মানুষের গল্পআশফাক আহমেদ

মানুষের ইতিহাস – পর্বঃ ২

ভাবানুবাদঃ আশফাক আহমেদ

A Brief History of Humankind by Yuval Noah Harari – বই অবলম্বনে।

আদিম জিনের উপাখ্যান

পনার হাজব্যান্ড বা ওয়াইফ কি বিয়ের এত বছর পরেও অন্য নারী/পুরুষ দেখলেই ছোঁক ছোঁক করেন? আপনারা বাবার কি ডায়বেটিক? হাজারবার মানা করা সত্ত্বেও উনি কি মিষ্টি জাতীয় খাবারের লোভ সামলাতে পারেন না? কিন্তু কেন এই ঘটনাগুলো ঘটছে? কে দায়ী এইসবের পেছনে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আসলে আমাদের আশেপাশে তাকিয়ে পাওয়া যাবে না। এর উত্তর পেতে হলে আমাদের একটু পেছনে ফিরতে হবে। বেশি পেছনে না। মাত্র ৩০ হাজার বছর আগে। যখন আমরা শিকার আর ফলমূল সংগ্রহ করে বেঁচে ছিলাম। আমাদের সেই আদিপুরুষদের মনস্তত্ত্ব ঘাঁটলেই আমাদের আজকের মনস্তত্ত্বের কিছুটা আঁচ পাওয়া যাবে।

প্রথমেই আপনার বাবার সমস্যাটা সলভ করি। কথা হলো, মিষ্টি জাতীয় খাবারের প্রতি আপনার বাবার এত আকর্ষণ কেন? এই আকর্ষণ কি তার বাবা, তার বাবা এবং তার বাবারও ছিল উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, ছিল। আমাদের পূর্বপুরুষেরা যখন বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতো, তাদের খাবারের স্টক ছিল সীমিত। হাই ক্যালরি ফুড ছিল না বললেই চলে। অথচ শিকারের জন্য তো হাই ক্যালরি ফুডের দরকার। আর এই হাই ক্যালরি ফুডের একমাত্র উৎস ছিল পাকা ফলমূল। বনেজঙ্গলে তাও ছিল দুষ্কর।

আমাদের গ্রেট গ্রেট দাদী-নানীরা তাই যখনই কোন পাকা ফলের সন্ধান পেতেন, অমনি ধরে তা গাপুস গুপুস খেয়ে ফেলতেন। যেন স্থানীয় বদমাইশ বেবুনের দল এর সন্ধান পাবার আগেই তারা সব ক্যালরি শরীরস্থ করে ফেলতে পারেন। বেবুনের দল চুলোয় যাক। এই করে করে আমাদের মস্তিষ্কে মিষ্টি জাতীয় খাবারে আসক্তির একটা সার্কিট তৈরি হয়ে গেছে। আজ হয়তো আমরা হাইরাইজ এ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করি। স্মার্টফোন চালাই, গাড়ি ড্রাইভ করি। সেটা আমরা জানি, আমাদের ডিএনএ তো আর জানে না। সে ভাবে, আমরা বুঝি এখনো সেই সাভানার জঙ্গলে বসবাস করছি। কাজেই, মিষ্টি খাবার দেখলে আমাদের আর মাথা ঠিক থাকে না।

এবার আসি নারী-পুরুষ, প্রেম-ভালবাসা ঘটিত সমস্যায়। এর মূলেও আছে আমাদের পূর্বপুরুষদের পাপ। মনে করা হয়, সেসময়কার সমাজে কোন ব্যক্তিগত সম্পদের কোন ধারণা ছিল না। ব্যক্তিগত সম্পদ ছিল না বলে একগামী কোন রিলেশনেরও প্রয়োজন দেখা দেয়নি সেই সময়। যত যাই বলেন, মানুষ কিন্তু একগামী রিলেশনে আবদ্ধ হয় এবং টিকিয়ে রাখে তার সন্তানদের কথা ভেবে, নিজেদের কথা ভেবে না। আমার সন্তান যেহেতু আমার সম্পদ পাচ্ছে না, কাজেই আমার তো একগামী (হোক না লোক দেখানো) রিলেশনে থাকারও প্রয়োজন নাই ব্যাপারটা অনেকটা এই রকম।

তো নারী-পুরুষ তাদের সন্তান-সন্ততি নিয়ে একটা ছোটখাটো দল আকারে থাকতো। এক নারী যত খুশি পুরুষের সাথে সুসম্পর্ক করতে পারতো। ‘ফাদারহুড’ বলে কোন ধারণা তখনো চালু হয়নি। পুরুষ ছিল নারীদের কাছে এক রকমের সেক্স টয়। প্রকৃতি সন্তান চায়। সেই সন্তান উৎপাদনের জন্য নারী সেই সময় পুরুষকে জাস্ট ব্যবহার করতো। আর একজন ভালো মা সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই বহু পুরুষের সাথে মিলিত হতেন। যেন তার সন্তান একই সাথে দক্ষ যোদ্ধা, ভালো গল্পকার এবং প্যাশনেট প্রেমিক হতে পারে। কোন এক পুরুষের মধ্যে এই সব গুণাবলীর সম্মিলন পাওয়া দুঃসাধ্য। কাজেই, একজনের সাথে প্রেম করাটা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

তারপর সেই সন্তানদের দেখভাল করতো দলের সবাই মিলে। কোন পুরুষই জানতো না, ঠিক কোনটা তার সন্তান। কাজেই, সব শিশুকেই সমান চোখে দেখা হত। গ্রীক দার্শনিক প্লেটোও ঠিক এরকম একটা সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। জন্মের পরপরই শিশুদের দায়িত্ব নেবে রাষ্ট্র। মা-বাবার উপর কোন দায়িত্ব থাকবে না। সেই শিশুরা রাষ্ট্রীয় সদনে সমান সুযোগ-সুবিধায় বড় হবে। কেউ জানবে না, তার বাবা-মা কে। বাবা-মা’রাও জানবে না, তাদের সন্তান কোনটি। একটা নির্দিষ্ট এইজ গ্যাপের সবাইকেই সেই শিশুটি বড় হয়ে বাবা বা মা ডাকবে। ব্যাপারটা অবাস্তব শোনালেও প্লেটো সম্ভবত সমাজে বিদ্যমান পাহাড়সম শ্রেণীবৈষম্য রোধে এরকম একটা ব্যবস্থার কথা ভেবেছিলেন।

ওয়েল, এমন সমাজ যে একেবারেই নেই, তা কিন্তু আমরা বলতে পারবো না। আমাদের দূর সম্পর্কের ভাই শিম্পাঞ্জী ও বোনোবোদের মধ্যে তো বটেই, আজকের যুগেও বারি ইন্ডিয়ান নামক এক গোষ্ঠীর মধ্যে এরকম কালেক্টিভ ফাদারহুডের চর্চা চালু আছে। এরা বিশ্বাস করে, কেবল এক পুরুষের স্পার্ম থেকেই সন্তানের জন্ম হয় না। বহু পুরুষের স্পার্ম এক নারীর গর্ভে পুঞ্জীভূত হয়ে তবেই সন্তানের জন্ম হয়।

প্রাচীন মানুষ যে সব দিক দিয়ে ভুল ছিল তা কিন্তু না। তাদের এইসব আপাত আজগুবি ধারণার মধ্যেও কিছু কিছু সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখে গেছে, কোন নারী যদি বিয়ের আগে এক বা একাধিক পুরুষের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করে থাকেন, তবে তার সন্তানের মধ্যে তাদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে। ব্যাপারটা খারাপ না, কী বলেন? একই মানুষের মধ্যে একিলিস থাকবে, হোমার থাকবে, আবার রোমিও-ও থাকবে!

যাই হোক, সোজা কথা, মনোগ্যামী আসলে আমাদের রক্তে নেই। আমাদের রক্তে প্রবল উল্লাসে বয়ে চলেছে পলিগ্যামীর স্রোত। এটা নারী-পুরুষ সবার জন্যই সত্য। আর এজন্যই ভালবেসে বিয়ে করার পরও আমাদের মধ্যে এত ঝগড়া, এত অশান্তি। আমাদের জিনে জিনে যে বহুগামীতার রাজত্ব। অথচ আমাদের ধর্ম, আমাদের সমাজ আমাদের উৎসাহিত করছে একগামী হতে। ভালবেসে, সুখে শান্তিতে বসবাস করে সৎ, চরিত্রবান স্বামী/স্ত্রীর খেতাব পেতে। আমাদের মধ্যে যে ডিপ্রেশন, যে একাকীত্ব আর নিঃসংগতা, তার কারণ বোধয় সেই দলবদ্ধ জীবন যাপন ছেড়ে জোর করে একগামী হবার চেষ্টা করা। প্রশ্ন হচ্ছে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিগুলো এখনো তাহলে টিকে আছে কীভাবে? পরকীয়ার প্রভাবে তো সব উড়ে যাওয়ার কথা।

এই ব্যাপারে আরেক দল মনস্তাত্ত্বিকের অন্যরকম থিওরি আছে। তারা বলেন, মানুষ স্বভাবতই মনোগ্যামাস এবং তার পার্টনারের ব্যাপারে পজেসিভ। অন্তত আমাদের ভাই-বেরাদরের তুলনায় আমরা অনেক বেশি মনোগ্যামাস। বাইরে আপনি যতই প্রগতিশীল ভাব দেখান না কেন, আপনার বউ/গার্লফ্রেন্ড আরেকজন পটেনশিয়াল পুরুষের গায়ে ঢলে পড়ে হেসে হেসে কথা বললে আপনার মধ্যে একটু হলেও খচখচ করবে। ব্যাপারটা মেয়েদের জন্যেও সত্য।

এই থিওরিস্টরা বলেন, প্রাচীন সমাজেও এরকম একটা ব্যাপার ছিল। এরা দল বেঁধে থাকলেও যাকে বলে ‘ফ্রি সেক্স’ তা এদের মধ্যে ছিল না। কাপলরা নিজেদের মত করে থাকতো। নিজেদের বাচ্চা নিজেরাই সামলাতো। বিপদে-আপদে পড়লে কেবল দলের অন্যদের সাহায্য নিত। নিজেদের সন্তানের প্রতি আমাদের যে এক ধরনের অন্ধত্ব কাজ করে, সে কাউকে খুন করে আসলেও মা যে তাকে ফেলে দিতে পারেনা না- এই ব্যাপারটা তখন থেকেই আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে।

পার্টনারের ক্ষত্রেও ব্যাপারটা তাই। আপনি হয়তো সবার কাছে আপনার পার্টনারের হাজারটা বদনাম করে বেড়ান। কিন্তু অন্য কেউ আপনার পার্টনারকে সামান্য সময়ের জন্যও দখল করতে এলেও ঠিকই আবার বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়ান। এই যে পজেসিভনেস, এইটা আমাদের পূর্বপুরুষদের সময় থেকেই আমাদের রক্তে বাহিত হয়ে আসছে। অনেকে বলেন, আজকের প্রযুক্তিনির্ভর সমাজে বিয়ে টিকে থাকার কথা না। এখনো যে টিকে আছে, তার কারণ বোধয় বহু বছরের এই অভ্যাস। নেক্সট টাইম আপনার পার্টনার যদি আপনাকে নিয়ে একটু পজেসিভ হয়ও, তাকে ভুল বুঝবেন না প্লিজ। সবই আমাদের পূর্বপুরুষদের পাপের ফসল।


মগজের ব্যবহার

শারীরিক দিক দিয়ে তো বটেই, স্রেফ মগজের দিক দিয়েও আমাদের শিকারী পূর্বপুরুষেরা আমাদের চেয়ে এগিয়ে ছিল। অন্তত তথ্য প্রমাণ তাই বলে। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য, গত তিরিশ হাজার বছরে আমাদের মগজের তেমন উন্নতি হয়নি। বরং কিছুটা অবনতি হয়েছে বলা যায়। তাহলে এই যে আমাদের আধুনিক সভ্যতা, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, স্পেসশিপ- এগুলো কার অবদান? কোন ভিনগ্রহী এসে তো এগুলো তৈরি করে দিয়ে যায়নি। এগুলো আমাদের মগজেরই অবদান। সত্যি করে বললে, আমাদের কালেক্টিভ মগজের। ইনডিভিজুয়াল মগজের সাইজ সত্যিই কমেছে।

প্রাচীন মানুষ ছিল ভয়াবহ লেভেলের জ্ঞানী। সারভাইভালের জন্যই তাদের জ্ঞানী না হয়ে উপায় ছিল না। আজ একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ের জগৎ-সংসার, পাড়া-প্রতিবেশী সম্বন্ধে কিছু না জেনেই দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। প্রাচীন মানুষের পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল না। নিজেদের এলাকার প্রতিটি ইঞ্চি সম্বন্ধে তাদের নিখুঁত জ্ঞান রাখতে হত। আমরা যেখানে গুগল ম্যাপ ছাড়া পাশের গলিতে ওয়ালমার্ট আছে কিনা, তাও বলতে পারি না।

খাবার সংগ্রহের কথাই ধরা যাক না কেন। কোন ফল কখন হয়, সেই জ্ঞান তো তাদের ছিলই, প্রতিবেশী বানর কিংবা হনুমানের দল এগজ্যাক্টলি কখন সেই ফলে আক্রমণ করে বসবে, সেই জ্ঞানও তাদের রাখতে হত। এইখানেই শেষ নয়। কোন ফল খেতে মজা, কোন ফলে বিষ আছে আর কোন ফল রোগবালাইয়ে ওষুধের কাজ দিবে এই সব তাদের নখদর্পণে ছিল। এগুলো ছিল সেকালের সাধারণ জ্ঞান। প্রত্যেক ইনডিভিজুয়ালকে এই জ্ঞানটুকু রাখতে হত। কোন ডাক্তার-বৈদ্য যেহেতু ছিল না তাদের বলে দেবার জন্য কিংবা লিখিত ভাষাও চালু হয়নি যে ফলের গায়ে কোন নিঃস্বার্থ মানুষ এসে লিখে রাখবেঃ “সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ এই ফলে বিষ আছে। এই ফল খাবেন না।”

পশু শিকারের জন্য তাদের প্রয়োজন হত হাতিয়ার। এই হাতিয়ারও ছিল হিজ-হিজ-হুজ-হুজ। সেই সময় মানুষ তাই ব্যবহার করতো, যা সে নিজে তৈরি করতো। ধরা যাক হারপুন। যে লোকটা হারপুন বানাতো, সেই ঐ হারপুন দিয়ে শিকার করতো। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ব্যবহার্যই তাই। ফলে কাঁচামাল সংগ্রহ থেকে শুরু করে গোটা ম্যানুফ্যাকচারিং প্রসেসের খুঁটিনাটি সে জানতো। আর ভালো শিকারের জন্য দরকার ভালো হারপুন। নিজের হারপুনকে সেরা শেপটা দেবার জন্য তাকে মগজ খাটাতেই হত।

আজ তার কুলাঙ্গার বংশধর কম্পিউটার ব্যবহার করে, সে কিন্তু জানে না, কম্পিউটার কীভাবে তৈরি হয়। কম্পিউটার কীভাবে কাজ করে- এটাও সে জানে না। অথচ মনের আনন্দে সে কম্পিউটারে চ্যাট করে চলেছে। এর নামই টেকনোলজি। যা আমাদের মাথা না খাটিয়ে সুবিধাটুকু পুরোপুরি উপভোগ করার সুযোগ এনে দেয়, তাই টেকনোলজি। ক্যালকুলাস যেমন গণিতের একটা শাখা। কিন্তু ক্যালকুলাসের সুত্রগুলো আপনি না বুঝেও আপনার কাজে ব্যবহার করতে পারবেন। sinX কে ডিফারেনশিয়েট করলে cosX পাওয়া যায়। এটা আমরা সবাই জানি। কীভাবে পাওয়া যায় এটা না বুঝলেও কিন্তু আপনি পরীক্ষার খাতায় নম্বর পেয়ে যাচ্ছেন কিংবা ফিজিক্সের একটা থিওরি প্রমাণ করতে কাজে লাগাতে পারছেন। এই ক্ষেত্রে ক্যালকুলাস কিন্তু গণিত বা বিজ্ঞান নয়, ক্যালকুলাস একটা প্রযুক্তি।

প্রাচীন মানুষের কাছে হাতিয়ার ছিল, কিন্তু সেই অর্থে টেকনোলজি ছিল না। পেশাভিত্তিক শ্রেণীবিন্যাস তখনো তৈরি হয় নি যে কোন একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ের দলের সব হারপুন তৈরি করবে। বাকি সবাই তা নিয়ে শিকারে বেরোবে। কাজেই, এখন আমরা একটা বস্তুর ফিজিক্স নিয়ে যত গভীরভাবে চিন্তা করি, আমাদের পূর্বপুরুষেরা তার চেয়েও বেশি চিন্তা করতেন। চিন্তা করতে বাধ্য হতেন বলা যায়। ফলে, তাদের মগজের ব্যবহারও ছিল বেশি।

আমরা যে দিন দিন আমাদের মগজের ব্যবহার কমিয়ে দিচ্ছি, তা নিয়ে কখনো ভেবেছি কি? লাইফস্টাইলের দিক দিয়েও তারা আমাদের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে ছিলেন। আজ একজন কর্পোরেট মানুষের ঘুম ভাঙে সকাল সাতটায়। কোনোভাবে নাশতা করে তাকে অফিসের উদ্দেশ্যে দৌড়াতে হয়। তারপর আট কি দশ ঘণ্টা অমানুষিক খাটা খেটে রাতে বাসায় ফিরে আর কিছু করার এনার্জি থাকে না আসলে। তা বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলাই হোক কিংবা স্ত্রীর সাথে!

অথচ ত্রিশ হাজার বছর আগে সেই একই মানুষটি সকাল নয়টা কি দশটায় হেলেদুলে জঙ্গলের উদ্দেশ্যে বের হত। ফলমুল, মাশরুম সংগ্রহ করে দিন কাটাতো। মাঝেমধ্যে ভুল করে বাঘ মামার টেরিটোরিতে ঢুকে পড়েই আবার দৌড়ে পালাতো। চারটার দিকে বাসায় ফিরে পরিবারের সবাই মিলে রান্নাবান্না করতো। বাচ্চাদের সাথে খেলতো। বাঘ মামার হাত থেকে বেঁচে আসার গল্প শোনাতো। সপ্তাহে পাঁচদিন বা ছয়দিন যে সে এই রুটিন ফলো করতো তাও নয়। বড়জোর দুই কি তিন দিন। অনেক সময় ভালো একটা শিকার পেলে গোটা সপ্তাহই পায়ের উপর পা তুলে কাটিয়ে দিত। কাজেই, হ্যাংআউট করার জন্য তাদের হাতে ছিল অফুরন্ত সময়।

আজ আমাদের হ্যাঙ্গাউট করার জন্য কতো প্ল্যান-প্রোগ্রাম করতে হয়। নিজের স্কেজিউল দেখতে হয়। বসের স্কেজিউল দেখতে হয়। তাদের এইসব স্কেজিউল দেখার প্যারা ছিল না। পরিবারের সবাই মিলে যখন খুশি যেখানে খুশি হ্যাং আউট করতে যেত। আগে থেকে বুকিং করারও ঝামেলা ছিল না। দুর্ভিক্ষ বা অপুষ্টি কাকে বলে তারা জানতো না। দুর্ভিক্ষ তো কৃষিযুগের সৃষ্টি আর অপুষ্টি আধুনিক শিল্পযুগের। তাদের গড় আয়ু হয়তো খুব বেশি ছিল না। তিরিশ কি চল্লিশ বছর। তার কারণ অধিক শিশু মৃত্যুহার। কিন্তু যারা অল্প বয়সে সারভাইভ করে যেত, তারা ঠিকই বছর ষাটেক সুস্থ সবল বেঁচে থাকতো।

তাদের এই ভাল থাকার রহস্য ছিল তাদের বৈচিত্র্যময় খাবারের মেন্যু। আমাদের দেশে একজন কৃষক যেখানে সকালের নাশ্তায় ভাত খান, দুপুরের লাঞ্চে ভাত খান এবং রাতের ডিনারেও ভাত খান, সেখানে এই মানুষেরা সকালে হয়তো খেতো আঙুর আর মাশরুম, দুপুরে কচ্ছপের ফ্রাই আর রাতে খরগোশের স্টেক। পরের দিন আবার মেন্যু বদলে যেত। এই করে করে সব রকম পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবারই তাদের খাওয়া হয়ে যেত।

অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-

পরবর্তীতে কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ কোন একটা ফসলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এতে একে তো সব রকম পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবারে ছেড়ে এক শর্করার দিকে ঝুঁকে পড়ায় মানবজাতির সামগ্রিক স্বাস্থ্য আগের তুলনায় খারাপ হয়ে পড়ে, তার উপর এক বছর ধান না হলে পুরো দেশে দুর্ভিক্ষ লেগে যেত। শিকারী সমাজ এই দিকে দিয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। কোন একটা নির্দিষ্ট ফসলের উপর এদের নির্ভরশীলতা না থাকায় বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস যাই হোক না কেন এদের খাবার ম্যানেজ হয়ে যেত। আর কিছু না হোক, বার রকমের ফলমূল তো আছেই।

আমাদের যাবতীয় রোগবালাইয়ের জন্মও এই কৃষি সমাজে এসে। যত রকম সংক্রামক রোগ আছে হাম, যক্ষ্মা, বসন্ত সব কিছুর জীবাণু আমাদের এই গবাদি পশু থেকে পাওয়া। আরেকটা কারণ হলো- কৃষি আর শিল্পভিত্তিক সমাজেই অল্প জায়গায় অনেক মানুষ খুব ঘিঞ্জি পরিবেশে বাস করে। শিকারী সমাজে এর বালাই ছিল না। মানুষ ঘুরে ঘুরে বেড়াতো। কোন এক এলাকায় রোগের বিস্তার হলে সেই এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেত। মহামারী বিস্তৃত হবার চান্সই পেত না।

তাই বলে যে প্রাচীন মানুষের সব কিছুই যে ভালো ছিল তা নয়। এই যে মহামারী বিস্তৃত হবার চান্স পেত না, তার কারণ হচ্ছে সেই সমাজে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ফেলে সবাই অন্য কোথাও চলে যেত। বৃদ্ধদের অবস্থা তো ছিল আরও করুণ। বৃদ্ধ মাত্রই একটা দলের জন্য বোঝা। তো সেই বোঝা ঘাড় থেকে নামানোর জন্য তারা বৃদ্ধদের কাঁধে কুড়োল দিয়ে আঘাত করে তাকে পরপারে পৌঁছে দিত। এই একটা দিকে আমরা আধুনিক মানুষ অনেক সভ্য হয়েছি বলা যায়। আমরা আমাদের বৃদ্ধ বাবা-মা কে কুড়োল দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলি না। বড়জোর বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে আসি।

শিশু হত্যা তো ছিল অতি সাধারণ ঘটনা। অবশ্য শিশু হত্যার এই রেওয়াজ আমরা মধ্যযুগে আরবে আর তারও আগে গ্রীক সমাজে দেখেছি। শিশু জন্মগতভাবে দুর্বল বা ভগ্নস্বাস্থ্য হলে এই শিশু সমাজের কোন কাজে আসবে না ভেবে তাকে হত্যা করতো। এই সেদিন পর্যন্ত প্যারাগুয়েতে আচে নামক এক জনগোষ্ঠী বাস করতো, যাদের জীবনধারা খুঁটিয়ে দেখলে প্রাচীন মানুষের জীবন আচরণের কিছুটা আঁচ পাওয়া যাবে। এরা এই আরব বা গ্রীকদের চেয়েও ছিল এক ধাপ এগিয়ে। শিশুর মাথায় চুল কম, তাকে মেরে ফেলো। শিশুটির চেহারা জোকার জোকার টাইপ তাকে মেরে ফেলো। কিংবা দলে মেয়ে বেশি হয়ে গেছে। আর মেয়ের দরকার নাই। কাজেই, এই মেয়ে শিশুটিকে মেরে ফেলো। আমাদের ডেফিনিশন অনুযায়ী এগুলো হিংস্রতা। ওদের ডিকশনারীতে হয়তো এগুলোকে হিংস্রতা ধরা হত না। আমরা যেমন অবলীলায় মানবশিশুর ভ্রূণ মেরে ফেলি, ওরাও ঠিক তেমনি অদরকারি মানব শিশু মেরে ফেলতো। আফটার অল, মানুষ তো। কিছু নির্বিকার হিংস্রতা আমাদের রক্তে, ইতিহাসে বেশ ভালোভাবেই আছে।


আদিম সমাজের বিশ্বাস

(ছবিটা ১২ থেকে ২০ হাজার বছর আগে আঁকা। এটা পাওয়া গেছে ফ্রান্সের দক্ষিণে লাসকাউ নামের এক গুহায়।)
(ছবিটা ১২ থেকে ২০ হাজার বছর আগে আঁকা। এটা পাওয়া গেছে ফ্রান্সের দক্ষিণে লাসকাউ নামের এক গুহায়।)

বিটায় আমরা একজন মরা মানুষ দেখতে পাচ্ছি। বাইসনের আক্রমণে যার মৃত্যু হয়েছে। মানুষটির মুখে পাখির আদল। কেন আমরা জানি না। মৃত্যুর পরও মানুষটির পুরুষাঙ্গ খাড়া হয়ে আছে। কেন তাও আমরা জানি না। মানুষটির পাশেই আরেকটা পাখি দেখতে পাচ্ছি আমরা। স্কলাররা বলেন এই পাখি আমাদের আত্মার প্রতীক। বাইসনের আক্রমণে মানুষটির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আত্মারূপী পাখিটি খাঁচা ছেড়ে পালিয়েছে।

কথা হচ্ছে শিকারী মানুষেরা কি সত্যিই এত গভীর অর্থ ভেবে ছবিটি এঁকেছিল? না এগুলো আমাদের ইন্টেলিজেন্ট ইন্টারপ্রিটেশন? টাইম মেশিনে করে অতীতে যাওয়া ছাড়া এই রহস্য ভেদ করার আসলে কোন উপায় নেই।  তখনো মানুষ শিকারী দশা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তবে মানুষ যে উন্নতি করছে তার সমস্ত রকম লক্ষণ এই ছবিতে বিদ্যমান।

( ছবিটা প্রায় ৯ হাজার বছর আগের। পাওয়া গেছে আর্জেন্টিনার এক গুহায়।)
( ছবিটা প্রায় ৯ হাজার বছর আগের। পাওয়া গেছে আর্জেন্টিনার এক গুহায়।)

এই ছবিকে বলা হয় শিকারী যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্ম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই চিত্রকর্মের তাৎপর্যও আমরা সঠিক জানি না। আমি নিজে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছি। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম পৃথিবীর মানুষ পাপে ডুবে আছে। এবং মানুষ সেটা জানেও। সমস্ত মানুষ এই পাপের গহবর থেকে মুক্তির জন্য হাত বাড়িয়েছে। আশা কোন এক ঈশ্বর বা পয়গম্বর এসে তাদের এই অতল গহবর থেলে টেনে তুলবে।

যথারীতি, আপনাদের প্রত্যেকেরই নিজ নিজ ব্যাখ্যা থাকতে পারে। আর আর্টের মূল সৌন্দর্য তো এটাই। কোন ব্যাখ্যাই সঠিক না। আবার সব ব্যাখ্যাই সঠিক। এই চিত্রকর্মগুলো আসলে আমাদের এক অদেখা ভুবনে নিয়ে যায়। আমাদের পূর্বপুরুষেরা কেমন ছিল, তাদের ধর্ম, সমাজ, সংস্কার এগুলো কেমন ছিল তা বোঝার জন্য এই চিত্রকর্ম ছাড়া আমাদের হাতে খুব বেশি মালমশলা নেই।

এই মালমশলাগুলো জোড়া লাগিয়েই আমরা আসলে আমাদের ইতিহাস নির্মাণ করি। ইতিহাসে তাই ধ্রুব সত্যি বলতে কিছু নেই। ইতিহাস আসলে আমাদের কল্পনার সবচেয়ে লজিক্যাল রূপায়ন। ওয়েল, চিত্রকর্ম ছাড়া আমাদের হাতে আর যা আছে, তা হলো সেই আমলের কিছু ফসিল। বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলে পরিচয়! ঠিক তেমনি মানুষ তোমার কর্ম, ফসিলে পরিচয়।

প্রত্নতাত্ত্বিকরা রাশিয়ায় তিরিশ হাজার বছর আগের এক কবর আবিষ্কার করেন। কবরটিতে তারা পঞ্চাশ বছর বয়স্ক এক লোকের কঙ্কাল পান যার সারা দেহ হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি মালা দিয়ে ঢাকা। হাতির দাঁত যে সেকালে বেশ দামী বস্তু ছিল, তা প্রাচীন ইতিহাসের পাঠক মাত্রই জানেন। সামান্য আইডিয়ার জন্য ‘রিভার গড’ পড়ে দেখতে পারেন। কিঞ্চিৎ মোটা বই। জীবন থেকে কয়েক ঘণ্টা মূল্যবান সময় চলে যাবে। কিন্তু আল্টিমেটলি ঠকবেন না কথা দিচ্ছি।

লোকটার হাতে ছিল হাতির দাঁতের ব্রেসলেট। আশেপাশে আরও কিছু কবরে এরকম বাহারি মালার সন্ধান পাওয়া গেছে। কিন্তু ওগুলোতে পুঁতির সংখ্যা ছিল কম। এই থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করেন এই ব্যাটা নিশ্চয়ই দলের লীডার ছিল। এজন্যই তার কবরে হাতির দাঁতের ছড়াছড়ি। কে বলে প্রাচীন সমাজ সাম্যবাদী সমাজ ছিল! কেবল খাদ্যের দিক থেকে হয়তো ছিল। কিন্তু সামাজিক স্ট্যাটাস নির্ণয় করে যে উপাদানগুলো সেদিক দিয়ে প্রাচীন সমাজ আজকের মতই বৈষম্য ও অনাচারে ভর্তি ছিল। তফাৎ এটুকুই আমাদের সমাজে এই নির্ণায়কগুলো ফ্ল্যাট, গাড়ি-বাড়ি, তাদের সমাজে ছিল হাতের দাঁতের তৈরি গহনা।

অবশ্য এর চেয়েও বড় বিস্ময় প্রত্নতাত্ত্বিকদের জন্য এখানে অপেক্ষা করছিল। একটা কবরে তো দুটো কঙ্কালের খোঁজ পাওয়া গেল। কঙ্কাল দুটো আবার উলটো দিক করে মাথায় মাথায় লাগানো। একটা কঙ্কাল বার-তের বছর বয়সী একটা ছেলের। আরেকটা নয়-দশ বছর বয়সী একটা মেয়ের। প্রত্যেকের শরীরই হাতির দাঁতের তৈরি হাজার পাঁচেক পুঁতি দিয়ে ঢাকা। একটা পুঁতি নিখুঁতভাবে তৈরি করতে একজন শ্রমিকের পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগার কথা। সেই হিসেবে হাজার দশেক পুঁতি তৈরি করতে সাড়ে সাত হাজার শ্রমঘণ্টা লাগবে একজন শ্রমিকের। সোজা বাংলায় তিন বছরের মত।

কার ঠেকা পড়েছে তিন বছর খেটে এরকম মালা তৈরি করবে? আর মৃত্যুর পর এরা নিশ্চয়ই মালা তৈরির জন্য তিন বছর অপেক্ষা করেনি। তার মানে একদল মানুষ মিলে অতি অল্প সময়ে এই গহনাগুলো তৈরি করেছে। এখন দলনেতাকে না হয় গহনা-টহনা পরিয়ে কবর দেয় যায়। এই বাচ্চাকাচ্চাকে কেন? একদল বলেন, এরা সাধারণ বাচ্চাকাচ্চা না। এরা দলপতির সন্তান। কাজেই, এদের অকাল মৃত্যুতে দলপতি যে সম্মান পেত, এরাও সেই সম্মানই পাবে। ‘রিচ কিডস অফ ঢাকা’রা যেমন পায় আরকি! আরেকদল বলেন, এদের সম্ভবত কোন রিচুয়ালের অংশ হিসেবে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেয়া হয়েছিল। কাজেই, এত সম্মান।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ এই দেবতার আইডিয়া পেলো কোথা থেকে? এক কথায় এর উত্তর দেয়া সম্ভব না। তবে এটুকু অনেকটা নিশ্চিত, মানুষের মধ্যে প্রথম যে ধর্মের বিকাশ ঘটে তাকে বলা যায় এনিমিজন। এনিমিজম এর বাংলা হতে পারে প্রাণীপূজা। বেটার হয় আত্মাপূজা বললে। এরা বিশ্বাস করতো সব কিছুর মধ্যেই আত্মা বিরাজমান।

সামান্য এই পাথর সেই পাথরও চাইলে আমাদের জন্য দোয়া করতে পারে কিংবা আমাদের অভিশাপ দিতে পারে। খালি পাথরই নয়, বাড়ির পাশে যে পাকুড় বৃক্ষ কিংবা বয়ে যাওয়া নদী প্রত্যেকেরই আত্মা আছে। মানুষ যে যুগ যুগ ধরে এদের পূজা করে আসছে তা এই বিশ্বাস থেকেই। বস্তুজগতের সাথে মানুষের এই যে আত্মার সম্পর্ক এটা কিন্তু নতুন নয়। বহুদিন একটা মোবাইল সেট ব্যবহার করে দেখবেন, ঐ সেটটার প্রতি মায়া পড়ে যাবে। বাজারে নতুন স্মার্টফোন এলেও সেটা তখন আর ফেলে দিতে ইচ্ছা হবে না। যারা ঋত্বিকের (ঋত্বিক রোশন না, ঋত্বিক ঘটক) ‘অযান্ত্রিক’ দেখেছেন, তারা ব্যাপারটা আরও ভালো রিলেট করতে পারবেন। গল্পে নায়কের পেটে ভাত নেই, কিন্তু সে তার প্রিয় গাড়িটা তবু বেঁচবে না। সে গভীরভাবে বিশ্বাস করে, গাড়িটার একটা প্রাণ আছে। আত্মা আছে। গাড়িটা বেঁচে দিলে সে নিজে যেমন প্রেমিকা হারানোর ব্যথায় কষ্ট পাবে, গাড়িটাও কম দুঃখ পাবে না।

এনিমিস্টরা বিশ্বাস করে মানুষ আর তার আশেপাশের সত্ত্বার মধ্যে কোন ব্যবধান নেই, কোন হায়ারার্কি নেই। মানুষের জন্য সবাই, আবার সবার জন্য মানুষ। একজন শিকারী যেমন নাচ-গান সেরেমনির মাধ্যমে একদল হরিণকে তাদের ডেরায় ইনভাইট করতে পারে। তারপর তাদের রিকুয়েস্ট করতে পারে হরিণের দলের একজন যেন স্বেচ্ছায় আত্মোৎসর্গ করে। তাদের বিশ্বাস ছিল, ঠিকমত মেসেজ দিতে পারলে হরিণের কাছেও মেসেজ পৌঁছানো সম্ভব। হরিণ যদি নিজে থেকেই নিজেকে কুরবানী করে তো ভালো, না হলে হরিণ শিকার করে পরে মাফটাফ চেয়ে নিলেই হবে।

এইখান থেকেই সম্ভবত ধারণা আসে যে, হরিণের কাছে মেসেজ পৌঁছানো গেলে আত্মার কাছে পৌঁছানো যাবে না কেন? এইখান থেকেই প্রাচীন সমাজে শামানের উৎপত্তি। শামানদের কাজ ছিল এই জগতের মানুষের সাথে অন্য জগতের মানুষের যোগাযোগ ঘটিয়ে দেয়া। এই অন্য জগৎ মানে নট নেসেসারিলি পরজগত। অনন্ত অসীম পরজগত কিংবা একক ঈশ্বরের ধারণা তখনো গড়ে ওঠেনি। কিন্তু মানুষ মরে গেলেও যে তার আত্মা মরে না আর সেই আত্মা জীবিতাবস্থায় তার কাছের মানুষদের আশেপাশেই ঘুরে বেড়ায়, তাদের ভাল করে কিংবা অনিষ্ট করে এই ব্যাপারে তাদের একটা পাকাপাকি রকম বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল। অবশ্য আবারও ঐ একই কথা। পুরোপুরি নিশ্চিৎ করে আমরা কিছুই বলতে পারি না। অতীতকে ডিকোড করার জন্য আমাদের হাতে যে সামান্য কিছু চিত্রকর্ম আর ফসিল ছাড়া তেমন কিছু নেই।


ইতিহাস জুড়ে বর্বরতার চিহ্ন

লা হয়, আমরা সবাই কাবিলের সন্তান। বড় ভাই কাবিল ছোট ভাই হাবিলকে খুন করে পৃথিবীতে তার লিগ্যাসী প্রতিষ্ঠা করে গেছে। কাজেই, অল্পবিস্তর খুনে সত্ত্বা আমাদের সবার মধ্যেই কমবেশি আছে। কারোটা প্রকাশ্য, কারোটা শিক্ষা-সংস্কৃতির মোড়কে এখনো ঢাকা পড়ে আছে। এই হাবিল-কাবিলের যে গল্পটা আমরা ছোটবেলায় শুনেছি, তাতে কিছুটা ফাঁকি আছে। হাবিল ভালো আর কাবিল খারাপ এই বাইনারীর ছাঁচে পুরো ঘটনা ফেলতে গিয়ে মূল বিষয়টাই আমাদের স্পর্শ করা হয় না। কেননা পৃথিবীর বাকি অর্ধেক গল্পের মতই এই গল্পের মূলেও আছে সেক্স।

হাবিল-কাবিল দুই ভাই। এতদূর পর্যন্ত গল্পটা ঠিকঠাক এগোয়। সমস্যাটা হয় তখনই, যখন হাবিলের সাথে তার এক যমজ বোনের জন্ম হয়। আর কাবিলের সাথে জন্ম নেয় আরেক যমজ বোন। এখন হাবিল-কাবিল হচ্ছে আদমের দুই সন্তান। পৃথিবীতে তখন মানুষ বা জনপ্রানী বলতে আর কেউ নেই। কাজেই, মানবজাতির বংশরক্ষার জন্য আপন বোনকে বিয়ে করা ছাড়া আর কোন গতি ছিল না। আল্লাহ তখন একটা নিয়ম করে দিলেন। হাবিল বিয়ে করবে কাবিলের সাথে জন্ম নেয়া যমজ বোনকে। কাবিলের ক্ষেত্রে সেটা ভাইস ভার্সা।

এখন দেখা দিল আসল সমস্যা। কাবিলের সাথে জন্ম নেয়া যমজ বোনটা বেশি সুন্দরী। কাবিল তাকেই বিয়ে করতে চায়। এদিকে হাবিল আল্লাহর আদেশের ভয়েই হোক কিংবা কাবিলের যমজের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়েই হোক- সেও তাকেই বিয়ে করতে চায়। হাবিলের সাথে জন্ম নেয়া যমজটার ওদিকে কোন খবর নেই। সে সুন্দরী নয় বলে কেউ তাকে পাত্তা দেয় না! কাজেই, সুন্দরী মেয়েরা সামান্য ভাব নিলেও এতে রাগ করার কিছু নেই। সৃষ্টির শুরু থেকেই এমনটা চলে আসছে।

যাই হোক, আদম তখন তাদের একটা প্রস্তাব দিলেন। দু’জনকে বললেন আল্লাহর উদ্দেশ্যে কিছু একটা কুরবানী দিতে। যার কুরবানীতে আল্লাহ লাইক দিবেন, সেই কাবিলের যমজ বোনকে পাবে। কাবিল কিছু শস্য অফার করলো আল্লাহকে। আর হাবিল দিল একটা সুস্থ সবল ছাগল। বলা বাহুল্য, হাবিলের কুরবানী কবুল হলো। কাবিল মনে করলো, এই সব তার বাপের কারসাজী। হাবিল তার বাপ আদমের পছন্দের ছেলে বলে আদম তার জন্য আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করেছে। বাকি ইতিহাস আমাদের জানা। কাবিল হাবিলকে মেরে ফেললো। এইখানেই গল্প শেষ নয়। মেরে ফেলার পর সে বিরাট অনুতপ্ত হলো। আর হাবিলের লাশ নিয়ে পথে পথে ঘুরতে থাকলো।

হাবিল-কাবিলের এই মিথ যে কেবল আব্রাহামিক কালচারেই সীমাবদ্ধ- তা নয়। রোম নগরীর প্রতিষ্ঠার পেছনেও এমন একটা মিথ চালু আছে। দুই ভাইয়ের যুদ্ধ ও রক্ত থেকে রোম নগরীর পত্তন। একই মিথ সম্ভবত এক এক জায়গায় এক একভাবে ছড়িয়েছে। আসল কথা, মানবজাতির ভায়োলেন্সের ইতিহাস খুব নতুন কিছু নয়। বাস্তবে ভায়োলেন্স ছিল বলেই মিথে সেটা বারবার এসেছে। কাজেই, মিথ ছেড়ে এবার বাস্তবে আসি।

পর্তুগালে একটা প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ করে দেখা গেল, ৪০০ কঙ্কালের মধ্যে মাত্র দুটোতে ভায়োলেন্সের চিহ্ন পাওয়া গেছে। একই রকম ফলাফল পাওয়া গেছে ইসরায়েলেও। এখানে ৪০০ কঙ্কালের মধ্যে মাত্র একটিতে ভায়োলেন্সের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই ফলাফলগুলো মানুষের হিংস্রতার সপক্ষে খুব জোরালো প্রমাণ নয়।

ইন্টারেস্টিং রেজাল্ট পাওয়া গেছে দানিউব উপত্যকায়। এখানে ৪০০ কংকালের ১৮টিতে ভায়োলেন্সের প্রমাণ স্পষ্ট। শুনে সংখ্যাটা কম মনে হতে পারে। কিন্তু পার্সেন্টেজ করলে ব্যাপারটার ভয়াবহতা বোঝা যাবে। জরিপের ফলাফলকে সঠিক ধরলে বলতে হয়, শতকরা ৪.৫ ভাগ মানুষ সে উপত্যকায় মারামারি খুনোখুনি করে মরতো। আজ এই পার্সেন্টেজ নেমে এসেছে ১.৫ এ। সমস্ত যুদ্ধ, টেরোরিস্ট এ্যাটাক আর লোকাল সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাস মিলিয়েই। তাহলেই বোঝেন, দানিয়ুব উপত্যকার মানুষ সেকালে কীরকম হিংস্র ছিল। এর সাথে কেবল তুলনা দেয়া যায় বিশ শতকের হিংস্রতার। লিখিত ইতিহাসে মানবজাতি সবচেয়ে বাজে সময় পার করেছে বিশ শতকে। দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের। ফলাফল বিশ শতকে প্রতি ১০০ জনে ৫ জন ভায়োলেন্সে মরেছে।

হাবিল-কাবিলের গল্প বড়জোর ৬ হাজার বছর পুরানো। সুদানেই ১২ হাজার বছর আগের এক কবরস্থানে ৫৯টা এমন কঙ্কাল পাওয়া গেছে যার মধ্যে ২৪টার গায়েই তীরের ফলার চিহ্ন পাওয়া গেছে। এক মহিলার গায়ে তো রীতিমত ১২টা ক্ষতচিহ্ন। যুদ্ধ শেষে পরাজিত গোত্রের নারীদের সাথে কী ব্যবহার করা হয়- আমরা সবাই জানি। এই কালচার হঠাৎ মধ্যযুগে তৈরি হয়নি। বহু আগে থেকেই এই নেশা আমাদের রক্তে মিশে আছে।

ব্যাভারিয়া (আজকের জার্মানিতে) জাস্ট একটা কবরের মধ্যেই খালি নারী ও শিশুদের লাশ পাওয়া গেছে। কোনরকম যত্ন ছাড়াই স্তূপ করে রাখা লাশ। প্রতিটা লাশই সেকালের অস্ত্র দিয়ে ভয়ানক রকম খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা। অল্প যে ক’টা পুরুষ কঙ্কাল পাওয়া গেছে, প্রতিটাতেই অত্যাচারের চিহ্ন আরও ভয়াবহ। বোঝাই যায়, কোন এক গোত্রের উপর সেসময় গণহত্যা হয়েছে। হত্যা শেষে সবগুলো লাশ নির্মমভাবে এক কবরে চাপা দেয়া হয়েছে। এর সাথে কেবল তুলনা চলে নাৎসী জার্মানদের কিংবা ৭১ সালে পাকিস্তানিদের বর্বরতার।

আমাদের হাতে এভিডেন্স আসলে খুব কম। কাজেই আমরা নিশ্চিৎ করে বলতে পারছি না অধিকাংশ মানুষ পর্তুগাল আর ইসরায়েলের সেকালের অধিবাসীদের মত শান্তশিষ্ট ছিল না দানিউব উপত্যকার মত খুনে, রক্তলোলুপ ছিল। তবে সেকালের দানিয়ুব বা সুদানের তুলনায় কিংবা এই তো সেদিনের বিশ শতকের তুলনায় আমরা যে এখনো অনেক ভালো আছি একথা নিঃসন্দেহেই বলা যায়। শতাব্দীর শেষাবধি এই কনসিস্টেন্সি ধরে রাখতে পারি কিনা সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।


অন্যান্য পর্বগুলো পড়ুন এখানে ⇑

Related Articles

5 1 vote
Post Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
Back to top button
0
Rate & Give your feedback!x
()
x

পুলিন বকসী: প্রথমত শহীদ সাহেবের ডান পন্থার কারনে ভাসানী তার বিরোধীতা করেন নি। শহীদ সাহেবের তীব্র আমেরিকা প্রীতিই (সিয়াটো-সিন্টো চুক্তি) ন্যাপ গঠনের অনেকগুলো কারনের অন্যতম কারন।

দ্বিতীয়ত আপনি যেভাবে তাকে আইয়ুব খানের একজন প্রায় 'দালাল' বা 'চাটুকার' বানায়া দিলেন সেই ভাসানীই কিন্তু ৬৯ এ ব্যপক ভূমিকা রেখেছিল শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে। শুধু তাই না এই উনসত্তরের আন্দোলনের শুরুটাও ভাসানীদের হাত ধরে।

ধন্যবাদ।

Farid Ahmed: আমি বহু জনকে জিজ্ঞেস করেছি, কেউ আমাকে সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারে নাই কেনো মওলানা ভাসানী আইয়ুব খানের প্রতিনিধি হিসাবে চীনে গিয়েছিলেন। আশা করি আপনি আলোকপাত করতে পারবেন এ ব্যাপারে। তাঁর আইয়ুব প্রীতি আমার আবিষ্কার না। ষাটের দশকেই এ নিয়ে বিস্তর কথা উঠেছে। আমি আগের একটা লেখায় সব রেফারেন্স দিয়েছি। আমি ভাসানীকে এখনও দালাল কিংবা চাটুকার বলি নাই, যদিও বলা উচিত ছিলো আমার।

১৯৮৬-৮৭ সালে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন জালাল আহমেদ। ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি এরশাদের সাথে হাত মেলান। এরশাদ তাঁকে অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশ মিশনে সেকেন্ড সেক্রেটারি পদে নিয়োগ দেয়। জালাল আহমেদ সংগোপনে তাঁর গোপনে বিয়ে করা বউকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমান। এখন পর্যন্ত এই অপরাধে ছাত্রদল তাঁকে দালাল বলে। আমরাও তাঁকে এরশাদের দালালই বলতাম। দালালকে তো দালালই বলা লাগে, তাই না?

Marzia Prova: ফরিদ ভাই আইয়ুব শাসনের আমলে পাকিস্তানের জোরদার উন্নয়ন দেখা যাচ্ছিল৷ ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এর আগে তার উন্নয়নের দশক পালন করার প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছিল। ভাসানীর কথা ছিল, "পশ্চিম পাকিস্তান যদি পূর্ব পাকিস্তানের উপর শোষণ না বন্ধ করে, তবে পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম।" এখন তথাকথিত আইয়ুবের উন্নয়ন পূর্ব বাংলাতেও হয়েছিল। শোষণের বিপরীতে এই উন্নয়নকে যদি সফলতা হিসেবে দেখা হয়, তবে ভাসানী একজন পাকিস্তান নাগরিক হিসেবে সফল শাসক এর প্রতি মুগ্ধতা ছিলেন! তাই নয় কি?

আপনি জাস্ট এই বিষয়টা এখনকার বাংলাদেশের সাথে মিলান। উন্নয়ন দিয়ে সফলতাকে নির্ধারণ বাকি অনেক কিছুকে যখন আড়াল করা হয়, তখনও তো দেশের অনেক মানুষের সেই সফল শাসকের প্রতি মুগ্ধতা থাকে৷ সম্ভবত ভাসানীর আইয়ুব প্রীতি সে জায়গা থেকে। জাস্ট আপনার লেখা আর কমেন্ট পড়ে এইটা মনে হইল। এই মানসিকতা অবশ্যই দ্বান্দ্বিক এবং স্ববিরোধী কোন সন্দেহ নাই৷ হয়ত এই মানসিকতা না থাকলে ভাসানী অন্যভাবে স্মরণীয় থাকতেন।

Farid Ahmed: আইয়ুব খানের সাথে মওলানার ওই উন্নয়নমূলক মুগ্ধতার সম্পর্ক ছিলো না। উনি ৬৩-তে সরকারী একটা ডেলিগেশন টিমের প্রধান হিসাবে চিনে যান। আইয়ুব খান সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে তাঁর বিন্দুমাত্র বিবেকে বাধেনি, যেখানে ৬২-তে বিশাল এক ছাত্র আন্দোলন হয়ে গিয়েছিলো আইয়ুব খান সরকারের গণবিরোধী শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে।


মওলানা ভাসানী ৬৯ এ ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে। শুধু তাই নয়, এই উনসত্তরের আন্দোলনের শুরুটাও ভাসানীদের হাত ধরে। তাহলে তাকে আইয়ুব খানের একজন প্রায় 'দালাল' বা 'চাটুকার' হিসেবে দেখাটা কি যৌক্তিক?

এই বক্তব্যের মূল কারণ হচ্ছে আমি আমার লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে মওলানা ভাসানী আইয়ুব খানের প্রতি সহানুভুতিশীল ছিলেন, তাঁর সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে চীন গমন করেছিলেন এবং ১৯৬৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন দেবার প্রতিশ্রুতি দেবার পরেও মওলানা ভাসানী গোপনে আইয়ুব খানকে সমর্থন দিয়েছিলেন।

এই অভিযোগটির লজিক্যাল ফ্যালাসিটা আগে বলি। তারপর আমি আইয়ুবের সাথে ভাসানীর সখ্যতা ব্যাখ্যা করবো।

ঊনসত্তরে মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন, ঊনসত্তরের আন্দোলনের তাঁর দুর্দান্ত ভূমিকা ছিলো, এই তথ্য দিয়ে কি তাঁর অন্য কাজগুলোকে জাস্টিফাই করা যায়? যায় না। আমি গতকাল একটা অপরাধ করেছি, আর আজকে একটা ভালো কাজ করেছি। এখন যদি আমি যুক্তি দেই যে আমি তো আজকে ভালো কাজ করেছি, তারপরেও আমাকে আপনারা অপরাধী বানিয়ে দিলেন, সেটা কেমন লাগবে আপনাদের কাছে? তিনি তেষট্টিতে আইয়ুবের প্রতিনিধি হিসাবে চীনে গেছেন, এই অভিযোগ ঊনসত্তরের ভূমিকা দিয়ে আড়াল করাটা আর যাই হোক না কেনো যুক্তিসঙ্গত কোনো কাজ হতে পারে না। ঊনসত্তর নয়, মূলত আটষট্টি সাল থেকে আইয়ুবের সমালোচনায় নামেন মওলানা ভাসানী। কিন্তু তেষট্টি থেকে আটষট্টির আগ পর্যন্ত তাঁর ভূমিকা কী আইয়ুবের ব্যাপারে? আসুন, ইতিহাস থেকে দেখি আমরা তিনি কী করেছিলেন সেই সময়ে।

১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসের ৭ তারিখে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার মির্জা দেশে মার্শাল ল জারি করেন। তিনি যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং আইয়ুব খানকে সুপ্রিম কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ দেন। ইস্কান্দার মির্জার দুর্ভাগ্য, এর মাত্র তিন সপ্তাহ পরে অক্টোবর মাসের ২৭ তারিখে আইয়ুব খান তাঁকেই উৎখাত করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নেন। ইস্কান্দার মির্জা মার্শাল ল জারি করার পর ১২ তারিখে নিরাপত্তা আইনে মওলানা ভাসানীকে বন্দি করেন। দীর্ঘ চার বছর তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন।

১৯৬২ সালের ৩রা নভেম্বর তাঁকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর পরই তিনি আইয়ুব খানের সাথে দেখা করেন, যেটা প্রবলভাবে সমালোচিত হয়। দেওয়ান শামসুল আরেফিন তাঁর, “Bhashani, the maulana Bhashani, the comrade” বইতে লিখেছেন,

“After more than four years in prison, the Moulana was released on November 3 1962. A few days after his release, he met with President Ayub in Rawalpindi. The Ayub-Bhashani meeting created a mixed reaction among the left political circles.”

আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের সময় পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় মিত্র ছিলো যুক্তরাষ্ট্র। চীনের সাথে পাকিস্তানের সীমান্ত নিয়ে বেশ ঝামেলাই ছিলো বলা চলে। সীমান্ত বিরোধ নিয়ে ১৯৫৯ সালে চীনের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। দুই পাশে দুই শত্রু দেশ ভারত এবং চীনকে পুষে রাখাটা খুবই ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ এই বিবেচনা থেকে চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের দিকে অগ্রসর হয় পাকিস্তান। এর জন্য অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের রোষেরও শিকার হয় পাকিস্তান। কিন্তু, তারপরেও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীনকে প্রাধান্য দেবার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান। ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো চীন সফর করেন।

পঞ্চাশের দশক থেকেই মওলানা ভাসানীর সাথে চীনের সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো রাজনৈতিক কারণে। চীনের সাথে সম্পর্ক আরো দৃঢ় করার জন্য মওলানার সাহায্য কামনা করেন তিনি। ১৯৬৩ সালের অগাস্ট মাসে তিনি মওলানাকে রাওয়ালপিণ্ডিতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। পত্র-পত্রিকাতে আইয়ুব-ভাসানী আঁতাতের খবর প্রকাশিত হতে থাকে। ভাসানী এগুলোকে ‘স্বার্থান্বেষী মহলের ছড়ানো গুজব’ বলে উড়িয়ে দেন।

এই আঁতাত যে গুজব না, সেটা টের পাওয়া যায় পাকিস্তানের প্রেরিত ডেলিগেশন টিমের প্রধান হওয়ার মধ্য দিয়ে। জাতীয় স্বার্থে তিনি এই দলের প্রধান হিসাবে চীনে যাচ্ছেন বলে তিনি জানান।

সেপ্টেম্বর মাসের ২৫ তারিখে ঢাকা থেকে প্রথমে করাচি যান তিনি। সেখান থেকে রেঙ্গুন হয়ে চীনে পৌঁছান মওলানা ভাসানী। পিকিং এ উষ্ণ অভ্যর্থনা পান তিনি। চীনের প্রিমিয়ার চৌ এন লাই এর সাথে সাক্ষাতে আইয়ুবের সরকারের জন্য সমর্থন প্রত্যাশা করেন তিনি। তিনি বলেন,

“I am old, perhaps I will not have another chance to come to china; I hope you and your country’s government can fully work together with Ayub khan’s government and his representative General Raza.”

চীনের যাবার সুযোগ তাঁর আরেকবারও হয়েছিলো। যদিও পরবর্তী এই সফর খুব বেশি প্রচারণা পায়নি। দেওয়ান শামসুল আরেফিন তাঁর বইতে লিখেছেন,

“Abdul Hamid Khan Bhashani paid another low-profile visit to China in 1964. The second visit was, in fact, more significant than the first one. This time he had exclusive talks with Chairman Mao, Premier Chou and other leaders including Den-Tsiao-ping.”

অগাস্ট মাসে রাওয়ালপিণ্ডিতে আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাৎ, তার মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে সরকারী প্রতিনিধি দলের নেতা হয়ে চীন সফর অন্য দল এবং নিজের দলের মধ্যেও তীব্র সমালোচনার সুত্রপাত ঘটায়। ন্যাপ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পিকিংপন্থী অংশ ভাসানীর নেতৃত্বে থেকে যায়, অন্যদিকে মস্কোপন্থী অংশ কমরেড মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে আলাদা হয়ে যায়।

পিকিং থেকে ফিরে আসার পরে শুধু মওলানা ভাসানী একাই নন, চিনপন্থী কম্যুনিস্টদের একটা বড় অংশ আইয়ুব খানের ভক্ত বনে যায়। আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের মহিমা কীর্তন করা শুরু করেন তারা। বাষাট্টির এতো বড় ছাত্র আন্দোলনের পরে যেখানে আইয়ুবের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার কথা ছিলো তাঁর, সেখানে তিনি আইয়ুব খানকে বিরক্ত না করার সিদ্ধান্ত নেন। ডক্টর নুরুন নবী তাঁর “Bullets of ‘71: A freedom fighter’s story” বইতে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন,

“After that visit, Moulana Bhashani declared his infamous policy statement, “Don’t disturb Ayub”. Bengali people were stunned. That was the biggest mistake of Moulana Bhashani’s political career.”

তারিক আলী চীনপন্থী বাম ছাত্রনেতা ছিলেন। তাঁর একটা বই আছে। বইটার নাম “Pakistan, military rule of peoples power”। বইটা প্রকাশিত হয়েছে দিল্লি থেকে ১৯৭০ সালে। এই বইতে তারিক আলী পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সাথে মাওলানা ভাসানীর নিবিড় সখ্যের কারণ অনুসন্ধান করে তার পটভূমি আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি তাঁর বইতে লেখেন, ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইউব খান মাওলানা ভাসানীকে পাকিস্তানের সরকারী প্রতিনিধি করে চীনে পাঠাতে চাইলে মাওলানা রাজি হন। সেখানে চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুং এর সাথে তাঁর যে গোপন সলাপরামর্শ হয় তার একটা বিবরণ তিনি মাওলানার কাছ থেকেই গ্রহণ করেছিলেন টেপ রেকর্ডারে।

তারিক আলী মওলানাকে প্রশ্ন করেছিলেন, “When you went to China what did Mao discuss with you when you met him?” এর উত্তরে মওলানা বলেছিলেন,

“মাও সে তুং আমাকে বলেন, “আপনি যদি সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন তাতে রাশিয়া, আমেরিকা এবং ভারতের হাতই শক্তিশালী হবে। আপনার কাজে হস্তক্ষেপ করা আমাদের নীতি বিরুদ্ধ, তথাপি আমরা আপনাকে সাবধানে এবং ধীর গতিতে আন্দোলনে অগ্রসর হতে অনুরোধ করবো। আপনার সরকারের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব আরো গাঢ় করার সুযোগ দিন।”

আগেই বলেছি, চীন থেকে ফিরে আসার পরেই মওলানা এবং তাঁর অনুসারীরা আইয়ুব খানের ভক্ত হয়ে যায়। সাপ্তাহিক ‘জনতা’ ছিলো ন্যাপের মুখপত্র। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন আনোয়ার জাহিদ। তিনি তখন ভাসানীর ব্যক্তিগত সচিব। আনোয়ার জাহিদ নিজেও আশির দশকে সামরিক শাসক এরশাদের দালালি এবং গোলামি করেছেন। তাঁকে সবাই ঝাঁড়ুদার মন্ত্রী হিসাবেই চিনতো। কারণ, তিনি একবার প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, এরশাদ যদি বলে, তবে তিনি রাস্তা ঝাঁড়ু দিতেও আপত্তি করবেন না। এই আনোয়ার জাহিদ ১৯৬৫ সালে সাপ্তাহিক জনতায় লেখেন, “There were only two Imperialist voices in Pakistan – Ayub and Vashani.”

আনোয়ার জাহিদের বক্তব্য পরিষ্কার, তিনি তাঁর নেতা এবং আইয়ুব খানকে একই কাতারে দেখেছেন। মওলানা ভাসানীর এই সামরিক শাসকের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের ফলাফল কী হতে পারে, সে সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মফিদুল হক লেখেন,

“১৯৬৩ সালে কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর জেনারেল আইউব আয়োজিত চীন সফরের পর থেকেই মাওলানা ভাসানীর পদস্খলন ঘটতে থাকে। চীনা রাষ্ট্র-নেতাদের আত্মস্বার্থ-প্রণোদিত নীতির কাছে মাওলানা ভাসানীর আত্মসমর্পণ এদেশের বাম রাজনীতির জন্য বিরাট দুর্ভাগ্যের সূচনা করে। রাজনৈতিক বিভ্রান্তি থেকে তিনি যে পথে পা দিয়েছিলেন তা শুধু আইউবের শাসনের সহায়ক ভূমিকা পালন করেনি, মাওলানা তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে সামরিক শাসকচক্রের যে সংযোগ গড়ে ওঠে তা পরবর্তী সময়েও বহু দুর্ঘটনার কারণ হয়েছিল।”

মওলানার নিজের দলের লোক হাজী দানেশও মওলানার সাথে আইয়ুব খানের সমঝোতা ছিলো বলে মনে করেন। এ কারণে আইয়ুবের বিরুদ্ধে তিনি বাম শক্তিগুলোকে একত্রিত করেননি বলে অভিযোগ করেন তিনি। হাজী দানেশ ছিলেন ন্যাপের সহ-সভাপতি। মওলানার সাথে তাঁর কোন্দল এমন পর্যায়ে যায় যে তিনি সহ একটা বিরাট অংশ ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে ন্যাপ থেকে বের হয়ে যান। ১৯৭১ সালের ৮ই জানুয়ারি হাজী দানেশ এক খোলা চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে তিনি বলেন,

“আপনি বিশ্বাস করতেন যে ইস্কান্দর মির্জা ও আইউব খান দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করবে। আইউবের বিরুদ্ধে বামপন্থী শক্তিগুলোকে সংগঠিত করার ব্যাপারে আপনার অনীহা এটাই প্রমাণ করে যে, শোষক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে আপনার যোগ ছিল। আমি এটা বিশ্বাস করতে পারিনা যে, আপনার ও ন্যাপের এ ধরনের নীতির মাধ্যমে লাখ লাখ শোষিত মানুষের মুক্তি আসবে।”

 

Masudur Rahman: ১৯৭০-এর জানুয়ারিতে সন্তোষে কৃষক সম্মেলনে মাওলানা ভাসানী আরও বললেন, ‘আমাদের ভাগ্য আমাদেরই গড়ে নিতে হবে। পিন্ডির গোলামি ছিন্ন করতে হবে।’ ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বরের বঙ্গোপসাগরীয় সাইক্লোনের প্রেক্ষাপটে উনি আবার সরাসরি বললেন ‘স্বাধিকার স্বায়ত্তশাসন নয়, চাই স্বাধীনতা।’

ফরিদ, তোমার লেখা আমি গুরুত্ব সহকারে পড়ি; অনেক কিছু জানতে পারি, শিখতে পারি। কোন মানুষই ভুলের উর্ধ্বে নন, যেমন ভাসানী। কিন্তু, তাই বলে তাকে আইয়ুব ইয়াহিয়ার সহচর বানিয়ে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিলে! মওলানা ভাসানীকে নিয়ে তোমার লেখাগুলি পড়ে আমি সত্যি হতাশ!

Farid Ahmed: আমিতো কোনো সিদ্ধান্ত দেই নাই। সবই কোট করেছি আমি। তিনি আইয়ুবের সহচর ছিলেন, এই অভিযোগ তখনই উঠেছে।

আমার বিশ্লেষণ আমি বলতে পারি। যে আইয়ুব ক্ষমতা দখল করে তাঁকে কারাগারে পাঠালো, তিনি কারাগার থেকে বের হয়ে সেই আইউবের প্রতিনিধি হয়ে চীন যান ঠিক কী কারণে? কোন স্বার্থে? আপনি আমাকে একটা মাত্র যৌক্তিক কারণ বলবেন মাসুদ ভাই এ ব্যাপারে। আমি দ্বিতীয় যুক্তিও শুনতে চাইবো না।

তিনি সিআইএ-র রিপোর্ট ইয়াহিয়াকে দিয়েছেন? কেনো? যেখানে তিনি নিজেই বলছেন এই দলিলে দেখা যাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার ষড়যন্ত্র চলছে। উনি কি বিচ্ছিন্নতার বিপক্ষে ছিলেন? বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার একেকজনের একেক ধরনের কর্মপন্থা ছিলো, সেই পন্থা নিয়ে সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু এই দলিল হস্তান্তর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষেই তাঁকে দাঁড় করিয়ে দেয়।

ভাসানী একজন স্ববিরোধী মানুষ ছিলেন। উনি স্বাধীনতার পক্ষেও বহু কথা বলেছেন, আবার বিপক্ষেও বলেছেন। আপনারা শুধু পক্ষেরটা জানেন, বিপক্ষেরটা না। আমি উনি স্বাধীনতার বিপক্ষে কী কী বলেছেন সেগুলো নিয়েই আরেকটা লেখা লিখবো দুই একদিনের মধ্যেই।

Swapan Mahmud: "পাকিস্তান ওয়ালাইকুমআসসালাম" এটাই স্বাধীনতার প্রথম প্রতীকী ঘোষণা।

Farid Ahmed: ওই এক তথ্য নিয়েই পড়ে থাকেন। মোল্লাদের অন্ধত্ব এবং একদেশদর্শীতা আমাকে পীড়া দেয় না, কিন্তু, আপনাদেরটা দেয়। কারণ, প্রগতিশীল বলে দাবি করেন আপনারা। দাবি করেন, অথচ সব তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে আসেন না। পূর্বানুমান সিদ্ধান্ত নিয়েই বসে থাকেন।

১৯৬২ সালে ছাত্ররা আইউব খানের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করেছিলো শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে। ভাসানী কি জানতেন না যে এই দেশের ছাত্র এবং জনগণ আইউব জান্তাকে বাতিল করে দিয়েছে? সেই জান্তার প্রতিনিধি হিসাবে ১৯৬৩ সালে তিনি চীনে যান কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর আপনাদের মতো বায়াসড লোক কোনো দিনই দিতে পারবেন না, খালি ওই এক ওয়ালাইকুম সালাম নিয়েই পড়ে থাকবেন আপনারা।

Masudur Rahman: খন্ডিত বিশ্লেষণ করে প্রমান করা যাবে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য '৭০ এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন নাই। একটি বিষয় অন্তত আমার কাছে পরিষ্কার, ভাসানীর তুমুল জনপ্রিয়তা থাকা সত্যেও ক্ষমতার লোভ তার ছিল না। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে উনিও কষ্ট পেতেন ভাসানীর এই পোস্টমর্টেম দেখে কারন উনি জানতেন উনার বঙ্গবন্ধু হওয়া পিছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশী। বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা থেকে মুক্ত করার জন্য যে গন আন্দোলনের দরকার ছিল, তা ভাসানী ছাড়া আর কে করতে পারতেন? তুমি তো ১৯৬৩ সনেই আটকে থাকলা, ফরিদ!

Farid Ahmed: উনার সামরিক শাসক সখ্যতা নিয়ে বিস্তারিত আমি লিখেছি মাসুদ ভাই। শুধু ৬৩-তে আটকে থাকিনি। যদিও ওইটাই সবচেয়ে ভাইটাল মুহুর্ত। কোন কারণে তিনি আইয়ুবের প্রতিনিধি হয়ে চীনে গিয়েছিলেন, সেটা জানাটা খুবই জরুরী আমাদের জন্য। মওলানা বাদে অন্য কেউ হলে আমি এক বাক্যে তাঁকে আইয়ুবের দালাল বলে দিতাম। ব্যক্তিটা উনি বলে আমি এখনো এর একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা খুঁজছি।

১৯৭২-১৯৭৬

মওলানা ভাসানী ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক হক-কথা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করলেও মুজিব সরকারের জাতীয়করণ নীতি এবং ১৯৭২-এর সংবিধানের এর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। ১৯৭৩ সালে খাদ্যের দাবিতে ঢাকায় ১৫-২২ মে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ১৯৭৪-এর ৮ এপ্রিল হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি গঠন করেন। একই বছর জুন মাসে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলে টাঙ্গাইলের সন্তোষে গৃহবন্দি হন। ১৯৭৬-এর ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লং মার্চে নেতৃত্ব দেন। একই বছর ২ অক্টোবর খোদাই খিদমতগার নামে নতুন আর একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

— উইকিপেডিয়া থেকে

Supik Anwar: ৫০ বছর ধরে বহুমাত্রিক ভাবে গন মানুষ এর রাজনীতি করা একজনকে শুধু কয়েক বছরের রাজনীতি দিয়ে মুল্যায়ন কতটুকু যুক্তিযুক্ত!? ঐ সময়ে উনি হাসপাতালে ছিলেন।পরে ভাসানী হাসপাতালে থাকা অবস্তায় মোশতাক উনাকে একদিন দেখতে গিয়েছে। তখন উনি মোশতাককে বলেছিলেন "আমার মুজিবররে তোমরা মাইরা ফেললা"!

Farid Ahmed: আপনি আপনার রেফারেন্স দেন। আর আমি আমার রেফারেন্স দিচ্ছি।

Supik Anwar: একজন সাংবাদিক (নামটা মনে পড়ছে না) উপস্থিত ছিলেন অই সময়। পরে উনি সহ সবাইকে রুম থেকে বাইরে যেতে বলেন মোশতাক। মোশতাক বেশ কিছুক্ষণ ভাসানীর সাথে একান্তে কথা বলে।এগুলা ভাসানীকে নিয়ে লিখা একটা কলামে পড়েছিলাম।মনে হয় ইরফানুল বারীর। আর ৭৫ এর পর উনি অনেক অসুস্থ ছিলেন। এই সুযোগ এ মোশতাক তার লেজেটিমিসির জন্য উনাকে ব্যবহার করেছে। আর জাতির জনক কে উনি কথটা পছন্দ করতেন সেই কথা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আছে। এছাড়া উনি মোশতাক ১ং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক থাকার পর ও তাকে ডিঙিয়ে মুজিবকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করেন সামশুল হক এর অনুপস্থিতিতে। আর আগরতলা মামলায় তার প্রিয় মুজিবরকে জেল থেকে বের করার হুংকার এবং তার ফলাফল তো জানাই আছে।

Farid Ahmed: এটা কোনো রেফারেন্স হলো? আসেন এর বিপরীতে আপনাকে রেফারেন্স দেখাই। কয়েকটা পত্রিকার কাটিং দেখাচ্ছি। কারো মুখের কথার চেয়ে পত্রিকা অনেক বিশ্বাসযোগ্য।

doc

Supik Anwar: মওলানা ভাসানীকে নিয়ে কয়েকটা কৌতুহল জাগানো প্রশ্ন পেলাম, এমনকি আমার লেখা শেয়ার করা কিছু মানুষও এই সব মন্তব্য পেয়েছেন দেখলাম। একটা প্রশ্ন হলো, ভাসানী ১৫ অগাস্টের হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করেছেন। মোশতাককে সমর্থন দিয়েছেন। জিজ্ঞেস করলাম, জেনেছেন কোথায়?

— তখনকার দৈনিক পত্রিকায়। বড় করে ছাপা হয়েছে তো।

— কিন্তু তখন যে চারটা মাত্র পত্রিকা আমাদের খবরের উৎস, সেগুলো তো এর আগেই বাকশাল সরকার সরকারী মুখপাত্র বানিয়ে বাকি সবগুলো পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলো। মাওলানার প্রতিষ্ঠিত হক কথাকে নিষিদ্ধ করেছিল ১৯৭২ সালেই। ফলে মোশতাকের আমলে যে তথ্য আমরা খবরের কাগজ সূত্রে পেলাম, সেগুলোর নির্ভরযোগ্যতা কী? কিংবা, এইভাবে গণমাধ্যম কবজা করার পরিণাম যে মানুষের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের সুযোগ এবং অভ্যাস দুটোই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল বাকশালের মাধ্যমে, চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে, আরো নানান সব নিপীড়নমূলক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে, এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হলো যে দিনে-দুপুরে রক্ষীবাহিনীর হাতে খুন হলেও সে খবর আর পত্রিকায় ছাপা হবে না, যে হাতিয়ারগুলো ব্যবহার করেই মোশতাকের মন্ত্রীসভায় লীগের নেতাদের স্বেচ্ছায় কিংবা বলপ্রয়োগে অংশ নেয়ানো হলো, তার নিন্দা কখনো করেছেন? ৯৫ বছরের বুড়ো ভাসানী ১৫ অগাস্টের বহু আগে থেকেই গৃহে অন্তরীণ ছিলেন। এই বয়োবৃদ্ধ মানুষটিকে কারা গৃহবন্দি করে রেখেছিল? তার নিন্দা করেছেন? সেই ঘরে আটকে থাকা, দুনিয়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারিতে আটকে রাখা অসুস্থ মানুষটাকে হাসপাতালে মোশতাক দেখতে গিয়েছিলেন, আওয়ামী নেতাদের মত তিনি বঙ্গভবনে গিয়ে মোশতাককে সমর্থন জানান নাই। এই ছবিটিই ফলাও করে পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, এবং পত্রিকাতে বাকি সব যা জানি সেটাও বাকশালের সংস্কৃতিতে কবজা করা পত্রিকার ভাষ্য, ভাসানী কি বলেছেন তা সেখানে কিভাবে মিলবে?

অভিযোগ করার আগে অভিযোগের প্রেক্ষাপটা তাই মনে রাখলে বোঝা যায়, অভিযোগকারীই ভয়াবহ একটা পরিস্থিতির সমর্থক, যেখানে কারও মতামত জানারও উপায় ছিল না, এমনই ভয়াবহ ছিল বাকশালি শাসন। তবুও ভাসানী কী মনে করতেন, সেটা জানতে ভাসানীর ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বাসযোগ্য মানুষদের কাছেই যেতে হবে। তাদের অনেকের কাছেই শুনেছি, নিজের সমর্থকদের ওপর এত নিপীড়নের পরও, আওয়ামী লীগের এত গণবিরোধী অবস্থানের পরও ভাসানী ১৫ অগাস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে দারুণ ব্যাথা পেয়েছিলেন। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক বিরোধিতা তিনি যতই করুন না কেন, তাকে পুত্রের মতই দেখতেন। প্রতিহিংসাপরায়ণ তিনি ছিলেন না, যদিও জনগণের বলপ্রয়োগে গভীর আস্থা পোষণ করতেন। সেই বলপ্রয়োগের স্মরণীয়তম দৃষ্টান্তটার কথাই বরং বলি।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাতেই হয়তো শেখ মুজিবুর রহমানের ফাঁসি হয়ে যেতো বঙ্গবন্ধু উপাধি পাবার আগেই; কেউ তাকে উদ্ধার করার সাহস কিংবা স্পর্ধা দেখায়নি, বন্দি ছিলেন তিনি ঢাকা সেনানিবাসে। '৬৯ এর প্রবল অভ্যূত্থানের ওপর দাঁড়িয়ে ভাসানী হুমকি দিয়েছিলেন পাক সামরিক জান্তাকে: মুজিবকে না মুক্তি দেয়া হলে জনতাকে নিয়ে তিনি ক্যানটনমেন্ট থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসবেন। আগুন ঝরানো মাওলানা তার নাম এমনি এমনি হয়নি।

এই হলো ভাসানী। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ৫০ বছর পূর্তিতে তার প্রাবল্যকে বুঝতে হলে খুচরো খুচরো প্রশ্ন করে কাজ হাসিল হবে না। অনেক বড় অকৃতজ্ঞতা এবং নিমকহারামি থেকেই ভাসানীকে নিয়ে এই জাতীয় মিথ্যা গুজব মোসাহেবরা ছড়িয়ে থাকে।

— (ফিরোজ আহমেদ)

Farid Ahmed: এটা পড়েন। আগুণ ঝরানো মওলানার আসল পরিচয় পাবেন। মুদ্রার অপর পিঠের মওলানা ভাসানী : জাফর ওয়াজেদ ↑। অলি আহাদের একটা বই আছে। বইটার নাম হচ্ছে, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-১৯৭৫। সেই বইতেও শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডে ভাসানীর সমর্থনের কথা বলা আছে। ভাসানী হাসপাতালে ভর্তি হন নভেম্বরের ২১ তারিখে। তিনি তারবার্তা পাঠান শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরের দিনই। তখন তিনি সন্তোষে। হাসপাতালে তিনি খন্দকার মোশতাককে কী বলেছেন, সেটা কোনো পত্রিকায় আসেনি। তিনি যে খুনি সরকারকে অভিনন্দিত করেছেন, তাদের সমর্থন জানিয়েছেন, এগুলো সব পত্রিকাতেই এসেছে। তাঁর নামে এগুলো বানানো খবর হলে তিনি অবশ্যই আপসেট হতেন এবং এগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। এদেরকে সহযোগিতা দিতেন না। বাস্তবে কিন্তু তা হয়নি। ফারাক্কা লং মার্চের সামনের সারিতে তিনি ছিলেন। কিন্তু, এর পিছনের পুরোটাই সায়েমের অবৈধ সরকার তথা জিয়াউর রহমান ছিলো।

doc

Supik Anwar: শুধুমাত্র পত্রিকার কয়েকটি লিখার উপর ভিত্তি করে উনাকে বারবার কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন তাতে কি সঠিক ইতিহাস প্রতিফলিত হচ্ছে!? যেই মানুষ সারা জীবন এই অঞ্চল এর মানুষকে নিয়ে মুক্তি সংগ্রাম করেছেন সেই আসাম থেকে বাংলা। কংগ্রেস থেকে বের হয়ে চিত্তরঞ্জন দল, তার পর মুসলিম লীগ এর সাথে পাকিস্তান আন্দোলন, জমিদার বিরোধী আন্দোলন , ভাষা সংগ্রাম, কৃষক আন্দোলন, লাইনপ্রথা, আওয়ামীলীগ সৃষ্টি, যুক্তফ্রন্ট, পাকিস্তানকে ওলাইকুম বলা, কাগমারী সন্মেলন, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতা, ১৯ দফা,৬৯ এর গন-আন্দোলন, ৭০ এর প্রলয়কারী তুফান, ইলেকশন এ আওয়ামীলীগকে সমর্থন, স্বাধীনতা সংগ্রাম,লং মার্চ সহ আরো মাটি ও মানুষের জন্য অনেক সংগ্রাম করা মানুষকে ইতিহাস এর ক্রনলজিকাল পাঠ না করে শুধুমাত্র কয়েকটি ঘটনার খণ্ডিত পাঠ ইতিহাসকে অবজ্ঞা করার মতই।

রেফারেন্স —
মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডের খবর শুনে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ঘটনার কয়েক দিন পর তিনি চিকিৎসার জন্য পিজি হাসপাতালে ভর্তি হন। এ সময়ে খোন্দকার মোশতাক আহমদ তার সরকারী স্টাফদের সাথে নিয়ে হুজুরের সংগে দেখা করেন। সেই বহরে সাবিহউদ্দীন আহমদও ছিলেন। তিনি তখন তার পি আর ও ছিলেন। আমি হুজুরের কেবিন কক্ষেই ছিলাম। এর একটু আগেই ফনি ভূষণ মজুমদার তার কেবিনে ফিরে গেছেন। তিনি দিনে একবার হলেও হুজুরের শরীরের খবর নিতে আসতেন। হুজুরের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও ভক্তি দেখে অবাক হয়েছি। কেবিনে ফিরে যাবার সময়ে তিনি আমাকে হুজুরের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলতেন। হুজুরের শরীর তখন খুবই খারাপ ছিলো। এখানে আসার আগে তিনি কুমুদিনী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। খোন্দকার মোশতাক কেবিনে ঢুকলে হুজুর তার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকান। বসতেও বলেননি। এক সময়ে তিনি বলেই ফেললেন "আমার মজিবরকে তোমরা মেরেই ফেললে!" তিনি ক্ষোভের সঙ্গে তাকে আরো বলেন "দুই আনার মুড়ি খেয়ে সারাদিন দলের কাজ করেছে আর তোমরা নেতা হইছো!" রাগ ও ক্ষোভের মাত্রা বাড়তে থাকলে এক সময়ে মোশতাক আমাকে একটু বাইরে যেতে,বলেন। আমি হুজুরের ঔষুধ দিয়ে বরান্দায় এসে দাঁড়াই। চলবে... [একুশে পদক প্রাপ্ত ছড়াকার আবু সালেহ্ এর টাইম লাইন হতে]

মোস্তাককে সমর্থন দেয়ার বরাত সরকারী প্রচার মাধ্যম। তখন দেশের পত্রিকার সংখ্যা ছিল ৪টি এবং ৪টিই সরকারী। এ অবস্থায় ১৫ আগস্টের পরপর যখন বিবৃতিটি প্রকাশিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে, তখন সরকারি মালিকানাধীন দৈনিকের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে স্বাভাবিক কারণেই। শুধু তা-ই নয়, মওলানা ভাসানীর কথিত বিবৃতিটি উদ্ধৃত করা হয় ‘বিশ্বস্ত সূত্রের’ বরাত দিয়ে। সততা ও সদিচ্ছা থাকলে বিশেষ দৈনিকটি থেকে সরাসরিই বিবৃতিটি উদ্ধৃত করা সম্ভব ছিল এবং ইতিহাস গবেষণার দৃষ্টিকোণ থেকে তেমনটি করা প্রয়োজনও ছিল। কিন্তু সহজবোধ্য কারণে দৈনিকটির নাম পর্যন্ত বলা হয় না বরং আশ্রয় নেয়া হয় ‘বিশ্বস্ত সূত্রের'।
[শাহ আহমদ রেজা]

Farid Ahmed: আপনি ঝোপে ঝাড়ে বাড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছেন। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরেও মওলানা ভাসানী রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, রাজনীতির মাঠে ছিলেন। কারণ, ফারাক্কা মিছিলের মতো বিশাল এক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তাঁর মতো সাহসী লোক নিশ্চয় ময়দানে প্রতিবাদ করেছেন, মিছিল মিটিং করেছেন। জাস্ট, কোনো একটা পত্রিকার একটু কাটিং দেখান আমাকে এ ব্যাপারে। আমি সবই পাঠ করেছি। এই লোক শেষবেলায় একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করাতো দূরের কথা, বরং সেটাকে সমর্থন করেছেন। এটাও ইতিহাস পাঠেরই অংশ।

Adil Mahmood: ভাসানী যে রকম ফ্লিপ ফ্লপ স্ববিরোধী আচরণ পাকিস্তান আমল থেকে করে গেছেন ওনার পক্ষে ব্যাক্তিগত পর্যায়ে মোশতাককে এই ধরনের কথা বলা এমন কিছু অসম্ভব না। এতে কোন সন্দেহ নাই যে রাষ্ট্রপ্রধান মুজিবের প্রতি তার গভীর বিরাগ থাকলেও ব্যাক্তি মুজিবকে উনি আজীবনই স্নেহ করে গেছেন। ব্যাক্তি মোশতাককে তোমরা এইটা কি করলা বলা এবং একই মোশতাকের সরকারকে অভিনন্দন জানানও অন্তত মাওলানার পক্ষে অসম্ভব কিছু না। সরকার ষড়যন্ত্র করে বিবৃতি ছাপিয়েছে এই ধরনের যুক্তিতে ৭৫ এর পর রাতারাতি ভোল পালটানো সবাই সাফাই গাইতে পারে এবং গায়। যারা মোশতাক মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়েছিল সে সব লীগ নেতা দাবী করেছে তাদের বন্দুকের মুখে নেওয়া হয়েছিল। ভাসানী ছিলেন পরিষ্কার বঙ্গবন্ধু সরকার বিরোধী সোচ্চার কণ্ঠ এবং লক্ষণীয়ভাবে দিনে দিনে কট্টর দক্ষিণপন্থীতে বিবর্তিত। বঙ্গবন্ধু সরকারের পতনের পর ডানপন্থী মোশতাকের প্রতি তার রাজনৈতিক সমর্থন এমন কি অবাস্তব যে সেটাকে নানান ষড়যন্ত্র তত্ত্ব অমূকে এই শুনেছে সেইই শুনেছে যার ভিত্তিতে সত্য হতে পারে না এইসব দাঁড়া করাতে হবে সেটাই বুঝি না। ভাসানীর পূর্ন ব্যবচ্ছেদ করলে বরং আরও অনেক বিতর্কিত কাজকারবার পাকিস্তান আমল থেকেই দেখা যায় যেগুলির কাছে এই মোশতাক অধ্যায় এমন কিছু না।

বঙ্গবন্ধুর আরেক সিনিয়র রাজনৈতিক কলিগ ৫৬ সালের প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান যার কেবিনেটে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী ছিলেন সেই আতাউর রহমান খান বঙ্গবন্ধুর পতনের পর ১৫ই আগস্ট নাজাত দিবস ঘোষণা করেছিলেন। মজার ব্যাপার হল এই আতা খান সাহেবই মোটে ৪ মাস আগে বঙ্গবন্ধুর নানান গুণগান গিয়ে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। আমার তো মনে হয় বঙ্গবন্ধু আমলেও ওনার নামে সরকারী পত্রিকায় মিথ্যা বিবৃতি দেওয়ানো হয় আর মোশতাক আমলে তো আমরা জানিই যে পত্রিকায় যার নামে যা ছাপা হয়েছিল সবই বানানো।

Swapan Mahmud: ভাষাণী-মুজিব গুরু শিষ্য দুজনই নির্বিশেষে মানুষ।দুজনেরই ভুল ছিল। এখন তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় না রেখে এ বিষয়গুলো মোকাবেলা করতে গেলে বঙ্গবন্ধু কেও আওতায় আনতে হবে। ভিয়েতনাম দিবসে মতিউল-কাদের হত্যা (স্বাধীন বাঙলাদেশে রাজপথে প্রথম হত্যা), কমরেড সিরাজ শিকদার কে পুলিশি হেফাজতে হত্যা (বাঙলাদেশে প্রথম বিচার বহির্ভূত হত্যা),দিন দুপুরে জাসদ অফিস জ্বালিয়ে দেয়া (১৯৭৩)।এই বিষয়গুলোও সামনে নিয়ে আসলে কী জামাত-শিবির বলা শুরু হবে।(বিতর্ক করার জন্য কমেন্ট করছি না এবং এ প্রসঙ্গে আর কোন কথা আমি বাড়াব না)

Farid Ahmed: মুজিবের ভুল নিয়ে তো আমরা কথা বলি। এগুলোর কোনোটাতেই তো তাঁকে ছাড় দেওয়া হয় না। একটা অপরাধকে খণ্ডন করতে যখন আরেকটাকে আনা হয়, তখন আসলে সেই অপরাধকে ঢাকার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। আপনি মুজিবকে বাদ দিয়ে পরিষ্কার করে শুধু ভাসানীর অপরাধকে অপরাধ বলতে পারছেন না কেনো? মুজিবের অপরাধের আলাপ যখন আলাপ করা হবে, তখন না হয় মুজিবকে ধোলাই দেওয়া যাবে। অন্যের অপরাধকে এনে তুলনা কখন করা হয়, সেটা আপনার না জানা থাকার কথা না। তাঁর সরকারের সবচেয়ে কট্টর সমালোচক হবার পরেও, মওলানার ক্ষেত্রে শেখ মুজিব যে উদারতা এবং ভালবাসা দেখিয়েছেন, প্রতিদানে মওলানা তাঁর ধারে কাছেও যেতে পারেন নাই। অথচ বয়োজ্যেষ্ঠ হিসাবে উল্টো ভূমিকাটা নেবার কথা ছিলো তাঁর।

Adil Mahmood: বঙ্গবন্ধু বা মুজিব সরকারের ভুলের কারনে ভাসানীর ভুল যদি ব্যাখ্যা করা যায় তাহলে অবশ্যই স্বাধীন বাংলাদেশে ভাসানীর মূল্যায়নে তৎকালীন সরকারের ভুলগুলিও আমলে আনা উচিত; এতে সমস্যা নাই। কিন্তু তাই বলে ভাসানীর ভুল ব্যালেন্স করার জন্য মুজিব সরকারের ভুলও পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের খাতিরে আনতে হবে তাহলে সেটা যৌক্তিক বিশ্লেষণ বলা যায় ন। এটা হয়ে যায় এখনকার প্রচলিত "অমুক ঘটনার সময় আপনি কোথায় ছিলেন" জাতীয় এগ্রিসেভ ডিফেস। এই ধরনের আক্রমণাত্মক ডিফেন্স সাজানো হয় নিজের পছন্দের দল বা ব্যাক্তির সমালোচনা আড়াল করার লক্ষ্য নিয়ে - আমি হয়ত খারাপ কিন্তু অপরপক্ষ তো আরো খারাপ। সে নিয়ে বল না কেন!

Iftakhar Ahmed Babu: আপনার এই পেপার কাটিং এর সত্যতা পাওয়া যায়নি ৷ সেরকম কোন বিবৃতি পাঠান হয়নি ৷

Farid Ahmed: পেপার কাটিং এর সত্যতা মানে কী বাবু ভাই? পত্রিকায় ছাপা হয়নি এই বিবৃতি, নাকি পত্রিকাওয়ালারা উনার নামে মিথ্যা বিবৃতি লিখেছে?

Iftakhar Ahmed Babu: বঙ্গভবন থেকে কেউ মিস কোট করেছিল ইচ্ছাকৃত ভাবেই l এটা নিয়ে অনেক অনুসন্ধান হয়েছে ৷ যে কোন তারবার্তা রেকর্ড রাখা হয় ৷ খোঁজা হয়েছে , কোন প্রমান পাওয়া যায় নাই ৷

Farid Ahmed: উনি কি এর পাল্টা বিবৃতি দিয়েছিলেন কোনো? অনুসন্ধানটা কাঁরা করেছিলো? সেটার রেফারেন্স কী?

Swapan Mahmud: তারপর দেখা যাচ্ছে খবরটা জানাচ্ছে বাসস।বাসস তো রাষ্ট্রীয় সংস্থা এরা প্রপাগান্ডাও ছড়াতে পারে।

Farid Ahmed: ভাসানী বামপন্থী ছিলেন বলে কি আপনাদের এই অবিশ্বাস? সেটা হলে লজিক্যাল কিছু হলো না। এর পাল্টা বিবৃতি কোথায়, মুজিব হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা করে ভাসানীর কর্মকাণ্ড কী? তিনি কি এর বিরুদ্ধে কখনো কিছু বলেছেন? এগুলো আনতে হবে আপনাদের সামনে। শুধু বাসস, বলেছে বলে অবিশ্বাস করে গেলে পক্ষপাতিত্ব হয়ে যাবে।

Swapan Mahmud: বামপন্থী ব'লে সাত খুন মাফ হ'য়ে যায়না।আমি শুধু একটা সম্ভাবনার কথা বলেছি।অপ্রাসঙ্গিক হ'লেও বলি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথম মিছিল ক'রে ছাত্র ইউনিয়ন।এই কিছুদিন আগে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলছিলেন উনি তখন এক আওয়ামীলীগ নেতার সাথে এ বিষয়ে আলাপ করতে হেলে ঐ নেতা বলেন "সেলিম এখনি মিছিল টিছিল করার দরকার নাই শেষে আওয়ামীলীগ সরকারকেই (মোশতাক ক্যাবিনেট) নিষিদ্ধ করে দেবে।"

Farid Ahmed: আওয়ামী লীগের নব্বইভাগ নেতাই স্বেচ্ছায় কিংবা ভয়ে মোশতাকের সাথে ছিলো। এগুলো প্রমাণিত। এই কাপুরুষদের ডিফেন্ড করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। সেলিম সাহেব যেটা বলেছেন, সেটা যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য।শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে দুজন লোকের করার সামর্থ্য ছিলো। এর একজন হচ্ছে জেনারেল ওসমানী এবং আরেকজন হচ্ছেন মওলানা ভাসানী। এই দুই ব্যক্তির গ্রহণযোগ্যতা ছিলো সারাদেশব্যাপী। দুঃখজনক হচ্ছে, তাঁরা দুজনেই এই কাজটা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

আমি একটা জিনিস দেখাচ্ছি এখানে আপনাদের। এটা সরাসরি কোনো প্রমাণ নয়। কিন্তু, ঘটনাটা তাৎপর্যপূর্ণ। অনেক না বলা জিনিস এখান থেকে বের করে আনা সম্ভব। ২১ তারিখ দুপুরবেলা সন্তোষ থেকে অসুস্থ ভাসানীকে নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। ভর্তি করা হয় পিজি হাসপাতালে। সন্ধ্যাবেলাতেই মোশতাক তাঁকে দেখতে হাসপাতালে যায়। পরের দিন এই খবরটা প্রতিটা সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় গুরুত্বের সাথে ছাপা হয়। ভাসানী যদি এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতেন, মোশতাকের মতো একটা লোকের তাঁর প্রতি এই সৌজন্যতা দেখানোর কথা নয় এবং পত্রিকাগুলোতে এটাকে এভাবে হাইলাইট করারও কথা নয়। আমি শুধু দৈনিক বাংলার খবরটা দিচ্ছি।

mostaq-vasani

রেকর্ডের স্বার্থে আরেক তালেবর পাপা টাইগারের চরিত্রটাও এই সুযোগে তুলে ধরি।

zia-osman

Swapan Mahmud: গোটা আওয়ামীলীগ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একটা প্রতিবাদ মিছিল করলো না।সুর সুর করে মোশতাকপন্থী হয়ে গেল। ওসমানী তো বাকশাল বিরোধীতা করে আওয়ামীলীগ ছেড়ে দিয়েছেন। ভাসানী ও আওয়ামীলীগ এ নেই। দায়ী হয়ে গেলেন তারা। আওয়ামীলীগ বরাবরই নপুংসক ও বিট্রেয়ারদের নেতৃত্ব পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেন ও ভারতে গিয়ে সাহায্য চান কাদের সিদ্দিকী, লতিফ সিদ্দিকী,সুলতান মনসুর। সুলতান ভাই'র কাছে সেই সব দিনগুলোর কথা অনেকবার শুনেছি। আজ তাদের তিনজনকেই আওয়ামীলীগ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তবে আমি জাতীয় চার নেতা, রাজ্জাক, তোফায়েল, সামাদ, আজাদ সহ যারা জেলে ছিলেন তাদের কথা বলছি না।তারা প্রকৃতই দেশপ্রেমী ও বঙ্গবন্ধুর কর্মী ছিলেন।বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথম মিছিল করতে হল বামপন্থি ছাত্র ইউনিয়ন কে। (আপনারা যাদের ঠাট্টা করে বলেন বামাতি) যে দল নিজের প্রতিষ্ঠাতাই শুধু নন জাতির পিতার ও হত্যার প্রতিবাদ করার হিম্মত রাখেনা তাদের কাছে দেশ মাতৃকার কোন মূল্য থাকতে পারেনা!

Farid Ahmed: আপনার এই পুরো বক্তব্যটাই অযৌক্তিক, অপ্রাসঙ্গিক এবং অপরিসীম খেদোক্তির বহিঃপ্রকাশ মাত্র । আমরা আওয়ামী লীগ নিয়ে আলোচনা করছি না, বা আওয়ামী লীগের সাথে কারো তুলনাও করছি না। এখানে স্পেসিফিক ইস্যু হচ্ছে খুনি সরকারে প্রতি ভাসানীর সমর্থন দেওয়া। আওয়ামী লীগের লোকেরা তো সমর্থন দিয়েছেই। মোশতাকও আওয়ামী লীগেরই লোক ছিলো। সেগুলো বললে কি ভাসানীর অপরাধ কমে যাবে? আপনি বলেন আপনি মুক্তমনের মানুষ, কিন্তু বামদের বিরুদ্ধে গেলেই আর আপনার মুক্তমনে কোনো কিছুই ঢোকে না। এটা খুবই দুঃখজনক। এতখানি ব্রেইন ওয়াশড হওয়া ঠিক না।

Swapan Mahmud: আমি বলেছি সব দায়ভার ভাসানীর হয়ে গেল!

Farid Ahmed: ভাসানীর সব দায়ভার এটাওতো কেউ বলে নাই, আমিও বলি নাই। তিনি খুনে সরকারকে সমর্থন দিয়েছেন, তাদের সাথে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। এতো বড় একজন রাজনীতিবিদ হয়ে, শেখ মুজিবের গুরুস্থানীয় হয়েও, শেখ এবং শেখ পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি কী করেছেন? মোশতাক তাঁর শয্যাপাশে গেলে কি একবারও বলেছেন, আমি খুনির সাথে হাত মেলাই না। বলেন নাই। এমন একটা নিম্নস্তরের লোককে ডিফেন্ড করেন কীভাবে আপনি, সেটাই তো আমি বুঝি না। নারী, শিশু হত্যা যাকে সামান্যতম বিচলিত করে না। আমি আওয়ামী লীগ করেছি, এই সব আকাম করা কোনো আওয়ামী লীগারকে সমালোচনা করতে আমি তো দ্বিধায় ভুগি না সামান্যতমও। সেটা করতে গিয়ে অমুক তমুক কী করেছে, কার দায় বেশি কম সেটা বিবেচনায় নেওয়া হবে না।