোগল সফরের সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই অটোমান শাসকদের থেকে অনেক উপরে, অটোমানেরা রাজধানীতেই সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। তবে এস্থলে বলে রাখা দরকার, সাফাভিদদের মতই মোগলেরা ইচ্ছেমত রাজধানী পাল্টাতো, বা সঠিক করে বলতে হয় যেখানে বাদশা সেটাকেই রাজধানী ঘোষণা করে দিত।
মোগলেরা প্রায় চল্লিশ শতাংশ সময় কাটাত মধ্যভারতের রাজধানীতে (দিল্লী, আগ্রা বা ফতেপুর সিক্রি), দশভাগ সময় উত্তরের রাজধানীতে (লাহোর, কাশ্মীর, কাবুল আর হাসান আবদালঃ হাসান আবদাল বর্তমান পাকিস্তানের উত্তর পাঞ্জাবের ছোট শহর। মাথাগরম মুসলমান পীর ওয়ালী কান্দাহারী এইখানে এক পাহাড়ে ডেরা বেঁধে থাকতেন, তার অপর প্রচলিত নাম হাসান আবদাল নামে শহরের নাম রাখা হয়। শোনা যায় শিখ গুরু নানকের সাথে হাসানের ব্যাপক ভেজাল লেগেছিল পানি সাপ্লাই কে কেন্দ্র করে।) আর পনেরোভাগ সময় কাটত দক্ষিণের রাজধানীতে (আজমীর, মান্ডু, বুরহানপুর বা দাক্ষিণাত্যে আওরঙ্গজেবের বিভিন্ন “স্থায়ী” ক্যাম্পে)।
শাসনের শেষদিকে আওরঙ্গজেব প্রতিটি যুদ্ধে থাকতে পছন্দ করতেন, এই জিনিসটি দেখা গিয়েছিল তরুণ আকবরের মধ্যে। পরে অবশ্য আকবর যুদ্ধের অংশটা তার ছেলেপেলে আর জেনারেলদের মধ্যে ছেড়ে দিয়েছিলেন, আর তিনি প্রতিটা যুদ্ধে স্ট্র্যাটেজিক দূরত্ব বজায় রেখে নজর রাখতেন। এই দূরত্ব বজায় রেখে নেতৃত্বদানের ব্যাপারটা জাহাঙ্গীর আর শাজাহানও অনুসরন করতেন। যুদ্ধাভিযানের হাওয়া বুঝে রাজধানী নির্ণয় হত। দাক্ষিণাত্যের উপর নজরদারি রাখার উদ্দেশ্যে জাহাঙ্গীর আজমীর বা মান্ডুতে মাসের পর মাস কাটিয়ে দিতেন।
শাজাহানের চোখ ছিল উত্তরে, তিনি লাহোর বা কাবুলে নিয়মিত সময় কাটাতেন উত্তরভারতে মোগল প্রতাপ বাড়ানোর লক্ষ্যে। মোগল ফৌজের এইরকম উত্তর দক্ষিণে যাতায়াতের পথে চালু রুট ছিল কাবুল – লাহোর – দিল্লী – আগ্রা – আজমীর – মান্ডু – বুরহানপুর। আগ্রা থেকে পূর্বে বাংলা প্রদেশে যাবার পথ ছিল অত্যন্ত অল্প ব্যবহৃত, সম্ভবত স্থলপথের চেয়ে গঙ্গা যমুনা নদী বাহিত নৌপথে যাতায়াত সহজ ছিল বলে। পশ্চিমের তুলনায় এদিকে গ্রামেগঞ্জের লোকসংখ্যাও ছিল বেশি, ফৌজ মার্চ করে যাবার মত মাইলের পর মাইল ফাঁকা জমি ছিল পূবে কম।
মধ্যযুগে ইয়োরোপীয় ছোট বাহিনীর মতই মোগল ফৌজ খাবারের সন্ধান নিত স্থানীয় এলাকা থেকে। অল্প কিছু জায়গা (যেমন কাশ্মীর বা কাবুল) ছাড়া ভারতের যেকোন স্থানই মোগল রাজদরবার ও ফৌজকে ছয় মাসের অধিক সময় ধরে খাবার সরবরাহ করতে সক্ষম ছিল। মোগল সিপাই খেতও অল্প, ফরাসী পর্যটক তাভের্নিয়ে বলে গেছেনঃ
“আমাদের একশ সৈন্য এদের হাজার সিপাইকে চোখবুঁজে হারিয়ে দিতে পারবে সত্য কথা, কিন্তু এ ও খেয়াল করা প্রয়োজন যে এই পরিবেশে আমাদের সিপাই টেকার সম্ভাবনা কম। ঘোড়সওয়ার আর পদাতিক দুইজনেই অল্প চিনি ময়দা নিয়ে ঘোরে, আর ঐ দিয়ে বল বানায়। চালডাল যোগাড় হলেই এরা খিচুড়ি বসিয়ে দেয়, আর ঘিয়ের বাটিতে আঙুলের ডগা ডুবিয়ে পটাপট চালডালনুনের এরকম নিরামিষ খিচুড়ি মেরে দেয়।”
সফরের আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক পয়সাকড়ি। সওদাগরেরা নিয়মিতই ঘুরঘুর করত মোগল সফরে টাকার থলি হাতে। যুদ্ধযাত্রা ও অন্যান্য সফরে টাকার নিশ্চিত যোগান ঠিক রাখতে স্ট্র্যাটেজিক স্থাপনায় বসে রাজকোষ। আগ্রার দূর্গ ছিল মূল ধনভান্ডার, এছাড়া ট্রেজারি খোলা হয় গোয়ালিওর, নানওয়াড়, আসিরগড় (বুরহানপুর), রোহতা আর লাহোরে। বাদশা নিজেও অঢেল পয়সাকড়ি নিয়ে সফরে যেতেন, মানুচ্চির মত মেনে নিলে আওরঙ্গজেব ৩০০ উটের পিঠে ছাপ্পান্নো হাজার পাউন্ড রূপা আর আঠাশ হাজার পাউন্ড সোনা নিয়েছিলেন কাশ্মীর যাবার সময়। এই ধনসম্পদ পথে খরচ হত প্রচুর, তাই মোগল সফর উপলক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানের ব্যবসাবাণিজ্যও ফেঁপে উঠত।
মোগলাই সফর মোসুম মেনে চলত মোটামুটি। যদিও তাদের শীতগ্রীষ্ম যেকোন সময়ই সফর সম্ভব ছিল ভারতে, তবু তারা গরমে উত্তরে আর শীতে দক্ষিণে থাকতে পছন্দ করত। যেমন হুমায়ুনের পর সব মোগল বাদশাই কাবুল বাস করতেন মে থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে, ঐটে উত্তরের উপজাতিদের কাছ থেকে যুদ্ধের ঘোড়া খরিদ করার উত্তম সময়। সেরকম কাশ্মীর ছিল গরমের সময়ের পয়লা পছন্দ। সফর মানেই রাস্তা নির্মান আর পথে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। সফরের পূর্বেই পাই পাই হিসেব হত দূরত্ব আর সময়ের ব্যাপারে। ফৌজ যেহেতু প্রায়ই ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ি পথে যেত, সম্মুখের দলের প্রথম কাজ ছিল ঝোপঝাড় সাফ করে পাহাড় কেটে রাস্তা সমান করা।
১৫৮৫ সালে কাবুল যাত্রার সময় আকবর আগ্রা দূর্গের মূল ইঞ্জিনিয়ার কাশিম খাঁ কে হুকুম দেন সিন্ধু পর্যন্ত রাস্তা তৈরি করতে হবে, নদীর ওপর ফৌজি যাতায়াতের মতন পোক্ত সেতু গড়তে হবে আর খাইবার পাসের মধ্য দিয়ে যাবার মত পথ বানাতে হবে। আবুল ফযলের মতে এই অভিযান নাকি মধ্য এশিয়ায় এতই ব্যাপক ভয়ের জন্ম দিয়েছিল যে বলখের সদরফটক বন্ধ করে রাখা হয় ভয়ে। একই লোক পরে কাশ্মীর যাবার প্রশস্ত রাস্তা তৈরি করেন মোগলাই বাদশার সফরের উপযোগী করে। এই রাস্তার বিরাট প্রশংসা করে আকবর ইরানের শাহ কে চিঠি লেখেন।
বাদশাহি সফরে এত লোকলস্কর পাইকপিয়াদা চাকর নফর হাতি ঘোড়া থাকত যে এর গতি দ্রুত হবার সম্ভাবনা ছিলনা বললেই হয়। গড়ে ১৬ কিমি এগোত কাফেলা, কিছু কিছু দিন ছিল পূর্ণ বিশ্রাম তাই ঐটা হিসাবে নিলে দল এগোত দিনে গড়ে ৮ কিমি। অবশ্যই এলাকা আর মৌসুম অনুযায়ী এর বেশকম হত। আর মূল ফৌজের গতি ছিল এর চেয়ে অনেক দ্রুত, দরবারে সমন পাওয়া মনসবদারেরা এগোত দিনে প্রায় ৩০ কিমি। চিঠিবাহকেরা কখনো কখনো দিনে ১২৫ কিমিও দৌড়াত।
তাই সফর হত সাধারণত অবিশ্বাস্য সংখ্যক মানুষের ধীরলয়ের যাত্রা। দেশের দৈনন্দিন যাত্রার এতে কোন হেরফের হতনা। দরবারের কেরানীরা সফরে বাদশার সাথেই ঘুরতেন। মানুচ্চি বলে গেছেন এদের আশিটা উট আর ত্রিশ হাতি লাগত সরকারী কাগজপত্তর বহনের জন্য। এই সফর বিজ্ঞাপনও ছিল বটে। ধুলো উড়িয়ে ঢোলসহরত বাজিয়ে হাতি ঘোড়া জৌলুষ দেখিয়ে গ্রামকে কে গ্রাম এগিয়ে যাওয়া বাদশাহী সফর দেশের লোকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিত দেশটা কার শাসনে। এছাড়া এই কাফেলা সারা দেশের রঙবেরঙের মানুষের মিলনমেলাও বটে, বিদেশী মনসবদার এখানে মিশত দেশী জমিদারের সাথে।
এই মোগল তাঁবু এক নূতন পরিবেশ তৈরি করল যা না পারসীক না মধ্য এশিয়ান না ভারতীয় না মুসলিম না হিন্দু, সব মিলিয়ে এক অভূতপূর্ব অনন্যসাধারন ককটেল। এই পরিবেশ কেমন ছিল তার খানিক আঁচ পাওয়া যায় মোগল আমীরের বর্ণনায়ঃ “যদিও অনেক নামাজকালাম আর রোজা রমজান ছিল ক্যাম্পে; জুয়া, সমকাম, মদ আর ব্যভিচারও চলত অগাধ।”
মোগল ক্যাম্পে পড়াশোনারও ব্যবস্থা ছিল, ক্যাম্পের অধিকাংশ গুনতে আর লিখতে জানতেন একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত। তাঁবুর ভাষা ছিল এক জগাখিচুড়ি, জবান-ই-উর্দু-ই-মুয়াল্লা, সহজভাবে উর্দু। এই উর্দু ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানীয় ভাষার ককটেল, সাথে মিশেছে পারস্যের ফার্সি।
শিকার ছিল সফরের অন্যতম অংশ। প্রায়ই রাজাগজার শিকারের ছবি বা বর্ণনা আমরা দেখতে পাই। এই শিকার হত মূল কাফেলা থেকে সরে এসে, বাদশা পাত্রমিত্র উজিরনাজির যখন শিকারে ব্যস্ত মূল কাফেলা তখন কাছেই ধীরলয়ে এগিয়ে চলেছে। বাদশার নিজস্ব শিকার দলে সাধারণত এক হাজারের মত সিপাই থাকত, বাকিরা মার্চে। কঠিন নিয়মের গন্ডিতে বাঁধা দরবার জীবনের বাইরে হাল্কা পরিবেশে মেতে উঠতেন সম্রাট। শিকারে সম্রাট নিতেনও বাছা বাছা পেয়ারের লোক।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
তবে শিকার শুধুই আনন্দের জন্য মনে করলে ভুল হবে, শিকার যোদ্ধার ট্রেনিংক্যাম্পও বটে। বন্য হিংস্র জানোয়ার ধরে বেঁধে ছোট বৃত্তে ছেড়ে দেয়া হত, আর শুরু হত শিকার। চতুর্দিকে হিংস্র জন্তু সামলে এদের শিকার করার অভ্যেস মোগলদের কাজে লাগত যুদ্ধক্ষেত্রে যখন শত্রু তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। শান্তিকালীন সময়ে শিকার তাই ছিল তাদের প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড।
তাই মোগলদের কাছে শান্তিকালীন সফর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে দেশের অর্থনীতি চাড় দিয়ে উঠত, রাস্তাঘাট সেতু তৈরি হত, প্রত্যন্ত অঞ্চলের শাসকের সাথে দেশের শাসকের দেখা হত আর মোগলাই জাঁকজমক সারাদেশে খোলতাই করে দেখানো হত। অগাস্টিন হিরিয়ার্ট জাহাঙ্গীরের কাফেলা নিয়ে বলে গেছেনঃ
“এই রাজার পয়সা কল্পনার অতীত। তিনি যখন সফরে যান সাথে থাকে পনেরো লক্ষ মানুষ, ঘোড়সওয়ার, পেয়াদা, অফিসার, নারী, শিশু। সাথে যায় দশ হাজার হাতি আর বিপুল গোলন্দাজের দল, যদিও অধিকাংশ সময়ই পয়সার চমক দেখানো ছাড়া এই এত কান্ড কারো কোন কাজে আসে না।”
পুরাতন খানাখাদ্য
পাঠ্য পরিচিতি
লিজি কলিংহ্যাম রচিত Curry: A Tale of Cooks and Conquerors এর কিছু অংশের ছায়ানুবাদ।
রকমারী খাবার
প্রতিদিন দুপুর বারোটায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুরাট কুঠির ইংরেজ অফিসারেরা বিরাট হলরুমে খেতে বসতেন লাইন ধরে। এক চাকর বদনা হাতে ঘুরে ঘুরে সকলের হাত ধুইয়ে দিত। ১৬৮৯ সালে জন অভিংটন নামে এক পাদ্রী খেতে বসেছিলেন ঐ খানাঘরে বাকীদের সাথে। ঝরঝরে চাউলের পুলাউ পরিবেশিত হয়েছিল, দানাগুলো একে অপরের সাথে লেগে ধরেনি আর তাতে মেশানো ছিল চৌদ্দরকম মশলা। টেবিলে আরো ছিল “দমপোখত”, মুর্গীর ভিতর কিসমিস বাদাম ঠেসে ভরে কড়াইয়ে ঘিতে চুবিয়ে রান্না হত এই খাবার। আরো ছিল কাবাব, নুন গোলমরিচ রসুন মাখা গরু আর খাসির গোস্ত তেলে ভাজা, যার “প্রতিটি টুকরার ভিতর মেশানো থাকত নানান মশলা।”
১৬৮৯ এ অভিংটন সায়েব যখন এই এলাহি খানাদানার আয়োজনে বিহ্বল, সুরাট তখন আওরঙ্গজেব বাদশার শাসনাধীন মোগল সাম্রাজ্যের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। ইয়োরোপীয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিগুলোও ঘুরঘুর করত ঐখানেই। পর্তুগীজ মসলার রমরমা একচেটে বাণিজ্য ততদিনে ওলন্দাজ, ইংরেজ আর ফরাসী থাপড়ে বাগিয়ে নিয়েছে, তারা যে যার মত কুঠিও গড়ে নিয়েছে শহরে। কোম্পানির অফিসারদের থাকার জায়গা আর চালানের মাল রক্ষণাবেক্ষণের গুদামঘর মিলিয়ে পুরো জায়গাটিকে ডাকা হত ফ্যাক্টর বা ফ্যাক্টরি, অর্থাৎ কুঠি।
সুরাট কুঠির দিনপঞ্জি লিখে গেছেন জার্মান ড্যুক অফ হলস্টাইনের পত্রবাহক আলবার্ট ম্যানডেলসো। ১৬৩৮ সালে ড্যুকসায়েব পারস্যে ম্যানডেলসোকে পাঠান সিল্ক ব্যবসার ধান্দায়, সেইখানে দুই ইংরেজ সওদাগরের মুখে ভারতের লোভনীয় বাণিজ্যের গল্প শুনে ওদিকেই হাঁটা দেয়া মনস্থ করেন, সাথে ছিল তিন জার্মান ভৃত্য আর এক পারসীক গাইড কাম দোভাষী। কুঠির মানুষ বোর্ডিং হাউসের মত বাঁধাধরা রুটিন মাফিক চলত। প্রত্যেক দিন দুইবার ঘড়ি ধরে গীর্জায় যেত সবাই, ভোর ছয়টায় আর রাত আটটায়।
রোববারে আবার মাহফিল হত তিনটে। ভোরের ধর্মকর্মের পরে লোকে কাজে লেগে যেত, ম্যানডেলসো দেখেছেন যে “প্রত্যেকেই কিছু না কিছু করছে, সকলেরই কাজ বাঁধা।” যার যার কাজের জায়গাও নির্দিষ্ট। কুঠির সকলেই ঘড়ি ধরে একসাথে খেত, আর পঞ্চাশ বছর পরের অভিংটনের মত তিনিও দেখেছেন যে খাওয়া হয় “একটি রুমে বিরাট গ্র্যান্ড টেবিলে, তাতে মিষ্টান্ন ছাড়াও থাকে কমপক্ষে পনেরো ষোল পদের মাংস।” প্রতিদিন রাতের খাবারের পর কুঠির কর্তা, তার পরেরজন, প্রধান সওদাগর আর গণ্যমান্য কেষ্টবিষ্টুরা সাগরের ধারে হাওয়া খেতে যেতেন।
অবসর সময়ে সওদাগরেরা মোগলদের মতই সময় কাটাতেন বাগানে বেড়িয়ে কি হুক্কা টেনে। চতুর্দিকেই ছড়ানো ছিল লালপানি আরক। এই আরক পাঞ্চ খেয়েই সর্বদা টাল হয়ে থাকতেন মাতাল বাদশা জাহাঙ্গীর। ইয়রোপীয়রা এই আরক খেত জালা জালা, এক ভোজের দিন ম্যানডেলসো খেয়াল করে দেখেন কুঠির সবাই খাচ্ছে “পেইলপান্টজ” নামে এক ড্রিঙ্ক, যা প্রস্তুত হত আরক, গোলাপজল, লেবুর রস আর চিনি মিশিয়ে। ইংরেজ এই ককটেল ড্রিঙ্ককে ডাকত “পাঞ্চ”। ১৮২০ সালের ইন্ডিয়ান আর্মির ল্যুটেন্যান্ট ম্যাথিউ ক্যাম্পবেল লিখে গেছেন মিল্ক পাঞ্চের রেসিপিঃ
তিরিশটি লেবুর খোসা দুই বোতল আরকে চুবিয়ে রাখ ১২ ঘন্টা। তারপর মদ ছেঁকে আলাদা কর আর তাতে দাও দশ বোতল আরক আর ছয় বোতল ব্র্যান্ডি কি রাম। তাতে ডুবাও আড়াই বোতল লেবুর রস, আটটা জায়ফল পেষা আর ১২ পাউন্ড চিনি। এছাড়া দাও আট কোয়ার্ট কাঁচা দুধ আর ১৪ কোয়ার্ট ফুটন্ত পানি, পুরোটা মেশাও বিরাট এক হাঁড়িতে। আধ ঘন্টা ধরে নাড় আর ঠান্ডা হয়ে এলে পরে ছেঁকে বোতলে ভর।
ভারতীয়দের কাছ থেকে তাদের পান খাবার অভ্যাস হয়েছিল। ভারতে নয়া আগতরা মাঝে মাঝে ব্যাপক ভয় পেত দেখে যে লোকে কফের সাথে থু থু করে রক্তের মত লাল কি একটা ফেলছে। তা ছিল পানের পিক, এই পান ভারতীয়রা সারাদিন চিবাত। মোগলেরা তাদের হিন্দুস্তানি প্রজাদের কাছ থেকে পান খাওয়া শেখে, পান খেলে নাকি দাঁতের মাড়ি শক্ত থাকে হজমবৃদ্ধি হয় ইত্যাদি।
ইশটিং পিশটিং করতেও পান সহায়ক ছিল বলে লোকে বিশ্বাস করত, এক পারসীক দূত বলে গেছেন যে বিজয়নগরের রাজার হেরেমের ৭০০ রাণী রাজকন্যে রক্ষিতার দৈনিক পান খাওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। রমরমিয়ে শাসন চালানোর পাশাপাশি খানাখাদ্যে মোগলেরা উত্তর ভারতে তাদের ছাপ যত সহজে রেখে গেছে দক্ষিণ ভারতে তা হয়নি। ষোড়শ আর সপ্তদশ শতাব্দীতে দক্ষিণ ভারত তাদের নিজেদের রান্নার কেতা চালু রাখে। বৈষ্ণব হিন্দু মন্দিরগুলোয় যেমন নিয়মিত রাঁধা হত তাদের নিজস্ব রেসিপির খাবার।
হিন্দু মন্দিরগুলো তাদের আশপাশের এলাকাগুলোর জন্য ছিল একাধারে জমির মালিক, কাজের মালিক, ব্যাঙ্ক, ইস্কুল, মিউজিয়াম, হাসপাতাল আর থিয়েটার। প্রায়শই এসব মন্দির গড়ে উঠত পাহাড়ের চূড়ায়, আর পাথরের সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে তাতে উঠত ভক্তের দল। পয়সাওলা ভক্তেরা দান করে আবার সিঁড়ির পাথরে খোদাই করে দিত তাদের উপহারের বর্ণনা।
মন্দিরের নিরামিষ আর মিষ্টান্ন রেঁধে প্রথমে দেওতার উদ্দেশ্যে রাখা হত, তারপর বিলিবন্টন হত এলাকার লোকদের মাঝে। দুধ আর তরল তরকারি যা বাঁটোয়ারা করা ব্যাপক ঝামেলার কাজ, তা যেত মন্দিরের পুরুতপান্ডার ভোগে। আজও মন্দিরে সেই পুরাতন রেসিপি ধরে রান্না করা হয়। দক্ষিণ ভারতের রেস্তোরাঁয় কার্যরত প্রচুর কুক রান্না শিখেছে মন্দিরের পাকশালা থেকেই। উদুপি মন্দিরে আজও ভক্তেরা ঘন ডাল খায় তেঁতুলটকে সিদ্ধ করা কুমড়া ফালি দিয়ে। সেই ডালে দেয়া হয় ঝাল মরিচ, মসুর ডাল, ধনেপাতা, মেথি, সর্ষেবিচি আর তেজপাতা ভাজা। বিশাল হাঁড়িতে রেঁধে কলাপাতায় পরিবেশিত হয় সেই খাবার, সবাই খেয়ে উঠে গেলে সেখানে গরু ছেড়ে দেয়া হয় সেই উচ্ছিষ্ট কলাপাতা খেয়ে সাফ করার জন্য।
মন্দিরের আরেক বৈশিষ্ট্য মিষ্টি। মোগল আমলে গেন্ডারি ছিল গুরুত্বপূর্ণ ফসল, মেলা পয়সা ছিল গেন্ডারি ব্যবসায়। ভক্তেরা নিজেদের উৎপন্ন গেন্ডারি দানও করত প্রচুর মন্দিরে মন্দিরে, তাই দিয়ে তৈরি হত অঢেল মিষ্টি। ডালের মত তরল পদার্থের বদলে মিষ্টি পরিবিহন আর বিতরন করা ছিল অনেক সহজ।
উত্তর ভারতও বিখ্যাত ছিল মন্দিরের প্রসাদের জন্য। ইংরেজ জাহাজের কাপ্তেন আলেক্সান্ডার হ্যামিলটন উড়িষ্যার জগন্নাথ মন্দিরে “দৈনিক শ পাঁচেক পান্ডাপুরুত ডাল আর ভাত রাঁধে ভগবানের জন্য। এছাড়া তৈরি হয় আটশ কেজি ওজনের পাঁচটি মিষ্টির চাঁই, তা দেবতার সামনে রেখে পুজোপাট সেরে পরে বড়লোক ভক্তদের কাছে বিক্রি হত কিছুটা, যা রয়ে যেত তা যেত গরীবের হাতে।”
ভক্তের কাছে মিষ্টি শুধুই খাবার ছিলনা, তা ছিল ঘরে বয়ে নিয়ে যাওয়া দেবতার আশির্বাদ। সেই মিষ্টিতে একগাদা চিনি আর তেঁতুল দেওয়াতে তা টিকেও থাকত অনেক দিন নষ্ট হবার বদলে। ধীরে ধীরে দক্ষিণেও মোগলাই খানা ঢুকে পড়ে। ১৬৩০ সালে শাজাহান হায়দ্রাবাদ জয় করেন, তবে বেশীদিন তা ধরে রাখতে পারেননি। এক শতাব্দী পরে মোগল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে থাকে আর গভর্নর নিজাম উল মুল্ক হায়দ্রাবাদের স্বাধীন নেতা হয়ে বসেন। ততদিনে মোগলাই খানা হায়দ্রাবাদে ঘাঁটি গেড়ে ফেলেছে।
লখনৌতে গল্প চালু আছে অযোধ্যার শেষ নবাব ওয়াজি আলি শা একবার দিল্লীর প্রিন্স মির্জা আসমান কাদেরকে দাওয়াত দেন। মির্জা সায়েব আবার ছিলেন ব্যাপক খাদ্যরসিক। তিনি খেতে বসে বেছে নিলেন মশলাদার মোরব্বা, কিন্তু কামড় দিয়ে তিনি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেন আরে এতো মোরব্বা নয় মাংসের কাবাব! ওয়াজি আলি শা তো ভারি খুশি মীর্জাকে জব্দ করে।
মির্জা দিল্লী ফিরে গেলেন মতলব আঁটতে আঁটতে যে কি করা যায়। পরে তিনি ওয়াজি আলিকে দাওয়াত দিলেন একদিন। ওয়াজি আলি মুখে দিয়ে অবাক হয়ে দেখেন সব খাবারঃ পুলাউ, বিরিয়ানি, মাংসের তরকারি, কাবাব চাটনি আচার সবই আসলে তৈরি করা হয়েছে চিনির ডেলা দিয়ে, দেখে বোঝার কোন উপায়ই নেই! অযোধ্যার নবাব হার মানলেন। তবে মোগলের বিদায় ঘন্টি ততদিনে বাজা শুরু হয়ে গিয়েছে, নবাব লখনৌকে দিল্লীর সমান সমান করতে মন দিলেন। প্রথম প্রথম লোকের তা পছন্দ হয়নি, দিল্লীর কবি মীর তকী মীর লিখে গেছেনঃ
“দিল্লীর ধ্বংসাবশেষও যেন দশগুণ ভালো লখনৌ এর চেয়ে, লখনৌ আসার পূর্বে আমার কেন মরণ হল না?”
তবে লখনৌ এর ব্যাপক পয়সাকড়ির টানে ঠিকই একে একে হাজির হয় গাতক বাদক কবি জাদুকরের দল, যেন মোগল দিল্লীরই আরেক সংস্করণ। পাচকেরাও হাঁটা দিল লখনৌর দিকে, ম্যালা মাইনের চাকরি জুটল তাদের। এক কুতুব তো নাকি তার পাচককে মাসে বারোশ রুপি দিতেন বেতন, ভারতের ইতিহাসে রান্না করে কেউ অত টাকা চোখে দেখেনি। এমনকি কবি মীর তকী মীরও তার মত পাল্টে পরে লিখেছিলেনঃ
“লখনৌ দিল্লীর চেয়েও চমৎকার, তাই আমার মন চলে সেই পানে।”
লখনৌবাসী ক্রীম প্রচন্ড ভালবাসত, তারা মোগলাই কুরামা বা কোরমা ক্রীম দিয়ে রাঁধল। কোরমাতে ব্যবহৃত হত অত্যুৎকৃষ্ট খাসির চাক, অথবা মুর্গি। মোগল কেতায় কোরমা রাঁধা হত পারসীক টেকনিকে, দইয়ে মাংস জিরিয়ে আদা রসুন পেঁয়াজ দিয়ে কষা। এতে পেস্তার গুঁড়োও দেয়া হত। লখনৌতে তারা এর মধ্যে ঢালল হাতাখানেক ক্রীম, এমনকি সামান্য ডালের মধ্যেও তারা ক্রীম দিয়ে জাফরান ছিটিয়ে এলাহি কারবার করত।
এছাড়া অযোধ্যা বিখ্যাত ছিল উত্তম চালের ভাতের জন্যে। লখনৌবাসীর জানের খাবার ছিল পুলাউ। দিল্লিতে বিরিয়ানি ছিল পয়লা পছন্দ, যা কিনা আসলে অধিক মশলাযুক্ত পুলাউ। লখনৌতে বলা হত “ভালো বিরিয়ানি হল মোটামুটি পুলাউয়ের সমান”। বিরিয়ানির ঝাঁঝালো মশলা সুগন্ধী ভাতের বাস সরিয়ে দিত বলে তারা এটাকে মোটেই ভালো চোখে দেখত না, লখনৌবাসীর মতে বিরিয়ানি হল পুলাউয়ের তুলনায় অযথা জবরজং খাবার।
বিশপ রেজিনাল্ড হেবারকে যখন অযোধ্যায় পুলাউ দেয়া হয় তখন তিনি আনন্দের সাথে লক্ষ্য করেন যে ঢাকার নবাবের পরিবেশিত বিরিয়ানির তুলনায় এই পুলাউ “অসম্ভব চমৎকার, সুস্বাদু এবং মোটেই তেল ঘি দিয়ে পরিপূর্ণ নয়”। হেবার লক্ষ্য করেন যে “এই অংশের উচ্চবর্ণের মুসলমানেরা বাঙালি আর হিন্দুর তেল চপচপে খাবার মারাত্মক নিচু নজরে দেখে, আর তাদের বরং পছন্দ অল্প মশলাযুক্ত শুকনো সুবাসিত খাদ্য”।
খাবার সুবাসিত করার উদ্দেশ্যে লখনৌ এর বাবুর্চিরা মুর্গিকে রাঁধার আগে শুধু কস্তুরি আর জাফরান খাইয়ে রাখত। এই প্রচন্ড ব্যয়বহুল পন্থা টিকে ছিল কারণ লখনৌ এর কুতুবেরা টাকা উড়াতে খুবই পছন্দ করতেন, খানাদানার টেবিলে তাদের ফুটানি দেখাতে ভাল লাগত। তারা চমকে দেয়া খাবার ও ভারি পছন্দ করতেন, বাবুর্চিরা রাঁধত পুলাউ কিন্তু প্লেট দেখে মনে হত হীরেমোতি রাখা আছে সেখানে। এই টেকনিক সুদূর বোগদাদ নগরী থেকে এসেছে, রাঁধার আগে চাউল লবন পানিতে জিরিয়ে নিলে ভাত ক্রিস্টালের মত চকচক করে। অন্যান্য চাউল কড়া লাল বা সবুজ করে রাঁধা হত চুনি পান্না বানানোর জন্য। এমনকি তারা সাধারন খিচুড়িরও খোমা পাল্টে দিল, দুর্দান্ত রকম মেহনত করে পেস্তা মসুর ডালের সাইজে কাটা হত আর বাদাম কাটা হত ভাতের সাইজে, ঐ দিয়ে রাঁধা হত খিচুড়ি যা নাকি একবার খাইলে মরিয়া গেলেও সুখ।
লখনৌ এর একটি বিখ্যাত রান্নার কায়দা বেরিয়েছিল সময়ের প্রয়োজনে। ১৭৮৪ সালে অযোধ্যায় বিরাট দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, নবাব আসফউদ্দৌলা করেন কি হাজারে হাজারে লোক নিয়োগ করেন শিয়া ইমামবাড়া মসজিদ তৈরিতে। শহরের সৌন্দর্যবৃদ্ধিও হল আবার লোকের খাবারও মিলল। বাজারের বাবুর্চি, যাদের নানবাই ডাকা হত, তাদের হুকুম দেয়া হল দিনরাত কাজ চলবে অতএব ২৪ ঘন্টার যেকোন সময় চাহিবামাত্র মজুরদের খাবারের ব্যবস্থা করা চাই। তারা মোগল দম-পোখতের ব্যবস্থা করল, যা কিনা মুর্গি দমে রাঁধতে হয়। আইন-ই-আকবরিতেও এর রেসিপি বর্ণিত আছে। সুরাটের ফ্যাক্টরিতেও জন অভিংটনকে দমপোখত দেয়া হয়েছিল। লখনৌতে নানবাইরা এইব্বড়া হাঁড়ির ভিতর মাংস সব্জী ঢুকিয়ে সিল করে দিল আর কয়লার আগুনে চড়িয়ে দিল। এইভাবে আস্তে আস্তে দমে খাবার রান্না হতেই থাকল আর মজুররা চাইলেই হাঁড়ি খুলে খাবার দিয়ে দেয়া সম্ভব হল। মাংস এতি ঝুরাঝুরা হত যে হাড্ডি থেকে মাংস খুলে ঝুলত। নবাব পরিদর্শনে গিয়ে সেই খাবারের গন্ধে এমনই উতলা হলেন যে নানবাইদের তলব করা হল তার প্রাসাদে সেই রান্না করার জন্য। কাশ্মিরি বাবুর্চিরা আবার দমপোখতের মধ্যে শালগম আর ভেড়ার মাংস ব্যবহার করতেন। দম পোখত রান্না হত সারারাত ধরে, আর সকালের নাস্তায় নবাব খেতেন সেই খাবার।
নবাব আসফউদ্দৌলা শামী কাবাবের জনক বলেও ধরা হয়, এইটি লখনৌ এর ট্র্যাডিশন। মোগল বাদশারা যেরকম অল্প অল্প করে খেতেন অযোধ্যার নবাবেরা তেমন নয়, এনারা ছিলেন বিরাট পেটুক। আসফউদ্দৌলা তো এমনই মোটারাম ছিলেন যে তার চড়বার মত ঘোড়াই পাওয়া যায়নি! তার দাঁতও পড়ে গিয়েছিল, চিবাতেও পারতেননা ঠিকমত। এই সমস্যা মোকাবিলার জন্যই শামী কাবাবের উদ্ভাবন। এই কাবাব তৈরি হত একবারে মিহি মাংসের কিমা থেকে।
ইয়োরোপীয়রা যেমন বাজে গোস্ত কিমা করে ভারতীয়রা তেমন নয়, তারা সাধারণত উচ্চপদের মাংসের টুকরাই কিমা করত। আবুল ফযলের আইন-ই-আকবরিতে কিমার উল্লেখ আছে পুলাউ এর উপকরণ হিসেবে। মোগলেরা গরুর মাংসের কিমা পছন্দ করত কিন্তু লখনৌবাসীর পছন্দ ছিল ভেড়ার গোস্তের কিমা, যা আরো নরম হয়। সেই নরম মাংস পেস্ট বানিয়ে তাতে দেয়া হত আদা রসুন, ধনে আর নানান মশলা। তারপর সেই মাংসের বল বা রোল বানিয়ে কাঠিতে গেঁথে আগুনে ঝলসানো হত। সেই কাবাব এতই নরম হত যে মোটকু নবাবের দন্তহীন মাড়ি গলেও তা চলে যেত পটাপট।
রুটিতে মাহমুদ নামে এক নানবাইয়ের অবদান স্মরণ করার মত। এই বাবুর্চি শিরমল রুটির আবিষ্কারক। এই রুটি হল ভারতীয় আর পারসিক রুটির মিলনের ফসল। ভারতীয়রা সবকিছুর মধ্যে ঘি দেয়, আর পারসীক বাবুর্চিরা লক্ষ্য করে স্থানীয়রা চাপাতি রুটি ভেজে খায়, যা ভাজার পরে ফুলে পুরির মত হয়। মুসলিম বাবুর্চিরা রুটি তাওয়ায় দেবার আগে তাতে ঘি মিশিয়ে দিল। সেই কাই তাওয়ায় ভেজে তৈরি হল পরোটা, আর তন্দুরের ভিতর দিয়ে তৈরি হল বাকরখানি। মাহমুদ মিয়া করলেন কি, ঐ বাকরখানির ময়দার কাইয়ের ভিতর ঘিয়ের সাথে যোগ করলেন দুধ আর ডিম। তারপরে তা কাগজের মত পাতলা করে তন্দুরে চালান করে দিলেন। সেই ঘিয়ে ভাজা অতুলনীয় রুটির নাম হল শিরমল, লখনৌবাসী তা দিয়ে সব্জী মাংস মিষ্টি ফির্নি সবই খেতে লাগল।
উচ্চবংশের লোকে ঐ দিয়ে রাতে খেয়ে লখনৌ এর রাস্তায় হাঁটতে বেরুত আর রাস্তার পাশের দোকান থেকে কিনে খেত ডালিম কি গোলাপজলের সুবাসিত শরবৎ। নানবাইরা আজো সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, এখনো লখনৌ এর লোকে রাস্তায় বেরিয়ে ভাজা শিরমল দিয়ে শামী কাবাব খেতে খেতে হেঁটে চলে।
জহরতি কারবার
পাঠ্য পরিচিতি
জঁ ব্যাপ্তিস্ত তাভের্নিয়ে রচিত “Travels in India” বইয়ের কিছু অংশের ভাবানুবাদ।
হিরে জহরতের কারবার
ঢাকার নবাব শায়েস্তা খাঁর সাথে যখন আরাকানের রাজার সঙ্গে যুদ্ধ চলছিল তখন আমি (ফরাসী পর্যটক ও জহরতওয়ালা জঁ ব্যাপ্তিস্ত তাভের্নিয়ে) ঢাকা যাই। শায়েস্তা খাঁ ছিলেন অতি চতুর ব্যক্তি, আরাকান রাজার অফিসারদের কোথায় কাকে কত টাকা ঘুষ দিতে হবে তা ছিল তার নখদর্পনে। এছাড়া আরাকানরাজের অধীনে কাজ করা পর্তুগীজদেরও তিনি ভাগিয়ে আনেন।
১৪ জানুয়ারি আমি নবাবকে সেলাম জানাতে তার প্রাসাদে যাই। তার জন্য ভেট নিয়েছিলাম সোনালি জরির কাজ করা রেশমি কাপড় আর বহুমূল্য একটি পান্না। সন্ধ্যায় আমি ওলন্দাজদের কুঠিতে ফেরত যাই, তাদের সাথেই আমি থাকছিলাম ঢাকায়। সেখানে নবাব পাঠালেন বেদানা, দুইটি পারস্যের তরমুজ আর তিন রকম আপেল।
পরদিন আমি তাকে আমার বিক্রয়ের মাল দেখালাম। তখন তার সাথে রাজপুত্র অর্থাৎ তার ছেলেও ছিল। আমি বিক্রির জন্য বের করলাম অন্যান্য জিনিসের সাথে একটা সোনার কেসওলা ঘড়ি, একজোড়া রূপার পাত বসানো পিস্তল আর একটা দূরবীণ। নবাব আর তার বছর দশেকের পুত্রের এসবই কিনে নিলেন, দাম পড়ল পাঁচ হাজার লিভে (Livre) এর মত।
১৬ তারিখ আমাকে উজির রসিদ লিখে দিলেন যেটা কাশিমবাজারে (মুর্শিদাবাদের বড় শহর কাশিমবাজার, কোলকাতা গঠনের আগে এই শহরের শক্ত বাণিজ্যিক গুরুত্ব ছিল) দেখালে আমি টাকা পেয়ে যাব। ঢাকার ওলন্দাজেরা আমাকে সাবধান করে দিল যে কাশিমবাজারের পথ মোটেই নিরাপদ না। সেখানে নদীপথে যেতে হয় কারণ স্থলপথ দুর্গম জঙ্গল আর জলকাদায় ভর্তি। পানিতে সমস্যা হল মাঝ দরিয়ায় ভারি বাতাস, আর ছোট নৌকা প্রায়ই ফট করে উল্টে যায়। মাঝেমধ্যে মাঝিরা যখন টের পায় যে প্যাসেঞ্জার ব্যাটা মালদার তখন ওরা নিজে থেকেই অনেক সময় নৌকা উল্টে দেয় পরে নদীর তল থেকে সোনারূপার পুঁটলি হাতিয়ে নেয়ার মতলবে।
আরো কয়টা দিন ওলন্দাজ, ইংরেজ আর পর্তুগীজদের সাথে দেখা করে আর কিছু মালসামান কিনে আমি ঢাকা ছাড়ি ২৯ তারিখ। ওলন্দাজ তাদের ছোট সশস্ত্র নৌকা দিয়ে আমাকে কিছুদূর এগিয়ে দিল। নদীতে কাটল ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ পর্যন্ত, তারপরে নৌকা একটা বড় গাঁয়ে ভিড়ল। সেখানে আমি একটা ঘোড়া কিনলাম নিজে চড়ার জন্য, কিন্তু মালপত্তরের জন্য আরেকটা ঘোড়া মিলল না। বাধ্য হয়ে ভাড়া করলাম দুইটি রমণীকে, তারা কাঁধে করে আমার মাল বইল। সন্ধ্যেবেলা পৌঁছালাম কাশিমবাজার।
ওলন্দাজ বড়কর্তা আর্নুল ফন ওয়াখটনডঙ্ক আমাকে ভারি আদরযত্ন করে তার বাড়িতে নিয়ে যান। পরদিনটা আমি তার সাথেই কাটাই, কারণ ১৪ তারিখ ওয়াখটনডঙ্কের তার হেড অফিস হুগলীতে ফিরত যাবার কথা। ১৫ তারিখ ওলন্দাজ আমাকে পাল্কি দেয় মুর্শিদাবাদ যাবার জন্য। মুর্শিদাবাদ বড় শহর, সেখানেই শায়েস্তা খাঁর রাজস্ব কর্মকর্তার অফিস। তাকে আমি আমার রসিদ দেখালাম। তিনি মনোযোগ দিয়ে পড়ে বললেন যে রসিদ ঠিক আছে এবং টাকাও প্রস্তুত, তবে কিনা ঠিক আগের দিন নবাব তাকে চিঠি লিখে পয়সা আটকে দেবার হুকুম দিয়েছেন। কোন কারণ বলা হয়নি।
মাথা চুলকাতে চুলকাতে আমি ঘরে ফিরে গেলাম। এটা কেমন হল! ১৬ তারিখে আমি নবাবকে পত্র দিলাম ঘটনার ব্যাখ্যা চেয়ে। পত্রবাহক চলে গেলে আমি হুগলির পথ ধরলাম, সেখানে অনেক ওলন্দাজের বাস। তাদের সাথে চমৎকার দিন কাটে আমার, ইয়োরোপীয় বাগানের মতই প্রশস্ত বাগানে বসে আমরা নানাবিধ সালাদ খেলাম, খেলাম বাঁধাকপি, অ্যাসপেরাগাস, মটরশুঁটি আর সিম। সিমের বীজ সুদূর জাপান থেকে আনা। ওলন্দাজেরা এইসব সব্জি ভারতে সাফল্যের সাথে উৎপাদন করলেও আর্টিচোক তারা কোন কারণে ফলাতে পারেনি। হুগলি ছিলাম আমি মার্চের দুই তারিখ পর্যন্ত, তারপরে ৫ তারিখে ফের যাই কাশিমবাজার।
এরপর মুর্শিদাবাদে গিয়ে সেই খাজাঞ্চিকে গিয়ে ধরলাম আর জিজ্ঞেস করলাম ওহে নবাব আর কোন চিঠি দিয়েছে নাকি? তাকে বললাম যে আমি শায়েস্তা খাঁকে চিঠি আগেই পাঠিয়েছি আর তার উত্তরের অপেক্ষায় আছি। এছাড়া ওলন্দাজ কুঠিসর্দারও নবাবকে আলাদা চিঠি দিয়েছে এ ব্যাপারে। খাজাঞ্চি সায়েব কইলেন হ্যাঁ চিঠি এসেছে বটে, তাতে লিখা তোমার রসিদের টাকা থেকে বিশটি হাজার রূপি কম পাবে। টাকা নেবে কিনা বল? নিলে এস সইসাবুদ করে দিচ্ছি টাকা নাও, নইলে ঢাকা গিয়ে নবাবের কাছ থেকে মাল ফেরত নিয়ে এস।
আমি সবই বুঝলাম। নবাবের এই অদ্ভুত হুকুমের কারণ বুঝতে হলে ফিরে তাকাতে হবে মোগল দরবারের দিকে। বলি শুনুন।
তখন আওরঙ্গজেবের আমল। তার দরবারে তিন জহুরির ভারি দাপট। তাদের দুইজন পারস্যের আর একজন ভারতীয় সওদাগর। তারা করত কি মোগল দরবারে ইয়োরোপীয় বা বিদেশী যেকোন ব্যবসায়ী হীরেজহরত বেচতে এলে সম্রাটের আগে তারা সেটা পরীক্ষা করত। মাঝে মাঝে জোর করেও পাথর কেড়ে নিয়ে যাচাই করা হত। দুই পারস্যের জহুরির একজনের নাম ছিল নবাব আকিল খাঁ, সে মূল্যবান পাথর যাচাই করত। পারস্যের অন্যজনের নাম ছিল মির্জা মহসিন, সে পাথরের উপর খাজনা নির্ধারন করত। আর ভারতীয় সওদাগর নায়েলচান্দের কাজ ছিল পাথরে কোন খুঁত আছে কিনা বা পাথর ঝুটা কিনা তা পরীক্ষা করা।
এই তিন সর্দার মিলে সম্রাটের পরোয়ানা বের করে আনে যে সকল পাথর সম্রাটের কাছে যাবার আগে তাদের হাতে পরীক্ষা হয়ে যাবে। এরা শপথ নিয়েছিল যে কখনোই কারো কাছ থেকে কিছু নেবেনা, তবে চান্সে এরা দুয়েকটা মণিমাণিক সরাতো ঠিকই। অথবা সরানোর বদলে মাঝে মাঝে দাম একবারে অর্ধেক কমিয়ে বলত যাতে সম্রাট আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আওরঙ্গজেব বাদশা হীরেজহরত তেমন পছন্দও করতেন না, তার আগ্রহ ছিল সোনা আর রূপায়।
বড় বড় উৎসবে মোগল বাদশাকে উপহার দেবার মত দামী পাথর না পেলে অনেক অভিজাত ব্যক্তি সোনার রূপি উপহার দিতেন। তবে সোনার রূপির চেয়ে মণিমুক্তা অধিকতর আভিজাত্যের প্রতীক ছিল। এইসব উৎসবের সময়েই সম্রাটের খাজাঞ্চিখানার মূল্যবান হীরে জহরত অভিজাতদের কাছে বিক্রয়ের জন্য খুলে দেয়া হত। সম্রাট জানতেন যে ঈদেচান্দে এই অভিজাতদের দল যখন বাদশাকে বাধ্যতামূলক ভেট দেবার জন্য পাথর তালাশ করবে তখন এগুলিই আবার উপহার হিসেবে বাদশার কাছে ফেরত আসবে। এভাবে টাকা আর পাথর দুইই বাদশার রইল।
তিন জহুরির সর্দারির আরেকটা খারাপ দিক ছিল। সম্রাট দেখে ফেরত দিলে অন্য কেউই সেই পাথর কেনার ঝুঁকি নিত না। এছাড়া তিন জহুরির অধীনে কাজ করত এক বিরাট জহুরি ব্যাটালিয়ন, তাদের কেউ হীরে জহুরি কেউ চুনি জহুরি কেউ পান্না জহুরি কেউ মোতি জহুরি। তারা মিলে বিরাট খাতায় পাথরের জাত ওজন আকার রং কাট সব নিখুঁতভাবে লিখে রাখত। পরে সেই পাথর যদি সওদাগর তিন জহুরিকে না দিয়ে অন্য কারো কাছে বেচতে নিয়ে যেত তখন এই জহুরির দল তাদের পাথরের সকল তথ্য দামসহ পাঠিয়ে দিত ক্রেতার ঠিকানায়। সেই কাগজে পাথরের নিখুঁত বর্ণনা থাকলেও দাম ইচ্ছে করে অর্ধেকের কম বলা হত। এইভাবে পাথরের মালিক ঠকতে বাধ্য হত। এই বেনিয়াদের ব্যবসা ইহুদিদের থেকেও হাজারগুনে খারাপ, বদবুদ্ধিতে এদের জুড়ি মেলা ভার। মানুষকে ঠকাতে এরা হেন কাজ নেই যা করতনা।
আমি যখন জাহানাবাদে যাই তখন এই তিনজনের একজন আমাকে এসে বলল সম্রাট নেই কিন্তু তারা পাথর পরীক্ষা করে দেখতে চায় সম্রাটের কাছে যাবার আগে। আমি রাজি হইনি। পরদিন তারা আবার আসে একে একে, আর তাদের চোখ নেচে ওঠে ষোল থেকে তিরিশ ক্যারেটের নয়টা মোতির একটা বড় কণ্ঠহার আর পঞ্চান্ন ক্যারেটের একটা বিরাট মোতি দেখে। আমি এই তিনজনকে কিছু বিক্রি করব না এইটা স্থির করেছি দেখে তিন জহুরি বাদশার আত্মীয় জাফর খাঁ কে খবর দেয় আর আমার মালগুলি জাফর খাঁ এর কাছে নিয়ে যাই দেখাতে। জাফর বড় মুক্তাটা দেখে অস্থির হয়ে পড়েন আর বলেন এটা তিনি উপযুক্ত দাম দিয়ে কিনে নেবেন আর এর কথা যেন সম্রাটের কানে না যায়। জাফর বলেন যে এটা তিনি সম্রাটকেই উপহার হিসেবে দেবেন।
যাই হোক জাফর খাঁ আরও বেশ কিছু মণিমাণিক আমার কাছ থেকে কিনে দেন আর আমার দামেই রাজি হন। কয়দিন পরে তিনি খবর পাঠান যে অন্যান্য কিছু ঠিক আছে কিন্তু মুক্তার জন্য তিনি দশ হাজার রূপি কম দেবেন। সেই তিন জহুরি তাকে বলেছে যে তারা আমার কাছ থেকে নাকি আরও আট/দশ হাজার রূপি কমেই কিনতে পারত, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। জাফর খাঁ বলে পাঠান যে ঐ দামই ফাইনাল, পছন্দ না হলে যেন আমি মোতি ফেরত নিয়ে যাই। আমি তাই করলাম, খামোখা কম দামে বিক্রি করার কোন অর্থ হয়না।
সেই তিন জহুরি পরে যখন খবর পায় যে আমি বাংলায় যাচ্ছি তারা শায়েস্তা খাঁকে লিখে পাঠায় হুঁশিয়ার সাবধান, এই ফরাসী এক মোতি নিয়ে আসছে যার দাম সে যা হাঁকছে তার হাজার দশেক রূপি কম। এই মোতি জাফর খাঁকে সে বেচার চেষ্টা করেছিল বেশী দামে কিন্তু হালে পানি পায়নি, এবার তোমাকে সেই মুক্তা বেচতে আসছে।
চিঠিতে আমার অন্যান্য পাথরের দামও কমিয়ে বলা হয়েছিল। সেই চিঠি শায়েস্তা খাঁর হাতে যায় আমাকে রসিদ লিখে দেবার পরে। সেইজন্য শায়েস্তা খাঁ রসিদের উপর স্টপ পেমেন্ট করে খাজাঞ্চিকে চিঠি পাঠান আর বলেন যে বিশ হাজার রূপি কম দেয়া হবে, নিলে নাও নইলে ভাগো।
উপায়ন্তর না দেখে আমি রফা করে দশ হাজার রূপিতে কমিয়ে আনি আর নবাবের খাজাঞ্চি আমাকে টাকা বুঝিয়ে দেন।
আরও পড়ুনঃ ভারতবর্ষের ইতিহাস – পর্বঃ ১