চোখ জুড়ানো ঘন সবুজ পাহাড়ের সারি ঘেরা, যেন রূপকথার পাতা থেকে উঠে আসা এক অঞ্চল, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে বড় দ্বীপ পৃথিবীর চিনির পাত্র খ্যাত কিউবার সবচেয়ে উর্বর ভূমি এটি। সেই সাথে সারা বিশ্বের অন্যতম নয়নাভিরাম ও সবুজতম এলাকা বলে খ্যাত। সারি সারি আকাশ ছোঁয়া চুনাপাথরের পাহাড় তৈরি করেছে মোহিনী সব ঘন সবুজ উপত্যকা, তার ফাঁকে ফাঁকেই গড়ে উঠেছে মানব বসতি।
কেবল ভিনিয়ালেস এসে পৌঁছেছি আগস্টের এক পাগল করা গরমের দুপুরে, ভারি ব্যাকপ্যাক রেখে ঝুল বারান্দার আরাম কেদারায় জমিয়ে বসে দৃষ্টি মেলে দিয়েছি সুদূরের দিগন্তে সবুজস্নাত পাহাড় সারির দিকে। সীমানা প্রাচীরের কাছে মাটি ফুঁড়ে যেন উদয় হল গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ছোট গল্পের অমর চরিত্র- সিনর বালথাজার! তামাটে রূক্ষ মুখ, পাক খাওয়া কর্কশ চুল, মাথায় আদ্যিকালের খড়ে বুনানো দুমড়ানো বিশাল সমব্রেরো টুপি, ঘামের প্রাচুর্যে পরনের এককালের সাদা শার্ট ধূসর হয়ে লেপটে আছে পিঠের সাথে, শরীরের আরেক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। মুহূর্ত কয়েক নিশ্চুপ দাড়িয়ে তোবড়ানো পাইপে অগ্নি সংযোগ করে পূর্ব নির্ধারিত গন্তব্যের দিকে রওনা দিলেন সিনিওর বালথাজার, তার আগে ঘর্মাক্ত ঠোঁট থেকে বেরেনো এক জাদুময় সুরেলা জোরাল শীষে পথ ঘাট মাড়িয়ে সাথে এসে জুটল মুখে লাগাম পড়ানো কিন্তু পিঠের জিন ছাড়া এক মধ্যমাকৃতীর ঘোড়া! এ যেন মার্কেজের পৌরাণিক বিশ্বে পৌঁছে গেছি অজানা জাদু বলে।
বিস্ময়ের পর বিস্ময়, হঠাৎই মনে হল পাশের কলা বাগানের এক গাছের কলার মোচার কাছে সুনসুন শব্দ তুলে উড়ে বেড়াচ্ছে চোখ ঝলসানো পান্না সবুজ এক বিশাল পতঙ্গ, আমার বিস্ময়াভূত দৃষ্টির সামনেই সেই পতঙ্গ পরিণত হল অতি দ্রুত বেগে ডানা নাড়ানো অতি ক্ষুদ্রাকৃতির এক পাখিতে, হামিংবার্ড!! আমাদের গ্রহের পক্ষীজগতের সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির সদস্য, আকারে একটি বড় পতঙ্গের মতই, ডানা নাড়াচ্ছে সেকেন্ডে বার ! সারা বিশ্বে (আসলে দুই আমেরিকায়) এখন পর্যন্ত ৩৩৯ ধরনের হামিংবার্ডের খোঁজ পাওয়া গেলেও থাকলেও কিউবাতে এখন পর্যন্ত দেখা গেছে করে ৩ ধরনের হামিংবার্ড, এর মধ্যে বি হামিংবার্ড বিশ্বের ক্ষুদ্রতম পাখি। বিস্ময়ের ধাক্কায় থ হয়ে ক্যামেরা হাতে নিতেও ভুলে গেছি, এর কয়েক মুহূর্তের মাঝেই কলাফুলের রসপান সাঙ্গ করে যেন শূন্যে মিলিয়ে গেল সবুজ হামিংবার্ড!!
আশ্রয়দাতা ডাঃ রিদেলের কাছে জানা গেল হামিংবার্ডের স্প্যানিশ ভাষায় নাম কলিব্রি হলেও স্থানীয়রা এর সঞ্চালয়মান ডানা থেকে উদ্ভূত শব্দের কারনে আদর করে শুনশুন বলে ডাকে! সেই সাথে আকর্ণ হাসি দিয়ে বললেন এখন পর্যন্ত অনেক অতিথিই এই পাখির ছবি তোলার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ছবি তোলা পর্যন্তই সার, পাখি সেখানে অনুপস্থিত! কিন্তু এই পাখিরা প্রায়ই আসবে ফুলের রস খেতে, মূলত সকালের দিকে। রোখ চেপে গেল, জীবনে প্রথম হামিংবার্ড দেখলাম, আর ছবি তুলব না! দৃশ্যপটে বাঁধব না জীবজগতের এই অপার বিস্ময়কে! ক্যামেরায় লেন্স ফিট করে ঘণ্টাখানেক ঠাই দাড়িয়ে অবশেষে ফ্রেম বন্দী করা গেল উড়ন্ত সৌন্দর্যকে। এর নাম কিউবার পান্না সবুজ হামিংবার্ড, সেকেন্ডে ডানা ঝাঁপটায় সে ৬০- ৮০ বার, আর হামিংবার্ডরাই আমাদের গ্রহের একমাত্র পাখি যারা পিছনের দিকেও উড়তে পারে, মানে ওড়ার সময়ও পেছন দিকে এগোতে পারে।
এর মাঝেই বারন্দার উপরে নেমে আসা ফলে নুয়ে পড়া গাছে দুই ধরনের গিরগিটি চোখে পড়ল, রঙধনুর সাত রঙে রাঙ্গানো! বেশ জায়গাটি তো! কোথাও যাবার আগেই স্রেফ বারান্দা থেকেই চোখে পড়ে এমন অমূল্য সব দৃশ্য, আরো কত কি বুঝি অপেক্ষা করছে এই স্বর্গ উপত্যকায়! পাশের বাঁশ ঝাড় থেকে শোনা যাচ্ছে বকের কোলাহল।
বিকেলে প্রতিবেশীর কৃষকের বাড়িতে যাওয়া হল তার নিজের হাতে সিগার তৈরি দেখতে, সারা বিশ্বের ধূমপায়ীদের কাছে সবচেয়ে আদরণীয় হাভানা সিগারের সর্বোকৃষ্ট চালান কিন্তু যায় এই উর্বর ভূমিতে উৎপাদিত ফসল থেকেই। তামাক পাতা শুকানোর জন্য তৈরি বিশেষ গোলাঘরে বসিয়ে চোখের সামনেই সিগার তৈরি করলেন চাষি ! সেই সাথে জানালেন সম্পূর্ণ ভাবে রাসায়নিক পদার্থ বর্জিত হওয়ায় ও নিকোটিনের মূল উৎস পাতার ডাটা ছিড়ে ফেলায় শরীরের জন্য এমন কোন ক্ষতিকর নয় এই বিশেষ সিগার, যে কারনে অনেক তামাক চাষিই অবিরাম ধূমপান করেও নব্বই বছরের বেশি আয়ু লাভ করেছেন! এই ধরনের গোলা ঘরে প্রায় এক বছর তামাক পাতা শুকানোর পর তা কারখানায় পাঠানো হয় প্রক্রিয়াজাত করার জন্য।
এই সময় দিগন্তে দেখা দিল নিকয কালো মেঘ দূতের দল, দেখা দিয়েই ক্ষান্ত নয় ক্রমশ পুরো আকাশ দখল করে ফেলল চোখের নিমিষে, ক্ষণে ক্ষণে চমকাচ্ছে বিজলী। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বাড়ী পৌছাতে না পৌছাতেই যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল মাথার উপরে, ঝুম বৃষ্টি! ক্রান্তীয় অঞ্চলের ঝড় কাকে বলে হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে ছাড়ল পরের একটি ঘণ্টা। কালবৈশাখীর চেয়ে মোটেও কম নয় তার তাণ্ডব। তার উপর পাহাড় ঘেরা উপত্যকা বলে বজ্রপাতের শব্দ অনবরত প্রতিদ্ধনি তৈরি করে নরক গুলজার করে ছাড়ল অবশেষে।
পরদিন সাত সকালেই শহরতলীর অদূরেই ঘোড়সওয়ারদের আস্তানায় যাওয়া হল। প্রকৃতির সন্তান এরা, আমাদের তথাকথিত সভ্যতা থেকে দূরে থেকেই খুশী আছে নিজেদের দেশোয়ালি জীবন নিয়ে, পুরুষেরা ঘোড়া চালানোর ব্যপারে সমান দড়, মেয়েরা ঘর-কন্না সামলানোর পাশাপাশি চাষাবাদের কাজেও দক্ষ।
তাদের মহল্লায় ঢুকতেই দেখা হল সিনোরা সাব্রিনার সাথে, শতবর্ষের পরিবর্তনের সাক্ষী মহিলা স্মিত হেসে জানালেন আসছে নভেম্বরে ঠিক ১০০ বছর পূর্ণ হবে তার, আজ পর্যন্ত কোন দিনই কৃত্রিম ঔষধ ব্যবহার করতে হয় নি তার, এখনো লাঠী-চশমার অবলম্বন ছাড়াই চালিয়ে নিচ্ছেন চমৎকার ভাবে!
চারপাশের মধুর উপভোগ্য নিস্তব্ধতা চুরমার করে উঠানে চার-চারটি ঘোড়া নিয়ে দমকা বাতাসের মত আবির্ভাব ঘটল হুবহু মরুর বেদুইন ওমর শরীফের মত দেখতে উইলফ্রেডোর। সেই আমাদের আজকের অভিযানের গাইড। ঘোড়ায় যে আগে চড়িনি এমন নয়, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতাগুলো ভুলতে পারলেই অনেক খুশী হতাম! যা হোক, চুপাচুপা নামের মোটামুটি শান্ত এক ঘোড়া বরাদ্দ হল, জিনে কোনমতে বসে ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণের অল্প কিছু নির্দেশনা জেনে নেবার পরপরই আমাদের যাত্রা শুরু।
সেই লাল কাদা-মাটির রাস্তা পেরিয়ে নানা পাথুরে ট্রেইল ধরে উঁচু-নিচু রাস্তা পাড়ি দিয়ে দুর্ভেদ্য বনের ভেতর দিয়ে অজানার পানে। বিভিন্ন দেশি আমরা কজনা, উইলফ্রেডো আমাদের নেতা, তার নির্দেশ মতই চলছে সমস্ত পরিকল্পনা। কিন্তু মূল সমস্যা তৈরি করছে আমার হাতের ভারী ক্যামেরা! চলমান ঘোড়া থেকে ভাল ছবি তুলি কি করে, বিশেষ করে যখন একটা হাত সর্বক্ষন রাখতেই হয় ঘোড়ার লাগামের উপরে!! কিন্তু এমন স্মৃতিময় যাত্রা ফ্রেমবন্দী করার লোভ তো আছে ষোল আনা, তাই চুপাচুপার পিঠ থেকে পতনের ঝুকি নিয়েই কিছু ছবি তোলা হল যাত্রার ফাঁকে ফাঁকে।
নানা বন, নদী, কাদাময় খাল, ঘাসের প্রান্তর পেরিয়ে পৌছালাম পটে আকা ছবির মত পাহাড় ঘেরা এক অতল হ্রদে। স্বচ্ছ জল টলটল করছে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে, চারিদিকে সবুজ পাহাড়ের প্রতিবিম্ব তার শরীর জুড়ে। তীরের কাছেই এক ঝোপের সাথে ঘোড়াগুলো বেঁধে সোজা সেই শান্তিময় প্রতিবিম্ব চুরমার করে সুশীতল জলে অবগাহনে চরম ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমরা, সেটা সুন্দরের আহবানে না চটচটে ঘাম ধুয়ে ফেলার তাগিদে তা বোঝার আগেই উইলফ্রেডোর চিৎকারে অবাক হয়ে উপলব্ধি করি একটি পুরো ঘণ্টা কালের অতলে চলে গেছে এই কয়েক মুহূর্তেই।
আবারে ঘোড়ায় চেপে এক ছোট্ট গ্রামের পানে আমাদের যাত্রা শুরু, এবারের পথ বেশ বন্ধুর, কয়েক জায়গায় সাংঘাতিক খাঁড়া ঢাল, যেন পাহাড়ের কিনার দিয়ে চলা। কিন্তু পরীক্ষিত সৈনিক আমাদের ঘোড়াগুলো দেখলাম পাহাড়ি ছাগলের মতন দক্ষতা নিয়েই একের পর এক বাঁধা অতিক্রম করে নিয়ে চলল অভীষ্ট লক্ষ্যের পানে।
চাষিদের সেই ডেরাতে ডাবের জলপানের বিরতি, সেই সাথে গাছপাকা ভেজালহীন পেপে, আম, অ্যাভোকাডো নানা ক্রান্তীয় ফলের সমাহার আমাদের যাত্রাবিরতিকে আক্ষরিক অর্থেই ফলাহার করে ছাড়ল। বেশ উচুতে জায়গাটি, সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে অনেক দূরের সীমানা পর্যন্ত সবুজের রাজত্ব।
আকাশে মেঘের দল করে চলেছে বিস্তর আঁকিবুঁকি রচনা আর তাদের সাথে যোগ দিয়েছে অসংখ্য টার্কি শকুন, বিশাল এই পাখিগুলোর রাজত্ব সারা কিউবাতেই( শকুনের উপস্থিতির প্রাচুর্য মানে প্রাকৃতিক পরিবেশের সুস্থতা, ভাবতে অবাক লাগে কেবল মাত্র মানুষের অসচেতনতায় উপমহাদেশের শতকরা ৯৯ ভাগ শকুন মারা গিয়েছে গত কয়েক দশকে, আর কদিন পর হয়ত বিশেষ করে বাংলাদেশের শিশুদের শকুন দেখতে হবে কেবল বইয়ের পাতায়) টার্কি শকুন আবার বিশেষ জাতের, এরাই একমাত্র শকুন যারা ঘ্রাণ শক্তির সাহায্যে খাদ্যানুসন্ধান করে থাকে, পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা যে কাজটি করে তীক্ষ দৃষ্টিশক্তির সাহায্যে, অসম্ভব শক্তিশালী ঘ্রাণশক্তির অধিকারী এই পাখিগুলো প্রায় ২০ কিলোমিটার দূর থেকেও খাবারের অবস্থান বুঝতে পারে!
সেই গ্রামের অধিবাসীদের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে চললাম আমরা এক চুনাপাথরের পাহাড়ের কাছে, খানিকটা সমতলের কাছে অতি উর্বর এলাকায় সবসময়ই নজরে আসে নয়ন জুড়ানো নানা ফসলের ভরা ক্ষেত- ধান, ইক্ষু, তামাক, কচু, নানা ধরনের সবজী, সেই সাথে চারনরত গরু, ছাগল, শূকরসহ নানা গবাদি পশু। সেই সফেদ পাহাড়ের কাছ দিয়ে আর বেশ খানিকটা পথ চলে সেই দিনের রোমাঞ্চকর ৭ ঘণ্টার যাত্রা শেষ হল আমাদের।
পরদিন সূর্যদেব পাহাড়ের আড়াল থেকে উঁকি দেবার আগেই আমরা প্রস্তুত যাত্রার জন্য, আজ যাওয়া হবে উপত্যকার অন্য প্রান্তে, মূল উদ্দেশ্য প্রকৃতি উপভোগ ও পাখি পর্যবেক্ষণ, সেই সাথে অ্যাকোয়াটিক বা জলজ নামে পরিচিত এক সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনাচারের সাথে সরাসরি পরিচয় হওয়া। স্থানীয় সবজান্তা হুয়ানিতো ( অর্থাৎ ছোট্ট হুয়ান) আমাদের গাইড।
মহা মজার লোক সে, সর্বক্ষণ মুখে খই ফুটছে (যদিও স্প্যানিশ ভাষায় তার একমাত্র সম্বল) আর সদা ব্যস্ত পথ চলতে চলতেই আমাদের কিছু না কিছু দেখাতে, পাহাড় থেকে শুরু করে উদ্ভিদ, পাখি, পতঙ্গ, ফসল- সব ব্যাপারেই অসামান্য জ্ঞান রাখে সে। হুয়ানিতোকে দেখে ভরসা পেলাম বটে, তেমন আশংকাও হল হয়ত তার কথার তোড়ে কোন জীবিত প্রাণীই আমাদের ধারে কাছে ভিড়বে না! সেই কথা একটু জানাতেই আরো একগাদা বাক্যবাণে বিদ্ধ হয়ে জানলাম ষাটোর্ধ এই চিরতরুণের বিবাহিত জীবন ৪২ বছরের, তার কাছে এখন তার স্ত্রী পেনিলোপি ক্রুজের মতই আবেদনময়ী এবং তার স্ত্রী তাকে আন্তোনিও ব্যান্দেরাস বলেই ডেকে থাকে, এমন কথায় মনে পড়ল নমস্য জীববিদ ও লেখক, জেরাল্ড ড্যারেল এমন এক প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা লোকের কথা লিখেছিলেন আর্জেন্টিনা নিয়ে লেখা এক বইতে।
যাত্রার শুরুতেই স্থানীয় এক পাহাড়ে নিয়ে গেল হুয়ানিতো আমাদের, যার বিশাল ঢাল জুড়ে আঁকা হয়েছে বিশাল চিত্রকর্ম যা বিখ্যাত প্রাগৈতিহাসিক ম্যূরাল নামে, সুউচ্চ পাহাড়ের গায়ে উজ্জল রঙে আকা হয়েছে আমাদের গ্রহের জীবনের ইতিহাস- আদি সাগরে এককোষী সরল জীব থেকে বহুকোষী জীব হয়ে ডাইনোসররা, তাদের স্থল গমন, স্তন্যপায়ীদের বিজয়রথ, শেষ পর্যন্ত বিবর্তনের ধারায় মানুষের আবির্ভাব। অতি সংক্ষেপে কিন্তু অত্যন্ত বড় স্কেলে করা এই ম্যূরালটি এই এলাকার অবশ্য দ্রষ্টব্য।
সেখান থেকে এক গ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের প্রথম যাত্রা অ্যাকোয়াটিক বা জলজ সম্প্রদায়ের গ্রামে। এমন নামে অভিহিত হবার কারণ এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা কোন রকম কৃত্রিম ঔষধ ব্যবহার করে না, সকল রোগের চিকিৎসায় তারা কেবল মাত্র পাহাড়ের গর্ভে লুকিয়ে থাকা একটি বিশেষ ঝর্ণার জল ব্যবহার করে থাকে, এবং খুব একটা শহরমুখি না হয়ে প্রকৃতির কোলেই সারাটা জীবন অতিবাহিত করে। গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে মেরী নামের এক মহি্লা সবার প্রথম এই ধনান্তরির উৎসের সন্ধান পান, যার মাধ্যমে তিনি অন্ধের অন্ধত্ব দূর করেন, পঙ্গুর পঙ্গুত্ব, রাতারাতি ঈশ্বরের অবতারে পরিণত হন। তার জল চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে যাওয়া কয়েকজন এখনো বেঁচে, যারা উৎসাহ ভরে প্রচার করেন সেই অলৌকিক কাহিনী, কিন্তু মেরীর দেহত্যাগের পরে সেই ঝর্ণার জল আর কারো অসুস্থতা নিবারন করতে পারে নি ( বোঝা যাচ্ছে সেই খনিজ জলে বিশেষ বিশেষ রোগ দূরকরণের উপাদান ছিল, কালের আবর্তে সেই খনিজ পদার্থের পরিমাণ কমে আসায় বা উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই কেরামতি বন্ধ হয়ে যায়, আর তিলকে তাল করে অতিলৌকিক রঙ দেয়া তো মানব সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ)।
গ্রামের প্রথম বাড়িটিতে দেখা হল আন্তনিও কার্লোসের সাথে, বয়স ৬৫ ছুই ছুই, স্বাস্থ্য অটুট, আজ পর্যন্ত কোন ঔষধ ব্যবহার করেন নি। কিউবার আর দশ জন মানুষের মতই অত্যন্ত অতিথি বৎসল, ভিনদেশী মুখ দেখে হৈ হৈ করে বসতে বলেই চট করে বাড়ীর পাশের আঁখক্ষেত থেকে মোটা তাজা আঁখ কেটে আনলেন আমাদের টাটকা গুয়ারাপ্পো ( আঁখের রস) খাওয়াবেন বলে। তার বাড়ীর বারান্দাতো বটেই, ঘরের বিছানা থেকে পর্যন্ত দেখা যায় অসামান্য মন ভুলানো প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী।
বাড়ীর এক কোণে ডাই করে রাখা টাটকা আনাজ, ফল-পাকুড়। দেয়ালে ঝুলানো রসুনের ভুরভুরে গন্ধ বিশ্বের যে কোন বাজারের রাসায়নিক সার আর কীটনাশক দিয়ে ফলানো চিমসে রসুনের চেয়ে অনেক আলাদা। মনে হল এমন জায়গায় এই ভাবে দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন, সেই সাথে তাদের মত পুষ্টিকর খাবার আর প্রচুর পরিশ্রম করলে হয়ত কারোই আর ডাক্তারের ঔষধের দারস্থ হতে হবে না।
সেই গ্রামের পর শুরু হল কঠিনতর যাত্রার পালা, আঁকাবাঁকা সর্পিল পথ চলে গেছে পাথুরে গুহার দিকে উপর পানে। ক্ষণে ক্ষণে রাস্তায় থামছি নানা বিস্ময়কে অবলোকনের জন্য-কোথাও একদল পিঁপড়া খাদ্য সঞ্চয়ের জন্য একগাদা সবুজ পাতা কেটে নিয়ে যাচ্ছে প্রবল পরিশ্রম করে। থেকে থেকে চোখে পড়ছে ভুবন ভুলানো রঙের অধিকারী নানা প্রজাপ্রতির, সেই সাথে সরব বিহঙ্গকূলতো আছেই।
এমন ভাবেই দেখা হয়ে গেল বিশ্বের ক্ষুদ্রতম শিকারি বাজগুলোর একটি আমেরিকান কেস্ট্রেলের সাথে আর এক বিশাল বকের সাথে, সেই সাথে ক্ষুদে প্লোভার আর পদ্মনীল কালেম পাখি।
এই পাহাড়ে এখনো টিকে আছে প্রাগৈতিহাসিক যুগের নানা গাছ, তবে সেই আমলের কোন প্রাণী টিকে থাকার সম্ভাবনা না থাকলেও তাদের বংশধররা কোন মতেই বিমুখ করে নি আমাদের, হুয়ানিতোর চিৎকারে মাথার উপরে তাকিয়ে দেখি বিশাল এক বনস্পতির মোটা ডালে আরামে রোদ পোয়াচ্ছে বিশাল এক গিরগিটি, সাক্ষাৎ জুরাসিক যুগের দানবদের বংশধর।
এমনি করে মধ্য দুপুরের খর সূর্য মাথায় পাহাড়ের গোঁড়ায় পৌঁছানো গেল, এবার ভেতরের গুহায় যাবার পালা, ভেতের সুচিভেদ্য অন্ধকার, এর মাঝে সরু পথ ধরে রুক্ষ দেয়াল ঘেঁষে এগোতে হবে, পা পিছলালেই বিকট কুৎসিত খাদ মুখবাদ্যান করে আছে স্বাগতম জানানোর জন্য, শুরু হল পাহাড়ের কন্দরে প্রবেশের অভিযান। কয়েক মুহূর্তেই ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়ে গেলাম, গায়ের সিল্কের শার্ট ঘেমে লেপটে চামড়ারই আরেক স্তরে পরিণত হয়েছে, তীক্ষ পাথর লেগে কয়েক জায়গায় ছিলে জ্বালা করছে, সবচেয়ে সমস্যা করছে কাঁধের ভারী ব্যাগ আর হাতের ক্যামেরা! এর মাঝেই চলতে চলতে ক্ষীণ আলোর ধারা চোখে পড়ল, আহ যেন শান্তির আলোকময় জীবনের আহ্বান সেই প্রায় অদৃশ্য আলোকরশ্মিতেই। দূরে দেখা গেল গুহামুখ, তাতে জাল বিছিয়ে আছে নানা গাছের বিশাল সব শেকড়। শেষ টুকুই সবচেয়ে কঠিন, খানিকটে গাইডের সাহায্য নিয়েই শেষ বাঁধা টপকাতেই পায়ের নিচে চোখে পড়ল স্ফটিক স্বচ্ছ জলাশয়, সেই বিখ্যাত ভূগর্ভের ঝরনা !!
ব্যস, আর বলার কিছু নেই! অলৌকিক বলে যে কিছু নেই এতো জানাই আছে, কিন্তু খানিক আগেই গুহার ঘুপসি গরমে আধা সেদ্ধ হতে হতে কেমন প্রাণ চাইছিল একটু ঠাণ্ডা জলে শরীর ভেজাতে, সেই ইচ্ছে পূরণের এর
চেয়ে ভালো বন্দোবস্ত আর কি হতে পারে! সোজা নেমে পড়লাম সেই প্রাকৃতিক জলাধারে। কিন্তু মহা শীতল জল, ঠাণ্ডায় প্রথমে তো কাপুনি ওঠার জোগাড়! কিন্তু ধাতস্থ হওয়া মাত্রই কানায় কানায় উপভোগ করা হল সেই সুখ, চোখ বুঝতেই প্রথমেই কালো বাজল মহাকাশের অসীম নিস্তব্ধতা, এর ফাঁকে চুইয়ে চুইয়ে এল যেন কোন দূর মহীরুহের মর্মর ধ্বনি, মাঝে মাঝে বিহঙ্গকুলের কলতান। ওঠবার পথে হুয়ানিতোর মন রক্ষার্থেই খানিকটে জল তর্পণ করে বিসর্জন দিলাম সেই ঝরনাতেই, প্রাচীন সেই স্থানের জলদেবতাদের উদ্দেশ্যে।
এবার দিনের সবচেয়ে উঁচু গন্তব্যের পানে আবার চড়াই-উৎরাই, ইচ্ছার বিরুদ্ধে সুশীতল পাহাড়ি ঝর্না ছেড়ে এগোতেই হল আবার পাথরময় শুষ্ক ভূমিতে। পথে দেখা হল নানা রঙবেরঙের পতঙ্গ, বিশালাকার শামুক আর অন্য জাতির গিরগিটিদের সাথে।
অবশেষে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কয়েক হাজার ফিট উপরে সেই চাতাল মত জায়গাতে পৌঁছানো গেল, সামনে নয়ন সার্থক করা প্রকৃতি। অ্যালান কোয়াটারমেইনের বুড়ো জুলু আমস্লোপোগাসের মত মনে হল- এমন দৃশ্য শত বছর তাকিয়ে থাকলেও পুরনো হবে না ! ইউনেসকো যে কেন ভিনিয়ালেস উপত্যকাকে বিশ্বের সবচেয়ে নয়নাভিরাম Cultural Landscape উপাধি কেন দিয়েছে তা নিয়ে আর কারো সন্দেহের অবকাশ থাকার করা নয়।
যাত্রা আবার নিচের দিকে, বাড়ীর উদ্দেশ্যে। এমনিভাবে নানা ঘটনার মাঝে একদিন সময় ফুরিয়ে এল এই স্বর্গে অবস্থানের, ফেরার দিন দুরপাল্লার বাসে চেপে বসেছি ত্রিনিদাদের উদ্দেশ্যে, অদৃশ্য ব্যথায় টন টন করে ওঠা মন পড়ে আছে দুপাশের চলমান উপত্যকায়, ঘুরে ঘুরে মনের পর্দায় ভেসে উঠছে এখানকার প্রকৃতি আর সদ্য পরিচিত হওয়া কিছু মানুষের মুখ- অতি বিরল নিঃস্বার্থপরতার অপাপবিদ্ধতায় মোড়া যাদের অন্তর। ভালো থেকো বন্ধুরা আমার, ভালো থেকো। চিরকাল যেন এমন স্বর্গই থাকে ভিনিয়ালেস।