এক
দোষে গুণে মিলেই মানুষ। কেউ-ই ফেরেশতা না। কারো মধ্যে ভালো গুণ বেশি থাকে, খারাপ গুণটা থাকে কম। আবার এর উল্টোটাও আছে। কারো মধ্যে দোষ বেশি থাকে, ভালোটা থাকে কম। মওলানা ভাসানী-ও এর উর্ধ্বে নন।
আমরা যখন কাউকে সমালোচনা করতে যাই, নিশ্চিতভাবে এই জিনিসটা মাথায় রেখেই করি। শুধু দোষ দেখাতে গেলে মানুষটা ভালো দিক চাপা পড়ে যায়, তাঁকে একটা আস্ত শয়তান বলে মনে হয়। আবার শুধু ভালো দিক দেখাতে গেলে খারাপ অংশটা ঢাকা পড়ে যায়। মনে হয় কোনো দেবদূতের কথা শুনছি আমরা।
সে কারণে আলোচনা-সমালোচনায় একটা ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়, নির্মোহ থাকতে হয়। কিন্তু মানবীয় দোষ-ত্রুটির বাইরে কিছু বিষয় আছে, যেগুলো মারাত্মক অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। সেগুলো কেউ করলে, তাঁঁর গুণ দিয়ে এই অপরাধকে ঢাকা যায় না, উচিতও না। অপরাধ না করেও কেউ কেউ দোষী হতে পারে সেই অপরাধকে সমর্থন দিয়ে।
বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ড হচ্ছে পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ড। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে এইদিন হত্যা করা হয়। শেখ মুজিবের অপরাধ যতো দীর্ঘই হোক না কেনো, তাঁকে এবং তাঁর পরিবারের সকল সদস্যকে হত্যা করার অধিকার কারো নেই। এই হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছে, তারা যেমন দায়ী, ঠিক একইভাবে এই হত্যাকাণ্ডের পর খুনিদের সমর্থিত সরকারকে যারা সমর্থন দিয়েছে, তাদের দায়ও কম নয়। এ’রকম একজন হচ্ছেন মওলানা ভাসানী।
তাঁকে সবাই মজলুম জননেতা বলে। তিনি নাকি গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব করতেন। এই ভদ্রলোকও এমন নৃশংস একটা হত্যাকাণ্ডের পরে খুনিদের তৈরি করা সরকারকে সমর্থন দিতে এগিয়ে আসেন। এই একটা কাজের কারণে মওলানা ভাসানী কোনোদিন আমার কাছ থেকে শ্রদ্ধা কুড়াতে পারেননি। নিরীহ নারী এবং শিশুদের হত্যাকাণ্ড যাঁকে সামান্যতম বিচলিত করে না, বরং সেই খুনিদের পক্ষে গিয়ে দাঁড়ান তিনি, তাঁকে ভালবাসাতো অনেক দূরের কথা, আমার শ্রদ্ধা পাবারও যোগ্য তিনি নন।
১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অসুস্থ হয়ে পড়েন মওলানা ভাসানী। আটাশ তারিখে তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় সরকারী খরচে। ভর্তি করা হয় পিজি হাসপাতালে। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে হাসপাতালে দেখতে যান মার্চ মাসের পাঁচ তারিখে। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী এটা ছিলো তাঁর দ্বিতীয়বার দেখতে যাওয়া। অত্যন্ত স্নেহ ভালবাসাময় ছিলো এই সাক্ষাৎকারপর্ব। আমি বিস্তারিত বর্ণনাতে যাচ্ছি না। আপনারা নিজেরাই সেই বর্ণনা পড়তে পারবেন। আমি পত্রিকার রিপোর্টটাই তুলে দিচ্ছি আপনাদের জন্য।
এর আড়াই বছর পরে মওলানা ভাসানী আবারও অসুস্থ হন। এটা ছিলো অগাস্ট মাস। সপ্তাহ খানেক আগে শেখ মুজিব নিহত হয়েছেন সপরিবারে। তাঁর খুনিরা খোন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট বানিয়েছে। এরাই মওলানাকে সন্তোষ থেকে নিয়ে আসে ঢাকায়। আবারও তাঁকে ভর্তি করা হয় পিজিতে। এইবার তাঁকে দেখতে আসে খোন্দকার মোশতাক। মোশতাক এসে মওলানার বিছানার পাশে সময় কাটায়। তাঁর হাত ধরে থাকে গভীর ভালবাসা নিয়ে।
মানুষের জীবন কী রকম এক বৈচিত্র্যে ভরা। কখন যে তা একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যাবে, কেউ তা জানে না।
দুই
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এই সরকারের সমালোচোনায় সর্ব প্রথম যিনি সোচ্চার হন, তিনি হচ্ছেন মওলানা ভাসানী। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসের তিন তারিখে পল্টনের এক জনসভায় তিনি প্রকাশ্যে এই সরকারের সমালোচনা করেন। গ্রামাঞ্চলে অপর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করে তিনি সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন।
তিনি বলেন, ‘জনগণের দুঃখ-দৈন্য দূর করার ব্যাপারে মুজিব সরকার ব্যর্থ হয়েছে।’ সমালোচনা শুরু করে সেখানেই থেমে থাকেন না তিনি। সরকারের সবচেয়ে বড় সমালোচক হিসাবেও তিনি আবির্ভূত হন। ‘হক কথা’ নামে তাঁর একটা পত্রিকা ছিলো। এই পত্রিকা আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর সমালোচক হিসাবে চারিদিকে সাড়া ফেলে দেয়।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
সরকারের শুধু সমালোচনা না, এই সরকারের পতনের জন্যও তিনি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালের ১১ জানুয়ারিতে মুজিব সরকারকে উৎখাত করার জন্য এক ডজনেরও বেশি দল-উপদল গ্রুপ নিয়ে একটি ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করা হয়। এই কমিটি ২১ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে যে জনসভা করে, তাতে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশকে আমি ভিয়েতনামে পরিণত করবো।’
মুজিব সরকারে পতন ঘটানো এবং বাংলাদেশকে ভিয়েতনাম বানানোর আগেই ফেব্রুয়ারি মাসে অসুস্থ হয়ে পড়েন মওলানা ভাসানী। ফেব্রুয়ারি মাসের আটাশ তারিখে তাঁকে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরের দিন সকালবেলাতেই তাঁর চিকিৎসার খোঁজ খবর নেবার জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী হাসপাতালে গিয়ে হাজির হন। তিনি মওলানা সাহেবের শারীরিক অবস্থা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে মওলানা সাহেব এবং চিকিৎসকদের সাথে আলাপ-আলোচনা করেন।
এখানেই শেষ হয় না। বিকালবেলাতেই তিনি যে সরকারের সমালোচনা করেন কঠোর ভাষায় নিয়মিত, যাদের পতনের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে চলেছেন, সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে দেখতে হাসপাতালে চলে আসেন। তিনি মওলানা সাহেবকে সম্ভাব্য সর্বোত্তম চিকিৎসার আশ্বাস প্রদান করেন।
চিকিৎসার ব্যয়ভার নিয়েও মওলানাকে দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করেন তিনি। সকল ব্যয়ভার তিনি ব্যক্তিগতভাবে বহন করবেন বলে জানান। প্রয়োজনে তাঁকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করাবেন, এই প্রতিশ্রুতিও প্রদান করেন তিনি। মওলানা ভাসানী দেশের বাড়িতে চলে যাবার জন্য ছেলেমানুষি জেদ ধরলে তিনি মওলানার স্ত্রীকেও ঢাকায় নিয়ে আসার আশ্বাস দেন।
শেখ মুজিবের আকস্মিক আগমন এবং এতসব প্রতিশ্রুতি পেয়ে অভিভূত হয়ে পড়েন মওলানা। তিনি তাঁর পিঠে সস্নেহে হাত বুলাতে বুলাতে বলেন, “আমি তোমার জন্য দোয়া করছি এবং যতদিন বেঁচে থাকবো, ততদিন তোমার জন্য দোয়া করবো।”
তিনি শেখ মুজিবের জন্য আজীবন দোয়া করেছিলেন কিনা, সেটা আমরা জানি না। কিন্তু, জানি যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বের হবার পর তিনি আবার শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে পড়েন।
১৯৭৩-এর ১৪ এপ্রিল তাঁর নেতৃত্বে ন্যাপ মওলানা ভাসানী, জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ গণমুক্তি ইউনিয়ন, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (লেলিনবাদী), শ্রমিক কৃষক সাম্যবাদী দলের সমন্বয়ে একটি ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামে ৬ দলীয় ঐক্যজোট গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। শেখ মুজিব সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে সর্বপ্রকার সংগ্রাম ও তৎপরতা পরিচালনার দৃঢ় সংকল্পও ব্যক্ত করা হয় এই ঘোষণায়।
এরপর ২৩ এপ্রিল যুক্তফ্রন্ট পল্টন ময়দানে যে জনসভা করে তাতে তিনি মুজিব সরকারকে উৎখাত এবং আওয়ামী লীগকে নির্মূল করার দৃঢ় সকল্প ব্যক্ত করেন। মে মাসের এক জনসভায় তিনি সদর্পকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘অতি শিগগিরই আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হবে এবং ঢাকার বাড়িঘরের উপর মুসলিম বাংলার পতাকা উড়বে।’
অথচ তাঁর অসুস্থতার সময় একবার নয়, দুই দুইবার তাঁকে দেখতে হাসপাতালে এসেছিলেন শেখ মুজিব। তাঁর সবচেয়ে বড় সমালোচক, তাঁর পতনের জন্য সবচেয়ে বেশি আগ্রহী মানুষটাকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ভালবাসা দেখিয়েছিলেন তিনি। মওলানা তাঁর প্রতিদান দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
যে শেখ মুজিব তাঁকে বাঁচানোর জন্য তাঁর চিকিৎসার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করেছেন, প্রয়োজনে তাঁকে বিদেশে পাঠিয়েও সুস্থ করতে চেয়েছেন, সেই মানুষটাকে তাঁর পরিবারের সকল সদস্যসহ হত্যা করার পরে মওলানা তারবার্তা পাঠিয়ে সেই খুনিদের সমর্থন জানিয়েছেন। এই তারবার্তা যদি সত্য নাও হয়, তারপরে তিনি দায়মুক্ত হন না। যে বিপুল উৎসাহ এবং আগ্রহ নিয়ে তিনি দিনের পর দিন সরকারবিরোধী আন্দোলন করেছেন, তাঁর সামান্যতম একটু অংশ তিনি দেখাতে পারেননি এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে গিয়ে।
তিনি এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করে কিছু বলেছেন, এর বিরুদ্ধে একটা মিছিল বা জনসমাবেশ করার চেষ্টা করেছেন, বা নিদেনপক্ষে মুখ খুলে বলেছেন যে এই কাজটা সঠিক হয়নি, এমন কোনো কিছু আমরা পাই না। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরেও তিনি যে সক্রিয় ছিলেন, সেটা তাঁর ফারাক্কা অভিমুখী লং মার্চ সংগঠিত করা থেকেই বোঝা যায়।
শেখ মুজিব মারা যাবার পর থেকে তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন, তার কি একবার মনে হয়নি যে, তিনি অসুস্থ হবার পরে এই মানুষটাই তাঁর অসুস্থতায় কী রকম ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলো, তাঁর বিছানার পাশে বসে তাঁকে সাহস যুগিয়েছিল, আশার বাণী শুনিয়েছিলো। খুব সম্ভবত এগুলোর কোনো কিছুই মনে পড়েনি মওলানার। বিচিত্র কোনো কারণে স্মৃতিভ্রংশ হয়েছিলো তাঁর। মুজিব নামের কেউ একজন ছিলো, সেটাই মনে পড়েনি তাঁর আর।