ভাষার উৎপত্তি ও ইতিহাস একটি বিশাল গবেষণা এবং আলোচনার বিষয়। বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় সাত হাজার ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে, যার অধিকাংশই রয়েছে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে। ভাষাবিজ্ঞানীরা এই বিপুল সংখ্যক ভাষাকে কয়েকটি ভাষা পরিবারে শ্রেনীবদ্ধ করতে পেরেছেন, প্রায় সকল ভাষাই কোন না কোন ভাষা পরিবারের সদস্য এবং নিকট কিংবা সুদূর অতীতে একটি ভাষা পরিবারের সকল ভাষার উৎসমূল একই। মূল ভাষা পরিবারগুলোর পরিচয় নিয়ে আলোচনা করা যাক।
অষ্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবারঃ
প্রাগৈতিহাসিক কালে ভারত থেকে শুরু করে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ন অঞ্চলে বসবাসকারী অষ্ট্রোলয়েড নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ছিল অষ্ট্রো-এশিয়াটিক বা অষ্ট্রিক ভাষা। পরে বিভিন্ন স্থানে অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষের আগ্রাসনে এই নৃ-গোষ্ঠী যেমন অবলুপ্ত হয়ে যায়, তেমনি অনেকাংশে সংকুচিত হয়ে পড়ে এই ভাষার ব্যাবহার। আবার অষ্ট্রোলয়েডদের সংস্পর্শে এসে মঙ্গোলীয় নৃ-গোষ্ঠীর অনেকে অষ্ট্রিক ভাষা গ্রহন করে। বর্তমানে এই ভাষা পরিবারে দুইটি ধারা বিদ্যমান-
১. মঙ্গোলীয় নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত মন-খেমার ভাষা
২. অষ্ট্রোলয়েড নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে প্রচলিত মুন্ডারী ভাষা
ভাষার ইতিহাস থেকে দেখা যায় ভারতে প্রথমে দ্রাবির এবং পরে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার আগ্রাসনে অস্ট্রিক ভাষাগুলো মূল জনগোষ্ঠী থেকে ক্রমে ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে যায়, যদিও বর্তমান ভারতের প্রধান ভাষাগুলোর মধ্যে, বিশেষতঃ বাংলায় এ ভাষার অনেক উপাদান রয়ে গেছে। থাইল্যান্ড এবং মিয়ানমারে চীন-তিব্বতী ভাষাভাষী মানুষদের বিভিন্ন দল ক্রমাগত বসতি স্থাপন করে অষ্ট্রিক ভাষাভাষীদের বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দেয়।
মালয়েশিয়া থেকেও অষ্ট্রিকরা মেলানেশীয় ভাষাভাষীদের আক্রমনে অপসৃত হয়ে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। মন-খেমার ধারার ভাষাগুলির মধ্যে শুধুমাত্র খেমার এবং ভিয়েটিক ভাষা দুটি বিশেষভাবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পেরেছে, এবং ভাষা দুটির রয়েছে হাজার বছরের লিখিত রুপ, কারন এই ভাষাভাষী রাজশক্তি কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে দীর্ঘদিন রাজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। এই দুটি ছাড়া এই পরিবারের অন্য ভাষাগুলি এখন বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে বিভিন্ন দেশে তাদের তাদের অস্তিত্ব ধরে রেখেছে।
ভারতের মেঘালয়ে নৃ-তাত্বিক মঙ্গোলীয় এবং মন-খেমার উপ ভাষা পরিবারের খাসিয়া ভাষী জনগোষ্ঠী নিজেদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাজ্য লাভ করলেও পশ্চিমবাংলা, বিহার, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে সাঁওতাল, মুন্ডা, হো, খাড়িয়া, ভূমিজ, ওঁরাও ইত্যাদি মুন্ডারী ভাষাভাষী আদিবাসী গোষ্ঠী সংখ্যালঘু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে কোন রকমে টিকে আছে। বৃহত্তর বাংলা অঞ্চলে সুদীর্ঘকাল ধরে বাঙালী জাতি গঠনের কালে বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে অষ্ট্রিকদের অধিকাংশই প্রোটো বাঙালিদের মাঝে বিলীন হয়ে যায়।
অন্যরা সমূলে উচ্ছেদ হয়ে দূরের পাহাড়/জঙ্গলে পালিয়ে যায়। এর বহু পরে সেন রাজত্বকাল থেকে পুনরায় তাদের কৃষি শ্রমিক হিসেবে বাংলাদেশের কয়েকটি অঞ্চলে পত্তন দেয়া হয়। এভাবে তারা এককালের নিজ দেশেই হয়ে আছে পরদেশী হয়ে, তবে ধরে রেখেছে তাদের সেই সুপ্রচীন ভাষা। এছাড়া থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া এবং চীনে নগন্য সংখ্যক মন-খেমার ধারার অষ্ট্রিক ভাষাভাষী মানুষ এখনও টিকে আছে।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারঃ
উরাল পর্বতমালার দক্ষিনে, বর্তমান রাশিয়ার বিস্তৃত স্তেপস্ অঞ্চলে একটি আধা যাযাবর আধা কৃষিজীবি ও পশুপালক জাতি প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে একটি ভাষা ও সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল। এরপর সম্ভবতঃ জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এবং ভূমি তথা খাদ্যের অপ্রতুলতার কারনে তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পশ্চিম, দক্ষিন এবং পূর্বদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
এই বিচ্ছিন্নতার কারনে তাদের ভাষায় ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে থাকে, কিন্তু এদের গভীরে সে মূল ভাষা ও সংস্কৃতির আদি রুপটি ঠিকই ভাষার ইতিহাস হয়ে রয়ে গেছে। এদের একটি দল খৃষ্টজন্মের দুহাজার বছর পূর্বকালে ককেশাস অঞ্চল এবং বর্তমানের রুমানিয়া, মলদোভিয়া, বুলগেরিয়া ও এশিয়া মাইনর অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং খৃষ্টপূর্ব দেড়হাজার বছর আগে তারা আনাতোলিয়া(বর্তমান তুরস্ক) অঞ্চলে সুপ্রশিদ্ধ হিটাইট জাতি গঠন করে।
অন্যান্য দল গুলি ধীরে ধীরে প্রায় সমগ্র ইউরোপ এবং মেসোপটেমিয়া হয়ে ইরান, আফগানিস্তান ও ভারতে বিস্তার লাভ করে। আমাদের, অর্থাৎ বাঙালী সহ বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের মাতৃভাষা এই মহা ভাষা পরিবারের অন্তর্গত।
প্রাথমিক পর্যায়ে এই ভাষা গোষ্ঠীর পশ্চিম ইউরোপ এবং পূর্ব ইউরোপ ও আর্যদের ভাষাসমূহ উচ্চারনগতভাবে দুটি শ্রেনীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। পরবর্তীতে পূর্ব ইউরোপ ও আর্যদের ভাষাভাষিদের শতম এবং পশ্চিম ইউরোপের ভাষাভাষীদের কেন্তম হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। এই শতম ও কেন্তম শব্দ দুটি আসলে আদি ইন্দো ইউরোপীয় ভাষার ১০০ সংখ্যাটিকে প্রকাশের জন্য ব্যাবহৃত “kṃtóm” শব্দটির দুটি বিবর্তিত রুপ।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
এটি śatam, satam, satəm, šimtas, sŭto ইত্যাদি রুপে পূর্ব ইউরোপীয় এবং আর্যদের মধ্যে ব্যাবহৃত হয়। এখনকার বাংলা হিন্দী ইত্যাদি ভাষায় এই ব্যবহৃত “শত” শব্দটি সেই “satam” শব্দেরই পরিবর্তিত রুপ। এইভাবে আদি ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাভাষী গোষ্ঠী একদিকে শতম অর্থাৎ ইন্দো-ইরানীয়, বাল্টিক, স্লাভ, আর্মেনিক, আলবেনীয় এবং অন্যদিকে কেন্তম অর্থাৎ হেলেনিক(গ্রীক), ইটালীক(ল্যাটিন), কেল্টিক, ডয়েচ(জার্মানিক) এবং তোখারিক ধারায় বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল।
ইন্দো-ইরানীয়(আর্য) ভাষা গোত্রঃ
ইরান, আফগানিস্তান এবং উত্তর ভারতের ভাষাগুলি এই ভাষার বিবর্তিত রুপ। এর মধ্যে রয়েছে প্রাচীন ইরানীয়, আভেস্তান, পাহলবী, সংস্কৃত, দার্দিক এবং আধুনিক ফার্সী, পশতু, কুর্দীশ, বালুচি, পাঞ্জাবী, সিন্ধী, হিন্দী, উর্দু, মারাঠী, গুজরাটী, উড়িয়া, অহম, সিংহলী, বাংলা ইত্যাদি ভাষা। বাল্টিক- প্রাচীন প্রুসিয়ান, বর্তমানের লিথুয়ানিয়ান, লাটভিয়ান, মলদাভিয়ান ভাষাসমূহ বাল্টিক ভাষা গোত্রের অন্তর্ভূক্ত।
স্লাভিক
বর্তমান রুশ, বেলারুশ, ইউক্রেনিয়ান, চেক, স্লোভাক, সার্বিয়ান, ক্রোয়াট, পোলিশ, বুলগেরিয়ান ইত্যাদি ভাষাসমূহ এই ভাষা গোত্রের অন্তর্ভূক্ত।
আর্মেনীয়
আর্মেনিয়া এবং রাশিয়ার কিছু অঞ্চলে বর্তমানে প্রচলিত ভাষাসমূহ এই ভাষা গোত্রের অন্তর্ভূক্ত।
আলবেনীয়
আলবেনিয়ায় বর্তমানে প্রচলিত ভাষাসমূহ এই ভাষা গোত্রের অন্তর্ভূক্ত।
হেলেনিক
প্রাচীন এবং আধুনিক গ্রীক ভাষা এই ভাষা গোত্রের অন্তর্ভূক্ত।
ইটালীক
প্রাচীন রোমান, ল্যাটিন এবং আধুনিক ইটালীয়, স্প্যানিশ, কাতালান, পর্তুগীজ, ফ্রেঞ্চ, রুমানিয়ান ইত্যাদি ভাষাসমূহ এই ভাষা গোত্রের অন্তর্ভূক্ত। স্প্যানিশ ভাষা বর্তমানে সারা বিশ্বে ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাভাষীদের মধ্যে সর্বাধিক মানুষের মাতৃভাষা।
কেল্টিক
এক সময় সমগ্র বৃটেন ও ফ্রান্সের প্রধান ভাষা ছিল কেল্টিক, বর্তমানে শুধুমাত্র আইরিশ ভাষা এই ভাষা গোত্রের অন্তর্ভূক্ত।
জার্মানিক
বর্তমান জার্মান, ইংলিশ, স্কটিশ, ডাচ, নরওয়েজিয়ান, সুইডিশ, আইসল্যান্ডার ইত্যাদি ভাষা জার্মানিক ভাষা পরিবারের অন্তর্গত। বৃটেনের প্রাচীন ব্রাইটন ভাষার স্থান অধিকার করে প্রথমে রোমান ভাষা এবং পরে জার্মান জাতিসত্বাভূক্ত এ্যাংলো স্যাক্সনদের ভাষা, যা এখন ইংলিশ হিসেবে পরিচিত। অপর দিকে আধুনিক জার্মান ভাষা জার্মানী এবং সুইজারল্যান্ড, অষ্ট্রিয়া, বেলজিয়াম ইত্যাদি দেশে প্রধান ভাষা হিসেবে পরিগনিত। জার্মান ভাষা আধুনিক ইউরোপে সর্বাধীক মানুষের মাতৃভাষা, অপরপক্ষে ইংলিশ বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ভাষা, যা প্রায় সকল দেশে গ্রহনযোগ্য ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। তোখারিক- প্রাচীন শক এবং বর্তমান চীনের উইগুর মুসলিমদের কথ্য ভাষা, তবে বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত।
ইউরোপের প্রায় সকল ভাষাই ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্গত, ব্যাতিক্রম হলো হাঙ্গেরীয়ান, ফিনিস(ফিনল্যান্ড), এস্তোনিয়ান, বাস্ক, জর্জিয়ান, চেচনিয়ান, ঈঙ্গুশেটিয়ান, দাগেস্তানী, এই ভাষাগুলি। রোমান সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রকৃয়ায় ইবেরিয়ান উপদ্বীপ(স্পেন ও পর্তুগাল) অঞ্চলে বসবাসকারী জনগন ধীরে ধীরে তাদের আদি ভাষা পরিত্যাগ করে ল্যাটিন ভাষা গ্রহন করে এবং ফ্রান্সের জনগন কেল্টিক ভাষা পরিত্যাগ করে ল্যাটিন গ্রহন করে বর্তমান কালের স্প্যানিশ, পর্তুগীজ এবং ফ্রেঞ্চ ভাষার জন্ম দেয়, তবে এ অঞ্চলের কিছু আদিবাসী শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তাদের প্রাচীন ভাষাটি এখনও বুকে ধারন করে আছে।
স্পেন ও ফ্রান্সোর তেমনি কিছু মানুষ এখনও সেই প্রাচীন বাস্ক ভাষায় কথা বলে। ভাষার ইতিহাস থেকে দেখা যায় ইন্দো-ইউরোপীয়দের সমকালে স্তেপস অঞ্চলে আরও একটি ভাষাভাষী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল, তারা হলো উরাল-আলটাইক জাতিগোষ্ঠী। এদের মধ্যে একটি দল ইউরোপের দিকে চলে যায়, তারা হাঙ্গেরী, ফিনল্যান্ড ও এস্তোনিয়া অঞ্চলে এখনও তাদের ভাষার অস্তিত্ব বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছে, এ কারনে তিনটি দেশের মানুষ এখন প্রাচীন উরাল ভাষা থেকে উদ্ভূত আধুনিক ভাষাসমূহ ব্যাবহার করে। জর্জিয়া, চেচনিয়া, ঈঙ্গুশেটিয়া ও দাগেস্তানের মানুষ স্লাভিক ভাষার প্রভাবমুক্ত থেকে এখনও প্রাচীন ককেশিয়ান ভাষা থেকে উদ্ভূত ভাষাসমূহের কোন একটি ভাষা ব্যাবহার করে।
আলটাইক ভাষা পরিবারঃ
রাশিয়ার স্তেপস অঞ্চলে যে সময় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা বিকষিত হচ্ছিল, সে সময় একই অঞ্চলে অন্য আরকেটি ভাষা প্রচলিত ছিল, যা উরাল-আলটাইক ভাষা হিসেবে পরিচিত। এই ভাষা পরিবারের একদল মানুষ ইউরোপের দিকে চলে যায়, যারা উরাল হিসেবে চিহ্ণিত, অন্য দল এশিয়া মাইনর এবং উত্তর এশিয়ার বিস্তির্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, তারা আলটাইক হিসেবে পরিচিত। এই ভাষা পরিবারের মূল তিনটি ভাষা হলো তুর্কীক, মঙ্গোলীয় এবং তুংগু। আধুনিক তুরস্ক, এশিয়া মাইনরের মুসলিম দেশ সমূহ, মঙ্গোলিয়া, সাইবেরিয়া সহ রাশিয়ার বেশ কিছু অঞ্চল, পূর্ব ইউরোপের বেশ কিছু অঞ্চল এবং চীনের বেশ কিছু অঞ্চল জুড়ে প্রধান কিংবা সহযোগী হিসেবে প্রায় ৩০ কোটি আলাটাইক ভাষা পরিবারের কোন একটি ভাষায় কথা বলে। এ ভাষার বহু উপকরন সমৃদ্ধ করেছে হাঙ্গেরীয়, ইরানীয়, ভারতীয়, রাশিয়ান, চীনা এবং আরবী ভাষাসমূহকে।
তুর্কীক
বর্তমান তুরস্ক, আজারবাইজান, বল্কান অঞ্চলের কয়েকটি দেশ যেমন বুলগেরিয়া-বসনিয়া, রাশিয়ার তাতার অঞ্চল, কাজাকিস্তান, কিরঘিজস্তান,উজবেকিস্তানে, তুর্কমেনিস্তান, চীনের উইগুড় প্রদেশ, সাইবেরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে তুর্কীক ভাষা থেকে উদ্ভূত আধুনিক ভাষা সমূহ প্রচলিত।
মঙ্গোলিয়ান
মঙ্গোলিয়া, চীনের জিনজিয়াং, কালমীক-রাশিয়া, বুরিয়াত-রাশিয়া, আফগানিস্তানের হেরাত প্রদেশ(মোঘল ভাষা), অন্তর্মঙ্গোলিয়া, মাঞ্চুরিয়া, চীনের গানশু প্রদেশ, ইত্যাদি অঞ্চলে মঙ্গোলিয়ান ভাষা প্রচলিত।
টুংগু
সাইবেরিয়ার কয়েকটি ভাষা যেমন; এভেন, নেগিডাল, নানাই, উগেডে ইত্যাদি এবং উত্তর-পশ্চিম চীনের মাঞ্চুরীয় জনগোষ্ঠির ব্যাবহৃত ভাষা।
এছাড়া কোরিয়ান এবং জাপানী ভাষা দুটিকেও আলটাইক ভাষা পরিবারভূক্ত বলে দাবী করেছেন বেশ কয়েকজন প্রখ্যাত প্রাচ্য ভাষাবিদ ও ভাষার ইতিহাস গবেষক (রামসটেড, এন্ড্রু মিলার, সের্গেই ষ্টারোসটিন, আন্না দাইবো, ওলেগ মুরদাক ), তবে অনেকেই আবার এ বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। তবে লক্ষনীয় বিষয় হলো, একসময় চীনা লেখনী রীতি ব্যাবহার করলেও এবং প্রচুর চীনা শব্দাবলী ব্যাবহার করলেও চীনা ব্যাকরন রীতির সাথে কোরিয়ান কিংবা জাপানী রীতির মিল নেই, বরং কোরিয়ান এবং জাপানী ভাষা দুটির মধ্যে ২৫% শব্দের মিল রয়েছে এবং ব্যাকরনগত ভাবে এ দুটি ভাষার সাথে আলটাইক ব্যাকরন রীতির যথেষ্ট মিল রয়েছে। আবার অনেকের (কোরিয়ায় অবস্থিত ফরাসি মিশনারীর দল, ক্লিফিংগার, কি মন লি, হালবার্ট) মতে কোরীয় ভাষা প্রোটো দ্রাবিরীয় তামিল ভাষা থেকে উদ্ভূত।
আফ্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবারঃ
আমাদের অতি পরিচিত সেমিটিক ভাষাসমূহ, যেমন আরবী, হিব্রু, ইত্যাদি এই ভাষা পরিবারের সদস্য। তবে সেমিটিক ছাড়াও এই ভাষা পরিবারে আরো পাঁচটি উল্লেখযোগ্য ভাষা গোষ্ঠী রয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছে আরও বিভিন্ন ভাষাসমূহ। এগুলো হলো বার্বার, শাদিক, কুশিটিক, ইজিপশিয়ান এবং ওমোটিক। মধ্য এশিয়া থেকে শুরু করে উত্তর আফ্রিকা, সহেলী আফ্রিকা, হর্ন অব আফ্রিকার বিস্তির্ন অঞ্চল জুড়ে রয়েছে আফ্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবারের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ। সেমেটিক ভাষার ইতিহাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সেমিটিক
মানব সভ্যতার ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ন ভাষাসমূহ সম্পৃক্ত রয়েছে এই ভাষাগোষ্ঠীতে। সেমিটিক নামটিও বেশ মজার, বলা হয়ে থাকে মহা প্লাবনের পর নবী নুহুর পুত্র সাম এই অঞ্চলে এসে বসতি গড়েন, তারই উত্তর প্রজন্ম হলো এখনকার জাতিগত সেমিটিকরা, সাম থেকে সেমিটিক, জাতি সেমিটিকদের ভাষাও সেমিটিক। বর্তমানে এই গোষ্ঠির আরবী, হিব্রু, আরামাইক, আমহারিক এবং তিগ্রিনিয়া ভাষায় বিভিন্ন দেশের মানুষ কথা বলে। মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর, পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার ২৭ কোটি মানুষ সরাসরি কোন একটি সেমিটিক ভাষায় কথা বলে, তবে অধিকাংশই আরবীতে। হিব্রু ইহুদী সম্প্রদায়, আরামাইক (বর্তমানে) আরবীয় খৃষ্টান সম্প্রদায় এবং আমহারিক ও তিগ্রিনিয়া ইথিওপিয়ায় ব্যাবহৃত হয়। প্রাচীন এবালাইট (সিরিয়া) এবং আক্কাদীয় (মেসোপটেমিয়া) সভ্যতার উত্তরসুরী এই ভাষাগোষ্ঠীর উদ্ভব খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে।
বার্বার
জাতিগত বার্বারদের মাতৃভাষা বার্বার, বর্তমানে মরক্কো এবং আলজেরিয়ার প্রধান ভাষা, এ ছাড়া আংশিকভাবে লিবিয়া, তিউনিশিয়া, মালি, নাইজার, বুরকিনা ফাসো, মৌরিতানিয়া ও মিশরে প্রচলিত। এটি অত্যন্ত প্রাচীন ভাষা, এর লিখিত রুপ প্রায় ২২০০ বছরের প্রাচীন। আগে টিফিনাগ লিপি ব্যাবহৃত হতো, মাঝে ল্যাটিন এবং এখন ব্যাপকভাবে আরবী লিপি ব্যাবহৃত হয়।
শাদিক
মধ্য এবং পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশে শাদিক ভাষাসমূহ ব্যাবহৃত হয়, যেমন নাইজার, নাইজেরিয়া, শাদ, মধ্য আফ্রিকা, ক্যামেরুন ইত্যাদি। কুশিটিক- হর্ন অব আফ্রিকা, তানজানিয়া, কেনিয়া, সুদান এবং মিশরের কিছু অংশে কুশিটিক ভাষা প্রচলিত। ওমোটিক- ইথিওপিয়ার দক্ষিন পশ্চিমাঞ্চলে প্রচলিত।
ঈজিপশিয়ান
প্রচীন মিশরীয় ভাষা, তবে অধুনা বিলুপ্ত এবং আরবী কতৃক অধিকৃত। এই ভাষাটিকে আগে হেমিটিক ভাষা বলা হতো, নবী নূহের পুত্র হাম এর নাম থেকে হেমিটিক। এর একটি রুপ “কপটিক” মিশরীয় খৃষ্টানদের মাঝে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত টিকে ছিল।
চীন-তিব্বতীয় ভাষা পরিবারঃ
এই সুবিশাল ভাষা পরিবারের একদিকে রয়েছে চীনা ভাষা গোষ্ঠী, অন্যদিকে তিব্বতী-বার্মান ভাষাগোষ্ঠী।
চৈনিক
চীন-তিব্বতীয় ভাষা পরিবারের প্রধানতম ভাষা হলো চৈনিক বা চীনা। পৃথক উচ্চারন রীতির কারনে এই ভাষাও অনেকগুলি উপভাষায় বিভক্ত, তবে জাতিগত হ্যান চৈনিকদের মাঝে প্রচলিত ম্যান্ডারিন ভাষাই অধিকাংশ চৈনিকদের সাধারন ভাষা, অন্ততঃ পঁচাশি কোটি মানুষ ম্যান্ডারিন ভাষায় কথা বলে। এ ছাড়া অন্যান্য গুরুত্বপূর্ন উপভাষা হলো- উয়ী(ক্যান্টনীজ): গুয়ানডং এবং গুয়াংজী প্রদেশের কথ্য ভাষা, এউ: সাংহাই, ঝেজিয়াং প্রদেশ এবং সন্নিহিত অঞ্চলের ভাষা, হাক্কা: গুয়ানডং এবং জীয়াংজি প্রদেশের ভাষা, ফুকিনিজ: ফুজিয়ান, গুয়ানডং, তাইওয়ান এবং সন্নিহিত অঞ্চলের ভাষা।
তাই
থাইল্যান্ডের থাই ভাষা, লাওসের লাও, মিয়ানমারের শান, উত্তর ভিয়েতনামের ভিয়েতনামী, চীনের মিয়াই এবং ঈয়াও, তাই ভাষা পরিবারে সদস্য।
তিব্বতী-বার্মান- তিব্বতী এবং মিয়ানমারের বর্মী ভাষা এই ভাষা পরিবারের অন্যতম প্রধান সদস্য। এ ছাড়া ভূটানের ভূটিয়া, লেপচা, পূর্ব ভারতের কোচ, বোরো, গারো, হাজং, মিজো, চাকমা, নাগা, মিয়ানমারের কাচিন, চীন, কারেন, দক্ষিন চীনের লোলো ইত্যাদি।
নাইজার-কঙ্গো এবং নীল-সাহারা ভাষা পরিবারঃ
আফ্রো-এশিয়াটিক ভাষাভাষী অঞ্চলের দক্ষিনে সমগ্র আফ্রিকার দেশসমূহে এই দুটি ভাষা পরিবারের অন্তর্গত কোন না ভাষা ব্যবহৃত হয়। নাইজার-কঙ্গো ভাষা পরিবার বর্তমানে জীবন্ত ভাষা সমূহের সবচেয়ে বেশী সংখ্যক ভাষা ধারন করে আছে, যদিও এদের অধিকাংশই বিলুপ্তির প্রান্তসীমায় অবস্থান করছে। এই পরিবারের প্রধান প্রধান ভাষা গোত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে আটলান্টিক, বান্টু(এর উল্লেখযোগ্য ভাষা সহেলী), মান্ডে, কর্দোফেনিয়ান ইত্যাদি। নীল-সাহারা পরিবারের উল্লেখযোগ্য গোত্রগুলির মধ্যে রয়েছে লাও, কানুরী, তেসো, নুবিয়ান, মাসাই, নুয়ের, ফুর ইত্যাদি।
বৃহত্তর আমেরিকায় এখনও টিকে আছে কয়েকশো ভাষা, যাদের সাথে উত্তর সাইবেরীয়া অঞ্চলে প্রচলিত ভাষাসমূহের দূরবর্তী সম্পর্ক রয়েছে। এদেরও অধিকাংশ ভাষা বিলুপ্তির প্রান্তসীমায় রয়েছে।
ইতিহাসের পরিপূর্ণ জ্ঞানের ক্ষেত্রে ভাষার উৎপত্তি, ইতিহাস এবং এর ধারা-উপধারা সম্পর্কে জানাটা খুবই জরুরী। সভ্যতার বিবর্তনে অনেক ক্ষেত্রেই ভাষা বিবর্তনের মুখ্য ভূমিকা ছিল।
বাংলা ভাষায় শব্দ ভাণ্ডার নিয়ে জানতে পড়ুনঃ রিপ্লি থেকেঃ শব্দ ও ভাষার কথা