ডার্ক হিউমারের ওস্তাদ যদি কাউকে বলতে হয়, তাহলে সেটা ক্যালিগুলা।
একবার এক এক সিনেটর তার বাসায় পার্টি দিল। ক্যালিগুলা প্রধান অতিথি। তো পার্টির মাঝখানেই সে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে যেই সিনেটর পার্টি দিসে- তার বউয়ের সাথে মৌজমাস্তি করে আসলো। আবার খেতে বসে সে অতিথিদের সামনে সিনেটরের বউ বিছানায় কেমন পারফর্ম করে সেটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে বলতে লাগলো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তার শ্রোতাদের মধ্যে স্বয়ং সিনেটর মহাশয়ও ছিল। কিন্তু কিছুই করার নাই। ক্যালিগুলা তখন রোমের সম্রাট। তার কথাই তখন আইন।
আরেকবার এরকম একটা পার্টিতে তিন প্রিন্সের মধ্যে কথা হচ্ছিল। রোমে তো আর প্রিন্স প্রথা ছিল নাচ। প্রিন্স মানে এখানে সিনেটরের ছেলেপুলে। তো তারা কথায় কথায় ক্যালিগুলাকে নিয়ে একটা বেফাঁস মজা করে ফেললো। আমরা যেমন আমাদের নেতানেত্রীদের নিয়ে করি আরকি। সেটা আবার ক্যালিগুলার এক বিশ্বস্ত দাস শুনে ফেলে। সে ক্যালিগুলাকে কানপড়া দিল।
ক্যালিগুলার সবার সামনে সেই তিন প্রিন্সকে আচ্ছামত ধোলাই দিল। ধোলাই মানে যেইসেই ধোলাই না, একেবারে যমের দরবারে পৌঁছে দিল বাচ্চাগুলোকে। ক্যালিগুলা ছিল স্যাডিস্ট প্রকৃতির মানুষ। মানুষ মেরে সে এক ধরনের বিকৃত আনন্দ পেত। আর সে তলোয়ারের এক কোপে মানুষ মারতো না। ধীরে ধীরে সাবজেক্টকে যন্ত্রণা দিয়ে মারতো। সাবজেক্ট যেন বুঝতে পারে সে কষ্ট পেয়ে মারা যাচ্ছে। মানুষের মনে ভয় ঢুকানোও ছিল তার এইভাবে মানুষ মারার আরেক উদ্দেশ্য।
যাই হোক, বাচ্চা তিনটাকে তো মারলো। কিন্তু সমস্যা হলো, এদের বাবারা তো আবার সমাজের উঁচু স্তরের মানুষ। এরা নিশ্চয়ই হাইকোর্টে বিচার চাইতে আসবে। ক্যালিগুলা ভাবলো, এতো ঝামেলা করার দরকার কি? সে তার সৈন্যদের পাঠালো সেই সিনেটরদের বাসায়। সৈন্যরা সিনেটরদের মেরে বিচার চাওয়ার মত লোক যেন না থাকে সেটার বন্দোবস্ত পাকা করে আসলো।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
এইভাবে কারণে-অকারণে সিনেটর মারার পিছনে একটা অর্থনৈতিক দিকও ছিল। হত্যার পরপরই ক্যালিগুলা সেই সিনেটরের সমস্ত সম্পত্তি কব্জা করতো। তাতে রাজকোষও সমৃদ্ধ হত, আর তার রাতভর পার্টির খরচও যোগাড় হত। একবার এক সিনেটরকে মারার পর তার সম্পত্তি সীজ করতে গিয়ে দেখা গেলো, বেচারার এক কানাকড়িও নেই কোথাও। সান্ত্রীরা যখন এই খবর দিল তাকে, তখন তার প্রতিক্রিয়াটা ছিল এরকম- Alas! That death went in vain.
বোঝা গেলো, ক্যালিগুলা অনেক খারাপ কিসিমের মানুষ ছিল। কিন্তু সে যে জন্ম থেকেই খারাপ— তা কিন্তু না। তার জীবন কাহিনী অনেকটা বাংলা সিনেমার নায়কদের মত। বাংলা সিনেমার নায়করা কখন খারাপ হয়? যখন তার বাপ-মা-ভাই-বোনকে শয়তান এসে কুকুরের মত হত্যা করে। ক্যালিগুলা সেই বাংলা সিনেমার রোমান নায়ক। তার বাপ ছিল আর্মির বড় জেনারেল। সৈন্যদলের মাঝে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা। সেই জনপ্রিয়তার ঢেউ আছড়ে পড়তে শুরু করেছে সাধারণ রোমানদের মাঝেও।
তখনকার শাসক টাইবেরিয়াস ব্যাপারটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। তার নিজের জনপ্রিয়তা তখন তলানীতে। তিনি কৌশলে বিষ খাইয়ে ক্যালিগুলার বাবাকে হত্যা করলেন। ব্যাপারটা জানাজানিও হল। কিন্তু বিচার চাওয়া তো দূরের কথা, উলটো ক্যালিগুলার মা আর বড় ভাইকে দ্বীপান্তরে পাঠানো হল। মা না খেতে পেয়ে মারা গেলো আর ভাইটা আত্মহত্যা করলো। ক্যালিগুলা নিজেও সেই সময়টা বন্দীদশায় কাটিয়েছে। কাজেই, ক্যালিগুলাকে আপনি যতোই নাম ধরে গালি দেন না কেন যে ‘তুই শালা একটা ক্যালিগুলা’ – তার ক্যালিগুলা হবার পেছনে যথেষ্ট জাস্টিফিকেশন আছে বৈকী!
কথা হচ্ছে এই – যে টাইবেরিয়াস ক্যালিগুলার বাবা-মাকে এইভাবে হত্যা করলেন, তিনিই আবার তাকে সিংহাসনে বসার রাস্তা তৈরি করে দিলেন কেন? সে আরেক গল্প। এই গল্প বরং অন্য একদিনের জন্য তোলা থাক। আমরা বরং ক্যালিগুলার সেন্স অফ হিউমারের আরেকটা উদাহরণ দিই। এটা যথেষ্ট ভদ্র ঘটনা। গ্ল্যাডিয়েটরের খেলা দেখার জন্য ছেলে-বুড়ো, সিনেটর-সম্রাট, সাধারণ মানুষ সবাই হাজির হত। তো সিনেটরদের জন্য আলাদা আসন বরাদ্দ থাকতো। আমাদের যেমন ক্রিকেট খেলার সময় মন্ত্রী-এমপিদের জন্য ভিআইপি বক্সের টিকেট থাকে আরকি। ধরা যাক, রোমে সেই সময় ৫০ জন সিনেটর ছিলেন। ৫০ জনের জন্য ৫০টা সীট বরাদ্দ।
ক্যালিগুলা করলো কি, বরাদ্দ সীটের সংখ্যা কমিয়ে ২০ এ নামিয়ে আনলো। কাজেই, সিনেটরদের মধ্যে ঐ সীটগুলো নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেলো। আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে সীট দখল হতে লাগলো। সীট দখলের জন্য ভিআইপপি বক্সের ভেতর মারামারি, ধাক্কাধাক্কি নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। কিছু সিনেটর সীট না পেয়ে দাসদের সাথে সাধারণা আসনে বসে খেলা দেখতে লাগলেন। বলতে গেলে, সমাজের অভিজাত হিসেবে তাদের কোন ইজ্জতই অবশিষ্ট রইলো না। ক্যালিগুলা দূর থেকে এগুলা দেখতেন আর মজা নিতেন।
ক্যালিগুলা আরো নিয়ম করলেন – তার আট বেহারা পালকি (পালকির রোমান ভার্সন আরকি) যখন রোমের রাস্তা দিয়ে যাবে, তখন সিনেটররা তার পাশে পাশে হেঁটে যাবেন। ব্যাপারটা এইভাবে ভাবুন যে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী রাস্তায় এ্যাম্বুলেন্স আটকে কোথাও গাড়ি ভ্রমণে বেরিয়েছেন, আমাদের মন্ত্রী মহাশয়রা সেই গাড়ির পাশে পাশে হেঁটে যাচ্ছে। এতোদিন সিনেটররা সম্রাটের পেছনে নিজস্ব পালকিতে যেতেই অভ্যস্ত ছিলেন। ক্যালিগুলার আইন তাদের সাধারণ মানুষের কাতারে নামিয়ে আনলো। তখনো সমাজতন্ত্রের কনসেপ্ট বাজারে আসেনি। এলে বলা যেত, ক্যালিগুলা কিঞ্চিৎ কম্যুনিস্টও ছিলেন বটে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তিনি পছন্দ করতেন না। ভেদাভেদ থাকবে শুধু সম্রাটে আর মানুষে। বাকি সব মানুষ সমান।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, এই লেভেলের সেন্স অফ হিউমারের জন্য আপনাকে যথেষ্ট ক্রিয়েটিভ হতে হবে। ক্যালিগুলার মধ্যে এই ব্যাপারটার কোন কমতি ছিল না বললেই চলে। আজ আমরা যে গ্ল্যাডিয়েটরের খেলা দেখি সিনেমার পর্দায়, মানে মানুষ আর বাঘের যে লড়াই দেখানো হয় -সেটা চালু করেছিলেন এই ক্যালিগুলাই। এর আগ পর্যন্ত গোটা ব্যাপারটা মানুষে মানুষে সীমাবদ্ধ ছিল। ক্যালিগুলা পুরো কনসেপ্টটাকেই এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেলেন।
ক্যালিগুলা তার ছোট বোনকে ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন মানে প্লেটোনিক ও অ-প্লেটোনিক দুইভাবেই ভালবাসতেন। এ নিয়ে রোমানরা নানা আকথা-কুকথা বলে বেড়াতো। সম্রাটের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে রসিকতা করা নাগরিকদের হাজার বছরের সংস্কৃতি। সেই বোন অল্প বয়সে মারা যান। ক্যালিগুলা এরপর বিয়েথা করে সংসারী হন। সেই ঘরে একটা বাচ্চাও হয়। সেই বাচ্চা ক্যালিগুলার কিনা নিশ্চিত হওয়া যায় না। বিয়ে যখন হয়, তখন তার স্ত্রী আট মাসের প্রেগন্যান্ট। ক্যালিগুলা অবশ্য এগুলো নিয়ে অতোটা খুঁতখুঁতে ছিলেন না। তার দরকার ছিল যেমন হোক একটা উত্তরাধিকারী।
ক্যালিগুলার বোনের নাম ছিল ড্রুসেলা। ক্যালিগুলার তার কন্যাশিশুর নামও রাখেন ড্রুসেলা। এই নিয়েও রোমের বাজারে হাজারো কৌতুক চালু ছিল। ক্যালিগুলা সেগুলাকে থোড়াই কেয়ার করেন। লোকটাকে আর কিছু না বললেও সাহসী বলতেই হবে। প্রত্যেক পুরুষেরই মনে সুপ্ত বাসনা থাকে নিজের কন্যা সন্তানের নাম তার হারানো প্রেমিকার নামে রাখতে। কয়জন সেই সাহসটুকু করে? ক্যালিগুলা করেছিলেন।
ক্যালিগুলা বেশিদিন বাঁচেননি। মাত্র ১৪০০ দিন স্থায়ী হয় তার রাজত্ব। যতো শক্তিশালীই হোন না কেনো, অভিজাতদের চটিয়ে কেউই বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। ক্যালিগুলাও পারেনি। আজকে যে কর্পোরেট সরকারগুলো দেশে দেশে রাজত্ব করছে, সে তো এই অভিজাতদের খুশি রেখেই।
ক্যালিগুলার সাথে সাথে তার বউ আর চার মাসের বাচ্চাকেও মেরে ফেলা হয়। জানেনই তো, রাজরক্ত বাঁচিয়ে রাখতে নেই। আজ যতোই নিরীহ আর অনুগত হোক না কেনো, কাল সে ঠিকই তার সিংহাসন দাবি করে বসবে।