শব্দের কেচ্ছা-কাহিনী
চায়ের কাপে বিস্কুট ডুবিয়ে খাওয়ার সময় হঠাৎ মাথায় আসলো যে এই চা চীনা শব্দ। আবার বিস্কুট ফরাসি শব্দ। বিস্কুটের সাথে থাকা চানাচুর হিন্দি। চায়ে যে চিনি ও পানি থাকে সেখানে চিনি চীনা অথচ পানি হিন্দি শব্দ। আবার চা ভর্তি পেয়ালাটা ফারসি কিন্তু কাপটা ইংরেজি শব্দ। এদিকে ইংরেজি শব্দটাই আবার পর্তুগিজ!
চা চীনা হলেও কফি কিন্তু তুর্কি শব্দ। আবার কেক পাউরুটির কেক ইংরেজি, পাউরুটি পর্তুগীজ। একটু দামী খানাপিনায় যাই। আগেই বলে রাখি, খানাপিনা হিন্দী আর দাম গ্রীক। রেস্তোরাঁ বা ব্যুফেতে গিয়ে পিৎজা, বার্গার বা চকোলেট অর্ডার দেয়ার সময় কখনো কি খেয়াল করেছেন, রেস্তোরা আর ব্যুফে দুইটাই ফরাসী ভাষার, সাথে পিৎজাও। পিৎজাতে দেয়া মশলাটা আরবি। মশলাতে দেয়া মরিচটা ফারসি!
বার্গার কিংবা চপ দুটোই আবার ইংরেজি। কিন্তু চকোলেট আবার মেক্সিকান শব্দ। অর্ডারটা ইংরেজি। যে মেন্যু থেকে অর্ডার করছেন সেটা আবার ফরাসী। ম্যানেজারকে নগদে টাকা দেয়ার সময় মাথায় রাখবেন, নগদ আরবি, আর ম্যানেজার ইতালিয়ান। আর যদি দারোয়ানকে বকশিস দেন, দারোয়ান ও তার বকশিস দুটোই ফারসি।
এবার চলুন বাজারে, সবজি ফলমূল কিনতে। বাজারটা ফারসি, সবজিও। যে রাস্তা দিয়ে চলছেন সেটাও ফারসি। ফলমূলে আনারস পর্তুগিজ, আতা কিংবা বাতাবিলেবুও। লিচুটা আবার চীনা, তরমুজটা ফারসি, লেবুটা তুর্কী। পেয়ারা–কামরাঙা দুইটাই পর্তুগীজ। পেয়ারার রঙ সবুজটা কিন্তু ফারসি। ওজন করে আসল দাম দেয়ার সময় মাথায় রাখবেন ওজনটা আরবি, আসল শব্দটাও আসলে আরবি। তবে দাম কিন্তু গ্রীক, আগেই বলেছি।
ধর্মকর্মেও একই অবস্থা। মসজিদ আরবি দরগাহ/ঈদগাহ ফারসি। গীর্জা কিন্তু পর্তুগীজ, সাথে গীর্জার পাদ্রীও। যিশু নিজেই পর্তুগীজ। কেয়াং এদিকে বর্মিজ, সাথে প্যাগোডা শব্দটা জাপানি। আর, মন্দিরের ঠাকুর হলেন তুর্কী।
আর কি বাকি আছে? ও হ্যাঁ। কর্মস্থল! অফিস আদালতে বাবা, স্কুল কলেজে কিন্ডারগার্টেনে সন্তান। বাবা নিজে কিন্তু তুর্কী, যে অফিসে বসে আছেন সেটা ইংরেজি, তবে আদালত আরবি, আদালতের আইন ফারসি, তবে উকিল আরবি।
ছেলে যে স্কুলে বা কলেজে পড়ে সেটা ইংরেজি, কিন্তু কিন্ডারগার্টেন আবার জার্মান! স্কুলে পড়ানো বই কেতাব দুইটাই আরবি শব্দ। যে কাগজে এত পড়াশোনা সেটা ফারসি। তবে কলমটা আবার আরবি। রাবার পেনসিল কিন্তু আবার ইংরেজি!
রিপ্লি থেকে’র অন্যান্য কিছু লেখা –
শব্দের কেচ্ছা-কাহিনী এখানেই খতম। তবে কেচ্ছাটা আরবি, কাহিনীটা হিন্দি, উভয়ের খতমটা আরবিতে। মাফ চাইলামনা বা সরি বললাম না, কারণ মাফটা আরবি আর সরিটা ইংরেজি।
ভাষা নিয়ে ভাসা ভাসা তথ্য!
বাংলায় বর্ণমালা ৫০টি, ইংরেজিতে ২৬টি, কিন্তু চাইনিজ ভাষায় বর্ণের সংখ্যা অযুতের ওপর! কেবল সাধারণ কাজকর্মের জন্যই জানা থাকা লাগে তিন থেকে ছয় হাজার বর্ণ! বিষয়টা ভয়াবহ মনে হলেও আসলে চাইনিজরা চলে সাংকেতিকভাবে, নির্দিষ্ট কোনো বর্ণমালার ধার ধারেনা। চাইনিজ ভাষাতে কিন্তু কোনো একবচন বহুবচন নেই, যেমনটা আমরা গরুকে গরুগুলো বানাই, কিংবা ব্রিটিশরা Cow-কে Cows, চাইনিজরা কিন্তু সেরকমটা পারেনা। এক বহু সব একই! তবে এত জটিল হলেও চাইনিজ ওরফে ম্যান্ডারিন ভাষা কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি লোকের মাতৃভাষা। প্রতি পাঁচজন বিশ্ববাসীর একজনের মুখের ভাষা এই ম্যান্ডারিনই। বেঁচে থাকা ভাষাদের মাঝে সবচে পুরনো লেখ্যরূপ এই ম্যান্ডারিনেরই। যীশুর জন্মেরও দেড় হাজার বছর আগে হাড়ে খোদাই করা হুবুহু আজকের যুগের চাইনিজ বর্ণ পাওয়া গেছে। তবে মজার ব্যাপার হলো, ম্যান্ডারিন শব্দটা কিন্তু সংস্কৃত!
দ্বিতীয়তে আসে স্প্যানিশ। চাইনিজ থেকে অনেক পিছিয়ে, আর ইংরেজি থেকে সামান্য এগিয়ে প্রায় ছেচল্লিশ কোটি লোকের মাতৃভাষা স্প্যানিশ। মজার ব্যাপার হল, খোদ স্পেনেই এত লোক নাই। স্পেনিশের জন্মদাতা স্পেনের জনসংখ্যা এর দশ ভাগের এক ভাগ, মাত্র সাড়ে চার কোটি! আসলে আমেরিকা জয়ের সময়ই স্পেনিশদের হাত ধরে সরি মুখ ধরে স্প্যানিশ ভাষা মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় ছড়িয়ে যায়।
এখন মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া, কিউবা, পেরুসহ মোট একত্রিশটি দেশের রাষ্ট্রভাষা স্প্যানিশ। আপনি স্প্যানিশ শিখুন, ব্যাস, মধ্য আর দক্ষিণ আমেরিকা আপনার জানের দোস্ত হয়ে যাবে! স্প্যানিশ নিয়ে আরেকটি কথা না বকলেই নয়, বিশ্বের সবচেয়ে “রোমান্টিক” ভাষা কিন্তু এই স্প্যানিশই!
স্প্যানিশের কাছে অল্পতে মার খেলেও ইংরেজি থার্ড জায়গাটা পাকা করেছে মোট ছত্রিশ কোটি লোককে দিয়ে। তবে এই ছত্রিশ কোটির মাতৃভাষা ইংরেজি হলেও, এমনিতে ইংরেজি বলা ও লেখায় দক্ষ লোকের সংখ্যা কিন্তু দেড়শো কোটির ওপর! অর্থাৎ বিস্তৃতি দিয়ে হিসাব করলে ইংরেজি ম্যান্ডারিনকেও টেক্কা দিবে! বৃটিশ সূর্য কখনো অস্ত যেতোনা। এখনো ব্রিটিশদের সে গৌরব টিকে আছে তাদের ভাষাকে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেবার মাধ্যমে! ইংরেজি ভাষার মধুর সমস্যা হলো আপনি, তুমি ও তুই সব একই You এর ফাঁদে পড়ে বসে আছে! তাই সম্বোধনের মিষ্টিভাবটা ইংরেজিতে পাওয়া মুশকিল! তবে ইংরেজি কিছুটা ডাকাতও বটে। তার অনেকগুলো বর্ণ ল্যাটিন আর অনেকগুলো শব্দ ফ্রেঞ্চ থেকে ঝোপ বুঝে কোপ দেয়া। অবশ্য ল্যাটিন আর রোমান অধিকাংশ ইউরোপিয়ান ভাষাকেই বর্ণটর্ণ বিনা সুদে ধার দিয়েছে।
চার নাম্বারে আছে ঘরের কাছের মিস হিন্দি। এবং এক্ষেত্রেও হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে প্রায় চৌত্রিশ কোটি ভাষাভাষী নিয়ে ইংরেজির সামান্য পেছনে পড়েছে সে। তবে ভারতের অফিশিয়াল ২৩ টি ভাষার মাঝে সে প্রথম। সংস্কৃতের কন্যা ও উর্দুর বোন হিন্দির সাথে হালকাপাতলা সম্পর্কও আছে বাংলার। সে হিসেবে হিন্দিকে কাজিন বলা যায়। এ কাজিন থেকে খানাপিনা, পানি, দাদা, নানার মতো বেশকয়েকটি শব্দ উপহার পেয়েছে বাংলা।
পাঁচে আরবি। মধ্যপ্রাচ্য থেকে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত আরবির লেখার রূপটি অনেক চমৎকার। খাতার ডান পাশ থেকে শুরু হয়ে বামে এসে শেষ হওয়া আরবি লাইন দেখে যে কেউই ভ্যাবাচ্যাকা খেতে পারেন! তবে আরবির আরেকটি ফ্যাক্ট হলো অ্যাবজাদ। এর মানে আরবিতে শুধু ব্যন্জনবর্ণই আছে, স্বর নেই। বরং স্বর উচ্চারন তৈরী করা হয় নির্দিষ্ট চিহ্ন ব্যন্জনবর্ণের ওপর যুক্ত করে। দেড় হাজার বছরের পুরনো আরবিকে ফেলে একটু সামনে এগোলেই শুনতে পাবেন পরিচিত একটি ধ্বনি।
হ্যাঁ, ছয়ে এসে দেখা মিলবে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার। অনেক ভাষার ফ্যাক্ট নিয়েই আলোচনা করা হলো। কিন্তু, মোট তেইশ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলার ফ্যাক্ট টা কি? সেটা হলো, বাংলা ভাষার মানুষ ভাষার দাবিতে রক্ত দিয়েছে। বাংলা ভাষার নেপথ্যের তথ্য বলি যেটা অনেকেরই অজানা।
উননিশশো একষট্টি সাল। আসামের শিলচরে ১৭ ই মে অসমিয়ার পাশাপাশি বাংলাকে সরকারি ভাষা করার দাবীতে আন্দোলনরত এগারোজনকে হত্যা করা হয়। যার মাঝে ছিলেন একমাত্র নারী ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য।