শনির উপগ্রহ ‘টাইটান’
শনির সবচে বড় উপগ্রহ টাইটানের আলাদা একটা বিশেষত্ব আছে। এটিকে বলা যেতে পারে সৌরজগতের সবচে দামী উপগ্রহ। কারণ টাইটান আগাগোড়া ভর্তি মূল্যবান খনিজ তেল আর প্রাকৃতিক গ্যাসে, যেই তেলের জন্য এখন পৃথিবীতে চলছে মানুষে মানুষে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ! টাইটানে আছে হাইড্রোকার্বন। যেমন- তরল মিথেন ও ইথেনের বড় বড় লেক আর নদনদী। সাগর থাকাও অসম্ভব নয়। এসব জলাশয় ওরফে তৈলাশয় থেকে যে পরিমাণ তেল পাওয়া সম্ভব তা পৃথিবীর মোট সঞ্চিত খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় একশো গুণ!
শুধু তাই নয়। লেক লিজিয়া ও লেক ক্রাকেন নামের দুটি লেকে যে পরিমাণ তরল মিথেন আছে সে পরিমাণ তেল সারা মধ্যপ্রাচ্যেও নেই। এখন ট্রাম্প-থেরেসারা কাইন্ডলি ইরাক ছেড়ে টাইটানে দৃষ্টি দিলে হয়!
ভিড ফ্লুমিনা নামে তরল মিথেনের একটি নদীও আছে যার আকার আমাদের যমুনা নদীর দশগুণের কম নয়! কিন্তু কথা হলো এতো তরল হাইড্রোকার্বন টাইটানে এলো কোথা থেকে? সূর্য থেকে অনেক দূরে হওয়ায় টাইটানের তাপমাত্রা অনেক কম, মাত্র -১৭৯.৫ ডিগ্রি। এত কম তাপমাত্রায় সব পানি সেখানে জমাট বেঁধে গেছে, আর মিথেন/ইথেনের গ্যাসগুলো পরিণত হয়েছে তরলে। প্রতি ষোলো দিনে একবার শনিকে পাক দিয়ে আসা টাইটান সাইজে বুধের চেয়েও বড়। আমাদের চাঁদও তার কাছে পিচ্চি! আগ্নেয়গিরি আছে, তবে সেগুলো থেকে লাভার বদলে বেরোয় মিথেন। এরা ক্রায়োভলকানো। অর্থাৎ ভলকানোর ছোটোভাই।
বায়ুমন্ডল আছে, তবে সেটায় প্রায় ৯৭ ভাগ নাইট্রোজেন, বাকিটুকু হাইড্রোকার্বনের গ্যাস। মাটির নিচে যে তরলের খনি আছে, ধারণা করা হয় সেটাও জলের বদলে তরল মিথেন। টাইটানকে চারিদিক থেকে ঘিরে রেখেছে কমলা রঙের কুয়াশা। এবং যথারীতি সেটাও মিথেনের। এমনকি বিজ্ঞানীরা দাবী করেছেন সে উপগ্রহে যদি কোনো জীব থেকেও থাকে তবে সে অক্সিজেনের বদলে হাইড্রোজেন গ্রহণ করবে, আর কার্বন ডাই অক্সাইডের বদলে ত্যাগ করবে- মিথেন!! পুরো টাইটানই তেলে তেলে তৈলাক্ত।
রিপ্লি থেকে’র অন্যান্য কিছু লেখা –
তবে এমনটা দেখে যদি ভাবা হয় আমেরিকা ইউরোপের মত তেলখেকো দেশগুলো চাইলেই সেখান থেকে তেল নিয়ে আসতে পারবে তবে সেটা ভুল। মাইনাস দেড়শো ডিগ্রীরও কম তাপমাত্রায় নভোচারীদের শরীরের রক্ত তো রক্ত, হাড়মাংস পর্যন্ত জমাট বেঁধে যাবে। তারপর আবার অক্সিজেনের প্রাপ্যতা ১% এরও কম। এর বাইরে প্রচন্ড বিষাক্ত ও রেডিয়েটিভ আবহাওয়া তো আছেই!
তবে সান্ত্বনার ব্যাপার হলো, নাসার পাঠানো ‘ক্যাসিনি’ নামক প্রোব (Cassini-Huygens Mission) টাইটানে জীবের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা আছে বলে জানিয়েছে! যদি তা-ই হয়, এবং জীবগুলো যদি মানুষের মতো স্বার্থপর না হয়, তবে তাদের কাছে তেল কেনার একটা অনুরোধ তো করা যেতেই পারে! তাতে অন্তত পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত তেলের জন্য এতো যে হানাহানি, মারামারি যুদ্ধবিগ্রহ চলছে- তা একটু হলেও কমবে!
মন্দ কি!
বৃহস্পতির চোখ!
বৃহস্পতির চোখ ওরফে দি গ্রেট রেড স্পটকে বলা হয় সৌরজগতের সবচে বড় ঝড়। তিনশো বছর ধরে বয়ে চলা এই প্রলয়ঙ্করী টর্ণেডো যুগে যুগে অবাক করে এসেছে তাবৎ জ্যোতির্বিদদের। ১৮৩০ এ আবিষ্কৃত হলেও বলা হয় এই চোখের জন্ম আরো আগে!
১৬৬৪ তে রবার্ট হুক সন্ধান পান এই চোখের। যদিও দুটি একই বস্তু কিনা তা নিয়ে তর্ক আজও আছে। তাছাড়া দোনেতোর ছবি, জিওভান্নির বর্ণনা সবখানেই ছিলো এই চোখের কথা। তবে পরে এস্ট্রোনমি নিয়ে পড়াশোনা থেমে যাওয়ায় মানুষ সাময়িকভাবে ভুলে যায় এটির কথা।
১৮৩০ এ আবার নতুনভাবে মানুষ আবিষ্কার করে বৃহস্পতির চোখকে। সেই থেকে আজও বয়ে চলছে এই ঝড়। প্রায় দুইশো বছরের পুরনো টর্ণেডো! কেউ কি কল্পনা করতে পারে?? কিন্তু আসল কথা হলো বৃহস্পতির চোখ জিনিসটা কি? আবার এটিকে ঝড়ই বা বলা হচ্ছে কেনো?
ঝড় বলার কারণ হলো এই গঠনটি বাস্তবেই এক বিশাল টর্ণেডো। বৃহস্পতি হলো গ্যাসের দৈত্য। তার সারাশরীর জুড়ে তাপমাত্রার চরম ওঠানামা হয় সারাক্ষণ, আর এ কারণেই জন্ম নিয়েছেন মিস্টার রেড স্পট, ওরফে বিখ্যাত বৃহস্পতির চোখ! সারাক্ষণই টর্ণেডোর মতো পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরে বেড়ান তিনি বৃহস্পতির বুকে! বলে রাখা ভালো যে এই ঝড়ের বেগ ঘন্টায় প্রায় আড়াইশো মাইল, পৃথিবীর সবচে প্রলয়ঙ্করী টর্ণেডোগুলোর সাথে বেগে টক্কর দিবে এটি, আর সাইজে ছাড়িয়ে যাবে সবগুলোকেই!
এখন দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো এই ঝড়কে চোখ বলার কারণ কি? উত্তর ছবির দিকে তাকালেই স্পষ্ট। বৃহস্পতির নিরক্ষরেখায় বসে যেনো টানা টানা লাল চোখ মেলে রেড স্পট নজর রাখছে সবার ওপর! যার জন্য তার বিখ্যাত নাম- “বৃহস্পতির চোখ“। এই চোখের এমন বেগ, গাছপাহাড় তো দূরের কথা একটা পুরো শহরও উড়িয়ে নিতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হবেনা!
এই ঝড়ের ভেতর এমন গ্যাসের খেলা চলে তার সমপরিমাণ গ্যাস বুধ শুক্র পৃথিবী মঙ্গল মিলিয়েও নেই! ক্ষণিকে ঠান্ডা ক্ষণিকে গরম অদ্ভুত সেই বিষাক্ত গ্যাসের ঝড়! তবে দুইশো বছরের পুরনো এই চোখের সবচে বড় বিশেষত্ব হলো তার আকৃতি! দি গ্রেট রেড স্পটের ব্যাস প্রায় সাড়ে ষোলোহাজার কিমি, যেখানে পৃথিবীর ব্যাস প্রায় তেরো হাজার। অর্থাৎ এ ঝড়ের আকৃতি পৃথিবীর চেয়েও বড়, প্রায় ১.৩ গুণ!
ভাবা যায়? এমন একটি টর্ণেডো যা সাইজে পৃথিবীর চেয়েও বিশাল! এ যেনো ওকলাহোমা, ট্রাই স্টেট, সিডর, আইলার বাপ! ফসফরাস-সালফারের বিষাক্ত বাতাসের কল্যাণে লালচে সুন্দর এই চোখ যতটা না মোহনীয় তার চাইতে শতসহস্র গুণ বেশি ভয়ংকর। এ ভয় অবাক করে। জানার আগ্রহ জাগায়। যে আগ্রহের শেষ নেই।