এক
ঔপনিবেশিক ইংরেজের জাহাজে কেউ ঢিল মারলেই তাকে জলদস্যু ডাকা হত, যার ঢিল যত বড় সে তত বড় কুখ্যাত জলদস্যু। এইরকম এক দুর্ধর্ষ জলদস্যু ভারতের পশ্চিম উপকূলে ইংরেজকে খুবই বিরক্ত করতো, তার নাম কানোজী আংরে। মারাঠা নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল। বম্বে থেকে সাভান্তওয়াড়ি পর্যন্ত আস্ত পশ্চিম ভারতীয় উপকূল ছিল তার সাম্রাজ্য, ১৭২৯ সালে মৃত্যুর আগ অবধি প্রবল প্রতাপশালী নৌ পরাশক্তি ইংরেজ, পর্তুগীজ আর ওলন্দাজের সাথে যুদ্ধে তিনি ছিলেন আনডিফিটেড চ্যাম্পিয়ন।
কানোজীর শৈশব সম্পর্কে অল্পই জানা যায়। তার পিতা টুকাজী মারাঠা লিডার শিবাজীর বাহিনীতে যোগ দেন ১৬৫৮ সালে, নানাবিধ যুদ্ধে অ্যাকশন ট্যাকশন দেখিয়ে পদোন্নতিও হয় তার দ্রুত। তাকে গুরুত্বপূর্ণ নৌ মিলিটারি পোস্ট স্বর্ণদূর্গে পাঠানো হয়, এখানেই কানোজী চোখ মেলে বেড়ে ওঠেন। তার দিন কাটে সাগরের তীরে জাহাজ তৈয়ার দেখে, নাবিকদের খুব কাছে থেকে দেখে ছোটবেলা থেকেই তার সাগরের জীবন সম্পর্কে ধারণা পোক্ত হয়।
১৬৯৮ সালে তাকে সরখেল অর্থাৎ অ্যাডমিরাল পদে বসানো হয়, তাকে দরিয়া সারেং ও ডাকা হত। পশ্চিম উপকূলের সর্দার হবার পর প্রথম প্রথম তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর জাহাজ ছুঁতেন না, কিন্তু পরে আরেকটু পাকনা হয়ে ১৭০২ সালে তিনি ৬ ইংরেজসহ কোম্পানীর নৌকা পাকড়ে নিজের বন্দরে নিয়ে যান। হাঁ হাঁ করে বোম্বে থেকে কোম্পানীর লোক খবর পাঠায় যেন কালবিলম্ব না করে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। কানোজী সেই অনুরোধ উপেক্ষা করেন এবং বোম্বে কুঠিতে খবর পাঠান যে তিনি তাদেরকে আংরে নামটা সারাজীবন মনে রাখার ব্যবস্থা করবেন।
১৭০৪ সালে তিনি নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করেন। বোম্বে কাউন্সিল হুমকি দেয় কোন অবস্থাতেই যেন বোম্বে উপকূল এলাকায় ইংরেজ জাহাজ তল্লাস বা আটক না করা হয়, ইংরেজ ঐ এলাকা নিজের খাসতালুক বলেই মনে করত। কানোজী পাল্টা বলে পাঠান যে এলাকা তার নিজের, সুতরাং তার দস্তক নিয়েই সকল জাহাজ চলবে। অন্যথা হলে যেখানেই জাহাজ সেখানেই কষা মাইর। তিনি তার কথা রেখেছিলেন।
১৭০৭ সালে তিনি বোম্বে ফ্রিগেট আক্রমণ করে উড়িয়ে দেন। ১৭১০ সালে বোম্বের কাছে কান্নারি দ্বীপ (বর্তমানে খান্ডেরি) দখল করেন, ব্রিটিশ জাহাজ গোডলফিনের সাথে দুইদিন তুমুল যুদ্ধ চলে। ইংরেজ বীরত্বের সাথে পলায়ন করে, যাকে বলে বাহাদুরিকে সাথ হটনা। তারা পরে দাবী করে যে তারাই হুড়ো দিয়ে কানোজীকে ভাগিয়ে দেয়। বৃহৎ ইয়োরোপীয় জাহাজের সাথে দিনের পর দিন যুদ্ধ করলেও কানোজীর ফ্লীটের পক্ষে তা দখল করা সম্ভব ছিল না, কারন তার বেশিরভাগ জাহাজ ছোট সাইজের দ্রুতগামী মিলিটারি বোট। গভীর জলের বৃহৎ জাহাজের সাথে সম্মুখ সমরের বদলে আতকা ঝটিকা ফাইট দিতেই তারা পটু। তাই গোডলফিন পার পেয়ে যায়।
১৭১২ সালের নভেম্বরে তিনি কান পাকড়ে ধরে আনেন বোম্বে গভর্নরের সশস্ত্র ইয়ট, এক মাস পরে গোয়ার উত্তরে দুই কোম্পানীর লোক আটক করা হয়। এইসব ঘটনার কিছুদিন আগে কানোজী একটি বৃহৎ পর্তুগীজ আর্মাডার কয়েকটি জাহাজ দখল করেন, বিপুল পরিমান কামান বারুদ সহ। এই ঘটনায় ত্যক্ত হয়ে পর্তুগীজ বলে হে আমার ইংরেজ ব্রাদার, আইস দুইজনে মিলে কানোজীর সানডে মানডে ক্লোজ করে দেই। উন্নাসিক ইংরেজ গভর্নর এইস্ল্যাবি সেই অফার প্রত্যাখ্যান করেন, নোংরা পর্তুগীজের সাথে আবার কিসের প্যাক্ট।
কানোজী বোম্বেতে তিরিশ হাজার রূপী দাবী করে বন্দীদের মুক্তির বিনিময়ে, ইংরেজ সেই টাকা পাঠায়। মুক্তি পায় ইয়োরোপীয় বন্দীর দল। তখন চুক্তি হয় ইংরেজ কানোজীর মধ্যে। চুক্তি অনুযায়ীঃ
১. কোন ইংরেজ জাহাজ কানোজী আক্রমণ করবেনা
২. মাহিম হতে বোম্বে পর্যন্ত কেউ কারো জাহাজে হাত দেবেনা
৩. রেগুলার দস্তক পরিশোধ করে ইংরেজ সওদাগরেরা কানোজীর সকল বন্দরে বাণিজ্য করতে পারবে
৪. যেকোন মারাঠা জাহাজ ইংরেজ জাহাজ আক্রমণ করলে তার দায় নিতে কানোজী বাধ্য থাকবে
৫. ইংরেজ বন্দরে মারাঠারা পাস কিনে বাণিজ্য করতে পারবে।
কানোজী এই সকল শর্ত মেনে নেন, কিন্তু তার প্রস্তাবিত অন্যান্য শর্ত ইংরেজ মেনে নেয়নি। সেগুলো ছিলঃ
১. কোম্পানীকে মূল্য বুঝিয়ে দেবার সাথে সাথে তারা তাকে বারুদ বিক্রয় করবে
২. একটি জায়গা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে তাকে বারুদ ফ্যাক্টরি গড়ার জন্য
৩. শত্রু আক্রমণ করলে ইংরেজ তাকে সাহায্য করবে
৪. সওদাগরি জাহাজ বোম্বে বন্দরে রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে না।
সুতরাং এই চুক্তি চূড়ান্তরকম একতরফা, কানোজীকে কোনঠাসা করাই এর উদ্দেশ্য। ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠতে থাকেন কানোজী, সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকেন তিনি।
জড়ো করা হয় শক্তিশালী জাহাজ, প্রতিটায় বসানো হয় ৩০ থেকে ৪০টি কামান। বাহিনীর চিফ গানার হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় এক দূর্দান্ত ওলন্দাজকে। আরো চাকরি পায় জ্যামাইকান দুর্ধর্ষ জলদস্যু জন প্ল্যান্টেইন, তাকে করা হয় দ্রুতগামী মিলিটারি নৌকা ফ্লীটের প্রধান। এদের অল্প বেতনের ব্যবস্থা করা হয়, আর ডিল হয় যে লুটপাটের তিন চতুর্থাংশ তাদের।
১৭১৭ সালে বোম্বের গভর্নর চার্লস বুন ঠিক করলেন কানোজীর ঘাঁটি বিজয়দূর্গ আক্রমণ করতে হবে। ক্যাপ্টেন বার্লোর অধীনে শক্তিশালী ব্রিটিশ ফ্লীট বিজয়দূর্গ অভিযানে গেল, সেখানে মারাঠা বাহিনী তাদের দেয় বেধড়ক পিটুনি। অধিকাংশ ইংরেজ নাবিক সিপাই অক্কা পায়, বাকিরা এদিক ওদিক পালিয়ে বাঁচে। মরিয়া ক্যাপ্টেন বুন ১৭১৮ এর নভেম্বরে আবার হামলা করেন। তার জাহাজ বন্দরে যাবার সময় তেমন গুলিগোলা চলেনি, কিন্তু পার্শ্ববর্তী বীচে জাহাজ ভিড়ানো মাত্রই গর্জে ওঠে স্ট্র্যাটেজিক্যাল লোকেশনে বসানো মারাঠা কামান। টানা গুলি চালিয়ে ইংরেজের হালুয়া টাইট করা হয় এবং পুনরায় তারা দূর্গের ধারেকাছেও না গিয়ে উল্টোদিকে পালাতে বাধ্য হয়।
আতঙ্কিত বোম্বে গভর্নর মহান ইংল্যান্ডের রাজার কাছে রিইনফোর্সমেন্ট চেয়ে পাঠান, বোম্বে মেরিনে যোগ দিতে আসে কমোডর ম্যাথিয়াসের নেতৃত্বে চারটে রাজকীয় রণতরী। মরিয়া ইংরেজ দুশমনি ভুলে ডাক দেয় পর্তুগীজকে, একত্রে তারা বিজয়দূর্গের মাইল পাঁচেক দূরে কোলাবা আক্রমণ করে। অক্টোবর ১৭২২ এর কথা। সম্মিলিত ইয়োরোপীয় শক্তির পুটুতে সাফল্যের সাথে রামলাথি কষিয়ে এবারেও তাদের বিতাড়িত করে দুর্ধর্ষ মারাঠা বাহিনী। আক্রান্ত জাহাজ, গোলাবারুদ ইত্যাদি মারাঠাদের হাতেই রেখে পালাতে বাধ্য হয় ইংরেজ পর্তুগীজ।
অন্য পরাক্রমশালী ইয়োরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি ওলন্দাজকেও ক্ষেপিয়ে দিয়েছিলেন কানোজী, তাদের কিছু জাহাজ তিনি দখল করেন। ১৭২৪ সালে এবার দূর্গ আক্রমণ করে ওলন্দাজ বহর, তাদের ছিল সাতটে শক্তিশালী জাহাজের স্কোয়াড্রন। প্রত্যেক জাহাজে পেরেক মারা ছিল ৩০ থেকে ৫০টি বৃহৎ কামান। যথারীতি এদেরকেও পিটিয়ে তক্তা করা হল।
মারাঠা ফ্লীটের জাহাজের থেকে ইংরেজ, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ এমনকি মোগল জাহাজও বড় ও শক্তিশালী ছিল, তবু কানোজীর বাহিনীর এই অপ্রতিরোধ্য গতির কারণ ছিল তার নিজস্ব ট্যাকটিকস। তার জাহাজগুলি ছিল ছোট ও দ্রুতগামী, যেকোন আক্রমনে তারা বড় জাহাজকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে করতো পাইকারি অ্যাটাক। আক্রান্ত জাহাজের গানার কোনদিকে কামান ফিরাবে সেইটা বুঝতে বুঝতেই দড়ি বেয়ে উঠে আসতো মারাঠা সিপাইরা, আর সবাইকে মেরে পিটিয়ে বারুদ সোনা লুট করে জাহাজে আগুন ধরিয়ে যেভাবে এসেছিল সেভাবেই দ্রুত পালিয়ে যেত কানোজীর লোক। খাঁটি ব্লিৎজক্রিগ।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
এই ট্যাকটিকসের দুর্বল দিকটা হল, কানোজীর নৌবাহিনীকে সর্বদা উপকূল এলাকার কাছাকাছি থাকতে হত। তার জাহাজ গভীর সমুদ্রে অপারেশনের উপযোগী ছিলনা। তাই প্রায়ই দেখা যেত ইংরেজ পর্তুগীজ জাহাজ তার ধাওয়া খেয়ে গভীর সাগরে পালিয়ে গেছে। মারাঠারা মাইলের পর মাইল খোলা জলে লড়াই করার মত জাহাজ তৈরী করেনি, তাই তাদের বিচরন ছিল মোটামুটি ভারতের পশ্চিম উপকূল ঘিরে।
দুই
নিউপোর্ট, রোড আইল্যান্ডের টমাস টিউকে ১৬৯২ সালে বারমুডায় দেখা যায়। সেখানে সে একটা ছোট পালতোলা নৌকা কেনে, পয়সা সে কোথায় পেয়েছিল কেউই নিশ্চিত না। তবে পরে এক কর্মকর্তা লিখে গেছেন যে সে অতীতে দুর্ধর্ষ জলদস্যু ছিল। ১৬৯১ এর শেষে একই নামের এক দস্যু কেপ কডে লুটপাট চালায়। যদিও একথা প্রমাণিত না যে এই টিউই সেই ব্যক্তি, কিন্তু সন্দেহ থেকেই যায়।
১৬৯২ সালে মহাজোটের যুদ্ধ [ওয়ার অফ গ্র্যান্ড অ্যালায়েন্স। সপ্তদশ শতাব্দীতে অস্ট্রিয়া, হোলি রোমান এম্পায়ার, স্পেন, সুইডেন, স্কটল্যান্ড, বাভারিয়া, ওলন্দাজ ইত্যাদি বিভিন্ন ইয়োরোপীয় পরাশক্তির ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের বিরুদ্ধে গঠিত মহাজোট] তুঙ্গে, গভর্নর রিচিয়ারের কাছ থেকে সে ফরাসী জাহাজ আক্রমণ করার লিখিত পরোয়ানা বের করে আনে। এরপর সে পাল তোলে পূর্ব দিক।
পশ্চিম আফ্রিকার তটের কাছে ঝড়বাদল পার করে উত্তমাশা অন্তরীপ পেরিয়ে টিউ প্রবেশ করে ভারত মহাসাগরে, তারপর চলতে থাকে লোহিত সাগরের দিকে। পূর্ব আফ্রিকা আর আরব উপদ্বীপের মাঝে ১৭ মাইল চওড়া এলাকাকে আরবেরা ডাকতো- বাবেল মান্দেব অর্থাৎ অশ্রুকণার প্রবেশদ্বার। এইখানেই টিউ তার প্রথম শিকার পায়।
১৬৯৩ এর জুলাইয়ে দেখা গেল একটি “উঁচু জাহাজ” যাচ্ছে লোহিত সাগরের উত্তরপানে। জনসন বলে গেছেন যে সেই বৃহৎ জাহাজে তিনশ সিপাই ছিল, “তবু টিউ বুক চিতিয়ে তা আক্রমণ করে জয় করে। বলা হয়ে থাকে এই অভিযানে টিউয়ের দলের প্রত্যেক সদস্য তিন হাজার পাউন্ডের উপরে বখরা পায়”। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ছিল তাদের স্বপ্নেরও অতীত। আক্রান্ত জাহাজটি মোগল সম্রাট প্রথম আলমগির (আওরঙ্গজেব) এর, তাই জাহাজভর্তি ছিল হিরেমোতি সিল্ক আর মশলার ছড়াছড়ি।
টিউয়ের দল খবর পেল এইটি একটি মোগল বহরের প্রথম জাহাজ, আরো পাঁচটি জাহাজ কাছাকাছিই আছে। টিউ সেগুলিও ধাওয়া করতে চাইলেন, কিন্তু কোয়ার্টারমাস্টার আর অধিকাংশ নাবিক বেঁকে বসে। হাল্কা মারপিটের পর অধিকাংশের কথাই গ্রাহ্য হল, যে যার পয়সা বুঝে নিয়ে ফিরে যাওয়ার পথ দেখল। টিউ আমেরিকা ফিরে যায়।
১৬৯৪ এর নভেম্বরে টিউ পুনরায় সাগরে পাড়ি জমায়, মাদাগাস্কারে টমাস ওয়েক, উইলিয়াম ওয়ান্ট, টমাস জোনস আর ক্যাপ্টেন গ্লোভার তার সাথে যোগ দেয়। এরা সবার চোখ ছিল প্রাচ্যের সম্পদের দিকে। টিউকে সর্দার ঘোষণা করা হল। এইসব জলদস্যু জাহাজের একটির নাম “ফ্যান্সি”, তার ক্যাপ্টেন হেনরি এভেরি।
১৬৯৫ এর জুনে টিউ আবার ঘুরাফিরা করতে থাকে বাবেল মান্দেবে। পরে কি হল তা খানিক অস্পষ্ট, সম্ভবত টিউ দক্ষিণে ধাবমান এক ভারতীয় সওদাগরের বহর টার্গেট করে। বহরের কিছু অংশ সুরাটে যাচ্ছিল। টিউয়ের মূল লক্ষ্য সম্ভবত ছিল সশস্ত্র ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ ফতে মুহম্মদের সাথে থাকা মোগল ধনদৌলতে ভরপুর জাহাজ গাঞ্জে সাওয়াই। যাই হোক, পরবর্তী ঘটনা মোটেই টিউয়ের পক্ষে যায়নি…সেই সওদাগরী জাহাজের গোলা খেয়ে টিউ হল ইন্নালিল্লা। ক্যাপ্টেন মারা যাওয়াতে লোকজন খুব ভয় পেয়ে গেল, আর সেই গোলমালের ভেতর নেতা হিসেবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল ফ্যান্সি জাহাজের ক্যাপ্টেন এভেরি।
এভেরি জলদস্যু জগতের অতি কেউকেটা ব্যক্তি কিন্তু তার সম্বন্ধে জানা যায় অল্পই। জনসন বলে গেছেন যে তার জন্ম ডেভনের প্লেমিথে। অন্য রেকর্ডে পাওয়া যায় যে তার পিতা প্লেমিথের সরাই মালিক কিংবা ধনী জাহাজওয়ালা। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যে তার আসল নাম নাকি জন এভেরি, কিন্তু পরবর্তী সকল নথীতে এমনকি তার নিজের লেখা কাগজেও তার নাম জন নয় হেনরি এভেরি। বেঞ্জামিন ব্রিজম্যান নামটিও সে প্রায়ই ব্যবহার করত শোনা যায়। হতে পারে (না ও হতে পারে) যে সে নৌবাহিনীতে কাজ করেছিল কিছুদিন।
১৬৯৩ সালে রয়াল আফ্রিকান কোম্পানির কাগজে তার নামে হেডিং উঠেছিল যে “লং বেন ওরফে এভেরি” এক বিবেকবর্জিত ও লাইসেন্সবিহীন নচ্ছাড় দাস ব্যবসায়ী। সেই শতকের শেষ পর্যন্ত দাস ব্যবসায় রয়্যাল আফ্রিকান কোম্পানির ছিল একচেটে ব্যবসা, কিন্তু এইসব লং বেন মার্কা লোক তাদের সুখের নিদ্রায় ভারি ব্যাঘাত ঘটাত।
ফিরে আসি বাবেল মান্দেবে। নিজ জাহাজ ফ্যান্সি থেকে এভেরি খবর পেল নেতা টিউ তার জাহাজ অ্যামিটি তে গোলার আঘাতে নিহত হয়েছে, আর অ্যামিটির লোককে বন্দী করে নিয়ে গেছে ভারতীয় মোগল সিপাই। এভেরি সম্ভবত তাদের পিছু পিছু গিয়ে হাজির হয় মোগল যুদ্ধজাহাজ ফতে মুহম্মদে, যেখানে বন্দীদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এভেরি তখন ঠাণ্ডা মাথায় চাল চালল, জাহাজটিকে কৌশলে আলাদা করে সুযোগ বুঝে করল আক্রমণ। টিউয়ের অ্যামিটির গোলায় সম্ভবত মোগল জাহাজ কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েই ছিল, তাই বেশি লড়াই করতে পারল না। ফতে মুহম্মদের পতন হল, বন্দীরা হল মুক্ত। জাহাজ লুটে এভেরির পকেটে গেল পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডের মত। মেলা টাকা, কিন্তু আসল জাহাজের তুলনায় কিছুই না।
এইবার এভেরি নজর দিল গাঞ্জে সাওয়াই এর দিকে। এইটি সোজা জাহাজ নয়, ৬২ কামান আর পাঁচশ মোগল সিপাই ছিল তাতে। তবে ফ্যান্সি ছিল এর চেয়ে দ্রুতগতির, তার কামানের সংখ্যাও কম নয় ৪৬টি। এভেরির দলে দেড়শর মত সৈন্য। শুরু হল লড়াই।
লড়াই শুরু হতেই বোঝা গেল মোগল জাহাজের কপাল ভাল নয়। আতকা কোন কারণ ছাড়াই তাদের নিজেদের একটা কামান গেল ফেটে, তাতে মারা গেল কিছু সিপাই আর জাহাজময় ভারি তালগোল লেগে গেল। তার উপর ভাগ্যক্রমে ফ্যান্সির এক গোলা সোজা হিট করল মোগল জাহাজের মূল মাস্তুল, এরপর জাহাজ নিয়ন্ত্রণ করাই হল মুস্কিল। এইবার এভেরি তার জাহাজ পাশাপাশি এনে লাফ দিয়ে গিয়ে আক্রমণ করলেন মোগল সিপাইদের।
খুবই ঝুঁকির ব্যাপার কিন্তু, মোগল সিপাই তাদের চারগুণ তো হবেই তখন। শুরু হল খাঁটি পাইরেট তলোয়ার ফাইট। অভিজাত মোগল ক্যাপ্টেন ইব্রাহীম খাঁ সায়েব পেছনদিকে লুকিয়ে রইলেন, তার মতলব ছিল মোগলেরা বিজয়ী হলে বেরিয়ে আসবেন। তবে লড়াই তখনো যেকোনো দিকেই যেতে পারত, কিন্তু আস্তে আস্তে এভেরির লোকের হাতে বিজয় কাছিয়ে আসতে থাকে। ঘণ্টা দুই তুমুল পিটাপিটির পর মোগলেরা ক্ষ্যান্ত দিল, জাহাজের ডেকময় তখন লাশ আর লাশ।
গাঞ্জে সাওয়াই এভেরির হাতে আসল। ধনদৌলতের বহর দেখে এমনকি দুঁদে জলদস্যুদেরও চোখ ছানাবড়া, কম করেও সোয়া তিন থেকে ছয় লাখ পাউন্ডের মাল! সোনা রূপার মোহরে বোঝাই। এত পেয়েও জলদস্যুদের শখ মেটেনি, তারা জাহাজের যাত্রীদের ধরে ধরে পাশবিক নির্যাতন শুরু করে দিল। মেয়েরা লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করা শুরু করল আরো ভয়ঙ্কর পরিণতি এড়ানোর আশায়, জীবিত মেয়েদের জলদস্যুরা ইচ্ছেমত ব্যবহার করে। কয়েকদিনের ইচ্ছেমত লুট, নির্যাতন, ধর্ষণ আর হত্যার তাণ্ডব শেষ হলে জলদস্যুরা ফেরার পথ ধরে।
এরপর এভেরি ফরাসী দ্বীপ ল্য রিইউনিওনে গিয়ে লুটের মাল ভাগাভাগি করে নেয়, তারপর পর্তুগীজ দ্বীপ সাও তোমে তে থেমে সওদাপাতি করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পথ ধরে। সেখানে সেন্ট টমাস দ্বীপে নেমে তার চক্ষুস্থির, সেখানে সে মোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তি। তাদের মোগল সম্রাটের জাহাজলুটের খবর আমেরিকা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে আর তার লোকদের হন্যে হয়ে খোঁজা হচ্ছে। স্থানীয় গভর্নরেরা তার মহামূল্য হিরেমোতি ঘুষ নিতে রাজিই হল না, সে তখন এতই বিপদজনক। তখন এভেরি দল ভেঙে দিয়ে নিজের পথ দেখল।
পরে এভেরি সম্ভবত আইজ্যাক নামের এক ছোট পালতোলা জাহাজে আয়ারল্যান্ড ফিরে আসে। এরপরে সে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কেউ বলে তাকে বেঞ্জামিন ব্রিজম্যান ছদ্মনামে আয়ারল্যান্ডে দেখা গেছে, আবার কেউ দাবী করে সে কান্ট্রিসাইডে ভদ্দরলোকের মত থাকছে। ক্যাপ্টেন জনসন অবশ্য লিখে গেছেন যে এভেরি নাকি পরে ডেভনে ফিরে যায় আর পথের ভিখিরির মত তার মৃত্যু হয়, কিন্তু আসল কথা হল কি হয়েছিল তা সঠিক করে জানা যায়না। ইতিহাসে তার পরিচয় বুদ্ধিমান জলদস্যু হিসেবে, যে কিনা মহাশয়তানি করেও পার পেয়ে গিয়েছিল ঠিক।
তথ্যসূত্রঃ
প্রথম পর্ব
১. রাজারাম নারায়ন সালেতোর, Indian Pirates: From the Earliest Times to the Present Day
২. সত্যেন্দ্র সিং, Blueprint to Bluewater, the Indian Navy, 1951-65
৩. কে শ্রীধরণ, Sea: Our Saviour
৪. কে কে এন কুরুপ, India’s Naval Traditions: The Role of Kunhali Marakkars
৫. যোগেশ শর্মা, Coastal Histories: Society and Ecology in Pre-modern India
ছবিসূত্রঃ উইকিমিডিয়া
দ্বিতীয় পর্ব
অ্যাঙ্গাস কনস্ট্যাম রচিত Pirates: The Complete History From 1300 BC to the Present Day এর কিছু অংশের ছায়ানুবাদ। ব্যবহৃত ছবিটি The Pirates Own Book এ প্রকাশিত, উইকিমিডিয়া হতে নেয়া।