পোস্ট টপিকঃ
হেরেমের গোলাম
পাঠ্য পরিচিতি
হেরেম আর হারাম একই জিনিষ- নিষিদ্ধ বস্তু। হেরেম একটি আন্তর্জাতিক শব্দ, যেমন পুলিশ। যে ভাষাতেই বলেন পাবলিক বুঝবে। মুচকি একটা হাসিও দিতে পারে। তুর্কী সাম্রাজ্যের আমলে শুরু হওয়া হেরেম প্রতিষ্ঠানটিকে আমাদের ভারতীয় মোগল সম্রাটেরা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। শাজাহানের হেরেম জীবনের খানিকটা বর্ণনা পাওয়া যায় জেমস হুইলার লিখিত “The History of India from the Earliest Ages: pt. 1. Mussulman rule” বইতে
শাহজাহানের হেরেমখানা
শাজাহান যে জড়বুদ্ধি ছিলেন এটাই স্বাভাবিক, চরম কামুক স্বভাব চরিতার্থ করতে গিয়ে পুরুষত্ব বলে তার কিছু বাকি ছিল না। এক রাজপুত বাউলের ভাষায়, শাজাহান ছিলেন হেরেমের গোলাম। হেরেমের বর্ণনা দিলে কিছুটা ধরতে পারবেন তার রাজত্বের হালহকিকত। প্রাসাদের হেরেম কোয়ার্টারকে ডাকা হত মহল। গোসলখানা আর জানালার মাঝে বিপুল জায়গা নিয়ে মহল এলাকা। বাগান আর ফোয়ারার দিকে মুখ করা অগুণতি রুমে হাজার দুয়েক নারীর বাস, খোজা বা অতিথি নারীরা যা বলতো তার বাইরে এরা কিছুই জানতো না। মহান বাদশা ছাড়া অন্য কোন পুরুষ হেরেমে নিষিদ্ধ। বাদশা হেরেমে থাকাকালীন তার পাহারায় থাকতো একশো তাতার নারী, তাদের কমান্ডারও ছিলো নারী। কমান্ডারের র্যাঙ্ক আর বেতন যেকোন আমীরের সমান।
হেরেমের নারীরা তিন কিসিমের লোক; রাণী, রাজকন্যা আর রক্ষিতা। প্রত্যেক নারীর নিজের কোয়ার্টার ছিল, আর ছিল র্যাঙ্ক অনুযায়ী মাসকাবারি বেতন। রাণী আর রাজকন্যাদের খাবার আসতো মোগলাই রান্নাঘর থেকে, তাই তাদের ডাকা হত “বেগম” অর্থাৎ বে-গম, দুঃখহীনা (হিন্দি “গম” মানে দুঃখ)। রক্ষিতারা নিজেদের বেতনের পয়সা দিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করতো।
রাণী, রাজকন্যা আর রক্ষিতা সকলেই একভাবে সাজগোজ করতো। মাথার চুল থাকতো বেণী করা, একেকদিন একেক রঙের জামা পরতো তারা। সারা গায়ে ঝলমল করতো মণিমুক্তা। সকলের বুড়ো আঙুলে ছোট্ট আয়না বসানো আঙটি পরা, তাই দিয়ে দিনভর তারা নিজেদের দিকে চেয়ে থাকতো।
প্রত্যেকের সাথে থাকতো কিছু যুবতী। তারা নাচতো, গাইতো, বাদ্য বাজাতো, নাটক করতো। মাঝে মাঝে তারা সবাই বাদশার সামনে নাচগান করতো। কেউ বাদশাকে খুশি করতে পারলেই অটোমেটিক প্রমোশন, রাণী বা রক্ষিতা হয়ে নিজস্ব রুম আর মাসকাবারি বেতনের ব্যবস্থা হত। কোন নারীই কোন কাজ করতো না, সেজন্য থাকতো দাসেরা।
মহলে কিছু মহিলা ছিল দিদিমণি, তাদের কথাই আইন। বড় বড় মন্ত্রী মিনিস্টার কে কোন মেয়ে ভোগ করবে, কার বরাদ্দ কোন ধরনের মেয়ে এগুলি দেখা দিদিমণির কাজ। অঢেল তাদের স্বাধীনতা, যখন খুশি যার কাছে খুশি দূত পাঠিয়ে কাজ হাসিল করতে এরা ওস্তাদ। উজির নাজির, গভর্নর, বড়লাট সবাই এদের নানাবিধ উপহার দিত প্রায় প্রায়ই। সেইসব উপহার তারা বাদশার পছন্দের মেয়েকে পাঠিয়ে দিত। মহল ছিল এক জটিল রাজনৈতিক কেন্দ্র, প্রত্যেক আমীর তাদের একটা দুটো মেয়েকে মহলে ঢুকিয়ে দেবার জন্য অস্থির থাকতো। মেয়ে যদি দিদিমণি বা স্বয়ং বাদশার চোখে পড়ে যায় তাহলেই আমীর সাহেবের কেল্লা ফতে। তবে বিপদ আসতো অন্য দিক থেকে, দিদিমণির দল আমীর ওমরাহের ফ্যামিলি সিক্রেট বের করে সেই তথ্য পাচার করে দিত মাঝে মাঝে।
শাজাহান তার আগের সকল মোগল শাসকের মধ্যে সবচাইতে বড় হারামজাদা ছিলেন। আমীরদের মেয়েদের সাথে ফুর্তি করে তার শখ মিটতো না, তাদের বউদের দিকেও তার নজর ছিল। তার প্রাসাদে নিয়ম করে মেলা বসানো হত, আমীরদের বউরা মেয়েদের নিয়ে আসতো শপিং করতে। ওইখানে শাজাহান দিদিমণিদের বলে দিতেন কোন বউ নিয়ে আসতে হবে। লজ্জা শরম বলে কিছু তার ছিলনা, আমীরদের তিনি দাস বলেই গণ্য করতেন। আমীরের দল অসহ্য বেদনায় ছটফট করতো, বৃথা আক্রোশে দাঁত কিড়মিড় করতো। শাজাহানের বিপদের সময় এদের লম্বা দিতে একদম দেরি হয়নি।
আগ্রার বিখ্যাত তাজমহল শাজাহানের তৈরী। ওইটা বানাতে যে কত মিলিয়ন স্টার্লিং খরচ হয়েছে খোদাই মালুম, শুনেছি বিশ হাজার লোক বিশ বছরে ওটা তৈরী করে। মেয়েমানুষের নামে এত পয়সা খরচ করা শাজাহানের পক্ষেই সম্ভব। তার প্রথম রাণীর নাম মুমতাজ মহল, আসফ খানের কন্যা। রূপের কারনে একে তার বিয়ে করা, মুমতাজ জীবিত থাকাকালীনই শাজাহান অন্য মেয়ে বিয়ে করেন। মুমতাজের কবরের উপর তাজমহল তৈরী, সাদা মার্বেলের গম্বুজে কবর ঢাকা। ভেতরে দেওয়াল সাদা মার্বেলের, নানান রত্নখচিত। কয়টা দরজাও সাদা মার্বেলের, নানান কারুকাজ করা।
পুরো বিল্ডিংটা মেয়েলি ধরনের। শক্তি বা বীর্যের কোন নামগন্ধ নেই, গ্রীস বা রোমের মতন নয় একদম। অসম্ভব সুন্দর দালান, মেয়েলি ধাঁচের সুন্দর। দেখলে বিগত স্ত্রীর কবর নয় বরং রক্ষিতার মাজার মনে হয়। তাজমহল শাজাহানের আইডিয়া, তিনি মেয়ে ভালবাসতেন বদ্ধ মাতাল যেমন ভালোবাসে তার বোতল। তারা যখন জীবিত ছিল তখন তিনি তাদের নিয়ে আদাড়ে বাগানে খেলা করতেন, মরে গেলে তাদের কবর ঝকঝকে মার্বেলে মুড়ে দিয়েছেন।
তাজমহলে জড়িয়ে আছে এক বিরাট কেলেংকারি কিচ্ছা, ভুলে যাওয়া কঠিন। মুমতাজ আর শাজাহানের এক কন্যা ছিল, তার নাম ছিল বেগম সাহিব। তিনি বেগম সাহিবকে তার রক্ষিতা বানিয়েছিলেন, বেগম যা চাইতো দুনিয়ার শেষ কোনা ঝেটিয়ে তা আনার ব্যবস্থা করা হত। বেগমের প্রতি তার আতিরিক্ত আদর ছিল চোখে পড়ার মত অস্বস্তিকর।
শীতকালে শাজাহান থাকতেন আগ্রা, গ্রীষ্মে কাশ্মির। দুই শহরেই তার কার্যক্রম ছিল খাঁটি বদমাইসের মত। এই লম্পটের সাহিত্য বা সঙ্গীতের প্রতি কোন দরদ ছিল না, জ্ঞানীলোকেরও দুই আনা দাম ছিল না তার কাছে। রক্তের হোলিখেলায় তার দাঁত বেরিয়ে যেত, অশ্লীল ভাঁড়ামো আর স্থূল পর্ণোগ্রাফিতে তিনি আমোদ পেতেন। চোখের তারা না কাঁপিয়ে তিনি বিষ খাইয়ে মারতেন মানুষ, তাই নিজে বিষ খেয়ে মরার ব্যাপারে তার ব্যাপক ভয় ছিল। বেগম সাহিবের তত্ত্বাবধানে রান্না খাবার ছাড়া তিনি কিছু খেতেননা।
জাহাঙ্গীরের মতন শাজাহান ছিলেন লোভী। অল্প বয়সে তিনি অনেক ধনরত্ন জড় করেন, তাই দিয়ে তৈরী হয় তাজমহল। দিল্লীর কাছে শাজাহানাবাদ বলে একটা শহর গড়ে তোলেন, ওইখানে প্রস্তুত হয় ময়ূর সিংহাসন। নানাবিধ মেলার আয়োজন করে টাকা উড়াতেও তার জুড়ি ছিলনা। কিন্তু শেষদিকে এসে তিনি একবারে কিপ্টা হয়ে ওঠেন, সব টাকা জমিয়ে রাখতে থাকেন বিপদের জন্য। বিপদ তার আসে অচিরেই, কিন্তু জমানো ধনরত্ন কোথায় উড়ে গেলো তখন…শাজাহান কিছুই করতে পারলেননা।
বেনারস আফিম এজেন্সী
পাঠ্য পরিচিতি
ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অন্যতম প্রধান রপ্তানীদ্রব্য ছিল আফিম ও আফিমজাত মাদক। বাংলায় উৎপন্ন আফিম চড়াদামে চীনে বিক্রয় করা কোম্পানীর অন্যতম মুনাফার উৎস। আফিম চীনে নিষিদ্ধ মাল তখন, এই নিয়ে কোম্পানীর চীনের সাথে দুইবার মারপিটও হয়ে গেছে। এই লিখাটি ১৮৫১ সালে “The Records of The Bengal Government” হতে নেয়া, ঐ বইয়ে বাংলাদেশের আফিম ব্যবসা নিয়ে বিস্তারিত লেখেন কোম্পানীর শুল্ক, লবণ ও আফিম বোর্ডের প্রধান পরীক্ষক ডব্লিউ সি বি ইটওয়েল, এম ডি।
ভারতে আফিম চাষ
ভারতে পপিচাষ হয় মূলতঃ ছশো মাইল বাই দুশ মাইল বিস্তৃত এলাকায়, উত্তরে গোরকপুর, দক্ষিণে হাজারীবাগ, পূবে দিনাজপুর আর পশ্চিমে আগ্রা তক। এই বিস্তীর্ণ এলাকা দুইটি এজেন্সিতে বিভক্ত, বিহার আর বেনারস। বিহারের হেড অফিস পাটনায়, আর বেনারস এজেন্সি চালানো হয় গাজীপুর (আমাদের ঢাকার গাজীপুর নয়, বর্তমান ভারতের উত্তরপ্রদেশের গাজীপুর) কুঠি হতে। এই দুই এজেন্ট আবার কোলকাতায় শুল্ক, লবণ ও আফিম বোর্ডের অধীনে। বিহার এজেন্সি অপেক্ষাকৃত বড় ও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এরা বেনারসের তিনগুণ আফিম উৎপন্ন করে।
বেনারস এজেন্সি আটটি ডিভিশনে বিভক্ত, যথা বেনারস ও মির্জাপুর, গাজীপুর, আজিমগড়, জৌনপুর, সেলিমপুর, গোরকপুর, কৌনপুর এবং ফতেপুর। এই আট বিভাগ মিলিয়ে ১৮৪৯-৫০ মৌশুমে মোট এক লাখ সাত হাজার আটশ বিঘা জমিতে পপিচাষ হত। প্রতিটি বিভাগ প্রধান ছিলেন সাব-ডেপুটি আফিম এজেন্ট, তিনি থাকতেন বিভাগীয় প্রধান কুঠিতে। বিভাগীয় প্রধান কুঠি হতে বাৎসরিক মাল গুনেগেঁথে পাঠানো হত গাজীপুর হেডকোয়ার্টারে।
এইসব সাব-ডেপুটির ছাড়াও ছিলেন কালেক্টররা, যারা ছিলেন বিভিন্ন কুঠির চার্জে। কালেক্টর ঠিক সাব-ডেপুটির অধীন নন, তারা সরাসরি ডেপুটি এজেন্টের সাথে কারবার করতেন। কালেক্টর কড়া নজর রাখতেন যেনো ডেপুটির অনুমোদন ব্যতিত সাব-ডেপুটি কোন মাল কিনা বা বেচা করতে না পারেন। আবার সাব-ডেপুটি খেয়াল রাখতেন যেনো কালেক্টর মাল সংগ্রহ করার সময় কোন দুই নম্বরি না হয়। বেশি মুনাফার লোভে কালেক্টররা আফিমচাষিদের যেনো না ঠকায় বা যেনো অন্যভাবে না বাঁশ দেয় সেদিকেও সাব-ডেপুটির নজর থাকতো। কোন কোন বিভাগে আবার সাব-ডেপুটি ছিলোনা, কাগজে কলমে সেখানে গাজীপুরের ডেপুটিই ছিলেন প্রধান…তবে কার্যতঃ কালেক্টরই বিভাগ চালাতো তখন। পুরো বিভাগ একলা চালানো বড় কঠিন কর্ম, অভিজ্ঞ নেটিভ অফিসারদের উপর অনেক দায়িত্ব বর্তাতো। এদের ডাকা হত গোমস্তা।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
প্রতিটি বিভাগ আবার বিভিন্ন উপবিভাগে বিভক্ত, এদের বলা হত “কুঠি এলাকা”। প্রতিটি এলাকার এমনভাবে সাজানো যেনো একজন অফিসারের পক্ষেই তা সামলানো সম্ভব হয়। এলাকাগুলির দায়িত্বে থাকতেন একজন গোমস্তা। গোমস্তাদের হেড অফিস ছিল এক একটি কুঠি। কুঠি বলতে বুঝাতো দালানটাইপ কিছু, এলাকার কেন্দ্রে স্ট্র্যাটেজিক স্থানে অবস্থিত। কুঠির রাজস্ব হিসেব রাখতে গোমস্তার অধীনে থাকতো তহবিলদার বা খাজাঞ্চি, তার কাজ ছিলো এলাকার মালের ডেবিট ক্রেডিট হিসেব রাখা।
সাব-ডেপুটি এজেন্ট আফিম চাষিদের সাথে চুক্তি করার পর গোমস্তারা জমি মাপজোক করে এলাকা দাঁড় করানোর জন্যে। এরা মাপার পর সাব-ডেপুটির নিজস্ব লোক আবার গিয়ে জমি মাপে। এই দ্বিতীয় গ্রুপের লোকেদের হাতে শীতকালে জমি ন্যস্ত থাকে, তখন আফিম চাষের অযোগ্য জমি। সুতরাং পরে যেনো জমির মাপ নিয়ে ঝামেলা না লাগে তাই এই দুইবার মাপার ব্যবস্থা। গোমস্তারা আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে, সাব-ডেপুটির সইকৃত আগাম টাকা এরা বুঝিয়ে দেয় এলাকার আফিম চাষিদের মধ্যে। চাষিদের কাছ থেকে আফিম আদায় করা ও গাজীপুর সদরে পাঠিয়ে দেওয়ার গুরুদায়িত্বও গোমস্তাদের।
গোমস্তাদের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাদের সহায়তা করে আরো কিছু লোক, এদের ডাকা হয় জমিদার। জমিদারদের কাজ চাষিদের সরাসরি তদারক করা, আর চাষের ভালোমন্দ দেখা। এইসব নেটিভ অফিসারদের পাশাপাশি কাজ করতো মুত্তামীমের দল, এরা মোটামুটি পান্ডাগোছের লোক…পুরো বিভাগের সব ঠিকঠাক চলছে কিনা তার রিপোর্ট দিত এরা ডেপুটি বা সাব-ডেপুটিকে। পুরো সিস্টেমে এরকম নেটিভ অফিসারের সংখ্যা প্রচুর। প্রথম শ্রেনীর নেটিভ অফিসার দেড়শ এর কাছাকাছি, তাদের অধীনে ছিল আরো বারোশ অফিসার ও চাকর। এদের মত স্থায়ী কর্মচারীর পাশাপাশি আফিম মৌসুমে চাকরি করতো আরো অনেকে। শুধুমাত্র গাজীপুর সদর দপ্তরেই ছয়শ অস্থায়ী কর্মকর্তা কাজ করতো, যাদের মধ্যে তিনচারজন ইয়োরোপীয় সহকারী হিসেবে কাজ করতো আর চোদ্দপনেরোটি ছিল সাদা খ্রীস্টান ছেলেপিলে।
মাঠে পপিচাষে নিযুক্ত মোট লোকের সংখ্যা বিপুল। লম্বরদার (লম্বরদার = নম্বরদার, ইংরেজী নম্বর হিন্দি দার। গ্রামের মোড়ল বিশেষ) যারা কোম্পানীর সাথে চুক্তি সই করতো, তাদের সংখ্যা ১৮৪৯-৫০ মৌসুমে ছিলো ২১,৫৪৯। মোট চাষির সংখ্যা ছিলো ১,০৬,১৪৭। কতটা জমিতে কতটা আফিম হবে বলা শক্ত। সব ঠিকঠাক থাকলে একবিঘা জমি থেকে ১২ কি ১৩ সের আফিম উৎপন্ন হয়। বাজে মৌসুমে বিঘাপ্রতি আসে ৬ কি ৮ সের।
এজেন্সির কড়া আইন ছিল মূল্যের ব্যাপারে। কাউকে জবরদস্তি করে আফিম ব্যবসায় ঢোকানো হতনা, কিন্তু স্বেচ্ছায় আসা চাষিরা কোম্পানী নির্ধারিত দামে আফিম বিক্রয়ে চুক্তিবদ্ধ ছিল। তাদের সাফ বলে দেয়া হত মূল্য পছন্দ না হলে চাদর পেতে ঘুমিয়ে থাকো তোমার জমিতে আপত্তি নেই, দর নিয়ে মুলামুলি চলবেনা। সাব-ডেপুটি চুক্তি করতেন লম্বরদারের সাথে, যার অধীনে চাষিরা কাজ করতো। চুক্তি হবার পর লম্বরদারকে হিন্দি ভাষায় লিখিত চুক্তির কপি দেওয়া হত, এই কপির চলতি নাম ছিল হাত-চিটঠি। লম্বরদারের নাম, চাষিদের নাম, গোমস্তা নির্ণিত জমির বর্ণনা, বুঝে নেওয়া আগাম টাকা ও প্রতিশ্রুত আফিমের ওজনের বিস্তারিত বিবরন থাকতো হাত-চিটঠিতে। মৌসুম শেষে সাব-ডেপুটি ও লম্বরদার এই হাত-চিটঠি মোতাবেক লেনদেন করতো।
চিটঠি অনুযায়ী, নির্ধারিত সময় পর পর লম্বরদার এজেন্সি হতে আগাম টাকা পেত। মোট নির্ধারিত মূল্যের অর্ধেক বা তার বেশি পরিশোধ করা হত মাল হাতবদলের সময়, বাকী টাকা আগাম দেয়া হত। চাষিদের কাঁচামাল কিনার জন্যে আগাম ছিল আবশ্যক। কে কত আগাম পাবে তার আলাদা হিসেব আছে। যদি জমিতে আগেও চাষ হয়ে থাকে, তাহলে গত বছরের হিসেব দেখে আগাম অনুমান করা হত। পতিত জমির ক্ষেত্রে হিসেবটা একটু জটিল, তাকে বিঘাপ্রতি কিছু বেশি টাকা আগাম দিতে হত জমি ফসলের উপযুক্ত করে তুলবার জন্যে।
সেপ্টেম্বর/অক্টোবরের দিকে প্রথম কিস্তির টাকা দেয়া হয়, চারা রোপনের পরে নভেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তি। ফসল তুলে এজেন্সির হাতে বুঝিয়ে দেবার পর বাকি টাকা। পুরো ব্যাপারটাই দুই পক্ষের জন্য অসম্ভব স্বচ্ছ একটি প্রক্রিয়া। কোন চাষি ঠিকমত কাজ না করলে তার টাকা আটকে দেয়া হয়, আর আগাম টাকা পাই পয়সা ফেরত নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অন্যদিকে ঝড় বৃষ্টি বা বন্যায় ফসল নষ্ট হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমান পাওয়া গেলে চাষিকে দেওয়া আগাম মকুব করে দেয়া হয়। পূর্ববাংলায় চাষিরা নীলচাষে অস্বীকৃতি জানালে চাবকে লাল করে দেয়া হয় শুনেছি। ওখানে নীলচাষের নামে যে বজ্জাতি চলছে তার তুলনায় আফিম এজেন্সির কার্যক্রম সুপ্রশংসনীয়।
ভিন্দালু
পাঠ পরিচিতি
লিজি কলিংহ্যাম রচিত Curry: A Tale of Cooks and Conquerors এর কিছু অংশের ছায়ানুবাদ।
ভারতে ইউরোপীয় খাবার
ভাস্কো দা গামা কালিকটে ভিড়ার প্রায় এক শতাব্দী পরে ওলন্দাজ ইয়ান হাউখেন ফন লিন্সখ্যোতেন ১৫৮৩ এর সেপ্টেম্বরে গোয়াতে আসেন। লাইন ধরে সকল পর্তুগীজ রমণী মহানন্দে ভারতীয় খাবার খাচ্ছে দেখে তিনি তো অবাক। মূল খাবার ছিল সিদ্ধ ভাতের উপর পানির মত পাতলা স্যুপ ঢেলে তার সাথে মাছ, টক আমের আচার আর মাছ বা মাংসের ঝোল।
ষোড়শ শতাব্দীর ইয়োরোপীয় যার মূল খাবার ছিল রুটি আর ঝলসানো মাংস, তার এইসব অচিন খানা দেখে অবাক লাগারই কথা। ভারতের পর্তুগীজেরা আপাত অপরিচিত খাবার খেয়ে হজম করত শুধু তাই নয়, একবারে খাঁটি ভারতীয়ের মত হাত দিয়েই খেত। রমণীরা কারো হাতে চামচ দেখলে তাই নিয়ে ভারি হাসাহাসিও করত।
পর্তুগাল ছোট দেশ কিন্তু তাদের খাবারে নানান জায়গার প্রভাব ছিল। আইবেরিয়া উপদ্বীপে প্রচুর গম, শুকর, ভেড়া, অলিভ অয়েল আর নানাপদের আঙুর হত ওয়াইন আর ভিনেগার বানানোর জন্য। এছাড়াও পর্তুগীজ খাবারে অন্যান্য কালচারের প্রভাব ছিল। ইহুদী সেটলার আর মুর রাজারা আনে চাউল, বাদাম, বেদানা, লেবুজাতীয় ফল আর চিনি।
ইয়োরোপীয় মশলা বাণিজ্যের বদৌলতে গোলমরিচ, লবঙ্গ আর দারচিনির অভাব ছিলনা। ১৪৯২ এ কলম্বাসের ভুলে আমেরিকা আবিষ্কারের ফলে ওদিক থেকে আসে অদ্ভুত কিছু নতুন জিনিস আসে যেমন টমেটো, আলু, ভুট্টা, কাজুবাদাম আর টার্কি। ষোড়শ শতাব্দীর টিপিক্যাল খাবার ছিল লবঙ্গ, দারচিনি, গোলমরিচ, জাফরান, বাদামের গুঁড়া(তরকারি ঘন করার জন্য) আর অল্প ভিনেগার দিয়ে রাঁধা মুর্গীর স্ট্যু।
দক্ষিণ ভারতে লোকে খেত ভাত। কাছেই জঙ্গলে গিজগিজ করত এলাচ দারচিনি লবঙ্গের ঝাড়। সব সসে এইসব দিয়ে ঘন করা হত, এছাড়া টকটক ভাবও আসত তেঁতুল ব্যবহারের জন্য। ভারতে তেঁতুল প্রথম আফ্রিকা থেকে আনে আরব সওদাগরের দল। উপকূলে লাইন ধরে ছিল নারকেলগাছ, নারকেলের দুধ প্রায় সব কারিতেই দেয়া হত। এছাড়া ছিল নারকেল কোরা।
ভারতের পর্তুগীজদের ভয়ানক পেট পুড়ত গমের রুটির জন্য। দক্ষিণ ভারতীয়রা মাঝে মাঝে গম দিয়ে চাপাতি তৈয়ার করত ঠিকই, কিন্তু গমের বদলে চালের গুঁড়াই তাদের পছন্দ ছিল বেশী। এই চালের গুঁড়া দিয়ে বানানো হত নরম ইডলি, চাটনি দিয়ে খাওয়ার জন্য। আরও হত উপ্পাম যার ভেতরটা স্পঞ্জি, নারকেলের দুধে ডুবিয়ে এলাচ সহকারে এই দিয়ে সকালে নাস্তা হত। আর ছিল দোসা।
গমের রুটির জন্য পর্তুগীজদের মন কাঁদার ধর্মঘটিত কারণও ছিল। ষোড়শ শতাব্দীর ক্যথলিকদের কাছে রুটির মর্যাদা মারাত্মক। তাই মিশনারিরা নানাদিকে গুঁতাগুঁতি শুরু করল রুটি বানানোর জন্য। সমস্যা ছিল ঈস্ট, রুটির জন্যে আবশ্যক ঈস্ট ভারতে ছিলনা। গোয়ান বাবুর্চির দল করল কি, তাড়ি ব্যবহার শুরু করল ঈস্টের বদলে। কাজ ভালই হল, তাদের বদৌলতে ভারতে ইয়োরোপীয় রুটি জাঁকিয়ে বসে। তৈরি হল ক্রোয়াসাঁর মত নরম রুটি আর দুধ সহকারে প্রস্তুত মিষ্টি রুটি পাউ-দ্য-লো। এমনকি পরে ভারতে যখন ইংরেজ শাসনামল তখনো পশ্চিম ভারতে সর্বোৎকৃষ্ট রুটি বানাত পর্তুগীজরাই।
১৬৩৮ সালে অ্যালবার্ট ম্যানডেলস্লো নামের তরুণ জার্মান যখন ভারত সফরে ছিলেন, তখন গোয়ার সেন্ট পল কলেজে তিনি পর্তুগীজ কনফেকশনারি খান তিনি। টেবিলে ছিল ফল, রুটি আর মিহি পোর্সেলিনের প্লেটে নানাবিধ মাছমাংসের পদ। খাবারের শেষে ডেজার্ট হিসেবে আসে টার্ট, ফ্লোরেন্টিন, ডিমের কাস্টার্ড, মিষ্টিপান আর মোরব্বা।
বাংলায় পর্তুগীজেরা মগদের এইসব রান্নায় উস্তাদ করে তোলে। বৌদ্ধ মগদের আরব সওদাগরের দল জাহাজে খালাসি আর বাবুর্চিপদে চাকরি দিত অনেক আগে থেকে। হুগলীতে পর্তুগীজ গেড়ে বসার পর তারা আরবদের লাথ মেরে তাড়িয়ে দেয় ঠিকই কিন্তু আরবদের মতই খালাসি বাবুর্চি হিসেবে মগদের রেখে দেয়। দেখতে দেখতে মগেরা বেকিং এ চোস্ত হয়ে ওঠে। ইয়োরোপীয় স্টাইলে পেস্ট্রি আর কেকবিস্কিট বাংলায় সরবরাহ হতে থাকে।
এদিকে গোয়ার বাবুর্চিরা আস্তে আস্তে পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো শুরু করল। গরুর খাঁটি দুধ বা বাদামের দুধের বদলে নারকেল দুধ দেয়া হল, চিনির বদলে চালানো হল গুড়ের ডেলা। মাখমের বদলে ঘি। আটার বদলে চালের গুঁড়া।
পর্তুগীজ খাবার ছিল মাংসভিত্তিক। ভেড়া, শুকর, গরুর মাংস। মুসলিমেরা শুকর ছুঁত না, হিন্দুরা শিউরে উঠত গরুর মাংসের নামে। এছাড়া প্রচুর ভারতীয় ছিল নিরামিষভোজী। এইসবের তোয়াক্কা না করে পর্তুগীজেরা গণহারে মাংস সাঁটাত। এতে তেমন অবাক হবার কিছু না থাকলেও মূল বিস্ময়ের ব্যাপার হল তারা স্থানীয় জনগণের খাবারের অভ্যাস পাল্টে দিতে পেরেছিল অনেকখানি।
১৬৫০ সালে জঁ ব্যাপ্তিস্ত তাভের্নিয়ে দেখে গেছেন সেখানে সাধারণ জনগণ গরু আর শুকরের মাংস খায়। গোয়ার খ্রিস্টান ক্যুইজিনে আজও প্রচুর মাংসের ছড়াছড়ি। ভারতে অন্য কোন ইয়োরোপীয় জাত স্থানীয় লোকের খাবারে এতটা হস্তক্ষেপ করতে পারেনি। পর্তুগীজেরা পেরেছিল দেশের লোককে পাইকারি খ্রিস্টানধর্মে দীক্ষিত করে। উনবিংশ শতাব্দীতে গোয়ার অধিকাংশ লোকে লাইন ধরে রোববারে গীর্জায় যেত, ইয়োরোপীয় জামাজুতা পরত, দাড়ি কামাত আর পর্তুগীজ স্টাইল বাংলোয় থাকত। আর সবচেয়ে বড় কথা, নির্বিচারে গরু শুয়োর খেত।
পর্তুগীজরা গোয়ার লোকদের খালি গরু শুয়োর খেতেই শেখায়নি তা রাঁধতেও শিখিয়েছিল। গোয়ার নামকরা খাবারটির নাম ভিন্দালু, যা কিনা এখন পশ্চিমে অধিকাংশ ভারতীয় রেস্টুরেন্টে পাওয়া যায়। ইংরেজ ১৭৯৭ সালে পয়লা ভিন্দালু চেখে দেখে, গোয়া দখলের পরে। ইয়োরোপীয় রান্নায় দক্ষ জাতপাতহীন বাবুর্চি ভারতে পেয়ে ইংরেজ হয় আনন্দে আটখানা, পত্রপাঠ এদের কিচেনে লাগানো হয় আর পরে তাদের সাথে নিয়ে যায় ইংল্যান্ড। এভাবেই লন্ডনে ভিন্দালুর ব্যবসা জমে ওঠে।
ভিন্দালুকে সাধারণত মনে করা হয় ভারতীয় খাবার, কিন্তু আদতে এটা পর্তুগীজ খাবার কার্নে দি ভিনো ই আলুস এর গোয়ান সংস্করণ। কার্নে দি ভিনো ই আলুস মানে হল ওয়াইন ভিনেগার আর রসুন দিয়ে রান্না মাংস। “ভিন্দালু” শব্দটা “ভিনো ই আলুস” এর অপভ্রংশ। অল্প টক মাংসের এই তরকারি ছিল পর্তুগীজদের ব্যাপক পছন্দ। তবে ভারতে এসে পর্তুগীজেরা দেখল সেখানে ভিনেগার তৈরি হয়না, তবে বুদ্ধিমান বাবুর্চিরা তেঁতুল গোলমরিচ মিশিয়ে সেরকম টক সস তৈরি করে ফেলল ঠিকই।
কোন কোন ফ্রান্সিস্কান পাদ্রী নাকি এই সমস্যার সমাধান করেছিলেন তাড়ি থেকে ভিনেগার বানিয়ে। তার সাথে তেঁতুল আর ছিল অনেক রসুন। এই সসে তারা আরো দিত গোলমরিচ, দারচিনি আর লবঙ্গ। আর ভিন্দালুর আরেক সুপারস্টার মরিচ। কোন কোন রেসিপিতে ২০টা মরিচ ব্যবহারের কথাও আছে।
গোয়ান ক্যুইজনের মূল উপাদান হিসেবে মাথা চাড়া দেয় মরিচ। সকল মাছ আর নিরামিষের তরকারিতে, সসেজে আর শুয়োরের মাংসে মরিচ দেয়া হত। এভাবে শুরু হয় এক নতুন ফিউশন, পর্তুগীজ উপাদান (শুয়োর) তার সাথে হাল্কা আরব প্রভাব (শুকনো ফল), পর্তুগীজ কায়দা (ভিনেগারে রান্না করা), সাথে দক্ষিণ ভারতীয় মশলা, তেঁতুল, নারকেল কোরা আর নারকেলের দুধ। সাথে মরিচের ঝাল।
ভারতে অনেক কিছুর মতই মরিচ আমদানি করে পর্তুগীজরা। তারা টার্কিও এনেছিল, এই আজব পক্ষীকে দেখে ভারতীয়রা তো অবাক। বাদশা জাহাঙ্গীরের হুকুমে গোয়া থেকে টার্কি নিয়ে যাওয়া হয় রাঁধার জন্য, দরবারে টার্কির ছবিও আঁকেন আঁকিয়ের দল। তবে ইংরেজ আসার আগে টার্কির মাংস জনপ্রিয় হয়নি।
এছাড়া ছিল অজানা ফলের আমদানি। পর্তুগীজরা আমেরিকা থেকে আনে পেঁপে, আতা আর পেয়ারা। আর ছিল প্রবল জনপ্রিয় ফল আনারস। কলম্বাস ১৪৯৩ সালে দ্বিতীয় যাত্রায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে আনারস বগলে নিয়ে আসেন, আর স্প্যানিশরা এর প্রেমে পড়ে যায়। ধারণা করা হয় ১৫৫০ সালের দিকে পর্তুগীজেরা ভারতে আনারস আনে। জাহাঙ্গীর ১৬০৫ এ গদীতে আরামে হেলান দিয়ে যখন বসেন ততদিনে ইয়োরোপীয় কুঠিগুলোয় আনারস ফলে একাকার। এই জাহাঙ্গীর বাদশা ছিলেন বিরাট ফলখোর, টেবিলে নিয়মিত আনারস সাপ্লাই নিশ্চিত করতে তিনি আগ্রায় আনারস আবাদের হুকুম দিলেন।
মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই ভারতে টমেটো আর আলু আনে পর্তুগীজরা, তবে ইংরেজ এগুলো রান্নার কায়দা দেখিয়ে দেওয়ার আগে ভারতে তা তেমন জনপ্রিয় ছিলনা। এর চেয়ে অনেক সফল ছিল কাজুবাদাম, আজও গোয়ায় আর কেরালা উপকূলে কাজুবাদাম হয়। দক্ষিণ ভারতীয়রা সিফুড পুলাউ এ চিংড়ির সাথে এই বাদাম দেয়, সসে বাদাম দেয়, বাদাম গুঁড়া করে পাউডার করে তাই দিয়ে কাজু-কাটলি নামের মিষ্টি বানায়। আর কাজুগাছের ডাঁটা ছেঁচে জুস বের করে তাই দিয়ে “ফেনি” নামক কড়া মদ বানায়।
এখনো গোয়ার পাঞ্জিম শহরের ছোট তাড়িখানায় দেখা যায় রেডিওতে ক্রিকেটের ধারাবিবরণী শুনতে শুনতে ফেনি গলায় ঢালছে লোকে। মরিচ নিঃসন্দেহে ভারতীয় খাবারে পর্তুগীজদের সবচাইতে বড় অবদান। তবু এমনকি সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত মরিচ দক্ষিণ ভারতেই আটকে ছিল।
দুই শতাব্দী পার হয়ে গেছে ততদিনে পর্তুগীজদের মরিচ আমদানীর। উত্তর ভারতে মরিচ নিয়ে যায় মারাঠারা। মারাঠাদের নাম ছিল উদ্দাম আর বিপদজনক হিসাবে, মোগল পর্তুগীজ দুয়েরই ঘাম ছুটিয়ে ছেড়েছিল মারাঠা। শেষ মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের দুই চোখের বিষ ছিল মারাঠা, তাদের নেতা শিবাজীকে তিনি তাচ্ছিল্য করে ডাকতেন পাহাড়ের ইঁদুর। দুমদাম ঝটিকা আক্রমণ করে বড় মোগল বাহিনীকে ঠাশ ঠাশ চড় মেরে দ্রুত পাহাড়ে পালিয়ে যেত ছোট ছোট সঙ্ঘবদ্ধ মারাঠা বাহিনী।
এক উত্তর ভারতীয় পন্ডিত লিখে গেছেন যে তার মনে হয় মারাঠারা “শুষ্ক আর মাথাগরম” থাকত কারণ তারা “সবকিছুর মধ্যে মরিচ দিত”। সারাদিন যুদ্ধংদেহী মনোভাবের এই তার কারণ মনে হত। তিনি বলেন, মোগলেরা খেত চাউলের পুলাউ, বাদামের হালুয়া আর মধ্য এশিয়ার শুকনা ফল, তাই তারা নরমসরম। এই কথায় সত্যতা তেমন না থাকলেও একথা ঠিক যে ঘর থেকে দূরে দিনের পর দিন পড়ে থাকা মোগলেরা তাদের রাজসিক খাবার আর আফিম মেয়েমানুষ ইত্যাদি না পেয়ে ভারি মনমরা থাকত।
মারাঠারা পর্তুগীজদেরও ব্যাপক দৌড়ের উপর রেখেছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে মারাঠারা ব্যাপক তাণ্ডব চালায় পর্তুগীজ কুঠিগুলোয়, ১৭৪৯ সাল আসতে আসতে পর্তুগীজের হাতে দিউ, দামান, ভাসেই আর গোয়া এই চারটে কুঠি অবশিষ্ট ছিল। ওলন্দাজ থাপড়ে নিয়ে গেছে কোচিন আর ইংরেজ বাগিয়ে নিয়েছে মশলা বাণিজ্য। ম্যালেরিয়া কলেরায় গোয়ায় মানুষ মারা যাওয়া শুরু করল, আর উনবিংশ শতাব্দী আসতে আসতে শহর জনশূন্যই হয়ে গেল বলা যায়।
আর যে মারাঠার দল পর্তুগীজদের কান ধরে বের করে দেয়ায় বড় ভূমিকা রেখেছিল সেই তারাই উত্তর ভারতে নিয়ে গেল পর্তুগীজ মরিচ। উত্তর ভারতের সেই পন্ডিত লিখে গেছেন, “এই গত দশ বিশ বছর ধরে এইসব লোকেরা যে খালি ঝাড়ে বাড়ছে তাই নয়, এলাকার লোকেদেরও এরা মরিচ খাওয়া শিখিয়ে ছেড়েছে।”
আরও পড়ুনঃ ভারতবর্ষের ইতিহাস – পর্বঃ ২