মুঘল রসনাবিলাস
বসন্তকাল, ১৬৪১। দুই পর্তুগীজ পাদ্রীকে নিয়ে যাওয়া হয় লাহোরের এক চমকদার প্রাসাদের গ্র্যান্ড রিসেপশন রুমের লাগোয়া ব্যালকনিতে। প্রাসাদের মালিক মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম কুতুব আসফ খাঁ, আরজুমান্দ বানু বেগম ওরফে মুমতাজ মহলের পিতা।
ঐ সন্ধ্যায় আসফ খাঁ আর তার বউ মহান বাদশা শাজাহানকে চাট্টি ভাত খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছিলেন। লুকিয়ে ব্যালকনি থেকে দুই পাদ্রী এই ব্যাপক খানাদানার আয়োজন দেখতে থাকেন হাঁ করে। ঝলমল করছে সিল্কি রূপালি সোনালি জরির কাজ করা কার্পেট, চতুর্দিকে মৌমৌ করছে সুগন্ধী আতরের বাস। রুমের ঠিক কেন্দ্রে মিহি মসলিনের কাজ করা টেবলক্লথ আর তার চারধারে নানবিধ কুশন। সোনামোতির হার গলায় ঝুলিয়ে রুমে ঢুকলেন মহান মুঘল সম্রাট, আগেপিছে দাসীবান্দি সহকারে। কুশনে আরাম করে বসে সকলে হাত ধুয়ে নিলেন অত্যাধিক কচি ও ততোধিক সুন্দরী দাসীদের এগিয়ে দেওয়া পানিপাত্রে।
শুরু হল খাবারের পাত্রের আগমন, একের পর এক। খাবার আনছিল ঝলমলে রঙদার সিল্কের পাজামা আর অতিস্বচ্ছ মসলিনের কুর্তা পরিহিত খোজার দল। তারা হাঁটু গেড়ে বসে থাকা কচি সুন্দরীদের হাতে সোনার বাটি চালান করছিল যেন মেয়েগুলি সম্রাটের পাত্রে ঢেলে দিতে পারে। মোঘলদের এইরকম টেবিলম্যানার দেখে দুই পাদ্রী ভারি মাথা চুল্কাতে লাগলো। হিসাব মিলে নাই।
খানাদানা চলে ঘন্টা চারেক। এরপরে খাবার সব চলে যাবার পরে নাচনেওয়ালি মেয়েরা নাচতে নাচতে ঘরে প্রবেশ করে, পার্টির সকলেই ভারি আমোদিত হয়ে উপভোগ করেন। তবে শাজাহান বাদশার আসল উৎসাহ ছিল তার সামনে রাখা তিন ঝাঁকা গয়নাতে। মহান সম্রাট যখন এইসব পাথরমোতি যাচাই করতে ব্যস্ত তখন খোজারা এসে পাদ্রীদের বলে- গেম ওভার, বিদেয় হও। পাদ্রীদ্বয় বিদায় নিলেন।
উপরের কাহিনী আমাদের যে পাদ্রী বলে গেছেন তার নাম ফ্রায়ার সেবাস্টিয়ান মানরিক। তার এরকম অভিজাত মুসলমানের অন্দরে ঢুকে সার্কাস দেখার কাহিনী রীতিমত অবিশ্বাস্য। প্রত্যেক প্রাসাদের অন্দর উঁচু দেয়ালে ঘেরা থাকত, তাতে পাহারাও ছিল দিনরাত। মুসলিম মেয়েরা ছিল কড়া পর্দার ঘেরাটোপে বন্দী, শুধুমাত্র পরিবারের লোক আর চাকরনফরের অনুমতি ছিল তাদের দেখার। এইরকম ভিন্নধর্মী লোকের কাছে প্রাসাদের অন্দর উন্মুক্ত করে দেবার গল্প তাই কষ্টকল্পনাই ঠেকে।
মানরিক সম্ভবত বিভিন্ন শোনা গল্প জোড়া দিয়ে উপরের কিচ্ছা বানিয়েছেন। সপ্তদশ শতাব্দীর অনেক পর্যটকেরই অভ্যাস ছিল নানান গল্পের মধ্যে নিজেকে চালান করে দেওয়া। তবে আসফ খাঁ এর সাথে মানরিকের দোস্তি ছিল ঠিকই।
মানরিক ভারতে এসেছিলেন সেই রোম হতে। পথে লাহোরে স্টপ নেওয়ার কারণ পলিটিকাল, এক পাদ্রী শাজাহান বাদশার বন্দী হয়ে ছিল প্রায় ন’বছর। আসফ খাঁ বাদশার অতি পিয়ারের লোক, তাকে ধরেটরে যদি কিছু হয়। মানরিক ঝানু কূটনীতিক বলতে হবে, কিভাবে কিভাবে তিনি পাদ্রীর রিলিজের ব্যবস্থা তো করেনই উপরন্তু আসফ খাঁকে তিনি এতোই প্রভাবিত করেন যে খাঁ সাহেব হুকুম দেন মানরিক যেকোন সময় বিনা বাঁধায় তার দরবারে হাজির হতে পারবে। এ বড় সহজ হুকুম নয়।
শাজাহান ছিলেন পঞ্চম মুঘল বাদশা, পয়লা নম্বর ছিলেন বাবর। বাবর অর্থ বাঘ। এই বাদশা ছিলেন অষ্টম হেনরির সমসাময়িক। আজকে যেখানে উজবেকিস্তান সেখানে মধ্যযুগে ছিল ফরগনা রাজ্য, বাবর ছিলেন এই ফরগনার রাজকুমার। ১৫ বছর বয়েসে তিনি সমরকন্দ জয় করেন, কিন্তু এই রূপসী নগর তার হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় উজবেকরা। ভগ্নমনোরথ বাবর চোখ ফিরান আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের দিকে, তারপর হিন্দুস্তানের দিকে তার নজর পড়ে।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
বাবরই প্রথম হিন্দুস্তান আক্রমণ করেননি, সেই ১৩৯৮ সালেই তার পূর্বপুরুষ তৈমুর লং দিল্লী ছ্যাড়াবেড়া করে গিয়েছিলেন। এছাড়া সেই দ্বাদশ শতাব্দী থেকেই নানাবিধ সুলতানের হাতে ভারতের বিভিন্ন অংশ শাসিত হয়। তুরস্ক, ইরান আর আফগানিস্তানের নানান লোক ভারতে ঘাঁটি গাড়ে আর নিজেদের অতি উচ্চবংশ হিসেবে পরিচয় দেয়। তারা যে এলাকায় রাজত্ব করত সেখানকার দরিদ্র লোকেরা বিশেষত অচ্ছুৎ লোকেরা কলমা পড়ে কনভার্টেড হয়ে যায় অনেকাংশে।
বাবর বাদশা হিন্দুস্তান বিজয়ে তেমন উৎফুল্ল ছিলেন না। “হিন্দুস্তানের কোন আকর্ষন নেই”, তিনি লিখে গেছেন, “শহর গ্রাম দুটাই ভারি বিশ্রী। আমাদের সাথে তুলনা করলে এ এক পুরাই আলাদা বিশ্ব, সিন্ধু নদী পেরোলেই মাঠঘাট গাছ ফুল পাত্থর মানুষ আদব লেহাজ সবই জানি ক্যামন ক্যামন। লোকগুলি মোটামুটি ল্যাংটোই ঘুরে বেড়ায়, কোমরের কাছে কি একটা ময়লা ন্যাকড়া জড়ানো। মানুষগুলি দেখতে ভারি কুচ্ছিত, সমাজে কোন আভিজাত্য-ফাত্য নেই।” তবে হিন্দুস্তানের একটা ভাল দিক হল “দেশটা বিরাট আর সোনামাণিকও প্রচুর”।
বাবরের একটা বিরাট অভিযোগ ছিল যে হিন্দুস্তানের খাবার একেবারে যা-তা। “একটাও ভালো খাবার নাই, মাংস আঙুর তরমুজ খরমুজ কিসসু না। কোন বরফ নাই, ঠান্ডা পানি নাই, বাজারে রুটি নাই।” বাবরের দেশে লোকজন মহা আয়োজন করে খেত, বাগদাদ হতে প্রকাশিত অনেক পুরাতন একটি মুসলিম রান্নার বইতে লিখা আছে খাওয়া হল ছয়টি আনন্দের মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বমহান (অন্য পাঁচ আনন্দ হল পান, কাপড়, রতি, আতর আর বাদ্যবাজনা)।
সমরখন্দে হেরে যাবার পর নানান পাহাড়পর্বতে থাকতে থাকতে বাবরের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল তিনবেলা যাযাবর ঘোড়সওয়ারদের মতন মাংস খাওয়ার। এই মাংস রান্না হত অতি সহজে ক্যাম্পফায়ারে বসে ঝলসে। ১৯২০ সালে এক ইংরেজ সিভিল সার্ভেন্টকে স্থানীয় আফ্রিদীর দল মাংস রেঁধে খাওয়ায় যার রেসিপি সেই বাবরের সময়কার। তাকে দেওয়া হয় কাঠিগাঁথা এক টুকরা ভাজা ভেড়ার মাংস। হাত দিয়ে খুলে খুলে খেতে হয় সেই মাংস। আর্মিনিয়াস ভাম্বেরি নামের এক হাঙ্গেরিয়ান প্রফেসর ১৮৬০ সালে লিখে গেছেন সেই মাংস ভাজার রেসিপিঃ
কয় চামচ চর্বি গলানো হয় (সাধারনত ভেড়ার লেজের চর্বি) একটা পাত্রে, আর গলামাত্র তাতে ঢালা হয় ছোট টুকরা মাংস। অল্প ভাজা হয়ে এলে পরে, তিন আঙুল পরিমান পানি ঢালা হয় আর ধীরে বলক ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়। মাংস নরম হয়ে আসলে পরে গোলমরিচ আর ফালি করে কাটা গাজর যোগ করা হয়, আর সবার উপরে একস্তর চাউল। আরেকটু পানি যুক্ত করা হয়, আর চাউল ফুটে ভাত হওয়া মাত্র আগুনের ধাক কমিয়ে আনা হয়। ঢাকনা দিয়ে ঢেকে পাত্রটি রেখে দেয়া হয় গরম কয়লার উপর, ভাপে আরো সিদ্ধ হয় মাংস, ভাত আর গাজর। আধঘন্টা পরে খাবার পরিবেশিত হয় স্তরে স্তরে। সবার তলে চর্বিতে মাখামাখি ভাত, তার উপর গাজর আর সবার উপরে মাংস।
ভাম্বেরি বলে গেছেন এই রান্না অতি উপাদেয়, তবে তাসখন্দে ডিনারে একই খাবার খেয়ে জনৈক মার্কিন ডিপ্লোম্যাট বলেছেন যে খাবার “অত্যন্ত তৈলাক্ত এবং বিস্বাদ”।
চোখ ফিরাই ভারতের হিন্দু কুইজিনের দিকে। একটি চমৎকার দরকারী হিন্দু খানার রেসিপি রেখে গেছেন দ্বাদশ শতাব্দীর রাজা তৃতীয় সোমেশ্বর। তিনি পশ্চিম চালুক্য সাম্রাজ্যের রাজা ছিলেন বর্তমান মহারাষ্ট্র আর কর্নাটক অঞ্চলে। তিনি যুদ্ধটুদ্ধের বদলে চিত্রকলা বা সাহিত্যেই আগ্রহী ছিলেন শোনা যায়। রাজ্যের বিবিধ কর্নার যখন বেহাত হয়ে যাচ্ছিল তখন তিনি যুদ্ধে যোগ দেবার বদলে বই লিখা শুরু করেন। বইয়ের নাম “মানোসোল্লাস”। বইতে একজন রাজার দৈনন্দিন ব্যাপারস্যাপার অর্থাৎ শিকার, রমণ, হিরেমোতি, ডুলিপাল্কি, রাজকীয় ছাতা আর খাবারের বর্ণনা ভরা। সোমেশ্বর লিখে গেছেন যে রাজার প্রয়োজন স্বাস্থ্যকর আর পুষ্টিকর খাবার খাওয়া। যেমন ঝাল দৈ এ ডুবিয়ে ডালের বড়া, এলাচ দিয়ে ভাজা শুকরের গোস্ত, অথবা ঝলসানো লেজ। সোমেশ্বরের অন্যান্য কিছু প্রিয় খাবারের মধ্যে ছিল কচ্ছপ ভাজা (খেতে নাকি ভাজাকলার মতন) আর ঝলসানো ধেড়ে ইঁদুর। পাঁচ শতক পরেও এই খাবারের অভ্যাস হিন্দু রাজাগণের ছিল, দক্ষিণের বিখ্যাত বিজয়নগরের বাজারে ভেড়া, শুকর বা গরুর গোস্তের পাশাপাশি পাওয়া যেত চড়াই পাখি, ইঁদুর, বিড়াল আর টিকটিকি গিরগিটির মাংস।
সোমেশ্বর বর্ণিত ঝলসানো ধেড়ে ইঁদুরের রেসিপিঃ
কালো ধেড়ে ইঁদুর, যেগুলো মাঠে আর নদীর ঘাটে ধরা হত তার নাম ছিল মাইগ্যা। এগুলির গায়ের রোম ছাড়িয়ে গরম পানিতে ধুয়ে ঝলসানো হত লেজশুদ্ধা। তবে তার আগে পেট কেটে ভেতরের প্রত্যঙ্গাদি বের করে আনা হত, ওগুলি পৃথকভাবে কাঁচা আম আর লবণ সহযোগে রাঁধা হত। লোহার শিকে ঝলসানো হত কয়লার আগুনে, যতক্ষন না তা বাদামী রঙ ধারণ করত। ভালোমত ভাজা হয়ে গেলে পরে তার উপর লবণ, জিরা দিয়ে খাওয়া হত।
তবে মাংসভক্ষণের এই কালচার ধীরে ধীরে হটে যায় ভারত থেকে- বৌদ্ধ আর জৈনধর্ম প্রসারের সাথে সাথে। সম্রাট অশোক, যিনি ভারতের সুবৃহৎ এলাকা শাসন করেন খ্রীস্টজন্মের ২৬৮ হতে ২৩১ বছর আগ পর্যন্ত, ছিলেন নিরামিষাশী। বৌদ্ধ অনুসারী অশোকের কালে তার অনুসারীরাও নিরামিষাশী হয়ে পড়ে। অশোকের কিচেনে বড় করে খোদিত ছিল “এইখানে জীব জানোয়ার হত্যা করা হয় না”।
বাবুর হিন্দুস্তানে আসতে আসতে ভারত অনেকাংশে নিরামিষভোজী হয়ে গেছে। প্রধান ভারতীয় বর্ণ ব্রাহ্মণেরা শুধু নিরামিষ খেত। তারা মাংস খাওয়া ব্যান করে দেয় কারণ জানোয়ার খেলে জানোয়ারের গুণাবলী প্রকাশ পায়। কট্টর ব্রাহ্মণেরা মাংস তো নয়ই এমনকি পেঁয়াজ রসুন পর্যন্ত ছুঁতেন না।
তবে সবক্ষেত্রে তা খাটত না। ইতালীয় পর্যটক পিয়েত্রো দেলা ভাল্লে দেখে গেছেন রাজপুতেরা, যারা কিনা অতি উচ্চ ক্ষত্রীয় বংশ, দেদারসে মাংস খেত। শিকার ছিল রাজপুতদের অন্যতম টাইমপাস। রাজস্থানী কুইজিনে আজো শিকার করা মাংসের রেসিপি পাওয়া যায়, যেমন ভাজা পেঁয়াজ, ধনেপাতা, হলুদ, রসুন আর আদা দিয়ে কষিয়ে বন্যশুকর খোলা আগুনে ঝলসানো।
তবে বেশিরভাগ ভারতীয় নিরামিশ খেত, হয় ধর্মীয় কারনে অথবা পয়সার অভাবে। জঁ ব্যাপ্তিস্ত তাভের্নিয়ে বলে এক ফরাসী জহরতওয়ালা লিখে গেছেন যে মুসলিম গ্রামে খুঁজে হয়তোবা ভেড়া, মুরগী কি পায়রা কিনতে পাওয়া যায়, কিন্তু হিন্দুপ্রধান গ্রামগুলোয় একদম ফকফকা। পিয়েত্রো দেলা ভাল্লে গজগজ করে গেছেন যে মাছমাংস কিসুই পাওয়া যায়না ভারতে, খালি ভাত আর দুধ মাখন খেয়ে থাকতে হয়।
ষোড়শ আর সপ্তদশ সতাব্দীতে হিন্দুস্তানের অধিকাংশ লোকে খিচুড়ি বলে একটা সাধারন খাবার খেত। চাউল আর ডাল নিয়ে অল্প পানিতে ঘুটা দিয়ে তৈয়ার হত সেই খিচুড়ি, জায়গাভেদে রেসিপির কিছু এদিক সেদিক হত কারণ সব জায়গায় উৎপন্ন চাউল এক ছিল না। তাভের্নিয়ে লক্ষ্য করেছিলেন যে ভারতীয় সিপাইরা খিচুড়িতে অল্প ঘি মাখিয়ে নিত, কেউ কেউ আচার বা মাছও খেত তার সাথে। দূর্দান্ত বড়লোকের দল তাদের পয়সা দেখানোর জন্য খিচুড়িতে দিত কষে মশলা। তাভের্নিয়ে আওরঙ্গাবাদে রাজপুত্রদের জন্য রাঁধা খিচুড়ির কথায় বলেছেন, “এদের ভাত আর সব্জীতে এমন কড়া মসলা যে আমি মুখেই তুলতে পারিনি, রাজভোগ রেখে ক্ষুধার্ত পেটেই আমাকে ফিরতে হল”।
ভেনিশিয়ান নিকোলাই মানুচ্চি বলে গেছেন যে গরুর গোস্ত খাওয়া ছিল এক বিরাট পাপের ব্যাপার। আয়ুর্বেদিক বইপত্রে গরুর গোস্তকে “ভারি, গরম, তৈলাক্ত আর মিষ্ট” বলে অভিহিত করা আছে। এটি হজম করতে সময় লাগে বলে সাবধানবাণীও রয়েছে। পিছনে ফিরে আমরা যদি প্রথম শতাব্দীতে তাকাই, দেখি যে ভারতীয়রা ছিল নিয়মিত গরুখোর। মহাভারতে এমনকি বলা আছে ব্রাহ্মণেরা ভারি মজা করে গরুর তরকারি খাচ্ছেন, যদিও সেখানে আরো বর্ণনা আছে একটি গরুর যে কিনা তার আত্মীয়স্বজনদের ভয়ানকভাবে কেটে কুটে খেয়ে ফেলার জন্য অভিযোগ করছে।
বাবর যে হিন্দুস্তান জয় করেন সেখানে গরু ছিল মহাপবিত্র প্রাণী। মানুচ্চি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেন যে এরা যে শুধু গোস্ত খাওয়া নিষিদ্ধ করেছে তাই নয় এরা গরুর বিবিধ প্রডাক্ট যেমন দুধ, মাখন, গোবর আর চনা মিশিয়ে শরবৎ বানিয়ে খাচ্ছে সকল রোগশোকপাপতাপ থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে। তিনি বিতৃষ্ণা নিয়ে দেখেন যে ভারতীয়রা দুই হাতে চনা ঢেলে খাচ্ছে আর সর্বাঙ্গে গোবর ঢেলে নিজেকে পবিত্র ঘোষণা করছে।
তাই মুঘলদের গরুখাসী খাওয়ার বাসনার সাথে সাধারন ভারতীয় খাবারের লাগল ধাক্কা। মুসলমানদের কাছে খাবার দারুন পবিত্র ব্যাপার, তাদের কুরানে বেহেস্তের খাবারদাবারের বিস্তর বর্ণনা। আর ভারতীয়দের কাছে খাবার আমোদের কিছু ছিলনা, পেট ভরলেই হল এই তাদের মনোভাব। ভালো ভালো খাবার দেবতাদের উদ্দেশ্যেই দেওয়া হত, বাকিরা খেত প্রসাদ। ঘরের কর্তাকেই মাছের মুড়োটি প্রদান করা হত, গিন্নীর পালা সবার শেষে।
যাহোক মোগলাই কিচেনে এইসব হিন্দুস্তানী মধ্য এশিয়ান আর ইরানী খাবার মিলেমিশে হল একাকার। ফলাফল মোগলাই খাবার, পরে বিদেশীদের কাছে যার সাথে ভারতীয় খাবারের কোন প্রভেদ রইল না। ভারতীয় খাবারের সাথে মুঘল স্টার্টটা বাজে হলেও পরে ঠিক হয়ে গেছে। যদিও বাবর বাদশা বাজারের খানাখাদ্যে তুমুল বিরক্ত ছিলেন, তিনি ঠিক করলেন চারটে হিন্দুস্তানী বাবুর্চি রাখা হবে। এদের কান পাকড়ে নিয়ে আসা হয়েছিল পরাজিত সুলতান ইব্রাহীম লোদির কিচেন থেকে। এই সিদ্ধান্তে পরে মহা পস্তান বাবর। তার জীবনীতে তিনি লিখে গেছেন তিনি এক শুক্কুরবার সন্ধ্যায় খরগোশের স্টু আর জাফরানী কেতায় রাঁধা মাংস তেলেভাজা চাপাতি দিয়ে খেয়ে ভক করে বমি করে দিয়েছিলেন। খাবার বিষাক্ত, এই সন্দেহে তিনি একটা কুকুরকে সেই বমি খাওয়ান। কুকুরটিও বমি খেয়ে বমি করে দেয়।
পরে ধরা পড়ে যে পরাজিত সুলতানের মাতার ঘুষ খেয়ে চারটে বাবুর্চির একজন মাংসে বিষ মিশিয়ে দেয়। এই বজ্জাতিতে যুক্ত ছিল আরেকটি লোক, সম্রাটের নিজস্ব টেস্টার যে কিনা খাবারে বিষ পরীক্ষা করত। টেস্টারকে কেটে পঁয়ত্রিশ পিস করা হয়, আর বাবুর্চিকে জীবন্ত অবস্থায় তার গায়ের চামড়া ছিলে ফেলা হয়।
এরপরে বাবর আর হিন্দুস্তানি বাবুর্চি রেখেছিলেন কিনা জানা যায়না। তবে আমরা জানি বাবরপুত্র হুমায়ুনের হিন্দুস্তানি কুক ছিল। পারস্যের সম্রাটকে তিনি ভারতীয় ডিশ খাইয়েছিলেন, তা সম্ভবত ছিল খিচুড়ির মোগলাই সংস্করণ। বাংলার আফগান শাসক শের শা এর লাথি খেয়ে হুমায়ুন পারস্যে পালিয়েছিলেন। ১৫ বছর পরে তিনি আবার হিন্দুস্তান ফিরে পান, তখন তিনি বগলে ভরে নিয়ে আসেন কয়টা পারসীক বাবুর্চি। সাথে এল পারসীক কুইজিন, পাঁচ শতাব্দী আগে বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফার আমলে যার জন্ম। এরা খাবারদাবারে অকল্পনীয় পয়সা খরচ করতো, খলিফা আল মনসুর তো খেতে খেতেই অক্কা পেয়েছিলেন। তুরস্ক, আরব, মিশর সব জায়গা থেকে বাবুর্চিরা বাগদাদে জড়ো হত, সাথে নিয়ে যেত তাদের নিজস্ব রান্নার স্টাইল।
পারসীক রান্নার কুতুবমিনার ছিল পুলাউ। সেই যে যাযাবর ঘোড়াওয়ালার দল মাংসের সাথে ভাত পাকাতো তারই রাজকীয় সংস্করন এই পুলাউ। পারস্যে বার্লি আর গম ছিল কমন, চাউল আমদানী হত ভারত থেকে। তাই ইম্পোর্টেড চালের পুলাউ ছিলো ব্যাপক আভিজাত্যের বিষয়। চালের কোয়ালিটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত আগ্রার উত্তর এলাকার চাল ছিল তাদের ফেভারিট। সেই চালের ভাত হত ঝরঝরে, লেগে ধরত না। তার বাসও ছিল চমৎকার, সারা ঘর ভরে যেত সুগন্ধে।
বাবুর্চিরা নানান রেসিপি তৈয়ার করেছিল, ফলের পুলাউ, হলুদ-জাফরান পুলাউ, মুর্গী পুলাউ (বিশেষ অনুষ্ঠানে পাকানোর জন্য) ইত্যাদি। রেসিপিভেদে যুক্ত হত পেঁয়াজ রসুন, কিসমিস কাজুবাদাম ইত্যাদি। পারসীকরা লবণ জলে ঘন্টার পর ঘন্টা চাল ভিজিয়ে রাখতো যেন রান্না হলে পরে চকচকে সাদা দেখায়। এই কড়া সাদা কালার দরকার ছিল অন্যান্য গাঢ় রঙের বিবিধ তরকারির সাথে কন্ট্রাস্ট আনার জন্য। পারস্যের এই পুলাউ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তুরষ্কে একে ডাকা হত পিলাফ। স্পেনে গিয়ে এই পুলাউ সামুদ্রিক মাছ আর জাফরান মিলে হল পায়েইয়া, আর ইটালিতে মাখন মিলিয়ে পুলাউ হল রিজোট্টো।
আর ভারতে, পারস্য আর মধ্য এশিয়ার কুইজিনের সাথে হিন্দুস্তানী কায়দা মিলে পুলাউ আরেক অভাবনীয় নূতন চেহারা নিল মুঘল পাকশালায়।
আরও পড়ুনঃ ফ্রাসোঁয়া পিরার্দের ডাইরী