এক
দেশ স্বাধীন হবার পরে শেখ মুজিব এবং তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় সমালোচক হিসাবে আবির্ভূত হন মওলানা ভাসানী। সরকারের সমালোচনা শুধু না, এই সরকারের পতনের জন্যও তিনি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের ২৪ আগস্ট দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে মওলানা ভাসানী বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রতিবিপ্লব আসন্ন।’ কোন রাজনৈতিক শক্তি এই প্রতিবিপ্লবের নেতৃত্ব দেবে, সে সম্পর্কে তিনি অবশ্য খোলাখুলিভাবে কিছু বলেননি।
১৯৭২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর পল্টনের এক জনসভায় ভাসানী বলেন, ‘জনগণের ইচ্ছায় সরকার পরিচালিত হবে। জনগণকে বাদ দিয়ে সরকার চলতে পারে না।’ তিনি দাবি করেন, ‘সর্বদলীয় সরকার চাই, অন্ন, বস্ত্র দাও, না হলে গদি ছাড়।’ ভাসানী আরো বলেন, ‘জনগণের দুঃখ-দৈন্য দূর করার ব্যাপারে মুজিব সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি গণপরিষদ ও মন্ত্রীসভা ভেঙে দিয়ে জাতীয় কনভেনশন ডেকে জাতীয় সরকার গঠন করার আহ্বান জানান।
১৯৭৩ সালের ১১ জানুয়ারিতে মুজিব সরকারকে উৎখাত করার জন্য এক ডজনেরও বেশি দল-উপদল গ্রুপ নিয়ে একটি ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করা হয়। এই কমিটি ২১ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে যে জনসভা করে, তাতে ভাসানী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশকে আমি ভিয়েতনামে পরিণত করবো।’
জাসদের সাধারণ সম্পাদক আসম আবদুর রব ১৯৭৩ সালে গোপনে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে দেখা করে মুজিব সরকার বিরোধী আন্দোলনে তাকে নেতৃত্বদানের অনুরোধ করেন। ভাসানী তখন তাকে বলেছিলেন, ‘মুজিব বেইমান, মীরজাফর, তাঁকে উৎখাত করতে হবে।’
শেখ মুজিবকে উৎখাত করাটা এক ধরনের অবসেশনে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো মওলানার জন্য। ফলে, নিয়মতান্ত্রিক কিংবা অনিয়মতান্ত্রিক যে কোনো উপায়েই শেখ মুজিবের পতনের জন্য তিনি মরিয়া ছিলেন। এ কাজের জন্য বাম, ডান, মধ্যপন্থী, চরমপন্থী এমন কোনো দল নেই, যাদের সাথে গাঁটছড়া বাধেননি তিনি।
শুধু তাই নয়, সামরিক ব্যক্তিদেরও তিনি অনুরোধ করেছিলেন মুজিবের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসার জন্য। একজন গণতান্ত্রিক নেতার কতোখানি পচন হলে এমন একটা অনুরোধ সামরিক ব্যক্তিদের করতে পারে সেটা বলাই বাহুল্য। সামরিক বাহিনী যখন ক্ষমতা নিতে যায়, তখন প্রাণহানি এবং রক্তপাতের বড় ধরনের একটা ঝুঁকি থাকে।
পাকিস্তানের দীর্ঘ সময় রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার কারণে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পরিণতির বিষয়ে তাঁর সুস্পষ্ট ধারণার থাকার কথা। সেই ধারণা থাকার পরেও যখন তিনি এরকম অনুরোধ করতে পারেন, তখন মুজিবের বিরুদ্ধে তাঁর আক্রোশের পরিমাণটাও অনুমান করা যায়।
মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমান ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ রাইফেলসের মহাপরিচালক ছিলেন। তিনি ‘কাছে থেকে দেখা ১৯৭৩-১৯৭৫’ নামে একটা বই লিখেছেন। বইটা প্রকাশিত হয়েছে প্রথমা প্রকাশনী থেকে।
এই বইতে মেজর খলিলুর রহমান স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, মুজিবকে সরিয়ে সামরিক বাহিনীকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার জন্য ভাসানী তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন,
সেবার গাড়িতে ছিলাম আমি ও আমার দ্বিতীয় ছেলে – যার বয়স তখন ১২ বছর। ছেলে বলল এবং আমারও ইচ্ছে হলো টাঙ্গাইল হয়ে যাওয়ার সময় মওলানা ভাসানীকে একটু সালাম করে যাই। তাঁকে পেলাম পুরনো সন্তোষের জমিদারবাড়ি, বর্তমানে মওলানার স্থাপিত ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন তার বাঁশের তৈরি বাড়ির কাছেই এক দোকানে। দোকানে খাওয়ার মতো কিছু ছোট ছোট চম্পা কলা ছিল। তাই দিয়ে তিনি আমাদের বাপ-বেটাকে আপ্যায়ন করলেন। তাঁর অভ্যাসমতো তিনি একাই কথা বলতে থাকলেন। বেশির ভাগই আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে। আমি কথা বলিনি, দরকারও পড়েনি, আর দরকার পড়লেও ফুসরত পাওয়া যেত না। কারণ, তিনি কথা বলতেন অনর্গল। অবশেষে মওলানা কথা প্রসঙ্গে এলেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে। সেখানেই ঘটল বিপদ। অনেকটা হঠাৎই বললেন, ‘দেখো খলিল, তুমরা দ্যাশটারে লইয়া লও। মুজিব চালাইতে পারব না। বুঝলা না, মুজিব হইল আমার মতো আন্দোলনকারী, প্রশাসনকারী নয়। বুঝলা না। মুজিব ভালো ছেলে, কিন্তু সে পারব না।’
রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে শেখ মুজিবকে সরিয়ে দেবার এই অবসেশনের কারণেই হয়তো শেখ মুজিব সপরিবারে এক নৃশংস এবং নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেও মওলানার মধ্যে কোনো শোক কিংবা অনুতাপ দেখা যায় না। তার বদলে সন্তোষ থেকে তিনি খন্দকার মোশতাককে টেলিগ্রাম পাঠান এই হত্যাকাণ্ডকে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করে। অস্ত্র হাতে ক্ষমতা দখলকারী খুনিদের এবং এদের মূল হোতা খন্দকার মোশতাকের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবার জন্য দোয়াও করেন তিনি।
মওলানা যখন সামরিক পোশাক পরা একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাকে সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য উস্কানি দিচ্ছিলেন, তখন তাঁর নিরাপত্তায় নিয়োজিত একজন পুলিশের উপপরিদর্শক পাশেই উপস্থিত ছিলেন। সেই পুলিশ অফিসারের কর্তব্য ছিলো এটা অফিসে রিপোর্ট করা। মেজর জেনারেল খলিলেরও উচিত ছিলো তাঁকে সাথে সাথে গ্রেফতার করা। কিন্তু, তাঁরা দুজনেই সেই কাজ করেননি। তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন বা সঠিক দায়িত্ব পালন করেননি। কেনো তাঁরা এই কাজটা করেননি, সেটাই শোনা যাক মেজর জেনারেল খলিলের মুখ থেকে।
আমার পাশেই বসা উর্দি পরা পুলিশের উপপরিদর্শক। মওলানার নিরাপত্তারক্ষী। তিনিও শুনছিলেন সব কথা। তাঁর দায়িত্ব ছিল কথাগুলোকে প্রতিবেদন আকারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের গোচরে আনা। আর আমার কর্তব্য ছিল তাঁকে এই বিদ্রোহাত্মক কথাগুলো বলার জন্য মওলানাকে বন্দী করতে আদেশ দেওয়া। কিন্তু আমার কাছে তখন এই কর্তব্য পালন সম্ভবপর মনে হয়নি। আর আমার মনে হয়, পুলিশ অফিসারটিও তাঁর কর্তব্য পালন করার কথা চিন্তা করেননি। কারণ, অনুরূপ কথা হয়তো তিনি আগেও বহুবার শুনেছেন।
মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান এবং অজ্ঞাত সেই পুলিশের উপপরিদর্শক যে কারণে মওলানার এই বিদ্রোহাত্মক কথাকে গুরুত্ব দেননি, সেটা জানার পরে মওলানার ব্যক্তিত্ব নিয়েই সংশয়ে পড়া লাগে। এতো বড় একজন রাজনীতিবিদের প্রফেশনাল আচরণ বলতে যা বোঝায় তার কিছুই আসলে ছিলো না। কোন কথা কোথায় বলা উচিত, কোনটা বলা উচিত না, কোন কথার গুরুত্ব কী, তার পরিণাম কী হতে পারে, এগুলো সম্পর্কে খুব বেশি সম্যক ধারণা তাঁর ছিলো বলে মনে হয় না। থাকলে, এই সব ছেলেমানুষি ধরনের বিপদজনক আবদার তিনি রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের কাছে করতেন না।
আমাদের জাতিগত সমস্যা হচ্ছে, এই সব গ্রাম্য আচরণের খ্যাত মানুষগুলোকে প্রচার-প্রচারণা করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বিশাল বানিয়ে মানুষের সামনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যার কারণে, যাঁর সামান্যতম সাধারণ এবং স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞানও নেই, তাঁকেও মহান নেতা বলে শ্রদ্ধা করা লাগে, দেওয়াল লিখন লেখা হয় এই বলে যে বাঙালি জাতির জাতির পিতা হচ্ছে মওলানা ভাসানী।
দুই
৫০ বছর ধরে বহুমাত্রিক ভাবে গন মানুষ এর রাজনীতি করা একজনকে শুধু কয়েক বছরের রাজনীতি দিয়ে মূল্যায়ন কতটুকু যুক্তিযুক্ত?
এটা একটা অত্যন্ত শক্তিশালী যুক্তি। কোনো একটা নির্দিষ্ট ঘটনা কিংবা নির্দিষ্ট সময়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকলে একজন ব্যক্তির সামগ্রিক মূল্যায়ন করাটা বেশ কঠিন কাজই হয়ে পড়ে। আর সেই মূল্যায়নও হয় অনেকটা অন্ধের হাতির দেখার মতো। কখনো হাতিকে মনে হয় থামের মতো, কখনো বা মনে হয় সাপের মতো।
ব্যক্তির সামগ্রিক মূল্যায়নে কোনো একটা নির্দিষ্ট ঘটনা কিংবা সময়কালও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়তে পারে, কিংবা সেই ঘটনা বা সময়কালের ঘটনাপ্রবাহ দিয়ে ব্যক্তির পূর্বের সমস্ত অর্জনকে বাতিলও করে দেওয়া যেতে পারে। নির্ভর করছে সেই ঘটনা কিংবা সময়কালের গুরুত্বের উপর।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
ধরুন, একজন ব্যক্তি সারাজীবন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, কিন্তু একাত্তরে এসে পাকিস্তানের দালাল হয়ে গেলো সেই লোক। তখন, তাকে আপনি কি বাংলাদেশ আন্দোলনের যোদ্ধা হিসাবে দেখবেন? দেখবেন না নিশ্চয়। গোলাম আযম বায়ান্নতে ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলো।
কিন্তু তারপরেও আমরা তাকে সেই সম্মান দেই না। কারণ হচ্ছে, সে নিজেই একাত্তরে গিয়ে বলেছে ভাষা আন্দোলন করাটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো। এরকম আরো অনেক উদাহরণ দেখাতে পারি। খন্দকার মোশতাকের কথাই ধরুন। একজন একনিষ্ঠ আওয়ামী লীগার ছিলো সে। কিন্তু, পঁচাত্তরের কলঙ্কজনক অধ্যায়ের কারণে আওয়ামী লীগাররা তাকে খারিজ করে দিয়েছে।
আজকে আমরা অলি আহাদের গল্প শুনবো। এই ভদ্রলোক একজন ডাকসাইটে রাজনীতিবিদ ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা, মওলানা ভাসানী এবং শেখ মুজিবের সাথে রাজনীতি করেছেন তিনি। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন তিনি। ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। যুবলীগেরও প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছেন তিনি।
বায়ান্ন সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি। ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে যে সমস্ত ছাত্ররা বের হয়ে এসে বন্দিত্ব গ্রহণ করে, তিনি তাঁদের মধ্যে একজন। তাঁদের মধ্যে একজন বললেও ভুল হবে। তিনিই প্রথম বন্দি হন এবং কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। ভাষা আন্দোলনের কারণে শুধু জেলই খাটেন না তিনি, তাঁর ছাত্রজীবনটাও ধ্বংস হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই অপরাধে তাঁর ছাত্রত্ব কেড়ে নেয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার বছরের জন্য বহিষ্কার করে তাঁকে।
১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানী ন্যাপ প্রতিষ্ঠা করলে, সেখানে যোগ দেন তিনি। না দিয়ে তাঁর উপায়ও ছিলো না। এর মধ্যে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন তিনি। সেই সময় থেকে ভাসানীর ভাবশিষ্য হিসাবে থেকে যান তিনি।
ভাসানীর অনেক ভাবশিষ্যই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শিবিরে যোগ দিয়েছিলো, অলি আহাদ ব্যতিক্রম। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করেন। তাঁর এই ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০০৪ সালে তাঁকে স্বাধীনতা পদকেও ভূষিত করেছে।
দেশ স্বাধীন হবার পরে শুধু মওলানা ভাসানী একা নন, তাঁর সাথে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের প্রায় সকলেই শেখ মুজিব এবং তাঁর সরকারের তীব্র বিরোধিতায় নামেন। এটাতে আমার আসলে কোনো আপত্তি নেই। রাজনীতিতে পক্ষ দল, বিপক্ষ দল, দুটোই থাকতে হয়। এই দুইয়ের কারণে একটা ভারসাম্য অবস্থা বজায় থাকে।
শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে, সরকারী ক্ষমতায় থাকা দলটার স্বৈরাচারে পরিণত হবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের আজকের আওয়ামী লীগ এর জ্বলন্ত প্রমাণ। আমার আপত্তির জায়গাটা ভিন্ন। শেখ মুজিবের দুঃশাসনের প্রতিবাদ করে তাঁরা আন্দোলন সংগ্রাম করতে পারতেন। সেটা করা না গেলে বিপ্লব কিংবা বিদ্রোহেরও প্রস্তুতি নিতে পারতেন।
কিন্তু একজন মানুষ একদল ঘাতকের হাতে নিজে তো মারা গেছেনই, তাঁর বংশের কাউকেই বাঁচিয়ে রাখা হয়নি। এমন একটা নৃশংস ঘটনায় উল্লাস করতে পারে ইতর শ্রেণীর প্রাণীরা, দীর্ঘদিনের রাজনীতি করা ঘাগু লোকেরা না। শেখ মুজিবের সাথে তাঁদের আদর্শের দ্বন্দ্ব ছিলো, জমিজমা দখলকেন্দ্রিক কোনো ব্যক্তিগত কাজিয়া-ফ্যাসাদ ছিলো না। এই হত্যাকাণ্ডের পরে তাঁদের উচিত ছিলো এর তীব্র প্রতিবাদ করা, খুনিদের প্রতিহত করা। কিন্তু তার বদলে এরা সেই হত্যাকাণ্ডে উল্লসিত হয়েছেন, উদ্বাহু নৃত্য করেছেন, খুনিদের সর্বাত্মক সমর্থন এবং সহযোগিতা দিয়েছেন। সেই খুনকে বৈধতা দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।
অলি আহাদকে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা চিনবে না। তাদের জন্য একটা তথ্য দিচ্ছি। সংরক্ষিত কোটায় এই মুহূর্তে বিএনপির যে সাংসদ সংসদে রয়েছেন, সেই রুমিন ফারহানা হচ্ছেন অলি আহাদের মেয়ে। রুমিন অবশ্য নিজেও তাঁর মুক্তিযোদ্ধা বাবার পরিচয় ভুলে গিয়েছেন। তাঁর কাছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এবং ইসলামি ছাত্রশিবির এখন একই মায়ের পেটের দুই ভাই।
অলি আহাদ ১৯৮২ সালে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে একটা বই লেখেন। বইটার নাম হচ্ছে, “জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫↑”। এই বইটার চতুর্থ সংস্করণকে তিনি অনেকের নামে উৎসর্গ করেছেন। প্রথম তিনটা নাম হচ্ছে, কায়েদ-ই-আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মওলানা মওদুদী এবং দেওবন্দের মওলানা হোসেন আহমদ মাদানী। জিন্নাহকে তিনি সারাবিশ্বের অন্যতম ক্ষণজন্মা পুরুষ হিসাবে উল্লেখ করেছেন।
এই বইটার ব্যাপ্তিকাল যেহেতু ৪৫ থেকে ৭৫, স্বাভাবিকভাবেই এখানে পঁচাত্তরের ঘটনা প্রবাহ এসেছে। আমি নিজস্ব ভাষা এখানে আর দিচ্ছি না। বইটা থেকে সরাসরি তুলে দিচ্ছি। ভাগ্য ভালো অলি আহাদের বক্তব্য তাঁর নিজের লেখা বইতেই আছে, পত্রিকায় থাকলে এটাকে অস্বীকার করার জন্য কেউ না কেউ ছুটে আসতো।
তথাকথিত বড় মানুষদের মল-মূত্র সাফসুতরো করার জন্য স্বেচ্ছাশ্রমে কিছু মানুষ থাকে। এদের কাজ হচ্ছে দ্রুত এসে মলমূত্রকে সরিয়ে ফেলা নতুবা বলা যে আমার নেতার পুরীষ এটা হতেই পারে না। তিনি গোলাপ গন্ধের পুরীষ নির্গমন করতেন, এমন দুর্গন্ধময় পুরীষ আমার নেতার হতেই পারে না। অলি আহাদের দুর্ভাগ্য, তিনি এই বিশেষ ট্রিটমেন্টটা আজকে পাবেন না। পাবার পথ তিনি নিজেই রুদ্ধ করে দিয়েছেন।
অলি আহাদ তাঁর বইতে সেই অংশের শিরোনাম দিয়েছেন ‘১৫ই আগস্টের ঐতিহাসিক পটপরিবর্তন’। সেখানে তিনি লিখেছেন,
এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ ও অমানিশার অবসান ঘটে বাংলা মায়ের সাতটি সন্তানের দুঃসাহসিক প্রচেষ্টায়। মৃত্যুঘণ্টা বাজে মুজিবী জালেমশাহীর। উদয় হয় অরুণ রাঙ্গা প্রভাত। অকুতোভয় এই সাতটি দামাল সন্তান যেন বাংলাদেশের সাত কোটি মুক্তিপাগল বাঙ্গালীর আশা-আকাঙ্ক্ষার সাক্ষাৎ প্রতিনিধি। এক এক কোটির প্রতিনিধি যেন এক একজন। ইহারা হইতেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৭ জন অফিসার লেঃ কর্নেল রশীদ, লেঃ কঃ ফারুক, মেজর পাশা, মেজর হুদা, মেজর মহিউদ্দিন এবং পদচ্যুত মেজর ডালিম ও মেজর শাহরিয়ার। সেইদিন যেমন আপামর বাংগালী জনতা তাহাদিগকে কৃতজ্ঞতাভরে হৃদয় নিংড়ানো স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানাইয়াছিল, তেমনি স্বাধীনচেতা বাঙ্গালী মাত্রই চিরকাল এই ৭ জন তরুণকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাইবে। বস্তুতঃ জাতীয় নেতৃত্বের অবিমৃষ্যকারিতা ও বিজাতীয় দাসত্বের শৃঙ্খল হইতে মুক্তি পাওয়ার সূর্য সম্ভাবনা হিসাবেই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট চিরকাল পরিগণিত হইবে। আজাদী পাগল বাংগালীর জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ১৫ই আগস্ট সত্যিই এক অনন্য দিবস। ইহা ছিল কার্যতঃ দিল্লীর দাসত্বের অশুভ শৃঙ্খল মোচনের প্রথম পদক্ষেপ ও শুভ সূচনা।
পাঠক, নির্মম এক হত্যাকাণ্ডের পর সেই হত্যাকাণ্ড এবং হত্যাকারীদের প্রতি অলি আহাদের এই অসুস্থ উল্লাস এবং বন্দনার পরেও কি আপনারা তাঁর সারাজীবনের সাফল্য নিয়ে জাবর কাটতে আগ্রহী হবেন? যদি হন, তবে বুঝতে হবে আপনার মধ্যেও একই সমস্যা রয়েছে। অলি আহাদের এই বক্তব্য থেকেই অনুমান করা যায় মওলানা ভাসানীর আচরণ কেমন ছিলো। কারণ, এঁরা সবাই একই রসুনের গোঁড়া।
দেশ স্বাধীন হবার পরে পেট ভর্তি হিংসা নিয়ে শেখ মুজিবের পতনই কামনা করেছে এঁরা রাতদিন। কাজেই, পত্রিকায় যখন আসে, ভাসানী এই পরিবর্তনকে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসাবে বর্ণনা করে তারবার্তা পাঠিয়েছেন বঙ্গভবনে, সেটাকে অসত্য কিছু মনে হয় না। অলি আহাদ নিজেও তাঁর বইতে তাঁর গুরু ভাসানী যে এই রক্তাক্ত পরিবর্তনকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন, সে কথা পরিষ্কারভাবে লেখা রয়েছে।