মানুষের গল্পআশফাক আহমেদ

মানুষের ইতিহাস – পর্বঃ ৩

ভাবানুবাদঃ আশফাক আহমেদ

A Brief History of Humankind by Yuval Noah Harari – বই অবলম্বনে।

বর্বর মানুষের আগ্রাসন

ভূলগুলো যে আমরা ইচ্ছে করে করি তা না। বহু বছরের অভ্যাসের ফসল এই ভুলগুলো। যেমন- কলম্বাসকে আমরা আমেরিকার আবিষ্কর্তা ধরি। কিংবা জেমসকুককে অস্ট্রেলিয়ার। অথচ এই মানুষেরা আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কারের বহু আগে থেকেই সেখানে মানুষ বসবাস করতো। ৪৫ হাজার বছর আগেই যেমন মানুষ অস্ট্রেলিয়ার বুকে প্রথম পা রাখে। যে মানুষটি প্রথম আফ্রো-এশিয়ার গণ্ডী ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ার বুকে তার পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছিল, তার নাম-ঠিকানা আমরা জানি না।

অস্ট্রেলিয়ার সত্যিকার আবিষ্কারক যদি কেউ হয়, তবে সেই নাম না জানা মানুষ কিংবা মানুষী, জেমস কুক নন। বহু বছরের চর্চায় আমাদের মধ্যে একটা ধারণা বদ্ধমূল ঢুকে গেছে যে, আবিষ্কর্তা মানে সাদা মানুষ হতে হবে। সাদা মানুষের ইতিহাস যে বড়জোর লাস্ট এক হাজার বছরের, একথা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। আজকের এই সভ্যতা হয়তো সাদা মানুষের দান, কিন্তু ভূখণ্ডগুলোর আবিষ্কারের ব্যক্তিত্ব অন্তত নয়। কলম্বাস বা কুককে বড়জোর ভূখণ্ডগুলোর পুনরাবিষ্কারক বলা চলে।

যাই হোক, চাঁদে যাওয়া যেমন মানুষের ইতিহাসে একটা বড় মাইলস্টোন ছিল, অস্ট্রেলিয়া যাত্রাও তেমন। বলতে কি, অস্ট্রেলিয়াই মানুষের তৈরি প্রথম উপনিবেশ। “The Martian” মুভিতে একটা দারুণ কথা আছেঃ

“যখন তুমি কোথাও ফসল ফলানো শুরু করবে, তখন তুমি সেই জায়গাটাকে কলোনাইজ করে ফেললে। “

অস্ট্রেলিয়া সেই অর্থে মানুষের প্রথম কলোনী। এই ব্যাপারটা মাথায় রেখেই হয়তো কুক সাহেব অস্ট্রেলিয়া আসার সময় সাথে করে আপেল, আঙুর আর পীচফল নিয়ে এসেছিলেন। সাহেব জানতেন না যে তারও বহু হাজার বছর আগেই মানুষ এখানে এসে ছোটখাটো কলোনী তৈরি করে বসেছে। ভেবে অবাক হতে পারেন, ৪৫ হাজার বছর আগে মানুষের হাতে এই টেকনোলজি ছিল কি যার দৌলতে সে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলিয়া এসে পৌঁছাবে?

মানচিত্রের দিকে ভালো করে লক্ষ করলে ব্যাপারটা আরেকটু পরিষ্কার হবে। লোকে বলে, সম্ভবত এই মানুষেরা ইন্দোনেশিয়ার কোন উপদ্বীপ থেকে এসেছিলো। জাহাজ না হোক, নৌকা বা ভেলা নিশ্চয়ই তাদের ছিল। এই সিম্পল প্রযুক্তি যে আমাদের কতোটা এগিয়ে দিয়েছে, চোখে আঙুল দিয়ে না দেখালে তা অনেক সময় বোঝা যায় না।

আর সব সামুদ্রিক প্রাণীর কথা ভাবুন। সমুদ্রে নিজেদের দাদাগিরি প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের হাজার বছরের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। পাখনা আর ফুলকার মত অংগ-প্রত্যঙ্গ ডেভেলপ করতে হয়েছে। মানুষকে এইসব শারীরিক প্যারা নিতে হয়নি। সামান্য বুদ্ধি খাটিয়ে নৌকা বানিয়েই সে কাজ হাসিল করে নিয়েছে। মানুষের এই বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব অবশ্য আর সবার জন্য খুব সুখবর বয়ে আনেনি। মানুষের আগমনের আগ পর্যন্ত মহাদেশগুলোর জীববৈচিত্র্য আপন গতিতে বিবর্তিত হচ্ছিল। মানুষ এসে সেই বিবর্তনের ধারায় একটা প্রলয় ঘটিয়ে দেয়। এতদিন পর্যন্ত মানুষ প্রকৃতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছিল। যেদিন থেকে মানুষ সমুদ্র পাড়ি দিল, সে বুঝলো- সে আসলে অসীম ক্ষমতার অধিকারী। তার আর প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নেবার প্রয়োজন নেই। দরকারে সেই প্রকৃতিকে তার মত করে বদলে নিতে পারবে। আর হতেও লাগলো তাই।

এতদিন মানুষ বাঘ-সিংহের মোকাবেলা করেই অভ্যস্ত ছিল। অস্ট্রেলিয়ায় এসে তারা মুখোমুখি হলো ক্যাঙ্গারু, কোয়ালা আর মারসুপিয়ান সিংহের মত নতুন প্রজাতির। আর মজার ব্যাপার হলো, এদের প্রায় সবাই-ই কয়েক হাজার বছরের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। মানুষ যখন অস্ট্রেলিয়ায় পা রাখে, তখন গোটা মহাদেশে অন্তত চব্বিশটা প্রজাতি ছিল যাদের ওজন পঞ্চাশ কেজির বেশি। সংজ্ঞানুযায়ী, এদের অতিকায় প্রানীর দলে ফেলা যায়। এদের মধ্যে তেইশ জনই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে বৌ-বাচ্চা সহ বিলুপ্ত হয়ে গেল।

আচ্ছা, আফ্রিকায় তো বাঘ-সিংহ মানুষের সাথে যুদ্ধ করে টিকে রইলো। কোয়ালা আর মারসুপিয়ায়নরা তবে মারা পড়লো কেন? খুব সিম্পল। মানুষ যখন থেকে হাতিয়ার বানানো শুরু করেছে, বাঘ-সিংহও সেই সাথে মানুষকে এড়িয়ে চলা শিখে গেছে। অন্তত দলবদ্ধ মানুষকে তো বটেই। এরা সাতচল্লিশের দাঙ্গা দেখেনি। না দেখেই তারা বুঝে গেছিলো যে, দলবদ্ধ মানুষের চেয়ে হিংস্র আর কিছুই হতে পারে না। এদের গায়ের চামড়া তাই কিছুটা হলেও রক্ষা পেয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার প্রাণীকুল এই বোঝাপড়ার সময়টুকুও পায়নি। দোপেয়ে দৈত্য দেখলে যে এদের এড়িয়ে চলতে হবে এই নলেজটুকু এরা জিনের মধ্য দিয়ে পরের প্রজন্মের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। মানুষ দেখে এরা আগের মতই খুব কুলভাবে ঘুরে বেড়িয়েছে। ফলাফল, তেলাপোকা টিকিয়া রহিয়াছে, কিন্তু এরা খুব কুলভাবে নিশ্চিহ্ন হইয়া গিয়াছে।

কথা হচ্ছে, যথাযথ তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই আমরা এই গণহত্যার দায় মানুষের ঘাড়ে চাপাতে পারি কিনা। জবাব হচ্ছে, পারি। যারা মানুষকে এই দায় থেকে ইনডেমনিটি দিতে চান, তাদের যুক্তি হচ্ছে ভয়ানক কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়তো এই প্রাণীকুলের বিলুপ্তির কারণ। বরফ যুগে যেমনটা ঘটে। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, এক লাখ বছর পর পর একে বরফ যুগের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আর এই প্রতিকূল আবহাওয়ায় প্রাণীকুলের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ প্রতিবার বিলুপ্ত হয়ে যায়।

গন্ডগোলটা এইখানেই। শেষ বরফ যুগ আমরা দেখেছি পঁচাত্তর হাজার বছর আগ থেকে পনের হাজার বছর আগ পর্যন্ত। এর প্রকোপ সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল এক সত্তর হাজার বছর আগে আর এক বিশ হাজার বছর আগে। মানে ঐ বরফ যুগের একবারে শুরুতে আর শেষ দিকে। যাবার আগে একেবারে কাঁপিয়ে দিয়ে গিয়েছিল আমাদের। ডাইপ্রোটোডন বেচারা এই বরফযুগ আর তার আগের দশটার মত বরফযুগ লাইক এ্যা বস পার করে এসেছে।

৪৫ হাজার বছর আগে তাহলে কী এমন হলো যে সে নিজের অস্তিত্ব আর টিকিয়ে রাখতে পারলো না? মানুষের আগমন ছাড়া তো আশেপাশে বলার মত আর কোন ঘটনা চোখে পড়ে না। বেচারা ডাইপ্রোটোডনই যে কেবল এর শিকার হয়েছে, তা নয়। আরও অনেকেই এই ম্যাসাকারের শিকার। পুরো ব্যাপারটাকে তো আর কাকতাল বলা যায় না।

ও, আরেকটা ব্যাপার। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যখন কোথাও আঘাত হানে, স্থলবাসী প্রাণীদের সাথে সামুদ্রিক প্রাণীদের উপরও সে সমান তেজে আঘান হানে। বাদ যাবে না কোন শিশু টাইপ অবস্থা। অস্ট্রেলিয়ায় ঘটে যাওয়া এই গণহত্যায় কিন্তু কোন সামুদ্রিক প্রাণীর গায়ে আঁচড়টাও পড়েনি। সম্ভবত মানুষের হাতে তখনো সেই টেকনোলজি আসে নি যে, সামুদ্রিক প্রাণীর গায়েও হাত তুলবে। থাকলে হয়তো এদেরও খবর ছিল। এই যে আমরা যত দোষ মনুষ্য ঘোষের উপর চাপাচ্ছি, তার পেছনে আসলে মানুষের আরও কিছু কুকর্ম দায়ী। সবগুলো ডাটা ইন্টারপোলেট করলে আপনিও হয়তো মানুষকেই দায়ী করবেন। কোন দৈব দুর্যোগ বা ভিনগ্রহী দেবতাকে নয়।

মানুষের স্বভাবই এই যে, সে মোটামুটি যেখানেই গেছে, তার হাত রক্তে রাঙিয়ে এসেছে। নিউজিল্যান্ডের কথাই বলি না কেন। এটা কিন্তু খুব পুরনো দেশ নয়। মানুষ প্রথম এইখানে বসতি গড়ে মাত্র ৮০০ বছর আগে। ইউরোপীয়রা আসে আরও ৩-৪ শ’ বছর পর। মাওরিস নামক এক জনগোষ্ঠী এইখানে বসতি গড়ার কয়েকশ বছরের মধ্যেই এখানকার অতিকায় প্রায় সব প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যায়। ইউরোপীয়দেরও হয়তো এক্ষেত্রে অসামান্য অবদান আছে, কিন্তু মাওরিসদের অবদানও আমরা অস্বীকার করতে পারি না। অবলা পাখিরাও এই হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি। তাদের সমাজের ৬০ শতাংশও এই সময়টায় বিলুপ্ত হয়ে যায়।

অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-

একই ঘটনা ঘটে আর্কটিক মহাসাগরের ম্যামথদের সাথে। উত্তর মেরুর এই বাসিন্দারা মানুষের ভয়ে এশিয়া, ইউরোপ হয়ে পিছাতে পিছাতে উত্তর মেরুতে আশ্রয় নেয়। মানুষের যখন বুদ্ধিভিত্তিক বিকাশ হচ্ছিল, তখনো এরা অ্যাঙ্গেল দ্বীপে এদের ছোট্ট নীড়ে সুখে শান্তিতেই ঘর সংসার করছিল। এদের এই সুখ বেশিদিন টিকলো না। চার হাজার বছর আগে মানুষ প্রথম অ্যাঙ্গেল দ্বীপে পা রাখে। আর ঐ সময়েই এদের শেষ সদস্যটি বেঁচে ছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়। কাকতাল? সিনেমার স্ক্রিপ্ট ছাড়া এতগুলো কাকতাল নিশ্চয়ই সম্ভব নয়। মানুষ যে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সিরিয়াল কিলার, এখন বিশ্বাস হলো তো?


কৃষির উদ্ভাবন

মানুষের গল্প বলতে গেলে মধ্যপ্রাচ্যের কথা বারবার আসবেই। অনুকূল আবহাওয়ার কারণেই হোক আর ইন্টেলেকচুয়াল সুপেরিওরিটির কারণেই হোক, এখানকার মানুষই বারবার সভ্যতার পত্তন করেছে। আপনি চান বা না চান, আমাদের শেকড়ের সন্ধান করতে হলে এদের কাছে বারবার ফিরে আসতেই হবে। সত্তর হাজার বছর আগে মানুষ প্রথম মধ্যপ্রাচ্যে আসে। পরবর্তীতে বেশ একটা লম্বা সময় জুড়ে সে চাষবাস ছাড়াই থাকে। প্রকৃতিতেই এত সম্পদ ছড়ানো ছিল যে মানুষের খেয়েপরে বেঁচে থাকা নিয়ে কোন টেনশন ছিল না।

মানুষের প্রথম ও সবচেয়ে প্রবল ইনস্টিংক্ট হচ্ছে শিকার। এই করেই তার দিব্যি চলে যেত। তাই বলে যে প্রকৃতিতে সম্পদ যে সবসময় একই পরিমাণে ছিল তা নয়। মানুষ মানুক না মানুক, প্রযুক্তি কিন্তু সাইনুসয়ডাল কার্ভ ঠিকই মেনে চলে। কখনো সে সম্পদে উপচে পড়ে, এর পরেই হতো একটা বিশাল সময় যায় অভাব ও দারিদ্র্যে। প্রকৃতির এই মেকানিজমের সাথে মানুষের একটা অঘোষিত বোঝাপড়া ছিল। প্রাচুর্যের সময় লোকে বেশি বাচ্চাকাচ্চা নিত। আর অভাবের সময় কম। প্রযুক্তি নারীদের জন্যও ফিডব্যাকের ব্যবস্থা রেখেছে। প্রাচুর্যের সময় নারীরা তাড়াতাড়ি বয়োসন্ধিতে পৌঁছাতো। ফলে গর্ভবতীও হতো তাড়াতাড়ি। আর অভাবের সময় উলটো।

১৮ হাজার বছর আগে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। বরফ যুগ সরে গিয়ে জায়গা করে দেয় গ্লোবাল ওয়ার্মিংকে। ফলে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে, সেই সাথে বৃষ্টিপাতও। যাকে বলে কৃষি কাজের জন্য আদর্শ পরিবেশ। গম জাতীয় খাদ্যশস্যের জন্য পারফেক্ট আবহাওয়া। ‘সারভাইভাল ফর দ্যা ফিটেস্ট’ বলে একটা কথা আছে। এটা সবার জন্যই সমান সত্য। এই গরম আবহাওয়ায় গম জাতীয় শস্য পৃথিবীতে নিজের দখল বুঝে নিতে থাকে আস্তে আস্তে। মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ যে আগে গম খেতো না তা না। আর দশটা ফলমূলের মতই তার পাকস্থলী এই ইনসিগনিফিক্যান্ট দানাকে মাঝেমধ্যেই আপন করে নিত। কিন্তু এটা তখনো মানুষের প্রধান খাদ্য হয়ে ওঠেনি। ধান-গম তবে কী করে পৃথিবীতে তাদের সাম্রাজ্য গড়ে তুললো? মানুষ কি তবে কোন এক সকালে ঘুম থেকে উঠে প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে কৃষি কাজ শুরু করেছিলো?

উহুঁ। অধিকাংশ আবিষ্কারের মতই এটাও বেশ আকস্মিক। গম তো আর কাঁচা খাওয়া যায় না। এটা ঝেড়ে গুঁড়া করতে হত, তারপর রান্না করে খেতে হত। কাজেই যেখানে গমের দানা পাওয়া যেত, সেখানেই এটা খাওয়া হত না। একে অনেক আদর যত্ন করে বাসায় নিয়ে আসা হত। আসার পথে কিছু দানা অবশ্যই মাটিতে পড়ে যেত। সেই দানা থেকে নতুন গমের জন্ম হত।

এদিকে খাবারের অভাব হলে মানুষ এক জায়গা ছেড়ে আরেক জায়গায় মুভ করতো। যাবার পথে অতি অবশ্যই বন জঙ্গল পড়তো। রাস্তা ক্লিয়ার করার জন্য সেই বনজঙ্গল পুড়িয়ে তারা সামনে এগোত। ফলে বিচিত্র রকমের লতাগুল্ম মরে যেত ঠিকই। কিন্তু সেই জায়গা দখল করে নিত গমের মত কই মাছের প্রাণেরা। আর আগে সূর্যালোক আর পানির মত রিসোর্সের জন্য ধান-গমকে আরও অনেকের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে হত। লতাগুল্মের সংখ্যা আর ভ্যারিয়েশন কমে যাওয়ায় তারা বলা যায় একচেটিয়া ভোগ শুরু করে। পুঁজিবাদের নিয়মই হচ্ছে, যে পায়, সে আরও পায়। আর যে পায় না, সে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে। পুঁজিবাদী ধান-গম তাই মানচিত্রে একের পর এক তাদের বিজয় নিশান ওড়াতে থাকে।

যাই হোক, একটা সময় মানুষ খেয়াল করলো, বছরে একটা নির্দিষ্ট সময় গমের ফলন হচ্ছে। ঐ সময়টায় তারা ঐ ফলনের কাছাকাছি বউবাচ্চা নিয়ে থাকতে শুরু করলো। ধরা যাক, সেই সময়টা চার সপ্তাহ। পরের বার গমের ফলন আরও বেড়ে গেল। সমস্ত গম তুলে প্রসেস করতে তাই সময়ও একটু বেশি লাগলো। ধরা যাক, সেটা পাঁচ সপ্তাহ। এর পরের বার ছয় সপ্তাহ। এই করে করে এই ডিউরেশনটা বাড়তেই থাকলো। কালে কালে সেটা হয়ে উঠলো একটা স্থায়ী নিবাস। আমরা আজকাল যাকে গ্রাম বলি, সেই গ্রামগুলোর জন্ম ঠিক এইভাবেই।


লাক্সারি ট্র্যাপ

তিহাসের পাতায় পাতায় ‘লাক্সারি ট্র্যাপ’ এর ছড়াছড়ি। ১০ হাজার বছর আগে মানুষ যখন শিকার ছেড়ে পুরোপুরি চাষবাসে মন দেয়, তখন সে ভেবেছিলো, চাষবাস করলে তার জীবন বুঝি অনেক সুখের হবে। খাবারের সন্ধানে আর পথে পথে ঘুরতে হবে না। ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়াই খাদ্যের সন্ধান মিলিবে। বউ-বাচ্চা লইয়া বাড়িতে বসেই রক করা যাইবে।

কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। বাড়তি ফসল মানেই বাড়তি সুখ না। এই বাড়তি ফসল ফলাতে গিয়ে মানুষকে দিনরাত খেটে মরতে হলো। মানুষের শরীর এই কষ্টের জন্য প্রস্তুত ছিল না। মানুষের শরীর হচ্ছে মাস্তি করার জন্য। সে খাবে-দাবে, ঘুরবে-ফিরবে। পথের মধ্যে যা কুড়িয়ে পাবে, তাই দিয়ে পেটের ক্ষুধা মেটাবে। কিন্তু ফসল ফলাতে গিয়ে তাকে নিজের সাথে অনেক কম্প্রোমাইজ করতে হলো। ভালো ফসল ফলাতে হলে একদম মসৃণ, চকচকা শস্যক্ষেত্র চাই যেখানে নুড়ি, পাথর কিচ্ছু থাকতে পারবে না। মানুষ সকাল সন্ধ্যা খেটে সেগুলো পরিষ্কার করলো।

এদিকে ধানগম হচ্ছে ব্রাহ্মণ গোত্রীয় ফসল। এরা এদের ত্রিসীমানায় কোন ছোটলোক আগাছা সহ্য কতে পারে না। এই আগাছা নিড়াতে মানুষকে একটা সিগনিফিক্যান্ট সময় দিতে হলো। এদের ক্ষুধা-তৃষ্ণাও অনেক বেশি। খালি বৃষ্টির পানি দিয়ে এদের পিপাসা মিটতো না। এদের পিপাসা মেটানোর জন্য মানুষকে দূর-দূরান্ত থেকে কাঁধে করে পানি বয়ে নিরে আসতে হলো। গবাদি পশুর বিষ্ঠা দিয়ে মেটাতে হলো এদের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা।

আমরা মনে করি, আমরা জঙ্গুলে ধান-গমকে নিজেদের বুদ্ধিবলে পোষ মানিয়েছি। সত্যিটা হচ্ছে এই যে, আমরা ধান-গমকে পোষ মানাইনি, উলটো ধান-গম আমাদের পোষ মানিয়েছে। ওদের সুখ-সুবিধার জন্য আমরা নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছি। শিকারী জীবন ছেড়ে ওদের বসতির পাশে নিজেদের বসতি গড়েছি। বার রকমের ফলমূল খাওয়া ছেড়ে ওরা যেন ভালো থাকে, ওদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন ভালো থাকে তার দিকে নজর দিয়েছি। এই করে করে সামান্য একটা ঘাস, যেটা হয়তো কারো চোখেই পড়তো না, আজ পৃথিবীর পঁচিশ লাখ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি জায়গা জুড়ে নিজেদের সাম্রাজ্য স্থাপন করে বসে আছে।

এই যে এত ভালবাসা, এত ত্যাগ-তিতিক্ষা এর বিনিময়ে কী পেলাম? ফুড সিকিউরিটি? উহুঁ। আগে যেখানে আমরা প্রকৃতির কাছ থেকে দু’হাত ভরে নিতাম, সেখানে আমরা দু-তিনটা ফসলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লাম। বৈচিত্রের অভাবে আমাদের শরীরের ইম্যিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়লো। তার উপর সময়মত বৃষ্টি না হলে আমরা শেষ। বউ-বাচ্চা নিয়ে না খেয়ে মরতে হলো।

শুরুতে অবশ্য বাড়তি ফসল দেখে আমাদের চোখ টাটিয়ে গেল। আমরা স্থায়ী বসতি গড়ে বছর বছর বাচ্চা নেয়া শুরু করলাম। ভাবলাম, খাবার টেনশন তো নাই। বাচ্চা নেয়াই যায়। ভেবেও দেখলাম না, এত গুলো মুখের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে বাড়তি ফসল আছে কিনা। সেই সামান্য উদ্বৃত্ত নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চাটা ঠিকমত না খেতে পেয়ে মারা পড়লো।

কৃষি সমাজের নিয়মই হয়ে গিয়েছিল এমন যে- প্রতি তিনটা বাচ্চার মধ্যে একটা অপুষ্টি নয়তো অসুখ-বিসুখে মারা যাবেই। আর বসতিগুলোও ছিল ঘিঞ্জি আর রোগজীবাণুর আড়ৎ। যে কয়টা মরতো, জন্ম নিত তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। সেই বাড়তি মুখের অন্ন যোগানোর জন্য মানুষকে আরও বেশি বেশি ফসল ফলাতে হলো। আরও বেশি ফসল আরও বেশি খাটনি।

সমস্যার এইখানেই শেষ না। পৃথিবীতে সবসময়ই এমন কিছু মানুষ ছিল যারা নিজেরা কোন কাজ করতো না। অন্যের পরিশ্রমে ভাগ বসিয়ে নিজেদের রুটিরুজি করতো। ছোট পরিসরে এদের আমরা সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ বলি। আর বড় পরিসরে আদর করে বলি সরকার, পুলিশ কিংবা আর্মি। আর এটা তো জানা কথাই যে, সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসীই দিনশেষে সম্রাট হন।

সে যাই হোক, কৃষকের এই ফসলে বাইরের মানুষ এসে আক্রমণ চালাতো। বলতো, আমাদের ভাগ দাও। অবশ্যই মুখের ভাষায় না, অস্ত্রের ভাষায়। এদের প্রতিহত করার জন্য কৃষকদের একটা ইউনিটকে, কখনো বা গোটা ইউনিটকেই যুদ্ধবিদ্যার প্র্যাকটসিটা চালিয়ে যেতে হত। দিনে চাষবাস করো, আর রাতের বেলা ফসল পাহাড়া দাও। এই এক্সট্রা খাটনির জন্য তারা কোন ওভারটাইমও পেত না। তাদের জীবনটা একেবারে ব্যাড়াছ্যাড়া হয়ে গেল।

কৃষি মানুষকে যে লাক্সারির স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সময়ে সেটা নির্মম ফাঁদে পরিণত হলো। কৃষি ছিল মানব ইতিহাসের প্রথম ফাঁদ। সেই যে মানুষ ফাঁদে পা দিল, এরপর থেকে একটার পর একটা ফাঁদে পড়তেই লাগল। কৃষিকাজ যতটা না বিপ্লব, তার চেয়ে বেশি ধোঁকা হয়ে দেখা দিল মানুষের জীবনে। আশীর্বাদ নয়, দেখা দিল অভিশাপরূপে।

কথা হলো, এত কিছুর পরেও মানুষ কৃষিকাজ ছেড়ে আবার শিকারী জীবনে ফিরে গেল না কেন? কারণ, এই বদলগুলো ঘটেছে খুব ধীরে। ধীরে মানে এখনকার মত দশ-বিশ বছরে না। এক হাজার বছরে হয়তো খুব সামান্য একটা পরিবর্তন ঘটেছে। পরের প্রজন্মগুলো এই ধারাকে একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

দশ হাজার বছর আগে মানুষ যখন পুরোপুরি কৃষিতে থিতু হয়, এর সমস্ত ভাল আর মন্দ নিয়ে ততদিনে মানুষ ভুলেই গেছে যে তারাও এক সময় শিকারী ছিল। চাইলেও আর পিছু ফেরার সুযোগ তখন নেই। ইতিহাসের নিয়মই হচ্ছে এই যে, মানুষ একবার একটা লাক্সারিতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে এক সময় সেটাকে মৌলিক চাহিদা বলে মনে করে। আমাদের দাদা-নানা রা টেলিভিশন ছাড়াই চলেছেন। আমাদের বাবা-মা’র কাছে সেটা ছিল নেসেসিটি। আবার আমাদের বাবা-মায়েরা মোবাইল ফোন ছাড়াই দিব্যি প্রেম করেছেন। বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ রেখেছেন। আর আমরা মোবাইল ছাড়া নিজেদের অস্তিত্বই কল্পনা করতে পারি না। একদিন ভার্সিটিতে মোবাইল না নিয়ে এলে মনে হয়, আমার অস্তিত্ব বুঝি নাই হয়ে গেছে পৃথিবীর ময়দান থেকে। ইতিহাসের প্রতিটা ধাপই মানুষের সাথে এই ছলনা করেছে।

শুরুতে সে একটা সুখী, সুন্দর, আরামদায়ক জীবনের লোভ দেখিয়েছে। পরে ঠিকই তাকে আগের মতই কিংবা আগের চেয়েও কষ্টসাধ্য একটা জীবনের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কম্পিউটার আবিষ্কার হয়েছিল বড় বড় ক্যালকুলেশন নিমেষে করে ফেলার জন্য। সোজা কথায়, মানুষের জীবনকে সহজ করার জন্য। আসলেই কি তাই হয়েছে? মানুষ আগে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করতো। বাসায় এসে বউ-বাচ্চা নিয়ে হুমায়ূন আহমদের নাটক দেখতো। আজ তার ক্যালকুলেশন সহজ হয়েছে, কিন্তু জীবন হয়ে গেছে কঠিন। আজ সে এগার-বারো ঘণ্টা কাজ করেও কুলাতে পারে না। না পারে বসকে খুশি করতে, না পারে বউকে খুশি করতে।

ই-মেইল বা টেক্সটের কথাই ধরি না কেন! ই-মেইলের আগের যুগে মানুষ মানুষকে চিঠি লিখে খোঁজখবর করতো। প্রতিটা বাক্য, প্রতিটা শব্দ খুব চিন্তা করে লেখা হত। ভালবাসা দিয়ে লেখা হত। এখন সেই কাজই অফিশিয়ালি করা হয় মেইল দিয়ে আর আনঅফিশিয়ালী টেক্সট, ফেসবুক আর হোয়াটসএ্যাপের মাধ্যমে। প্রশ্ন হলো, ই-মেইল আমাদের জীবনে সুখ নিয়ে আসছে কিনা। উত্তর আবারো না। আমাদের দিনের একটা বড় অংশ কেটে যায় আজাইরা ইমেইল সাফ করতে। আর গ্রামীনফোনের মেসেজ তো আছেই!

সেকালেও হয়তো দু’একজন লোক ছিল, যারা টেকনোলজিকে অস্বীকার করেছিল। কৃষিকাজে না লেগে শিকারী যুগেই পড়ে রইলো। এ যুগেও হয়তো আছে তেমন। ফেসবুক বা মোবাইল ইউজ করে না। হয়তো লাখে একজন। কিন্তু আছে। সমস্যা হলো, টেকনোলজির নিয়মই হচ্ছে এই যে তার সমস্ত অসুবিধা নিয়েই অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাবে। সাময়িক লাক্সারির টোপ দেখিয়ে মানুষকে ফেলে দিবে বিরাট ট্র্যাপে। মানুষের জীবনকে করে তুলবে কঠিন থেকে কঠিনতর।


মানুষের স্বার্থের বলি

শিকারী মানুষের মধ্যেও কিছু ইন্টার্নাল হিসাব-নিকাশ ছিল। তারা যখন শিকারে বেরোতো, চোখের সামনে যা পেত, তাই শিকার করতো না। হয়তো তারা ভেড়া শিকারে বেরোলো। খুঁজে খুঁজে তারা বয়স্ক আর বুড়ো-ধাড়িগুলোকেই শিকার করতো। অল্প বয়স্কগুলোকে আপাতত ছেড়ে দিত। এইটুকু কমন সেন্স তাদের ছিল, যুবতী ভেড়াগুলোকে মেরে ফেললে পরবর্তীতে নতুন ভেড়া তারা পাবে কই?

এই সিলেক্টিভ শিকারে তাদের লাভই হচ্ছিল। কিন্তু বাঘ-সিংহের যন্ত্রণায় এই লাভ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছিল না। বাঘ-সিংহ এসে ভেড়া খেয়ে ফেললে মানুষ খাবে কী? মানুষ তখন নিজে থেকে এদের প্রটেকশন দিতে আরম্ভ করলো। একটা ঘের দেয়া এলাকায় তাদের আটকে তাদের সিকিউরিটি নিশ্চিত করলো। কিন্তু সিকিউরিটি-ই তো জীবনের সব কিছু নয়। স্বাধীনতা বলেও একটা জিনিস আছে। কাজেই সব ভেড়াই মানুষের বশ্যতা স্বীকার করলো না। কিছু পুরুষ ভেড়া ছিল, যেগুলো খুবই এ্যাগ্রেসিভ। মানুষের কথা শুনতেই চাইতো না। মানুষ সেগুলোকে অল্প বয়সেই মেরে ফেললো।

দলের বাকিদের শিক্ষা দিয়ে দিল যে বেশি তেড়িবেড়ি করলে তাদেরও এই অবস্থা হবে। স্ত্রী ভেড়াদের দশা হলো আরও করুণ। যেগুলো একটু শুকনা-পাতলা ছিল, সেগুলোকে চোখ বন্ধ করে মেরে ফেলা হলো। ফলে, খালি মোটা আর থলথলে ভেড়াগুলোর জিনই এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বাহিত হবার সুযোগ পেল। ফলাফল, ভেড়া দিনকে দিন ফুলতে থাকলো আর মানুষের বশ হতে লাগলো।

এর আগে মানুষ যেখানেই গেছে, সেখানকার ডেমোগ্রাফিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। অবশ্যই নেগেটিভ পরিবর্তন। এই প্রথম মানুষ খোদ বিবর্তনের গতি পালটে দিতে শুরু করলো। বিবর্তনকে ব্যবহার করতে লাগলো নিজের দরকার মত। দশ হাজার বছর আগেই মানুষ গরু, ছাগল, শুয়োর, ভেড়া আর মুরগিকে নিজেদের বশ করে ফেলে। গোটা পৃথিবীতে তখন তাদের সংখ্যা ছিল কয়েক মিলিয়নের মত। আজ এক মুরগিই আছে পঁচিশ বিলিয়নের বেশি। তার মানে প্রতিটা মানুষের জন্য প্রায় চারটা করে মুরগি।

আর গরু-ছাগল, শুয়োর-ভেড়া তো আছেই বিলিয়নখানেকের বেশি। বিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, মুরগি কিন্তু মানুষের চেয়ে অনেক বেশি সফল। বিবর্তনের সানগ্লাস দিয়ে দেখলে, যে জিন নিজেকে যত বেশি ছড়িয়ে দিতে পেরেছে,সে তত সফল। সেই হিসেবে মুরগি ইতিহাসের সফলতম প্রাণীদের একটি।

ওয়েইট! ইভোল্যুশনারী সাকসেস আর ইনডিভিজ্যুয়াল সাকসেস এক জিনিস না। এই ইভোল্যুশনারী সাকসেস অর্জনের জন্য এদের বিরাট মূল্য দিতে হয়েছে। যে কারণে এদের ব্যক্তিগত জীবন বলতে কিছুই নাই এখন। বনমুরগির গড় আয়ু ছিল সাত থেকে বার বছর। গবাদি পশুর ক্ষেত্রে সেটা বিশ থেকে পঁচিশ বছর। এতটা হয়তো এরা বাঁচতো না। কিন্তু তবু এদের জীবনেও একটা আশা ছিল, সম্ভাবনা ছিল এতগুলো দিন, মাস, বছর পৃথিবীর রঙ, রূপ, রস উপভোগ করার।

আজ সেই সম্ভাবনাকে আমরা গলা টিপে মেরে ফেলেছি। আজ একটা মুরগির গড় আয়ু কয়েক সপ্তাহ, বড়জোর কয়েক মাস। যে মুরগি ডিম পাড়ে, আর যে গাভী দুধ দেয় এদের হয়তো কিছু বেশিদিন বেঁচে থাকতে দেয়া হয়। কিন্তু কিসের বিনিময়ে? চরম অপমান আর অসম্মানের বন্দী জীবনের বিনিময়ে। একটা তরুণী গাভীর পারস্পেক্টিভে একবার চিন্তা করুন। তারও তো ইচ্ছা হতে পারে ভালো দেখে একটা গরুর সাথে প্রেম করতে। দু’জনে মিলে বাচ্চা জন্ম দিতে। তারপর সেই বাচ্চাকে আদর-যত্ন করে বড় করতে, দুধ খাওয়াতে। অথচ আমরা তার প্রতিটা অধিকারই কেড়ে নিচ্ছি নিজেদের স্বার্থ হাসিলে। সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে পুরুষগুলোকে। এরা যখন আমাদের আর কাজে লাগে না, তখন এদের খোঁজা করে ফেলা হয়। সবচেয়ে মারমুখী পুরুষটাও তখন মানুষের দাসানুদাস হয়ে যায়। আর দশটা প্রাণীর মত এদের যে একটা সামাজিক জীবন ছিল, সেই জীবন আমরা পুরোপুরি কেড়ে নিয়েছি নিজেদের সুখ-সুবিধা আদায়ে।

নিজেদের সুখ-সুবিধার জন্য মানুষ কতোদূর নামতে পারে, তা কিছু উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। নিউ গিনির সমাজের কথা বলি। এদের সমাজে একটা মানুষ কতটুকু সম্পদশালী তা যাচাই করা হত তার শুয়োর সংখ্যা দিয়ে। তো শুয়োরগুলো যেন পালাতে না পারে, সেজন্যে তারা শুয়োরের নাক কেটে দিত। একে তো শুয়োরগুলো নাকের ব্যথায় প্রচণ্ড কষ্ট পেত, তার উপর ঘ্রাণ শুঁকতে না পারায় নিজে নিজে খাবারও খুঁজতে পারতো না। ফলাফল, মানুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া।

আরেকদল তো ছিল ‘একটেল এক ধাপ এগিয়ে’। এরা শুয়োরের চোখ জাস্ট কানা করে দিত। স্বাধীনতার তো প্রশ্নই আসে না। সবচেয়ে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয় গরু-ছাগলের সাথে। গরু-ছাগল তো আর এমনি এমনি দুধ দেয় না। কেবল বাচ্চা হলেই দুধ দেয়। তো প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ বাচ্চা জন্ম নেবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাচ্চাগুলোকে মেরে ফেলতো। যতটুকু দুধ দোয়ানোর দুইয়ে নিত। তারপর মা বেচারীকে আবার প্রেগন্যান্ট করে ছাড়তো।

একটা গরু হয়তো পাঁচ বছর বাঁচে। দেখা যায়, বাচ্চা জন্মের দুই কি চার মাসের মধ্যে তাকে আবার প্রেগন্যান্ট করে ফেলা হয়। ভদ্রমহিলা তার জীবনের অধিকাংশ সময়ই এভাবে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় কাটিয়ে দেন। কেবল দুধের সর্বোচ্চ সাপ্লাই নিশ্চিত করার জন্য। নিষ্ঠুরতার এখানেই শেষ নয়। সবচেয়ে বড় নিষ্ঠুরতা আমরা সবাই কমবেশি গ্রামে গিয়ে স্বচক্ষে দেখেছি। বাছুরটাকে মা গরুর কাছে নিয়ে আসা হয়। সে দুধ খাওয়া শুরু করলেই তাকে মায়ের বুক থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। মা-শিশু দু’জনেই এতে প্রবল বাধা দেয়। কিন্তু মানুষের হিংস্রতার সামনে সেই বাধা কিছুই নয়। ভেবে দেখুন তো, এই একই কাজ মানুষের সাথে কেউ করলে আমাদের কেমন লাগতো?

এত গেল পরিচিত দৃশ্যের কথা। অপরিচিত দৃশ্যের কথা বলি। একটা গোষ্ঠী আছে যারা ভেড়ার বাচ্চা মেরে তার মাংস খেয়ে চামড়াটা রেখে দিত। সেই চামড়া দিয়ে ভেড়ার একটা অবয়ব তৈরি করতো। ভেড়ার সেই অবয়ব মা ভেড়ার কাছে আনলে তার শরীরে দুধ আসতো। আরেকটা টেকনিক হচ্ছে বাছুরের মুখে শিং এর মত ধারালো কিছু দিয়ে ঢেকে রাখা। বাছুর তখন দুধ খেতে চাইলে মা নিজেই তাকে ব্যথায় সরিয়ে দিবে। সাহারা মরুভূমির লোকজন উটের বাচ্চার নাক আর উপরের ঠোঁট কেটে রাখতো। যেন বেশি দুধ খেতে না পারে। অল্পতেই হাঁপিয়ে যায়।

পৃথিবীর ইতিহাস আসলে ভালবাসার ইতিহাস নয়। অন্যায়ের ইতিহাস। সবচেয়ে বড় অন্যায়টা বোধ হয় আমরা করেছি আর করেই চলেছি এই গৃহপালিত পশুপাখিদের সাথে। পৃথিবীটা তাদের কাছে একটা জেলখানা বৈ কিছু তো নয়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, এই অন্যায়ের জন্য আমাদের ভেতরে কোন অনুশোচনাও নেই। সম্ভবত, ধান-গম আমাদের যেভাবে বুনো মানুষ থেকে ঘরবন্দী মানুষে পরিণত করেছে, আমরা তারই প্রতিশোধ নিয়েছি গরু-ছাগল আর মুরগির উপর। তাদের ঘরবন্দী করে। স্বাধীন জীবন কেড়ে নিয়ে।


অন্যান্য পর্বগুলো পড়ুন এখানে ⇑

Related Articles

0 0 votes
Post Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
Back to top button
0
Rate & Give your feedback!x
()
x

পুলিন বকসী: প্রথমত শহীদ সাহেবের ডান পন্থার কারনে ভাসানী তার বিরোধীতা করেন নি। শহীদ সাহেবের তীব্র আমেরিকা প্রীতিই (সিয়াটো-সিন্টো চুক্তি) ন্যাপ গঠনের অনেকগুলো কারনের অন্যতম কারন।

দ্বিতীয়ত আপনি যেভাবে তাকে আইয়ুব খানের একজন প্রায় 'দালাল' বা 'চাটুকার' বানায়া দিলেন সেই ভাসানীই কিন্তু ৬৯ এ ব্যপক ভূমিকা রেখেছিল শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে। শুধু তাই না এই উনসত্তরের আন্দোলনের শুরুটাও ভাসানীদের হাত ধরে।

ধন্যবাদ।

Farid Ahmed: আমি বহু জনকে জিজ্ঞেস করেছি, কেউ আমাকে সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারে নাই কেনো মওলানা ভাসানী আইয়ুব খানের প্রতিনিধি হিসাবে চীনে গিয়েছিলেন। আশা করি আপনি আলোকপাত করতে পারবেন এ ব্যাপারে। তাঁর আইয়ুব প্রীতি আমার আবিষ্কার না। ষাটের দশকেই এ নিয়ে বিস্তর কথা উঠেছে। আমি আগের একটা লেখায় সব রেফারেন্স দিয়েছি। আমি ভাসানীকে এখনও দালাল কিংবা চাটুকার বলি নাই, যদিও বলা উচিত ছিলো আমার।

১৯৮৬-৮৭ সালে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন জালাল আহমেদ। ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি এরশাদের সাথে হাত মেলান। এরশাদ তাঁকে অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশ মিশনে সেকেন্ড সেক্রেটারি পদে নিয়োগ দেয়। জালাল আহমেদ সংগোপনে তাঁর গোপনে বিয়ে করা বউকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমান। এখন পর্যন্ত এই অপরাধে ছাত্রদল তাঁকে দালাল বলে। আমরাও তাঁকে এরশাদের দালালই বলতাম। দালালকে তো দালালই বলা লাগে, তাই না?

Marzia Prova: ফরিদ ভাই আইয়ুব শাসনের আমলে পাকিস্তানের জোরদার উন্নয়ন দেখা যাচ্ছিল৷ ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এর আগে তার উন্নয়নের দশক পালন করার প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছিল। ভাসানীর কথা ছিল, "পশ্চিম পাকিস্তান যদি পূর্ব পাকিস্তানের উপর শোষণ না বন্ধ করে, তবে পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম।" এখন তথাকথিত আইয়ুবের উন্নয়ন পূর্ব বাংলাতেও হয়েছিল। শোষণের বিপরীতে এই উন্নয়নকে যদি সফলতা হিসেবে দেখা হয়, তবে ভাসানী একজন পাকিস্তান নাগরিক হিসেবে সফল শাসক এর প্রতি মুগ্ধতা ছিলেন! তাই নয় কি?

আপনি জাস্ট এই বিষয়টা এখনকার বাংলাদেশের সাথে মিলান। উন্নয়ন দিয়ে সফলতাকে নির্ধারণ বাকি অনেক কিছুকে যখন আড়াল করা হয়, তখনও তো দেশের অনেক মানুষের সেই সফল শাসকের প্রতি মুগ্ধতা থাকে৷ সম্ভবত ভাসানীর আইয়ুব প্রীতি সে জায়গা থেকে। জাস্ট আপনার লেখা আর কমেন্ট পড়ে এইটা মনে হইল। এই মানসিকতা অবশ্যই দ্বান্দ্বিক এবং স্ববিরোধী কোন সন্দেহ নাই৷ হয়ত এই মানসিকতা না থাকলে ভাসানী অন্যভাবে স্মরণীয় থাকতেন।

Farid Ahmed: আইয়ুব খানের সাথে মওলানার ওই উন্নয়নমূলক মুগ্ধতার সম্পর্ক ছিলো না। উনি ৬৩-তে সরকারী একটা ডেলিগেশন টিমের প্রধান হিসাবে চিনে যান। আইয়ুব খান সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে তাঁর বিন্দুমাত্র বিবেকে বাধেনি, যেখানে ৬২-তে বিশাল এক ছাত্র আন্দোলন হয়ে গিয়েছিলো আইয়ুব খান সরকারের গণবিরোধী শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে।


মওলানা ভাসানী ৬৯ এ ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে। শুধু তাই নয়, এই উনসত্তরের আন্দোলনের শুরুটাও ভাসানীদের হাত ধরে। তাহলে তাকে আইয়ুব খানের একজন প্রায় 'দালাল' বা 'চাটুকার' হিসেবে দেখাটা কি যৌক্তিক?

এই বক্তব্যের মূল কারণ হচ্ছে আমি আমার লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে মওলানা ভাসানী আইয়ুব খানের প্রতি সহানুভুতিশীল ছিলেন, তাঁর সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে চীন গমন করেছিলেন এবং ১৯৬৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন দেবার প্রতিশ্রুতি দেবার পরেও মওলানা ভাসানী গোপনে আইয়ুব খানকে সমর্থন দিয়েছিলেন।

এই অভিযোগটির লজিক্যাল ফ্যালাসিটা আগে বলি। তারপর আমি আইয়ুবের সাথে ভাসানীর সখ্যতা ব্যাখ্যা করবো।

ঊনসত্তরে মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন, ঊনসত্তরের আন্দোলনের তাঁর দুর্দান্ত ভূমিকা ছিলো, এই তথ্য দিয়ে কি তাঁর অন্য কাজগুলোকে জাস্টিফাই করা যায়? যায় না। আমি গতকাল একটা অপরাধ করেছি, আর আজকে একটা ভালো কাজ করেছি। এখন যদি আমি যুক্তি দেই যে আমি তো আজকে ভালো কাজ করেছি, তারপরেও আমাকে আপনারা অপরাধী বানিয়ে দিলেন, সেটা কেমন লাগবে আপনাদের কাছে? তিনি তেষট্টিতে আইয়ুবের প্রতিনিধি হিসাবে চীনে গেছেন, এই অভিযোগ ঊনসত্তরের ভূমিকা দিয়ে আড়াল করাটা আর যাই হোক না কেনো যুক্তিসঙ্গত কোনো কাজ হতে পারে না। ঊনসত্তর নয়, মূলত আটষট্টি সাল থেকে আইয়ুবের সমালোচনায় নামেন মওলানা ভাসানী। কিন্তু তেষট্টি থেকে আটষট্টির আগ পর্যন্ত তাঁর ভূমিকা কী আইয়ুবের ব্যাপারে? আসুন, ইতিহাস থেকে দেখি আমরা তিনি কী করেছিলেন সেই সময়ে।

১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসের ৭ তারিখে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার মির্জা দেশে মার্শাল ল জারি করেন। তিনি যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং আইয়ুব খানকে সুপ্রিম কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ দেন। ইস্কান্দার মির্জার দুর্ভাগ্য, এর মাত্র তিন সপ্তাহ পরে অক্টোবর মাসের ২৭ তারিখে আইয়ুব খান তাঁকেই উৎখাত করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নেন। ইস্কান্দার মির্জা মার্শাল ল জারি করার পর ১২ তারিখে নিরাপত্তা আইনে মওলানা ভাসানীকে বন্দি করেন। দীর্ঘ চার বছর তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন।

১৯৬২ সালের ৩রা নভেম্বর তাঁকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর পরই তিনি আইয়ুব খানের সাথে দেখা করেন, যেটা প্রবলভাবে সমালোচিত হয়। দেওয়ান শামসুল আরেফিন তাঁর, “Bhashani, the maulana Bhashani, the comrade” বইতে লিখেছেন,

“After more than four years in prison, the Moulana was released on November 3 1962. A few days after his release, he met with President Ayub in Rawalpindi. The Ayub-Bhashani meeting created a mixed reaction among the left political circles.”

আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের সময় পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় মিত্র ছিলো যুক্তরাষ্ট্র। চীনের সাথে পাকিস্তানের সীমান্ত নিয়ে বেশ ঝামেলাই ছিলো বলা চলে। সীমান্ত বিরোধ নিয়ে ১৯৫৯ সালে চীনের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। দুই পাশে দুই শত্রু দেশ ভারত এবং চীনকে পুষে রাখাটা খুবই ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ এই বিবেচনা থেকে চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের দিকে অগ্রসর হয় পাকিস্তান। এর জন্য অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের রোষেরও শিকার হয় পাকিস্তান। কিন্তু, তারপরেও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীনকে প্রাধান্য দেবার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান। ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো চীন সফর করেন।

পঞ্চাশের দশক থেকেই মওলানা ভাসানীর সাথে চীনের সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো রাজনৈতিক কারণে। চীনের সাথে সম্পর্ক আরো দৃঢ় করার জন্য মওলানার সাহায্য কামনা করেন তিনি। ১৯৬৩ সালের অগাস্ট মাসে তিনি মওলানাকে রাওয়ালপিণ্ডিতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। পত্র-পত্রিকাতে আইয়ুব-ভাসানী আঁতাতের খবর প্রকাশিত হতে থাকে। ভাসানী এগুলোকে ‘স্বার্থান্বেষী মহলের ছড়ানো গুজব’ বলে উড়িয়ে দেন।

এই আঁতাত যে গুজব না, সেটা টের পাওয়া যায় পাকিস্তানের প্রেরিত ডেলিগেশন টিমের প্রধান হওয়ার মধ্য দিয়ে। জাতীয় স্বার্থে তিনি এই দলের প্রধান হিসাবে চীনে যাচ্ছেন বলে তিনি জানান।

সেপ্টেম্বর মাসের ২৫ তারিখে ঢাকা থেকে প্রথমে করাচি যান তিনি। সেখান থেকে রেঙ্গুন হয়ে চীনে পৌঁছান মওলানা ভাসানী। পিকিং এ উষ্ণ অভ্যর্থনা পান তিনি। চীনের প্রিমিয়ার চৌ এন লাই এর সাথে সাক্ষাতে আইয়ুবের সরকারের জন্য সমর্থন প্রত্যাশা করেন তিনি। তিনি বলেন,

“I am old, perhaps I will not have another chance to come to china; I hope you and your country’s government can fully work together with Ayub khan’s government and his representative General Raza.”

চীনের যাবার সুযোগ তাঁর আরেকবারও হয়েছিলো। যদিও পরবর্তী এই সফর খুব বেশি প্রচারণা পায়নি। দেওয়ান শামসুল আরেফিন তাঁর বইতে লিখেছেন,

“Abdul Hamid Khan Bhashani paid another low-profile visit to China in 1964. The second visit was, in fact, more significant than the first one. This time he had exclusive talks with Chairman Mao, Premier Chou and other leaders including Den-Tsiao-ping.”

অগাস্ট মাসে রাওয়ালপিণ্ডিতে আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাৎ, তার মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে সরকারী প্রতিনিধি দলের নেতা হয়ে চীন সফর অন্য দল এবং নিজের দলের মধ্যেও তীব্র সমালোচনার সুত্রপাত ঘটায়। ন্যাপ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পিকিংপন্থী অংশ ভাসানীর নেতৃত্বে থেকে যায়, অন্যদিকে মস্কোপন্থী অংশ কমরেড মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে আলাদা হয়ে যায়।

পিকিং থেকে ফিরে আসার পরে শুধু মওলানা ভাসানী একাই নন, চিনপন্থী কম্যুনিস্টদের একটা বড় অংশ আইয়ুব খানের ভক্ত বনে যায়। আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের মহিমা কীর্তন করা শুরু করেন তারা। বাষাট্টির এতো বড় ছাত্র আন্দোলনের পরে যেখানে আইয়ুবের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার কথা ছিলো তাঁর, সেখানে তিনি আইয়ুব খানকে বিরক্ত না করার সিদ্ধান্ত নেন। ডক্টর নুরুন নবী তাঁর “Bullets of ‘71: A freedom fighter’s story” বইতে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন,

“After that visit, Moulana Bhashani declared his infamous policy statement, “Don’t disturb Ayub”. Bengali people were stunned. That was the biggest mistake of Moulana Bhashani’s political career.”

তারিক আলী চীনপন্থী বাম ছাত্রনেতা ছিলেন। তাঁর একটা বই আছে। বইটার নাম “Pakistan, military rule of peoples power”। বইটা প্রকাশিত হয়েছে দিল্লি থেকে ১৯৭০ সালে। এই বইতে তারিক আলী পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সাথে মাওলানা ভাসানীর নিবিড় সখ্যের কারণ অনুসন্ধান করে তার পটভূমি আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি তাঁর বইতে লেখেন, ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইউব খান মাওলানা ভাসানীকে পাকিস্তানের সরকারী প্রতিনিধি করে চীনে পাঠাতে চাইলে মাওলানা রাজি হন। সেখানে চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুং এর সাথে তাঁর যে গোপন সলাপরামর্শ হয় তার একটা বিবরণ তিনি মাওলানার কাছ থেকেই গ্রহণ করেছিলেন টেপ রেকর্ডারে।

তারিক আলী মওলানাকে প্রশ্ন করেছিলেন, “When you went to China what did Mao discuss with you when you met him?” এর উত্তরে মওলানা বলেছিলেন,

“মাও সে তুং আমাকে বলেন, “আপনি যদি সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন তাতে রাশিয়া, আমেরিকা এবং ভারতের হাতই শক্তিশালী হবে। আপনার কাজে হস্তক্ষেপ করা আমাদের নীতি বিরুদ্ধ, তথাপি আমরা আপনাকে সাবধানে এবং ধীর গতিতে আন্দোলনে অগ্রসর হতে অনুরোধ করবো। আপনার সরকারের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব আরো গাঢ় করার সুযোগ দিন।”

আগেই বলেছি, চীন থেকে ফিরে আসার পরেই মওলানা এবং তাঁর অনুসারীরা আইয়ুব খানের ভক্ত হয়ে যায়। সাপ্তাহিক ‘জনতা’ ছিলো ন্যাপের মুখপত্র। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন আনোয়ার জাহিদ। তিনি তখন ভাসানীর ব্যক্তিগত সচিব। আনোয়ার জাহিদ নিজেও আশির দশকে সামরিক শাসক এরশাদের দালালি এবং গোলামি করেছেন। তাঁকে সবাই ঝাঁড়ুদার মন্ত্রী হিসাবেই চিনতো। কারণ, তিনি একবার প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, এরশাদ যদি বলে, তবে তিনি রাস্তা ঝাঁড়ু দিতেও আপত্তি করবেন না। এই আনোয়ার জাহিদ ১৯৬৫ সালে সাপ্তাহিক জনতায় লেখেন, “There were only two Imperialist voices in Pakistan – Ayub and Vashani.”

আনোয়ার জাহিদের বক্তব্য পরিষ্কার, তিনি তাঁর নেতা এবং আইয়ুব খানকে একই কাতারে দেখেছেন। মওলানা ভাসানীর এই সামরিক শাসকের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের ফলাফল কী হতে পারে, সে সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মফিদুল হক লেখেন,

“১৯৬৩ সালে কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর জেনারেল আইউব আয়োজিত চীন সফরের পর থেকেই মাওলানা ভাসানীর পদস্খলন ঘটতে থাকে। চীনা রাষ্ট্র-নেতাদের আত্মস্বার্থ-প্রণোদিত নীতির কাছে মাওলানা ভাসানীর আত্মসমর্পণ এদেশের বাম রাজনীতির জন্য বিরাট দুর্ভাগ্যের সূচনা করে। রাজনৈতিক বিভ্রান্তি থেকে তিনি যে পথে পা দিয়েছিলেন তা শুধু আইউবের শাসনের সহায়ক ভূমিকা পালন করেনি, মাওলানা তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে সামরিক শাসকচক্রের যে সংযোগ গড়ে ওঠে তা পরবর্তী সময়েও বহু দুর্ঘটনার কারণ হয়েছিল।”

মওলানার নিজের দলের লোক হাজী দানেশও মওলানার সাথে আইয়ুব খানের সমঝোতা ছিলো বলে মনে করেন। এ কারণে আইয়ুবের বিরুদ্ধে তিনি বাম শক্তিগুলোকে একত্রিত করেননি বলে অভিযোগ করেন তিনি। হাজী দানেশ ছিলেন ন্যাপের সহ-সভাপতি। মওলানার সাথে তাঁর কোন্দল এমন পর্যায়ে যায় যে তিনি সহ একটা বিরাট অংশ ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে ন্যাপ থেকে বের হয়ে যান। ১৯৭১ সালের ৮ই জানুয়ারি হাজী দানেশ এক খোলা চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে তিনি বলেন,

“আপনি বিশ্বাস করতেন যে ইস্কান্দর মির্জা ও আইউব খান দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করবে। আইউবের বিরুদ্ধে বামপন্থী শক্তিগুলোকে সংগঠিত করার ব্যাপারে আপনার অনীহা এটাই প্রমাণ করে যে, শোষক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে আপনার যোগ ছিল। আমি এটা বিশ্বাস করতে পারিনা যে, আপনার ও ন্যাপের এ ধরনের নীতির মাধ্যমে লাখ লাখ শোষিত মানুষের মুক্তি আসবে।”

 

Masudur Rahman: ১৯৭০-এর জানুয়ারিতে সন্তোষে কৃষক সম্মেলনে মাওলানা ভাসানী আরও বললেন, ‘আমাদের ভাগ্য আমাদেরই গড়ে নিতে হবে। পিন্ডির গোলামি ছিন্ন করতে হবে।’ ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বরের বঙ্গোপসাগরীয় সাইক্লোনের প্রেক্ষাপটে উনি আবার সরাসরি বললেন ‘স্বাধিকার স্বায়ত্তশাসন নয়, চাই স্বাধীনতা।’

ফরিদ, তোমার লেখা আমি গুরুত্ব সহকারে পড়ি; অনেক কিছু জানতে পারি, শিখতে পারি। কোন মানুষই ভুলের উর্ধ্বে নন, যেমন ভাসানী। কিন্তু, তাই বলে তাকে আইয়ুব ইয়াহিয়ার সহচর বানিয়ে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিলে! মওলানা ভাসানীকে নিয়ে তোমার লেখাগুলি পড়ে আমি সত্যি হতাশ!

Farid Ahmed: আমিতো কোনো সিদ্ধান্ত দেই নাই। সবই কোট করেছি আমি। তিনি আইয়ুবের সহচর ছিলেন, এই অভিযোগ তখনই উঠেছে।

আমার বিশ্লেষণ আমি বলতে পারি। যে আইয়ুব ক্ষমতা দখল করে তাঁকে কারাগারে পাঠালো, তিনি কারাগার থেকে বের হয়ে সেই আইউবের প্রতিনিধি হয়ে চীন যান ঠিক কী কারণে? কোন স্বার্থে? আপনি আমাকে একটা মাত্র যৌক্তিক কারণ বলবেন মাসুদ ভাই এ ব্যাপারে। আমি দ্বিতীয় যুক্তিও শুনতে চাইবো না।

তিনি সিআইএ-র রিপোর্ট ইয়াহিয়াকে দিয়েছেন? কেনো? যেখানে তিনি নিজেই বলছেন এই দলিলে দেখা যাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার ষড়যন্ত্র চলছে। উনি কি বিচ্ছিন্নতার বিপক্ষে ছিলেন? বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার একেকজনের একেক ধরনের কর্মপন্থা ছিলো, সেই পন্থা নিয়ে সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু এই দলিল হস্তান্তর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষেই তাঁকে দাঁড় করিয়ে দেয়।

ভাসানী একজন স্ববিরোধী মানুষ ছিলেন। উনি স্বাধীনতার পক্ষেও বহু কথা বলেছেন, আবার বিপক্ষেও বলেছেন। আপনারা শুধু পক্ষেরটা জানেন, বিপক্ষেরটা না। আমি উনি স্বাধীনতার বিপক্ষে কী কী বলেছেন সেগুলো নিয়েই আরেকটা লেখা লিখবো দুই একদিনের মধ্যেই।

Swapan Mahmud: "পাকিস্তান ওয়ালাইকুমআসসালাম" এটাই স্বাধীনতার প্রথম প্রতীকী ঘোষণা।

Farid Ahmed: ওই এক তথ্য নিয়েই পড়ে থাকেন। মোল্লাদের অন্ধত্ব এবং একদেশদর্শীতা আমাকে পীড়া দেয় না, কিন্তু, আপনাদেরটা দেয়। কারণ, প্রগতিশীল বলে দাবি করেন আপনারা। দাবি করেন, অথচ সব তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে আসেন না। পূর্বানুমান সিদ্ধান্ত নিয়েই বসে থাকেন।

১৯৬২ সালে ছাত্ররা আইউব খানের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করেছিলো শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে। ভাসানী কি জানতেন না যে এই দেশের ছাত্র এবং জনগণ আইউব জান্তাকে বাতিল করে দিয়েছে? সেই জান্তার প্রতিনিধি হিসাবে ১৯৬৩ সালে তিনি চীনে যান কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর আপনাদের মতো বায়াসড লোক কোনো দিনই দিতে পারবেন না, খালি ওই এক ওয়ালাইকুম সালাম নিয়েই পড়ে থাকবেন আপনারা।

Masudur Rahman: খন্ডিত বিশ্লেষণ করে প্রমান করা যাবে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য '৭০ এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন নাই। একটি বিষয় অন্তত আমার কাছে পরিষ্কার, ভাসানীর তুমুল জনপ্রিয়তা থাকা সত্যেও ক্ষমতার লোভ তার ছিল না। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে উনিও কষ্ট পেতেন ভাসানীর এই পোস্টমর্টেম দেখে কারন উনি জানতেন উনার বঙ্গবন্ধু হওয়া পিছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশী। বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা থেকে মুক্ত করার জন্য যে গন আন্দোলনের দরকার ছিল, তা ভাসানী ছাড়া আর কে করতে পারতেন? তুমি তো ১৯৬৩ সনেই আটকে থাকলা, ফরিদ!

Farid Ahmed: উনার সামরিক শাসক সখ্যতা নিয়ে বিস্তারিত আমি লিখেছি মাসুদ ভাই। শুধু ৬৩-তে আটকে থাকিনি। যদিও ওইটাই সবচেয়ে ভাইটাল মুহুর্ত। কোন কারণে তিনি আইয়ুবের প্রতিনিধি হয়ে চীনে গিয়েছিলেন, সেটা জানাটা খুবই জরুরী আমাদের জন্য। মওলানা বাদে অন্য কেউ হলে আমি এক বাক্যে তাঁকে আইয়ুবের দালাল বলে দিতাম। ব্যক্তিটা উনি বলে আমি এখনো এর একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা খুঁজছি।

১৯৭২-১৯৭৬

মওলানা ভাসানী ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক হক-কথা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করলেও মুজিব সরকারের জাতীয়করণ নীতি এবং ১৯৭২-এর সংবিধানের এর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। ১৯৭৩ সালে খাদ্যের দাবিতে ঢাকায় ১৫-২২ মে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ১৯৭৪-এর ৮ এপ্রিল হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি গঠন করেন। একই বছর জুন মাসে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলে টাঙ্গাইলের সন্তোষে গৃহবন্দি হন। ১৯৭৬-এর ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লং মার্চে নেতৃত্ব দেন। একই বছর ২ অক্টোবর খোদাই খিদমতগার নামে নতুন আর একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

— উইকিপেডিয়া থেকে

Supik Anwar: ৫০ বছর ধরে বহুমাত্রিক ভাবে গন মানুষ এর রাজনীতি করা একজনকে শুধু কয়েক বছরের রাজনীতি দিয়ে মুল্যায়ন কতটুকু যুক্তিযুক্ত!? ঐ সময়ে উনি হাসপাতালে ছিলেন।পরে ভাসানী হাসপাতালে থাকা অবস্তায় মোশতাক উনাকে একদিন দেখতে গিয়েছে। তখন উনি মোশতাককে বলেছিলেন "আমার মুজিবররে তোমরা মাইরা ফেললা"!

Farid Ahmed: আপনি আপনার রেফারেন্স দেন। আর আমি আমার রেফারেন্স দিচ্ছি।

Supik Anwar: একজন সাংবাদিক (নামটা মনে পড়ছে না) উপস্থিত ছিলেন অই সময়। পরে উনি সহ সবাইকে রুম থেকে বাইরে যেতে বলেন মোশতাক। মোশতাক বেশ কিছুক্ষণ ভাসানীর সাথে একান্তে কথা বলে।এগুলা ভাসানীকে নিয়ে লিখা একটা কলামে পড়েছিলাম।মনে হয় ইরফানুল বারীর। আর ৭৫ এর পর উনি অনেক অসুস্থ ছিলেন। এই সুযোগ এ মোশতাক তার লেজেটিমিসির জন্য উনাকে ব্যবহার করেছে। আর জাতির জনক কে উনি কথটা পছন্দ করতেন সেই কথা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আছে। এছাড়া উনি মোশতাক ১ং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক থাকার পর ও তাকে ডিঙিয়ে মুজিবকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করেন সামশুল হক এর অনুপস্থিতিতে। আর আগরতলা মামলায় তার প্রিয় মুজিবরকে জেল থেকে বের করার হুংকার এবং তার ফলাফল তো জানাই আছে।

Farid Ahmed: এটা কোনো রেফারেন্স হলো? আসেন এর বিপরীতে আপনাকে রেফারেন্স দেখাই। কয়েকটা পত্রিকার কাটিং দেখাচ্ছি। কারো মুখের কথার চেয়ে পত্রিকা অনেক বিশ্বাসযোগ্য।

doc

Supik Anwar: মওলানা ভাসানীকে নিয়ে কয়েকটা কৌতুহল জাগানো প্রশ্ন পেলাম, এমনকি আমার লেখা শেয়ার করা কিছু মানুষও এই সব মন্তব্য পেয়েছেন দেখলাম। একটা প্রশ্ন হলো, ভাসানী ১৫ অগাস্টের হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করেছেন। মোশতাককে সমর্থন দিয়েছেন। জিজ্ঞেস করলাম, জেনেছেন কোথায়?

— তখনকার দৈনিক পত্রিকায়। বড় করে ছাপা হয়েছে তো।

— কিন্তু তখন যে চারটা মাত্র পত্রিকা আমাদের খবরের উৎস, সেগুলো তো এর আগেই বাকশাল সরকার সরকারী মুখপাত্র বানিয়ে বাকি সবগুলো পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলো। মাওলানার প্রতিষ্ঠিত হক কথাকে নিষিদ্ধ করেছিল ১৯৭২ সালেই। ফলে মোশতাকের আমলে যে তথ্য আমরা খবরের কাগজ সূত্রে পেলাম, সেগুলোর নির্ভরযোগ্যতা কী? কিংবা, এইভাবে গণমাধ্যম কবজা করার পরিণাম যে মানুষের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের সুযোগ এবং অভ্যাস দুটোই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল বাকশালের মাধ্যমে, চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে, আরো নানান সব নিপীড়নমূলক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে, এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হলো যে দিনে-দুপুরে রক্ষীবাহিনীর হাতে খুন হলেও সে খবর আর পত্রিকায় ছাপা হবে না, যে হাতিয়ারগুলো ব্যবহার করেই মোশতাকের মন্ত্রীসভায় লীগের নেতাদের স্বেচ্ছায় কিংবা বলপ্রয়োগে অংশ নেয়ানো হলো, তার নিন্দা কখনো করেছেন? ৯৫ বছরের বুড়ো ভাসানী ১৫ অগাস্টের বহু আগে থেকেই গৃহে অন্তরীণ ছিলেন। এই বয়োবৃদ্ধ মানুষটিকে কারা গৃহবন্দি করে রেখেছিল? তার নিন্দা করেছেন? সেই ঘরে আটকে থাকা, দুনিয়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারিতে আটকে রাখা অসুস্থ মানুষটাকে হাসপাতালে মোশতাক দেখতে গিয়েছিলেন, আওয়ামী নেতাদের মত তিনি বঙ্গভবনে গিয়ে মোশতাককে সমর্থন জানান নাই। এই ছবিটিই ফলাও করে পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, এবং পত্রিকাতে বাকি সব যা জানি সেটাও বাকশালের সংস্কৃতিতে কবজা করা পত্রিকার ভাষ্য, ভাসানী কি বলেছেন তা সেখানে কিভাবে মিলবে?

অভিযোগ করার আগে অভিযোগের প্রেক্ষাপটা তাই মনে রাখলে বোঝা যায়, অভিযোগকারীই ভয়াবহ একটা পরিস্থিতির সমর্থক, যেখানে কারও মতামত জানারও উপায় ছিল না, এমনই ভয়াবহ ছিল বাকশালি শাসন। তবুও ভাসানী কী মনে করতেন, সেটা জানতে ভাসানীর ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বাসযোগ্য মানুষদের কাছেই যেতে হবে। তাদের অনেকের কাছেই শুনেছি, নিজের সমর্থকদের ওপর এত নিপীড়নের পরও, আওয়ামী লীগের এত গণবিরোধী অবস্থানের পরও ভাসানী ১৫ অগাস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে দারুণ ব্যাথা পেয়েছিলেন। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক বিরোধিতা তিনি যতই করুন না কেন, তাকে পুত্রের মতই দেখতেন। প্রতিহিংসাপরায়ণ তিনি ছিলেন না, যদিও জনগণের বলপ্রয়োগে গভীর আস্থা পোষণ করতেন। সেই বলপ্রয়োগের স্মরণীয়তম দৃষ্টান্তটার কথাই বরং বলি।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাতেই হয়তো শেখ মুজিবুর রহমানের ফাঁসি হয়ে যেতো বঙ্গবন্ধু উপাধি পাবার আগেই; কেউ তাকে উদ্ধার করার সাহস কিংবা স্পর্ধা দেখায়নি, বন্দি ছিলেন তিনি ঢাকা সেনানিবাসে। '৬৯ এর প্রবল অভ্যূত্থানের ওপর দাঁড়িয়ে ভাসানী হুমকি দিয়েছিলেন পাক সামরিক জান্তাকে: মুজিবকে না মুক্তি দেয়া হলে জনতাকে নিয়ে তিনি ক্যানটনমেন্ট থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসবেন। আগুন ঝরানো মাওলানা তার নাম এমনি এমনি হয়নি।

এই হলো ভাসানী। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ৫০ বছর পূর্তিতে তার প্রাবল্যকে বুঝতে হলে খুচরো খুচরো প্রশ্ন করে কাজ হাসিল হবে না। অনেক বড় অকৃতজ্ঞতা এবং নিমকহারামি থেকেই ভাসানীকে নিয়ে এই জাতীয় মিথ্যা গুজব মোসাহেবরা ছড়িয়ে থাকে।

— (ফিরোজ আহমেদ)

Farid Ahmed: এটা পড়েন। আগুণ ঝরানো মওলানার আসল পরিচয় পাবেন। মুদ্রার অপর পিঠের মওলানা ভাসানী : জাফর ওয়াজেদ ↑। অলি আহাদের একটা বই আছে। বইটার নাম হচ্ছে, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-১৯৭৫। সেই বইতেও শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডে ভাসানীর সমর্থনের কথা বলা আছে। ভাসানী হাসপাতালে ভর্তি হন নভেম্বরের ২১ তারিখে। তিনি তারবার্তা পাঠান শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরের দিনই। তখন তিনি সন্তোষে। হাসপাতালে তিনি খন্দকার মোশতাককে কী বলেছেন, সেটা কোনো পত্রিকায় আসেনি। তিনি যে খুনি সরকারকে অভিনন্দিত করেছেন, তাদের সমর্থন জানিয়েছেন, এগুলো সব পত্রিকাতেই এসেছে। তাঁর নামে এগুলো বানানো খবর হলে তিনি অবশ্যই আপসেট হতেন এবং এগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। এদেরকে সহযোগিতা দিতেন না। বাস্তবে কিন্তু তা হয়নি। ফারাক্কা লং মার্চের সামনের সারিতে তিনি ছিলেন। কিন্তু, এর পিছনের পুরোটাই সায়েমের অবৈধ সরকার তথা জিয়াউর রহমান ছিলো।

doc

Supik Anwar: শুধুমাত্র পত্রিকার কয়েকটি লিখার উপর ভিত্তি করে উনাকে বারবার কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন তাতে কি সঠিক ইতিহাস প্রতিফলিত হচ্ছে!? যেই মানুষ সারা জীবন এই অঞ্চল এর মানুষকে নিয়ে মুক্তি সংগ্রাম করেছেন সেই আসাম থেকে বাংলা। কংগ্রেস থেকে বের হয়ে চিত্তরঞ্জন দল, তার পর মুসলিম লীগ এর সাথে পাকিস্তান আন্দোলন, জমিদার বিরোধী আন্দোলন , ভাষা সংগ্রাম, কৃষক আন্দোলন, লাইনপ্রথা, আওয়ামীলীগ সৃষ্টি, যুক্তফ্রন্ট, পাকিস্তানকে ওলাইকুম বলা, কাগমারী সন্মেলন, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতা, ১৯ দফা,৬৯ এর গন-আন্দোলন, ৭০ এর প্রলয়কারী তুফান, ইলেকশন এ আওয়ামীলীগকে সমর্থন, স্বাধীনতা সংগ্রাম,লং মার্চ সহ আরো মাটি ও মানুষের জন্য অনেক সংগ্রাম করা মানুষকে ইতিহাস এর ক্রনলজিকাল পাঠ না করে শুধুমাত্র কয়েকটি ঘটনার খণ্ডিত পাঠ ইতিহাসকে অবজ্ঞা করার মতই।

রেফারেন্স —
মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডের খবর শুনে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ঘটনার কয়েক দিন পর তিনি চিকিৎসার জন্য পিজি হাসপাতালে ভর্তি হন। এ সময়ে খোন্দকার মোশতাক আহমদ তার সরকারী স্টাফদের সাথে নিয়ে হুজুরের সংগে দেখা করেন। সেই বহরে সাবিহউদ্দীন আহমদও ছিলেন। তিনি তখন তার পি আর ও ছিলেন। আমি হুজুরের কেবিন কক্ষেই ছিলাম। এর একটু আগেই ফনি ভূষণ মজুমদার তার কেবিনে ফিরে গেছেন। তিনি দিনে একবার হলেও হুজুরের শরীরের খবর নিতে আসতেন। হুজুরের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও ভক্তি দেখে অবাক হয়েছি। কেবিনে ফিরে যাবার সময়ে তিনি আমাকে হুজুরের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলতেন। হুজুরের শরীর তখন খুবই খারাপ ছিলো। এখানে আসার আগে তিনি কুমুদিনী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। খোন্দকার মোশতাক কেবিনে ঢুকলে হুজুর তার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকান। বসতেও বলেননি। এক সময়ে তিনি বলেই ফেললেন "আমার মজিবরকে তোমরা মেরেই ফেললে!" তিনি ক্ষোভের সঙ্গে তাকে আরো বলেন "দুই আনার মুড়ি খেয়ে সারাদিন দলের কাজ করেছে আর তোমরা নেতা হইছো!" রাগ ও ক্ষোভের মাত্রা বাড়তে থাকলে এক সময়ে মোশতাক আমাকে একটু বাইরে যেতে,বলেন। আমি হুজুরের ঔষুধ দিয়ে বরান্দায় এসে দাঁড়াই। চলবে... [একুশে পদক প্রাপ্ত ছড়াকার আবু সালেহ্ এর টাইম লাইন হতে]

মোস্তাককে সমর্থন দেয়ার বরাত সরকারী প্রচার মাধ্যম। তখন দেশের পত্রিকার সংখ্যা ছিল ৪টি এবং ৪টিই সরকারী। এ অবস্থায় ১৫ আগস্টের পরপর যখন বিবৃতিটি প্রকাশিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে, তখন সরকারি মালিকানাধীন দৈনিকের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে স্বাভাবিক কারণেই। শুধু তা-ই নয়, মওলানা ভাসানীর কথিত বিবৃতিটি উদ্ধৃত করা হয় ‘বিশ্বস্ত সূত্রের’ বরাত দিয়ে। সততা ও সদিচ্ছা থাকলে বিশেষ দৈনিকটি থেকে সরাসরিই বিবৃতিটি উদ্ধৃত করা সম্ভব ছিল এবং ইতিহাস গবেষণার দৃষ্টিকোণ থেকে তেমনটি করা প্রয়োজনও ছিল। কিন্তু সহজবোধ্য কারণে দৈনিকটির নাম পর্যন্ত বলা হয় না বরং আশ্রয় নেয়া হয় ‘বিশ্বস্ত সূত্রের'।
[শাহ আহমদ রেজা]

Farid Ahmed: আপনি ঝোপে ঝাড়ে বাড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছেন। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরেও মওলানা ভাসানী রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, রাজনীতির মাঠে ছিলেন। কারণ, ফারাক্কা মিছিলের মতো বিশাল এক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তাঁর মতো সাহসী লোক নিশ্চয় ময়দানে প্রতিবাদ করেছেন, মিছিল মিটিং করেছেন। জাস্ট, কোনো একটা পত্রিকার একটু কাটিং দেখান আমাকে এ ব্যাপারে। আমি সবই পাঠ করেছি। এই লোক শেষবেলায় একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করাতো দূরের কথা, বরং সেটাকে সমর্থন করেছেন। এটাও ইতিহাস পাঠেরই অংশ।

Adil Mahmood: ভাসানী যে রকম ফ্লিপ ফ্লপ স্ববিরোধী আচরণ পাকিস্তান আমল থেকে করে গেছেন ওনার পক্ষে ব্যাক্তিগত পর্যায়ে মোশতাককে এই ধরনের কথা বলা এমন কিছু অসম্ভব না। এতে কোন সন্দেহ নাই যে রাষ্ট্রপ্রধান মুজিবের প্রতি তার গভীর বিরাগ থাকলেও ব্যাক্তি মুজিবকে উনি আজীবনই স্নেহ করে গেছেন। ব্যাক্তি মোশতাককে তোমরা এইটা কি করলা বলা এবং একই মোশতাকের সরকারকে অভিনন্দন জানানও অন্তত মাওলানার পক্ষে অসম্ভব কিছু না। সরকার ষড়যন্ত্র করে বিবৃতি ছাপিয়েছে এই ধরনের যুক্তিতে ৭৫ এর পর রাতারাতি ভোল পালটানো সবাই সাফাই গাইতে পারে এবং গায়। যারা মোশতাক মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়েছিল সে সব লীগ নেতা দাবী করেছে তাদের বন্দুকের মুখে নেওয়া হয়েছিল। ভাসানী ছিলেন পরিষ্কার বঙ্গবন্ধু সরকার বিরোধী সোচ্চার কণ্ঠ এবং লক্ষণীয়ভাবে দিনে দিনে কট্টর দক্ষিণপন্থীতে বিবর্তিত। বঙ্গবন্ধু সরকারের পতনের পর ডানপন্থী মোশতাকের প্রতি তার রাজনৈতিক সমর্থন এমন কি অবাস্তব যে সেটাকে নানান ষড়যন্ত্র তত্ত্ব অমূকে এই শুনেছে সেইই শুনেছে যার ভিত্তিতে সত্য হতে পারে না এইসব দাঁড়া করাতে হবে সেটাই বুঝি না। ভাসানীর পূর্ন ব্যবচ্ছেদ করলে বরং আরও অনেক বিতর্কিত কাজকারবার পাকিস্তান আমল থেকেই দেখা যায় যেগুলির কাছে এই মোশতাক অধ্যায় এমন কিছু না।

বঙ্গবন্ধুর আরেক সিনিয়র রাজনৈতিক কলিগ ৫৬ সালের প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান যার কেবিনেটে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী ছিলেন সেই আতাউর রহমান খান বঙ্গবন্ধুর পতনের পর ১৫ই আগস্ট নাজাত দিবস ঘোষণা করেছিলেন। মজার ব্যাপার হল এই আতা খান সাহেবই মোটে ৪ মাস আগে বঙ্গবন্ধুর নানান গুণগান গিয়ে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। আমার তো মনে হয় বঙ্গবন্ধু আমলেও ওনার নামে সরকারী পত্রিকায় মিথ্যা বিবৃতি দেওয়ানো হয় আর মোশতাক আমলে তো আমরা জানিই যে পত্রিকায় যার নামে যা ছাপা হয়েছিল সবই বানানো।

Swapan Mahmud: ভাষাণী-মুজিব গুরু শিষ্য দুজনই নির্বিশেষে মানুষ।দুজনেরই ভুল ছিল। এখন তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় না রেখে এ বিষয়গুলো মোকাবেলা করতে গেলে বঙ্গবন্ধু কেও আওতায় আনতে হবে। ভিয়েতনাম দিবসে মতিউল-কাদের হত্যা (স্বাধীন বাঙলাদেশে রাজপথে প্রথম হত্যা), কমরেড সিরাজ শিকদার কে পুলিশি হেফাজতে হত্যা (বাঙলাদেশে প্রথম বিচার বহির্ভূত হত্যা),দিন দুপুরে জাসদ অফিস জ্বালিয়ে দেয়া (১৯৭৩)।এই বিষয়গুলোও সামনে নিয়ে আসলে কী জামাত-শিবির বলা শুরু হবে।(বিতর্ক করার জন্য কমেন্ট করছি না এবং এ প্রসঙ্গে আর কোন কথা আমি বাড়াব না)

Farid Ahmed: মুজিবের ভুল নিয়ে তো আমরা কথা বলি। এগুলোর কোনোটাতেই তো তাঁকে ছাড় দেওয়া হয় না। একটা অপরাধকে খণ্ডন করতে যখন আরেকটাকে আনা হয়, তখন আসলে সেই অপরাধকে ঢাকার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। আপনি মুজিবকে বাদ দিয়ে পরিষ্কার করে শুধু ভাসানীর অপরাধকে অপরাধ বলতে পারছেন না কেনো? মুজিবের অপরাধের আলাপ যখন আলাপ করা হবে, তখন না হয় মুজিবকে ধোলাই দেওয়া যাবে। অন্যের অপরাধকে এনে তুলনা কখন করা হয়, সেটা আপনার না জানা থাকার কথা না। তাঁর সরকারের সবচেয়ে কট্টর সমালোচক হবার পরেও, মওলানার ক্ষেত্রে শেখ মুজিব যে উদারতা এবং ভালবাসা দেখিয়েছেন, প্রতিদানে মওলানা তাঁর ধারে কাছেও যেতে পারেন নাই। অথচ বয়োজ্যেষ্ঠ হিসাবে উল্টো ভূমিকাটা নেবার কথা ছিলো তাঁর।

Adil Mahmood: বঙ্গবন্ধু বা মুজিব সরকারের ভুলের কারনে ভাসানীর ভুল যদি ব্যাখ্যা করা যায় তাহলে অবশ্যই স্বাধীন বাংলাদেশে ভাসানীর মূল্যায়নে তৎকালীন সরকারের ভুলগুলিও আমলে আনা উচিত; এতে সমস্যা নাই। কিন্তু তাই বলে ভাসানীর ভুল ব্যালেন্স করার জন্য মুজিব সরকারের ভুলও পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের খাতিরে আনতে হবে তাহলে সেটা যৌক্তিক বিশ্লেষণ বলা যায় ন। এটা হয়ে যায় এখনকার প্রচলিত "অমুক ঘটনার সময় আপনি কোথায় ছিলেন" জাতীয় এগ্রিসেভ ডিফেস। এই ধরনের আক্রমণাত্মক ডিফেন্স সাজানো হয় নিজের পছন্দের দল বা ব্যাক্তির সমালোচনা আড়াল করার লক্ষ্য নিয়ে - আমি হয়ত খারাপ কিন্তু অপরপক্ষ তো আরো খারাপ। সে নিয়ে বল না কেন!

Iftakhar Ahmed Babu: আপনার এই পেপার কাটিং এর সত্যতা পাওয়া যায়নি ৷ সেরকম কোন বিবৃতি পাঠান হয়নি ৷

Farid Ahmed: পেপার কাটিং এর সত্যতা মানে কী বাবু ভাই? পত্রিকায় ছাপা হয়নি এই বিবৃতি, নাকি পত্রিকাওয়ালারা উনার নামে মিথ্যা বিবৃতি লিখেছে?

Iftakhar Ahmed Babu: বঙ্গভবন থেকে কেউ মিস কোট করেছিল ইচ্ছাকৃত ভাবেই l এটা নিয়ে অনেক অনুসন্ধান হয়েছে ৷ যে কোন তারবার্তা রেকর্ড রাখা হয় ৷ খোঁজা হয়েছে , কোন প্রমান পাওয়া যায় নাই ৷

Farid Ahmed: উনি কি এর পাল্টা বিবৃতি দিয়েছিলেন কোনো? অনুসন্ধানটা কাঁরা করেছিলো? সেটার রেফারেন্স কী?

Swapan Mahmud: তারপর দেখা যাচ্ছে খবরটা জানাচ্ছে বাসস।বাসস তো রাষ্ট্রীয় সংস্থা এরা প্রপাগান্ডাও ছড়াতে পারে।

Farid Ahmed: ভাসানী বামপন্থী ছিলেন বলে কি আপনাদের এই অবিশ্বাস? সেটা হলে লজিক্যাল কিছু হলো না। এর পাল্টা বিবৃতি কোথায়, মুজিব হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা করে ভাসানীর কর্মকাণ্ড কী? তিনি কি এর বিরুদ্ধে কখনো কিছু বলেছেন? এগুলো আনতে হবে আপনাদের সামনে। শুধু বাসস, বলেছে বলে অবিশ্বাস করে গেলে পক্ষপাতিত্ব হয়ে যাবে।

Swapan Mahmud: বামপন্থী ব'লে সাত খুন মাফ হ'য়ে যায়না।আমি শুধু একটা সম্ভাবনার কথা বলেছি।অপ্রাসঙ্গিক হ'লেও বলি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথম মিছিল ক'রে ছাত্র ইউনিয়ন।এই কিছুদিন আগে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলছিলেন উনি তখন এক আওয়ামীলীগ নেতার সাথে এ বিষয়ে আলাপ করতে হেলে ঐ নেতা বলেন "সেলিম এখনি মিছিল টিছিল করার দরকার নাই শেষে আওয়ামীলীগ সরকারকেই (মোশতাক ক্যাবিনেট) নিষিদ্ধ করে দেবে।"

Farid Ahmed: আওয়ামী লীগের নব্বইভাগ নেতাই স্বেচ্ছায় কিংবা ভয়ে মোশতাকের সাথে ছিলো। এগুলো প্রমাণিত। এই কাপুরুষদের ডিফেন্ড করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। সেলিম সাহেব যেটা বলেছেন, সেটা যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য।শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে দুজন লোকের করার সামর্থ্য ছিলো। এর একজন হচ্ছে জেনারেল ওসমানী এবং আরেকজন হচ্ছেন মওলানা ভাসানী। এই দুই ব্যক্তির গ্রহণযোগ্যতা ছিলো সারাদেশব্যাপী। দুঃখজনক হচ্ছে, তাঁরা দুজনেই এই কাজটা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

আমি একটা জিনিস দেখাচ্ছি এখানে আপনাদের। এটা সরাসরি কোনো প্রমাণ নয়। কিন্তু, ঘটনাটা তাৎপর্যপূর্ণ। অনেক না বলা জিনিস এখান থেকে বের করে আনা সম্ভব। ২১ তারিখ দুপুরবেলা সন্তোষ থেকে অসুস্থ ভাসানীকে নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। ভর্তি করা হয় পিজি হাসপাতালে। সন্ধ্যাবেলাতেই মোশতাক তাঁকে দেখতে হাসপাতালে যায়। পরের দিন এই খবরটা প্রতিটা সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় গুরুত্বের সাথে ছাপা হয়। ভাসানী যদি এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতেন, মোশতাকের মতো একটা লোকের তাঁর প্রতি এই সৌজন্যতা দেখানোর কথা নয় এবং পত্রিকাগুলোতে এটাকে এভাবে হাইলাইট করারও কথা নয়। আমি শুধু দৈনিক বাংলার খবরটা দিচ্ছি।

mostaq-vasani

রেকর্ডের স্বার্থে আরেক তালেবর পাপা টাইগারের চরিত্রটাও এই সুযোগে তুলে ধরি।

zia-osman

Swapan Mahmud: গোটা আওয়ামীলীগ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একটা প্রতিবাদ মিছিল করলো না।সুর সুর করে মোশতাকপন্থী হয়ে গেল। ওসমানী তো বাকশাল বিরোধীতা করে আওয়ামীলীগ ছেড়ে দিয়েছেন। ভাসানী ও আওয়ামীলীগ এ নেই। দায়ী হয়ে গেলেন তারা। আওয়ামীলীগ বরাবরই নপুংসক ও বিট্রেয়ারদের নেতৃত্ব পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেন ও ভারতে গিয়ে সাহায্য চান কাদের সিদ্দিকী, লতিফ সিদ্দিকী,সুলতান মনসুর। সুলতান ভাই'র কাছে সেই সব দিনগুলোর কথা অনেকবার শুনেছি। আজ তাদের তিনজনকেই আওয়ামীলীগ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তবে আমি জাতীয় চার নেতা, রাজ্জাক, তোফায়েল, সামাদ, আজাদ সহ যারা জেলে ছিলেন তাদের কথা বলছি না।তারা প্রকৃতই দেশপ্রেমী ও বঙ্গবন্ধুর কর্মী ছিলেন।বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথম মিছিল করতে হল বামপন্থি ছাত্র ইউনিয়ন কে। (আপনারা যাদের ঠাট্টা করে বলেন বামাতি) যে দল নিজের প্রতিষ্ঠাতাই শুধু নন জাতির পিতার ও হত্যার প্রতিবাদ করার হিম্মত রাখেনা তাদের কাছে দেশ মাতৃকার কোন মূল্য থাকতে পারেনা!

Farid Ahmed: আপনার এই পুরো বক্তব্যটাই অযৌক্তিক, অপ্রাসঙ্গিক এবং অপরিসীম খেদোক্তির বহিঃপ্রকাশ মাত্র । আমরা আওয়ামী লীগ নিয়ে আলোচনা করছি না, বা আওয়ামী লীগের সাথে কারো তুলনাও করছি না। এখানে স্পেসিফিক ইস্যু হচ্ছে খুনি সরকারে প্রতি ভাসানীর সমর্থন দেওয়া। আওয়ামী লীগের লোকেরা তো সমর্থন দিয়েছেই। মোশতাকও আওয়ামী লীগেরই লোক ছিলো। সেগুলো বললে কি ভাসানীর অপরাধ কমে যাবে? আপনি বলেন আপনি মুক্তমনের মানুষ, কিন্তু বামদের বিরুদ্ধে গেলেই আর আপনার মুক্তমনে কোনো কিছুই ঢোকে না। এটা খুবই দুঃখজনক। এতখানি ব্রেইন ওয়াশড হওয়া ঠিক না।

Swapan Mahmud: আমি বলেছি সব দায়ভার ভাসানীর হয়ে গেল!

Farid Ahmed: ভাসানীর সব দায়ভার এটাওতো কেউ বলে নাই, আমিও বলি নাই। তিনি খুনে সরকারকে সমর্থন দিয়েছেন, তাদের সাথে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। এতো বড় একজন রাজনীতিবিদ হয়ে, শেখ মুজিবের গুরুস্থানীয় হয়েও, শেখ এবং শেখ পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি কী করেছেন? মোশতাক তাঁর শয্যাপাশে গেলে কি একবারও বলেছেন, আমি খুনির সাথে হাত মেলাই না। বলেন নাই। এমন একটা নিম্নস্তরের লোককে ডিফেন্ড করেন কীভাবে আপনি, সেটাই তো আমি বুঝি না। নারী, শিশু হত্যা যাকে সামান্যতম বিচলিত করে না। আমি আওয়ামী লীগ করেছি, এই সব আকাম করা কোনো আওয়ামী লীগারকে সমালোচনা করতে আমি তো দ্বিধায় ভুগি না সামান্যতমও। সেটা করতে গিয়ে অমুক তমুক কী করেছে, কার দায় বেশি কম সেটা বিবেচনায় নেওয়া হবে না।