এক
১৯৭০ সালের ১৯শে জানুয়ারি সন্তোষের এক কৃষক সমাবেশে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন মওলানা ভাসানী। বক্তৃতা দিতে গিয়ে এক বিস্ফোরক তথ্য দেন তিনি। তিনি বলেন, “পাকিস্তানের রাজনীতি সম্পর্কে তিনি সিআইএ-র একটা গোপন রিপোর্ট পেয়েছেন।” এটি জনগণের কাছে প্রকাশ করার জন্য তিনি তাঁর দলের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ তোয়াহাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু, তোয়াহা জনগণের অবগতির জন্য তা সংবাদপত্র প্রকাশ করেননি বলেও তিনি উল্লেখ করেন। দলিলের একটা কপি তিনি ইয়াহিয়াকে পাঠিয়েছেন বলেও জানান। বিষয়টা সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পূর্ণ ধারণা যাতে থাকে, সেটাই ছিলো তাঁকে এই দলিল পাঠানোর মূল কারণ।
কিছুদিন পরে মোহাম্মদ তোয়াহা স্বীকার করেছিলেন যে, মওলানা ভাসানী তাঁকে সিআইএ-র এরকম একটা দলিল দিয়েছিলেন। করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে মোহাম্মদ তোয়াহা বলেন, তাঁর হাতে একটি সিআইএ-র দলিল রয়েছে। এর নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে কোনো ধরনের সন্দেহ থাকা উচিত নয় বলেও তিনি সাংবাদিকদের বলেন। দলিলটিতে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করার একটি চক্রান্তের পরিকল্পনা রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তাঁর নেতা মাওলানা ভাসানী নির্দেশ দিলে তিনি তা সাধারণ্যে প্রকাশ করবেন।
মওলানা ভাসানী এবং তাঁর দলের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় কোনোভাবে তাঁদের হাতে সিআইএ-র একটা দলিল এসেছিলো। যে দলিলে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার কোনো পরিকল্পনার বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছিলো। এখানে কয়েকটা বিষয় আমাদের খেয়াল করতে হবে।
-
- এই পরিকল্পনাটা কে বা কারা করেছিলো?
- সিআইএ-র গোপন দলিল মওলানা ভাসানীর হাতে গেলো কী করে?
- একই সাথে আরেকটা বিষয়ও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হলে ভাসানী কিংবা তোয়াহার সমস্যা কী ছিলো?
যাঁরাই এই ষড়যন্ত্র করুক না কেনো, নিশ্চিতভাবেই পূর্ব বাংলার মানুষের ভালো চেয়েছিলেন তাঁরা। স্বাধীন একটা দেশের স্বপ্ন নিয়ে এগিয়েছিলেন, পাকিস্তানের অধীনস্থ হয়ে থাকতে চাননি। কেনো তারা এই পরিকল্পনাকে ফাঁস করতে চেয়েছিলেন? কেনো এর একটা রিপোর্ট মওলানা ভাসানী ইয়াহিয়ার হাতে পৌঁছে দিয়েছিলেন?
ওই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা সবচেয়ে বড় যে দাবি নিয়ে এগোচ্ছিল, আন্দোলন করছিলো, সেটা হচ্ছে ছয় দফা। তোয়াহা বর্ণিত পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন করার যে চক্রান্ত পরিকল্পনা, সেটা খুব সম্ভবত এই ছয় দফার আন্দোলন। কারণ, ছয় দফাই ছিলো বাঙালির স্বায়ত্ব-শাসনের দাবি।
পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতারা ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে এক জাতীয় সম্মেলন আহবান করেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে শেখ মুজিব এই সম্মেলনে যোগ দেন। ৪ ফেব্রুয়ারি লাহোর পৌঁছান তাঁরা। পরের দিন সাবজেক্ট কমিটির সভায় শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি হিসেবে ‘ছয়দফা’ প্রস্তাব পেশ করেন। এটাকে সম্মেলনের আলোচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান তিনি। কিন্তু সম্মেলনের উদ্যোক্তারা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। পরদিন পশ্চিম পাকিস্তানি পত্রপত্রিকায় ছয়দফার বিবরণ ছাপিয়ে শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদীরূপে চিত্রিত করা হয়। ফলে, শেখ মুজিব ৬ ফেব্রুয়ারির সম্মেলন বর্জন করেন।
১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয়দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। ছয় দফার ধারণা গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে দিতে থাকেন শেখ মুজিব এবং তাঁর সহযোদ্ধারা। পরিস্থিতি সামাল দিতে আইয়ুব সরকার তাঁকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে এবং অবশেষে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিচার শুরু করে।
এই ছয় দফা সত্তরের নির্বাচনেও আরো শক্তিশালীভাবে এসে উপস্থিত হয়। আওয়ামী লীগ সাধারণ নির্বাচনে ছয়দফা কর্মসূচির স্বপক্ষে গণরায়ের জন্য নির্বাচনী প্রচারণা চালায়। এটাকেই খুব সম্ভবত বিচ্ছিন্নতার ষড়যন্ত্র হিসাবে দেখেছিলেন মওলানা ভাসানী এবং তাঁর সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ তোয়াহা। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব যখন ছয় দফা পেশ করেন, তখন থেকেই মওলানা ভাসানী এবং তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীরা একে সিআইএ-র দলিল বলে নিন্দা ও বিরোধিতা করে আসছিলেন। সত্তর সালে ছয় দফার বাইরে নতুন কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠেনি, বরং ছেষট্টির সেই ছয় দফার দাবিই চুড়ান্ত গতি পেয়েছিলো। কাজেই, এটাই যে সিআইএর-র গোপন দলিলে মওলানা পেয়েছিলেন, সেটা বলাই বাহুল্য।
এখন আসা যাক আমাদের দ্বিতীয় প্রশ্নে। সিআইএ-র এই গোপন দলিল মওলানা ভাসানীর হাতে গেলো কী করে? এর উত্তর আমাদের জানা নেই। তাঁর সাথে কী সিআইএ-র গোপন যোগাযোগ ছিলো? কারণ মাঝে মাঝেই তিনি সিআইএ-র দলিল নিয়ে কথা বলতেন। সিআইএ-র দলিল তাঁর হাতে থাকা এবং সেটা প্রচার করার ঘোষণা থেকে তাঁর চিনপন্থী মিত্রদের মাঝেও এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিলো। সাপ্তাহিক গণশক্তি এ ব্যাপারে গুরুতর অভিযোগ তুলে বলেছিলো,
“মাওলানা ভাসানী যে সমস্ত সি.আই.এ সংক্রান্ত গোপন তথ্য সরবরাহ করে যাচ্ছেন তার সূত্র কি? কিভাবে তিনি এইসব খবর জানতে পারছেন? তথ্য সরবরাহ করে আসছেন? মাওলানা সাহেবের উচিত সত্বর এ বিষয়ে সমস্ত বিবরণসহ সংবাদপত্রে একটা পূর্ণ বিবৃতি দিয়ে বিভ্রান্তির অবসান ঘটান। তিনি যদি একাজ না করেন তাহলে জনগণ তাঁর উদ্দেশ্যের সততা ইত্যাদি সম্পর্কে স্বভাবতই নানা প্রশ্ন তুলতে পারে।”
মওলানা ভাসানী নিজেই উল্লেখ করেছেন যে সিআইএ-র সেই দলিল তিনি ইয়াহিয়ার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক ইয়াহিয়ার সাথে তাঁর সখ্যতা কতোটুকু ছিলো?
শুধু ইয়াহিয়া নয়, আইয়ুব খানের সাথেও মওলানার অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিলো। আইয়ুব খান রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার পরে মওলানা ভাসানীকে কারারুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু, আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে কারাগার থেকে বের হয়ে আসার পর, ১৯৬৩ সালে তিনি আইয়ুব সরকারের সরকারী দলের প্রতিনিধি হিসাবে চীন সফর করেন। পিকিং থেকে ফিরে আসার পরে শুধু মওলানা ভাসানী একাই নন, চিনপন্থী কম্যুনিস্টদের একটা বড় অংশ আইয়ুব খানের ভক্ত বলে যায়। আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের মহিমা কীর্তন করা শুরু করে তারা।
মওলানা ভাসানীর এই সামরিক শাসকের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের ফলাফল কী হতে পারে, সে সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মফিদুল লেখেন,
“১৯৬৩ সালে কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর জেনারেল আইউব আয়োজিত চীন সফরের পর থেকেই মাওলানা ভাসানীর পদস্খলন ঘটতে থাকে। চীনা রাষ্ট্র-নেতাদের আত্মস্বার্থ-প্রণোদিত নীতির কাছে মাওলানা ভাসানীর আত্মসমর্পণ এদেশের বাম রাজনীতির জন্য বিরাট দুর্ভাগ্যের সূচনা করে। রাজনৈতিক বিভ্রান্তি থেকে তিনি যে পথে পা দিয়েছিলেন তা শুধু আইউবের শাসনের সহায়ক ভূমিকা পালন করে নি, মাওলানা তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে সামরিক শাসকচক্রের যে সংযোগ গড়ে ওঠে তা পরবর্তী সময়েও বহু দুর্ঘটনার কারণ হয়েছিল।”
মওলানা ভাসানী শুধু আইউবের শাসনের সহায়ক ভূমিকাই পালন করেননি, আইউব পরবর্তী সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার ক্ষেত্রেও সেই সহায়ক ভূমিকাকে তিনি চলমান রাখতে চেয়েছিলেন। এ কারণে, বাঙালির বিচ্ছিন্নতাবাদের গোপন দলিলও ইয়াহিয়ার কাছে পৌঁছে দিতে তিনি দ্বিধা করেননি। জনগণের কাছে অবশ্য তিনি সেই দলিল হস্তান্তর করেননি, বরং তাঁর সাধারণ সম্পাদককে অভিযুক্ত করেছেন এই দলিল প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা দেখানোতে।
মোহাম্মদ তোয়াহা করাচির সংবাদ সম্মেলনে স্বীকার করেছিলেন যে সিআইএ-র দলিলের এক কপি তাঁর হাতে রয়েছে। ১৯৭০ সালের মে মাসে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ করার সময় যে পত্র তিনি লেখেন, সেখানে তাঁর কাছে কোনো দলিল ছিলো না বলে তিনি উল্লেখ করেন। তাঁর পদত্যাগপত্র থেকেই সেই বক্তব্যটা তুলে দিচ্ছি আমি।
“মাওলানা ভাসানী ও ন্যাপ নেতৃত্বের একটি অংশ সি. আই. এ-র দলিল নামে কথিত একটি দলিল লইয়া আমার বিরুদ্ধে তীব্র মিথ্যা কুৎসা প্রচার করিতেছেন।
যাহার প্রচার করিতেছেন, তাহারা খুব ভালোভাবেই জানেন যে, ঐ দলিল আমার নিকট কোন দিনই ছিল না, এখনও নাই। কিন্তু যখন সন্তোষে মাওলানা সাহেব আমার উপরে দোষ আরোপ করিতেছিলেন, ঠিক তখন সন্তোষেই ঐ দলিলের কয়েকশত সাইক্লো কপি ছিলো, মাওলানাকে তাহা জানানোও হয়, মাওলানা তাহা সেখানে বিলি করেন নাই।”
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
মোহাম্মদ তোয়াহার ভাষায় কয়েকশত কপি না থাকলেও, মওলানার কাছে যে দলিলের কপি ছিলো সেটা মওলানার নিজের বক্তব্যেই জানা যায়। যার একটা কপি তিনি জেনারেক ইয়াহিয়াকে দিয়েছিলেন। কিন্তু, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তিনি জনগণকে সেই কপি দেখাতে চাননি। তার বদলে তাঁর সাধারণ সম্পাদককে বলির পাঠা বানিয়েছিলেন। তোয়াহা জনগণকে এই দলিল দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে তিনি অভিযোগ করেছেন, কিন্তু কথা হচ্ছে, তিনি নিজেও তো সেটা জনগণকে দেখাতে পারতেন। এমন না যে এর কপি শুধু মোহাম্মদ তোয়াহার কাছেই ছিলো। এই দলিল, আদৌ তার অস্তিত্ব ছিলো কিনা, তা আর কখনোই জানা যায়নি। কারণ, মওলানা এই দলিল পরবর্তীতে আর কখনো দেখাননি কিংবা এর কথা আর বলেননি।
দুই
কোন মানুষই ভুলের উর্ধ্বে নন, যেমন ভাসানী। কিন্তু, তাই বলে তাকে আইয়ুব ইয়াহিয়ার সহচর বানিয়ে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড় করানোটা কি ঠিক?
প্রথমেই যে অংশটা আমি পরিষ্কার করতে চাই, সেটা হচ্ছে, মওলানা ভাসানীকে আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড় করাই নাই। আমি ইতিহাস পাঠ করি নৈর্ব্যক্তিক মনন নিয়ে, কারো প্রতি আমার অন্ধ কোনো ভক্তিও নেই, আবার কারো প্রতি অন্ধ বিদ্বেষও নেই। মওলানার বিষয়েও আমার অবস্থান সেটাই। তাঁর প্রতি ব্যক্তিগত কোনো ক্ষোভ নেই আমার।
উনি ১৯৫৭ সালে প্রথম পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ইঙ্গিত দিয়েছেন। এটা ইতিহাসের অংশ। সেই তিনিই আবার পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা নিয়ে নানা ধরনের স্ববিরোধী কথাবার্তা বলেছেন পুরো ষাটের দশক ধরে এবং সত্তর-একাত্তর সালে। আমি এ নিয়ে একটা আলাদা লেখা লিখবো, কাজেই এখানে বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না।
শুধু মূল অংশটা বলে যাচ্ছি, মওলানা ভাসানীকে ভুলক্রমেও আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষের লোক বলে মনে করি না, যদিও তাঁর দলের অনেক বাঘা বাঘা নেতাই একাত্তরে পাকিস্তানের দালালি করেছে। উদাহরণ হিসাবে মশিউর রহমান যাদু মিয়ার কথা বলা যায়। আবার অনেকেই মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছেন, যেমন অলি আহাদ। ভাসানী নিজেও বাংলাদেশের পক্ষ অবলম্বন করেই ভারতে গিয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে থেকে গিয়ে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সহায়কের ভূমিকাতে তিনি যাননি। এরকম ভূমিকার একজন মানুষকে স্বাধীনতাবিরোধী বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
ভাসানীকে আইয়ুব, ইয়াহিয়ার সহচর আমি বানাইনি। ষাটের দশকে এদের সাথে সখ্যতার কারণে তাঁর দলের লোকজন বা তাঁর রাজনৈতিক মিত্ররাই তাঁর ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কাজেই, এই সময়ে এসে আমি ভাসানীর পুনর্মূল্যায়ন করছি, ঘটনাটা সে রকম না। সামরিক জান্তাদের সাথে তাঁর দহরম-মহরমের বিষয়টা সেই সময়েই নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের মাধ্যমেই। আমরা এই তথ্যগুলোকে জানি না, বা আমাদের মস্তিষ্কে আমরা যেরকমভাবে কোনো কিছুকে দেখতে চাই সেই ধরনের একপেশে তথ্য জানতে পছন্দ করে বলে আমরা এগুলোকে এড়িয়ে গিয়েছি সযত্নে।
১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসের ৭ তারিখে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার মির্জা দেশে মার্শাল ল জারি করেন। তিনি যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং আইয়ুব খানকে সুপ্রিম কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ দেন। ইস্কান্দার মির্জার দুর্ভাগ্য, এর মাত্র তিন সপ্তাহ পরে অক্টোবর মাসের ২৭ তারিখে আইয়ুব খান তাঁকেই উৎখাত করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নেন।
আরো অনেকের মতো মওলানা ভাসানীকেও জেলে পুরে দেয় আইয়ুব খান। দীর্ঘ চার বছর দশ মাস জেলে থাকেন মওলানা ভাসানী। ১৯৬৩ সালে জেলের মধ্যেই অনশন ধর্মঘটে যান তিনি। এর পরই সরকার তাঁকে মুক্ত করে দেয়। তিনি জেলে থাকা অবস্থাতেই আইয়ুব খানের শিক্ষা নীতির প্রতিবাদে ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা বিশাল এক আন্দোলন করে ফেলেছে। শুধু ছাত্র না, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে আইয়ুব খান মূর্তিমান এক স্বৈরশাসক ছাড়া আর কিছুই নয়।
এই পরিবেশ পরিস্থিতে মওলানা ভাসানী এক অদ্ভুত কাজ করেন। তিনি আইয়ুব খানের প্রতিনিধি হিসাবে সরকারী সফরে চীনে যান। আইয়ুব খান তখন বৈদেশিক নীতিতে চীনের দিকে ঝোঁকার পরিকল্পনা করছিলেন। সেই ব্যবস্থা করার জন্যই তিনি মওলানাকে চীনে পাঠিয়েছিলেন। মওলানা সেখানে গিয়ে মাও সে তুং এবং চৌ-এন-লাই এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। পিকিং থেকে ফিরে আসার পরে শুধু মওলানা ভাসানী একাই নন, চিনপন্থী কম্যুনিস্টদের একটা বড় অংশ আইয়ুব খানের ভক্ত বনে যায়। আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের মহিমা কীর্তন করা শুরু করে তারা।
তারিক আলী চীনপন্থী বাম ছাত্রনেতা ছিলেন। তাঁর একটা বই আছে। বইটার নাম “Pakistan, military rule of peoples power”। বইটা প্রকাশিত হয়েছে দিল্লি থেকে ১৯৭০ সালে। এই বইতে তারিক আলী পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সাথে মাওলানা ভাসানীর নিবিড় সখ্যের কারণ অনুসন্ধান করে তার পটভূমি আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি তাঁর বইতে লেখেন, ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইউব খান মাওলানা ভাসানীকে পাকিস্তানের সরকারী প্রতিনিধি করে চীনে পাঠাতে চাইলে মাওলানা রাজি হন। সেখানে চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুং এর সাথে তাঁর যে গোপন সলাপরামর্শ হয় তার একটা বিবরণ তিনি মাওলানার কাছ থেকেই গ্রহণ করেছিলেন টেপ রেকর্ডারে।”
তারিক আলী মওলানাকে প্রশ্ন করেছিলেন, “When you went to China what did Mao discuss with you when you met him?” এর উত্তরে মওলানা বলেছিলেন,
“মাও সে তুং আমাকে বলেন, আপনি যদি সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন তাতে রাশিয়া, আমেরিকা এবং ভারতের হাতই শক্তিশালী হবে। আপনার কাজে হস্তক্ষেপ করা আমাদের নীতি বিরুদ্ধ, তথাপি আমরা আপনাকে সাবধানে এবং ধীর গতিতে আন্দোলনে অগ্রসর হতে অনুরোধ করবো। আপনার সরকারের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব আরো গাঢ় করার সুযোগ দিন।”
আগেই বলেছি, চীন থেকে ফিরে আসার পরেই মওলানা এবং তাঁর অনুসারীরা আইয়ুব খানের ভক্ত হয়ে যায়। সাপ্তাহিক ‘জনতা’ ছিলো ন্যাপের মুখপত্র। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন আনোয়ার জাহিদ। তিনি তখন ভাসানীর ব্যক্তিগত সচিব। আনোয়ার জাহিদ নিজেও আশির দশকে সামরিক শাসক এরশাদের দালালি এবং গোলামি করেছেন। তাঁকে সবাই ঝাঁড়ুদার মন্ত্রী হিসাবেই চিনতো। কারণ, তিনি একবার প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, এরশাদ যদি বলে, তবে তিনি রাস্তা ঝাঁড়ু দিতেও আপত্তি করবেন না। এই আনোয়ার জাহিদ ১৯৬৫ সালে সাপ্তাহিক জনতায় লেখেন, “There were only two Imperialist voices in Pakistan – Ayub and Vashani.”
আনোয়ার জাহিদের বক্তব্য পরিষ্কার, তিনি তাঁর নেতা এবং আইয়ুব খানকে একই কাতারে দেখেছেন।
মওলানা ভাসানীর এই সামরিক শাসকের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের ফলাফল কী হতে পারে, সে সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মফিদুল হক লেখেন,
“১৯৬৩ সালে কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর জেনারেল আইউব আয়োজিত চীন সফরের পর থেকেই মাওলানা ভাসানীর পদস্খলন ঘটতে থাকে। চীনা রাষ্ট্র-নেতাদের আত্মস্বার্থ-প্রণোদিত নীতির কাছে মাওলানা ভাসানীর আত্মসমর্পণ এদেশের বাম রাজনীতির জন্য বিরাট দুর্ভাগ্যের সূচনা করে। রাজনৈতিক বিভ্রান্তি থেকে তিনি যে পথে পা দিয়েছিলেন তা শুধু আইউবের শাসনের সহায়ক ভূমিকা পালন করে নি, মাওলানা তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে সামরিক শাসকচক্রের যে সংযোগ গড়ে ওঠে তা পরবর্তী সময়েও বহু দুর্ঘটনার কারণ হয়েছিল।
ভাসানী অনুগত এককালের বহু ডাকসাইটে নেতার চরম নীতি-বিবর্জিতভাবে সামরিক শক্তির অঙ্কশায়িনী হওয়ার শেকড় এখানেই নিহিত। চীনের রাজনীতির অন্ধ আনুগত্য মাওলানা ভাসানীকে করে তুলেছিল আইউব অনুগত এবং জন বিচ্ছিন্ন এই রাজনীতির পাশাপাশি তাঁর দলের সঙ্গে পাকিস্তানের শাসক সশস্ত্রবাহিনীর সংযোগ দলের বহু সদস্যের নীতি ও আদর্শের বিনষ্টি ঘটিয়েছিল।”
মওলানা ভাসানী শুধু আইউবের শাসনের সহায়ক ভূমিকাই পালন করেননি, আইউব পরবর্তী সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার ক্ষেত্রেও সেই সহায়ক ভূমিকাকে তিনি চলমান রাখতে চেয়েছিলেন। এ কারণে, বাঙালির বিচ্ছিন্নতাবাদের গোপন সিআইএ দলিলও ইয়াহিয়ার কাছে পৌঁছে দিতে তিনি দ্বিধা করেননি।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সাথে মওলানা ভাসানীর যোগসাজশ আইয়ুব পরবর্তী সময়েও ছিলো বলে তাঁর নিজের লোকেরাই সন্দেহ করতেন। মওলানা ভাসানীর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহচর ছিলেন মাহবুব উল্লাহ। ইনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক। এক সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও ছিলেন। তিনি ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লেখেন,
“সম্বর্ধনা শেষে মাওলানা ভাসানী সাইদুল হাসানের বাসায় উঠলেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মাহবুব, ‘মার্শাল ল’ হলে তোমরা কি করবা?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এরকম কিছু হবে নাকি? মাওলানা মৌন থাকলেন, কথা ছিল পরদিন তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দেবেন। কিন্তু তা না করে রাতের বেলা সন্তোষ চলে গেলেন।
মাওলানা এমনিভাবেই তাঁর রাজনৈতিক পদক্ষেপকে রহস্যাবৃত করে রাখতেন। এখন প্রশ্ন, মাওলানা কি সামরিক আইন জারি হবার খবর জানতেন?
খুব সম্ভবত পশ্চিম পাকিস্তান সফরকালেই তিনি তা জানতে পেরেছিলেন। হয়তো এ ব্যাপারে নিয়ে সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর আলাপও হয়ে থাকতে পারে। সে ইতিহাস রহস্যাবৃত।”
মাহবুব উল্লাহ সাহেব সামরিক বাহিনীর সাথে মওলানার সম্পর্কের বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন মাত্র, কিন্তু মওলানার নিজের দলের লোক হাজি দানেশ মওলানার সাথে সামরিক শাসকদের যোগ ছিলো বলে অভিযোগ করেন। হাজি দানেশ ছিলেন ন্যাপের সহ-সভাপতি। মওলানার সাথে তাঁর কোন্দল এমন পর্যায়ে যায় যে তিনি সহ একটা বিরাট অংশ ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে ন্যাপ থেকে বের হয়ে যান। ১৯৭১ সালের ৮ই জানুয়ারি হাজি দানেশ এক খোলা চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে তিনি বলেন,
“আপনি বিশ্বাস করতেন যে ইস্কান্দর মির্জা ও আইউব খান দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করবে। আইউবের বিরুদ্ধে বামপন্থী শক্তিগুলোকে সংগঠিত করার ব্যাপারে আপনার অনীহা এটাই প্রমাণ করে যে, শোষক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে আপনার যোগ ছিল। আমি এটা বিশ্বাস করতে পারিনা যে, আপনার ও ন্যাপের এ ধরনের নীতির মাধ্যমে লাখ লাখ শোষিত মানুষের মুক্তি আসবে।”
১৯৭০ সালে বাঙালি যখন নিজস্ব অধিকার আদায়ের জন্য, পাকিস্তানের শাসন-শোষণ থেকে বের হয়ে আসার জন্য তীব্র আন্দোলন করছে, সেই সময় হঠাৎ করেই একদিন মওলানা ঘোষণা দিলেন যে, এখন থেকে তিনি আর কৃষক সমাবেশ করবেন না। তার বদলে নতুন এক সংগ্রাম করার বাসনা তিনি প্রকাশ করলেন। সেই বাসনাটা হচ্ছে তিনি গ্রামে গ্রামে চোর ডাকাত ধরবেন। যেখানে তখন সমস্ত রাজনৈতিক শক্তি একীভূত হচ্ছে বাঙালির মুক্তির জন্য, সেখানে তিনি এই হাস্যকর সংগ্রামে নিজেকে জড়ানোর কথা ঘোষণা দিলেন। এই ধরনের কর্মসূচী যে চলমান মূল রাজনৈতিক স্রোতধারা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়া, সেটা বোঝার জন্য খুব বেশি রাজনৈতিক জ্ঞান থাকার প্রয়োজন নেই।
তবে, এই কাহিনীর এখানেই শেষ নয়। তিনি প্রকাশ্যে আশাবাদ ব্যক্ত করলেন যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাঁর চোর ধরার কর্মসূচীর বাস্তব রূপ দেয়ার ব্যাপারে তাঁর জুন সংগ্রামে শরিক না হলেও পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রধান সাহেবজাদা ইয়াকুব খান একজন পরহেজগার মুসলমান হিসাবে তাঁকে নিশ্চয়ই সমর্থন করবেন।
সত্তর সালের সেই রাজনৈতিক উত্তাল সময়ে মওলানার এই চোর ধরার মতো হাস্যকর কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করেন বদরুদ্দীন উমর। সাপ্তাহিক গণশক্তির ১০ই মে সংখ্যায় তিনি লেখেন,
“মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আজ একদল লোক সামন্ত বুর্জোয়া শোষকদের হাতকে জোরদার করার জন্যে প্রদেশব্যাপী চোর ঘুষখোর ধরে তাদের শাস্তি দেওয়ার একটা কর্মসূচীর মধ্যে রাজনৈতিক কর্মীদের টেনে নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা করেছে। তারা আজ জনগণকে বোঝাতে চাইছে যে, চোর ঘুষখোর ধরার এই পথেই তারা কৃষক শ্রমিকদের মুক্তি আনবে। তাদের জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করবে।
এদেশের সামন্ত বুর্জোয়া শোষকদের সাথে পরোক্ষভাবে হাত মিলিয়ে মাওলানা ভাসানী চোর ঘুষখোর ধরার যে পরিকল্পনা পেশ করেছেন তার স্বরূপ সম্পর্কে আজ গণতান্ত্রিক শক্তির সচেতন হতে হবে।”
সামরিক শাসকদের প্রতি তাঁর আস্থা এবং ভালবাসা বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরেও মওলানা ভাসানী অব্যহত রেখেছেন।
রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে শেখ মুজিবকে সরিয়ে দেবার এই অবসেশনের কারণেই হয়তো শেখ মুজিব সপরিবারে এক নৃশংস এবং নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেও মওলানার মধ্যে কোনো শোক কিংবা অনুতাপ দেখা যায় না। তার বদলে সন্তোষ থেকে তিনি সামরিক শক্তি সমর্থিত খন্দকার মোশতাককে টেলিগ্রাম পাঠান এই হত্যাকাণ্ডকে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করে। অস্ত্র হাতে ক্ষমতা দখলকারী খুনিদের এবং এদের মূল হোতা খন্দকার মোশতাকের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবার জন্য দোয়াও করেন তিনি।