তারেক অণুব্লগপোস্ট

স্বর্গ উপত্যকা ভিনিয়ালেস

লিখেছেনঃ তারেক অণু

চোখ জুড়ানো ঘন সবুজ পাহাড়ের সারি ঘেরা, যেন রূপকথার পাতা থেকে উঠে আসা এক অঞ্চল, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে বড় দ্বীপ পৃথিবীর চিনির পাত্র খ্যাত কিউবার সবচেয়ে উর্বর ভূমি এটি। সেই সাথে সারা বিশ্বের অন্যতম নয়নাভিরাম ও সবুজতম এলাকা বলে খ্যাত। সারি সারি আকাশ ছোঁয়া চুনাপাথরের পাহাড় তৈরি করেছে মোহিনী সব ঘন সবুজ উপত্যকা, তার ফাঁকে ফাঁকেই গড়ে উঠেছে মানব বসতি।

কেবল ভিনিয়ালেস এসে পৌঁছেছি আগস্টের এক পাগল করা গরমের দুপুরে, ভারি ব্যাকপ্যাক রেখে ঝুল বারান্দার আরাম কেদারায় জমিয়ে বসে দৃষ্টি মেলে দিয়েছি সুদূরের দিগন্তে সবুজস্নাত পাহাড় সারির দিকে। সীমানা প্রাচীরের কাছে মাটি ফুঁড়ে যেন উদয় হল গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ছোট গল্পের অমর চরিত্র- সিনর বালথাজার! তামাটে রূক্ষ মুখ, পাক খাওয়া কর্কশ চুল, মাথায় আদ্যিকালের খড়ে বুনানো দুমড়ানো বিশাল সমব্রেরো টুপি, ঘামের প্রাচুর্যে পরনের এককালের সাদা শার্ট ধূসর হয়ে লেপটে আছে পিঠের সাথে, শরীরের আরেক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। মুহূর্ত কয়েক নিশ্চুপ দাড়িয়ে তোবড়ানো পাইপে অগ্নি সংযোগ করে পূর্ব নির্ধারিত গন্তব্যের দিকে রওনা দিলেন সিনিওর বালথাজার, তার আগে ঘর্মাক্ত ঠোঁট থেকে বেরেনো এক জাদুময় সুরেলা জোরাল শীষে পথ ঘাট মাড়িয়ে সাথে এসে জুটল মুখে লাগাম পড়ানো কিন্তু পিঠের জিন ছাড়া এক মধ্যমাকৃতীর ঘোড়া! এ যেন মার্কেজের পৌরাণিক বিশ্বে পৌঁছে গেছি অজানা জাদু বলে।

বিস্ময়ের পর বিস্ময়, হঠাৎই মনে হল পাশের কলা বাগানের এক গাছের কলার মোচার কাছে সুনসুন শব্দ তুলে উড়ে বেড়াচ্ছে চোখ ঝলসানো পান্না সবুজ এক বিশাল পতঙ্গ, আমার বিস্ময়াভূত দৃষ্টির সামনেই সেই পতঙ্গ পরিণত হল অতি দ্রুত বেগে ডানা নাড়ানো অতি ক্ষুদ্রাকৃতির এক পাখিতে, হামিংবার্ড!! আমাদের গ্রহের পক্ষীজগতের সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির সদস্য, আকারে একটি বড় পতঙ্গের মতই, ডানা নাড়াচ্ছে সেকেন্ডে বার ! সারা বিশ্বে (আসলে দুই আমেরিকায়) এখন পর্যন্ত ৩৩৯ ধরনের হামিংবার্ডের খোঁজ পাওয়া গেলেও থাকলেও কিউবাতে এখন পর্যন্ত দেখা গেছে করে ৩ ধরনের হামিংবার্ড, এর মধ্যে বি হামিংবার্ড বিশ্বের ক্ষুদ্রতম পাখি। বিস্ময়ের ধাক্কায় থ হয়ে ক্যামেরা হাতে নিতেও ভুলে গেছি, এর কয়েক মুহূর্তের মাঝেই কলাফুলের রসপান সাঙ্গ করে যেন শূন্যে মিলিয়ে গেল সবুজ হামিংবার্ড!!

ভিনিয়ালেস

আশ্রয়দাতা ডাঃ রিদেলের কাছে জানা গেল হামিংবার্ডের স্প্যানিশ ভাষায় নাম কলিব্রি হলেও স্থানীয়রা এর সঞ্চালয়মান ডানা থেকে উদ্ভূত শব্দের কারনে আদর করে শুনশুন বলে ডাকে! সেই সাথে আকর্ণ হাসি দিয়ে বললেন এখন পর্যন্ত অনেক অতিথিই এই পাখির ছবি তোলার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ছবি তোলা পর্যন্তই সার, পাখি সেখানে অনুপস্থিত! কিন্তু এই পাখিরা প্রায়ই আসবে ফুলের রস খেতে, মূলত সকালের দিকে। রোখ চেপে গেল, জীবনে প্রথম হামিংবার্ড দেখলাম, আর ছবি তুলব না! দৃশ্যপটে বাঁধব না জীবজগতের এই অপার বিস্ময়কে! ক্যামেরায় লেন্স ফিট করে ঘণ্টাখানেক ঠাই দাড়িয়ে অবশেষে ফ্রেম বন্দী করা গেল উড়ন্ত সৌন্দর্যকে। এর নাম কিউবার পান্না সবুজ হামিংবার্ড, সেকেন্ডে ডানা ঝাঁপটায় সে ৬০- ৮০ বার, আর হামিংবার্ডরাই আমাদের গ্রহের একমাত্র পাখি যারা পিছনের দিকেও উড়তে পারে, মানে ওড়ার সময়ও পেছন দিকে এগোতে পারে।

এর মাঝেই বারন্দার উপরে নেমে আসা ফলে নুয়ে পড়া গাছে দুই ধরনের গিরগিটি চোখে পড়ল, রঙধনুর সাত রঙে রাঙ্গানো! বেশ জায়গাটি তো! কোথাও যাবার আগেই স্রেফ বারান্দা থেকেই চোখে পড়ে এমন অমূল্য সব দৃশ্য, আরো কত কি বুঝি অপেক্ষা করছে এই স্বর্গ উপত্যকায়! পাশের বাঁশ ঝাড় থেকে শোনা যাচ্ছে বকের কোলাহল।

ভিনিয়ালেস

বিকেলে প্রতিবেশীর কৃষকের বাড়িতে যাওয়া হল তার নিজের হাতে সিগার তৈরি দেখতে, সারা বিশ্বের ধূমপায়ীদের কাছে সবচেয়ে আদরণীয় হাভানা সিগারের সর্বোকৃষ্ট চালান কিন্তু যায় এই উর্বর ভূমিতে উৎপাদিত ফসল থেকেই। তামাক পাতা শুকানোর জন্য তৈরি বিশেষ গোলাঘরে বসিয়ে চোখের সামনেই সিগার তৈরি করলেন চাষি ! সেই সাথে জানালেন সম্পূর্ণ ভাবে রাসায়নিক পদার্থ বর্জিত হওয়ায় ও নিকোটিনের মূল উৎস পাতার ডাটা ছিড়ে ফেলায় শরীরের জন্য এমন কোন ক্ষতিকর নয় এই বিশেষ সিগার, যে কারনে অনেক তামাক চাষিই অবিরাম ধূমপান করেও নব্বই বছরের বেশি আয়ু লাভ করেছেন! এই ধরনের গোলা ঘরে প্রায় এক বছর তামাক পাতা শুকানোর পর তা কারখানায় পাঠানো হয় প্রক্রিয়াজাত করার জন্য।

ভিনিয়ালেস

এই সময় দিগন্তে দেখা দিল নিকয কালো মেঘ দূতের দল, দেখা দিয়েই ক্ষান্ত নয় ক্রমশ পুরো আকাশ দখল করে ফেলল চোখের নিমিষে, ক্ষণে ক্ষণে চমকাচ্ছে বিজলী। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বাড়ী পৌছাতে না পৌছাতেই যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল মাথার উপরে, ঝুম বৃষ্টি! ক্রান্তীয় অঞ্চলের ঝড় কাকে বলে হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে ছাড়ল পরের একটি ঘণ্টা। কালবৈশাখীর চেয়ে মোটেও কম নয় তার তাণ্ডব। তার উপর পাহাড় ঘেরা উপত্যকা বলে বজ্রপাতের শব্দ অনবরত প্রতিদ্ধনি তৈরি করে নরক গুলজার করে ছাড়ল অবশেষে।

পরদিন সাত সকালেই শহরতলীর অদূরেই ঘোড়সওয়ারদের আস্তানায় যাওয়া হল। প্রকৃতির সন্তান এরা, আমাদের তথাকথিত সভ্যতা থেকে দূরে থেকেই খুশী আছে নিজেদের দেশোয়ালি জীবন নিয়ে, পুরুষেরা ঘোড়া চালানোর ব্যপারে সমান দড়, মেয়েরা ঘর-কন্না সামলানোর পাশাপাশি চাষাবাদের কাজেও দক্ষ।

ভিনিয়ালেস

তাদের মহল্লায় ঢুকতেই দেখা হল সিনোরা সাব্রিনার সাথে, শতবর্ষের পরিবর্তনের সাক্ষী মহিলা স্মিত হেসে জানালেন আসছে নভেম্বরে ঠিক ১০০ বছর পূর্ণ হবে তার, আজ পর্যন্ত কোন দিনই কৃত্রিম ঔষধ ব্যবহার করতে হয় নি তার, এখনো লাঠী-চশমার অবলম্বন ছাড়াই চালিয়ে নিচ্ছেন চমৎকার ভাবে!

চারপাশের মধুর উপভোগ্য নিস্তব্ধতা চুরমার করে উঠানে চার-চারটি ঘোড়া নিয়ে দমকা বাতাসের মত আবির্ভাব ঘটল হুবহু মরুর বেদুইন ওমর শরীফের মত দেখতে উইলফ্রেডোর। সেই আমাদের আজকের অভিযানের গাইড। ঘোড়ায় যে আগে চড়িনি এমন নয়, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতাগুলো ভুলতে পারলেই অনেক খুশী হতাম! যা হোক, চুপাচুপা নামের মোটামুটি শান্ত এক ঘোড়া বরাদ্দ হল, জিনে কোনমতে বসে ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণের অল্প কিছু নির্দেশনা জেনে নেবার পরপরই আমাদের যাত্রা শুরু।

সেই লাল কাদা-মাটির রাস্তা পেরিয়ে নানা পাথুরে ট্রেইল ধরে উঁচু-নিচু রাস্তা পাড়ি দিয়ে দুর্ভেদ্য বনের ভেতর দিয়ে অজানার পানে। বিভিন্ন দেশি আমরা কজনা, উইলফ্রেডো আমাদের নেতা, তার নির্দেশ মতই চলছে সমস্ত পরিকল্পনা। কিন্তু মূল সমস্যা তৈরি করছে আমার হাতের ভারী ক্যামেরা! চলমান ঘোড়া থেকে ভাল ছবি তুলি কি করে, বিশেষ করে যখন একটা হাত সর্বক্ষন রাখতেই হয় ঘোড়ার লাগামের উপরে!! কিন্তু এমন স্মৃতিময় যাত্রা ফ্রেমবন্দী করার লোভ তো আছে ষোল আনা, তাই চুপাচুপার পিঠ থেকে পতনের ঝুকি নিয়েই কিছু ছবি তোলা হল যাত্রার ফাঁকে ফাঁকে।

tourists

নানা বন, নদী, কাদাময় খাল, ঘাসের প্রান্তর পেরিয়ে পৌছালাম পটে আকা ছবির মত পাহাড় ঘেরা এক অতল হ্রদে। স্বচ্ছ জল টলটল করছে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে, চারিদিকে সবুজ পাহাড়ের প্রতিবিম্ব তার শরীর জুড়ে। তীরের কাছেই এক ঝোপের সাথে ঘোড়াগুলো বেঁধে সোজা সেই শান্তিময় প্রতিবিম্ব চুরমার করে সুশীতল জলে অবগাহনে চরম ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমরা, সেটা সুন্দরের আহবানে না চটচটে ঘাম ধুয়ে ফেলার তাগিদে তা বোঝার আগেই উইলফ্রেডোর চিৎকারে অবাক হয়ে উপলব্ধি করি একটি পুরো ঘণ্টা কালের অতলে চলে গেছে এই কয়েক মুহূর্তেই।

lake

আবারে ঘোড়ায় চেপে এক ছোট্ট গ্রামের পানে আমাদের যাত্রা শুরু, এবারের পথ বেশ বন্ধুর, কয়েক জায়গায় সাংঘাতিক খাঁড়া ঢাল, যেন পাহাড়ের কিনার দিয়ে চলা। কিন্তু পরীক্ষিত সৈনিক আমাদের ঘোড়াগুলো দেখলাম পাহাড়ি ছাগলের মতন দক্ষতা নিয়েই একের পর এক বাঁধা অতিক্রম করে নিয়ে চলল অভীষ্ট লক্ষ্যের পানে।

চাষিদের সেই ডেরাতে ডাবের জলপানের বিরতি, সেই সাথে গাছপাকা ভেজালহীন পেপে, আম, অ্যাভোকাডো নানা ক্রান্তীয় ফলের সমাহার আমাদের যাত্রাবিরতিকে আক্ষরিক অর্থেই ফলাহার করে ছাড়ল। বেশ উচুতে জায়গাটি, সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে অনেক দূরের সীমানা পর্যন্ত সবুজের রাজত্ব।

green

আকাশে মেঘের দল করে চলেছে বিস্তর আঁকিবুঁকি রচনা আর তাদের সাথে যোগ দিয়েছে অসংখ্য টার্কি শকুন, বিশাল এই পাখিগুলোর রাজত্ব সারা কিউবাতেই( শকুনের উপস্থিতির প্রাচুর্য মানে প্রাকৃতিক পরিবেশের সুস্থতা, ভাবতে অবাক লাগে কেবল মাত্র মানুষের অসচেতনতায় উপমহাদেশের শতকরা ৯৯ ভাগ শকুন মারা গিয়েছে গত কয়েক দশকে, আর কদিন পর হয়ত বিশেষ করে বাংলাদেশের শিশুদের শকুন দেখতে হবে কেবল বইয়ের পাতায়) টার্কি শকুন আবার বিশেষ জাতের, এরাই একমাত্র শকুন যারা ঘ্রাণ শক্তির সাহায্যে খাদ্যানুসন্ধান করে থাকে, পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা যে কাজটি করে তীক্ষ দৃষ্টিশক্তির সাহায্যে, অসম্ভব শক্তিশালী ঘ্রাণশক্তির অধিকারী এই পাখিগুলো প্রায় ২০ কিলোমিটার দূর থেকেও খাবারের অবস্থান বুঝতে পারে!

turkey-vulter

সেই গ্রামের অধিবাসীদের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে চললাম আমরা এক চুনাপাথরের পাহাড়ের কাছে, খানিকটা সমতলের কাছে অতি উর্বর এলাকায় সবসময়ই নজরে আসে নয়ন জুড়ানো নানা ফসলের ভরা ক্ষেত- ধান, ইক্ষু, তামাক, কচু, নানা ধরনের সবজী, সেই সাথে চারনরত গরু, ছাগল, শূকরসহ নানা গবাদি পশু। সেই সফেদ পাহাড়ের কাছ দিয়ে আর বেশ খানিকটা পথ চলে সেই দিনের রোমাঞ্চকর ৭ ঘণ্টার যাত্রা শেষ হল আমাদের।

পরদিন সূর্যদেব পাহাড়ের আড়াল থেকে উঁকি দেবার আগেই আমরা প্রস্তুত যাত্রার জন্য, আজ যাওয়া হবে উপত্যকার অন্য প্রান্তে, মূল উদ্দেশ্য প্রকৃতি উপভোগ ও পাখি পর্যবেক্ষণ, সেই সাথে অ্যাকোয়াটিক বা জলজ নামে পরিচিত এক সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনাচারের সাথে সরাসরি পরিচয় হওয়া। স্থানীয় সবজান্তা হুয়ানিতো ( অর্থাৎ ছোট্ট হুয়ান) আমাদের গাইড।

মহা মজার লোক সে, সর্বক্ষণ মুখে খই ফুটছে (যদিও স্প্যানিশ ভাষায় তার একমাত্র সম্বল) আর সদা ব্যস্ত পথ চলতে চলতেই আমাদের কিছু না কিছু দেখাতে, পাহাড় থেকে শুরু করে উদ্ভিদ, পাখি, পতঙ্গ, ফসল- সব ব্যাপারেই অসামান্য জ্ঞান রাখে সে। হুয়ানিতোকে দেখে ভরসা পেলাম বটে, তেমন আশংকাও হল হয়ত তার কথার তোড়ে কোন জীবিত প্রাণীই আমাদের ধারে কাছে ভিড়বে না! সেই কথা একটু জানাতেই আরো একগাদা বাক্যবাণে বিদ্ধ হয়ে জানলাম ষাটোর্ধ এই চিরতরুণের বিবাহিত জীবন ৪২ বছরের, তার কাছে এখন তার স্ত্রী পেনিলোপি ক্রুজের মতই আবেদনময়ী এবং তার স্ত্রী তাকে আন্তোনিও ব্যান্দেরাস বলেই ডেকে থাকে, এমন কথায় মনে পড়ল নমস্য জীববিদ ও লেখক, জেরাল্ড ড্যারেল এমন এক প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা লোকের কথা লিখেছিলেন আর্জেন্টিনা নিয়ে লেখা এক বইতে।

যাত্রার শুরুতেই স্থানীয় এক পাহাড়ে নিয়ে গেল হুয়ানিতো আমাদের, যার বিশাল ঢাল জুড়ে আঁকা হয়েছে বিশাল চিত্রকর্ম যা বিখ্যাত প্রাগৈতিহাসিক ম্যূরাল নামে, সুউচ্চ পাহাড়ের গায়ে উজ্জল রঙে আকা হয়েছে আমাদের গ্রহের জীবনের ইতিহাস- আদি সাগরে এককোষী সরল জীব থেকে বহুকোষী জীব হয়ে ডাইনোসররা, তাদের স্থল গমন, স্তন্যপায়ীদের বিজয়রথ, শেষ পর্যন্ত বিবর্তনের ধারায় মানুষের আবির্ভাব। অতি সংক্ষেপে কিন্তু অত্যন্ত বড় স্কেলে করা এই ম্যূরালটি এই এলাকার অবশ্য দ্রষ্টব্য।

ভিনিয়ালেস

সেখান থেকে এক গ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের প্রথম যাত্রা অ্যাকোয়াটিক বা জলজ সম্প্রদায়ের গ্রামে। এমন নামে অভিহিত হবার কারণ এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা কোন রকম কৃত্রিম ঔষধ ব্যবহার করে না, সকল রোগের চিকিৎসায় তারা কেবল মাত্র পাহাড়ের গর্ভে লুকিয়ে থাকা একটি বিশেষ ঝর্ণার জল ব্যবহার করে থাকে, এবং খুব একটা শহরমুখি না হয়ে প্রকৃতির কোলেই সারাটা জীবন অতিবাহিত করে। গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে মেরী নামের এক মহি্লা সবার প্রথম এই ধনান্তরির উৎসের সন্ধান পান, যার মাধ্যমে তিনি অন্ধের অন্ধত্ব দূর করেন, পঙ্গুর পঙ্গুত্ব, রাতারাতি ঈশ্বরের অবতারে পরিণত হন। তার জল চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে যাওয়া কয়েকজন এখনো বেঁচে, যারা উৎসাহ ভরে প্রচার করেন সেই অলৌকিক কাহিনী, কিন্তু মেরীর দেহত্যাগের পরে সেই ঝর্ণার জল আর কারো অসুস্থতা নিবারন করতে পারে নি ( বোঝা যাচ্ছে সেই খনিজ জলে বিশেষ বিশেষ রোগ দূরকরণের উপাদান ছিল, কালের আবর্তে সেই খনিজ পদার্থের পরিমাণ কমে আসায় বা উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই কেরামতি বন্ধ হয়ে যায়, আর তিলকে তাল করে অতিলৌকিক রঙ দেয়া তো মানব সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ)।

গ্রামের প্রথম বাড়িটিতে দেখা হল আন্তনিও কার্লোসের সাথে, বয়স ৬৫ ছুই ছুই, স্বাস্থ্য অটুট, আজ পর্যন্ত কোন ঔষধ ব্যবহার করেন নি। কিউবার আর দশ জন মানুষের মতই অত্যন্ত অতিথি বৎসল, ভিনদেশী মুখ দেখে হৈ হৈ করে বসতে বলেই চট করে বাড়ীর পাশের আঁখক্ষেত থেকে মোটা তাজা আঁখ কেটে আনলেন আমাদের টাটকা গুয়ারাপ্পো ( আঁখের রস) খাওয়াবেন বলে। তার বাড়ীর বারান্দাতো বটেই, ঘরের বিছানা থেকে পর্যন্ত দেখা যায় অসামান্য মন ভুলানো প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী।

বাড়ীর এক কোণে ডাই করে রাখা টাটকা আনাজ, ফল-পাকুড়। দেয়ালে ঝুলানো রসুনের ভুরভুরে গন্ধ বিশ্বের যে কোন বাজারের রাসায়নিক সার আর কীটনাশক দিয়ে ফলানো চিমসে রসুনের চেয়ে অনেক আলাদা। মনে হল এমন জায়গায় এই ভাবে দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন, সেই সাথে তাদের মত পুষ্টিকর খাবার আর প্রচুর পরিশ্রম করলে হয়ত কারোই আর ডাক্তারের ঔষধের দারস্থ হতে হবে না।

সেই গ্রামের পর শুরু হল কঠিনতর যাত্রার পালা, আঁকাবাঁকা সর্পিল পথ চলে গেছে পাথুরে গুহার দিকে উপর পানে। ক্ষণে ক্ষণে রাস্তায় থামছি নানা বিস্ময়কে অবলোকনের জন্য-কোথাও একদল পিঁপড়া খাদ্য সঞ্চয়ের জন্য একগাদা সবুজ পাতা কেটে নিয়ে যাচ্ছে প্রবল পরিশ্রম করে। থেকে থেকে চোখে পড়ছে ভুবন ভুলানো রঙের অধিকারী নানা প্রজাপ্রতির, সেই সাথে সরব বিহঙ্গকূলতো আছেই।

butterflies

এমন ভাবেই দেখা হয়ে গেল বিশ্বের ক্ষুদ্রতম শিকারি বাজগুলোর একটি আমেরিকান কেস্ট্রেলের সাথে আর এক বিশাল বকের সাথে, সেই সাথে ক্ষুদে প্লোভার আর পদ্মনীল কালেম পাখি।

castrol

এই পাহাড়ে এখনো টিকে আছে প্রাগৈতিহাসিক যুগের নানা গাছ, তবে সেই আমলের কোন প্রাণী টিকে থাকার সম্ভাবনা না থাকলেও তাদের বংশধররা কোন মতেই বিমুখ করে নি আমাদের, হুয়ানিতোর চিৎকারে মাথার উপরে তাকিয়ে দেখি বিশাল এক বনস্পতির মোটা ডালে আরামে রোদ পোয়াচ্ছে বিশাল এক গিরগিটি, সাক্ষাৎ জুরাসিক যুগের দানবদের বংশধর।

big-lizard

এমনি করে মধ্য দুপুরের খর সূর্য মাথায় পাহাড়ের গোঁড়ায় পৌঁছানো গেল, এবার ভেতরের গুহায় যাবার পালা, ভেতের সুচিভেদ্য অন্ধকার, এর মাঝে সরু পথ ধরে রুক্ষ দেয়াল ঘেঁষে এগোতে হবে, পা পিছলালেই বিকট কুৎসিত খাদ মুখবাদ্যান করে আছে স্বাগতম জানানোর জন্য, শুরু হল পাহাড়ের কন্দরে প্রবেশের অভিযান। কয়েক মুহূর্তেই ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়ে গেলাম, গায়ের সিল্কের শার্ট ঘেমে লেপটে চামড়ারই আরেক স্তরে পরিণত হয়েছে, তীক্ষ পাথর লেগে কয়েক জায়গায় ছিলে জ্বালা করছে, সবচেয়ে সমস্যা করছে কাঁধের ভারী ব্যাগ আর হাতের ক্যামেরা! এর মাঝেই চলতে চলতে ক্ষীণ আলোর ধারা চোখে পড়ল, আহ যেন শান্তির আলোকময় জীবনের আহ্বান সেই প্রায় অদৃশ্য আলোকরশ্মিতেই। দূরে দেখা গেল গুহামুখ, তাতে জাল বিছিয়ে আছে নানা গাছের বিশাল সব শেকড়। শেষ টুকুই সবচেয়ে কঠিন, খানিকটে গাইডের সাহায্য নিয়েই শেষ বাঁধা টপকাতেই পায়ের নিচে চোখে পড়ল স্ফটিক স্বচ্ছ জলাশয়, সেই বিখ্যাত ভূগর্ভের ঝরনা !!

underground-spring

ব্যস, আর বলার কিছু নেই! অলৌকিক বলে যে কিছু নেই এতো জানাই আছে, কিন্তু খানিক আগেই গুহার ঘুপসি গরমে আধা সেদ্ধ হতে হতে কেমন প্রাণ চাইছিল একটু ঠাণ্ডা জলে শরীর ভেজাতে, সেই ইচ্ছে পূরণের এর

চেয়ে ভালো বন্দোবস্ত আর কি হতে পারে! সোজা নেমে পড়লাম সেই প্রাকৃতিক জলাধারে। কিন্তু মহা শীতল জল, ঠাণ্ডায় প্রথমে তো কাপুনি ওঠার জোগাড়! কিন্তু ধাতস্থ হওয়া মাত্রই কানায় কানায় উপভোগ করা হল সেই সুখ, চোখ বুঝতেই প্রথমেই কালো বাজল মহাকাশের অসীম নিস্তব্ধতা, এর ফাঁকে চুইয়ে চুইয়ে এল যেন কোন দূর মহীরুহের মর্মর ধ্বনি, মাঝে মাঝে বিহঙ্গকুলের কলতান। ওঠবার পথে হুয়ানিতোর মন রক্ষার্থেই খানিকটে জল তর্পণ করে বিসর্জন দিলাম সেই ঝরনাতেই, প্রাচীন সেই স্থানের জলদেবতাদের উদ্দেশ্যে।

এবার দিনের সবচেয়ে উঁচু গন্তব্যের পানে আবার চড়াই-উৎরাই, ইচ্ছার বিরুদ্ধে সুশীতল পাহাড়ি ঝর্না ছেড়ে এগোতেই হল আবার পাথরময় শুষ্ক ভূমিতে। পথে দেখা হল নানা রঙবেরঙের পতঙ্গ, বিশালাকার শামুক আর অন্য জাতির গিরগিটিদের সাথে।

snail

bugs

অবশেষে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কয়েক হাজার ফিট উপরে সেই চাতাল মত জায়গাতে পৌঁছানো গেল, সামনে নয়ন সার্থক করা প্রকৃতি। অ্যালান কোয়াটারমেইনের বুড়ো জুলু আমস্লোপোগাসের মত মনে হল- এমন দৃশ্য শত বছর তাকিয়ে থাকলেও পুরনো হবে না ! ইউনেসকো যে কেন ভিনিয়ালেস উপত্যকাকে বিশ্বের সবচেয়ে নয়নাভিরাম Cultural Landscape উপাধি কেন দিয়েছে তা নিয়ে আর কারো সন্দেহের অবকাশ থাকার করা নয়।

ভিনিয়ালেস

ভিনিয়ালেস

যাত্রা আবার নিচের দিকে, বাড়ীর উদ্দেশ্যে। এমনিভাবে নানা ঘটনার মাঝে একদিন সময় ফুরিয়ে এল এই স্বর্গে অবস্থানের, ফেরার দিন দুরপাল্লার বাসে চেপে বসেছি ত্রিনিদাদের উদ্দেশ্যে, অদৃশ্য ব্যথায় টন টন করে ওঠা মন পড়ে আছে দুপাশের চলমান উপত্যকায়, ঘুরে ঘুরে মনের পর্দায় ভেসে উঠছে এখানকার প্রকৃতি আর সদ্য পরিচিত হওয়া কিছু মানুষের মুখ- অতি বিরল নিঃস্বার্থপরতার অপাপবিদ্ধতায় মোড়া যাদের অন্তর। ভালো থেকো বন্ধুরা আমার, ভালো থেকো। চিরকাল যেন এমন স্বর্গই থাকে ভিনিয়ালেস।

ভিনিয়ালেস কৃষক

old-man-with-havana-cigar

Related Articles

5 1 vote
Post Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
Back to top button
0
Rate & Give your feedback!x
()
x

পুলিন বকসী: প্রথমত শহীদ সাহেবের ডান পন্থার কারনে ভাসানী তার বিরোধীতা করেন নি। শহীদ সাহেবের তীব্র আমেরিকা প্রীতিই (সিয়াটো-সিন্টো চুক্তি) ন্যাপ গঠনের অনেকগুলো কারনের অন্যতম কারন।

দ্বিতীয়ত আপনি যেভাবে তাকে আইয়ুব খানের একজন প্রায় 'দালাল' বা 'চাটুকার' বানায়া দিলেন সেই ভাসানীই কিন্তু ৬৯ এ ব্যপক ভূমিকা রেখেছিল শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে। শুধু তাই না এই উনসত্তরের আন্দোলনের শুরুটাও ভাসানীদের হাত ধরে।

ধন্যবাদ।

Farid Ahmed: আমি বহু জনকে জিজ্ঞেস করেছি, কেউ আমাকে সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারে নাই কেনো মওলানা ভাসানী আইয়ুব খানের প্রতিনিধি হিসাবে চীনে গিয়েছিলেন। আশা করি আপনি আলোকপাত করতে পারবেন এ ব্যাপারে। তাঁর আইয়ুব প্রীতি আমার আবিষ্কার না। ষাটের দশকেই এ নিয়ে বিস্তর কথা উঠেছে। আমি আগের একটা লেখায় সব রেফারেন্স দিয়েছি। আমি ভাসানীকে এখনও দালাল কিংবা চাটুকার বলি নাই, যদিও বলা উচিত ছিলো আমার।

১৯৮৬-৮৭ সালে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন জালাল আহমেদ। ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি এরশাদের সাথে হাত মেলান। এরশাদ তাঁকে অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশ মিশনে সেকেন্ড সেক্রেটারি পদে নিয়োগ দেয়। জালাল আহমেদ সংগোপনে তাঁর গোপনে বিয়ে করা বউকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমান। এখন পর্যন্ত এই অপরাধে ছাত্রদল তাঁকে দালাল বলে। আমরাও তাঁকে এরশাদের দালালই বলতাম। দালালকে তো দালালই বলা লাগে, তাই না?

Marzia Prova: ফরিদ ভাই আইয়ুব শাসনের আমলে পাকিস্তানের জোরদার উন্নয়ন দেখা যাচ্ছিল৷ ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এর আগে তার উন্নয়নের দশক পালন করার প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছিল। ভাসানীর কথা ছিল, "পশ্চিম পাকিস্তান যদি পূর্ব পাকিস্তানের উপর শোষণ না বন্ধ করে, তবে পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম।" এখন তথাকথিত আইয়ুবের উন্নয়ন পূর্ব বাংলাতেও হয়েছিল। শোষণের বিপরীতে এই উন্নয়নকে যদি সফলতা হিসেবে দেখা হয়, তবে ভাসানী একজন পাকিস্তান নাগরিক হিসেবে সফল শাসক এর প্রতি মুগ্ধতা ছিলেন! তাই নয় কি?

আপনি জাস্ট এই বিষয়টা এখনকার বাংলাদেশের সাথে মিলান। উন্নয়ন দিয়ে সফলতাকে নির্ধারণ বাকি অনেক কিছুকে যখন আড়াল করা হয়, তখনও তো দেশের অনেক মানুষের সেই সফল শাসকের প্রতি মুগ্ধতা থাকে৷ সম্ভবত ভাসানীর আইয়ুব প্রীতি সে জায়গা থেকে। জাস্ট আপনার লেখা আর কমেন্ট পড়ে এইটা মনে হইল। এই মানসিকতা অবশ্যই দ্বান্দ্বিক এবং স্ববিরোধী কোন সন্দেহ নাই৷ হয়ত এই মানসিকতা না থাকলে ভাসানী অন্যভাবে স্মরণীয় থাকতেন।

Farid Ahmed: আইয়ুব খানের সাথে মওলানার ওই উন্নয়নমূলক মুগ্ধতার সম্পর্ক ছিলো না। উনি ৬৩-তে সরকারী একটা ডেলিগেশন টিমের প্রধান হিসাবে চিনে যান। আইয়ুব খান সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে তাঁর বিন্দুমাত্র বিবেকে বাধেনি, যেখানে ৬২-তে বিশাল এক ছাত্র আন্দোলন হয়ে গিয়েছিলো আইয়ুব খান সরকারের গণবিরোধী শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে।


মওলানা ভাসানী ৬৯ এ ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে। শুধু তাই নয়, এই উনসত্তরের আন্দোলনের শুরুটাও ভাসানীদের হাত ধরে। তাহলে তাকে আইয়ুব খানের একজন প্রায় 'দালাল' বা 'চাটুকার' হিসেবে দেখাটা কি যৌক্তিক?

এই বক্তব্যের মূল কারণ হচ্ছে আমি আমার লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে মওলানা ভাসানী আইয়ুব খানের প্রতি সহানুভুতিশীল ছিলেন, তাঁর সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে চীন গমন করেছিলেন এবং ১৯৬৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন দেবার প্রতিশ্রুতি দেবার পরেও মওলানা ভাসানী গোপনে আইয়ুব খানকে সমর্থন দিয়েছিলেন।

এই অভিযোগটির লজিক্যাল ফ্যালাসিটা আগে বলি। তারপর আমি আইয়ুবের সাথে ভাসানীর সখ্যতা ব্যাখ্যা করবো।

ঊনসত্তরে মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন, ঊনসত্তরের আন্দোলনের তাঁর দুর্দান্ত ভূমিকা ছিলো, এই তথ্য দিয়ে কি তাঁর অন্য কাজগুলোকে জাস্টিফাই করা যায়? যায় না। আমি গতকাল একটা অপরাধ করেছি, আর আজকে একটা ভালো কাজ করেছি। এখন যদি আমি যুক্তি দেই যে আমি তো আজকে ভালো কাজ করেছি, তারপরেও আমাকে আপনারা অপরাধী বানিয়ে দিলেন, সেটা কেমন লাগবে আপনাদের কাছে? তিনি তেষট্টিতে আইয়ুবের প্রতিনিধি হিসাবে চীনে গেছেন, এই অভিযোগ ঊনসত্তরের ভূমিকা দিয়ে আড়াল করাটা আর যাই হোক না কেনো যুক্তিসঙ্গত কোনো কাজ হতে পারে না। ঊনসত্তর নয়, মূলত আটষট্টি সাল থেকে আইয়ুবের সমালোচনায় নামেন মওলানা ভাসানী। কিন্তু তেষট্টি থেকে আটষট্টির আগ পর্যন্ত তাঁর ভূমিকা কী আইয়ুবের ব্যাপারে? আসুন, ইতিহাস থেকে দেখি আমরা তিনি কী করেছিলেন সেই সময়ে।

১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসের ৭ তারিখে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার মির্জা দেশে মার্শাল ল জারি করেন। তিনি যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং আইয়ুব খানকে সুপ্রিম কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ দেন। ইস্কান্দার মির্জার দুর্ভাগ্য, এর মাত্র তিন সপ্তাহ পরে অক্টোবর মাসের ২৭ তারিখে আইয়ুব খান তাঁকেই উৎখাত করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নেন। ইস্কান্দার মির্জা মার্শাল ল জারি করার পর ১২ তারিখে নিরাপত্তা আইনে মওলানা ভাসানীকে বন্দি করেন। দীর্ঘ চার বছর তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন।

১৯৬২ সালের ৩রা নভেম্বর তাঁকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর পরই তিনি আইয়ুব খানের সাথে দেখা করেন, যেটা প্রবলভাবে সমালোচিত হয়। দেওয়ান শামসুল আরেফিন তাঁর, “Bhashani, the maulana Bhashani, the comrade” বইতে লিখেছেন,

“After more than four years in prison, the Moulana was released on November 3 1962. A few days after his release, he met with President Ayub in Rawalpindi. The Ayub-Bhashani meeting created a mixed reaction among the left political circles.”

আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের সময় পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় মিত্র ছিলো যুক্তরাষ্ট্র। চীনের সাথে পাকিস্তানের সীমান্ত নিয়ে বেশ ঝামেলাই ছিলো বলা চলে। সীমান্ত বিরোধ নিয়ে ১৯৫৯ সালে চীনের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। দুই পাশে দুই শত্রু দেশ ভারত এবং চীনকে পুষে রাখাটা খুবই ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ এই বিবেচনা থেকে চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের দিকে অগ্রসর হয় পাকিস্তান। এর জন্য অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের রোষেরও শিকার হয় পাকিস্তান। কিন্তু, তারপরেও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীনকে প্রাধান্য দেবার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান। ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো চীন সফর করেন।

পঞ্চাশের দশক থেকেই মওলানা ভাসানীর সাথে চীনের সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো রাজনৈতিক কারণে। চীনের সাথে সম্পর্ক আরো দৃঢ় করার জন্য মওলানার সাহায্য কামনা করেন তিনি। ১৯৬৩ সালের অগাস্ট মাসে তিনি মওলানাকে রাওয়ালপিণ্ডিতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। পত্র-পত্রিকাতে আইয়ুব-ভাসানী আঁতাতের খবর প্রকাশিত হতে থাকে। ভাসানী এগুলোকে ‘স্বার্থান্বেষী মহলের ছড়ানো গুজব’ বলে উড়িয়ে দেন।

এই আঁতাত যে গুজব না, সেটা টের পাওয়া যায় পাকিস্তানের প্রেরিত ডেলিগেশন টিমের প্রধান হওয়ার মধ্য দিয়ে। জাতীয় স্বার্থে তিনি এই দলের প্রধান হিসাবে চীনে যাচ্ছেন বলে তিনি জানান।

সেপ্টেম্বর মাসের ২৫ তারিখে ঢাকা থেকে প্রথমে করাচি যান তিনি। সেখান থেকে রেঙ্গুন হয়ে চীনে পৌঁছান মওলানা ভাসানী। পিকিং এ উষ্ণ অভ্যর্থনা পান তিনি। চীনের প্রিমিয়ার চৌ এন লাই এর সাথে সাক্ষাতে আইয়ুবের সরকারের জন্য সমর্থন প্রত্যাশা করেন তিনি। তিনি বলেন,

“I am old, perhaps I will not have another chance to come to china; I hope you and your country’s government can fully work together with Ayub khan’s government and his representative General Raza.”

চীনের যাবার সুযোগ তাঁর আরেকবারও হয়েছিলো। যদিও পরবর্তী এই সফর খুব বেশি প্রচারণা পায়নি। দেওয়ান শামসুল আরেফিন তাঁর বইতে লিখেছেন,

“Abdul Hamid Khan Bhashani paid another low-profile visit to China in 1964. The second visit was, in fact, more significant than the first one. This time he had exclusive talks with Chairman Mao, Premier Chou and other leaders including Den-Tsiao-ping.”

অগাস্ট মাসে রাওয়ালপিণ্ডিতে আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাৎ, তার মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে সরকারী প্রতিনিধি দলের নেতা হয়ে চীন সফর অন্য দল এবং নিজের দলের মধ্যেও তীব্র সমালোচনার সুত্রপাত ঘটায়। ন্যাপ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পিকিংপন্থী অংশ ভাসানীর নেতৃত্বে থেকে যায়, অন্যদিকে মস্কোপন্থী অংশ কমরেড মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে আলাদা হয়ে যায়।

পিকিং থেকে ফিরে আসার পরে শুধু মওলানা ভাসানী একাই নন, চিনপন্থী কম্যুনিস্টদের একটা বড় অংশ আইয়ুব খানের ভক্ত বনে যায়। আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের মহিমা কীর্তন করা শুরু করেন তারা। বাষাট্টির এতো বড় ছাত্র আন্দোলনের পরে যেখানে আইয়ুবের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার কথা ছিলো তাঁর, সেখানে তিনি আইয়ুব খানকে বিরক্ত না করার সিদ্ধান্ত নেন। ডক্টর নুরুন নবী তাঁর “Bullets of ‘71: A freedom fighter’s story” বইতে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন,

“After that visit, Moulana Bhashani declared his infamous policy statement, “Don’t disturb Ayub”. Bengali people were stunned. That was the biggest mistake of Moulana Bhashani’s political career.”

তারিক আলী চীনপন্থী বাম ছাত্রনেতা ছিলেন। তাঁর একটা বই আছে। বইটার নাম “Pakistan, military rule of peoples power”। বইটা প্রকাশিত হয়েছে দিল্লি থেকে ১৯৭০ সালে। এই বইতে তারিক আলী পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সাথে মাওলানা ভাসানীর নিবিড় সখ্যের কারণ অনুসন্ধান করে তার পটভূমি আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি তাঁর বইতে লেখেন, ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইউব খান মাওলানা ভাসানীকে পাকিস্তানের সরকারী প্রতিনিধি করে চীনে পাঠাতে চাইলে মাওলানা রাজি হন। সেখানে চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুং এর সাথে তাঁর যে গোপন সলাপরামর্শ হয় তার একটা বিবরণ তিনি মাওলানার কাছ থেকেই গ্রহণ করেছিলেন টেপ রেকর্ডারে।

তারিক আলী মওলানাকে প্রশ্ন করেছিলেন, “When you went to China what did Mao discuss with you when you met him?” এর উত্তরে মওলানা বলেছিলেন,

“মাও সে তুং আমাকে বলেন, “আপনি যদি সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন তাতে রাশিয়া, আমেরিকা এবং ভারতের হাতই শক্তিশালী হবে। আপনার কাজে হস্তক্ষেপ করা আমাদের নীতি বিরুদ্ধ, তথাপি আমরা আপনাকে সাবধানে এবং ধীর গতিতে আন্দোলনে অগ্রসর হতে অনুরোধ করবো। আপনার সরকারের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব আরো গাঢ় করার সুযোগ দিন।”

আগেই বলেছি, চীন থেকে ফিরে আসার পরেই মওলানা এবং তাঁর অনুসারীরা আইয়ুব খানের ভক্ত হয়ে যায়। সাপ্তাহিক ‘জনতা’ ছিলো ন্যাপের মুখপত্র। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন আনোয়ার জাহিদ। তিনি তখন ভাসানীর ব্যক্তিগত সচিব। আনোয়ার জাহিদ নিজেও আশির দশকে সামরিক শাসক এরশাদের দালালি এবং গোলামি করেছেন। তাঁকে সবাই ঝাঁড়ুদার মন্ত্রী হিসাবেই চিনতো। কারণ, তিনি একবার প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, এরশাদ যদি বলে, তবে তিনি রাস্তা ঝাঁড়ু দিতেও আপত্তি করবেন না। এই আনোয়ার জাহিদ ১৯৬৫ সালে সাপ্তাহিক জনতায় লেখেন, “There were only two Imperialist voices in Pakistan – Ayub and Vashani.”

আনোয়ার জাহিদের বক্তব্য পরিষ্কার, তিনি তাঁর নেতা এবং আইয়ুব খানকে একই কাতারে দেখেছেন। মওলানা ভাসানীর এই সামরিক শাসকের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের ফলাফল কী হতে পারে, সে সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মফিদুল হক লেখেন,

“১৯৬৩ সালে কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর জেনারেল আইউব আয়োজিত চীন সফরের পর থেকেই মাওলানা ভাসানীর পদস্খলন ঘটতে থাকে। চীনা রাষ্ট্র-নেতাদের আত্মস্বার্থ-প্রণোদিত নীতির কাছে মাওলানা ভাসানীর আত্মসমর্পণ এদেশের বাম রাজনীতির জন্য বিরাট দুর্ভাগ্যের সূচনা করে। রাজনৈতিক বিভ্রান্তি থেকে তিনি যে পথে পা দিয়েছিলেন তা শুধু আইউবের শাসনের সহায়ক ভূমিকা পালন করেনি, মাওলানা তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে সামরিক শাসকচক্রের যে সংযোগ গড়ে ওঠে তা পরবর্তী সময়েও বহু দুর্ঘটনার কারণ হয়েছিল।”

মওলানার নিজের দলের লোক হাজী দানেশও মওলানার সাথে আইয়ুব খানের সমঝোতা ছিলো বলে মনে করেন। এ কারণে আইয়ুবের বিরুদ্ধে তিনি বাম শক্তিগুলোকে একত্রিত করেননি বলে অভিযোগ করেন তিনি। হাজী দানেশ ছিলেন ন্যাপের সহ-সভাপতি। মওলানার সাথে তাঁর কোন্দল এমন পর্যায়ে যায় যে তিনি সহ একটা বিরাট অংশ ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে ন্যাপ থেকে বের হয়ে যান। ১৯৭১ সালের ৮ই জানুয়ারি হাজী দানেশ এক খোলা চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে তিনি বলেন,

“আপনি বিশ্বাস করতেন যে ইস্কান্দর মির্জা ও আইউব খান দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করবে। আইউবের বিরুদ্ধে বামপন্থী শক্তিগুলোকে সংগঠিত করার ব্যাপারে আপনার অনীহা এটাই প্রমাণ করে যে, শোষক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে আপনার যোগ ছিল। আমি এটা বিশ্বাস করতে পারিনা যে, আপনার ও ন্যাপের এ ধরনের নীতির মাধ্যমে লাখ লাখ শোষিত মানুষের মুক্তি আসবে।”

 

Masudur Rahman: ১৯৭০-এর জানুয়ারিতে সন্তোষে কৃষক সম্মেলনে মাওলানা ভাসানী আরও বললেন, ‘আমাদের ভাগ্য আমাদেরই গড়ে নিতে হবে। পিন্ডির গোলামি ছিন্ন করতে হবে।’ ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বরের বঙ্গোপসাগরীয় সাইক্লোনের প্রেক্ষাপটে উনি আবার সরাসরি বললেন ‘স্বাধিকার স্বায়ত্তশাসন নয়, চাই স্বাধীনতা।’

ফরিদ, তোমার লেখা আমি গুরুত্ব সহকারে পড়ি; অনেক কিছু জানতে পারি, শিখতে পারি। কোন মানুষই ভুলের উর্ধ্বে নন, যেমন ভাসানী। কিন্তু, তাই বলে তাকে আইয়ুব ইয়াহিয়ার সহচর বানিয়ে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিলে! মওলানা ভাসানীকে নিয়ে তোমার লেখাগুলি পড়ে আমি সত্যি হতাশ!

Farid Ahmed: আমিতো কোনো সিদ্ধান্ত দেই নাই। সবই কোট করেছি আমি। তিনি আইয়ুবের সহচর ছিলেন, এই অভিযোগ তখনই উঠেছে।

আমার বিশ্লেষণ আমি বলতে পারি। যে আইয়ুব ক্ষমতা দখল করে তাঁকে কারাগারে পাঠালো, তিনি কারাগার থেকে বের হয়ে সেই আইউবের প্রতিনিধি হয়ে চীন যান ঠিক কী কারণে? কোন স্বার্থে? আপনি আমাকে একটা মাত্র যৌক্তিক কারণ বলবেন মাসুদ ভাই এ ব্যাপারে। আমি দ্বিতীয় যুক্তিও শুনতে চাইবো না।

তিনি সিআইএ-র রিপোর্ট ইয়াহিয়াকে দিয়েছেন? কেনো? যেখানে তিনি নিজেই বলছেন এই দলিলে দেখা যাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার ষড়যন্ত্র চলছে। উনি কি বিচ্ছিন্নতার বিপক্ষে ছিলেন? বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার একেকজনের একেক ধরনের কর্মপন্থা ছিলো, সেই পন্থা নিয়ে সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু এই দলিল হস্তান্তর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষেই তাঁকে দাঁড় করিয়ে দেয়।

ভাসানী একজন স্ববিরোধী মানুষ ছিলেন। উনি স্বাধীনতার পক্ষেও বহু কথা বলেছেন, আবার বিপক্ষেও বলেছেন। আপনারা শুধু পক্ষেরটা জানেন, বিপক্ষেরটা না। আমি উনি স্বাধীনতার বিপক্ষে কী কী বলেছেন সেগুলো নিয়েই আরেকটা লেখা লিখবো দুই একদিনের মধ্যেই।

Swapan Mahmud: "পাকিস্তান ওয়ালাইকুমআসসালাম" এটাই স্বাধীনতার প্রথম প্রতীকী ঘোষণা।

Farid Ahmed: ওই এক তথ্য নিয়েই পড়ে থাকেন। মোল্লাদের অন্ধত্ব এবং একদেশদর্শীতা আমাকে পীড়া দেয় না, কিন্তু, আপনাদেরটা দেয়। কারণ, প্রগতিশীল বলে দাবি করেন আপনারা। দাবি করেন, অথচ সব তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে আসেন না। পূর্বানুমান সিদ্ধান্ত নিয়েই বসে থাকেন।

১৯৬২ সালে ছাত্ররা আইউব খানের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করেছিলো শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে। ভাসানী কি জানতেন না যে এই দেশের ছাত্র এবং জনগণ আইউব জান্তাকে বাতিল করে দিয়েছে? সেই জান্তার প্রতিনিধি হিসাবে ১৯৬৩ সালে তিনি চীনে যান কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর আপনাদের মতো বায়াসড লোক কোনো দিনই দিতে পারবেন না, খালি ওই এক ওয়ালাইকুম সালাম নিয়েই পড়ে থাকবেন আপনারা।

Masudur Rahman: খন্ডিত বিশ্লেষণ করে প্রমান করা যাবে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য '৭০ এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন নাই। একটি বিষয় অন্তত আমার কাছে পরিষ্কার, ভাসানীর তুমুল জনপ্রিয়তা থাকা সত্যেও ক্ষমতার লোভ তার ছিল না। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে উনিও কষ্ট পেতেন ভাসানীর এই পোস্টমর্টেম দেখে কারন উনি জানতেন উনার বঙ্গবন্ধু হওয়া পিছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশী। বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা থেকে মুক্ত করার জন্য যে গন আন্দোলনের দরকার ছিল, তা ভাসানী ছাড়া আর কে করতে পারতেন? তুমি তো ১৯৬৩ সনেই আটকে থাকলা, ফরিদ!

Farid Ahmed: উনার সামরিক শাসক সখ্যতা নিয়ে বিস্তারিত আমি লিখেছি মাসুদ ভাই। শুধু ৬৩-তে আটকে থাকিনি। যদিও ওইটাই সবচেয়ে ভাইটাল মুহুর্ত। কোন কারণে তিনি আইয়ুবের প্রতিনিধি হয়ে চীনে গিয়েছিলেন, সেটা জানাটা খুবই জরুরী আমাদের জন্য। মওলানা বাদে অন্য কেউ হলে আমি এক বাক্যে তাঁকে আইয়ুবের দালাল বলে দিতাম। ব্যক্তিটা উনি বলে আমি এখনো এর একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা খুঁজছি।

১৯৭২-১৯৭৬

মওলানা ভাসানী ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক হক-কথা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করলেও মুজিব সরকারের জাতীয়করণ নীতি এবং ১৯৭২-এর সংবিধানের এর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। ১৯৭৩ সালে খাদ্যের দাবিতে ঢাকায় ১৫-২২ মে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ১৯৭৪-এর ৮ এপ্রিল হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি গঠন করেন। একই বছর জুন মাসে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলে টাঙ্গাইলের সন্তোষে গৃহবন্দি হন। ১৯৭৬-এর ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লং মার্চে নেতৃত্ব দেন। একই বছর ২ অক্টোবর খোদাই খিদমতগার নামে নতুন আর একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

— উইকিপেডিয়া থেকে

Supik Anwar: ৫০ বছর ধরে বহুমাত্রিক ভাবে গন মানুষ এর রাজনীতি করা একজনকে শুধু কয়েক বছরের রাজনীতি দিয়ে মুল্যায়ন কতটুকু যুক্তিযুক্ত!? ঐ সময়ে উনি হাসপাতালে ছিলেন।পরে ভাসানী হাসপাতালে থাকা অবস্তায় মোশতাক উনাকে একদিন দেখতে গিয়েছে। তখন উনি মোশতাককে বলেছিলেন "আমার মুজিবররে তোমরা মাইরা ফেললা"!

Farid Ahmed: আপনি আপনার রেফারেন্স দেন। আর আমি আমার রেফারেন্স দিচ্ছি।

Supik Anwar: একজন সাংবাদিক (নামটা মনে পড়ছে না) উপস্থিত ছিলেন অই সময়। পরে উনি সহ সবাইকে রুম থেকে বাইরে যেতে বলেন মোশতাক। মোশতাক বেশ কিছুক্ষণ ভাসানীর সাথে একান্তে কথা বলে।এগুলা ভাসানীকে নিয়ে লিখা একটা কলামে পড়েছিলাম।মনে হয় ইরফানুল বারীর। আর ৭৫ এর পর উনি অনেক অসুস্থ ছিলেন। এই সুযোগ এ মোশতাক তার লেজেটিমিসির জন্য উনাকে ব্যবহার করেছে। আর জাতির জনক কে উনি কথটা পছন্দ করতেন সেই কথা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আছে। এছাড়া উনি মোশতাক ১ং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক থাকার পর ও তাকে ডিঙিয়ে মুজিবকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করেন সামশুল হক এর অনুপস্থিতিতে। আর আগরতলা মামলায় তার প্রিয় মুজিবরকে জেল থেকে বের করার হুংকার এবং তার ফলাফল তো জানাই আছে।

Farid Ahmed: এটা কোনো রেফারেন্স হলো? আসেন এর বিপরীতে আপনাকে রেফারেন্স দেখাই। কয়েকটা পত্রিকার কাটিং দেখাচ্ছি। কারো মুখের কথার চেয়ে পত্রিকা অনেক বিশ্বাসযোগ্য।

doc

Supik Anwar: মওলানা ভাসানীকে নিয়ে কয়েকটা কৌতুহল জাগানো প্রশ্ন পেলাম, এমনকি আমার লেখা শেয়ার করা কিছু মানুষও এই সব মন্তব্য পেয়েছেন দেখলাম। একটা প্রশ্ন হলো, ভাসানী ১৫ অগাস্টের হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করেছেন। মোশতাককে সমর্থন দিয়েছেন। জিজ্ঞেস করলাম, জেনেছেন কোথায়?

— তখনকার দৈনিক পত্রিকায়। বড় করে ছাপা হয়েছে তো।

— কিন্তু তখন যে চারটা মাত্র পত্রিকা আমাদের খবরের উৎস, সেগুলো তো এর আগেই বাকশাল সরকার সরকারী মুখপাত্র বানিয়ে বাকি সবগুলো পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলো। মাওলানার প্রতিষ্ঠিত হক কথাকে নিষিদ্ধ করেছিল ১৯৭২ সালেই। ফলে মোশতাকের আমলে যে তথ্য আমরা খবরের কাগজ সূত্রে পেলাম, সেগুলোর নির্ভরযোগ্যতা কী? কিংবা, এইভাবে গণমাধ্যম কবজা করার পরিণাম যে মানুষের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের সুযোগ এবং অভ্যাস দুটোই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল বাকশালের মাধ্যমে, চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে, আরো নানান সব নিপীড়নমূলক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে, এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হলো যে দিনে-দুপুরে রক্ষীবাহিনীর হাতে খুন হলেও সে খবর আর পত্রিকায় ছাপা হবে না, যে হাতিয়ারগুলো ব্যবহার করেই মোশতাকের মন্ত্রীসভায় লীগের নেতাদের স্বেচ্ছায় কিংবা বলপ্রয়োগে অংশ নেয়ানো হলো, তার নিন্দা কখনো করেছেন? ৯৫ বছরের বুড়ো ভাসানী ১৫ অগাস্টের বহু আগে থেকেই গৃহে অন্তরীণ ছিলেন। এই বয়োবৃদ্ধ মানুষটিকে কারা গৃহবন্দি করে রেখেছিল? তার নিন্দা করেছেন? সেই ঘরে আটকে থাকা, দুনিয়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারিতে আটকে রাখা অসুস্থ মানুষটাকে হাসপাতালে মোশতাক দেখতে গিয়েছিলেন, আওয়ামী নেতাদের মত তিনি বঙ্গভবনে গিয়ে মোশতাককে সমর্থন জানান নাই। এই ছবিটিই ফলাও করে পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, এবং পত্রিকাতে বাকি সব যা জানি সেটাও বাকশালের সংস্কৃতিতে কবজা করা পত্রিকার ভাষ্য, ভাসানী কি বলেছেন তা সেখানে কিভাবে মিলবে?

অভিযোগ করার আগে অভিযোগের প্রেক্ষাপটা তাই মনে রাখলে বোঝা যায়, অভিযোগকারীই ভয়াবহ একটা পরিস্থিতির সমর্থক, যেখানে কারও মতামত জানারও উপায় ছিল না, এমনই ভয়াবহ ছিল বাকশালি শাসন। তবুও ভাসানী কী মনে করতেন, সেটা জানতে ভাসানীর ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বাসযোগ্য মানুষদের কাছেই যেতে হবে। তাদের অনেকের কাছেই শুনেছি, নিজের সমর্থকদের ওপর এত নিপীড়নের পরও, আওয়ামী লীগের এত গণবিরোধী অবস্থানের পরও ভাসানী ১৫ অগাস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে দারুণ ব্যাথা পেয়েছিলেন। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক বিরোধিতা তিনি যতই করুন না কেন, তাকে পুত্রের মতই দেখতেন। প্রতিহিংসাপরায়ণ তিনি ছিলেন না, যদিও জনগণের বলপ্রয়োগে গভীর আস্থা পোষণ করতেন। সেই বলপ্রয়োগের স্মরণীয়তম দৃষ্টান্তটার কথাই বরং বলি।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাতেই হয়তো শেখ মুজিবুর রহমানের ফাঁসি হয়ে যেতো বঙ্গবন্ধু উপাধি পাবার আগেই; কেউ তাকে উদ্ধার করার সাহস কিংবা স্পর্ধা দেখায়নি, বন্দি ছিলেন তিনি ঢাকা সেনানিবাসে। '৬৯ এর প্রবল অভ্যূত্থানের ওপর দাঁড়িয়ে ভাসানী হুমকি দিয়েছিলেন পাক সামরিক জান্তাকে: মুজিবকে না মুক্তি দেয়া হলে জনতাকে নিয়ে তিনি ক্যানটনমেন্ট থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসবেন। আগুন ঝরানো মাওলানা তার নাম এমনি এমনি হয়নি।

এই হলো ভাসানী। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ৫০ বছর পূর্তিতে তার প্রাবল্যকে বুঝতে হলে খুচরো খুচরো প্রশ্ন করে কাজ হাসিল হবে না। অনেক বড় অকৃতজ্ঞতা এবং নিমকহারামি থেকেই ভাসানীকে নিয়ে এই জাতীয় মিথ্যা গুজব মোসাহেবরা ছড়িয়ে থাকে।

— (ফিরোজ আহমেদ)

Farid Ahmed: এটা পড়েন। আগুণ ঝরানো মওলানার আসল পরিচয় পাবেন। মুদ্রার অপর পিঠের মওলানা ভাসানী : জাফর ওয়াজেদ ↑। অলি আহাদের একটা বই আছে। বইটার নাম হচ্ছে, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-১৯৭৫। সেই বইতেও শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডে ভাসানীর সমর্থনের কথা বলা আছে। ভাসানী হাসপাতালে ভর্তি হন নভেম্বরের ২১ তারিখে। তিনি তারবার্তা পাঠান শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরের দিনই। তখন তিনি সন্তোষে। হাসপাতালে তিনি খন্দকার মোশতাককে কী বলেছেন, সেটা কোনো পত্রিকায় আসেনি। তিনি যে খুনি সরকারকে অভিনন্দিত করেছেন, তাদের সমর্থন জানিয়েছেন, এগুলো সব পত্রিকাতেই এসেছে। তাঁর নামে এগুলো বানানো খবর হলে তিনি অবশ্যই আপসেট হতেন এবং এগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। এদেরকে সহযোগিতা দিতেন না। বাস্তবে কিন্তু তা হয়নি। ফারাক্কা লং মার্চের সামনের সারিতে তিনি ছিলেন। কিন্তু, এর পিছনের পুরোটাই সায়েমের অবৈধ সরকার তথা জিয়াউর রহমান ছিলো।

doc

Supik Anwar: শুধুমাত্র পত্রিকার কয়েকটি লিখার উপর ভিত্তি করে উনাকে বারবার কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন তাতে কি সঠিক ইতিহাস প্রতিফলিত হচ্ছে!? যেই মানুষ সারা জীবন এই অঞ্চল এর মানুষকে নিয়ে মুক্তি সংগ্রাম করেছেন সেই আসাম থেকে বাংলা। কংগ্রেস থেকে বের হয়ে চিত্তরঞ্জন দল, তার পর মুসলিম লীগ এর সাথে পাকিস্তান আন্দোলন, জমিদার বিরোধী আন্দোলন , ভাষা সংগ্রাম, কৃষক আন্দোলন, লাইনপ্রথা, আওয়ামীলীগ সৃষ্টি, যুক্তফ্রন্ট, পাকিস্তানকে ওলাইকুম বলা, কাগমারী সন্মেলন, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতা, ১৯ দফা,৬৯ এর গন-আন্দোলন, ৭০ এর প্রলয়কারী তুফান, ইলেকশন এ আওয়ামীলীগকে সমর্থন, স্বাধীনতা সংগ্রাম,লং মার্চ সহ আরো মাটি ও মানুষের জন্য অনেক সংগ্রাম করা মানুষকে ইতিহাস এর ক্রনলজিকাল পাঠ না করে শুধুমাত্র কয়েকটি ঘটনার খণ্ডিত পাঠ ইতিহাসকে অবজ্ঞা করার মতই।

রেফারেন্স —
মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডের খবর শুনে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ঘটনার কয়েক দিন পর তিনি চিকিৎসার জন্য পিজি হাসপাতালে ভর্তি হন। এ সময়ে খোন্দকার মোশতাক আহমদ তার সরকারী স্টাফদের সাথে নিয়ে হুজুরের সংগে দেখা করেন। সেই বহরে সাবিহউদ্দীন আহমদও ছিলেন। তিনি তখন তার পি আর ও ছিলেন। আমি হুজুরের কেবিন কক্ষেই ছিলাম। এর একটু আগেই ফনি ভূষণ মজুমদার তার কেবিনে ফিরে গেছেন। তিনি দিনে একবার হলেও হুজুরের শরীরের খবর নিতে আসতেন। হুজুরের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও ভক্তি দেখে অবাক হয়েছি। কেবিনে ফিরে যাবার সময়ে তিনি আমাকে হুজুরের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলতেন। হুজুরের শরীর তখন খুবই খারাপ ছিলো। এখানে আসার আগে তিনি কুমুদিনী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। খোন্দকার মোশতাক কেবিনে ঢুকলে হুজুর তার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকান। বসতেও বলেননি। এক সময়ে তিনি বলেই ফেললেন "আমার মজিবরকে তোমরা মেরেই ফেললে!" তিনি ক্ষোভের সঙ্গে তাকে আরো বলেন "দুই আনার মুড়ি খেয়ে সারাদিন দলের কাজ করেছে আর তোমরা নেতা হইছো!" রাগ ও ক্ষোভের মাত্রা বাড়তে থাকলে এক সময়ে মোশতাক আমাকে একটু বাইরে যেতে,বলেন। আমি হুজুরের ঔষুধ দিয়ে বরান্দায় এসে দাঁড়াই। চলবে... [একুশে পদক প্রাপ্ত ছড়াকার আবু সালেহ্ এর টাইম লাইন হতে]

মোস্তাককে সমর্থন দেয়ার বরাত সরকারী প্রচার মাধ্যম। তখন দেশের পত্রিকার সংখ্যা ছিল ৪টি এবং ৪টিই সরকারী। এ অবস্থায় ১৫ আগস্টের পরপর যখন বিবৃতিটি প্রকাশিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে, তখন সরকারি মালিকানাধীন দৈনিকের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে স্বাভাবিক কারণেই। শুধু তা-ই নয়, মওলানা ভাসানীর কথিত বিবৃতিটি উদ্ধৃত করা হয় ‘বিশ্বস্ত সূত্রের’ বরাত দিয়ে। সততা ও সদিচ্ছা থাকলে বিশেষ দৈনিকটি থেকে সরাসরিই বিবৃতিটি উদ্ধৃত করা সম্ভব ছিল এবং ইতিহাস গবেষণার দৃষ্টিকোণ থেকে তেমনটি করা প্রয়োজনও ছিল। কিন্তু সহজবোধ্য কারণে দৈনিকটির নাম পর্যন্ত বলা হয় না বরং আশ্রয় নেয়া হয় ‘বিশ্বস্ত সূত্রের'।
[শাহ আহমদ রেজা]

Farid Ahmed: আপনি ঝোপে ঝাড়ে বাড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছেন। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরেও মওলানা ভাসানী রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, রাজনীতির মাঠে ছিলেন। কারণ, ফারাক্কা মিছিলের মতো বিশাল এক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তাঁর মতো সাহসী লোক নিশ্চয় ময়দানে প্রতিবাদ করেছেন, মিছিল মিটিং করেছেন। জাস্ট, কোনো একটা পত্রিকার একটু কাটিং দেখান আমাকে এ ব্যাপারে। আমি সবই পাঠ করেছি। এই লোক শেষবেলায় একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করাতো দূরের কথা, বরং সেটাকে সমর্থন করেছেন। এটাও ইতিহাস পাঠেরই অংশ।

Adil Mahmood: ভাসানী যে রকম ফ্লিপ ফ্লপ স্ববিরোধী আচরণ পাকিস্তান আমল থেকে করে গেছেন ওনার পক্ষে ব্যাক্তিগত পর্যায়ে মোশতাককে এই ধরনের কথা বলা এমন কিছু অসম্ভব না। এতে কোন সন্দেহ নাই যে রাষ্ট্রপ্রধান মুজিবের প্রতি তার গভীর বিরাগ থাকলেও ব্যাক্তি মুজিবকে উনি আজীবনই স্নেহ করে গেছেন। ব্যাক্তি মোশতাককে তোমরা এইটা কি করলা বলা এবং একই মোশতাকের সরকারকে অভিনন্দন জানানও অন্তত মাওলানার পক্ষে অসম্ভব কিছু না। সরকার ষড়যন্ত্র করে বিবৃতি ছাপিয়েছে এই ধরনের যুক্তিতে ৭৫ এর পর রাতারাতি ভোল পালটানো সবাই সাফাই গাইতে পারে এবং গায়। যারা মোশতাক মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়েছিল সে সব লীগ নেতা দাবী করেছে তাদের বন্দুকের মুখে নেওয়া হয়েছিল। ভাসানী ছিলেন পরিষ্কার বঙ্গবন্ধু সরকার বিরোধী সোচ্চার কণ্ঠ এবং লক্ষণীয়ভাবে দিনে দিনে কট্টর দক্ষিণপন্থীতে বিবর্তিত। বঙ্গবন্ধু সরকারের পতনের পর ডানপন্থী মোশতাকের প্রতি তার রাজনৈতিক সমর্থন এমন কি অবাস্তব যে সেটাকে নানান ষড়যন্ত্র তত্ত্ব অমূকে এই শুনেছে সেইই শুনেছে যার ভিত্তিতে সত্য হতে পারে না এইসব দাঁড়া করাতে হবে সেটাই বুঝি না। ভাসানীর পূর্ন ব্যবচ্ছেদ করলে বরং আরও অনেক বিতর্কিত কাজকারবার পাকিস্তান আমল থেকেই দেখা যায় যেগুলির কাছে এই মোশতাক অধ্যায় এমন কিছু না।

বঙ্গবন্ধুর আরেক সিনিয়র রাজনৈতিক কলিগ ৫৬ সালের প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান যার কেবিনেটে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী ছিলেন সেই আতাউর রহমান খান বঙ্গবন্ধুর পতনের পর ১৫ই আগস্ট নাজাত দিবস ঘোষণা করেছিলেন। মজার ব্যাপার হল এই আতা খান সাহেবই মোটে ৪ মাস আগে বঙ্গবন্ধুর নানান গুণগান গিয়ে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। আমার তো মনে হয় বঙ্গবন্ধু আমলেও ওনার নামে সরকারী পত্রিকায় মিথ্যা বিবৃতি দেওয়ানো হয় আর মোশতাক আমলে তো আমরা জানিই যে পত্রিকায় যার নামে যা ছাপা হয়েছিল সবই বানানো।

Swapan Mahmud: ভাষাণী-মুজিব গুরু শিষ্য দুজনই নির্বিশেষে মানুষ।দুজনেরই ভুল ছিল। এখন তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় না রেখে এ বিষয়গুলো মোকাবেলা করতে গেলে বঙ্গবন্ধু কেও আওতায় আনতে হবে। ভিয়েতনাম দিবসে মতিউল-কাদের হত্যা (স্বাধীন বাঙলাদেশে রাজপথে প্রথম হত্যা), কমরেড সিরাজ শিকদার কে পুলিশি হেফাজতে হত্যা (বাঙলাদেশে প্রথম বিচার বহির্ভূত হত্যা),দিন দুপুরে জাসদ অফিস জ্বালিয়ে দেয়া (১৯৭৩)।এই বিষয়গুলোও সামনে নিয়ে আসলে কী জামাত-শিবির বলা শুরু হবে।(বিতর্ক করার জন্য কমেন্ট করছি না এবং এ প্রসঙ্গে আর কোন কথা আমি বাড়াব না)

Farid Ahmed: মুজিবের ভুল নিয়ে তো আমরা কথা বলি। এগুলোর কোনোটাতেই তো তাঁকে ছাড় দেওয়া হয় না। একটা অপরাধকে খণ্ডন করতে যখন আরেকটাকে আনা হয়, তখন আসলে সেই অপরাধকে ঢাকার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। আপনি মুজিবকে বাদ দিয়ে পরিষ্কার করে শুধু ভাসানীর অপরাধকে অপরাধ বলতে পারছেন না কেনো? মুজিবের অপরাধের আলাপ যখন আলাপ করা হবে, তখন না হয় মুজিবকে ধোলাই দেওয়া যাবে। অন্যের অপরাধকে এনে তুলনা কখন করা হয়, সেটা আপনার না জানা থাকার কথা না। তাঁর সরকারের সবচেয়ে কট্টর সমালোচক হবার পরেও, মওলানার ক্ষেত্রে শেখ মুজিব যে উদারতা এবং ভালবাসা দেখিয়েছেন, প্রতিদানে মওলানা তাঁর ধারে কাছেও যেতে পারেন নাই। অথচ বয়োজ্যেষ্ঠ হিসাবে উল্টো ভূমিকাটা নেবার কথা ছিলো তাঁর।

Adil Mahmood: বঙ্গবন্ধু বা মুজিব সরকারের ভুলের কারনে ভাসানীর ভুল যদি ব্যাখ্যা করা যায় তাহলে অবশ্যই স্বাধীন বাংলাদেশে ভাসানীর মূল্যায়নে তৎকালীন সরকারের ভুলগুলিও আমলে আনা উচিত; এতে সমস্যা নাই। কিন্তু তাই বলে ভাসানীর ভুল ব্যালেন্স করার জন্য মুজিব সরকারের ভুলও পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের খাতিরে আনতে হবে তাহলে সেটা যৌক্তিক বিশ্লেষণ বলা যায় ন। এটা হয়ে যায় এখনকার প্রচলিত "অমুক ঘটনার সময় আপনি কোথায় ছিলেন" জাতীয় এগ্রিসেভ ডিফেস। এই ধরনের আক্রমণাত্মক ডিফেন্স সাজানো হয় নিজের পছন্দের দল বা ব্যাক্তির সমালোচনা আড়াল করার লক্ষ্য নিয়ে - আমি হয়ত খারাপ কিন্তু অপরপক্ষ তো আরো খারাপ। সে নিয়ে বল না কেন!

Iftakhar Ahmed Babu: আপনার এই পেপার কাটিং এর সত্যতা পাওয়া যায়নি ৷ সেরকম কোন বিবৃতি পাঠান হয়নি ৷

Farid Ahmed: পেপার কাটিং এর সত্যতা মানে কী বাবু ভাই? পত্রিকায় ছাপা হয়নি এই বিবৃতি, নাকি পত্রিকাওয়ালারা উনার নামে মিথ্যা বিবৃতি লিখেছে?

Iftakhar Ahmed Babu: বঙ্গভবন থেকে কেউ মিস কোট করেছিল ইচ্ছাকৃত ভাবেই l এটা নিয়ে অনেক অনুসন্ধান হয়েছে ৷ যে কোন তারবার্তা রেকর্ড রাখা হয় ৷ খোঁজা হয়েছে , কোন প্রমান পাওয়া যায় নাই ৷

Farid Ahmed: উনি কি এর পাল্টা বিবৃতি দিয়েছিলেন কোনো? অনুসন্ধানটা কাঁরা করেছিলো? সেটার রেফারেন্স কী?

Swapan Mahmud: তারপর দেখা যাচ্ছে খবরটা জানাচ্ছে বাসস।বাসস তো রাষ্ট্রীয় সংস্থা এরা প্রপাগান্ডাও ছড়াতে পারে।

Farid Ahmed: ভাসানী বামপন্থী ছিলেন বলে কি আপনাদের এই অবিশ্বাস? সেটা হলে লজিক্যাল কিছু হলো না। এর পাল্টা বিবৃতি কোথায়, মুজিব হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা করে ভাসানীর কর্মকাণ্ড কী? তিনি কি এর বিরুদ্ধে কখনো কিছু বলেছেন? এগুলো আনতে হবে আপনাদের সামনে। শুধু বাসস, বলেছে বলে অবিশ্বাস করে গেলে পক্ষপাতিত্ব হয়ে যাবে।

Swapan Mahmud: বামপন্থী ব'লে সাত খুন মাফ হ'য়ে যায়না।আমি শুধু একটা সম্ভাবনার কথা বলেছি।অপ্রাসঙ্গিক হ'লেও বলি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথম মিছিল ক'রে ছাত্র ইউনিয়ন।এই কিছুদিন আগে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলছিলেন উনি তখন এক আওয়ামীলীগ নেতার সাথে এ বিষয়ে আলাপ করতে হেলে ঐ নেতা বলেন "সেলিম এখনি মিছিল টিছিল করার দরকার নাই শেষে আওয়ামীলীগ সরকারকেই (মোশতাক ক্যাবিনেট) নিষিদ্ধ করে দেবে।"

Farid Ahmed: আওয়ামী লীগের নব্বইভাগ নেতাই স্বেচ্ছায় কিংবা ভয়ে মোশতাকের সাথে ছিলো। এগুলো প্রমাণিত। এই কাপুরুষদের ডিফেন্ড করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। সেলিম সাহেব যেটা বলেছেন, সেটা যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য।শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে দুজন লোকের করার সামর্থ্য ছিলো। এর একজন হচ্ছে জেনারেল ওসমানী এবং আরেকজন হচ্ছেন মওলানা ভাসানী। এই দুই ব্যক্তির গ্রহণযোগ্যতা ছিলো সারাদেশব্যাপী। দুঃখজনক হচ্ছে, তাঁরা দুজনেই এই কাজটা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

আমি একটা জিনিস দেখাচ্ছি এখানে আপনাদের। এটা সরাসরি কোনো প্রমাণ নয়। কিন্তু, ঘটনাটা তাৎপর্যপূর্ণ। অনেক না বলা জিনিস এখান থেকে বের করে আনা সম্ভব। ২১ তারিখ দুপুরবেলা সন্তোষ থেকে অসুস্থ ভাসানীকে নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। ভর্তি করা হয় পিজি হাসপাতালে। সন্ধ্যাবেলাতেই মোশতাক তাঁকে দেখতে হাসপাতালে যায়। পরের দিন এই খবরটা প্রতিটা সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় গুরুত্বের সাথে ছাপা হয়। ভাসানী যদি এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতেন, মোশতাকের মতো একটা লোকের তাঁর প্রতি এই সৌজন্যতা দেখানোর কথা নয় এবং পত্রিকাগুলোতে এটাকে এভাবে হাইলাইট করারও কথা নয়। আমি শুধু দৈনিক বাংলার খবরটা দিচ্ছি।

mostaq-vasani

রেকর্ডের স্বার্থে আরেক তালেবর পাপা টাইগারের চরিত্রটাও এই সুযোগে তুলে ধরি।

zia-osman

Swapan Mahmud: গোটা আওয়ামীলীগ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একটা প্রতিবাদ মিছিল করলো না।সুর সুর করে মোশতাকপন্থী হয়ে গেল। ওসমানী তো বাকশাল বিরোধীতা করে আওয়ামীলীগ ছেড়ে দিয়েছেন। ভাসানী ও আওয়ামীলীগ এ নেই। দায়ী হয়ে গেলেন তারা। আওয়ামীলীগ বরাবরই নপুংসক ও বিট্রেয়ারদের নেতৃত্ব পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেন ও ভারতে গিয়ে সাহায্য চান কাদের সিদ্দিকী, লতিফ সিদ্দিকী,সুলতান মনসুর। সুলতান ভাই'র কাছে সেই সব দিনগুলোর কথা অনেকবার শুনেছি। আজ তাদের তিনজনকেই আওয়ামীলীগ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তবে আমি জাতীয় চার নেতা, রাজ্জাক, তোফায়েল, সামাদ, আজাদ সহ যারা জেলে ছিলেন তাদের কথা বলছি না।তারা প্রকৃতই দেশপ্রেমী ও বঙ্গবন্ধুর কর্মী ছিলেন।বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথম মিছিল করতে হল বামপন্থি ছাত্র ইউনিয়ন কে। (আপনারা যাদের ঠাট্টা করে বলেন বামাতি) যে দল নিজের প্রতিষ্ঠাতাই শুধু নন জাতির পিতার ও হত্যার প্রতিবাদ করার হিম্মত রাখেনা তাদের কাছে দেশ মাতৃকার কোন মূল্য থাকতে পারেনা!

Farid Ahmed: আপনার এই পুরো বক্তব্যটাই অযৌক্তিক, অপ্রাসঙ্গিক এবং অপরিসীম খেদোক্তির বহিঃপ্রকাশ মাত্র । আমরা আওয়ামী লীগ নিয়ে আলোচনা করছি না, বা আওয়ামী লীগের সাথে কারো তুলনাও করছি না। এখানে স্পেসিফিক ইস্যু হচ্ছে খুনি সরকারে প্রতি ভাসানীর সমর্থন দেওয়া। আওয়ামী লীগের লোকেরা তো সমর্থন দিয়েছেই। মোশতাকও আওয়ামী লীগেরই লোক ছিলো। সেগুলো বললে কি ভাসানীর অপরাধ কমে যাবে? আপনি বলেন আপনি মুক্তমনের মানুষ, কিন্তু বামদের বিরুদ্ধে গেলেই আর আপনার মুক্তমনে কোনো কিছুই ঢোকে না। এটা খুবই দুঃখজনক। এতখানি ব্রেইন ওয়াশড হওয়া ঠিক না।

Swapan Mahmud: আমি বলেছি সব দায়ভার ভাসানীর হয়ে গেল!

Farid Ahmed: ভাসানীর সব দায়ভার এটাওতো কেউ বলে নাই, আমিও বলি নাই। তিনি খুনে সরকারকে সমর্থন দিয়েছেন, তাদের সাথে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। এতো বড় একজন রাজনীতিবিদ হয়ে, শেখ মুজিবের গুরুস্থানীয় হয়েও, শেখ এবং শেখ পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি কী করেছেন? মোশতাক তাঁর শয্যাপাশে গেলে কি একবারও বলেছেন, আমি খুনির সাথে হাত মেলাই না। বলেন নাই। এমন একটা নিম্নস্তরের লোককে ডিফেন্ড করেন কীভাবে আপনি, সেটাই তো আমি বুঝি না। নারী, শিশু হত্যা যাকে সামান্যতম বিচলিত করে না। আমি আওয়ামী লীগ করেছি, এই সব আকাম করা কোনো আওয়ামী লীগারকে সমালোচনা করতে আমি তো দ্বিধায় ভুগি না সামান্যতমও। সেটা করতে গিয়ে অমুক তমুক কী করেছে, কার দায় বেশি কম সেটা বিবেচনায় নেওয়া হবে না।