মুঘল রসনাবিলাস
মুঘলদের মধ্যে সম্রাট আকবর প্রথম হিন্দুস্তান পছন্দ করেছিলেন। পিতামহ বাবুরের মত তিনি ভারতের আদব লেহাজ কায়দা কানুন দেখে নাক সিটকে ছ্যা ছ্যা করেননি, হারানো মধ্য এশিয়ার ফেলে আসা ঘরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলার বদলে তিনি সুগঠিত মোঘল হিন্দুস্তান গড়ার দিকে মন দেন। এই করতে গিয়ে তিনি বাপদাদার পলিসি বদলে দিতে থাকেন। প্রচুর হিন্দু মন্ত্রীমিনিস্টার দরবারে আনা হল, বাবুর হুমায়ুনের আমলে যত ছিল তার প্রায় কয়েকগুণ। ধর্মীয় বৈষম্যমূলক জিজিয়া কর বাতিল করা হল, রাজস্থান হাতড়ে যে সব হিন্দু বউ তিনি ধরে এনেছিলেন তাদের হারেমে নিজস্ব কোয়ার্টারে দেবদেবী পূজা করার অনুমতি মিলল। মাঝে মাঝে তিনি তাদের সাথে দিওয়ালিও উদযাপন করতেন।
পিতামহ বাবুরের মত সম্রাট আকবর কেবল পারসিক কালচার আমদানী করতেই ব্যস্ত ছিলেন না, তা যেন হিন্দুস্তানী কেতার সাথে মিশে যায় সেদিকেও তিনি নজর দিলেন। তার দরবারে রামায়ন মহাভারত ফার্সিতে অনূদিত হল, আকবরকে রাতের খাবারের পর গীত গেয়ে শুনাতেন রাজস্থানী সুরের জাদুকর মিয়া তানসেন। আবুস সামাদ নামে এক পারসিক ছবি আঁকিয়েকে হুমায়ুন ভারতে এনেছিলেন, সম্রাট আকবর হুকুম দিলেন তিনি যেন একশর উপর ভারতীয় চিত্রকরকে পারস্যের ক্ষুদ্রকায় চিত্রাঙ্কন (মিনিয়েচার পেইন্টিং) এর কায়দা শিখিয়ে দেন।
একই ব্যাপার মোগল পাকঘরেও চলল। এইখানে সূক্ষ্ম রুচির পারসিক পুলাউ এর সাথে দেখা হল ঝাঁঝালো মশলাদার ভারতীয় ভাতের রেসিপি। দুয়ে মিলে তৈরী হল এক অভূতপূর্ব মাস্টারপিস, বিরিয়ানি। পারস্যের একটি অনন্য সাধারন টেকনিক ছিল দইয়ে মাংস জিরানো, বিরিয়ানিতে ঐ দইয়ে মিশিয়ে দেয়া হল পেঁয়াজ রসুন বাদাম আর মশলা। দীর্ঘসময় জিরানো শেষ হলে মাংস তেলে ভাজা হত, তারপরে অন্য ডেগচিতে চালান হত। তারপর পুলাউ এর কায়দা অনুসরন করে আধাসিদ্ধ চাউল ঐ মাংসের উপর ঢালা হত। জাফরানসিক্ত দুধ ঢালা হত তার উপর রঙ আনার জন্য, তারপর ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দীর্ঘসময় ধরে দমে রান্না চলতো। ঢাকনির উপর এবং ডেগচির চতুর্দিকে থাকতো তপ্ত কয়লা, ডেগের ভিতরে পুলাউ এর ভিতরেও কিছু।
আকবরের পাকশালার বাবুর্চিরা এক ঘন্টার নোটিশে একশর উপর অভ্যাগতর খাবার প্রস্তুত করতে সক্ষম ছিল। আকবর তার বাবুর্চি ব্যাটালিয়নে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব আর উত্তর ভারত থেকে রিক্রুট করতেন। যে যার মত দুর্দান্ত টেকনিক আমদানী করেছিল, তারা নিজেরাও একে অপরের কাছ থেকে শিখত। এভাবেই গড়ে উঠে কালজয়ী মোগলাই কুইজিন। আকবরের ঘনিষ্ঠ আবুল ফজল তার আইন-ই-আকবরি গ্রন্থে অন্যান্য অনেক কিছুর পাশাপাশি তৎকালীন রান্নার রেসিপিও রেখে গেছেন। সেখানে দেখা যায় মোগল বাবুর্চিরা যেসব উপাদানের উপর জোর দিত তার মধ্যে চাউল, ডাল, আটা/ময়দা আর চিনি উল্লেখযোগ্য।
কৃষিকাজের উন্নতির সাথে সাথে এসব উপাদান সহজলভ্য হয়ে আসে, আকবরের আমলে আবাদী জমির পরিমাণ বাড়ানো হয় আর সেচের পানির ব্যবস্থা উন্নত হয়। চিনির আবাদ বাড়ানো হয় আর কিছু কিছু স্থানে প্রথমবারের মতন বছরে দুইটি ফসল উৎপন্ন করা শুরু হয়। সপ্তদশ সতাব্দীর এক পর্যটক ভারতের বাজারে দোকানের পর দোকানে পটের উপর পট ডাঁই করা তেলের ভান্ড, চাল ডাল ময়দা আর অসংখ্য শস্যের ঝুড়ি দেখে তার বিস্ময়ের কথা লিখে গেছেন।
মোগলাই খাবারে আরেক গুরুত্বপূর্ণ পদ জাফরান আর হিং। এগুলি পারসিক উপাদান, মুঘল আমলে ভারতে এর চাষ শুরু হল। হিন্দু নিরামিষাশী জনগণ লুফে নিল হিং, হাল্কা তেলে হিং ভাজলে রসুনের মত ফ্লেভার বেরোয় যা পেঁয়াজ রসুন এড়িয়ে চলা হিন্দুদের ভারি পছন্দ হল। এইরকম হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে হিং খাওয়া ধরল, কিছু পর্যটক লিখে গেছেন যে ভারতবাসী এতই হিং খায় যে তাদের মুখে ভারি বদ গন্ধ!
অনেক রেসিপিতে বিপুল পরিমাণ কিসমিস আর বাদাম দরকার ছিল, যেমন জর্দা বিরিঞ্জ রেসিপিতে। মাংস আর শুকানো ফল ছিল পারস্যের খাবারে বহুল প্রচলিত, তাই টনকে টন এপ্রিকট, ডুমুর আর কাজুবাদাম ভারতে আমদানী হতে থাকল। এছাড়া উত্তর ভারতের হাঁস আর নানাবিধ সবুজ সব্জী যুক্ত হতে থাকল মোগলাই কুইজিনে।
আইন-ই-আকবরি অনুযায়ী জর্দা বিরিঞ্জের রেসিপিঃ
১০ সের চাউল, ৫ সের মিছরি, ৩.৫ সের ঘি; কিসমিস, কাজু আর পেস্তা বাদাম (আধ সের করে), একপো লবণ, আধপো আদা, জাফরান, দারচিনি। মোটামুটি চারজনের খাবার হবে এতে, কেউ কেউ এতে মাংসও দিয়ে থাকেন।
মাংসের পদগুলিতে প্রচুর কিমা ব্যবহৃত হত, কিমা ছিল পারসিক বাবুর্চিদের ভারি পছন্দ। মাংস কিমা করে রাখা গরম দেশগুলির জন্য খুব কাজের জিনিস, কারণ পশু জবে করার কিছুক্ষনের মধ্যেই তা রান্না না করলে মাংসের চাকাগুলি খুব শক্ত হয়ে যায়। মুসলমানরা প্রচুর পেঁয়াজ রসুন খেয়ে থাকে। আবুল ফজল দোপেঁয়াজা বলে একটা খাবারের রেসিপি দিয়ে গেছেন, দুইটি পেঁয়াজ ব্যবহৃত হয় তাই নাম দোপেঁয়াজা। একটা পেঁয়াজ কেটে ভাজা হয়, অন্যটি পিষে পেস্টের মতন করা হয়। মোগলাই দোপেঁয়াজায় গোলমরিচ, হলুদ, ধনেপাতা, এলাচ আর রসুনের কোয়া দেয়া হত, আর প্রচুর লবণ।
বিপুল পরিমাণ খাবার প্রতিদিন প্রস্তুত হলেও সম্রাট আকবর খেতেন অল্প। যৌবনে তার মত খাদক কমই ছিল, কিন্তু দ্রুত তিনি খাওয়া কমিয়ে আনেন। আবুল ফজল বলে গেছেন যে আকবর দিনে একবেলা খেতেন, যত বয়েস হচ্ছিলো তার খাবারের পরিমাণ যাচ্ছিল কমে। মাংসের প্রতিও তার কেমন বিতৃষ্ণা জাগে পরেরদিকে, তিনি এক পর্যায়ে নিরামিষাশীই হয়ে গেছিলেন বলা চলে। যুদ্ধযাত্রার আগে বাবুর হুমায়ুন মাঝে মধ্যে মদমাংস খেয়ে তাজা হয়ে নিতেন, যদিও মদ ইসলামে নিষিদ্ধ। আকবরের এগুলোর বালাই ছিলনা, তিনি সন্ন্যাসব্রতই নিয়েছিলেন বলা চলে।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
শুক্কুরবার শুক্কুরবার আকবর নানাবিধ মোল্লামৌলবির জমায়েত করতেন, আর ধর্মের বিবিধ দিক নিয়ে আলোচনা চলতো। প্রথমদিকে খালি মুসলিম পন্ডিত এলেও পরেরদিকে আকবর ওপেন ফর অল করে দেন, দাঁতে দাঁত চেপে অক্ষম আক্রোশে মোল্লারা দেখেন আকবরের দরবারে হিন্দু জৈন পার্সি এমনকি পর্তুগীজ পাদ্রীদের আগমন। নানারকম গুজব ছড়াতে থাকে, লোকে বলাবলি করে যে প্রতি রাতে আকবরের রুমের জানলা বেয়ে নাকি এক বামুনঠাকুর উঠে তাকে রামায়ন মহাভারতের গপ্পো শুনিয়ে ঘুম পাড়ায় আর তাকে বুঝায় হে সম্রাট গরু খাওয়া মহাপাপ কিন্তু! আকবর করলেন কি, বিশেষ ধর্মীয় দিনে সারাদেশে গরু জবেহ আর মাংস বিক্রয় নিষিদ্ধ করে দিলেন, আর দরবারের লোকেদের বললেন পেঁয়াজ রসুন বাদ দিয়ে খেতে।
সম্রাট আকবর কেমন যেন দেখতেও হিন্দুদের মতন হয়ে গেলেন, মুসলমানদের ঐতিহ্য অনুযায়ী ছোট চুল রাখার বদলে হিন্দু মহারাজদের মত লম্বা চুল রাখলেন, তিনি হিন্দু বামুনদের অনুমতি দিলেন তার কোমরে মোতি বসানো বিছা লাগিয়ে দিতে, আর তার দেখাদেখি অনেক সভাসদ হাতে রাখি পরা শুরু করল। পুত্র জাহাঙ্গীর আর নাতি শাজাহানও আকবরের এই প্রথাগুলো টিকিয়ে রাখেন, বিশেষত গরু জবে নিষিদ্ধের ব্যাপারটা। এছাড়া সপ্তাহের বিশেষ দিনে তারা মাংস ছুঁতেন না, আর যে জিনিসটা পরবর্তী সকল মুঘল সম্রাট মেনে চলতেন তা হল তারা কেউই গঙ্গার পবিত্র পানি ছাড়া পানি পান করতেন না।
মুঘলরাই পারস্য থেকে শরবৎ আমদানী করেছিল, ফলের রসের সাথে বরফ কুঁচি মিশিয়ে। কিন্তু তা খাওয়া হত খাবার ছাড়া অন্যান্য সময়, খাবারের সময় ছিল শুধু পানি। সম্রাট আকবর গঙ্গার পানিকে বলতেন অমৃত জল, আর তিনি গঙ্গা থেকে যত দূরেই থাকতেন তিনি ঐ পানিই খেতেন। জঁ ব্যাপ্তিস্ত তাভের্নিয়ে দেখেছিলেন উটের পর উটের সারি দরবারের জন্য গঙ্গার পানি নিয়ে যাচ্ছে। এমনকি আকবর যখন গঙ্গা নদী থেকে ২০০ মাইল দূরে পাঞ্জাবে ছিলেন, বড় পাত্রে পানি ভরে সেখানে চালান দিত রানারের দল। তাভের্নিয়ে অবশ্য তার গ্লাসের গঙ্গার পানি দেখে অমৃত জল বলেননি, বরং মদের সাথে মিশ্রিত ময়লা পানি দেখে তার মুখ বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চাকরনফরেরা যারা মদ ছাড়া খালি ঐ পানি খেত তাদের চেয়ে সভাসদদের অবস্থা ভালো ছিল।
মুঘল আমলে সকল অভিজাত ব্যক্তিই ছিলেন ভোজনবিলাসী, তারা সম্রাটকে নিত্যনতুন খাবার খাইয়ে চমকে দিতে চাওয়ার অভিলাষে দেশ বিদেশ ঢুঁড়ে ধরে আনতেন নানাবিধ পাকা রাঁধুনি। আসফ খাঁ যখন শাজাহানকে দাওয়াত দিয়ে আনেন তখন তিনি ইয়োরোপীয় কুইজনের ব্যবস্থা করেন, কেকপেস্ট্রি তৈয়ার করে কিছু পর্তুগীজ দাস।
আসফ খাঁ সাহেবের মোগলাই ব্যাঙ্কুয়েটের বর্ণনা দিয়ে গেছেন ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের ভারতীয় দূত টমাস রো এর পাদ্রী এডওয়ার্ড টেরি। রো কে পাঠানো হয়েছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মুঘলই ফরমান বের করে আনার জন্য, ওলন্দাজ আর পর্তুগিজ কোম্পানীর ভারতে ব্যবসা করে লাল হয়ে যাবার ঘটনায় ইংরেজ তখন হিংসায় জ্বলেপুড়ে ছারখার।
খাবার পরিবেশিত হল দস্তরখান পেতে, তা ঘিরে তিনজন করে বসল। অতিথি হিসেবে রোকে দশটি অতিরিক্ত পদ দেয়া হল, আর সবচেয়ে কম মর্যাদার লোক টেরি পেলেন দশটা পদ কম। যাইহোক, পঞ্চাশটা বাটি পাতা হল, প্রতিটি বাটি থেকেই অল্প চাখলেন টেরি। নানান রঙের ভাত, বিশেষত গোলাপী আর সবুজ ভাত তার মন কেড়ে নিল। তিনি লিখে গেছেন যে ভাত রান্নায় ভারতীয় বাবুর্চিরা ইংরেজ পাচকের চেয়ে অনেক ভালো, তাদের ভাত ঠিক ঠিক সিদ্ধ হয়। বেশিও না কমও না। এছাড়া তারা অল্প আদা গোলমরিচ আর মাখন দেয় ভাতে।
মুঘলদের মাংস রান্নার কেতা টেরির ভারি পছন্দ হল, তিনি লক্ষ্য করলেন যে আস্ত মাংসের চাক সিদ্ধ, বেক বা রোস্ট করার পরিবর্তে ছোট ছোট টুকরায় কেটে পেঁয়াজ আর অন্যান্য মশলায় ভেজে তারপর স্টু করা হচ্ছে, যা খাবারের স্বাদই বদলে দিচ্ছে। এইটেই প্রথম ইয়োরোপীয়দের কারির বর্ণনার অন্যতম, কিন্তু দুঃখের বিষয় তিনি বিভিন্ন কারির বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে যাননি। তিনি খাবারের বর্ণনা শেষ করলেন এই বলে যে খানাদানা চলছিল অতি দীর্ঘসময়, আর ততক্ষণ পা মুড়ে বসে থাকতে থাকতে উনার দফারফা।
আকবরের বংশধর জাহাঙ্গীর আর শাজাহানের আমলেমুঘল সাম্রাজ্য তুঙ্গে ওঠে, শাজাহানের সম্পদ ছিল ১৬৪৭ সালের হিসেবে দুইশ বিশ মিলিয়ন রূপী। তার মধ্যে তিনি তিরিশ মিলিয়ন খরচ করতেন নিজের জন্য। চিত্রকলা, কাব্য, স্থাপত্য (বিশেষত বউয়ের কবরের উপর স্থাপিত তাজমহল) ইত্যাদিতে প্রচুর পয়সা ঢালা হল। মুঘল পাকশালাতেও খরচ করা হয় অঢেল অর্থ।
জাহাঙ্গীরের ইরানী বউ নূরজাহান দুর্দান্ত কিছু রেসিপি প্রস্তুত করেন, আর জাহাঙ্গীর নিজে গুজরাতি খিচুড়ি আমদানী করেন কিচেনে। গুজরাতের কোন এক এলাকা পাড়ি দেবার সময় তিনি যে খিচুড়ি খান ঐটা খেয়ে তিনি ঘোষণা দেন যে এই অতি চমৎকার টেকনিক তার পাকশালায় নিয়ে যাওয়া হোক আর সপ্তাহের নিরামিষ দিনগুলোয় তাকে খিচুড়ি খাওয়ানো হোক। নগদে পাকড়ে নিয়ে যাওয়া হল ঐ গুজরাতি কুককে। পরে আরো বিভিন্ন রেসিপির খিচুড়ির চল হয় মুঘল প্রাসাদে, শাজাহানের আমলে সেবাস্টিয়ান মানরিককে প্রচন্ড জমকালো মশলাদার খিচুড়ি খেতে দেয়া হয়, ঐ খিচুড়ি নাকি পালাপার্বণে বাঙালিরা ভোজে খেত। ঐ খিচুড়িতে ছিল কাজুবাদাম, কিসমিস, রসুন, জয়ত্রী, জায়ফল, এলাচ, দারচিনি আর গোলমরিচ।
মুঘলরা যখন যুদ্ধে যেত তখন তাদের সাথে সাথেই ঘুরত পোর্টেবল কিচেন। বলা হয়ে থাকে যে, মুঘল বাদশা পরদিন সকাল দশটায় যুদ্ধযাত্রা করবেন এরকম প্ল্যান হলে আগের দিন রাত দশটা থেকেই পাকশালা ব্যস্ত হয়ে যেত, যেন সময়মত পরদিন সকালের প্রাতরাশের ব্যবস্থা হয়। পঞ্চাশ উটের পিঠে চড়ে দুইশ কুলি সহযোগে খাবার চালান হত, কুলিদের মাথায় থাকত নানাবিধ থালা বাটি চামচ খুন্তির ঝাঁকা। পঞ্চাশটি উত্তম গরু দুইয়ে ফ্রেশ দুধের ব্যবস্থা করা হত যেন প্রয়োজনীয় দুধ ক্রীম দই মাখন পাওয়া যায়। মুঘলদের একটি প্রিয় জায়গা ছিল কাশ্মীর, বিশেষত গরমের সময়ে। এই কাশ্মীরেই স্থানীয় কায়দার সাথে মিলে একটি খাবার নিখুঁত হয়ে উঠলো, খাবারটির নাম রোগান জোশ।
রোগান জোশের উৎপত্তি পারস্যে, ফার্সিতে রোগান মানে মাখন আর জোশ মানে তপ্ত। মাখনে মাংস রান্না হয় দেখে এরূপ নামকরণ। কাশ্মীরে স্থানীয় উপকরণ দিয়ে এই খাবার প্রস্তুত হল। কাশ্মিরী ব্রাহ্মণেরা মাংস রাঁধে ঠিকই কিন্তু পেঁয়াজ রসুন বাদে, তারা বরং তাদের ভার্সনে ব্যবহার করল মৌরি আর হিং। এছাড়া কাশ্মিরের মুসলমান পাচকেরা দিল পেঁয়াজ রসুন আর স্থানীয় মোরগচূড়া গাছের শুকিয়ে যাওয়া ফুল। এই ফুলের রঙ টকটকে লাল, তাই রোগান জোশের রঙ দাঁড়ালো লালচে। কেউ কেউ বলে থাকেন একারণেই খাবারটির নাম রোগান জোশ, কাশ্মিরি ভাষায় রোগান অর্থ লাল।
বাবুরের ভারত নিয়ে অন্যতম খেদ ছিল যে এইখানকার ফলগুলি একবারে বাজে। জীবনের শেষদিকে তিনি আঙুর আর তরমুজের চাষ করিয়েছিলেন, সেই মিষ্টি তরমুজ খেয়ে হোমসিক বাবুরের চোখে পানি চলে আসে। সম্রাট আকবর বিরাট ফলের বাগান করেন, তা ছিল পারস্য আর মধ্য এশিয়ার নানান ফলে পরিপূর্ণ। জাহাঙ্গীর সমরকন্দ আর কাবুলের আপেলের প্রশংসা নিয়ে দিস্তে দিস্তে পাতা লিখে গেছেন, আরো লিখেছেন এক বসায় সর্বোচ্চ কয়টা চেরি খাওয়া যায় অথবা তাদের পারসিক তরমুজ খেয়ে আহমেদাবাদের শেখেদের চোখ কেমন ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল। শেখেদের গুজরাতি তরমুজ ছিল সাইজে ছোট, মিষ্টিও কম।
ফলফ্রুট নিয়ে মুঘলরা ভারি অস্থির ছিল, টমাস রো অবাক হয়ে গিয়েছিলেন দেখে যে এরা ফলের পিছনে কত টাকা খরচ করে। এ ব্যাপারে তার বিরক্তিও ছিল, আসফ খাঁ যখন উপহার হিসেবে বিশটি তরমুজের ঝুড়ি পাঠান তখন রো বিরক্ত হয়ে লিখে যান, “এদের খালি খাই খাই। এখন পর্যন্ত আমি যা পেলাম তার সবই হয় খাওয়া যায় নাইলে পান করতে হয়।” ফল এতটাই উচ্চ মর্যাদার ছিল যে তা উপঢৌকন হিসেবে ব্যবহৃত হত। বলখের রাজা যখন শাজাহানের পুত্র আওরঙ্গজেবের কাছে বার্তা পাঠান তখন সাথে গিয়েছিল ১০০ উট বোঝাই ফল আর বাদাম। (সাথে আরো এসেছিল সপ্তদশ শতাব্দীর ভায়াগ্রা, বাক্সবন্দী একরকম বিস্বাদ দুর্গন্ধী মাছ যা নাকি কামোত্তেজনা বাড়িয়ে দিত)।
জাহাঙ্গীর শাজাহান জীবনেও মধ্য এশিয়া যাননি, তাই তাদের হৃদয় হিন্দুস্তানেই পড়ে ছিল, তাদের প্রিয় ফল ছিল আম। আম সম্পর্কে বাবর বলে গেছে ঐটে হিন্দুস্তানের সেরা ফল বটে তবে তেমন আহামরি কিছু না। ৮০ বছর পরে জাহাঙ্গীর ঘোষণা করেন আমের কাছাকাছি একটা কাবুলি ফলও আসতে পারেনা। স্বাদ অথবা মিষ্টতা কোন দিক দিয়েই। একবার শাজাহান তার পুত্রকে কড়া চিঠি দেন কারণ ছেলে নাকি দাক্ষিণাত্যের অত্যুত্তম মিষ্টি আম তাকে না পাঠিয়ে নিজেই সব খেয়ে ফেলছে!
শাজাহানের চোখ ধাঁধানো স্থাপত্য, ময়ূর সিংহাসন, আলো ঝলমলে পাকশালার দুর্দান্ত রান্নাবান্না সবই এসেছিল ভারতের গরীব চাষার পয়সায়, যারা যত দিন যাচ্ছিল ততই আরো গরীব হয়ে পড়ছিল। ১৬৩০ সালে ভারতজুড়ে নেমে আসে খরার করালগ্রাস, ইয়োরোপীয় পর্যটকেরা লিখে গেছেন কিভাবে ভারতীয়রা গোবরগাদায় খাদ্যকণা নিয়ে মারামারি করতো। গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যায়, রাস্তার পাশে জমা হয় লাশের স্তুপ। পরে লঙ্গরখানা খোলা হয় আর চাষীদের কাছ থেকে খাজনা আদায় স্থগিত করা হয়।
শাজাহান ছিলেন একটি অপদার্থ শাসক। ভারতে শাসন পোক্ত করার বদলে তিনি অযথা মধ্য এশিয়ায় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। তার কাঠমোল্লা পুত্র আওরঙ্গজেব মুঘল দরবারে ইসলামের আধিপত্য পুনর্বহাল করেন। দিল্লীতে মদ প্রস্তুত নিষিদ্ধ করা হয়, কাউকে মদ বিক্রি করতে দেখলে সে হিন্দুই হোক বা মুসলমান ঘ্যাচাং করে তার একটা হাত বা পা নামিয়ে দেয়া হত। সঙ্গীত নিষিদ্ধ করা হয় দরবার থেকে। এই এত কিছুর মধ্যেও যা টিকে ছিল তা হল পূর্বপুরুষের খাবারের প্রতি ভালোবাসা। তিনি দৈনিক হাজার রূপী খরচা করতেন খাবারের পিছনে, আর চলতো নূতন পাচকের খোঁজ। যখন তার পুত্র সুলেমান নামক বিরিয়ানি বাবুর্চিকে পাঠাতে অস্বীকার করে, তিনি অস্থির হয়ে তাগাদা দেন যেন সুলেমানের কায়দাকানুন জানা কোন শিষ্যকে অন্তত পাঠানো হয়।
১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরে মুঘলদের ক্ষমতা কমে আসে, ভারতের বিভিন্ন স্থানে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে স্থানীয় রাজারা। মুঘলদের খাবারের ঐতিহ্যটাও আস্তে আস্তে তাদের হাতেই চলে যায়।
মুঘলদের নানান কাহিনী নিয়ে আরও পড়ুনঃ "ভারতবর্ষের ইতিহাস" - পর্ব-১ এবং পর্ব-২