A Brief History of Humankind by Yuval Noah Harari – বই অবলম্বনে।
সুখের সংজ্ঞা কী?
কেমিক্যাল হ্যাপিনেস এর আইডিয়াটা একদম নতুন কিছু না। ১৯৩২ সালে Brave New World নামের একটি উপন্যাসে এই আইডিয়াটা একটা কংক্রীট ফর্মে প্রথমবারের মত হাজির হয়। লেখক এইখানে দেখান, জাগতিক সাফল্য, প্রতিষ্ঠান এগুলো আমাদের সুখ এনে দিতে পারে না। সুখ আসতে হবে ভেতর থেকে। আর তার মাধ্যম হচ্ছে সাইকায়াট্রিক ড্রাগ।
লেখক এমন একটা ড্রাগের কথা এইখানে কল্পনা করেন, যা প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ডোজে নিলে মানুষ ‘সুখী’ হবে। বাজারে চলতি ড্রাগগুলোর মত এটা মানুষের কর্মক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। এইভাবে মানুষকে সুখের সন্ধান দিতে পারলে মানুষ কোন রকম কোন অপরাধ করবে না। ফলে, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা এইসবের আর কোন দরকার হবে না আমাদের। আমরা আরো প্রোডাক্টিভ ক্ষেত্রে আমাদের ফোর্সগুলোকে কাজে লাগাতে পারবো।
এখানে দুটো সমস্যা। এক, এরকম কোন ড্রাগ এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি যা আপনাকে সুখ দিবে, কিন্তু বিনিময়ে আপনার শরীর বা মন থেকে কিছু শুষে নিবে না। আর দুই, সুখ আর সুখানুভূতি এক জিনিস না। লেখক এখানে যে জিনিসটার কথা বলেছেন সেটা হলো সুখানুভূতি। ইংরেজিতে যাকে বলে Pleasure. ডোপামিন, সেরোটোনিনের নিঃসরণ। আর এই নিঃসরণ পার্মানেন্ট কিছু নয়। খুবই ক্ষণস্থায়ী। মানুষের ইতিহাস যত পুরানো, নেশার ইতিহাসও তত পুরানো। নেশাদ্রব্য যুগ যুগ ধরেই আমাদের সুখানুভূতি দিয়ে আসছে। কিন্তু সুখ দিতে পারে নাই।
বিবর্তনও আমাদের ঐভাবেই তৈয়ার করেছে যেন আমরা বেশিক্ষণ সুখী হতে না পারি। বেশি সুখী হলেও সমস্যা আছে। সেক্স করে আমরা যেমন সুখ পাই। ঐ সুখটুকু না পেলে কেউ হয়তো সেক্স করতোই না। ফলে বাচ্চা হতো না। প্রজাতি হিসেবেও আমরা টিকে থাকতে পারতাম না। কিন্তু সেক্স করে আমরা যদি কন্টিনিউয়াসলি সুখ পেতেই থাকতাম, তাহলে মানুষ দিনরাত সেটাই করতো। খাদ্যের সন্ধানে আর বাইরে বেরোতো না। সুখের ফাঁদে পড়ে না খেয়ে মারা পড়তো গোটা প্রজাতি।
আর মানুষের মস্তিষ্কও এমন সে একটা নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি ডোপামিন, সেরোটোনিন নিঃসরণ করতে পারে না। কাজেই, যত সুখের ঘটনাই হোক, আমরা একটা নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি সুখী হতে পারি না। ধরেন, একদিন সকালে আপনি লাখ টাকা স্যালারির চাকরি পেলেন। দুপুরে আপনার বোন মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষার ফল হলো। সে চান্স পেয়েছে। বিকালে বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়াকে ওয়ানডেতে নির্মমভাবে হারালো। আর রাতের বেলা আপনার পুরানো গার্লফ্রেন্ড আপনার কাছে ফিরে এল। চার চারটা দারুণ ঘটনা ঘটলো একই দিনে। এতগুলো না ঘটে যদি একটা ঘটতো তাহলে আপনি যতটুকু সুখী হতেন, চারটা ঘটায় কি আপনি চারগুণ সুখী হবেন? মস্তিষ্ক থেকে চারগুন ডোপামিন, সেরোটোনিনের ক্ষরণ হবে? উত্তর হচ্ছে, না। আমাদের মস্তিষ্ক তো আর পারপেচুয়াল মেশিন না রে ভাই। এটা একটা লিমিটেড কোম্পানি যন্ত্র।
ড্রাগগুলো এক সময় আর কাজ করে না কেন? আপনাকে কেন আগের চেয়ে বেশি ড্রাগ নিতে হয় ঠিক আগের সেই অনুভুতিটা পাওয়ার জন্য? কারণ, শুরুতে ঐ ড্রাগ যে পরিমাণ ডোপামিনের নিঃসরণ ঘটিয়েছিল, অধিক ব্যবহারে তার কর্মদক্ষতা কমে যায়। সেইম নিঃসরণ ঘটাতে আগের চেয়ে বেশি ডোজ লাগে। এইখানে আবার আমরা সেই কানাগলিতে চলে আসি। সুখ আসলে কী? সুখ কি আমরা যে মুহূর্তগুলোতে সুখী ছিলাম, সেই মুহূর্তগুলোর যোগফল? নাকি অন্য কিছু?
নোবেল বিজয়ী অর্থনিতিবিদ ড্যানিয়েল কানম্যান বলেন, অন্য কিছু। তিনি হিসেব কষে দেখান, যে বিষয়গুলা মানুষকে সবচেয়ে বেশি পেইন দেয়, সেগুলাই বিগ পিকচারে মানুষকে সুখী করে তোলে। বাচ্চা মানুষ করা যেমন। খুবই পেইনফুল একটা কাজ। কিছুক্ষণ পর পর ন্যাপি বদলাও। বাচ্চার জন্য আলাদা খাবার বানাও। রাতে ঘুম ভেঙে কান্নাকাটি করলে তাকে কোলে নিয়ে হাঁটো। সোজা কথা, আপনার সুখ-শান্তি সব হারাম করে নিবে সে। তারপরও মানুষ বাচ্চা নেয়। আর জিজ্ঞেস করলে দাঁত বের করে হেসে বলে, এই বাচ্চাই তার জীবনের একমাত্র সুখ। অথচ পাটিগণিতের হিসাবে এই বাচ্চার হাসিমুখ তার জীবনে যতটা না সুখময় মুহূর্ত এনেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি দিয়েছে প্যারাময় মুহূর্ত।
প্যারাডক্সটা এইখানেই। মানুষের জীবন যোগ বিয়োগের ফর্মুলায় চলে না। মানুষ তার জীবনের কিছু লক্ষ উদ্দেশ্য তৈরি করে নেয়। ঐ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য সে যে কোন কষ্ট মেনে নিতে রাজি। নীৎসেও ঠিক এই কথাটাই বলেছেন। মানুষের জীবনে একটা মিনিং থাকা দরকার। মিনিং থাকলে কোন কষ্টই কষ্ট না। আর মিনিং না থাকলে সমস্ত রকম ম্যাটেরিয়াল সুযোগ সুবিধাও আপনাকে ভয়াবহ রকম অসুখী করে তুলবে।
মিনিং এর কথা যখন উঠলো বিজ্ঞান কিন্তু বলে, আমাদের মানব জীবনের কোন মিনিং নাই। আমরা অন্ধ বিবর্তনের একটা ফলাফল মাত্র। আমি আপনি মারা গেলে এই মহাবিশ্বের কিছুই আসবে যাবে না। সে তার মত করে চলতেই থাকবে। প্রকৃতির কাছে আমার যা দাম, একটা গরু, গাধা বা উটপাখিরও তাই দাম।
আমরা কিন্তু তারপরও আমাদের জীবনকে একটা মিনিং দেয়ার চেষ্টা করি। বিজ্ঞানী তার জীবনকে এই বলে মিনিং দেন যে, তার গবেষণা মানুষের জ্ঞান ভাণ্ডারকে একটু হলেও সমৃদ্ধ করছে। দেশপ্রেমিক সৈন্য ভাবে যে, তার আত্নত্যাগকে দেশবাসী শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। একজন উদ্যোক্তা আরো দশটা মানুষকে চাকরি দিয়ে, তাদের পরিবারের চলার ব্যবস্থা করে নিজের জীবনকে মিনিং দেন।
এই যে নিজের জীবনকে তাৎপর্য দেবার একটা প্রবণতা এর মধ্যে একটা বিরাট ফাঁকি আছে। এগুলো আর কিছুই না। নিজেকে বুঝ দেয়া। যে লোকটা দেশের জন্য জান দেয়, সেই দেশটাই তো পৃথিবীর মানচিত্র থেকে এক সময় হারিয়ে যেতে পারে। তখন কে তাকে স্মরণ করবে? যে মানুষী কষ্ট করে সন্তান মানুষ করে, সেই সন্তান যে তাকে ছেড়ে চলে যাবে না তার গ্যারান্টি কী?
এরপরও মানুষ তার জীবনের একটা অর্থ খুঁজে বেড়ায়। যতক্ষণ একটা লক্ষ বা উদ্দেশ্য থাকে জীবনে, সুখের আয়ুও ঠিক ততক্ষণই।
কৃত্রিম প্রজনন
বায়োইঞ্জিনিয়ারিং এর শুরু বিশ বা একুশ শতকে না। ১০ হাজার বছর আগে মানুষ যেদিন ষাঁড়কে খোঁজা করে বলদ বানিয়েছিল, সেদিন থেকেই বায়োইঞ্জিনিয়ারিং এর শুরু। বলদ নামটার মধ্যেই এর সাবমিসিভ আচরণ নিহিত। এরে পোষ মানানো সোজা। এরে দিয়ে লাঙল টানানোও সোজা। গবাদি পশু খোঁজা করেই মানুষ ক্ষান্ত দেয় নাই। নিজের ছেলেরেও সে খোঁজা করে দিয়েছে। সেই ছেলেকে নাচেগানে পারদর্শী করে তুলেছে।
সুলতানের হারেমে বেগম সাহেবাদের সেবাযত্নে কাজে লাগিয়েছে। সেকালের বায়োইঞ্জিনিয়েরিং এর সাথে আজকের বায়োইঞ্জিনিয়েরিং এর পার্থক্যটা তাহলে কই? পার্থক্যটা লেভেলে। সেকালের ইঞ্জিনিয়েরিং ছিল খুবই স্থূল লেভেলের। চোখে দেখা যেত। আজকের ইঞ্জিনিয়েরিং সেলুলার লেভেলে, জিন লেভেলে। চোখে দেখা যায় না এমন। আজকে তাই লিঙ্গ বদলানোর জন্য কাউকে খোঁজা করা লাগে না। কিছু হরমোন চেঞ্জ করে দিলেই হলো!
এক ব্রাজিলিয়ান ভদ্রলোকের একবার এক শখ হলো। উনি এমন একটা খরগোশ পুষবেন যার গা থেকে সবুজ আলোকছটা বেরোবে। উনি এক ফ্রেঞ্চ ল্যাবরেটরীতে খোঁজখবর করলেন। এর জন্য মালকড়ি ছাড়তেও উনার সমস্যা নাই। ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানীরা একটা খরোগোশের ভ্রূণ নিল। সেই ভ্রূণের ডিএনএ-তে জেলীফিস থেকে পাওয়া সবুজ ফ্লুরোসেন্ট আলোর জিন ঢুকিয়ে দিল।
বুম! সেই কাঙ্ক্ষিত খরগোশের জন্ম হলো যার গা থেকে কিনা সবুজ আভা বেরোয়। ভদ্রলোক এই খরগোশ বাবুর নাম দিলেন Alba. Alba কোন বিবর্তনের ফসল নয়। নিখাদ ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের ফসল। এখন পর্যন্ত আমরা জেনে এসেছি, সমস্ত প্রাণীসত্ত্বাই লক্ষ লক্ষ বছর বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের এই পর্যায়ে এসেছে।
এই প্রক্রিয়ায় আমরা যে বাম হাত ঢুকাই নি তা নয়। আমরা যখন রুগ্ন ভেড়াগুলোকে মেরে মোটা, নাদুশ-নুদুশ ভেড়াগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছি, তখনই আমরা এদের ন্যাচারাল বিবর্তনে এক দফা ইন্টারফিয়ার করে ফেলেছি। কবি বলেছেন, ভেড়াকে ভেড়ার মত থাকতে দাও। আমরা তা দিই নি। আমরা ওদেরকে নিজেদের প্রয়োজনমত গুছিয়ে নিয়েছি।
তবু সেটা ছিল বিবর্তনে হস্তক্ষেপ। যাতে কিনা বছরের পর বছর লেগে যেত। আজ আমরা ন্যাচারাল বিবর্তনকে অস্বীকার করে নিজেদের খেয়াল খুশিমত প্রাণীদের ডিজাইন করে চলেছি। এই ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন ব্যাপারটা আমরা কেউ কেউ ঈশ্বরের এখতিয়ারে ছেড়ে চেয়ে বসে ছিলাম। সমস্যা হলো, এই সেক্টরে ঈশ্বরের মনোপলি আর নাই। মানুষও এই বিজনেসে নেমেছে।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
এখনো পর্যন্ত আমরা ছোট ছোট সেক্টরে আমাদের কেরদানি দেখাচ্ছি। E-Coli’র মত ব্যাকটেরিয়া দিয়ে আমরা ইনসুলিন তৈরি করছি। তাতে মেলা খরচ বেঁচে যাচ্ছে। উত্তর মেরুর বাসিন্দা মাছের জিন আলুর ভেতর ঢুকিয়ে আলুকে আরো ঠাণ্ডা প্রতিরোধী করে তুলেছি। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা ঘটেছে ল্যাব র্যাটদের সাথে। জেনেটিক প্রকৌশলীরা আজকাল এমন সব ইঁদুরের জন্ম দিচ্ছেন যাদের র্যাম আর হার্ডডিস্ক, বুদ্ধি আর স্মৃতিশক্তি দুটোই তাদের পূর্বপুরুষদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি।
Vole এর কথা বলি। এরা অনেকটা ইঁদুর টাইপের প্রাণী। অধিকাংশ প্রজাতিই বেশ চরিত্রহীন। মানে আজ একে ধরে তো কাল ওকে ধরে। বিজ্ঞানীরা তো এইসব নষ্টামি পছন্দ করেন না। তারা এমন এক প্রজাতি ডেভেলপ করলেন, যেখানে ছেলে vole আর মেয়ে vole দুজনেই দীর্ঘস্থায়ী মনোগ্যামাস রিলেশনে বিশ্বাসী।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, তারা মনোগ্যামীর জিন বের করে ফেলেছেন। Vole এর ক্ষেত্রে যদি এটা করা যায়, মানুষের ক্ষেত্রে নয় কেন? এরশাদ কাকুর শরীরে আপনি মনোগ্যামীর জিন ঢুকিয়ে দিলেন। কাকু আরো দশজনের মত স্ত্রীভক্ত, বিশ্বস্ত, অনুগত স্বামী হয়ে গেলেন। খুব কি খারাপ হয় ব্যাপারটা?
ঘটনা এখানেই শেষ না। বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, বাঁচা মানুষ নিয়ে কাজ তো অনেক হলো। এবার মরা মানুষ নিয়ে কিছু করা যাক। হার্ভার্ডের এক প্রফেসর প্রস্তাব দিলেন, নিয়েন্ডারথালের জিন মানুষের ভ্রূণে ঢুকায়ে দেখলে কেমন হয়? বেশ ক’জন মহিলা সেই নিয়েন্ডারথাল বাচ্চা পেটে ধরার জন্য কিনা রাজিও হয়ে গেল!
কথা হলো, নিয়েন্ডারথালদের দিয়ে আমরা কী করবো? এরা ধ্বংস হয়েছে তো হয়েছে, এদের আবার বাঁচায়ে তোলার কী দরকার? দরকার আছে। নিয়েন্ডারথাল মস্তিষ্কের সাথে আমরা যখন আমাদের স্যাপিয়েন্স মস্তিষ্কের তুলনা করবো, তখনই আমরা বুঝতে পারবো দুই ভাইর মধ্যে পার্থক্যটা আসলে কী। ঠিক কী কারণে আমরা যাকে Consciousness বলি, বাংলায় চেতনা বলি এই চেতনা আমাদের মধ্যে ডেভেলপ করেছে। লোকে হয়তো টাকা দিয়ে নিয়েন্ডারথাল কিনেও নিবে। দু’জন কাজের মানুষ যে খাটনিটা খাটতে পারতো, একা একটা নিয়েন্ডারথাল সেটা খেটে দিবে।
আচ্ছা, আমরা যদি নিয়েন্ডারথাল ডিজাইন করতে পারি, স্যাপিয়েন্স-ই বা কেন ডিজাইন করতে পারবো না? আর স্যাপিয়েন্স ডিজাইন তো খুব কঠিন কিছু না। যেখানে আমরা ইঁদুর ডিজাইন করে তার বুদ্ধিশুদ্ধি বাড়িয়ে দিচ্ছি, সেখানে মানুষ কেন পারবো না? ইঁদুরের শরীরে DNA বেস আছে প্রায় আড়াই বিলিয়নের মত। মানুষের শরীরে সেটা ২.৯ বিলিয়ন। মাত্র ১৪% বেশি। ইঁদুরে যদি হয়, মানুষে কেন নয়? জিনিয়েস ইঁদুর যদি হয়, জিনিয়েস মানুষ কেন নয়? চরিত্রবান ইঁদুর যদি হয়, চরিত্রবান মানুষ কেন নয়?
সত্যিটা হচ্ছে এই যে, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়েরিং আমাদের শরীরে একটা বড় ধাক্কা দিতে যাচ্ছে। হয়তো আর কয়েক দশকের মধ্যেই। আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে, গড় আয়ু বাড়বে, হয়তো অমরত্বও পেয়ে যেতে পারি আমরা। শরীরের ধাক্কা তো আমরা নিতে পারবো। কিন্তু আমাদের মনের ভেতর এটা যে ধাক্কা দিবে, আমাদের সোশ্যাল স্ট্রাকচারে যে ধাক্কা দিবে সেই ধাক্কা আমরা নিতে পারবো তো?
তার চেয়েও বড় প্রশ্ন আমরা Homo sapiens-ই থাকবো তো? নাকি বাপ-দাদাদের মুখে চুনকালি মেখে আমরা এমন কিছুতে পরিণত হবো যাকে কোনভাবেই আর Sapiens বলা যাবে না?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
খালি চোখে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে খুব সাদামাটা একটা গল্প মনে হয়। এক বিজ্ঞানী যিনি কিনা একটা আর্টিফিশিয়াল সত্ত্বা তৈরি করেন, যেটা পরে কন্ট্রোলের বাইরে চলে যায়। বাজারে এরকম ভুরি ভুরি সায়েন্স ফিকশন আছে। এইসব গল্পের মূল বক্তব্যই হচ্ছে আমরা যদি বেশি তেড়িবেড়ি করি, নিজেদের ঈশ্বরের সমকক্ষ ভাবা শুরু করি তাহলে আমাদের খবরই আছে।
এর বাইরেও কিন্তু এই গল্পের একটা গভীর তাৎপর্য আছে। ফ্রাংকেনস্টাইন আমাদের এই বলে সতর্ক করে দেয় যে, মানবজাতির শেষ ঘনায়া আসতেসে। এই শেষ পারমাণবিক বোমা বা উল্কাপাতের কারণে হবে না। মানুষ নিজেই তার কেয়ামত ডেকে আনছে। এই কেয়ামত মানে পৃথিবীর শেষ হয়ে যাওয়া না। এই কেয়ামত মানে প্রজাতি হিসেবে হোমো স্যাপিয়েন্স এর শেষ হয়ে যাওয়া। আমাদের জায়গায় তখন এমন এক প্রজাতির আবির্ভাব হবে, যাদের শরীর তো আমাদের থেকে আলাদা হবেই, এদের আবেগ-অনুভূতিও আমাদের স্কেলে মাপা যাবে না।
এই ভাবনাটাকে আমরা ঠিক নিতে পারি না। আমরা চিরকালই নিজেদের ‘বেস্ট’ জেনে আসছি। আমরা বড় বড় স্কাইস্ক্র্যাপার বানাবো, মহাকাশ যাবো, মঙ্গলে প্লট বুকিং দিব। সব আমরাই করবো। আমাদের চেয়েও বেটার কেউ থাকতে পারে, এটা আমরা নিতেই পারি না। কিন্তু সময় তো আর বসে থাকে না। সময় তার নিজের গতিতে এগোয়।
যে জন্যে আজ আমরা যে প্রেডিক্ট করি, দেখা যায় ভবিষ্যতে তার কিছুই মেলে না। এ্যাপোলো ১১ যখন চাঁদে গেল, আমরা স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করলাম। যে ২০০০ সালের মধ্যে আমরা মঙ্গলে থাকা শুরু করবো। সেটা কি হয়েছে? থাকা তো দূরের কথা, যেতেই পারলাম না এখন পর্যন্ত। উলটা কী হলো? আমরা ইন্টারনেট পাইলাম। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাটে নিজেদের প্রাইভেসি নিলামে তুললাম।
কাজেই, ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের আশংকাকে আমরা চাইলেও হেসে উড়ায়ে দিতে পারি না। এ্যাডভান্সড মানুষের কিছু কিছু লক্ষণও তো ইদানীং দেখা দিচ্ছে। আর এই লক্ষণগুলো দেখা দিচ্ছে আমাদের ল্যাবগুলোতে। ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেস যেমন আজকাল বেশ জনপ্রিয় রিসার্চ টপিক। এখানে করা হয় কি, আমাদের মাথার খুলিতে কতগুলো ইলেক্ট্রোড বসানো হয়।
ফলে, মস্তিষ্কের ভেতরে যে ইলেকট্রিক্যাল সিগনালগুলো তৈরি হচ্ছে, কম্পিউটারে সেগুলা দেখা যায়। এইটুকু পর্যন্ত ঠিক আছে। এই সিগনাল এ্যানালিসিস করে আপনি রোগ নির্ণয় করবেন। মস্তিষ্কের কোন অংশ কী কাজ করে এগুলো করবেন। সবই বুঝলাম।
কিন্তু এই সিগনালগুলো যদি ইন্টারনেটে ফাঁস করে দেয়া হয়? কিংবা কতগুলা মানুষের এইভাবে পাওয়া সিগনালগুলো যদি একসাথে প্যাকেজ আকারে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়া হয়, তখন কী হবে? কিংবা একজন সিগনাল যদি আরেকজনের মস্তিষ্কে ইনপুট হিসেবে দেয়া হয়? একজন মানুষ কি তখন আরেকজনের মস্তিষ্কের ভেতর ঢুকে যাবে? তার ছোটবেলার স্মৃতি, প্রথম প্রেমিকার স্মৃতি, প্রথম পরাজয় সব জেনে যাবে? মানুষের যে প্রাইভেসি বলে একটা জিনিস আছে সেই প্রাইভেসির তখন কী হবে? ইনডিভিজুয়ালিজম বলে কি কিছু থাকবে তখন?
এইরকম একটা কালেক্টিভ সত্ত্বাকে কি আমরা আর ‘মানুষ’ বলতে পারি? না, পারি না। এটা হবে সম্পূর্ন নতুন কিছু। এদেরও আবেগ-অনুভূতি, সাইকোলজি সবই থাকবে। আমাদের স্ট্যান্ডার্ড দিয়ে যাকে হয়তো আমরা ব্যাখ্যা করতে পারবো না। আরেকটা সম্ভাবনা এরকম। ধরেন, আপনি আপনার ব্রেইনের একটা ব্যাক আপ পোর্টেবল হার্ডডিস্কে রেখে দিলেন। তারপর ল্যাপটপে সেটা চালাইলেন। এখন ল্যাপটপ কি আপনার মতই চিন্তা করা শুরু করবে? নাকি বিবর্তনের নিয়ম অনুযায়ী, সেও আগের কিছু ইনপুট আর নিজের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে চিন্তা করা শুরু করবে? যদি সেটাই হয়, তাহলে সেই ল্যাপটপকে আমরা কী বলবো? ল্যাপটপ না মানুষ?
২০০৫ সালে হিউম্যান ব্রেইন প্রজেক্ট নামে এরকমই একটা বিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট চালু হয়েছে। এর আল্টিমেট উদ্দেশ্য কম্পিউটারের মধ্যে মানুষের মস্তিষ্ক পুরাপুরি রিক্রিয়েট করা। এটা যদি হয়, তাহলে ৪ বিলিয়ন বছরের কারাবাসের পর মস্তিষ্ক জৈব যৌগের জাল থেকে মুক্ত হবে। অজৈব যৌগের যে একটা বিশাল জগৎ আছে, ঐখানে তার প্রথম পদচারণা ঘটবে। এর এচূড়ান্ত পরিণতি কী আমরা জানি না। আদৌ কম্পিউটার আমাদের মস্তিষ্কের জালকে ভেদ করতে পারবে কিনা তাও আমরা নিশ্চিত নই। কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে তো দোষ নাই।
চেষ্টায় যে কিছু কিছু ফল হচ্ছে না তাও তো না। প্রথম মানব ডিএনএ ম্যাপ করতে আমাদের লেগেছিল ১৫ বছর। খরচ হয়েছিল ৩ বিলিয়ন ডলার। এখন সেই ডিএনএ ম্যাপ করতে কয়েক সপ্তার বেশি লাগে না। পকেট থেকে যায় মাত্র কয়েকশো ডলার। পারসোনালাইজড চিকিৎসার যুগ তাই শুরু হলো বলে।
একদিন আসবে, যখন পাড়ার ডাক্তার আপনার ডিএনএ দেখে বলে দিবে, যে বয়সকালে আপনার লিভারে সমস্যা হতে পারে। হার্টের দিক থেকে মোটামুটি নিশ্চিন্ত। ৯০ পার্সেন্ট লোক যে ওষুধ খেয়ে ভালো হয়, সেটা আপনার জন্য কাজ নাও করতে পারে। আপনার প্রেসক্রিপশনে হয়তো এমন বড়ির কথা লেখা থাকবে, যা সেই ৯০ পার্সেন্ট খেয়ে উলটা অসুস্থ হয়ে পড়বে।
খোলাবাজারে এইভাবে DNA সিকোয়েন্স পাওয়া গেলে ডাক্তারদের না হয় সুবিধা হবে। সমস্যাটা হবে পলিসি মেকারদের। এইভাবে DNA ওপেন করে দেয়া ঠিক হবে কিনা এইটা আরেকটা ফিলোসফিক্যাল সমস্যা। ব্যাঙ্কের লোকজন আপনার DNA দেখে যদি বুঝে ফেলে, আপনি খুবই উড়নচন্ডী প্রকৃতির মানুষ, তাহলে তো আপনাকে আর ধার দিবে না। চাকরির ইন্টারভিউয়ে আমরা তখন সিভি না নিয়ে ডিএনএ রেজাল্ট নিয়ে হাজির হব। ডিএনএ ভালো দেখালে আপনি চাকরি পাবেন, আর না হলে নাই। ব্যাপারটা এক রকম বৈষম্য হয়ে গেল না?
সায়েন্স ফিকশন লেখকেরা ভবিষ্যতের পৃথিবীর স্পেসশিপ নিয়ে লেখেন, টাইম ট্রাভেল নিয়ে লেখেন। কিন্তু এর ফলে আমরা যে মরাল, ফিলোসফিক্যাল দ্বন্দ্বগুলার সম্মুখীন হব সেগুলা নিয়ে খুব একটা কেউ লেখেন না। কেননা, সেই সময়কে বোঝা, সেই সময়ের সমস্যাগুলোকে ধারণ করা, আমাদের মরাল স্ট্যান্ডার্ড দিয়ে প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। এমনে একটা সত্ত্বার কথা ভাবুন তো যার কোন সেক্সুয়ালিটি নাই, যার মনোসংযোগের ক্ষমতা আমার আপনার চেয়ে হাজার গুণ বেশি। রাগ, দুঃখ, ঘৃণা, হিংসা বলে কোন বস্তু যার মধ্যে নাই তার আবেগ, তার চাহিদা আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করবো?
বলা হয়, বিগ ব্যাং-এর মধ্য দিয়ে মহাবিশ্বের যাত্রা শুরুর। এর আগে সময়, সভ্যতা, প্রাণ কোন কিছুরই কোন অস্তিত্ব ছিল না। আমরা সম্ভবত সেরকমই একটা নতুন বিস্ফোরণের দিকে এগোচ্ছি। এই বিস্ফোরণের আগের পৃথিবী আর পরের পৃথিবীর মধ্যে মাইক্রোস্কোপ দিয়েও কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের কাছে যা মূল্যবান পরিবার, প্রিয়জন, ভালবাসা, ঘৃণা সব কিছুই মূল্যহীন হয়ে পড়বে সেই নতুন পৃথিবীর মানুষদের কাছে।
এই নতুন মানুষদের আমরা নাম দিয়েছি Homo Deus. ঈশ্বরের সমান মানুষ। এই নতুন মানুষদের নিয়েও হয়তো গল্প লেখা হবে। অন্যকোন দিন। অন্যকোন সময়।
(সমাপ্ত )
অন্যান্য পর্বগুলো পড়ুন এখানে ⇑