বিজ্ঞানব্লগপোস্ট

মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও বিগ ব্যাং

লিখেছেনঃ শিক্ষানবিস

মহাবিশ্বের উৎপত্তি

জ থেকে প্রায় ১৩৭৪.৯ কোটি বছর আগে, মহাবিস্ফোরণের (Big Bang) মাত্র ৪ লক্ষ বছর পরে মহাবিশ্বের সব বাতি প্রায় ধপ করেই নিভে গিয়েছিল। এর আগে মহাবিশ্ব ছিল একটা ভয়ানক গরম, ফুটন্ত, ছুটন্ত প্লাজমা— প্রোটন, নিউট্রন আর ইলেকট্রনের এক চঞ্চল, ঘন মেঘ। সেইখানে কেউ থাকলে চারিদিকে দেখত শুধু ধোঁয়াশা আর ধোঁয়াশা, তবে একইসাথে সেটা হতো অন্ধ করে দেয়ার মতো উজ্জ্বল।

আনুমানিক ৪ লক্ষ বছর বয়সে প্রসারমান মহাবিশ্বটা এত ঠাণ্ডা হয়ে যায় যে, অবশেষে ইলেকট্রন আর প্রোটন মিলে হাইড্রোজেন পরমাণু তৈরির সুযোগ পায়। এই ঘটনার নাম পুনর্মিলন (Recombination)। সে সময় ধোঁয়াশা দূর হয়, মহাবিশ্ব আরো ঠাণ্ডা হতে থাকে, এবং সবকিছু বেশ দ্রুত অন্ধকার হয়ে যায়। মহাবিস্ফোরণের অকল্পনীয় তেজোলীলা আর তার উত্তরকাণ্ডের পর মহাবিশ্বে এই যে আঁধারের রাজত্ব শুরু হলো, জ্যোতির্বিদরা এর নাম দিয়েছেন অন্ধকার যুগ (Dark Ages)।

এবং সে ছিল আসলেই বেজায় অন্ধকার। এমনকি প্রথম দিককার নক্ষত্রেরাও সেই আঁধার দূর করতে পারেনি। কারণ, তারা সবচেয়ে বেশি বিকিরণ নিঃসরণ করত অতিবেগুনী তরঙ্গদৈর্ঘ্যে যা আবার হাইড্রোজেনের প্রিয় খাদ্য; হাইড্রোজেন সেই তরঙ্গ শোষণ করে আয়নিত হতে থাকায় নবসৃষ্ট অতিবেগুনী রশ্মি নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারছিল না। তাই বলা যায়, মহাবিশ্ব আদিম উত্তপ্ত ও উজ্জ্বল ধোঁয়াশা’র হাত থেকে মুক্ত হয়ে আবার একটা শীতল ও অন্ধকার ধোঁয়াশা’র হাতে বন্দি হয়েছিল।

এই ধোঁয়াশাও একসময় দূর হয়েছে, কিন্তু কিভাবে হয়েছে তা আজকালকার জ্যোতিঃপদার্থবিদ দের মাথা ব্যথার প্রধান কারণগুলোর একটি। হয়ত এর জন্য দায়ী মূলত প্রথম যুগের নক্ষত্রেরা যাদের তীব্র আলো ঢিমেতালে দীর্ঘ সময় ধরে হাইড্রোজেনের অর্গল থেকে ইলেকট্রনকে মুক্ত করতে থেকেছে—যে ঘটনার নাম ‘পুনরায়নীভবন’ (Reionization)। কিংবা হয়ত আয়নীভবনের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি এসেছে দানবীয় কৃষ্ণবিবরের চারদিকে চক্কর খেতে খেতে তার ভিতর পড়তে থাকা উত্তপ্ত গ্যাস থেকে।

পুনরায়নীভবন বা সংক্ষেপে কেবল ‘আয়নীভবন’—কখন এবং কিভাবে ঘটেছে তা বুঝার সবচেয়ে ভালো উপায় মহাবিশ্বের প্রাচীনতম বস্তুগুলোর জন্মের ইতিহাস খতিয়ে দেখা। প্রথম নক্ষত্রগুলো কখন জন্ম নিয়েছিল, তারা দেখতে কেমন ছিল? অনেক নক্ষত্র একসাথে মিলে কিভাবে গ্যালাক্সি তৈরি করেছিল, এবং প্রায় সব গ্যালাক্সির কেন্দ্রে যে অতিকায় কৃষ্ণবিবর পাওয়া যায় তাদের উৎপত্তিই বা কিভাবে হয়েছিল? আর নক্ষত্র থেকে গ্যালাক্সি গঠন এবং গ্যালাক্সির হাতে অতিকায় কৃষ্ণবিবর তৈরির এই কালানুক্রমের ঠিক কোন পর্যায়ে হাইড্রোজেনের আয়নীভবন শুরু হয়েছিল? এবং আয়নীভবন প্রক্রিয়াটা ধীর ছিল, না কি আকস্মিক ছিল?

জ্যোতিঃপদার্থবিদরা ১৯৬০ এর দশক থেকেই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু উত্তর দেয়ার জন্য যত শক্তিশালী দূরবীক্ষণ ও কম্পিউটার দরকার তা আমাদের হাতে এসেছে মাত্র সাম্প্রতিক কালে। হালের দূরবীক্ষণ দিয়ে মহাবিস্ফোরণের মাত্র ৫০ কোটি বছর পরে জন্ম নেয়া বস্তু থেকে আসা আলোও সনাক্ত করা যাচ্ছে। আর হালের কম্পিউটার দিয়ে মহাবিশ্বের প্রথম নক্ষত্রদের জন্মপ্রক্রিয়া সিমুলেশন করা যাচ্ছে।

মহানক্ষত্র

মাত্র এক দশক আগেও জ্যোতিঃপদার্থবিদরা ভেবে বসে ছিলেন যে, তারা প্রথম নক্ষত্রদের জন্মের কাহিনী জেনে গেছেন। প্রতিষ্ঠিত কাহিনীটা ছিল এরকম: পুনর্মিলনের পরপর পুরো মহাবিশ্ব জুড়ে মোটামুটি সমসত্ত্বভাবে হাইড্রোজেন পরমাণু ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, কিন্তু অদৃশ্য পদার্থ (Dark matter) এমন এক অদৃশ্য কণা দিয়ে তৈরি যা এযাবৎ সনাক্ত করা যায়নি—তখনই জায়গায় জায়গায় দানা বেঁধে প্রচুর ‘হেলো’ (Halo) তৈরি করেছিল; একেকটা হেলো’র ভর ছিল গড়পড়তায় সূর্যের ভরের ১ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ গুণ।

এসব হেলো তাদের মহাকর্ষ বল দিয়ে হাইড্রোজেনকে নিজেদের ভিতর নিয়ে আসছিল। এভাবে হাইড্রোজেন জড়ো হতে হতে যখন হেলোগুলোর কেন্দ্রে হাইড্রোজেন গ্যাসের ঘনত্ব অনেক বেড়ে যায় তখন সেখানে পারমাণবিক বিক্রিয়া শুরু হয় এবং গ্যাসমেঘগুলো ঝিলিক মেরে উঠে—জন্ম হয় মহাবিশ্বের প্রথম নক্ষত্রসমষ্টির।

মহাবিশ্বের উৎপত্তি

এই প্রথম নক্ষত্ররা—যাদেরকে জ্যোতির্বিদরা ‘৩য় নক্ষত্রসমষ্টি’ (Population III stars) নামে ডাকেন—যে গোটা বিশ্বকে আয়নিত করে হাইড্রোজেনের পর্দা উন্মোচন করে দিতে একেবারে অসমর্থ ছিল তা নয়। কিন্তু সবই নির্ভর করছে নক্ষত্রগুলো ঠিক কেমন ছিল তার উপর। তারা যদি যথেষ্ট উজ্জ্বল ও যথেষ্ট দীর্ঘজীবী না হয় তাহলে কাজটা শেষ করতে পারবে না।

মহাবিশ্বের উৎপত্তি
Population III stars

এই নক্ষত্রদের বৈশিষ্ট্য বহুলাংশে নির্ভর করে তাদের আকারের উপর। এক দশক আগে জ্যোতির্বিদরা ভাবতেন, সব নক্ষত্র মোটামুটি এক আকারের ছিল—গড়পড়তায় সূর্যের চেয়ে ১০০ গুণ ভারী। কারণ, একটা গ্যাসমেঘ যখন নিজের মহাকর্ষের প্রভাবে নিজের কেন্দ্রের দিকে সংকুচিত হতে থাকে তখন তার তাপমাত্রা বাড়ে, এবং সেই তাপ এক ধরণের ‘বিকিরণ চাপ ‘ তৈরি করে যা মহাকর্ষ বলের বিপরীতে কাজ করে; নক্ষত্র যদি তার কিছু তাপ মোচন করতে না পারে তাহলে বিকিরণ চাপের বিকর্ষণের কাছে মহাকর্ষ হেরে যাবে, মেঘের সংকোচন থেমে যাবে, এবং নক্ষত্রের ভ্রুণটি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে।

প্রথম দিককার নক্ষত্ররা ছিল মূলত হাইড্রোজেন দিয়ে তৈরি, এবং হাইড্রোজেন তাপমোচনে খুবই অদক্ষ। (আমাদের সূর্যের মতো নক্ষত্রদের ভিতরে সামান্য পরিমাণে অন্যান্য মৌল, যেমন অক্সিজেন ও কার্বন থাকে যা তাদেরকে তাপমোচনে সাহায্য করে।) তাই আদি মহাবিশ্বের ভ্রুণতারারা অনেক হাইড্রোজেন সংগ্রহ করতে পারত, কিন্তু উচ্চচাপ তাদের কেন্দ্রভাগের হাইড্রোজেনকে বেশি ঘন হতে দিত না যার ফলে সেখানে কেন্দ্রীন সংযোজন (Nuclear fusion) বিক্রিয়াও শুরু হতে পারত না, যে বিক্রিয়ার শক্তি কেন্দ্রবহির্ভূত সব গ্যাস মহাশূন্যে ছুঁড়ে ফেলতে পারে। ভ্রুণতারাটি হাইড্রোজেন জমা করতে করতে এক বিশালবপু, অতিভারী, সুবিস্তৃত মেঘখণ্ডে পরিণত হতো, কিন্তু কখনো প্রকৃত নক্ষত্র হতে পারত না।

কিন্তু সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেটোত্তর গবেষক টমাস গ্রাইফ অতিসূক্ষ্ণ সিমুলেশনের মাধ্যমে নক্ষত্র গঠন নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষার পর জানাচ্ছেন, কাহিনীটা এত সরল না। তার সিমুলেশনে মহাকর্ষের পাশাপাশি সংকোচনশীল হাইড্রোজেন গ্যাসের মধ্যে গড়ে উঠা বর্ধিষ্ণু চাপের প্রভাবও ধর্তব্যের মধ্যে নেয়া হয়েছে। সিমুলেশনটি বলছে, আদিম নক্ষত্রগুলো অনেকভাবে গঠিত হয়ে থাকতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে সেসব নক্ষত্রের ভর সূর্যের সর্বোচ্চ দশ লক্ষ গুণও হতে পারে। আবার কখনো সংকোচনশীল মেঘটা ছিন্নভিন্ন হয়ে অনেকগুলো অপেক্ষাকৃত কম ভরের (সৌরভরের বিশ-ত্রিশ গুণ) নক্ষত্রও তৈরি করতে পারে।

অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-

নক্ষত্রদের আকার যদি এত বৈচিত্র্যময় হয়ে থাকে তাহলে তাদের আয়ুও অনেক আলাদা আলাদা হতে পারে, এবং সেক্ষেত্রে আয়নীভবন কালও অনেক এদিক ওদিক হতে পারে। সূর্যের চেয়ে ১০০ গুণের মতো ভারী নক্ষত্ররা হচ্ছে জ্যোতির্বিজ্ঞানের রকস্টার: তারা ঝাকানাকা জীবন যাপন করে এবং অল্প বয়সে মারা যায়। অন্যদিকে ছোটো নক্ষত্ররা অনেক ধীরে সুস্থে জ্বালানি খরচ করে ও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে। তাই, যদি আয়নীভবনের প্রধান কারণ নক্ষত্ররাই হয়ে থাকে, তাহলে পুরো আয়নীভবন ঘটতে অনেক সময়—হয়ত শত শত কোটি বছর—লাগবে, যেহেতু অনেক আদিম নক্ষত্রই অল্প ভরের।

কৃষ্ণ আলো

ত বড়ই হোক না কেন, সব আদিম নক্ষত্রের মৃত্যু ঘটেছে ভয়ংকর বিস্ফোরণের মাধ্যমে—যে বিস্ফোরণকে বলে অতিনবতারা (Supernova)—এবং বিস্ফোরণের পর উপর্যুপরি সংকোচনের মাধ্যমে তারা কৃষ্ণবিবরে পরিণত হয়েছে। এবং আয়নীভবনে সম্ভবত নক্ষত্রদের তুলনায় তাদের সন্তান কৃষ্ণবিবরদের ভূমিকাই বেশি।

blackhole
Black Hole

কৃষ্ণবিবরেরা দেদারসে আশপাশের সব গ্যাস গিলতে থাকে, এবং গ্যাস বিবরের ভিতরে পড়ার সময় প্রচণ্ড ঘন ও উত্তপ্ত হয়ে উঠে—তাপমাত্রা পৌঁছতে পারে প্রায় কোটি ডিগ্রি পর্যন্ত। তাপটা এতই বেশি যে, অধিকাংশ গ্যাস বিবরে হারিয়ে গেলেও, সামান্য যেটুকু কৃষ্ণবিবরের দুই মেরু থেকে ফিনকির (জেট) মতো নির্গত হয় তাও প্রায় হাজার কোটি আলোকবর্ষ দূর পর্যন্ত দেখা যায়। জেটবিশিষ্ট অতিকায় কৃষ্ণবিবরের এই বাতিঘর গুলোকেই কোয়েজার (Quasar) বলা হয়।

কৃষ্ণবিবরেরা দেদারসে আশপাশের সব গ্যাস গিলতে থাকে, এবং গ্যাস বিবরের ভিতরে পড়ার সময় প্রচণ্ড ঘন ও উত্তপ্ত হয়ে উঠে—তাপমাত্রা পৌঁছতে পারে প্রায় কোটি ডিগ্রি পর্যন্ত। তাপটা এতই বেশি যে, অধিকাংশ গ্যাস বিবরে হারিয়ে গেলেও, সামান্য যেটুকু কৃষ্ণবিবরের দুই মেরু থেকে ফিনকির (জেট) মতো নির্গত হয় তাও প্রায় হাজার কোটি আলোকবর্ষ দূর পর্যন্ত দেখা যায়। জেটবিশিষ্ট অতিকায় কৃষ্ণবিবরের এই বাতিঘর গুলোকেই কোয়েজার (Quasar) বলা হয়।

Hubble-Finds-Quasar
Hubble Quasar

১৯৬০ এর দশক থেকে ১৯৯০ এর দশক পর্যন্ত আসলে আদি মহাবিশ্ব সম্পর্কে জানার একমাত্র উপায় ছিল কোয়েজার। প্রথমে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বুঝতেই পারেননি এগুলো কী। এরা দেখতে নক্ষত্রের মতো, কিন্তু এদের নিঃসৃত আলোর লোহিত সরণ—মহাবিশ্বের প্রসারণের কারণে যাত্রাপথে আলোর অপেক্ষাকৃত লাল হওয়া—অনেক বেশি। লোহিত সরণ বলছিল যে, তারা যেকোনো নক্ষত্রের চেয়ে অনেক অনেক বেশি দূরে অবস্থিত, যার অর্থ তাদের উজ্জ্বলতাও ভয়াবহ রকমের বেশি, কেননা উজ্জ্বলতা বেশি না হলে এত দূর থেকে দেখা যেত না। আবিষ্কৃত প্রথম কোয়েজার— ৩সি ২৭৩-এর লোহিত সরণ ০.১৬, যার অর্থ তার আলো আমাদের কাছে আসতে ২০০ কোটি বছর লেগেছে।

এরপর বেশ দ্রুত আরো অনেক কোয়েজার পাওয়া গেছে, কোনো কোনোটার লোহিত সরণ ছিল প্রায় ২, অর্থাৎ তাদের আলো ১০০০ কোটি বছরের ভ্রমণ শেষে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া’র প্যালোমার মানমন্দিরে মার্টিন শ্মিট, জেমস গান এবং ডোনাল্ড শ্নাইডার একত্রে ৪.৯ লোহিত সরণের—১২৫০ কোটি বছর আগের বা মহাবিস্ফোরণের মাত্র ১২৫ কোটি বছর পরের—একটা কোয়েজার আবিষ্কার করেন।

কিন্তু এত প্রাচীন কোয়েজারের আলোতেও হাইড্রোজেন দ্বারা শোষণের কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না। নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন থাকলে সে একটা নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে নিত। তার মানে, এই আলো যখন কোয়েজারটি ছেড়ে পৃথিবীর দিকে ধাবিত হওয়া শুরু করেছে তারও আগে মহাবিশ্বের প্রায় সব হাইড্রোজেন নিরপেক্ষ থেকে আয়নিত হয়ে গেছে।

hubble-cake-telescope
হাবল কেক টেলিস্কোপ

১৯৯০ এর দশকে এর চেয়ে প্রাচীন কোনো কোয়েজার পাওয়া যায়নি বললেই চলে। কারণটা দুরবিনের দুর্বলতা নয়—শক্তিশালী হাবল নভোদুরবিন ও হাওয়াই এর মাওনা কিয়া তে স্থাপিত কেক দুরবিন দুটোই ঐ দশকের শুরুর দিকে কাজ শুরু করেছিল—বরং এত প্রাচীন কোয়েজারের বিরলতা। অতিকায় কৃষ্ণবিবরদের মধ্যে কেবল সবচেয়ে ভারীগুলো থেকেই জেট বেরোয় যাদের সংখ্যা তখন বেশি ছিল না। তাছাড়া কোয়েজার আমরা কেবল তখনই দেখতে পারি, যখন তাদের জেট নির্গমনের দিকটা সরাসরি আমাদের দিকে হয় যা-ও বেশ বিরল।

তার উপর, কৃষ্ণবিবর সক্রিয়ভাবে গ্যাস গিলতে না থাকলে জেট বেরোনর কোনো সম্ভাবনা থাকে না। অধিকাংশ কৃষ্ণবিবর তাদের জীবনের সবচেয়ে সক্রিয় সময়টা পার করেছে ২ থেকে ৩ লোহিত সরণের মধ্যে। কারণ গড়পড়তায় তখনকার গ্যালাক্সিতে গ্যাসের পরিমাণ বর্তমানের চেয়ে বেশি ছিল। এই স্বর্ণসময়ের চেয়ে পিছনে গেলেই কোয়েজার সংখ্যা অনেক কমে যায়। তারপরও তখনকার অন্তত যতগুলো কোয়েজার আছে, সেগুলো আবিষ্কার ২০০০ সালের আগে সম্ভব হয়নি। সে বছর ‘স্লোন ডিজিটাল স্কাই সার্ভে’ সেযাবৎ নির্মীত সর্বাধুনিক ডিটেক্টর (যা বানিয়েছিলেন সেই জেমস গান) দিয়ে মহাবিশ্বের আবিষ্কারযোগ্য সব কোয়েজারের শুলুক সন্ধানে নামে। এই জরিপে ৫.৫ এর চেয়ে বেশি লোহিত সরণ বিশিষ্ট ৪০ থেকে ৫০ টি কোয়েজার পাওয়া গিয়েছিল।

জরিপে ৬ থেকে ৬.৪ লোহিত সরণের মধ্যকার কিছু কোয়েজারও পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু এর চেয়ে অতীত দেখা আর এর পক্ষে সম্ভব ছিল না। এবং ৬.৪ লোহিত সরণেও নিরপেক্ষ হাইড্রোজেনের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। চিহ্নটা অবশেষে পাওয়া গেছে মাওনা কিয়া তে স্থাপিত ‘ইউনাইটেড কিংডম ইনফ্রারেড টেলিস্কোপ’ (UKIRT) দিয়ে পরিচালিত অবলোহিত তরঙ্গের জরিপে। এই জরিপে আবিষ্কৃত ৭.০৮৫ লোহিত সরণের একটা কোয়েজারের আলোতে সামান্য পরিমাণ অতিবেগুনী রশ্মি শোষণকারী নিরপেক্ষ হাইড্রোজেনের চিহ্ন মিলেছে।

মহাবিস্ফোরণের মাত্র ৭৯ কোটি বছর পরে অস্তিত্বশীল এই কোয়েজারটির নাম ULAS J1120+0641 (সংখ্যগুলো বস্তুটার স্থানাঙ্ক নির্দেশ করে), এবং এটাই প্রথমবারের মতো মহাবিশ্বের পুনরায়নীভবন যুগ (epoch) সম্পর্কে কিছু বাস্তব ধারণা দিয়েছে। কিন্তু ধারণাটুকু বেশ অপ্রতুল, কারণ এমনকি তারও আগে মহাবিশ্বের অধিকাংশ হাইড্রোজেন ধ্বংস—তথা আয়নিত—হয়ে গিয়েছিল।

ULAS-J1120-0641-Quasar
ULAS J1120+0641 Quasar

কিংবা হয়ত তখনো সব আয়নিত হয়ে যায়নি। হয়ত এই কোয়েজার মহাবিশ্বের এমন একটা অঞ্চলে আছে যেখানে নিরপেক্ষ হাইড্রোজেনের পরিমাণ কম, হয়ত সে সময়কার অন্যান্য স্থানের কোয়েজারের চারদিকে আরো বেশি নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন আছে। কিন্তু উল্টোটাও সত্যি হতে পারে: হয়ত এই কোয়েজারের আশপাশেই নিরপেক্ষ হাইড্রোজেনের পরিমাণ বেশি, এবং অন্যত্র আরো কম; সেক্ষেত্রে আয়নীভবন হয়ত আরো আগে শেষ হয়েছে। তখনকার আরো বেশি কোয়েজারের নমুনা হাতে না থাকায় নিশ্চিত করে কিছুই বলা সম্ভব না।

কিন্তু ULAS J1120+0641 থেকে পাওয়া তথ্যগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রথমত, সে সময় কোয়েজারের সংখ্যা এত কম ছিল যে তারা আয়নীভবনের প্রধান চালিকাশক্তি হতে পারে না। উপরন্তু, কোয়েজারটির আপাত উজ্জ্বলতা ও দূরত্ব থেকে তার প্রকৃত উজ্জ্বলতা মাপা হয়েছে; এই উজ্জ্বলতার জন্য যে পরিমাণ শক্তির দরকার তা যোগান দিতে হলে তার গর্ভে সূর্যের চেয়ে অন্তত ১০০ কোটি গুণ ভারী একটা অতিকায় কৃষ্ণবিবর থাকতে হবে। মহাবিস্ফোরণের পর এত কম সময়ে এত বিশাল কৃষ্ণবিবর কিভাবে তৈরি হলো?

কিন্তু পর্যবেক্ষণ তো বলছে, আসলেই তৈরি হয়েছিল। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান আব্রাহাম লোব এর মতে, সূর্যের চেয়ে ১০০ গুণ ভারী একটা নক্ষত্র যদি মহাবিস্ফোরণের বিশ-ত্রিশ কোটি বছর পর কৃষ্ণবিবরে পরিণত হতে পারে, তাহলে অনুকূল পরিস্থিতিতে কৃষ্ণবিবরটির পক্ষে এত কম সময়ে এত ভারী হওয়া হয়ত সম্ভব। কিন্তু সেক্ষেত্রে তাকে জন্মের পর থেকেই অবিরাম গ্যাস গিলতে থাকতে হবে, যা খুব কঠিন।

কারণ, কৃষ্ণবিবর গ্যাস গিলতে গিলতে অনেক উজ্জ্বল হয়ে উঠার পর আশপাশের সব গ্যাস তাড়িয়ে দেয়, যার ফলে নিজের দোষেই একসময় আর তার খাওয়ার কিছু থাকে না, এবং সে সাময়িকভাবে নিভে যায়। এই নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে তার চারদিকে আবার গ্যাস জড়ো হতে থাকে, এবং গ্যাসদের কৃপায় সে আবার জ্বলে উঠার সুযোগ পায়। নিষ্ক্রিয়তা-সক্রিয়তার এই চক্রকে ‘কর্মচক্র’ (Duty cycle) বলে। কর্মচক্রের অমোঘ বিধানের কারণেই কোনো কৃষ্ণবিবরের বিরতিহীন উদরপূর্তির সাধ মিটে না।

অল্প সময়ে আকার বৃদ্ধির আরেকটা উপায় অবশ্য আছে—অন্য কৃষ্ণবিবরদের সাথে মিলিত হওয়া। আরো সুবিধা হয় যদি শুরুতেই তাদের ভর সূর্যের ১০০ গুণের চেয়ে অনেক বেশি থাকে, গ্রাইফের সিমুলেশন যা সম্ভব বলছে। সূর্যের চেয়ে এত বড় নক্ষত্রের ধারণাটা ইদানিং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এরা যদি আসলেই থেকে থাকে তাহলে ২০১৮ সালে জেমস ওয়েব নভোদুরবিন কাজ শুরু করার পর ধরা পড়বে, কারণ এদের উজ্জ্বলতা হওয়ার কথা আমাদের গোটা গ্যালাক্সির সমান।

গ্যালাক্সি সন্ধান

দূরের কোয়েজার আবিষ্কারের চেষ্টায় ভাটা পড়লেও, দূরের গ্যালাক্সি আবিষ্কারের চেষ্টায় নতুন জোয়ার এসেছে। এক্ষেত্রে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছিল হাবল নভোদুরবিন দিয়ে তোলা একটা ছবি, নাম ‘হাবল ডিপ ফিল্ড ‘। ১৯৯৫ সালে হাবল নভোদুরবিনের পরিচালনা প্রতিষ্ঠান ‘স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনস্টিটিউট ‘ এর তদানীন্তন প্রধান রবার্ট উইলিয়ামস এর মাথায় ভূত চেপেছিল। কেবল পরিচালকের জন্য বরাদ্দ বিশেষ সময় কাজে লাগিয়ে তিনি দুরবিনটাকে আকাশের সম্পূর্ণ খালি একটা জায়গার দিকে ৩০ ঘণ্টা ধরে তাক করে রেখেছিলেন।

আমাদের চোখের যে সুযোগটা নেই দুরবিনের সেটা আছে, সে তার নেত্রে আগত ফোটন জমা করে রাখতে পারে। তাই সময়ের সাথে সাথে তার ফোটনসংগ্রহ বাড়তে থাকে। এভাবে আপাতদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ খালি জায়গাতেও সে জ্যোতিষ্ক আবিষ্কার করে ফেলে। হাবল যেদিকে তাকিয়েছিল সেদিকে অদৃষ্ট কিছু আসলেই আছে কি-না সে নিয়ে অনেক বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানীরও ঘোর সন্দেহ ছিল। কিন্তু উইলিয়ামস ছিলেন আশাবাদী।

universe
মহাবিশ্ব

এবং সবুরে মেওয়াও ফলেছে। হাবল প্রায় কয়েক হাজার ছোটো, ক্ষীণ গ্যালাক্সি আবিষ্কার করেছিল যার কোনো কোনোটা ছিল সে যাবত দেখা সবচেয়ে দূরের গ্যালাক্সি। এরপর হাবল গভীর মহাশূন্য দর্শন চালিয়ে গেছে। ২০০৯ সালে এক নভোযাত্রার সময় তার ভিতর ‘ওয়াইড ফিল্ড ক্যামেরা ৩ ‘ নামে একটা নতুন ডিটেক্টর বসানো হয় যা অবলোহিত আলোও ধরতে সক্ষম।

এর কর্মদক্ষতা ছিল আগের ডিটেক্টরের চেয়ে ৩৫ গুণ বেশি, এবং যথারীতি সে আরো অনেক গভীর জলের মাছ খুঁজে পেয়েছে। আগে যেখানে ৭ লোহিত সরণের চেয়ে দূরের মাত্র চার-পাঁচটা গ্যালাক্সি চেনা ছিল, সেখানে এখন একশ’রও বেশি পাওয়া গেছে। অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যানিয়েল স্টার্ক ও ক্যালটেক এর রিচার্ড এলিস ২০১২ সালের এক গবেষণাপত্রে অবিশ্বাস্য ১১.২ লোহিত সরণের এক গ্যালাক্সি আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছেন, অর্থাৎ এটা মহাবিস্ফোরণের মাত্র ৪০ কোটি বছর পর জীবন যাপন করছিল।

কোয়েজারদের মতো এসব আদিম গ্যালাক্সিও তখনকার নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন সম্পর্কে অনেক কিছু জানাতে পারে। দেখা গেছে, এই গ্যালাক্সিগুলোর যতটুকু অতিবেগুনী রশ্মি নিঃসরণ করার কথা ততটুকু আমরা পাচ্ছি না, কিছু অংশ খোয়া গেছে। এটা আত্মঘাতী হাইড্রোজেনের কর্ম, সে ওটুকু শোষণ করে নিজেকে ধ্বংস করেছে। যত বেশি হাইড্রোজেন আয়নিত হয়েছে, অতিবেগুনী শোষণের পরিমাণ ততই কমেছে। তাই মহাবিস্ফোরণ থেকে যত বর্তমানের দিকে আসা যায়, গ্যালাক্সির অতিবেগুনী আলোও তত বেশি পাওয়া যায়, এবং মহাবিস্ফোরণের আনুমানিক ১০০ কোটি বছর পর আর শোষণ করার কেউ থাকে না, হাইড্রোজেনের চাদর সরিয়ে বিশ্বজগৎ একদম স্বচ্ছ হয়ে উঠে।

গ্যালাক্সির গুলি তে হাইড্রোজেন যে ভালভাবেই বিদ্ধ হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই, বন্দুকের ডগায় ধোঁয়া পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পাড়ায় তার একচেটিয়া মস্তানি ছিল সেটা বলা যাচ্ছে না। কারণ এই শ’খানেক গ্যালাক্সি থেকে হিসাব করে গোটা বিশ্বে কতগুলো এইরকম গ্যালাক্সি ছিল তা বের করা হয়েছে, এবং সেই সংখ্যাটা সব হাইড্রোজেনকে আয়নিত করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। সেজন্য আরো যত শক্তি দরকার সেটা যে কৃষ্ণবিবর যোগান দিতে পারবে না তা আমরা ইতিমধ্যেই আলোচনা করেছি, তারা ওরকম দাপুটে হওয়ার জন্য যথেষ্ট সময়ই পায়নি।

তবে হয়ত সমাধান হাতের কাছেই আছে। হয়ত আমাদের চোখের আড়ালে এখনো অনেক আদিম গ্যালাক্সি রয়ে গেছে। হাবল তার ডাগর আঁখি যে কয়টার দিকে ফেলেছে সেগুলো ছিল সে সময়কার সবচেয়ে উজ্জ্বল গ্যালাক্সি। কিন্তু তখনকার টিমটিমে হাজারো গ্যালাক্সি হয়ত “সে কি আমারি পানে ভুলে পড়িবে না” গেয়ে চলেছে। বিধি আরো উদার হৃদয় দূরবীক্ষণ তৈরি না করা পর্যন্ত তাদের তৃষাটুকু পূরানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে তাদের সান্ত্বনা দেয়া যায় এই বলে যে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রায় বিশ্বাস করেই ফেলেছেন, “বিশ্বায়নীভবনে গ্যালাক্সিদের ভূমিকাই প্রধান।”

ভরসা আইনস্টাইন

কেবারে নবজাতক গ্যালাক্সিগুলো দেখতে কেমন ছিল এবং তাদের নক্ষত্রমেলা ঠিক কখন বসতে শুরু করেছিল তা এখন পর্যন্ত অজানা। হাবল যেগুলো দেখেছে সেগুলোকে ঠিক বুড়ো বলা যাবে না—আরো এক দুই শ’ কোটি বছর পরের গ্যালাক্সিদের তুলনায় তাদেরকে বেশ নবীনই দেখায়। কিন্তু তদ্দিনেই তাদের ভিতর প্রায় দশ কোটির মতো নক্ষত্র জড়ো হয়ে গিয়েছিল, এবং নক্ষত্রগুলোর রঙও একটু লালচে যেমনটা একেবারে নতুন গ্যালাক্সিতে দেখা যায় না। দেখে মনে হয়, তারা অন্তত দশ কোটি বছর ধরে নক্ষত্র জোগাড় করছিল। সুতরাং, হাবল আমাদেরকে আদিম গ্যালাক্সির সন্ধান দিলেও, আদিমতমদের সন্ধান পেতে অপেক্ষা করতে হবে আরো সংবেদী জেমস ওয়েব নভোদুরবিনের।

তবে হাবলের আবেদনও একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। তাকে সংবেদন সংকট থেকে উদ্ধারের জন্য স্বয়ং মহাবিশ্বই হাজির যার প্রাকৃতিক লেন্স অদৃশ্য বস্তুর দিকেও তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। অনেক ভারী বস্তু—এক্ষেত্রে গ্যালাক্সিপুঞ্জ—তার আশপাশের স্থান প্রচণ্ড বাঁকিয়ে দেয় যেটা আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। বস্তুটির পিছনের যে আলো আগে তার কারণে আমাদের দিকে আসতে পারছিল না, সেটা এই সুযোগে বাঁকা পথ দিয়ে চলে আসতে পারে। সামনের বস্তুটাকে পুরোবস্তু, আর পিছনেরটাকে পটবস্তু ডাকা যাক। বক্রপথে আসা আলোয় পটবস্তুটাকে বিকৃত দেখায়, এবং তার আকারও স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। তাই, একটু বিকৃতভাবে হলেও অনেক দূরের বস্তু এই পদ্ধতিতে দেখা সম্ভব।

Gravitational Lense
Gravitational Lense

গ্যালাক্সিপুঞ্জের পিছনে থাকা দূরবর্তী বস্তুর আলো এতটাই বিবর্ধিত হয় যে তাদেরকে স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ থেকে ২০ গুণ পর্যন্ত উজ্জ্বল দেখাতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় গ্যালাক্সি দেখার জন্য হাবল গবেষকদের একটা আলাদা দলই আছে, এবং তারা ইতিমধ্যে ২৫০টি গ্যালাক্সি আবিষ্কার করে ফেলেছে যেগুলো ‘ডিপ ফিল্ড’ জরিপে হাবলের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। নতুন গ্যালাক্সিগুলোর লোহিত সরণ গড়পড়তায় ৬ থেকে ৮ এর মধ্যে, তবে ১১ লোহিত সরণেও কয়েকটা পাওয়া গেছে। ডিপ ফিল্ড জরিপের গ্যালাক্সিগুলো হাইড্রোজেন-বিশ্বের যে চিত্র তুলে ধরেছিল, মহাকর্ষ লেন্সিং এর মাধ্যমে পাওয়া নতুন গুলো এখন পর্যন্ত তা-ই সমর্থন করছে।

গ্যালাক্সিপুঞ্জের পিছনে থাকা দূরবর্তী বস্তুর আলো এতটাই বিবর্ধিত হয় যে তাদেরকে স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ থেকে ২০ গুণ পর্যন্ত উজ্জ্বল দেখাতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় গ্যালাক্সি দেখার জন্য হাবল গবেষকদের একটা আলাদা দলই আছে, এবং তারা ইতিমধ্যে ২৫০টি গ্যালাক্সি আবিষ্কার করে ফেলেছে যেগুলো ‘ডিপ ফিল্ড’ জরিপে হাবলের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। নতুন গ্যালাক্সিগুলোর লোহিত সরণ গড়পড়তায় ৬ থেকে ৮ এর মধ্যে, তবে ১১ লোহিত সরণেও কয়েকটা পাওয়া গেছে। ডিপ ফিল্ড জরিপের গ্যালাক্সিগুলো হাইড্রোজেন-বিশ্বের যে চিত্র তুলে ধরেছিল, মহাকর্ষ লেন্সিং এর মাধ্যমে পাওয়া নতুন গুলো এখন পর্যন্ত তা-ই সমর্থন করছে।

hubble-gravitational-lens
Hubble Gravitational Lens

হাবল তার অনুসন্ধানের গভীরতা বাড়িয়েই চলবে। ইতিমধ্যেই ‘ফ্রন্টিয়ার ফিল্ডস’ নামে একটা নতুন প্রকল্পের ঘোষণা দেয়া হয়েছে যার কাজই হবে মহাবিশ্বের সবচেয়ে ভারী গ্যালাক্সিপুঞ্জ গুলোর মধ্যে ৬টিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা। এই পুঞ্জগুলো তাদের বিশাল বপু দিয়ে পিছনের যা কিছু ঢেকে রেখেছে তার সব বাঁকা পথে আবিষ্কারের চেষ্টা করা হবে। হাবল ৯৫.৬ মিনিটে একবার পৃথিবীকে আবর্তন করে, এবং প্রতি আবর্তনে ৪৫ মিনিট পর্যবেক্ষণের কাজ করা যায়। এরকম ১৪০টা আবর্তনকাল ফ্রন্টিয়ার ফিল্ডস এর জন্য বরাদ্দ।

দমক সন্ধান

বে সবাইকে ছাপিয়ে আদিম মহাবিশ্ব সম্পর্কে জানার সর্বোত্তম উপায় হয়ে উঠতে পারে আরেকটা বাতিঘর: গামারশ্মি দমক (Gamma-ray Burst)—এদিক ওদিক থেকে হঠাৎ ছুটে আসা অত্যুচ্চ কম্পাঙ্কের বিকিরণের দমক। ১৯৬০ এর দশকে আবিষ্কৃত এই ঘটনা যেন আগের সব রহস্যকেও হার মানিয়েছিল। এখন ধারণা করা হচ্ছে, অতিভারী নক্ষত্রের মৃত্যুর সময় এই দমক তৈরি হয়। বিশাল নক্ষত্র অকস্মাৎ ধ্বসে পড়ে কৃষ্ণবিবরে পরিণত হওয়ার সময় ফিনকি’র মতো করে গামারশ্মির তীব্র ঝলক মহাশূন্যে ছড়িয়ে দেয়। এই গামারশ্মি জেট গিয়ে যখন আশপাশের গ্যাসে আছড়ে পড়ে তখন সেই গ্যাস থেকে দৃশ্যমান আলো ও অবলোহিত তরঙ্গে আরেকটা উজ্জ্বল বিকিরণ নিঃসৃত হয় যা সাধারণ দুরবিন দিয়ে দেখা যায়।

মহাকাশের আর ভূমির দুরবিনের যোগসাজশে একই সাথে গামারশ্মি দমক আর দমকপরবর্তী অস্তরাগ সনাক্ত করা যায়। গামারশ্মি যেহেতু বায়ুমণ্ডল ভেদ করে ভূপৃষ্ঠে পৌঁছতে পারে না, সেহেতু গামারশ্মি দুরবিন স্থাপন করা হয় মহাকাশে। পৃথিবীকে চক্কর দিতে দিতে দুরবিনটি যখনই কোনো দিক থেকে দমক আসতে দেখে তখনই সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, এবং একই সাথে যেদিক থেকে দমকটি এসেছে সেই দিকের স্থানাঙ্ক পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়। তড়িঘড়ি করে জ্যোতির্বিদরা তাদের ভূদুরবিন তখন সেদিকে তাক করেন, যাতে গামারশ্মিটির দমকে গ্যাস থেকে তৈরি হওয়া অস্তরাগ সনাক্ত করা যায়। অস্তরাগটি দেখা গেলে, যে গ্যালাক্সিতে দমকটি তৈরি হয়েছে সেটার লোহিত সরণ নির্ণয় করা সম্ভব হয়।

গামারশ্মি দমকের কাছে মহাবিশ্বের অন্যসব মহাঘটনা নিতান্তই শিশু। দমক শুরু হওয়ার পর থেকে প্রথম কয়েক ঘণ্টা তার উজ্জ্বলতা থাকে একটা গ্যালাক্সির উজ্জ্বলতার দশ লক্ষ গুণ। এমনকি কোয়েজারের চেয়েও তারা ১০ থেকে ১০০ গুণ বেশি উজ্জ্বল। এদের দেখতে হলে তাই হাবলের মতো অনেকক্ষণ জুলজুল করে তাকিয়ে থাকতে হয় না। ২০০৯ সালে মাওনা কিয়া’র দুরবিন দিয়ে একটা গামারশ্মি দমকের মাতৃগ্যালাক্সি’র লোহিত সরণ ৮.২ নির্ণয় করা হয়েছিল, অর্থাৎ সেটা মহাবিস্ফোরণের ৬০ কোটি বছর পরের ঘটনা।

দমকটা এতই উজ্জ্বল ছিল যে সেটা ৮.২ এ না থেকে ১৫ বা এমনকি ২০ লোহিত সরণে, অর্থাৎ মহাবিস্ফোরণের মাত্র ২০ কোটি বছরেরও কম সময় পরে থাকলেও দেখা যেত। ২০ কোটি বছর পরই প্রথম নক্ষত্রগুলো গঠিত হতে শুরু করেছিল এবং প্রচণ্ড ভারী হওয়ার কারণে সেগুলোই গামারশ্মি দমক তৈরির জন্য সবচেয়ে আদর্শ। এখন পর্যন্ত যত উজ্জ্বল দমক আবিষ্কার করা গেছে, এই প্রথম নক্ষত্রদের দমক তার চেয়েও অনেক বেশি উজ্জ্বল হবে।

কোয়েজার ও গ্যালাক্সিদের তুলনায় গামারশ্মি দমক বেশি সম্ভাবনাময়। কোয়েজার তৈরির জন্য লাগে অতিকায় কৃষ্ণবিবর যা আদিম যুগে বেশ বিরল। আর গ্যালাক্সিদের মধ্যে কেবল উজ্জ্বলগুলোর দিকেই হাবলের চোখ যায়, যাদের সংখ্যা টিমটিমে গ্যালাক্সিদের তুলনায় অনেক অনেক কম। কিন্তু গামারশ্মি দমক উজ্জ্বল, টিমটিমে যেকোনো গ্যালাক্সিতে তৈরি হতে পারে এবং যেখানেই হোক না কেন তাকে দেখা যাবেই। সুতরাং গামারশ্মি দমক আবিষ্কার করে তখনকার মহাবিশ্বের গড়পড়তা অবস্থা অনেক ভালো বুঝা সম্ভব।

তবে সমস্যা হচ্ছে, ৯৯ শতাংশ গামারশ্মি দমকই সরাসরি আমাদের দিকে লক্ষ্য করে আসে না। আর যেগুলোও বা আমাদের দিকে আসে সেগুলোর মধ্যে মাত্র কয়েকটা অনেক বেশি লোহিত সরণের, অর্থাৎ অনেক দূরের। তাই প্রতিদিন গড়ে একটা করে গামারশ্মি সনাক্ত করা গেলেও তাদের দিয়ে আদিম মহাবিশ্বের একটা নির্ভরযোগ্য চিত্র দাঁড় করাতে অন্তত এক দশক লাগবে। যে ‘সুইফ্ট গামা-রে বার্স্ট মিশন’ বর্তমানে কাজ করছে তা ততদিন টিকবে না।

তাই শীঘ্রই আরেকটা গামারশ্মি নভোদুরবিন পাঠাতে হবে, যাতে সে নতুন গামারশ্মি দমকের স্থানাঙ্কগুলো জেমস ওয়েব নভোদুরবিনে বা ভবিষ্যতের অন্যান্য শক্তিশালী ভূদুরবিনে পাঠাতে পারে। আগামী দশকেই ৩০ মিটার ব্যাসের তিনটা ভূদুরবিন কাজ শুরু করবে। ভবিষ্যতের এই দুরবিনগুলো কাজ শুরু করার পর কোয়েজার শিকারী, গ্যালাক্সি জরিপকারী, এবং গামারশ্মি সন্ধানী সবাই নতুন করে পালে হাওয়া পাবেন। মহাবিশ্বের সেই সময়টা সম্পর্কে আরো স্পষ্ট ধারণা পেতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।

এর মধ্যে আরো একটা অস্ত্র নিয়ে রেডিও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ময়দানে হাজির হতে শুরু করেছেন—নিম্ন কম্পাঙ্কের রেডিও দুরবিন। কোয়েজার-গ্যালাক্সি-গামারশ্মি দমক দিয়ে তো হাইড্রোজেনের হত্যাকারীদের সম্পর্কে জানা যায়। কিন্তু স্বয়ং হাইড্রোজেনই ২১ সেন্টিমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যে একটা বিকিরণ নিঃসরণ করে। পুনরায়নীভবন যুগের হাইড্রোজেন থেকে এই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের যে বিকিরণগুলো নিঃসৃত হয়েছিল তারা লোহিত সরণের কারণে বর্তমানে ১.৫ থেকে ৩ মিটারের মতো লম্বা হয়ে গেছে, অর্থাৎ বর্তমানে তাদের কম্পাঙ্ক ১০০ থেকে ২০০ মেগাহার্জ।

যে তরঙ্গটা ১.৫ মিটার লম্বা, অর্থাৎ যার কম্পাঙ্ক ২০০ মেগাহার্জ তার লোহিত সরণের পরিমাণ আনুমানিক ৬, অর্থাৎ পুনরায়নীভবনের একেবারে শেষদিকে সে হাইড্রোজেন ছেড়েছিল। আর যার দৈর্ঘ্য ২ মিটার সে তারও আগের, যারটা ৩ মিটার সে আরো আগের। যত বর্তমানের দিকে আসা যাবে, অক্ষত হাইড্রোজেনের পরিমাণ তত কমবে, এবং এই বিকিরণটাও তত কমবে, যেহেতু হাইড্রোজেন থেকেই সে নিঃসৃত হয়। তাই এই বিকিরণ বিশ্লেষণ করে আয়নীভবনের পুরো ইতিহাসটা বলে দেয়া যাবে।

কিছুদিন আগ পর্যন্তও এত কম কম্পাঙ্কের রেডিও বিকিরণ সনাক্ত করার কেউ ছিল না। ২০১২ সালে নেদারল্যান্ডের রেডিও জ্যোতির্বিজ্ঞান সংস্থা ‘অ্যাস্ট্রন’ প্রায় ২৫,০০০ এন্টেনার সমন্বয়ে ‘লোফার’ (LOFAR—LOw Frequency ARray) নামে এক দানব-দুরবিন তৈরি করেছে যা বর্তমানে পুনরায়নীভবনের হাইড্রোজেন সনাক্ত করার একেবারে দ্বারপ্রান্তে আছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় স্থাপিত মার্কিন দুরবিন ‘PAPER’ এবং অস্ট্রেলিয়ায় স্থাপিত দুরবিন ‘MWA’ ও একই উদ্দেশ্যে কাজ করে যাচ্ছে। আর ২০২৫ সাল নাগাদ SKA (Square Kilometer Array) নামে একটা দুরবিনের কাজ শেষ হবে যার হাজার হাজার এন্টেনা’র কিছু থাকবে অস্ট্রেলিয়াতে আর কিছু থাকবে দক্ষিণ আফ্রিকাতে। এই লক্ষচোখা দানব আদিম ইতিহাসের প্রতিটি ধাপের হাইড্রোজেনের বিস্তৃত মানচিত্র তৈরি করে ফেলতে পারবে।

আদিম মহাবিশ্ব সম্পর্কে জানার এই জোয়ার শুরু হয়েছিল ১৯৬৫ সালে, মহাবিস্ফোরণের ৪ লক্ষ বছর পরে অর্থাৎ পুনর্মিলন যুগে তৈরি হওয়া মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ (পটকিরণ) আবিষ্কারের মাধ্যমে। তবে ইতিহাসটা এখনো বেশ ধোঁয়াটেই রয়ে গেছে। ২০২৫ এ, পটকিরণ আবিষ্কারের ৬০ বছর পূর্তিতে, হয়ত অবশেষে মহাবিশ্বের মতো আমাদের ধোঁয়াশারও অবসান ঘটবে।

 

Related Articles

5 1 vote
Post Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
Back to top button
0
Rate & Give your feedback!x
()
x

পুলিন বকসী: প্রথমত শহীদ সাহেবের ডান পন্থার কারনে ভাসানী তার বিরোধীতা করেন নি। শহীদ সাহেবের তীব্র আমেরিকা প্রীতিই (সিয়াটো-সিন্টো চুক্তি) ন্যাপ গঠনের অনেকগুলো কারনের অন্যতম কারন।

দ্বিতীয়ত আপনি যেভাবে তাকে আইয়ুব খানের একজন প্রায় 'দালাল' বা 'চাটুকার' বানায়া দিলেন সেই ভাসানীই কিন্তু ৬৯ এ ব্যপক ভূমিকা রেখেছিল শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে। শুধু তাই না এই উনসত্তরের আন্দোলনের শুরুটাও ভাসানীদের হাত ধরে।

ধন্যবাদ।

Farid Ahmed: আমি বহু জনকে জিজ্ঞেস করেছি, কেউ আমাকে সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারে নাই কেনো মওলানা ভাসানী আইয়ুব খানের প্রতিনিধি হিসাবে চীনে গিয়েছিলেন। আশা করি আপনি আলোকপাত করতে পারবেন এ ব্যাপারে। তাঁর আইয়ুব প্রীতি আমার আবিষ্কার না। ষাটের দশকেই এ নিয়ে বিস্তর কথা উঠেছে। আমি আগের একটা লেখায় সব রেফারেন্স দিয়েছি। আমি ভাসানীকে এখনও দালাল কিংবা চাটুকার বলি নাই, যদিও বলা উচিত ছিলো আমার।

১৯৮৬-৮৭ সালে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন জালাল আহমেদ। ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি এরশাদের সাথে হাত মেলান। এরশাদ তাঁকে অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশ মিশনে সেকেন্ড সেক্রেটারি পদে নিয়োগ দেয়। জালাল আহমেদ সংগোপনে তাঁর গোপনে বিয়ে করা বউকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমান। এখন পর্যন্ত এই অপরাধে ছাত্রদল তাঁকে দালাল বলে। আমরাও তাঁকে এরশাদের দালালই বলতাম। দালালকে তো দালালই বলা লাগে, তাই না?

Marzia Prova: ফরিদ ভাই আইয়ুব শাসনের আমলে পাকিস্তানের জোরদার উন্নয়ন দেখা যাচ্ছিল৷ ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এর আগে তার উন্নয়নের দশক পালন করার প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছিল। ভাসানীর কথা ছিল, "পশ্চিম পাকিস্তান যদি পূর্ব পাকিস্তানের উপর শোষণ না বন্ধ করে, তবে পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম।" এখন তথাকথিত আইয়ুবের উন্নয়ন পূর্ব বাংলাতেও হয়েছিল। শোষণের বিপরীতে এই উন্নয়নকে যদি সফলতা হিসেবে দেখা হয়, তবে ভাসানী একজন পাকিস্তান নাগরিক হিসেবে সফল শাসক এর প্রতি মুগ্ধতা ছিলেন! তাই নয় কি?

আপনি জাস্ট এই বিষয়টা এখনকার বাংলাদেশের সাথে মিলান। উন্নয়ন দিয়ে সফলতাকে নির্ধারণ বাকি অনেক কিছুকে যখন আড়াল করা হয়, তখনও তো দেশের অনেক মানুষের সেই সফল শাসকের প্রতি মুগ্ধতা থাকে৷ সম্ভবত ভাসানীর আইয়ুব প্রীতি সে জায়গা থেকে। জাস্ট আপনার লেখা আর কমেন্ট পড়ে এইটা মনে হইল। এই মানসিকতা অবশ্যই দ্বান্দ্বিক এবং স্ববিরোধী কোন সন্দেহ নাই৷ হয়ত এই মানসিকতা না থাকলে ভাসানী অন্যভাবে স্মরণীয় থাকতেন।

Farid Ahmed: আইয়ুব খানের সাথে মওলানার ওই উন্নয়নমূলক মুগ্ধতার সম্পর্ক ছিলো না। উনি ৬৩-তে সরকারী একটা ডেলিগেশন টিমের প্রধান হিসাবে চিনে যান। আইয়ুব খান সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে তাঁর বিন্দুমাত্র বিবেকে বাধেনি, যেখানে ৬২-তে বিশাল এক ছাত্র আন্দোলন হয়ে গিয়েছিলো আইয়ুব খান সরকারের গণবিরোধী শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে।


মওলানা ভাসানী ৬৯ এ ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে। শুধু তাই নয়, এই উনসত্তরের আন্দোলনের শুরুটাও ভাসানীদের হাত ধরে। তাহলে তাকে আইয়ুব খানের একজন প্রায় 'দালাল' বা 'চাটুকার' হিসেবে দেখাটা কি যৌক্তিক?

এই বক্তব্যের মূল কারণ হচ্ছে আমি আমার লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে মওলানা ভাসানী আইয়ুব খানের প্রতি সহানুভুতিশীল ছিলেন, তাঁর সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে চীন গমন করেছিলেন এবং ১৯৬৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন দেবার প্রতিশ্রুতি দেবার পরেও মওলানা ভাসানী গোপনে আইয়ুব খানকে সমর্থন দিয়েছিলেন।

এই অভিযোগটির লজিক্যাল ফ্যালাসিটা আগে বলি। তারপর আমি আইয়ুবের সাথে ভাসানীর সখ্যতা ব্যাখ্যা করবো।

ঊনসত্তরে মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন, ঊনসত্তরের আন্দোলনের তাঁর দুর্দান্ত ভূমিকা ছিলো, এই তথ্য দিয়ে কি তাঁর অন্য কাজগুলোকে জাস্টিফাই করা যায়? যায় না। আমি গতকাল একটা অপরাধ করেছি, আর আজকে একটা ভালো কাজ করেছি। এখন যদি আমি যুক্তি দেই যে আমি তো আজকে ভালো কাজ করেছি, তারপরেও আমাকে আপনারা অপরাধী বানিয়ে দিলেন, সেটা কেমন লাগবে আপনাদের কাছে? তিনি তেষট্টিতে আইয়ুবের প্রতিনিধি হিসাবে চীনে গেছেন, এই অভিযোগ ঊনসত্তরের ভূমিকা দিয়ে আড়াল করাটা আর যাই হোক না কেনো যুক্তিসঙ্গত কোনো কাজ হতে পারে না। ঊনসত্তর নয়, মূলত আটষট্টি সাল থেকে আইয়ুবের সমালোচনায় নামেন মওলানা ভাসানী। কিন্তু তেষট্টি থেকে আটষট্টির আগ পর্যন্ত তাঁর ভূমিকা কী আইয়ুবের ব্যাপারে? আসুন, ইতিহাস থেকে দেখি আমরা তিনি কী করেছিলেন সেই সময়ে।

১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসের ৭ তারিখে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার মির্জা দেশে মার্শাল ল জারি করেন। তিনি যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং আইয়ুব খানকে সুপ্রিম কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ দেন। ইস্কান্দার মির্জার দুর্ভাগ্য, এর মাত্র তিন সপ্তাহ পরে অক্টোবর মাসের ২৭ তারিখে আইয়ুব খান তাঁকেই উৎখাত করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নেন। ইস্কান্দার মির্জা মার্শাল ল জারি করার পর ১২ তারিখে নিরাপত্তা আইনে মওলানা ভাসানীকে বন্দি করেন। দীর্ঘ চার বছর তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন।

১৯৬২ সালের ৩রা নভেম্বর তাঁকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর পরই তিনি আইয়ুব খানের সাথে দেখা করেন, যেটা প্রবলভাবে সমালোচিত হয়। দেওয়ান শামসুল আরেফিন তাঁর, “Bhashani, the maulana Bhashani, the comrade” বইতে লিখেছেন,

“After more than four years in prison, the Moulana was released on November 3 1962. A few days after his release, he met with President Ayub in Rawalpindi. The Ayub-Bhashani meeting created a mixed reaction among the left political circles.”

আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের সময় পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় মিত্র ছিলো যুক্তরাষ্ট্র। চীনের সাথে পাকিস্তানের সীমান্ত নিয়ে বেশ ঝামেলাই ছিলো বলা চলে। সীমান্ত বিরোধ নিয়ে ১৯৫৯ সালে চীনের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। দুই পাশে দুই শত্রু দেশ ভারত এবং চীনকে পুষে রাখাটা খুবই ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ এই বিবেচনা থেকে চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের দিকে অগ্রসর হয় পাকিস্তান। এর জন্য অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের রোষেরও শিকার হয় পাকিস্তান। কিন্তু, তারপরেও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীনকে প্রাধান্য দেবার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান। ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো চীন সফর করেন।

পঞ্চাশের দশক থেকেই মওলানা ভাসানীর সাথে চীনের সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো রাজনৈতিক কারণে। চীনের সাথে সম্পর্ক আরো দৃঢ় করার জন্য মওলানার সাহায্য কামনা করেন তিনি। ১৯৬৩ সালের অগাস্ট মাসে তিনি মওলানাকে রাওয়ালপিণ্ডিতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। পত্র-পত্রিকাতে আইয়ুব-ভাসানী আঁতাতের খবর প্রকাশিত হতে থাকে। ভাসানী এগুলোকে ‘স্বার্থান্বেষী মহলের ছড়ানো গুজব’ বলে উড়িয়ে দেন।

এই আঁতাত যে গুজব না, সেটা টের পাওয়া যায় পাকিস্তানের প্রেরিত ডেলিগেশন টিমের প্রধান হওয়ার মধ্য দিয়ে। জাতীয় স্বার্থে তিনি এই দলের প্রধান হিসাবে চীনে যাচ্ছেন বলে তিনি জানান।

সেপ্টেম্বর মাসের ২৫ তারিখে ঢাকা থেকে প্রথমে করাচি যান তিনি। সেখান থেকে রেঙ্গুন হয়ে চীনে পৌঁছান মওলানা ভাসানী। পিকিং এ উষ্ণ অভ্যর্থনা পান তিনি। চীনের প্রিমিয়ার চৌ এন লাই এর সাথে সাক্ষাতে আইয়ুবের সরকারের জন্য সমর্থন প্রত্যাশা করেন তিনি। তিনি বলেন,

“I am old, perhaps I will not have another chance to come to china; I hope you and your country’s government can fully work together with Ayub khan’s government and his representative General Raza.”

চীনের যাবার সুযোগ তাঁর আরেকবারও হয়েছিলো। যদিও পরবর্তী এই সফর খুব বেশি প্রচারণা পায়নি। দেওয়ান শামসুল আরেফিন তাঁর বইতে লিখেছেন,

“Abdul Hamid Khan Bhashani paid another low-profile visit to China in 1964. The second visit was, in fact, more significant than the first one. This time he had exclusive talks with Chairman Mao, Premier Chou and other leaders including Den-Tsiao-ping.”

অগাস্ট মাসে রাওয়ালপিণ্ডিতে আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাৎ, তার মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে সরকারী প্রতিনিধি দলের নেতা হয়ে চীন সফর অন্য দল এবং নিজের দলের মধ্যেও তীব্র সমালোচনার সুত্রপাত ঘটায়। ন্যাপ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পিকিংপন্থী অংশ ভাসানীর নেতৃত্বে থেকে যায়, অন্যদিকে মস্কোপন্থী অংশ কমরেড মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে আলাদা হয়ে যায়।

পিকিং থেকে ফিরে আসার পরে শুধু মওলানা ভাসানী একাই নন, চিনপন্থী কম্যুনিস্টদের একটা বড় অংশ আইয়ুব খানের ভক্ত বনে যায়। আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের মহিমা কীর্তন করা শুরু করেন তারা। বাষাট্টির এতো বড় ছাত্র আন্দোলনের পরে যেখানে আইয়ুবের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার কথা ছিলো তাঁর, সেখানে তিনি আইয়ুব খানকে বিরক্ত না করার সিদ্ধান্ত নেন। ডক্টর নুরুন নবী তাঁর “Bullets of ‘71: A freedom fighter’s story” বইতে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন,

“After that visit, Moulana Bhashani declared his infamous policy statement, “Don’t disturb Ayub”. Bengali people were stunned. That was the biggest mistake of Moulana Bhashani’s political career.”

তারিক আলী চীনপন্থী বাম ছাত্রনেতা ছিলেন। তাঁর একটা বই আছে। বইটার নাম “Pakistan, military rule of peoples power”। বইটা প্রকাশিত হয়েছে দিল্লি থেকে ১৯৭০ সালে। এই বইতে তারিক আলী পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সাথে মাওলানা ভাসানীর নিবিড় সখ্যের কারণ অনুসন্ধান করে তার পটভূমি আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি তাঁর বইতে লেখেন, ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইউব খান মাওলানা ভাসানীকে পাকিস্তানের সরকারী প্রতিনিধি করে চীনে পাঠাতে চাইলে মাওলানা রাজি হন। সেখানে চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুং এর সাথে তাঁর যে গোপন সলাপরামর্শ হয় তার একটা বিবরণ তিনি মাওলানার কাছ থেকেই গ্রহণ করেছিলেন টেপ রেকর্ডারে।

তারিক আলী মওলানাকে প্রশ্ন করেছিলেন, “When you went to China what did Mao discuss with you when you met him?” এর উত্তরে মওলানা বলেছিলেন,

“মাও সে তুং আমাকে বলেন, “আপনি যদি সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন তাতে রাশিয়া, আমেরিকা এবং ভারতের হাতই শক্তিশালী হবে। আপনার কাজে হস্তক্ষেপ করা আমাদের নীতি বিরুদ্ধ, তথাপি আমরা আপনাকে সাবধানে এবং ধীর গতিতে আন্দোলনে অগ্রসর হতে অনুরোধ করবো। আপনার সরকারের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব আরো গাঢ় করার সুযোগ দিন।”

আগেই বলেছি, চীন থেকে ফিরে আসার পরেই মওলানা এবং তাঁর অনুসারীরা আইয়ুব খানের ভক্ত হয়ে যায়। সাপ্তাহিক ‘জনতা’ ছিলো ন্যাপের মুখপত্র। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন আনোয়ার জাহিদ। তিনি তখন ভাসানীর ব্যক্তিগত সচিব। আনোয়ার জাহিদ নিজেও আশির দশকে সামরিক শাসক এরশাদের দালালি এবং গোলামি করেছেন। তাঁকে সবাই ঝাঁড়ুদার মন্ত্রী হিসাবেই চিনতো। কারণ, তিনি একবার প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, এরশাদ যদি বলে, তবে তিনি রাস্তা ঝাঁড়ু দিতেও আপত্তি করবেন না। এই আনোয়ার জাহিদ ১৯৬৫ সালে সাপ্তাহিক জনতায় লেখেন, “There were only two Imperialist voices in Pakistan – Ayub and Vashani.”

আনোয়ার জাহিদের বক্তব্য পরিষ্কার, তিনি তাঁর নেতা এবং আইয়ুব খানকে একই কাতারে দেখেছেন। মওলানা ভাসানীর এই সামরিক শাসকের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের ফলাফল কী হতে পারে, সে সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মফিদুল হক লেখেন,

“১৯৬৩ সালে কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর জেনারেল আইউব আয়োজিত চীন সফরের পর থেকেই মাওলানা ভাসানীর পদস্খলন ঘটতে থাকে। চীনা রাষ্ট্র-নেতাদের আত্মস্বার্থ-প্রণোদিত নীতির কাছে মাওলানা ভাসানীর আত্মসমর্পণ এদেশের বাম রাজনীতির জন্য বিরাট দুর্ভাগ্যের সূচনা করে। রাজনৈতিক বিভ্রান্তি থেকে তিনি যে পথে পা দিয়েছিলেন তা শুধু আইউবের শাসনের সহায়ক ভূমিকা পালন করেনি, মাওলানা তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে সামরিক শাসকচক্রের যে সংযোগ গড়ে ওঠে তা পরবর্তী সময়েও বহু দুর্ঘটনার কারণ হয়েছিল।”

মওলানার নিজের দলের লোক হাজী দানেশও মওলানার সাথে আইয়ুব খানের সমঝোতা ছিলো বলে মনে করেন। এ কারণে আইয়ুবের বিরুদ্ধে তিনি বাম শক্তিগুলোকে একত্রিত করেননি বলে অভিযোগ করেন তিনি। হাজী দানেশ ছিলেন ন্যাপের সহ-সভাপতি। মওলানার সাথে তাঁর কোন্দল এমন পর্যায়ে যায় যে তিনি সহ একটা বিরাট অংশ ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে ন্যাপ থেকে বের হয়ে যান। ১৯৭১ সালের ৮ই জানুয়ারি হাজী দানেশ এক খোলা চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে তিনি বলেন,

“আপনি বিশ্বাস করতেন যে ইস্কান্দর মির্জা ও আইউব খান দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করবে। আইউবের বিরুদ্ধে বামপন্থী শক্তিগুলোকে সংগঠিত করার ব্যাপারে আপনার অনীহা এটাই প্রমাণ করে যে, শোষক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে আপনার যোগ ছিল। আমি এটা বিশ্বাস করতে পারিনা যে, আপনার ও ন্যাপের এ ধরনের নীতির মাধ্যমে লাখ লাখ শোষিত মানুষের মুক্তি আসবে।”

 

Masudur Rahman: ১৯৭০-এর জানুয়ারিতে সন্তোষে কৃষক সম্মেলনে মাওলানা ভাসানী আরও বললেন, ‘আমাদের ভাগ্য আমাদেরই গড়ে নিতে হবে। পিন্ডির গোলামি ছিন্ন করতে হবে।’ ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বরের বঙ্গোপসাগরীয় সাইক্লোনের প্রেক্ষাপটে উনি আবার সরাসরি বললেন ‘স্বাধিকার স্বায়ত্তশাসন নয়, চাই স্বাধীনতা।’

ফরিদ, তোমার লেখা আমি গুরুত্ব সহকারে পড়ি; অনেক কিছু জানতে পারি, শিখতে পারি। কোন মানুষই ভুলের উর্ধ্বে নন, যেমন ভাসানী। কিন্তু, তাই বলে তাকে আইয়ুব ইয়াহিয়ার সহচর বানিয়ে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিলে! মওলানা ভাসানীকে নিয়ে তোমার লেখাগুলি পড়ে আমি সত্যি হতাশ!

Farid Ahmed: আমিতো কোনো সিদ্ধান্ত দেই নাই। সবই কোট করেছি আমি। তিনি আইয়ুবের সহচর ছিলেন, এই অভিযোগ তখনই উঠেছে।

আমার বিশ্লেষণ আমি বলতে পারি। যে আইয়ুব ক্ষমতা দখল করে তাঁকে কারাগারে পাঠালো, তিনি কারাগার থেকে বের হয়ে সেই আইউবের প্রতিনিধি হয়ে চীন যান ঠিক কী কারণে? কোন স্বার্থে? আপনি আমাকে একটা মাত্র যৌক্তিক কারণ বলবেন মাসুদ ভাই এ ব্যাপারে। আমি দ্বিতীয় যুক্তিও শুনতে চাইবো না।

তিনি সিআইএ-র রিপোর্ট ইয়াহিয়াকে দিয়েছেন? কেনো? যেখানে তিনি নিজেই বলছেন এই দলিলে দেখা যাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার ষড়যন্ত্র চলছে। উনি কি বিচ্ছিন্নতার বিপক্ষে ছিলেন? বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার একেকজনের একেক ধরনের কর্মপন্থা ছিলো, সেই পন্থা নিয়ে সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু এই দলিল হস্তান্তর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষেই তাঁকে দাঁড় করিয়ে দেয়।

ভাসানী একজন স্ববিরোধী মানুষ ছিলেন। উনি স্বাধীনতার পক্ষেও বহু কথা বলেছেন, আবার বিপক্ষেও বলেছেন। আপনারা শুধু পক্ষেরটা জানেন, বিপক্ষেরটা না। আমি উনি স্বাধীনতার বিপক্ষে কী কী বলেছেন সেগুলো নিয়েই আরেকটা লেখা লিখবো দুই একদিনের মধ্যেই।

Swapan Mahmud: "পাকিস্তান ওয়ালাইকুমআসসালাম" এটাই স্বাধীনতার প্রথম প্রতীকী ঘোষণা।

Farid Ahmed: ওই এক তথ্য নিয়েই পড়ে থাকেন। মোল্লাদের অন্ধত্ব এবং একদেশদর্শীতা আমাকে পীড়া দেয় না, কিন্তু, আপনাদেরটা দেয়। কারণ, প্রগতিশীল বলে দাবি করেন আপনারা। দাবি করেন, অথচ সব তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে আসেন না। পূর্বানুমান সিদ্ধান্ত নিয়েই বসে থাকেন।

১৯৬২ সালে ছাত্ররা আইউব খানের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করেছিলো শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে। ভাসানী কি জানতেন না যে এই দেশের ছাত্র এবং জনগণ আইউব জান্তাকে বাতিল করে দিয়েছে? সেই জান্তার প্রতিনিধি হিসাবে ১৯৬৩ সালে তিনি চীনে যান কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর আপনাদের মতো বায়াসড লোক কোনো দিনই দিতে পারবেন না, খালি ওই এক ওয়ালাইকুম সালাম নিয়েই পড়ে থাকবেন আপনারা।

Masudur Rahman: খন্ডিত বিশ্লেষণ করে প্রমান করা যাবে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য '৭০ এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন নাই। একটি বিষয় অন্তত আমার কাছে পরিষ্কার, ভাসানীর তুমুল জনপ্রিয়তা থাকা সত্যেও ক্ষমতার লোভ তার ছিল না। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে উনিও কষ্ট পেতেন ভাসানীর এই পোস্টমর্টেম দেখে কারন উনি জানতেন উনার বঙ্গবন্ধু হওয়া পিছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশী। বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা থেকে মুক্ত করার জন্য যে গন আন্দোলনের দরকার ছিল, তা ভাসানী ছাড়া আর কে করতে পারতেন? তুমি তো ১৯৬৩ সনেই আটকে থাকলা, ফরিদ!

Farid Ahmed: উনার সামরিক শাসক সখ্যতা নিয়ে বিস্তারিত আমি লিখেছি মাসুদ ভাই। শুধু ৬৩-তে আটকে থাকিনি। যদিও ওইটাই সবচেয়ে ভাইটাল মুহুর্ত। কোন কারণে তিনি আইয়ুবের প্রতিনিধি হয়ে চীনে গিয়েছিলেন, সেটা জানাটা খুবই জরুরী আমাদের জন্য। মওলানা বাদে অন্য কেউ হলে আমি এক বাক্যে তাঁকে আইয়ুবের দালাল বলে দিতাম। ব্যক্তিটা উনি বলে আমি এখনো এর একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা খুঁজছি।

১৯৭২-১৯৭৬

মওলানা ভাসানী ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক হক-কথা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করলেও মুজিব সরকারের জাতীয়করণ নীতি এবং ১৯৭২-এর সংবিধানের এর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। ১৯৭৩ সালে খাদ্যের দাবিতে ঢাকায় ১৫-২২ মে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ১৯৭৪-এর ৮ এপ্রিল হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি গঠন করেন। একই বছর জুন মাসে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলে টাঙ্গাইলের সন্তোষে গৃহবন্দি হন। ১৯৭৬-এর ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লং মার্চে নেতৃত্ব দেন। একই বছর ২ অক্টোবর খোদাই খিদমতগার নামে নতুন আর একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

— উইকিপেডিয়া থেকে

Supik Anwar: ৫০ বছর ধরে বহুমাত্রিক ভাবে গন মানুষ এর রাজনীতি করা একজনকে শুধু কয়েক বছরের রাজনীতি দিয়ে মুল্যায়ন কতটুকু যুক্তিযুক্ত!? ঐ সময়ে উনি হাসপাতালে ছিলেন।পরে ভাসানী হাসপাতালে থাকা অবস্তায় মোশতাক উনাকে একদিন দেখতে গিয়েছে। তখন উনি মোশতাককে বলেছিলেন "আমার মুজিবররে তোমরা মাইরা ফেললা"!

Farid Ahmed: আপনি আপনার রেফারেন্স দেন। আর আমি আমার রেফারেন্স দিচ্ছি।

Supik Anwar: একজন সাংবাদিক (নামটা মনে পড়ছে না) উপস্থিত ছিলেন অই সময়। পরে উনি সহ সবাইকে রুম থেকে বাইরে যেতে বলেন মোশতাক। মোশতাক বেশ কিছুক্ষণ ভাসানীর সাথে একান্তে কথা বলে।এগুলা ভাসানীকে নিয়ে লিখা একটা কলামে পড়েছিলাম।মনে হয় ইরফানুল বারীর। আর ৭৫ এর পর উনি অনেক অসুস্থ ছিলেন। এই সুযোগ এ মোশতাক তার লেজেটিমিসির জন্য উনাকে ব্যবহার করেছে। আর জাতির জনক কে উনি কথটা পছন্দ করতেন সেই কথা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আছে। এছাড়া উনি মোশতাক ১ং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক থাকার পর ও তাকে ডিঙিয়ে মুজিবকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করেন সামশুল হক এর অনুপস্থিতিতে। আর আগরতলা মামলায় তার প্রিয় মুজিবরকে জেল থেকে বের করার হুংকার এবং তার ফলাফল তো জানাই আছে।

Farid Ahmed: এটা কোনো রেফারেন্স হলো? আসেন এর বিপরীতে আপনাকে রেফারেন্স দেখাই। কয়েকটা পত্রিকার কাটিং দেখাচ্ছি। কারো মুখের কথার চেয়ে পত্রিকা অনেক বিশ্বাসযোগ্য।

doc

Supik Anwar: মওলানা ভাসানীকে নিয়ে কয়েকটা কৌতুহল জাগানো প্রশ্ন পেলাম, এমনকি আমার লেখা শেয়ার করা কিছু মানুষও এই সব মন্তব্য পেয়েছেন দেখলাম। একটা প্রশ্ন হলো, ভাসানী ১৫ অগাস্টের হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করেছেন। মোশতাককে সমর্থন দিয়েছেন। জিজ্ঞেস করলাম, জেনেছেন কোথায়?

— তখনকার দৈনিক পত্রিকায়। বড় করে ছাপা হয়েছে তো।

— কিন্তু তখন যে চারটা মাত্র পত্রিকা আমাদের খবরের উৎস, সেগুলো তো এর আগেই বাকশাল সরকার সরকারী মুখপাত্র বানিয়ে বাকি সবগুলো পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলো। মাওলানার প্রতিষ্ঠিত হক কথাকে নিষিদ্ধ করেছিল ১৯৭২ সালেই। ফলে মোশতাকের আমলে যে তথ্য আমরা খবরের কাগজ সূত্রে পেলাম, সেগুলোর নির্ভরযোগ্যতা কী? কিংবা, এইভাবে গণমাধ্যম কবজা করার পরিণাম যে মানুষের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের সুযোগ এবং অভ্যাস দুটোই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল বাকশালের মাধ্যমে, চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে, আরো নানান সব নিপীড়নমূলক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে, এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হলো যে দিনে-দুপুরে রক্ষীবাহিনীর হাতে খুন হলেও সে খবর আর পত্রিকায় ছাপা হবে না, যে হাতিয়ারগুলো ব্যবহার করেই মোশতাকের মন্ত্রীসভায় লীগের নেতাদের স্বেচ্ছায় কিংবা বলপ্রয়োগে অংশ নেয়ানো হলো, তার নিন্দা কখনো করেছেন? ৯৫ বছরের বুড়ো ভাসানী ১৫ অগাস্টের বহু আগে থেকেই গৃহে অন্তরীণ ছিলেন। এই বয়োবৃদ্ধ মানুষটিকে কারা গৃহবন্দি করে রেখেছিল? তার নিন্দা করেছেন? সেই ঘরে আটকে থাকা, দুনিয়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারিতে আটকে রাখা অসুস্থ মানুষটাকে হাসপাতালে মোশতাক দেখতে গিয়েছিলেন, আওয়ামী নেতাদের মত তিনি বঙ্গভবনে গিয়ে মোশতাককে সমর্থন জানান নাই। এই ছবিটিই ফলাও করে পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, এবং পত্রিকাতে বাকি সব যা জানি সেটাও বাকশালের সংস্কৃতিতে কবজা করা পত্রিকার ভাষ্য, ভাসানী কি বলেছেন তা সেখানে কিভাবে মিলবে?

অভিযোগ করার আগে অভিযোগের প্রেক্ষাপটা তাই মনে রাখলে বোঝা যায়, অভিযোগকারীই ভয়াবহ একটা পরিস্থিতির সমর্থক, যেখানে কারও মতামত জানারও উপায় ছিল না, এমনই ভয়াবহ ছিল বাকশালি শাসন। তবুও ভাসানী কী মনে করতেন, সেটা জানতে ভাসানীর ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বাসযোগ্য মানুষদের কাছেই যেতে হবে। তাদের অনেকের কাছেই শুনেছি, নিজের সমর্থকদের ওপর এত নিপীড়নের পরও, আওয়ামী লীগের এত গণবিরোধী অবস্থানের পরও ভাসানী ১৫ অগাস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে দারুণ ব্যাথা পেয়েছিলেন। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক বিরোধিতা তিনি যতই করুন না কেন, তাকে পুত্রের মতই দেখতেন। প্রতিহিংসাপরায়ণ তিনি ছিলেন না, যদিও জনগণের বলপ্রয়োগে গভীর আস্থা পোষণ করতেন। সেই বলপ্রয়োগের স্মরণীয়তম দৃষ্টান্তটার কথাই বরং বলি।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাতেই হয়তো শেখ মুজিবুর রহমানের ফাঁসি হয়ে যেতো বঙ্গবন্ধু উপাধি পাবার আগেই; কেউ তাকে উদ্ধার করার সাহস কিংবা স্পর্ধা দেখায়নি, বন্দি ছিলেন তিনি ঢাকা সেনানিবাসে। '৬৯ এর প্রবল অভ্যূত্থানের ওপর দাঁড়িয়ে ভাসানী হুমকি দিয়েছিলেন পাক সামরিক জান্তাকে: মুজিবকে না মুক্তি দেয়া হলে জনতাকে নিয়ে তিনি ক্যানটনমেন্ট থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসবেন। আগুন ঝরানো মাওলানা তার নাম এমনি এমনি হয়নি।

এই হলো ভাসানী। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ৫০ বছর পূর্তিতে তার প্রাবল্যকে বুঝতে হলে খুচরো খুচরো প্রশ্ন করে কাজ হাসিল হবে না। অনেক বড় অকৃতজ্ঞতা এবং নিমকহারামি থেকেই ভাসানীকে নিয়ে এই জাতীয় মিথ্যা গুজব মোসাহেবরা ছড়িয়ে থাকে।

— (ফিরোজ আহমেদ)

Farid Ahmed: এটা পড়েন। আগুণ ঝরানো মওলানার আসল পরিচয় পাবেন। মুদ্রার অপর পিঠের মওলানা ভাসানী : জাফর ওয়াজেদ ↑। অলি আহাদের একটা বই আছে। বইটার নাম হচ্ছে, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-১৯৭৫। সেই বইতেও শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডে ভাসানীর সমর্থনের কথা বলা আছে। ভাসানী হাসপাতালে ভর্তি হন নভেম্বরের ২১ তারিখে। তিনি তারবার্তা পাঠান শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরের দিনই। তখন তিনি সন্তোষে। হাসপাতালে তিনি খন্দকার মোশতাককে কী বলেছেন, সেটা কোনো পত্রিকায় আসেনি। তিনি যে খুনি সরকারকে অভিনন্দিত করেছেন, তাদের সমর্থন জানিয়েছেন, এগুলো সব পত্রিকাতেই এসেছে। তাঁর নামে এগুলো বানানো খবর হলে তিনি অবশ্যই আপসেট হতেন এবং এগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। এদেরকে সহযোগিতা দিতেন না। বাস্তবে কিন্তু তা হয়নি। ফারাক্কা লং মার্চের সামনের সারিতে তিনি ছিলেন। কিন্তু, এর পিছনের পুরোটাই সায়েমের অবৈধ সরকার তথা জিয়াউর রহমান ছিলো।

doc

Supik Anwar: শুধুমাত্র পত্রিকার কয়েকটি লিখার উপর ভিত্তি করে উনাকে বারবার কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন তাতে কি সঠিক ইতিহাস প্রতিফলিত হচ্ছে!? যেই মানুষ সারা জীবন এই অঞ্চল এর মানুষকে নিয়ে মুক্তি সংগ্রাম করেছেন সেই আসাম থেকে বাংলা। কংগ্রেস থেকে বের হয়ে চিত্তরঞ্জন দল, তার পর মুসলিম লীগ এর সাথে পাকিস্তান আন্দোলন, জমিদার বিরোধী আন্দোলন , ভাষা সংগ্রাম, কৃষক আন্দোলন, লাইনপ্রথা, আওয়ামীলীগ সৃষ্টি, যুক্তফ্রন্ট, পাকিস্তানকে ওলাইকুম বলা, কাগমারী সন্মেলন, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতা, ১৯ দফা,৬৯ এর গন-আন্দোলন, ৭০ এর প্রলয়কারী তুফান, ইলেকশন এ আওয়ামীলীগকে সমর্থন, স্বাধীনতা সংগ্রাম,লং মার্চ সহ আরো মাটি ও মানুষের জন্য অনেক সংগ্রাম করা মানুষকে ইতিহাস এর ক্রনলজিকাল পাঠ না করে শুধুমাত্র কয়েকটি ঘটনার খণ্ডিত পাঠ ইতিহাসকে অবজ্ঞা করার মতই।

রেফারেন্স —
মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডের খবর শুনে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ঘটনার কয়েক দিন পর তিনি চিকিৎসার জন্য পিজি হাসপাতালে ভর্তি হন। এ সময়ে খোন্দকার মোশতাক আহমদ তার সরকারী স্টাফদের সাথে নিয়ে হুজুরের সংগে দেখা করেন। সেই বহরে সাবিহউদ্দীন আহমদও ছিলেন। তিনি তখন তার পি আর ও ছিলেন। আমি হুজুরের কেবিন কক্ষেই ছিলাম। এর একটু আগেই ফনি ভূষণ মজুমদার তার কেবিনে ফিরে গেছেন। তিনি দিনে একবার হলেও হুজুরের শরীরের খবর নিতে আসতেন। হুজুরের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও ভক্তি দেখে অবাক হয়েছি। কেবিনে ফিরে যাবার সময়ে তিনি আমাকে হুজুরের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলতেন। হুজুরের শরীর তখন খুবই খারাপ ছিলো। এখানে আসার আগে তিনি কুমুদিনী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। খোন্দকার মোশতাক কেবিনে ঢুকলে হুজুর তার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকান। বসতেও বলেননি। এক সময়ে তিনি বলেই ফেললেন "আমার মজিবরকে তোমরা মেরেই ফেললে!" তিনি ক্ষোভের সঙ্গে তাকে আরো বলেন "দুই আনার মুড়ি খেয়ে সারাদিন দলের কাজ করেছে আর তোমরা নেতা হইছো!" রাগ ও ক্ষোভের মাত্রা বাড়তে থাকলে এক সময়ে মোশতাক আমাকে একটু বাইরে যেতে,বলেন। আমি হুজুরের ঔষুধ দিয়ে বরান্দায় এসে দাঁড়াই। চলবে... [একুশে পদক প্রাপ্ত ছড়াকার আবু সালেহ্ এর টাইম লাইন হতে]

মোস্তাককে সমর্থন দেয়ার বরাত সরকারী প্রচার মাধ্যম। তখন দেশের পত্রিকার সংখ্যা ছিল ৪টি এবং ৪টিই সরকারী। এ অবস্থায় ১৫ আগস্টের পরপর যখন বিবৃতিটি প্রকাশিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে, তখন সরকারি মালিকানাধীন দৈনিকের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে স্বাভাবিক কারণেই। শুধু তা-ই নয়, মওলানা ভাসানীর কথিত বিবৃতিটি উদ্ধৃত করা হয় ‘বিশ্বস্ত সূত্রের’ বরাত দিয়ে। সততা ও সদিচ্ছা থাকলে বিশেষ দৈনিকটি থেকে সরাসরিই বিবৃতিটি উদ্ধৃত করা সম্ভব ছিল এবং ইতিহাস গবেষণার দৃষ্টিকোণ থেকে তেমনটি করা প্রয়োজনও ছিল। কিন্তু সহজবোধ্য কারণে দৈনিকটির নাম পর্যন্ত বলা হয় না বরং আশ্রয় নেয়া হয় ‘বিশ্বস্ত সূত্রের'।
[শাহ আহমদ রেজা]

Farid Ahmed: আপনি ঝোপে ঝাড়ে বাড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছেন। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরেও মওলানা ভাসানী রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, রাজনীতির মাঠে ছিলেন। কারণ, ফারাক্কা মিছিলের মতো বিশাল এক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তাঁর মতো সাহসী লোক নিশ্চয় ময়দানে প্রতিবাদ করেছেন, মিছিল মিটিং করেছেন। জাস্ট, কোনো একটা পত্রিকার একটু কাটিং দেখান আমাকে এ ব্যাপারে। আমি সবই পাঠ করেছি। এই লোক শেষবেলায় একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করাতো দূরের কথা, বরং সেটাকে সমর্থন করেছেন। এটাও ইতিহাস পাঠেরই অংশ।

Adil Mahmood: ভাসানী যে রকম ফ্লিপ ফ্লপ স্ববিরোধী আচরণ পাকিস্তান আমল থেকে করে গেছেন ওনার পক্ষে ব্যাক্তিগত পর্যায়ে মোশতাককে এই ধরনের কথা বলা এমন কিছু অসম্ভব না। এতে কোন সন্দেহ নাই যে রাষ্ট্রপ্রধান মুজিবের প্রতি তার গভীর বিরাগ থাকলেও ব্যাক্তি মুজিবকে উনি আজীবনই স্নেহ করে গেছেন। ব্যাক্তি মোশতাককে তোমরা এইটা কি করলা বলা এবং একই মোশতাকের সরকারকে অভিনন্দন জানানও অন্তত মাওলানার পক্ষে অসম্ভব কিছু না। সরকার ষড়যন্ত্র করে বিবৃতি ছাপিয়েছে এই ধরনের যুক্তিতে ৭৫ এর পর রাতারাতি ভোল পালটানো সবাই সাফাই গাইতে পারে এবং গায়। যারা মোশতাক মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়েছিল সে সব লীগ নেতা দাবী করেছে তাদের বন্দুকের মুখে নেওয়া হয়েছিল। ভাসানী ছিলেন পরিষ্কার বঙ্গবন্ধু সরকার বিরোধী সোচ্চার কণ্ঠ এবং লক্ষণীয়ভাবে দিনে দিনে কট্টর দক্ষিণপন্থীতে বিবর্তিত। বঙ্গবন্ধু সরকারের পতনের পর ডানপন্থী মোশতাকের প্রতি তার রাজনৈতিক সমর্থন এমন কি অবাস্তব যে সেটাকে নানান ষড়যন্ত্র তত্ত্ব অমূকে এই শুনেছে সেইই শুনেছে যার ভিত্তিতে সত্য হতে পারে না এইসব দাঁড়া করাতে হবে সেটাই বুঝি না। ভাসানীর পূর্ন ব্যবচ্ছেদ করলে বরং আরও অনেক বিতর্কিত কাজকারবার পাকিস্তান আমল থেকেই দেখা যায় যেগুলির কাছে এই মোশতাক অধ্যায় এমন কিছু না।

বঙ্গবন্ধুর আরেক সিনিয়র রাজনৈতিক কলিগ ৫৬ সালের প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান যার কেবিনেটে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী ছিলেন সেই আতাউর রহমান খান বঙ্গবন্ধুর পতনের পর ১৫ই আগস্ট নাজাত দিবস ঘোষণা করেছিলেন। মজার ব্যাপার হল এই আতা খান সাহেবই মোটে ৪ মাস আগে বঙ্গবন্ধুর নানান গুণগান গিয়ে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। আমার তো মনে হয় বঙ্গবন্ধু আমলেও ওনার নামে সরকারী পত্রিকায় মিথ্যা বিবৃতি দেওয়ানো হয় আর মোশতাক আমলে তো আমরা জানিই যে পত্রিকায় যার নামে যা ছাপা হয়েছিল সবই বানানো।

Swapan Mahmud: ভাষাণী-মুজিব গুরু শিষ্য দুজনই নির্বিশেষে মানুষ।দুজনেরই ভুল ছিল। এখন তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় না রেখে এ বিষয়গুলো মোকাবেলা করতে গেলে বঙ্গবন্ধু কেও আওতায় আনতে হবে। ভিয়েতনাম দিবসে মতিউল-কাদের হত্যা (স্বাধীন বাঙলাদেশে রাজপথে প্রথম হত্যা), কমরেড সিরাজ শিকদার কে পুলিশি হেফাজতে হত্যা (বাঙলাদেশে প্রথম বিচার বহির্ভূত হত্যা),দিন দুপুরে জাসদ অফিস জ্বালিয়ে দেয়া (১৯৭৩)।এই বিষয়গুলোও সামনে নিয়ে আসলে কী জামাত-শিবির বলা শুরু হবে।(বিতর্ক করার জন্য কমেন্ট করছি না এবং এ প্রসঙ্গে আর কোন কথা আমি বাড়াব না)

Farid Ahmed: মুজিবের ভুল নিয়ে তো আমরা কথা বলি। এগুলোর কোনোটাতেই তো তাঁকে ছাড় দেওয়া হয় না। একটা অপরাধকে খণ্ডন করতে যখন আরেকটাকে আনা হয়, তখন আসলে সেই অপরাধকে ঢাকার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। আপনি মুজিবকে বাদ দিয়ে পরিষ্কার করে শুধু ভাসানীর অপরাধকে অপরাধ বলতে পারছেন না কেনো? মুজিবের অপরাধের আলাপ যখন আলাপ করা হবে, তখন না হয় মুজিবকে ধোলাই দেওয়া যাবে। অন্যের অপরাধকে এনে তুলনা কখন করা হয়, সেটা আপনার না জানা থাকার কথা না। তাঁর সরকারের সবচেয়ে কট্টর সমালোচক হবার পরেও, মওলানার ক্ষেত্রে শেখ মুজিব যে উদারতা এবং ভালবাসা দেখিয়েছেন, প্রতিদানে মওলানা তাঁর ধারে কাছেও যেতে পারেন নাই। অথচ বয়োজ্যেষ্ঠ হিসাবে উল্টো ভূমিকাটা নেবার কথা ছিলো তাঁর।

Adil Mahmood: বঙ্গবন্ধু বা মুজিব সরকারের ভুলের কারনে ভাসানীর ভুল যদি ব্যাখ্যা করা যায় তাহলে অবশ্যই স্বাধীন বাংলাদেশে ভাসানীর মূল্যায়নে তৎকালীন সরকারের ভুলগুলিও আমলে আনা উচিত; এতে সমস্যা নাই। কিন্তু তাই বলে ভাসানীর ভুল ব্যালেন্স করার জন্য মুজিব সরকারের ভুলও পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের খাতিরে আনতে হবে তাহলে সেটা যৌক্তিক বিশ্লেষণ বলা যায় ন। এটা হয়ে যায় এখনকার প্রচলিত "অমুক ঘটনার সময় আপনি কোথায় ছিলেন" জাতীয় এগ্রিসেভ ডিফেস। এই ধরনের আক্রমণাত্মক ডিফেন্স সাজানো হয় নিজের পছন্দের দল বা ব্যাক্তির সমালোচনা আড়াল করার লক্ষ্য নিয়ে - আমি হয়ত খারাপ কিন্তু অপরপক্ষ তো আরো খারাপ। সে নিয়ে বল না কেন!

Iftakhar Ahmed Babu: আপনার এই পেপার কাটিং এর সত্যতা পাওয়া যায়নি ৷ সেরকম কোন বিবৃতি পাঠান হয়নি ৷

Farid Ahmed: পেপার কাটিং এর সত্যতা মানে কী বাবু ভাই? পত্রিকায় ছাপা হয়নি এই বিবৃতি, নাকি পত্রিকাওয়ালারা উনার নামে মিথ্যা বিবৃতি লিখেছে?

Iftakhar Ahmed Babu: বঙ্গভবন থেকে কেউ মিস কোট করেছিল ইচ্ছাকৃত ভাবেই l এটা নিয়ে অনেক অনুসন্ধান হয়েছে ৷ যে কোন তারবার্তা রেকর্ড রাখা হয় ৷ খোঁজা হয়েছে , কোন প্রমান পাওয়া যায় নাই ৷

Farid Ahmed: উনি কি এর পাল্টা বিবৃতি দিয়েছিলেন কোনো? অনুসন্ধানটা কাঁরা করেছিলো? সেটার রেফারেন্স কী?

Swapan Mahmud: তারপর দেখা যাচ্ছে খবরটা জানাচ্ছে বাসস।বাসস তো রাষ্ট্রীয় সংস্থা এরা প্রপাগান্ডাও ছড়াতে পারে।

Farid Ahmed: ভাসানী বামপন্থী ছিলেন বলে কি আপনাদের এই অবিশ্বাস? সেটা হলে লজিক্যাল কিছু হলো না। এর পাল্টা বিবৃতি কোথায়, মুজিব হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা করে ভাসানীর কর্মকাণ্ড কী? তিনি কি এর বিরুদ্ধে কখনো কিছু বলেছেন? এগুলো আনতে হবে আপনাদের সামনে। শুধু বাসস, বলেছে বলে অবিশ্বাস করে গেলে পক্ষপাতিত্ব হয়ে যাবে।

Swapan Mahmud: বামপন্থী ব'লে সাত খুন মাফ হ'য়ে যায়না।আমি শুধু একটা সম্ভাবনার কথা বলেছি।অপ্রাসঙ্গিক হ'লেও বলি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথম মিছিল ক'রে ছাত্র ইউনিয়ন।এই কিছুদিন আগে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলছিলেন উনি তখন এক আওয়ামীলীগ নেতার সাথে এ বিষয়ে আলাপ করতে হেলে ঐ নেতা বলেন "সেলিম এখনি মিছিল টিছিল করার দরকার নাই শেষে আওয়ামীলীগ সরকারকেই (মোশতাক ক্যাবিনেট) নিষিদ্ধ করে দেবে।"

Farid Ahmed: আওয়ামী লীগের নব্বইভাগ নেতাই স্বেচ্ছায় কিংবা ভয়ে মোশতাকের সাথে ছিলো। এগুলো প্রমাণিত। এই কাপুরুষদের ডিফেন্ড করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। সেলিম সাহেব যেটা বলেছেন, সেটা যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য।শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে দুজন লোকের করার সামর্থ্য ছিলো। এর একজন হচ্ছে জেনারেল ওসমানী এবং আরেকজন হচ্ছেন মওলানা ভাসানী। এই দুই ব্যক্তির গ্রহণযোগ্যতা ছিলো সারাদেশব্যাপী। দুঃখজনক হচ্ছে, তাঁরা দুজনেই এই কাজটা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

আমি একটা জিনিস দেখাচ্ছি এখানে আপনাদের। এটা সরাসরি কোনো প্রমাণ নয়। কিন্তু, ঘটনাটা তাৎপর্যপূর্ণ। অনেক না বলা জিনিস এখান থেকে বের করে আনা সম্ভব। ২১ তারিখ দুপুরবেলা সন্তোষ থেকে অসুস্থ ভাসানীকে নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। ভর্তি করা হয় পিজি হাসপাতালে। সন্ধ্যাবেলাতেই মোশতাক তাঁকে দেখতে হাসপাতালে যায়। পরের দিন এই খবরটা প্রতিটা সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় গুরুত্বের সাথে ছাপা হয়। ভাসানী যদি এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতেন, মোশতাকের মতো একটা লোকের তাঁর প্রতি এই সৌজন্যতা দেখানোর কথা নয় এবং পত্রিকাগুলোতে এটাকে এভাবে হাইলাইট করারও কথা নয়। আমি শুধু দৈনিক বাংলার খবরটা দিচ্ছি।

mostaq-vasani

রেকর্ডের স্বার্থে আরেক তালেবর পাপা টাইগারের চরিত্রটাও এই সুযোগে তুলে ধরি।

zia-osman

Swapan Mahmud: গোটা আওয়ামীলীগ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একটা প্রতিবাদ মিছিল করলো না।সুর সুর করে মোশতাকপন্থী হয়ে গেল। ওসমানী তো বাকশাল বিরোধীতা করে আওয়ামীলীগ ছেড়ে দিয়েছেন। ভাসানী ও আওয়ামীলীগ এ নেই। দায়ী হয়ে গেলেন তারা। আওয়ামীলীগ বরাবরই নপুংসক ও বিট্রেয়ারদের নেতৃত্ব পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেন ও ভারতে গিয়ে সাহায্য চান কাদের সিদ্দিকী, লতিফ সিদ্দিকী,সুলতান মনসুর। সুলতান ভাই'র কাছে সেই সব দিনগুলোর কথা অনেকবার শুনেছি। আজ তাদের তিনজনকেই আওয়ামীলীগ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তবে আমি জাতীয় চার নেতা, রাজ্জাক, তোফায়েল, সামাদ, আজাদ সহ যারা জেলে ছিলেন তাদের কথা বলছি না।তারা প্রকৃতই দেশপ্রেমী ও বঙ্গবন্ধুর কর্মী ছিলেন।বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথম মিছিল করতে হল বামপন্থি ছাত্র ইউনিয়ন কে। (আপনারা যাদের ঠাট্টা করে বলেন বামাতি) যে দল নিজের প্রতিষ্ঠাতাই শুধু নন জাতির পিতার ও হত্যার প্রতিবাদ করার হিম্মত রাখেনা তাদের কাছে দেশ মাতৃকার কোন মূল্য থাকতে পারেনা!

Farid Ahmed: আপনার এই পুরো বক্তব্যটাই অযৌক্তিক, অপ্রাসঙ্গিক এবং অপরিসীম খেদোক্তির বহিঃপ্রকাশ মাত্র । আমরা আওয়ামী লীগ নিয়ে আলোচনা করছি না, বা আওয়ামী লীগের সাথে কারো তুলনাও করছি না। এখানে স্পেসিফিক ইস্যু হচ্ছে খুনি সরকারে প্রতি ভাসানীর সমর্থন দেওয়া। আওয়ামী লীগের লোকেরা তো সমর্থন দিয়েছেই। মোশতাকও আওয়ামী লীগেরই লোক ছিলো। সেগুলো বললে কি ভাসানীর অপরাধ কমে যাবে? আপনি বলেন আপনি মুক্তমনের মানুষ, কিন্তু বামদের বিরুদ্ধে গেলেই আর আপনার মুক্তমনে কোনো কিছুই ঢোকে না। এটা খুবই দুঃখজনক। এতখানি ব্রেইন ওয়াশড হওয়া ঠিক না।

Swapan Mahmud: আমি বলেছি সব দায়ভার ভাসানীর হয়ে গেল!

Farid Ahmed: ভাসানীর সব দায়ভার এটাওতো কেউ বলে নাই, আমিও বলি নাই। তিনি খুনে সরকারকে সমর্থন দিয়েছেন, তাদের সাথে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। এতো বড় একজন রাজনীতিবিদ হয়ে, শেখ মুজিবের গুরুস্থানীয় হয়েও, শেখ এবং শেখ পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি কী করেছেন? মোশতাক তাঁর শয্যাপাশে গেলে কি একবারও বলেছেন, আমি খুনির সাথে হাত মেলাই না। বলেন নাই। এমন একটা নিম্নস্তরের লোককে ডিফেন্ড করেন কীভাবে আপনি, সেটাই তো আমি বুঝি না। নারী, শিশু হত্যা যাকে সামান্যতম বিচলিত করে না। আমি আওয়ামী লীগ করেছি, এই সব আকাম করা কোনো আওয়ামী লীগারকে সমালোচনা করতে আমি তো দ্বিধায় ভুগি না সামান্যতমও। সেটা করতে গিয়ে অমুক তমুক কী করেছে, কার দায় বেশি কম সেটা বিবেচনায় নেওয়া হবে না।