১৮৩২ সালের কথা। পৃথিবী তখনো আজকের মত দ্রুত আর স্মার্ট হয়ে ওঠেনি। যোগাযোগের মাধ্যম বলতে কেবলই চিঠি। পিতার কাছে টাকা চাহিয়া পত্র লিখিতো পুত্র, প্রমোশনের সংবাদ জানাইয়া স্ত্রীর কাছে পত্র লিখিত স্বামী। সেই চিঠি ট্রেনে করিয়া পোঁছাইতো এক স্টেট হইতে আরেক স্টেটে। ঘোড়ার ডাকের যুগ পেরিয়ে পৃথিবী তখন পৌঁছেছে পনি এক্সপ্রেসের যুগে। তাও সেই চিঠি কখনো পৌঁছাইতো, কখনো না।
সেবছর হেমন্তে এক চিত্রশিল্পী প্যারিসের লুভর মিউজিয়াম ঘুরে দেশে ফেরত যাচ্ছেন। লুভরের শিল্পকর্ম তাকে যারপরনাই মুগ্ধ করেছে। নিজের এই মুগ্ধতার কথা তিনি জানাতে চান নতুন পৃথিবীকে। এই নতুন পৃথিবীর নাম আমেরিকা। শুধু চিত্রকর্ম নয়, ইলেকট্রিসিটি নিয়েও তার থলিতে দারুণ কিছু সংবাদ আছে। এ্যাম্পিয়ার, ওম, ফ্যারাডে, গাউস বাঘা বাঘা সব বিজ্ঞানীরা ইলেক্ট্রিসিটি নামক এক অত্যাশ্চর্য শক্তি নিয়ে দারুণ দারুণ সব পরীক্ষা করে চলেছেন। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার খবরও তিনি আমেরিকায় পৌঁছে দেবেন।
ট্রেনে এক যাত্রীর সাথে ইলিকট্রিসিটি নিয়ে তার আলাপ হচ্ছিল। যাত্রীটি তাকে বলেঃ ইলেকট্রিসিটি এক সময় মাইলের পর মাইল পাড়ি দেবে। ঠিক আলোর গতিতে। চিত্রশিল্পীটি তখন বলেনঃ “If this be so, I see no reason why intelligence might not be instantaneously transmitted by electricity to any distance.” এই চিত্রশিল্পীর নাম স্যামুয়েল মোর্স । হ্যাঁ, টেলিগ্রাফের জনক স্যামুয়েল মোর্স। এই মোর্সের হাত ধরেই আমরা প্রবেশ করবো ইলেকট্রিক্যাল কম্যুনিকেশন-এর যুগে।
মোর্সের ব্যাকগ্রাউণ্ডটা একটু বলা দরকার। মোর্স ছিলেন অভিজাত পরিবারের সন্তান। ক্ষমতার কাছাকাছি তাদের অবস্থান। জীবনের শুরুটা তাই আরাম আয়েশেই কেটেছে তার। ধনী আমেরিকানদের পোর্ট্রেট এঁকে দিতেন তিনি। নিউইয়র্কের ব্রডওয়েতে তার একটা গ্যালারিও ছিল। জেনারেল লাফায়েত নামক এক ভদ্রলোকের পোর্ট্রেট আঁকার জন্য বেশ মোটা অঙ্কের টাকা পান তিনি। স্ত্রীকে এই খুশির সংবাদ জানিয়ে পত্র লেখেন। অথচ তার স্ত্রী মারা গেছে দুই বছর আগেই। এই ঘটনা তাঁর মনে গভীর দাগ কাটে। যোগাযোগের দ্রুত ও সহজলভ্য মাধ্যমের চিন্তা তাঁর মস্তিষ্কে পাকাপোক্তভাবে আসন গেড়ে বসে। ইয়েলে থাকাকালীন তিনি ইলেকট্রিসিটির উপর বেশ কিছু লেকচার এ্যাটেণ্ড করেছিলেন। এক ছুটিতে বেশ কিছু ইলেকট্রিক্যাল এক্সপেরিমেন্টেও সাহায্য করার অভিজ্ঞতা আছে তার। লুভর থেকে ফিরে এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আঁটঘাঁট বেঁধে মাঠে নামলেন তিনি।
তার আইডিয়াটা ছিল এরকম – একটা তারের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করলে তার চারপাশে একটা চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি হয়। একে বলা হয় তড়িচ্চুম্বক। এই তড়িচ্চুম্বকটির একটি পেন্সিলকে এমনভাবে ধাক্কা দিবে যেন সেটা নিচে কাগজের উপর একটা চিহ্ন এঁকে দিবে। আস্তে ধাক্কা দিলে ডট(.), জোরে ধাক্কা দিলে ড্যাশ(-)। ধাক্কা জোরে না আস্তে সেটা নির্ভর করবে তড়িৎ প্রবাহের তীব্রতার উপর। নিউইয়র্ক ফিরে এসে তিনি অবশ্য অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি তখন মাত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি এই ভার্সিটির আর্টসের প্রফেসর হিসেবে জয়েন করেন। বছর তিনেক পর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণকাজ যখন শেষ হয়, তখন তিনি সম্পূর্ণ মনোযোগ দেন তাঁর সম্ভাব্য আইডিয়া বাস্তবায়নে।
একটা বড় ক্লাসরুম ছিল মোর্সের। নাওয়া-খাওয়া, ঘুম সব এইখানেই করতেন তিনি। রুমটাকে একটা ছোটখাট স্টুডিও বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। এক পাশে পড়াতেন, এক পাশে ছবি আঁকতেন আর এক পাশে করতেন এক্সপেরিমেন্ট। এইখানেই তৈরি হয় বিশ্বের প্রথম টেলিগ্রাফ। এই টেলিগ্রাফের ডিজাইনটি ছিল এমন যে তা দিয়ে দিয়ে শূন্য থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যা রিপ্রেজেন্ট করা যেত। ‘Father sick, come sharp’ জাতীয় কোন বাক্য গঠন করার ক্ষমতা এর ছিল না।
মোর্স তার বিজ্ঞানী বন্ধুদের এই ডিজাইন দেখালেন। তারা নানারকম পরামর্শ দিলেন। কেউ বললেন, এককোষী ব্যাটারি বদলে বহুকোষী ব্যাটারী ব্যবহার করতে। কেউ বললেন, বেশি করে তার প্যাঁচাতে। মোর্স সম্ভবত জানতেন না যে, একটা কয়েলের মধ্য দিয়ে যত বেশি তার প্যাঁচানো যায়, আবিষ্ট ভোল্টেজের পরিমাণও তত বেড়ে যায়। এর মধ্যে তিনি একজন ইনভেস্টরও পেয়ে গেলেন। আলফ্রেড ভেইল নামক এই ভদ্রলোক মোর্স কোডকে সংখ্যার বেড়াজাল ভেঙে অক্ষরের জগতে নিয়ে এলেন।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
ইংরেজি ভাষায় ২৬টা বর্ণ আছে। প্রতিটা বর্ণের জন্য দরকার আলাদা আলাদা কোড। এখন এই কোডিং আপনি দুরকমে করতে পারেন। একটা উপায় হচ্ছে এমন যে প্রতিটা বর্ণের জন্য আপনি তিন বা চার সিম্বলের একটা সুনির্দিষ্ট প্যাটার্ণ ঠিক করে দিলেন। এই ধরেন, তিনটে ডট দিয়ে আপনি A বোঝালেন, B বোঝালেন দুটো ডট আর একটা ড্যাশ দিয়ে, C বোঝালেন একটা ডট, একটা ড্যাশ আবার একটা ডট দিয়ে এইভাবে চলতে থাকবে।
এইটা আমি মনগড়া উদাহরণ ব্যবহার করলাম। সত্যিকার মোর্স কোড দেখতে পাবেন নিচের ছবিটিতে
আরেক রকমের কোডিং আছে যা নির্ভর করে একটা ভাষায় কোন বর্ণের ব্যবহার কতো ব্যাপক তার উপর। যার ব্যবহার বেশি, তার জন্য এ্যাসাইন করবেন ছোট, সহজ কোন সিম্বল। যার ব্যবহার কম, তার জন্য বরাদ্দ থাকবে লম্বা, বিদঘুটে কোন সিম্বল। ইংরেজিতে যেমন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় “E” বর্ণটি।
মোর্স কোড খেয়াল করে দেখেন, E এর জন্য বরাদ্দ আছে মাত্র একটি ডট। সবচেয়ে সহজ কোডটি। তারপর T। T এর জন্য বরাদ্দ আছে একটা মাত্র ড্যাশ। আরেকটা সহজ কোড। সবচেয়ে কম ব্যবহৃত হয় Q আর Z। এদের জন্য রাখা আছে ডট-ড্যাশ মিলিয়ে চার সিম্বলের বড় বড় কোডগুলো। ভেইল যখন এই প্রোগ্রামটি ডিজাইন করেন, তখন তিনি এই লেটার ফ্রিকোয়েন্সি’র ব্যাপারটা মাথায় রেখেই তা করেছিলান। ডিজাইন সম্পন্ন হলে পৃথিবী মুখোমুখি হয় প্রথম তারবার্তারঃ ‘‘A patient waiter is no loser.’’ মোর্সের বরাৎ ভালো। টেলিগ্রাফ মেশিনের সাথে সাথে কোডটাও লোকমুখে তার নামেই প্রচলিত হয়ে গেল। ভেইলের স্থান হল ইতিহাসের ফুটনোটে। মাল্টিপ্লেক্সিং-এর ধারণাটিও এই সময়ে ডেভেলপ করে। এই মাল্টিপ্লেক্স কিন্তু সেই মাল্টিপ্লেক্স না! বসুন্ধরা সিটি’র সাথে একে মেলালে ভুল হবে। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলি।
ধরুন, একই সময়ে দু’জন ইউজার ডাটা পাঠাতে চাচ্ছেন। প্রত্যেক ইউজারের জন্য একটিকরা তার বরাদ্দ করা আছে। তার দুটি সমান্তরালে সিগনাল ক্যারি করে চলেছে। প্রথম তারে লাল-সবুজ-লাল-সবুজ এইভাবে সিগনাল যাচ্ছে। অন্যটায় নীল-হলুদ-নীল-হলুদ এইভাবে। এখন কোন একটা পয়েন্টে তার দুটো মিলে একটা তার হয়ে গেল। এখন সেই তারে সিগনাল পাওয়া যাবে এরকমঃ লাল-নীল-সবুজ-হলুদ-লাল-নীল-সবুজ-হলুদ। অর্থাৎ, সে পর্যায়ক্রমে দুটো তার থেকেই সিগনাল বয়ে নিয়ে চলেছে। এই ব্যাপারটাকে বলা হয় টাইম ডিভিশন মাল্টিপ্লেক্সিং। কারণ, প্রতিটা তারের সিগনালের জন্য ঐ কমন তারে আলাদা আলাদা টাইম স্লট বরাদ্দ করা থাকে। এতে করে লাভের লাভ হচ্ছে এই যে, আগে যে কাজ করতে দুটো তার লাগতো, সেই একই কাজ এখন একটা তার দিয়ে করা যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটা খুব লাভজনক মনে হচ্ছে না। কিন্তু ২০০ কিলোমিটার লম্বা ট্রান্সমিশন লাইনের কথা চিন্তা করে দেখুন। একটা তার দিয়ে করা ভাল না দুটো?
মোর্সের আশিতম জন্মদিনে দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে টেলিগ্রাফ অফিসে কর্মরত লোকজন এসে মোর্সকে শুভেচ্ছা জানায়। সেন্ট্রাল পার্কে এক জম্পেশ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তারা। টেলিগ্রাফের জনককে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে সেদিন কেউ কোন কার্পণ্য করেনি। এর এক বছর পরেই তার মৃত্যু হয়। মোর্সের মৃত্যুর পর থেকেই টেলিগ্রাফের বিজনেসও পড়ে যেতে থাকে। আস্তে আস্তে রেডিও, টেলিফোন এসে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে টেলিগ্রাফকে বাতিলের দলে ফেলে দেয়। মোর্স কোড তবু বহুদিন রাজত্ব করে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর করা যে কোন মুভিতেই দেখবেন খবর পাঠানোর জন্য এই কোড ব্যবহার করা হচ্ছে। ১৯৯৯ সালে এর সর্বশেষ ব্যবহার হয়। আজ বিজ্ঞান জাদুঘর ছাড়া কোথাও এর কোন অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না।
এই টেলিগ্রাফ কিন্তু একটা গোটা ইনডাস্ট্রির জন্ম দিয়েছিল। রেলওয়ে, সংবাদপত্র থেকে শুরু করে মিলিটারি পর্যন্ত যোগাযোগের জন্য এর উপর নির্ভরশীল ছিল বহুদিন। টেলিগ্রাফে যেভাবে মেসেজটি আসতো, তা ডিকোড করার জন্য একটি নতুন পেশারই জন্ম হয়। এইকাজটি যারা করতো, তাদের বলা হত মোর্স টেলিগ্রাফার। সেকালের টেলিকম ইঞ্জিনিয়ার বলতে পারেন এদের। তারাও হয়তো আজকের টেলিকম ইঞ্জিনিয়ারদের মত মনে মনে বলতো, I am a telegraph engineer, I have no life.
ভালো স্যালারির সাথে সাথে সমাজে তাদের একটা বিশেষ স্থান ছিল। ঝানু অপারেটররা তো মিনিটে পঁয়তাল্লিশটা পর্যন্ত শব্দ ডিকোড করতে পারতেন। ভাবা যায়! টেলিগ্রাফ অফিসে চাকরি করে মিলিয়নিয়ার হয়েছেন, এমন লোকের সংখ্যাও নেহায়েৎ কম নয়। এ্যান্ড্রু কার্নেগির মত বড় শিল্পপতি থেকে শুরু করে থমাস আলভা এডিসন পর্যন্ত অনেকেই তরুণ বয়সে টেলিগ্রাফ অফিসে কাজ করেছেন। টেলিগ্রাফ নিজের অজান্তে অন্য একটা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে। এর ফলে প্রথমবারের মত মহিলাদের ঘরের বাইরে কর্মসংস্থান তৈরি হয়। মার্কিন নারীরা তাই মোর্সকে একটা ধন্যবাদ দিতেই পারেন।
যেতে যেতে বলি, ট্রেনে বসে করা মোর্সের সেই নোটগুলো এখনো ওয়াশিংটনের লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসে সংরক্ষণ করা আছে। কেউ চাইলে দেখে আসতে পারেন।
লেখকের অন্যান্য লেখাঃ আশফাক আহমেদ