বিজ্ঞানব্লগপোস্ট

সময়ের সংজ্ঞা কী? বৈজ্ঞানিকভাবে সময়ের বিশ্লেষণ

লিখেছেনঃ হিমাংশু কর

সময়ের সংজ্ঞা কী? দার্শনিক মতবাদ

জানার পরিমাণ সসীম, আর অসীম অজানা; বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আমরা দাড়িয়ে আছি ব্যাখ্যার অতীত অবস্থার এক অসীম মহাসমুদ্রের মধ্যে, এক ক্ষুদ্র দ্বীপের উপর। প্রত্যেক প্রজন্মে আমাদের কাজ হলো আরও কিছুটা ভূমি পুনর্দখল করা। – থমাস হাক্সলি

প্রাচীন কালের মানুষেরা রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেত। এই যে পৃথিবী, গ্রহ-নক্ষত্র, আকাশ ভরা বিস্ময়, এর শুরু হয়েছিলো কখন ? আসলেই কি এর কোন শুরু আছে, নাকি চিরন্তন এই মহাবিশ্ব ? আদিকাল থেকে মানুষ এই মহাবিশ্বকে চিরন্তন ভেবে এসেছে। স্বাভাবিক ভাবেই তারা ভাবত, এই মহাবিশ্ব বুঝি চিরকালই ছিল। আর তার কোন এক পর্যায়ে মানুষের মত প্রাণীরা এই পৃথিবীর বুকে বাস করা শুরু করেছে। প্রাচীন দার্শনিকরাও এই মহাবিশ্ব নিয়ে চিন্তা করেছেন।

অ্যারিস্টটল(খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৪ – খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২) তার “Meteorology” -এর ১২ তম অধ্যায়ে যুক্তি দেখিয়েছেন- সময় কখনো থেমে থাকে না, আর এই মহাবিশ্বও চিরন্তন। অর্থাৎ তিনি ভাবতেন, সময়ের কোন শুরু বা শেষ নেই। যখন কিছু ছিল না তখনও সময় ছিল; আর এই বিশ্বজগতের পরিণতি যাই হোক না কেন, সময়ের মত সময় বয়েই চলবে।

অ্যারিস্টটল ছিলেন তার সময়ের সবথেকে প্রভাবশালী দার্শনিক। তিনি এমনই প্রভাবশালী দার্শনিক ছিলেন যে, তার মৃত্যুর প্রায় ২০০০ বছর পর পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার মতই মানুষ মেনে নিয়েছিল। অ্যারিস্টটল ছাড়া তার সমসাময়িক এপিকুরাসও (খ্রিস্টপূর্ব ৩৪১ – খ্রিস্টপূর্ব ২৭০) একই রকম মতামত দিয়েছেন। এসব দার্শনিকদের মতে স্থান এবং সময় দুটোই ছিল পরম।

আসলে প্রাচীনকালের দার্শনিকদের কাছে সময় ছিল এক রহস্যের নাম। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দার্শনিক ও চিন্তাবিদরা সময়ের রহস্য ভেদ করতে চেয়েছেন। কিন্তু কোন কূল কিনারা পাননি। তারা ধরেই নিয়েছিলেন যে সময় এক অতিপ্রাকৃত বিষয়। আর সেসব দার্শনিক আরও গভীরে গিয়ে অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন, তারাও একটি নিশ্চিত উত্তর খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে একটা সময় তাদের ধারণা হয়েছিল যে, সময় সম্ভবত মানুষের মস্তিষ্কের একধরনের উপলব্ধি। এরপর অনেক সময় চলে গেছে ;দর্শনের আধিপত্য শেষ হয়েছে। এখন আধুনিক বিজ্ঞানের যুগ। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে, সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

দৈনন্দিন জীবনে আমরা ঘড়ি দিয়েই সময়কে বুঝে নেই । কিন্তু সময় তো আর ঘড়ির উপর নির্ভর করে চলে না। ঘড়ির কাটা থেমে থাকলেও সময় বয়েই চলে। অনেক ক্ষেত্রে ঘড়ির এক ঘণ্টা পার হলেও আমাদের কাছে মনে হয় যেন এক ঘন্টার অনেক বেশি সময় চলে গেছে! আবার অনেক ক্ষেত্রে এর উল্টোটিও ঘটে। আসলে, সময় একটি ব্যক্তি নিরপেক্ষ জিনিস হলেও আমরা আমাদের মস্তিষ্কের সাহায্যেই সময়কে অনুভব করে থাকি।

ফলে সময় নিয়ে সঠিক ও পরিপূর্ণ ধারণা পেতে হলে শুধু পদার্থবিজ্ঞানের উপর নির্ভর করলেই চলে না। পাশাপাশি শরীরতত্ত্ব, স্নায়ুবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের মত বিষয়ের উপরও নির্ভর করতে হয়। আর পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিচার করতে গেলে খুব কম কথায় সময় বিষয়টিকে সংজ্ঞায়িত করাও বেশ কঠিন। তাই সময়ের সঠিক বিশ্লেষণের জন্য এর ভৌত রূপের(পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে) পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক দিকটিও(শারীরবিজ্ঞান ও স্নায়ুবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে) জানার প্রয়োজন রয়েছে ।

পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সময়

দি প্রশ্ন করা হয় সময়ের সংজ্ঞা কী? তাহলে পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এর উত্তর কি হবে ? হয়ত বলা যেতে পারে, এটি একটি ভৌত রাশি। কারণ, পদার্থবিজ্ঞানের আলোচনায় যেসব রাশিকে দরকার হয় এবং সেটাকে পরিমাপ করা যায়, তাকে ভৌত রাশি বলা হয়। যেমন তাপমাত্রা। সময়ও তাপমাত্রার মত একটি ভৌত রাশি। কিন্তু তাপমাত্রাসহ অন্যসব রাশির সাথে সময়ের একটি বড় পার্থক্য রয়েছে। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা, ভর, তড়িৎ প্রবাহ, দীপন ক্ষমতা ইত্যাদিকে আমরা মাপার পাশাপাশি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে ধরতে, ছুতে ও অনুভব করতে পারি। যেমন- দৈর্ঘ্য,প্রস্থ ও উচ্চতাকে দেখা যায়, স্কেল দিয়ে মাপা যায়।

কোন বস্তুকে হাত দিয়ে তুলে আমরা তার ভর অনুভব করতে পারি। তাপমাত্রা ও তড়িৎ প্রবাহের সংস্পর্শে এসে অনুভব করতে পারি( তাই বলে তড়িৎ প্রবাহ অনুভব করতে যাওয়াটা নিশ্চয় বোকামি হবে !)। অর্থাৎ- সব ভৌত রাশিকেই পরিমাপের পাশাপাশি ত্বক, চোখ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব করা যায়। কিন্তু সময়কে শুধুমাত্র মস্তিষ্কের বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার সাহায্যেই অনুভব করতে হয়। ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব করার কোন উপায় নেই। অন্য সব ভৌত রাশির সাথে এখানেই সময়ের পার্থক্য।

সময় যে বয়ে চলেছে এটি আমরা বুঝতে পারি পরিবর্তন বা গতির সাহায্যে। সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারণে ঋতু পরিবর্তন হয়। পৃথিবীর নিজের অক্ষের উপর ঘোরার কারণে রাত-দিন হয়। আমরা বুঝতে পারি সময় বয়ে চলেছে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, ঘড়িতে যে সময় মাপা হয় সেটিও কিন্তু গতির সাহায্যেই।

আদিকালের ঘড়িগুলোতে এই বিষয়টি খুব ভালমতো বোঝা যেত। সূর্যঘড়িতে ছায়ার পরিবর্তন থেকে সময় মাপা হত। জলঘড়ি বা বালিঘড়িতেও এই পরিবর্তনের বিষয়টি সরাসরি দেখা যেত। এসব প্রাকৃতিক ঘড়ির পরে আবিষ্কার করা হয় যান্ত্রিক ঘড়ি। এসব ঘড়িতেও কোন একটি দণ্ড বা দোলকের পর্যায়কালকে ব্যাবহার করেই সময় মাপা হত।

এরপর আসে আণবিক ঘড়ি। একটি ক্রিস্টাল অণুর কম্পনের হারকে ব্যাবহার করে আণবিক ঘড়িতে সময় মাপা হয়। পারমানবিক ঘড়িতে মাপা হয় পরমাণুর কম্পনের সাহায্যে। এক কথায়, গতি ছাড়া সময়ের প্রবাহকে মাপার কোন উপায় নেই, এমনকি বোঝারও উপায় নেই। এখন যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় গতি কি ? তাহলেই একটি দার্শনিক সমস্যার মধ্যে পরে যাবেন। কারণ কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোন বস্তুর সে সরণ হয়, সেটিই তার গতি। অর্থাৎ সময়ের ধারনা ছাড়া গতি পরিমাপের কোন উপায় নেই।

তাহলে দেখা যাচ্ছে- সময়ের ধারনা ছাড়া গতিকে বোঝার উপায় নেই, আবার অন্যদিকে গতির সাহায্যেই সময়কে বুঝতে হচ্ছে। ফলে “গতি” ও “সময়” এই দুটি জিনিসকে এমনিতে খুব সাধারণ জিনিস মনে হলেও এদের মৌলিক রূপ বুঝতে চাইলেই এক রহস্যময় জট পাকিয়ে যায়। সময় যে একটি গোলমেলে জিনিস সেটি কিন্তু বহুকাল আগের থেকেই মানুষের জানা ছিল। আজ থেকে প্রায় সারে তিন হাজার বছর আগে সেন্ট অগাস্টিন বলেছিলেন- “ কেউ যদি জিজ্ঞেস করে সময়ের সংজ্ঞা কী ? – মনে হয় জানি, কিন্তু উত্তর দিতে গেলেই বুঝতে পারি জানি না। ”

গতি থেকেই যে সময়ের ধারনাটি সৃষ্টি হয়েছে, একথা প্রথম স্পষ্ট করেন বলেন অ্যারিস্টটল। তার ভাষায়- “ সময় হলো গতির পরিমাপ।” কিন্তু গতিবিদ্যার(Dynamics) মৌলিক স্বীকার্য সম্পর্কে তার ধারণা ছিল একদম ভুল। তিনি ভাবতেন- হালকা বস্তুর থেকে ভারী বস্তু বেশি বেগে পতিত হয়। অর্থাৎ সময় সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের ধারণাকে আমরা গ্রহণ করতে পারছি না।

অ্যারিস্টটলের পরে গতিবিদ্যা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন ইতালিয়ান জ্যোতির্বিদ গ্যালিলিও গ্যালিলি। তিনি পরীক্ষা করে দেখান যে- অ্যারিস্টটলের ধারণা ভুল। পাশাপাশি তিনিই প্রথম বলেন- গতিবিদ্যায়, বস্তুর দূরত্ব অতিক্রমের ক্ষেত্রে বেগটিই শুধু গুরুত্বপূর্ণ না, সময়ের সাথে কি হারে বেগ পরিবর্তন হচ্ছে সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। এভাবেই গ্যালিলিওর হাত ধরে এই প্রথম পদার্থবিজ্ঞানের আলোচনায় ত্বরণের ধারণা প্রবেশ করে।

গ্যালিলিও ত্বরণ ও সময়কে বিজ্ঞানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেও বলবিদ্যা শুরু হবার আগ পর্যন্ত – স্থান, সময়, ত্বরণ এসবের গুরুত্ব ভালমতো বোঝা যায় নি। বলবিদ্যা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখা গেল, এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিউটনের আগে “স্থান” ও “সময়” এই দুটোকেই পরম বলে ভাবা হত। কিন্তু নিউটন তার মহাকর্ষ তত্ত্ব ও গতির সূত্র আবিষ্কার করার পর আমাদের পরম স্থানের ধারনা ত্যাগ করতে হয়েছে ।

অ্যারিস্টটল মনে করতেন- বস্তুপি-গুলোর স্থিত অবস্থাই পছন্দ। অর্থাৎ কেউ যদি কোন বল প্রয়োগ না করে তাহলে কোন বস্তু সারা জীবন এই স্থির অবস্থায়ই থেকে যাবে। পাশাপাশি তিনি এটাও ভাবতেন যে, গতিশীল বস্তুও স্থিতিশীল অবস্থায় আসতে চায়। । আর নিউটনের তত্ত্বের পার্থক্যটি ঠিক এখানেই। নিউটনের তত্ত্ব থেকে জানা যায়- কোন বস্তুকে বল প্রয়োগ না করলে গতিশীল বস্তু চিরকাল চলতেই থাকবে; আর স্থির বস্তু চিরকাল স্থিরই থেকে যাবে। এই তত্ত্ব থেকে বোঝা গেল স্থিতির কোন পরম মানই আসলে নেই।

স্থিতির কোন পরম মান না থাকার বিষয়টি নিউটনকে খুব অস্বস্তিতে ফেলেছিল। এসব নিয়ে নিউটন একটু অসস্থিতে থাকলেও বিষয়টি কিন্তু বেশ মজার। কেননা, স্থিতির যদি কোন পরম মান না থাকে তাহলে কে “স্থির” আর কে’ই বা “গতিশীল” কোনভাবেই বলা সম্ভব না!! ধরুন একটি লোক রাস্তার পাশে দাড়িয়ে আছে, আরেকটি লোক একটি নির্দিষ্ট বেগে তার দিকে সাইকেল চালিয়ে আসছে। এখন অ্যারিস্টটলের তত্ত্ব অনুসারে আমরা বলতে পারব, কোন লোকটি স্থির আর কোন লোকটি চলমান।

আমাদের উত্তর হবে- দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি স্থির, আর সাইকেল চালিয়ে আসা লোকটি চলমান। কিন্তু নিউটনের তত্ত্ব অনুসারে এভাবে নিদিষ্ট করে বলার কোন উপায় নেই। বলতে হবে দাঁড়ানো লোকটির সাপেক্ষে সাইকেলের লোকটি চলমান অথবা সাইকেলের লোকটির সাপেক্ষে দাঁড়ানো লোকটি চলমান। একি আজব কথা! শুনতে আজব শোনালেও বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন নিউটনের তত্ত্বই সঠিক।

নিউটনের তত্ত্ব সঠিক কিনা তা খুব সহজে একটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। আমারা যদি পৃথিবীর ঘূর্ণনকে বিবেচনায় না আনি, তবে পৃথিবীর উপর একটি ট্রেনের গতিকে দুইভাবেই বলতে পারি । এক – পৃথিবী স্থির, আর রেল লাইনের উপর দিয়ে একটি ট্রেন পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে ছুটে চলেছে, অথবা এটাও বলা যেতে পারে যে ট্রেনটি স্থির, আর পৃথিবী পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে ছুটে চলেছে।

এখন ট্রেনের ভেতর যদি কেউ কোন গতিশীল বস্তু নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে, তবে দেখা যাবে নিউটনের সূত্রগুলো ট্রেনটির ভেতরেও প্রযোজ্য। যেমন- ট্রেনের একটি টেবিলের উপর যদি কেউ একটি পিংপং বল নিয়ে খেলে, তাহলে দেখা যাবে ট্রেনের বাইরের থাকা একটি টেবিলের উপরে এটি যেমন আচরণ করত এখানেও একই আচরণ করছে। ফলে রেলগাড়িটি চলছে নাকি পৃথিবী চলছে সেটি বলার কোন উপায় নেই।

অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-

স্থিতির কোন পরম মান না থাকলে কিন্তু আরও একটি সমস্যা হবে। যেমন- ট্রেনের ভিতর দুটি ঘটনা যদি ভিন্ন সময়ে ঘটে, তবে ঘটনাগুলো ঠিক কোথায় ঘটেছে এ বিষয়েও নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাবে না। পিং বলটি যখন টেবিলের উপর থেকে লাফিয়ে এক সেকেন্ড পর টেবিলে ধাক্কা খাবে, তখন ট্রেনের বাইরে থাকা কোন লোকের মনে হবে- বল দুটো ধাক্কা খেয়েছে ৩০ বা ৪০ মিটার ব্যবধানে।

কারণ এই এক সেকেন্ড সময়ের মধ্যে ট্রেনটি ৩০ মিটার দূরে সরে যাবে। কিন্তু ট্রেনে থাকা কারও মনে হবে যেন, ধাক্কাটি একই স্থানে হয়েছে। কারণ সে লক্ষ্য করবে ধাক্কার স্থানটি টেবিলের একই বিন্দুতে হয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, পরম স্থিতি বা পরম স্থানের আসলে কোন অস্তিত্বই নেই। নিউটন ছাড়াও বিসপ বার্কেলে নামে একজন এংলো-আইরিশ দার্শনিক নিউটনের মত কোন গাণিতিক পদ্ধতি ছাড়াই স্থানের পরম ধারনাকে বাতিল করে দিয়েছিলেন।

নিউটনের আবিষ্কারের পর, স্থানের পরম ধারনা বাতিল হয়ে গেলেও সময়কে তখনও পরম বিবেচনা করা হত। অর্থাৎ সময়ের কোন আদি-অন্ত নেই। যখন কোন কিছু ছিল না, তখনও সময় ছিল। আবার যদি কখনো সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায় তবুও সময়ে একইভাবে বয়ে চলবে। পরম সময়ের আরেকটি অর্থ হলো- সময় সব ক্ষেত্রেই, সব স্থানেই একই গতিতে বয়ে চলে। পৃথিবীতে এক সেকেন্ড অতিবাহিত হলে মহাবিশ্বের যেকোনো প্রান্তের জন্যও ঠিক এক সেকেন্ড অতিবাহিত হবে।

পরম সময় নিয়ে প্রাচীন কালেই কিছু দার্শনিক বিতর্ক শুরু হয়েছিল। কিছু কিছু দার্শনিক প্রশ্ন তুলেছিলেন যে- সময় যদি পরম হয়, অর্থাৎ মহাবিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে অসীম কাল বলে কিছু থেকে থাকে, তবে মহাবিশ্ব সৃষ্টির আগে সৃষ্টিকর্তা কেন অসীম কাল অপেক্ষা করেছিলেন ? আজ থেকে হাজার বছর আগে আসলে এসব প্রশ্নের কোন সমাধান সম্ভব ছিল না।

এসব দার্শনিক প্রশ্ন ছাড়া কিছু আধা-বৈজ্ঞানিক প্রশ্নও উঠেছিল। অনেকে বলেছিলেন- গতি ছাড়া যেহেতু সময়কে বোঝার উপায় নেই; আর পরম গতি বলেও কিছু নেই। তাহলে পরম সময় বলে কিছু আছে কি ? নাকি সময় নিজেও আপেক্ষিক ?

তবে আমাদের সাধারণ জ্ঞান বলে- মহাবিশ্ব যদি ধ্রুব আর পরম বলে কিছু থেকে থাকে, তবে তা সময়ই হবে। স্থানের পরম ধরানা নিয়ে অনেকে সন্দেহ পেষণ করলেও, কোন বিজ্ঞানী কোনদিন সময়ের পরম ধারনা নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলে নি। কিন্তু সবাই তো আর স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া বিজ্ঞানী না। আলোর বেগ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন নামে সুইস পেটেন্ট অফিসের এক কেরানী, যুগান্তকারী এক আবিষ্কার করে ফেললেন! শেষ পর্যন্ত আমাদের পরম সময়ের ধারনা ত্যাগ করতেই হল।

সেই ছোটবেলা থেকেই আইনস্টাইনের আলো নিয়ে অনেক কৌতূহল ছিল। ছোট্ট আইনস্টাইন ভাবতেন, যদি একটি আলোক রশ্নিকে ধরে ফেলা যায়, তাহলে সেটি দেখতে কেমন হবে ? অথবা যদি একটি আলোর তরঙ্গের সাথে সমান গতিতে ছোটা যায় তাহলে আমরা কি দেখতে পাব? একটি স্থির তরঙ্গ ? আমরা যদি একটি বাস বা ট্রেনের সাথে একই গতিতে ছুটতে শুরু করি, তাহলে পাশের ট্রেনের মানুষ, চেয়ার, টেবিল কোনকিছুকেই আমরা চলমান দেখব না।

ঐ ট্রেনের সবকিছুকেই আমাদের স্থির মনে হবে। তেমনি আইনস্টাইন ভেবেছিলেন, যদি একটি আলোর তরঙ্গের সাথে এভাবে তাল মিলিয়ে চলা যায়, তাহলে সম্ভবত একসারি লম্বা স্থির আলোর তরঙ্গ দেখা যাবে। আইনস্টাইনের বয়স যখন মাত্র ১৬ বছর, তখনই তিনি বুঝতে পারেন এই চিন্তায় কিছু একটা গলদ আছে। পরবর্তীতে তিনি তার এক লেখায় বিষয়টিকে এভাবে উল্লেখ করেছেন:

“After ten years of reflection such a principle resulted from a paradox up on which I had already hit at the age of sixteen: If I pursue a beam of light with the velocity c (velocity of light in a vacuum) I should observe such a beam of light as a spatially oscillatory electromagnetic field at rest. However, there seems to be no such thing, whether on the basis of experience or according to Maxwell’s equations.”

আইনস্টাইন কলেজে পড়ার সময় জানতে পারলেন, আলোকে ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎক্ষেত্র ও চৌম্বকক্ষেত্রের সাহায্যেই প্রকাশ করা যায়। আর এই ক্ষেত্র দুটি ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎ-চুম্বক ক্ষেত্রের সমীকরণগুলো মেনে চলে। আইনস্টাইন ভাবলেন, আলোকে ভালমতো বোঝার জন্য এর থেকে ভাল আর উপায় আর কি’ই বা হতে পারে !

তিনি তখন ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলো নিয়ে পড়াশুনা করছিলেন। দেখা গেল তার ধারনাই ঠিক। ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ সেরকম কোন স্থির তরঙ্গ অনুমোদন করে না। তড়িৎ-চুম্বক ক্ষেত্রের সমীকরণগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, আলোর কোন স্থির তরঙ্গের সারি দেখা মানে- একটি তড়িৎ-চুম্বক ক্ষেত্রকে স্থির দেখা। অর্থাৎ এরকম কোন কিছু বাস্তবে ও ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ কোনটিতেই সম্ভব নয়।

ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎ-চুম্বক সমীকরণে আলোর বেগ ছিল একটি ধ্রুবক। অর্থাৎ এটির কোন পরিবর্তন হবে না। ম্যাক্সওয়েল নিজে এই ধ্রুবকের মান কত হবে তা নিজেই গণনা করে বের করেছিলেন। তিনি হিসেব করার পর দেখতে পেলেন, অবিশ্বাস্যভাবে এটি আলোর বেগের সমান। এ থেকেই তিনি প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন আলো আর কিছু নয়, এক ধরনের তড়িৎ-চুম্বক তরঙ্গ। কিন্তু ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ থেকে দেখা যাচ্ছে আলোর বেগ সব সময় একই থাকবে। আমরা কত বেগে ছুটছি সেটি কোন বিষয় না। আলোর পেছনে আমরা যত দ্রুতই ছুটি না কেন, একে আমরা একই বেগে চলতে দেখবে। কিন্তু এ কি করে সম্ভব ?

ধরুন আপনার সামনে একটি ট্রেন আলোর বেগে চলছে। ধরলাম আলোর বেগ ১০০ কিঃমিঃ/ঘণ্টা । এখন আমরা যদি এই ট্রেনের পেছনে ৯৮ কিঃমিঃ/ঘণ্টায় ছুটি তাহলে আমাদের কাছে মনে হবে এটি ঘণ্টায় ২ কিঃমিঃ বেগে ছুটছে। এটাই স্বাভাবিক, এরকমই আমরা দেখে আসছি। কিন্তু ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ বলছে- আমরা ৯৮ কিঃমিঃ বেগে ছুটার পরও আমরা দেখতে পাব এটি এখনো সেই ১০০ কিঃমিঃ বেগেই ছুটছে। কিন্তু এটিতো পুরোপুরি নিউটনের গতিসূত্রের লঙ্ঘন।

নিউটনের গতিসূত্র অনুসারে কোন কিছুর বেগকেও অন্য যেকোনো রাশির মত যোগ বিয়োগ করা যায়। যদি কেউ আমার দিকে ৫ কিঃমিঃ বেগে আসতে থাকে আর আমি তার দিকে ২ কিঃমিঃ বেগে যেতে থাকি, তাহলে আমার কাছে মনে হবে সে আমার দিকে (৫+২)=৭ কিঃমিঃ বেগে আসছে। আবার ধরি কেউ আমার সামনে ১০ কিঃমিঃ বেগে ছুটছে, আর আমি তার পেছনে ৮ কিঃমিঃ বেগে ছুটছি, তাহলে আমার মনে হবে সে আমার থেকে ২ কিঃমিঃ বেগে সামনের দিকে যাচ্ছে।

এবার কেউ যদি পাশাপাশি কোন বাসে বা ট্রেনে একই বেগে চলে, তাহলে নিউটনের সূত্র অনুযায়ী আমরা সেই বাসের সবকিছুই স্থির দেখব। আসলে বাস্তবে আমরা কিন্তু তা’ই দেখি। তবে আলোর ক্ষেত্রে কিন্তু এমন নিয়ম আর খাটছে না। ম্যাক্স ওয়েলের সমীকরণ থেকে দেখা যায়, আলোকে আমরা কখনই ধরতে পারব না, কারণ আমরা যত দ্রুতই ছুটি না কেন সামনে তাকালে দেখা যাবে, এটি আমাদের সাপেক্ষে সেই আগের বেগেই চলছে। এ যেন এক ভুতের সাথে পাল্লা দেওয়া, আমরা যত জোড়েই ছুটি না কেন সেই ভুতকে আমরা ধরতে পারব না।

এই বিষয়টিই আইনস্টাইনকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। আলোর ক্ষেত্রে কেন এমন হবে? আর যদি সত্যি এমনটা হয়, তার মানে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ অথবা নিউটনের সূত্র যেকোনো একটি ভুল আছে। কিন্তু এটি কি করে হতে পারে! নিউটনের সূত্রের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা মেকানিক্সের উপর ভিত্তি করে পুরো এক শিল্পবিপ্লব ঘটে গেল। আর তাছাড়া গ্রহ-নক্ষত্রদের গতি পর্যন্ত নিউটনের তত্ত্ব থেকে নিখুঁতভাবে হিসেব করে ফেলা যায়।

নিউটনের তত্ত্ব ভুল হবার কথা চিন্তাও করা যায় না। আবার ম্যাক্স ওয়েলের তড়িৎ-চুম্বক ক্ষেত্রের সমীকরণও খুবই সফল । আইনস্টাইন কোনভাবেই কিছু মেলাতে পারছিলেন না। আইনস্টাইন বুঝতে পেরেছিলেন আমরা প্রকৃতির এমন কিছু একটা জানি না, যার ফলে আমাদের মনে হচ্ছে নিউটন অথবা ম্যাক্সওয়েলের সূত্রে ভুল আছে। কিন্তু প্রকৃতির এই ধাঁধার একটা সমাধান তো অবশ্যই আছে।

১৯০৫ সালের কথা। আইনস্টাইন তখন বার্নের একটি পেটেন্ট অফিসে কেরানি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পেটেন্ট অফিসের কাজ শেষ হবার পরও তার হাতে প্রচুর সময় থাকত। এই সময়গুলোতে তিনি ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎ-চুম্বক ক্ষেত্রের সমীকরণগুলোকে খুব সতর্কতার সাথে বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণাপত্র লিখলেন। সেখানে তিনি দেখান যে, স্থির বেগে চলমান যেকোনো কাঠামো থেকেই আলোর বেগ সমান পাওয়া যাবে। সকল কাঠামোর সাপেক্ষে আলোর গতি সমান এটি দেখানোর পাশাপাশি- এই অবাস্তব ঘটনা কেন ঘটে তিনি তার ব্যাখ্যাও দেন। আর এই ব্যাখ্যা থেকেই তিনি বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব গঠন করেন।

প্রথমবার যখন তিনি আলোর বেগের এই অদ্ভুত আচরণের ব্যাখ্যা খুঁজে পেলেন, তিনি নিজেও অত্যন্ত আশ্চর্য হয়েছিলেন। কেননা এই ঘটনার শুধু একটাই সমাধান আছে; গতি বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে সময় ধীর হয়ে যায় ! সাধারণ মানুষ হয়ত কখনই এমন অদ্ভুত কথা ভেবেও দেখবে না। কিন্তু আইনস্টাইন দেখতে পেলেন শুধু এই বিষয়টি ধরে নিলেই আলোর বেগের রহস্য সমাধান হয়ে যায়। আমরা যখন কোন গাড়িতে দ্রুত বেগে ভ্রমণ করব তখন আমাদের গাড়ির ভেতরের সময় ধীর হয়ে যাবে। ফলে অতিক্রান্ত দূরত্বের হিসেব ঠিকই থাকবে।

বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করলে আরও ভালমতো বোঝা যাবে। আমরা সবাই জানি, সময়ের সাথে অবস্থানের পরিবর্তনকে বেগ বলে । কেউ যদি সেকেন্ডে ১০ কিঃমিঃ বেগে ১০ সেকেন্ড যায় তাহলে তার অতিক্রম করা দূরত্ব হবে ১০X১০=১০০ কিঃমিঃ । এবার বেগ দুইগুণ বাড়িয়ে সেকেন্ডে ২০ কিঃমিঃ করা হল। বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে বেগ বৃদ্ধির ফলে আমাদের ঘড়ির সময় ধীরে চলবে।

বেগ দ্বিগুণ করার ফলে আমাদের সময় অর্ধেক হয়ে যাবে; ১০ সেকেন্ডের জায়গায় ৫ সেকেন্ড। অতিক্রান্ত দূরত্ব হবে ২০X৫= ১০০ কিঃমিঃ। এবার আমরা বেগ আবারও দ্বিগুণ করে দিলাম; সেকেন্ডে ৪০ কিঃমিঃ । ফলে সময় আরও ধীর হয়ে ২.৫ সেকেন্ড হয়ে যাবে।ফলে অতিক্রান্ত দূরত্ব হবে, ৪০X২.৫=১০০ কিঃমিঃ । এভাবে বেগ যত বাড়ানো হবে সময় তত ধীরে চলবে। কিন্তু আমরা হিসেব করলে দেখতে পাব অতিক্রান্ত দূরত্ব ঠিকই আছে।

এখানে স্থান ও সময় আমাদের সাথে এক রহস্যময় খেলা খেলছে। বাস্তব পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন আমরা যত দ্রুতই ভ্রমণ করি না কেন, আমাদের সাপেক্ষে আলোর বেগ সব সময় একই থাকবে। এটি ঘটছে কারণ, আমরা যত দ্রুত ভ্রমণ করছি আমাদের ঘড়ি তত ধীর হয়ে যাচ্ছে। আলোর বেগ অস্বাভাবিক রকম দ্রুত, সেকেন্ডে প্রায় ৩০০০০০ কিঃমিঃ, যা আমাদের পরিচিত যেকোনো কিছুর বেগের চাইতে অনেকগুণ বেশি। তাই বাস্তব জীবনে আমরা সময় ধীর হবার এই প্রভাব বুঝতে পারি না।

যদি আলোর বেগের কাছাকাছি দ্রুততায় ভ্রমণ করা সম্ভব হত, তাহলে সময় ধীর হবার এই প্রভাব আমরা বুঝতে পারতাম। এখানে একটি বিষয় বলে রাখা ভাল; আমরা কিন্তু কখনই সময় ধীর হবার বিষয়টি বুঝতে পারব না। কেননা আমরা যদি কোন রকেটে খুব দ্রুত ভ্রমণ করি, তাহলে সেই রকেটের সব কিছুর সময়ই ধীর হয়ে যাবে। এমনকি আমাদের মস্তিষ্কের ঘড়িও ধীর হয়ে যাবে। মস্তিষ্কের ভিতর নিউরোট্রান্সমিটারের অণু-পরমাণুর গতিও ধীর হয়ে যাবে।

আমাদের মস্তিষ্ক তখন চিন্তাও করবে ধীর গতিতে। ফলে আমাদের মস্তিষ্ক কখনই বুঝতে পারবে না সময় ধীর হয়ে গেছে। তবে আমরা যদি পৃথিবীতে থাকা কোন ঘড়ির সাথে আমাদের ঘড়ি মিলিয়ে দেখি, তখন দেখা যাবে আমাদের ঘড়ির সময় ধীর হয়ে গিয়েছিল। আবার কেউ যদি কোন শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে আমাদের রকেটের ভেতরটা দেখতে পায়, সে দেখতে পাবে আমাদের রকেটের ভেতরের সবকিছুই ধীর হয়ে গেছে, আমাদের হাত-পা চলার গতিও ধীর হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের চলাফেরার এই ধীর গতি আমরা বুঝতে পারব না। কারণ আমাদের দেহঘড়িও একই তালে চলবে।

আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে দেখা যায় এই মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ গতি হলো আলোর বেগ। আর এই বেগের কোন তারতম্য হয় না। আমাদের সাধারণ জ্ঞান বলবে- কোন কিছুর বেগ আবার সব ক্ষেত্রেই ধ্রুব হতে পারে নাকি, ধ্রুব যদি কিছু থেকে থাকে তো সেটা হবে সময়।

কিন্তু আইনস্টাইনের তত্ত্ব থেকে দেখা যায় আমাদের সাধারণ জ্ঞানের কোন দামই এখানে নেই। এক্ষেত্রে আমাদের পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতের সাহায্য নিতে হবে। এই তত্ত্ব থেকে আমরা জানতে পারি, আলোর বেগের বিষয়টি প্রকৃতির একটি মূল নিয়ম, যা মহাবিশ্বের সকল বস্তুকণা ও মহাবিশ্বের যেকোনো প্রান্তেই প্রযোজ্য। কিন্ত সময় বিষয়টি একটি ব্যক্তিগত ধারনা। কে সময় পরিমাপ করছে তার পরিস্থিতির উপর নির্ভর করবে সময় কিভাবে বয়ে চলবে ।

আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রকাশ হবার পর বিজ্ঞানী মহলে হৈচৈ পড়ে যায়। অনেকেই সময় স¤পর্কে পরম ধারনা ত্যাগ করতে রাজি ছিল না। তবে এই তত্ত্বের আবেদন শুধু বিজ্ঞানী মহলেই সীমাবদ্ধ ছিল না। আপেক্ষিক তত্ত্বের গুরুত্ব অনুধাবন করার পর এ নিয়ে শত শত জনপ্রিয় ধারার লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। সেখানে এই তত্ত্বের সাথে বিজ্ঞান ও বাস্তবতার বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়। এর ভিতর কিছু লেখায় তত্ত্বটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি উঠে আসে উঠে আসে তা হল- সময়কে স্থান থেকে আলাদা করে দেখার কোন উপায় নেই। স্থানের তিনটি মাত্রা দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতার মত, সময়ও স্থানের একটি মাত্রা। স্থান ও কাল মিলেমিশে এক অভিন্ন স্বত্বা তৈরি হয়, তাকে বলা হয় স্থান-কাল। স্থান-কালের ধারনার পেছনের মূল বিষয়টি সেসময় খুব কম মানুষই অনুধাবন করতে পেরেছিল।

স্থান-কাল এক হয়ে যাওয়ায় এদের মধ্যে একটি প্রতিসাম্যতার সৃষ্টি হয়। এদের একটিকে কোন অক্ষের সাপেক্ষে ঘুরিয়ে সহজেই আরেকটিতে পরিণত করা যায়। আমরা যদি কোন বস্তুকে নিয়ে ৯০ ডিগ্রি ঘুরাই তাহলে এর দৈর্ঘ্য প্রস্থে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। আর প্রস্থ , উচ্চতায় রূপান্তরিত হয়ে যাবে। একটি সাধারণ ঘূর্ণনের মাধ্যমে স্থানের কোন মাত্রাকে অন্যটিতে পরিবর্তন করার স্বাধীনতা আছে। আর এখন সময় স্থানের আরেকটি মাত্রা হবার কারণে এই চতুর্মাত্রিক স্বত্বাকে একটি নির্দিষ্টভাবে ঘুরিয়ে স্থানকে সময়ে, আর সময়কে স্থানে রূপান্তরিত করা যায়।

এই নির্দিষ্ট চারমাত্রিক ঘূর্ণনের ফলে স্থান-কাল একটি নির্দিষ্ট উপায়ে বিচ্যুত হওয়াটা বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের একটি দাবি। অন্যভাবে বললে বলা যায়, বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের কিছু নিয়ম মেনে স্থান-কাল পর¯পরের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। অনেকেই ভাবতে পারেন, সময়ও যেহেতু মহাবিশ্বের স্থান-কালের একটি মাত্রা- তাই কোন বস্তুকে যদি উল্টো করলে দৈর্ঘ্যকে, প্রস্থ বা উচ্চতায় পরিণত করা যায়, তবে সময়কেও বুঝি উল্টো করে দেওয়া যাবে।

কিন্তু সমস্যা হলো, সময়কে কোন বস্তুর মত হাতে ধরে ঘুরানো যাবে না। তা করা গেলে আমরা ইচ্ছে মত সময়কে উল্টে দিয়ে অতীত ভ্রমণ করতে পারতাম। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট গাণিতিক উপায়েই এই বিষয়টি করে দেখানো যায়। আর এই গাণিতিকভাবে করা বিষয়টিকে বাস্তবে করতে গেলে প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণ শক্তির। শুধু তাই না, এই শক্তি আমাদের চেনাপরিচিত শক্তির মত না’ও হতে পারে ! সময়ের উল্টো দিকে চলতে গেলে আমাদের দরকার হয় বিশেষ ধরনের শক্তির ।

৩০০ বছর আগে নিউটন ভেবেছিলেন সময় একদম পরম, অর্থাৎ মহাবিশ্বের সকল স্থানেই সময় একই হারে বয়ে চলেছে। আমরা পৃথিবী, চাঁদ বা মঙ্গল গ্রহ যেখানেই থাকি না কেন সময় একটি ধ্রুব গতিতে চলতে থাকবে। আর স্থানের সাথে সময়ের কোন স¤পর্ক নেই। কিন্তু বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে দেখা গেল, সময় সব ক্ষেত্রে ধ্রুব গতিতে চলে না, বরং আলোই একটি ধ্রুব গতিতে চলে। আলোর গতি সকল অবস্থায় সমান থাকবে, আর ঘড়ির কাটা কতটা দ্রুত চলবে তা নির্ভর করবে আমরা কতটা দ্রুত চলছি তার উপর। নিউটনের ধারনায় সময়ের সাথে স্থানের কোন স¤পর্ক না থাকলেও আপেক্ষিক তত্ত্বে স্থান ও সময় একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।

উপরে বেগ বৃদ্ধি পাবার ফলে সময় ধীর হবার যে উদাহরণটি দেওয়া হয়েছিল সেটি কিন্তু সঠিক না। শুধুমাত্র বোঝার সুবিধার্থে গাড়ির বেগের বিষয়টি দেখানো হয়েছিল। সময় ধীর হবার আপেক্ষিক প্রভাব সবচেয়ে ভালমতো বোঝা যায় আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে। আমাদের বর্তমান প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি রকেটগুলোর বেগ কিন্তু খুব বেশি না। কিন্তু আমরা যখন আলোর বেগের ৯০% -এর কাছাকাছি বেগে ভ্রমণ করার মত রকেট তৈরি করতে পারব তখন সেগুলো মাপতে আর সূক্ষ্ম ঘড়ির দরকার হবে না। নিচে আলোর বেগ বৃদ্ধির সাথে সাথে সময় কতটা ধীর হয়ে যায় তা দেখানো হলোঃ

আলোর বেগের ৮৭% – সময় ২ গুন ধীর হয়ে যাবে ।
আলোর বেগের ৯৫% – সময় ৩ গুন ধীর হয়ে যাবে ।
আলোর বেগের ৯৭% – সময় ৪ গুন ধীর হয়ে যাবে ।
আলোর বেগের ৯৮% – সময় ৫ গুন ধীর হয়ে যাবে ।
আলোর বেগের ৯৯% – সময় ৭ গুন ধীর হয়ে যাবে ।
আলোর বেগের ৯৯.৯% – সময় ২২ গুন ধীর হয়ে যাবে ।
আলোর বেগের ৯৯.৯৯% – সময় ৭০ গুন ধীর হয়ে যাবে ।
আলোর বেগের ৯৯.৯৯৯৯% – সময় ৭০৭ গুন ধীর হয়ে যাবে ।
আলোর বেগের ৯৯.৯৯৯৯৯৯% – সময় ৭০৭১ গুন ধীর হয়ে যাবে।

এখন ধরা যাক আমরা এমন একটি রকেট তৈরি করতে পেরেছি যা আলোর বেগের ৯৯.৯৯% দ্রুততায় ভ্রমণ করতে পারে। যদি কেউ এই রকেটে চরে এক বছর কাটিয়ে আসে তাহলে আমরা আপেক্ষিক তত্ত্বের প্রভাব বেশ ভালমতোই বুঝতে পারব। ধরে নিলাম কয়েকদিন আগে আপনার মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আপনি চাচ্ছেন কিছুদিন একটু দ্রুতগামী রকেটে করে একটু মহাকাশ ভ্রমণ করে আসলে মন্দ হয় না।

আপনি একটি রকেটে করে আলোর বেগের ৯৯.৯৯% দ্রুততায় ১ বছর মহাকাশে ভ্রমণ করে এলেন। ফিরে এসে কি দেখবেন ? যা দেখবেন তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। আপনি রকেটের ভিতর থাকায় আপনার বয়স মাত্র এক বছর বেড়েছে, কিন্তু এদিকে পৃথিবীতে কেটে গেছে ৭০ টি বছর। ফিরে এসে আপনার বেশীরভাগ সহপাঠীকেই আর জীবিত পাওয়া যাবে না। আর যারা বেচে আছে তারা এতটাই বৃদ্ধ হয়ে গেছে যে আপনি তাদের চিনতেই পারবেন না। তাই এরকম মহাকাশ ভ্রমণ না করাই ভাল !

সময় ধীর হবার বিষয়টি কিন্তু শুধু মানুষ বা সচেতন প্রাণীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, বরং এই মহাবিশ্বের সকল প্রকার বস্তুকনিকার জন্যই প্রযোজ্য। যেমন- মিউওন কণিকার কথাই ধরা যাক। মিউওন খুবই অস্থায়ী একটি কণিকা, গড় আয়ু ২.২ মাইক্রোসেকেন্ড । এক সেকেন্ডের দুই লক্ষ্য ভাগের একভাগ সময়ের মধ্যেই এর উৎপত্তি ঘটে আবার ধ্বংসও হয়ে যায়। তাই মহাকাশ থেকে(বায়ুম-লে এসে উৎপন্ন হয়) যখন কোন মিউওন কণিকা পৃথিবীতে প্রবেশ করে, সেটি খুবই আশ্চর্যজনক লাগে।

কেননা এই কণিকাগুলো যদি আলোর বেগের খুব কাছাকাছি বেগেও ছুটে, তবুও ৭০০ মিটার পার হবার আগেই ধ্বংস হয়ে যাবার কথা । পৃথিবীর পৃষ্ঠ পর্যন্ত পৌঁছানোটা একদম অসম্ভব। কিন্তু মিউওন যেহেতু আলোর বেগের খুব কাছাকাছি বেগে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে, তাই আপেক্ষিকতা বিশেষ তত্ত্ব অনুসারে মিউওনের নিজের সময় প্রায় ৩০ গুন ধীর হয়ে গেছে। তাই আমাদের ঘড়ির হিসেবে মিউওন কণিকার পৃথিবীতে পৌছুতে-পৌছুতে ধ্বংস হবার কথা থাকলেও, মিউওনের নিজের ঘড়িতে তখনও ২.২ মাইক্রোসেকেন্ড পার হয়নি।

আবার তেজস্ক্রিয় কোন পদার্থের কথাই ধরা যাক। তেজস্ক্রিয় পদার্থের বৈশিষ্ট্য হলো- একটি নিদিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পরমাণুর ক্ষয় হয়। এবার যদি কোন তেজস্ক্রিয় পরমাণুকে আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে মহাকাশযানে করে এক বছর ঘুরিয়ে আবার পৃথিবীতে ফেরত আনা হয়, তবে দেখা যাবে, এই মহাকাশযানে থাকা অবস্থায় এক বছরে যে পরিমাণ পরমাণু ক্ষয় যাবার কথা ছিল তার থেকে অনেক কম পরিমাণ পরমাণু ক্ষয় গিয়েছে। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে এই সময় ধীর হবার বিষয়টি সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এমনকি অণু-পরমাণুর ভাঙ্গন বা কোন কণিকার গড় আয়ুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে দেখা যাচ্ছে সময় ধীর হয়ে যায়। কিন্তু বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের পর আইনস্টাইন এমন এক তত্ত্ব গঠন করেন যার ফলাফল আরও বেশি অদ্ভুত। সেই তত্ত্ব থেকে দেখা যাবে সময় শুধু ধীরই হয় না, এমনকি বেকেও যেতে পারে; ঘুরপাক খেতে পারে !!

আলোর বেগের সমস্যা নিয়ে কাজ করার পর আইনস্টাইন মহাকর্ষ বল নিয়ে কাজ করতে চাইলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল মহাকর্ষ বল কেন কাজ করে তা খুঁজে বের করা। কিন্তু এই অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি আবারও এক যুগান্তকারী আবিষ্কার করে ফেললেন। তার গণনা থেকে বোঝা গেল, স্থানকে(মহাশূন্য) আমরা যেমন সমতল বলে ভাবি বিষয়টি আসলে মোটেই তেমন না। বরং স্থান হলো বক্র। আর স্থানের এই বক্রতার কারণেই মহাকর্ষ বলের উৎপত্তি ঘটে।

স্থানের বক্রতাকে সহজে বোঝার জন্য স্থানকে(মহাশূন্য) একটি পাতলা চাদরের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। আমরা যদি এই চাদরের উপরে একটি ভারি পাথরকে রাখি তাহলে চাদরের মাঝের জায়গাটি বিকৃত হয়ে যাবে। এখন চাদরে যত ভারি পাথর চাপানো হবে, চাদরের বক্রতাও তত বেড়ে যাবে। ফলে এই চাদরের উপর কোন বস্তুর চলার পথও একটি বাঁকা পথ হয়ে যাবে। এখন কোন বস্তুকে চাদরের উপর ছেড়ে দিলে সেটি পাথরের দিকে গড়িয়ে পড়ে যেতে চাইবে।

আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে ভারি পাথরটি যেন বস্তুটিকে আকর্ষণ করছে। কিন্তু আসলে এটি কোন আকর্ষণ নয়, বরং চাদরের বক্রতার কারণেই এটি বস্তুটিকে ভারি পাথরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আইনস্টাইনের গণিত বলছে এটি কোন বল নয়, বরং চাদরের বক্রতার কারণেই এই বলের উদ্ভব হচ্ছে। তেমনি স্থান-কালের বক্রতার কারণেই বস্তুগুলো একে অপরের দিকে আকর্ষিত হয়।

কারণ প্রতিটি গ্রহ নক্ষত্রই এভাবে তার চারপাশের স্থানকে বাকিয়ে দেয়। নিউটন এই আকর্ষণের নাম দিয়েছিলেন মহাকর্ষ । কিন্তু কেন এই টান কাজ করে তা তিনি বলতে পারেননি। মহাকর্ষ বল কেন কাজ করে, আইনস্টাইন তার রহস্য উদঘাটন করে ফেললেন। আশ্চর্য বিষয় হলো, স্থানের এই বক্রতা এমনকি আলোকেও বাঁকা পথে চলতে বাধ্য করে।

এই চাদরের বক্রতার বিষয়টি আমাদের সৌরজগতের সাথে তুলনা করা যাক। সৌরজগতের কেন্দ্রে রয়েছে সূর্য। আর সূর্য তার বিশাল ভরের কারণে তার চারপাশের স্থানকে বাঁকা করে দিয়েছে। ফলে আশেপাশের গ্রহগুলো সূর্যের প্রতি একটি আকর্ষণ অনুভব করছে। আর এই আকর্ষণ নিউটনের ব্যাস্তবর্গীয় নিয়ম মেনে চলার ফলে, প্রতিটি গ্রহই একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথ দিয়ে সূর্যের চারদিকে ভ্রমণ করে চলেছে।

সূর্যের মত পৃথিবীও তার চারপাশের স্থানকে প্রতিনিয়ত বাকিয়ে চলেছে। আর সেকারণেই আমরা পৃথিবীর সাথে মাধ্যাকর্ষণের টান অনুভব করি। এই বক্রতা না থাকলে আমরা মহাশূন্যে ছিটকে যেতাম।

সময়ের সংজ্ঞা কী
পৃথিবী তার ভরের কারণে চারপাশের স্পেস-টাইমকে বাকিয়ে চলেছে | Photo – space.com

এখন লক্ষ করুন- বিশেষ তত্ত্ব থেকে আমরা জেনেছিলাম যে, স্থান ও সময় মূলত একই সত্ত্বা। ফলে স্থান ছাড়া সময় চিন্তাও করা যায় না। তাই স্থানের বক্রতার কারণে একটি বিশেষ ব্যাপার ঘটে, তা হলো- স্থান যদি বেকে যায় তবে সময়ও বেকে যাবে।

আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বকে ম্যাচেস প্রিন্সিপল(Mach’s Principle ) নামে একটি নীতির সাহায্যে সামারাইজ করা যায়। উপরে একটি উদাহরণে আমরা দেখেছিলাম, চাদরের উপর যত ভারি পাথর চাপানো যায়, চাদরের বক্রতাও তত বেশি হয়। তেমনি আইনস্টাইনের তত্ত্বকে সামারাইজ করে বলা যায়- ভর-শক্তির উপস্থিতি তার চারপাশের স্থান-কালের বক্রতা নির্ধারণ করে। আইনস্টাইন দেখালেন, স্থান-কালের বক্রতা সরাসরি ভর-শক্তির পরিমাণের উপর নির্ভর করে।

আইনস্টাইনের সমীকরণকে নিচের মত করে লেখা যায়:

ভর-শক্তি ——–>> স্থান-কালের বক্রতা

এই স্থান কালের বক্রতার দ্বারা সবকিছুই প্রভাবিত হয়। সামান্য আলোক রশ্নি থেক শুরু করে, মহাবিশ্বের সব বস্তু। এর আগে আমরা দেখেছিলাম, গতি বৃদ্ধির ফলে সময় ধীর হয়ে যায়। কিন্তু শুধু গতি বৃদ্ধির কারণেই যে সময় ধীর হয় তা কিন্তু না। কোন বস্তুর মহাকর্ষ বলও সময়কে ধীর করে দিতে পারে। উদাহরণ সরূপ- পৃথিবীর ভর সূর্যের থেকে অনেক কম। ফলে পৃথিবীর তুলনায় সূর্যের মহাকর্ষ বল অনেক বেশি। তাই আমরা যদি পৃথিবীতে অবস্থান করি তবে আমাদের সময় যেভাবে বয়ে চলবে সূর্যের ক্ষেত্রে আরও ধীরে চলবে। কেননা, সূর্যের মহাকর্ষ বল সময়কে ধীর করে দেবে।

মহাকর্ষ বলের প্রভাবে সময় ধীর হবার এই প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে আমরা জিপিএস(Global Positioning System) তৈরি করতে পেরেছি। জিপিএস মূলত একটি কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে কোন স্থানের অবস্থান নির্ণয় করে থাকে। ধরুন আপনি আপনার স্মার্ট-ফোনের জিপিএস ব্যাবহার করে আপনার অবস্থান জানতে চাচ্ছেন। এখন আপনার এই অবস্থান নির্ণয়ের কাজটি মূলত করা হবে কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে। আমরা জানি- পৃথিবীর মহাকর্ষ বল সবথেকে বেশি থাকে পৃথিবীর পৃষ্ঠে। পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে যত উপরে বা নিচে যাওয়া যাবে এই বল তত কমতে থাকবে।

কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবী থেকে অনেক উচ্চতায় অবস্থিত। তাই সেখানের মহাকর্ষ বল পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে কিছুটা কম। ফলে সেখানে সময়ের প্রবাহও কিছুটা দ্রুত । তাই কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে আপনার অবস্থান নির্ণয় করার জন্য যদি এই সময়ের ধীর হবার প্রভাব বিবেচনায় আনা না হয়, তবে আপনার সঠিক অবস্থান পাওয়া যাবে না। আইনস্টাইন যদি তার তত্ত্ব আবিষ্কার না করতেন, তাহলে জিপিএসের সাহায্যে নির্ভুল অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হত না। কৃত্রিম উপগ্রহের সাথে আমাদের পৃথিবীর সময়ের ব্যবধান কিন্তু খুব সামান্য। কিন্তু আমরা যদি এই সামান্য প্রভাবকে গণনায় না ধরি তবে সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা যাবে না। সময়ের এই প্রভাব গণনায় না ধরলে জিপিএসের হিসেবে ১২ কিলোমিটার এদিক ওদিক হয়ে যেত !

আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে দেখা যাচ্ছে- সময় মূলত এক ধরনের নদীর মত। নদী যেমন কোথাও ধীরে চলে, আবার কোথাও দ্রুত চলে তেমনি। স্থান কালের বক্রতার ফলে আরও একটি মজার বিষয় ঘটে। স্থান-কালের বক্রতা যদি অনেক বেশি হয় তখন নদীর পানিতে যেমন ঘূর্ণি তৈরি হয়, স্থান-কালের বক্রতার ফলেও এমন ঘূর্ণি তৈরি হতে পারে। ফলে এমন ঘূর্ণিযুক্ত স্থানে ইচ্ছে করলেও সোজা চলা যাবে না, সময়ও যে শুধু সামনের দিকেই প্রবাহিত হবে এমনও বলা যায় না।

আইনস্টাইনের তত্ত্ব থেকে দেখা যায়- মহাকর্ষ বলের প্রভাবে সময় ধীর হয়ে যায়, বেকে যায় , এমনকি নদীর পানিতে যেমন ঘূর্ণি তৈরি হয় তেমনি সময়ও ঘূর্ণিপাকে আবদ্ধ হতে পারে। তবে সময় ঘূর্ণিপাকে আবর্তিত হলেও সময় কখনো থেমে যাবে না। সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের সমীকরণ তা অনুমোদন করেনা।

আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব সময় সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিলেও, কিছু ধোঁয়াশা এখনো রয়েই গেছে। ভাবছেন এ আবার কেমন কথা? ব্যাখ্যা যদি স্পষ্টই হয়, তবে ধোঁয়াশার কথা আসছে কেন! তাহলে একটু খোলাসা করেই বলি। প্রকৃতিতে যা কিছু ঘটে সবকিছুর মূলে আছে চারটি মৌলিক বল। আমরা এই চারটির মধ্যে তিনটি বলের কোয়ান্টাম তত্ত্ব তৈরি করে ফেলেছি। কিন্তু মহাকর্ষ বলের কোয়ান্টাম তত্ত্ব এখনো সফল না।

সমস্যা হলো মহাকর্ষ বলকে কোয়ান্টানাইজ করতে গেলে তো সময়কে কোয়ান্টানাইজ করতে হবে(কারণ মহাকর্ষের সাথে সময় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত)। তাই একটি পরিপূর্ণ কোয়ান্টাম গ্যাভিটির(মহাকর্ষ বলের কোয়ান্টাম তত্ত্ব) তত্ত্ব ছাড়া সময় সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে সম্পূর্ণ বলা চলে না। তাই এখনো অল্প কিছু ধোঁয়াশা রয়েই গেছে।

সময় বাতিলের প্রস্তাব

মনিতে সময়ের কিছু বৈশিষ্ট্য একদম অপরিবর্তনীয়। আমরা না চাইলেও সময় তার গতিতে বয়ে চলে। অর্থাৎ একরকম বাধ্য হয়ে আমাদের সময়ের স্রোতে বয়ে চলতে হয়। স্থানের ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। স্থানে আমরা ইচ্ছে করলে চলতেও পারি আবার স্থিরও থাকতে পারি। কিন্তু সময়ের ক্ষেত্রে আমাদের ইচ্ছার কোন দাম নেই। মহাবিশ্ব সম্পর্কিত এই ধারনায় সময় মহাবিশ্বের একটি অবিচ্ছেদ্য উপাদান।

কিন্তু অনেক দার্শনিক এমনকি পদার্থবিদও আছেন যারা সময়ের অস্তিত্বই স্বীকার করেন নি। সেন্ট অগাস্টিন ছিলেন তেমন একজন দার্শনিক। তিনি “ কনফেশন অফ সেন্ট অগাস্টিন ” নামে ১৩ খণ্ডের একটি আন্তজীবনীমুলক বই লিখেন। ৪০০ খ্রিঃ দিকের এক লেখায় তিনি সময়ের প্রকৃতি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে লিখেছিলেন। সেখানে তিনি সময়ের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছেন। তার মতে, সময় আমাদের মস্তিষ্কের একটি বিভ্রম মাত্র।

তিনি অতীত ও ভবিষ্যৎের অস্তিত্বকে স্বীকার করতে চান নি। তার মতে অতীত সে তো গতই হয়েছে, আর ভবিষ্যৎ তো তাই, যা এখনো হয়নি। আর বর্তমান এমন একটি বিষয় যা ঠিক এই মুহূর্তেই পরিবর্তন হয়ে অতীত হয়ে গেল। তাহলে এগুলোর কোনটা আসলে সময় ? তার মতে এই অতীত বর্তমান বা ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। তবে পুরোটা মিলেই সময়। তাহলে ঠিক সময় বলে কি আসলেই কিছু আছে ? তার মতে পুরো সময়টিই মানে বর্তমান, অতীত আর ভবিষ্যৎ একইসাথে ঘটে আছে। কিন্তু আমাদের মস্তিষ্কের সীমাবদ্ধতার কারণে তা বুঝতে পারছি না।

তিনি তার সময়ের ব্যাখ্যায় ঈশ্বরকে নিয়ে এসেছিলেন। তার প্রশ্ন ছিল – ঈশ্বর কি সময়ের দ্বারা সীমাবদ্ধ? তিনি নিজেই এর উত্তর দিয়েছেন। তার মতে ঈশ্বর যেহেতু সর্বশক্তিমান, তাই তিনি সময় দ্বারা সীমাবদ্ধ নন। অর্থাৎ ঈশ্বর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একই সাথে জানতে পারেন।

সেন্ট অগাস্টিনের সময় সম্পর্কে এসব ধারনা কিন্তু বৈজ্ঞানিক নয়। কিন্তু অগাস্টিনের মত আমরাও “সময়” ও সময় প্রভাবের অদ্ভুত অজানা ও আপাতবিরোধী বৈশিষ্ট্য দেখে অবাক হয়ে যাই। অনেক সময় আমাদের মস্তিষ্ক ভাবতে পারে না, স্থান থেকে সময় কিভাবে আলাদা, আর আর কিভাবেই বা স¤পর্কিত। আমরা যদি স্থানের সামনে পেছনে বা বিভিন্ন দিকে ভ্রমণ করতে পারি, তাহলে সময়ের ক্ষেত্রে কেন পারি না? আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনকাল নির্দিষ্ট কিছু সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ভেবে অবাক হতে হয় আমরা অতীত মনে রাখি কিন্তু ভবিষ্যৎ কেন মনে রাখতে পারিনা।

এত গেল দার্শনিকের ধারণা। অনেক দার্শনিক ও সাধারণ মানুষের মত কয়েকজন বিজ্ঞানীও সময়ের অস্তিত্বকে স্বীকার করতে চান নি। তেমন একজন ছিলেন ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী জুলিয়ান বারবার। বারবার আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের উপর কলোগন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেছেন। তবে তার মূল আকর্ষণ ছিল কোয়ান্টাম র্গ্যাভিটি নিয়ে।

পদার্থবিজ্ঞানীরা সময়কে যেভাবে দেখেন বারবার তার চেয়ে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে চেয়েছেন। তিনি পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্র থেকে সময় বিষয়টিকে বাদ দিয়ে নতুন এক ধরনের পদার্থবিজ্ঞানের সূচনা করতে চেয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত তার “The End of Time” বইয়ের মাধ্যমে তিনি সময়ের ধারনাকে উপেক্ষা করে এক নতুন মতবাদের সূচনা করেন। বারবারের মতে- সময় বলে আসলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই, এটি শুধুমাত্র মস্তিষ্কের কল্পনা।

তিনি যুক্তি দেখান যে, আমাদের স্মৃতি ছাড়া অতীত বিষয়টির অন্য কোন প্রমাণ নেই। তেমনি ভবিষ্যৎও আমাদের কল্পনা মাত্র; এর সাপেক্ষে কোন প্রমাণ পাওয়া যাবে না। তার মতে, বস্তুকণার স্থান পরিবর্তন করার বিষয়টি আমাদের মধ্যে “সময়” নামক এক বিভ্রমের সৃষ্টি করে। কিন্তু আদতে প্রতিটি মুহূর্তই স্বতন্ত্র ভাবে টিকে থাকতে পারে; আর তা সম্পূর্ণটাই একসাথে আছে। অর্থাৎ তার মতে পুরো সময়টাই বর্তমান। অতীত বা ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। তিনি এর নাম দিয়েছেন “ Now ”।

বারবারের তত্ত্বের কাছাকাছি আরও একটি তত্ত্ব আছে। একে ব্লক ইউনিভার্স তত্ত্ব(Block universe theory) বলা হয়। ব্লক ইউনিভার্স তত্ত্বে, স্থান-কালকে একটি অপরিবর্তনীয় চার মাত্রিক পৃষ্ঠ হিসেবে দেখা হয়। এই তত্ত্ব মতেও সময়ের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একই সাথে ঘটেই আছে। এতে পরিবর্তন করার কিছু নেই, বা প্রবাহেরও কিছু নেই। কিন্তু ব্লক তত্ত্বে বারবারের মত সময়ের ধারনাকে বাতিল করে দেওয়া হয়নি। ব্লক তত্ত্ব এমনিতেই অনেক ত্র“টি আছে।

কিন্তু বারবারের তত্ত্ব সময়ের ধারনাকে বাতিল করে দেবার ফলে, সময়ের যে একটি মাত্রা আছে; স্থান আর কাল যে একই সত্ত্বার একটি ভিন্ন মাত্রা মাত্র; সে ধারনাকেও বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। ফলে এই তত্ত্ব চূড়ান্ত রকম সমোলচনার সৃষ্টি করেছে। তাই শুরু থেকে বেশিরভাগ বিজ্ঞানীরাই একে সন্দেহের চোখে দেখেছেন।

পরবর্তীতে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ শন ক্যারল বারবারের সময়বিহীন মহাবিশ্বের ধারনাকে একরকম বাতিল করে দিয়েছেন। মজার বিষয় হলো- তিনি কিন্তু বারবারের তত্ত্বের কোন বিপরীত তত্ত্ব প্রস্তাব করেন নি বা তার ধারনাকে বাতিল করেও দেন নি। তিনি একটি জিনিস স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন যে- বারবারের এই সময়বিহীন ধারনা পদার্থবিজ্ঞানে কোন কাজেই আসবে না। অর্থাৎ এই ধারনা শুধু ধারনাতেই সীমাবদ্ধ, বিজ্ঞানে এর কোন ব্যাবহারই নেই। ফলে একে বাতিল না করলেও তা বিজ্ঞানের জায়গায় স্থান পাচ্ছে না।

সময়ের অস্তিত্ব নিয়ে বিস্তারিত কাজ করেছেন টিম মডলিন। তিনি মূলত বিজ্ঞানের দর্শন নিয়ে কাজ করেন। সময়ের ধারণার বিষয়ে মডলিনকে একদমই মৌলবাদী বলা যায় । তার ধারনাও একদম স্পষ্ট। মডলিন যুক্তি দেখিয়েছেন যে- সময়ের তীর একদম বাস্তব একটি বিষয়, অর্থাৎ সময় কোন প্রতিসাম্যতা মানে না। আর পাশাপাশি বারবারের সময়হীনতার বিষয়টিকেও সরাসরি বাতিল করে দেন। তার যুক্তিগুলো কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও পদার্থবিজ্ঞানের আধুনিক ধারণার উপর ভিত্তি করে দেওয়া।

বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখলে এমনিতেও সময়বিহীন মহাবিশ্বকে অসম্ভব মনে হবে। নিউটনের বিশ্বে সময়কে পরম ভাবলেও, সময় নিয়ে নিউটনীয় বলবিদ্যার তেমন কিছু করার ছিল না। কেননা নিউটনের পদার্থবিদ্যায় সময়ের কোন উল্লেখই নেই। সেখানে সময়কে এক অর্থে শাশ্বত ধরে নেওয়া হয়েছে, আবার আরেক অর্থে হিসেবের মধ্যেই নেওয়া হয় নি। কিন্তু আইনস্টাইনের তত্ত্বে সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিস। স্থানের মাত্রার সাথে সময়ও মহাবিশ্বের আরেকটি মাত্রা।

ফলে এই মহাবিশ্বের অবিচ্ছেদ্য উপাদান হল সময়। আর গতির সাথে সময়ের একটি নির্দিষ্ট গাণিতিক সম্পর্ক রয়েছে। আইনস্টাইনের তত্ত্বে গতি বৃদ্ধির ফলে ভর বৃদ্ধি পায়, দৈর্ঘ্য সঙ্কুচিত হয় , পাশাপাশি সময় ধীর হয়ে যায়। সময়ের যদি অস্তিত্বই না থাকত তবে সময় ধীর হবার প্রশ্ন আসত না। তাই আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারেও বারবারের সময় বিহীন মহাবিশ্বের ধারনা টিকছে না।

সময়কে বাতিল করার প্রস্তাবও যেমন এসেছে- তেমনি এর উল্টো প্রস্তাবও এসেছে। এমন একজন পদার্থবিদ হলেন লী স্মোলিন। তিনি মূলত একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী। কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে কাজ করলেও পদার্থবিজ্ঞানের দর্শন নিয়ে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। এবিষয়ে তিনি সিরিজ আকারে বেশ কিছু থিসিস ও বই প্রকাশ করেন। ২০১৩ সালের এপ্রিলে তিনি, “টাইম রিবর্ন” নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এই বইতে(পৃঃ ১৭৯) তিনি দেখান যে- স্পেস বা স্থান একটি ইল্যুশন হলেও হতে পারে, কিন্তু সময় অবশ্যই বাস্তব।

মনস্তাত্ত্বিক সময়

লোর বেগের কাছাকাছি বেগে ভ্রমণ করার সময় মিওয়ন কণিকার সময় ধীর হয়ে যায়। অনেকেই হয়ত ইতিমধ্যে বলে ফেলেছেন- “মিওয়ন কণিকার তাতে কি আসে যায় ? এসব নিয়ে যত মাথাব্যথা আমাদের মত মানুষের”। বেচারা মিউওনের তো কোন চিন্তার ক্ষমতাই নেই। তবে বিষয়টি কিন্তু অবশ্যই ভাবার মত।

সময় ধীর হবার বিষয়টি সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হলেও, জড় জগত তো আর তা উপলব্ধি করতে পারছে না। শুধুমাত্র মানুষের মত বুদ্ধিমান প্রাণীর কাছে এই সময় ধীর হবার বিষয়টি গভীর তাৎপর্য বহন করে। সময় বিষয়টি ঠিক কি, তা না জেনেই প্রাচীনকাল থেকে মানুষ সময়কে জয় করতে চেয়েছে।

সময় নিয়ে এই যে সচেতনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা এটি শুধু মানুষেরই আছে। মানুষ সচেতনভাবে সময় নিয়ে চিন্তা করতে পারে। তারা ভাবতে পারে তাদের অতীতের সুখময় স্মৃতি ও দুঃখের অভিজ্ঞতার কথা। মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীদের কিন্তু আবার সময় নিয়ে সচেতনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা নেই। এমনকি সময়কে তারা সঠিকভাবে উপলব্ধিও করতে পারে না।

মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীদের সময়-জ্ঞান কেমন তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা করেছেন। এর মধ্যে কানাডার “ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন অন্টারিওর” প্রফেসর উইলিয়াম রবার্টসের গবেষণা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। রবার্টস এবং তার সহকর্মীরা ইঁদুরের সময়-জ্ঞান নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা করেন । এই পরীক্ষাগুলোতে তারা ক্ষুধার্ত ইঁদুরকে চিজ খুঁজতে দেন। তাদের পরীক্ষাতে দেখা যায়, একটি ইঁদুর কতক্ষণ সময় ব্যয় করে চিজ এক টুকরো চিজ পেয়েছে সেটি তাদের মস্তিষ্ক জেনে রাখে। কিন্তু এখন থেকে কত সময় আগে বা পরে চিজটি পেয়েছে তা তারা জানে না । অর্থাৎ অতীত বা ভবিষ্যতের কোন অর্থ তারা উপলব্ধি করতে পারে না।

সময়ের পরীক্ষণ
একটি ইঁদুর কতক্ষণ সময় ব্যয় করে চিজ এক টুকরো চিজ পেয়েছে সেটি তাদের মস্তিষ্ক জেনে রাখে। কিন্তু এখন থেকে কত সময় আগে বা পরে চিজটি পেয়েছে তা তারা জানে না | Photo – blogbyspkrm.weebly.com

ইঁদুরের থেকে আরও উন্নত প্রাণীর ক্ষেত্রেও বিষয়টি কিছুটা এমন। কুকুরের মালিকরা লক্ষ্য করে দেখেছেন, কত সময় আগে বা পরে কোন একটি ঘটনা ঘটল, সেটি তাদের কুকুর বুঝতে পারে না। কুকুর তার মালিককে পাঁচ মিনিট পরে দেখলেও যেমন খুশি হয়, পাঁচ ঘণ্টা পর দেখলেও একই রকম খুশি হয়। অর্থাৎ তাদের সময় প্রবাহের জ্ঞান নেই।

এখন অনেকেই হয়ত ভাবছেন, কোন প্রাণীর যদি ভবিষ্যতের ধারণা একদমই না থাকে, তবে সে জীবন ধারণ করে কি করে? খাবার খাওয়া বা কোন শিকার ধরার জন্যও তো কিছুটা পরিকল্পনা করতে হয়! হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। এরকম কাজের জন্য সামান্য হলেও ভবিষ্যতের ধারণা থাকতে হয়। তবে সেই ভবিষ্যৎ চিন্তা খুব সামান্য। একটু বিস্তারিত ব্যাখ্যা করলেই বিষয়টি ঠিকমত বোঝা যাবে। উপরে যেহেতু ইঁদুর ও কুকুরের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, তাই এই বিষয়টিও এসব প্রাণীর ক্ষেত্রে আলোচনা করা যেতে পারে।

এই বিষয়গুলো বোঝার জন্য বিজ্ঞানীরা কিছু মজার পরীক্ষা করেছেন। এসব পরীক্ষা করার জন্য ইঁদুর বা এমন প্রাণীদের প্রথমে কিছুটা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিজ্ঞানীরা কিছু ইঁদুরকে একটি প্রশিক্ষণ দিলেন যে- তোমরা যদি এই লিভারটিতে চাপ দাও তবে তোমরা এক টুকরো খাবার পাবে। দুই থেকে পাঁচ বার এভাবে প্রশিক্ষণ দিলেই ইঁদুরগুলো লিভার চেপে খাবার সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু এই ঘটনার মধ্যে সময়ের ব্যবধান যদি ত্রিশ সেকেন্ডের বেশি হয়, ইঁদুর আর এই বিষয়টি মনে রাখতে পার না।

অর্থাৎ লিভার চাপা ও খারাব পাওয়া এই দুটি ঘটনার ব্যবধান ত্রিশ সেকেন্ডের বেশি হলে সেটি ইঁদুরের সময়-জ্ঞানের বাইরে চলে যায়। ইঁদুর থেকে উন্নত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে এই সময় আরও কিছুটা বেশি। বানরের ক্ষেত্রে এই সময় সর্বোচ্চ নব্বই সেকেন্ড। অর্থাৎ ইঁদুর ত্রিশ সেকেন্ড ও বানর নব্বই সেকেন্ডের বেশি ভবিষ্যৎ দেখতে পায়না।

ইঁদুর , কুকুর বা বানরের সময়-জ্ঞান দেখে বোঝা যাচ্ছে, এসব প্রাণীরা মূলত বর্তমান সময়ে বাস করে। কিন্তু বর্তমান সময়টি কত দ্রুত বয়ে যাচ্ছে সেখানেও কিন্তু মানুষের সাথে অন্য প্রাণীদের অনেক তফাৎ রয়েছে। ভাবলে অবাক হবেন, এমনকি প্রায় সব প্রাণীর সময় প্রবাহই আলাদা আলাদা ।

সিনেমা বা ডকুমেন্টারিতে অনেক সময়ই আমরা স্লো মোশনের ভিডিও দেখে থাকি। ভাবুন তো, যদি আমাদেরকে একটি স্লো মোশনের বিশ্বে নিয়ে যাওয়া হয় তবে কেমন হবে ! আশেপাশের সবকিছুর পরিবর্তন তখন খুব ধীর গতিতে হবে। তবে একই সাথে যদি আমাদের মস্তিষ্কও ধীর গতিতে কাজ করে, তাহলে আমরা বিষয়টি বুঝতেই পারব না। কিন্তু আশেপাশের সবকিছু যদি ধীর গতির হয়, আর আমাদের মস্তিষ্ক যদি ঠিকঠাক কাজ করে, তবে বেশ মজাই হবে । তখন ইচ্ছে করলেই টেবিল থেকে পরে যাওয়া গ্লাস ধরে ফেলতে পারব। সমস্যা হবে খেলাধুলা নিয়ে। এমন সুবিধা পেলে গোলকিপারকে আর গোল দেওয়া যাবে না ! কিছু প্রাণী ঠিক এমন কিছু সুবিধা পেয়ে থাকে। ওদের সময় প্রবাহ আমাদের থেকে আলাদা। ওরা জগতটাকে দেখেও কিছুটা স্লো মোশনের ভিডিওর মত।

কুকুরের কথাই ধরা যাক। কুকুরের জীবনকাল মানুষের প্রায় সাত ভাগের একভাগের সমান। অর্থাৎ কুকুরের এক বছর সমান মানুষের সাত বছর। বিজ্ঞানীরা ভাবলেন আচ্ছা, তাহলে কুকুরের সময় প্রবাহ কি মানুষের তুলনায় ধীর? গবেষণায় দেখা গেল আসলেই তাই। কুকুরের সময় প্রবাহ মানুষের তুলনায় প্রায় পঁচিশ শতাংশ ধীর ।

গবেষণায় দেখা গেছে, কোন প্রাণীর সময় প্রবাহের হার মূলত নির্ভর করে দুটি জিনিসের উপর। একটি হলো শরীরের ওজন, আর অন্যটি বিপাকের হার। কোন প্রাণীর ওজন যত কম হবে আর শরীরের ভেতর ঘটা রাসায়নিক প্রক্রিয়া যত দ্রুত হবে, সেই প্রাণীর সময় তত বেশি ধীর হবে। তবে সময় প্রবাহের হার যত কম বা বেশিই হোক না কেন, মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীরা মূলত বর্তমানেই বাস করে। অতীত ও ভবিষ্যতের ধারনা তাদের কাছে একদমই ঝাপসা।

মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর সময়-জ্ঞান না থাকলেও নিয়ান্ডারথাল মানবদের সময় জ্ঞান ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। নিয়ান্ডারথাল মানবরা ঠিক মানুষ না; তবে আধুনিক মানুষের(Homo sapiens) খুব কাছাকাছি । আজ থেকে চল্লিশ হাজার বছর আগে পর্যন্ত মানুষদের পাশাপাশি এই নিয়ান্ডারথাল মানবরাও পাশাপাশি বাস করত। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম হলো- “শুধুমাত্র যোগ্যরাই টিকে থাকে”।

প্রকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে নিয়ান্ডারথালরা টিকতে পারে নি।চিরতরে হারিয়ে গেছে এই পৃথিবী থেকে। নিয়ান্ডারথালরা হারিয়ে গেলেও তাদের ইতিহাস হারিয়ে যায় নি। তারা দেখতে কেমন ছিল, তাদের খাদ্যাভ্যাস কেমন ছিল, আর তাদের বুদ্ধিমত্তা কেমন ছিল এসব বিষয়ে রয়ে গেছে শত শত আলামত ।

নিয়ান্ডারথাল মানবের কম্পিউটার রিজেনারেটেড ছবি
নিয়ান্ডারথাল মানব | Photo – britannica.com

প্রাচীন মানব ও নিয়ান্ডারথাল মানবদের দেহাবশেষ ও ব্যাবহার করা হাতিয়ার ইত্যাদিসহ অনেক প্রাচীন গুহা রয়েছে। তেমনি এক গুহার নাম শানিদার গুহা। ইরাকের রাজধানী বাগদাদ থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে ইরাক সীমান্তের এক উপত্যকার নাম শানিদার। শানিদার মানে হলো স্বপ্ন উপত্যকা। এই উপত্যকার একপাশে অবস্থিত এই “শানিদার গুহা”। এই গুহাটিকে নিঃসন্দেহে বিশেষ একটি স্থান বলা যেতে পারে। কারণ, কার্বন ডেট টেস্ট করে জানা গেছে- এই গুহাটিকে সেই ৫০০০০ হাজার বছর আগে থেকেই বসবাস করার যায়গা হিসেবে ব্যাবহার করা হত।

আজ থেকে প্রায় ৫০০০০ বছর আগে নিয়ান্ডারথাল মানবরা যেমন এই গুহাকে আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যাবহার করেছে, তেমনি ১১০০০ বছর আগের আধুনিক মানুষরাও এই স্থানকে ব্যাবহার করেছে। এমনকি আজও কিছু স্থানীয় কুর্দিস্থানীরা বছরের বিশেষ কিছু সময়ে এই স্থানকে এখনো ব্যাবহার করে থাকে। গুহাটির খনন করার সময় চারটি স্তরে বিভিন্ন সময়ের বসবাস করা মানুষদের কঙ্কাল ও তাদের ব্যাবহার করা হাতিয়ার ইত্যাদি পাওয়া গেছে।

Erbil-governorate-shanidar-cave
শানিদার গুহা | Photo – wikimapia.org

শানিদার গুহার সর্বশেষ স্তরটিই মূলত সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রায় ১০ টি নিয়ান্ডারথালদের দেহাবশেষ পাওয়া যায়। তার মধ্যে “শানিদার-৩” ও “শানিদার-৪” কে যে ইচ্ছে করেই কবর দেওয়া হয়েছিল সে বিষয়ে বিজ্ঞানী ও প্রতœতত্ত্ববিদরা নিশ্চিত হতে পেরেছেন । পাশাপাশি সেখানে থাকা বিভিন্ন জিনিস থেকে বোঝা যায় যে, তারা মৃত্যুর পরবর্তী সময় নিয়ে চিন্তা করেই এই কবরগুলো তৈরি করেছিল। অর্থাৎ নিয়ান্ডারথাল মানবদের যে সময়-জ্ঞান ছিল এটা নিশ্চিত। অন্যান্য প্রাণীদের মত তারা শুধু বর্তমান সময়েই বাস করত না ।

এখন নিশ্চয় প্রশ্ন জাগছে, অন্য কোন প্রাণীর সময় জ্ঞান না থাকলেও শুধু নিয়ান্ডারথাল ও আধুনিক মানুষের কেন সময় জ্ঞান থাকবে ? এর নিশ্চয় কারণ আছে ? মূলত, অতীত-ভবিষ্যতের ধারণা থাকার জন্য বিশেষ ধরণের মস্তিষ্কের গঠনের দরকার হয় । মানুষের মস্তিষ্কে প্রায় ১০০ বিলিয়ন নিউরোন রয়েছে। এই নিউরোনগুলো আবার বিশেষভাবে একটি আরেকটির সাথে যুক্ত হয়ে নিউরাল সার্কিট তৈরি করেছে।

এই নিউরাল সার্কিটগুলোই আমাদের স্মৃতি মনে রাখা, সচেতনভাবে ও যৌক্তিকভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা দিয়েছে। মজার বিষয় হলো, এই নিউরাল সার্কিট কিছুটা কম্পিউটারের লজিক গেটের মত কাজ করে। ক¤িপউটারের প্রোগ্রামিং ল্যাক্সগুয়েজে যেমন হ্যাঁ অথবা না প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যৌক্তিকভাবে কোন সমস্যা সমাধান করা হয়; আমাদের মস্তিষ্কও কিছুটা সেভাবেই কাজ করে ।

যে প্রাণীর মস্তিষ্কে যত বেশি নিউরন ও নিউরোন থেকে নিউরনের সংযোগ থাকবে, সেই প্রাণী তত বেশি বুদ্ধিমান হবে। মস্তিষ্কে যদি যথেষ্ট পরিমাণ নিউরোন ও আন্তঃনিউরোন সংযোগ থাকে, একমাত্র তখনই সময়-জ্ঞানের মত উন্নত ধরণের ধারণা থাকা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা থাকা সম্ভব। আর এত উন্নত মস্তিষ্ক শুধুমাত্র মানুষেরই আছে। আর তার কারণ- তাদের মস্তকটিও যথেষ্ট উন্নত। আসলে নিয়ান্ডারথালদের সাথে আধুনিক মানুষের খুব বেশি তফাৎ নেই। একদম সম্প্রতি, লরেন্স বার্কেলে ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির এ্যাডয়ার্ড রুবিন পরীক্ষা করে দেখেছেন- আধুনিক মানুষ ও নিয়ান্ডারথাল মানবের ডিএনএ এর মধ্যে মিল ৯৯.৫% – ৯৯.৯% পর্যন্ত ।

নিয়ান্ডারথালরাও মানুষের মত হাতিয়ার তৈরি করতে পারত। কিছু কিছু বিজ্ঞানীর ধারণা তাদের সম্ভবত একটি ভাষাও ছিল। নিয়ান্ডারথালদের সময়-জ্ঞান থাকলেও সেটি কিন্তু আধুনিক মানুষের মত উন্নত না। এটি মস্তিস্কের পরিপক্কতার উপর নির্ভর করে। জন্ম নেবার পরেই মানবশিশুদের মস্তিষ্ক পরিনত মানুষের মস্তিস্কের মত কাজ করতে পারে না। ফলে মানবশিশুদের ভবিষ্যৎ সময় সম্পর্কে ধারণা খুবই অ¯পষ্ট। বলা যায় শিশুরাও একরকম বর্তমান সময় নিয়েই ভাবে।

শিশুর বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তার মস্তিষ্ক পরিণত হয়। আর সেই সাথে সে ভবিষ্যৎ স¤পর্কে আরও ভালমতো ভাবতে পারে। আর সময়কেও আরও সূক্ষ্মভাবে উপলব্ধি করতে পারে। এই মস্তিষ্কের ক্রমবিকাশের বিষয়টি, মানুষের ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রেও ঠিক একই রকম। মানব সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে মানব জাতিরও বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটেছে, ভাষার বিকাশ ঘটেছে, সেইসাথে সময় সম্পর্কে উপলব্ধি আরও তীক্ষè হয়েছে। সেই প্রাচীনকাল থেকে আজকের দিন পর্যন্ত সময় স¤পর্কে মানুষের ধারণা দিন দিন পরিবর্তন হয়েই চলেছে।

প্রাচীনকালের মানুষরা খুব বেশি দূরের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভাবতে পারত না। আগুণ জালানোর জন্য প্রয়োজনীয় কাঠ যোগার, বাড়তি খাদ্য সংরক্ষণ এসবের মধ্যেই তাদের চিন্তা সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সভ্যতা শুরু হবার পর মানুষ সময়কে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে শিখেছে। তবে সেসময় তাদের কাছে সময় ছিল কিছুটা যাদুর মত। তারা ভাবত, যেটা ঘটার সেটা সময় হলে ঘটবেই।

এসব ধারণার পেছনে মূলত আদিম ধর্মবিশ্বাসের ভূমিকাটাই ছিল প্রধান। কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা শুরু হবার পর সময়কে কিছুটা আবর্তক মনে করা হত। ওরা ভাবত সবকিছুই বুঝি ঘুরে ফিরে আবার ঘটবে। কৃষিকাজ শুরু করার পর মানুষকে প্রকৃতির উপর খেয়াল রাখতে হত। তারা দেখত – একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর, গ্রীষ্ম আসে, বর্ষা আসে, শীত আসে। প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোও ফিরে ফিরে আসে।

আদিম বিশ্বাস, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের অভাব, প্রকৃতির উপর নির্ভরতা মানুষকে সময় সম্পর্কে এমন আবর্তক ও ম্যাজিক্যাল ধারণা পেতে বাধ্য করেছে। তবে এর পেছনে কিছু মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতাও ছিল। আদিম বিশ্বাসের কারণে তারা ভাবত- সবকিছু যদি ফিরে ফিরে এসেই থাকে- তবে মৃত মানুষও বুঝি আবার জন্মগ্রহণ করতে পারে। কে চায় এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে। এসব মনস্তাত্ত্বিক কারণেই তারা মৃতের কবরে ফুল, খাদ্য , হাতিয়ার ইত্যাদি রেখে দিত।

সময় সম্পর্কে এই আবর্তক ধারণা মানুষের মনে বেশ জোরালো প্রভাব ফেলেছিল। প্রাচীন ভারতীয়দের কৃষিনির্ভর সমাজব্যবস্থায় এই ধারণাই স্থায়ী আসন করে নেয়। তবে প্রাচীন ভারতীয়দের আবর্তক ধারণা কিছুটা আরও ব্যাপক আকারের। ওরা মনে করত- একই ঋতু বার বার ফিরে আসা, বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনা ফিরে ফিরে ঘটা বা গ্রহদের ফিরে আসাই শুধু না; বরং সমগ্র মহাবিশ্বের সকল ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হবে, আবার ধ্বংস হবে; আর এভাবে চলতেই থাকবে। প্রাচীনকালের বেশিরভাগ সভ্যতাই ছিল কৃষিনির্ভর। তাই এই আবর্তক ধারণা প্রায় সব প্রাচীন সমাজেই প্রভাব ফেলেছিল।

উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে সময়কে আমরা আজকে যেমন একটি রেখার মত কল্পনা করি যে- আমাদের পেছনে অসীম অতীত কাল ছিল, আর সামনেও অসীম ভবিষ্যৎ পরে রয়েছে, এমন ধারনাটা প্রাচীন সভ্যতার শুরু থেকেই ছিল না । সময়ের রৈখিক ধারণার শুরু হয় সেমেটিক ধর্মবিশ্বাস থেকে। আব্রাহামিক ধর্মগুলোতে বিশ্বাস করা হয় যে- এই মহাবিশ্ব একটি নির্দিষ্ট সময় আগে সৃষ্টি করা হয়েছিল, আর একটি নির্দিষ্ট সময় পরে এটি ধ্বংস হয়ে যাবে । অর্থাৎ সেমেটিক ধারণা অনুযায়ী সময়ের রূপ কিছুটা “রৈখিক” । ফলে এই ধারণাকে কিছুটা আধুনিক বলা যেতে পারে।

প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে সময় নিয়ে সবচেয়ে সচেতন ছিল মধ্য অ্যামেরিকার মায়া সভ্যতা। মায়ানরাই সর্বপ্রথম নির্ভুলভাবে সময় হিসেব করতে শিখেছিল। ওরা জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভিত্তিতে গণনা করে খুব আধুনিক একটি ক্যালেন্ডার তৈরি করেছিল। ভাবতে অবাক লাগবে- আধুনিক সময় গণনার ভিত্তি হিসেবে আমরা যে গেগ্ররি ক্যালেন্ডার ব্যাবহার করি, মায়াদের ক্যালেন্ডার তার থেকেও নির্ভুল ছিল। কারণ, গেগ্ররি ক্যালেন্ডার প্রতি দশ হাজার বছরে তিনদিন পিছিয়ে যায়; আর মায়াদের ক্যালেন্ডার প্রতি দশ হাজার বছরে মাত্র দুই দিন এগিয়ে থাকে।

মায়ান ক্যালেন্ডার( পাথরে খোদাই করা )
মায়ান ক্যালেন্ডার(পাথরে খোদাই করা) | Photo – steemit.com

মায়ানরা নির্ভুলভাবে সময় গণনার পদ্ধতি আবিষ্কার করলেও সময় সম্পর্কে তাদের ধারণা কিন্তু আজকালকার দিনের মত ছিল না। প্রতিটি প্রাচীন সভ্যতার মত তাদের কাছেও সময় ছিল কিছুটা ম্যাজিক্যাল। প্রতিটি বছর, দিন বা মুহূর্তকে ওরা কোন বিশেষ ঘটনার সাথে সম্পর্কিত করত। আমরা যেমন ভাবি- কোন কিছু ঘটুক আর না’ই ঘটুক, সময় বয়ে চলবেই। কিন্তু ওরা ভাবত ঐ বিশেষ ঘটনাগুলো ঘটার জন্যই বুঝি সময় বয়ে চলেছে।

মানব সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষের মন থেকে বিভিন্ন প্রকার ম্যাজিক্যাল ধারণা দূর হতে থাকে। সেই সাথে সময় সম্পর্কেও ম্যাজিক্যাল ধারণা বাতিল হয়ে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা শুরু হতে থাকে। জার্মান জ্যোতির্বিদ জোহানেস কেপলারই প্রথম সময়ের বৈজ্ঞানিক ধারনার উপর জোর দেন। তিনি সময়কে প্রাণবান ও ম্যাজিক্যাল ধারণা থেকে মুক্ত করে, পুরো মহাবিশ্বটিকেই একটি যাত্রিক ঘড়ি হিসেবে দেখার প্রস্তাব করেন । পরবর্তীতে কেপলারের এই “যাত্রিক ঘড়ি” ধারনার বিকাশ ঘটান রেনে ডেকার্তে, বেঞ্জামিন থম্পসন, লর্ড কেলভিনের মত বিজ্ঞানীরা । মূলত তাদের চিন্তাধারাই সময়ের ক্ষেত্রে একটি বিপ্লবাত্মক চেষ্টা ছিল।

লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন- উপরে বিভিন্ন প্রাণীর সময়-জ্ঞান নিয়ে আলোচনা করা সময় একটি বিষয়ের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে, সেটি হলো- “ কে কত দূর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে পারে”। কারন, যে প্রাণী যত বেশিদূর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে বা পরিকল্পনা করতে পারে, তার সময়-জ্ঞান তত বেশি সূক্ষ্ম। সময়ের উপর থেকে ম্যাজিক্যাল ধারণা দূর হবার আগ পর্যন্ত আমরা আসলে খুব বেশিদূর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতেও পারতাম না। আর একই কারনে খুব বেশিদূর অতীত নিয়েও ভাবতে পারতাম না।

ফলে এই পৃথিবী ও মহাবিশ্বটা আমাদের কাছে খুব বেশি পুরনো ছিল না। ডেকার্তে-কেপলারের বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা শুরু হবার আগে পুরো ইউরোপে জুড়ে সেমেটিক বিশ্বাসই ছিল সবক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। সেমেটিক বিশ্বাস অনুযায়ী, এই মহাবিশ্বের সবকিছুর সৃষ্টি মাত্র কয়েক হাজার বছর আগে। ফলে তার আগের বিষয় নিয়ে ভাবার কোন দরকারই ছিল না। কিন্তু বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা শুরু হবার পর বৈজ্ঞানিকভাবে পৃথিবীর বয়স নির্ধারণের চেষ্টা চলতে থাকে।

কমটি ডি বাফুন নামে এক ফরাসি গণিতবিদ প্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে পৃথিবীর বয়স নির্ধারণ করেন। তার হিসেবে দেখা যায় – পৃথিবীর বয়স কমপক্ষে পঁচাত্তর হাজার বছর। পরবর্তীতে পৃথিবীর বয়স নির্ধারণের সঠিক উপায় আবিষ্কারের পর দেখা যায় পৃথিবীতে কয়েক শত কোটি বছর পুরনো পাথরের অস্তিত্ব রয়েছে ।আর মহাবিশ্ব সৃষ্টির আধুনিক তত্ত্ব থেকে দেখা যায় ১৩.২ বিলিয়ন বছর আগে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি। মহাবিশ্ব সৃষ্টিরও কয়েকশত কোটি বছর পরে, মাত্র ৪৫০ কোটি বছর আগে আমাদের এই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল।

বিজ্ঞানের তত্ত্বের সাহায্য নিয়ে আমরা আজ থেকে ৫০০ কোটি বা তারও বেশি সময় পরে এই পৃথিবী-সৌরজগতের অবস্থা কেমন হবে সেটাও ভাবতে পারছি। মূলত সৌরজগতের বিবর্তনের বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হবার আগ পর্যন্ত আমাদের কাছে বৃহৎ সময় বলে তেমন কিছু ছিল না বললেই চলে। কিন্তু মহাবিশ্ব সৃষ্টির তত্ত্ব পাবার পর সময়ের অনেক বড় পর্যায় পর্যন্ত আমরা ভাবতে পারি । এমনকি সময় শুরু এবং শেষ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমরা ভাবতে পারি।

অনেক বড় সময়ের পাশাপাশি অনেক ক্ষুদ্র সময় নিয়েও আমরা ভাবতে পারি। এখন আমাদের এক সেকেন্ডের কয়েক কোটিভাগের মধ্যে ঘটে যাওয়া কোয়ান্টাম কণিকার সংঘর্ষের পরিণতি মাপতে হচ্ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে- মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধির সাথে সাথে আমাদের সময়-জ্ঞান দিন দিন বিস্তৃত ও সূক্ষ্ম হচ্ছে।


আরও পড়ুনঃ মহাবিশ্বের ঊষালগ্ন ⇑

Related Articles

5 2 votes
Post Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
Back to top button
0
Rate & Give your feedback!x
()
x

পুলিন বকসী: প্রথমত শহীদ সাহেবের ডান পন্থার কারনে ভাসানী তার বিরোধীতা করেন নি। শহীদ সাহেবের তীব্র আমেরিকা প্রীতিই (সিয়াটো-সিন্টো চুক্তি) ন্যাপ গঠনের অনেকগুলো কারনের অন্যতম কারন।

দ্বিতীয়ত আপনি যেভাবে তাকে আইয়ুব খানের একজন প্রায় 'দালাল' বা 'চাটুকার' বানায়া দিলেন সেই ভাসানীই কিন্তু ৬৯ এ ব্যপক ভূমিকা রেখেছিল শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে। শুধু তাই না এই উনসত্তরের আন্দোলনের শুরুটাও ভাসানীদের হাত ধরে।

ধন্যবাদ।

Farid Ahmed: আমি বহু জনকে জিজ্ঞেস করেছি, কেউ আমাকে সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারে নাই কেনো মওলানা ভাসানী আইয়ুব খানের প্রতিনিধি হিসাবে চীনে গিয়েছিলেন। আশা করি আপনি আলোকপাত করতে পারবেন এ ব্যাপারে। তাঁর আইয়ুব প্রীতি আমার আবিষ্কার না। ষাটের দশকেই এ নিয়ে বিস্তর কথা উঠেছে। আমি আগের একটা লেখায় সব রেফারেন্স দিয়েছি। আমি ভাসানীকে এখনও দালাল কিংবা চাটুকার বলি নাই, যদিও বলা উচিত ছিলো আমার।

১৯৮৬-৮৭ সালে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন জালাল আহমেদ। ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি এরশাদের সাথে হাত মেলান। এরশাদ তাঁকে অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশ মিশনে সেকেন্ড সেক্রেটারি পদে নিয়োগ দেয়। জালাল আহমেদ সংগোপনে তাঁর গোপনে বিয়ে করা বউকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমান। এখন পর্যন্ত এই অপরাধে ছাত্রদল তাঁকে দালাল বলে। আমরাও তাঁকে এরশাদের দালালই বলতাম। দালালকে তো দালালই বলা লাগে, তাই না?

Marzia Prova: ফরিদ ভাই আইয়ুব শাসনের আমলে পাকিস্তানের জোরদার উন্নয়ন দেখা যাচ্ছিল৷ ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এর আগে তার উন্নয়নের দশক পালন করার প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছিল। ভাসানীর কথা ছিল, "পশ্চিম পাকিস্তান যদি পূর্ব পাকিস্তানের উপর শোষণ না বন্ধ করে, তবে পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম।" এখন তথাকথিত আইয়ুবের উন্নয়ন পূর্ব বাংলাতেও হয়েছিল। শোষণের বিপরীতে এই উন্নয়নকে যদি সফলতা হিসেবে দেখা হয়, তবে ভাসানী একজন পাকিস্তান নাগরিক হিসেবে সফল শাসক এর প্রতি মুগ্ধতা ছিলেন! তাই নয় কি?

আপনি জাস্ট এই বিষয়টা এখনকার বাংলাদেশের সাথে মিলান। উন্নয়ন দিয়ে সফলতাকে নির্ধারণ বাকি অনেক কিছুকে যখন আড়াল করা হয়, তখনও তো দেশের অনেক মানুষের সেই সফল শাসকের প্রতি মুগ্ধতা থাকে৷ সম্ভবত ভাসানীর আইয়ুব প্রীতি সে জায়গা থেকে। জাস্ট আপনার লেখা আর কমেন্ট পড়ে এইটা মনে হইল। এই মানসিকতা অবশ্যই দ্বান্দ্বিক এবং স্ববিরোধী কোন সন্দেহ নাই৷ হয়ত এই মানসিকতা না থাকলে ভাসানী অন্যভাবে স্মরণীয় থাকতেন।

Farid Ahmed: আইয়ুব খানের সাথে মওলানার ওই উন্নয়নমূলক মুগ্ধতার সম্পর্ক ছিলো না। উনি ৬৩-তে সরকারী একটা ডেলিগেশন টিমের প্রধান হিসাবে চিনে যান। আইয়ুব খান সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে তাঁর বিন্দুমাত্র বিবেকে বাধেনি, যেখানে ৬২-তে বিশাল এক ছাত্র আন্দোলন হয়ে গিয়েছিলো আইয়ুব খান সরকারের গণবিরোধী শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে।


মওলানা ভাসানী ৬৯ এ ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে। শুধু তাই নয়, এই উনসত্তরের আন্দোলনের শুরুটাও ভাসানীদের হাত ধরে। তাহলে তাকে আইয়ুব খানের একজন প্রায় 'দালাল' বা 'চাটুকার' হিসেবে দেখাটা কি যৌক্তিক?

এই বক্তব্যের মূল কারণ হচ্ছে আমি আমার লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে মওলানা ভাসানী আইয়ুব খানের প্রতি সহানুভুতিশীল ছিলেন, তাঁর সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে চীন গমন করেছিলেন এবং ১৯৬৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন দেবার প্রতিশ্রুতি দেবার পরেও মওলানা ভাসানী গোপনে আইয়ুব খানকে সমর্থন দিয়েছিলেন।

এই অভিযোগটির লজিক্যাল ফ্যালাসিটা আগে বলি। তারপর আমি আইয়ুবের সাথে ভাসানীর সখ্যতা ব্যাখ্যা করবো।

ঊনসত্তরে মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন, ঊনসত্তরের আন্দোলনের তাঁর দুর্দান্ত ভূমিকা ছিলো, এই তথ্য দিয়ে কি তাঁর অন্য কাজগুলোকে জাস্টিফাই করা যায়? যায় না। আমি গতকাল একটা অপরাধ করেছি, আর আজকে একটা ভালো কাজ করেছি। এখন যদি আমি যুক্তি দেই যে আমি তো আজকে ভালো কাজ করেছি, তারপরেও আমাকে আপনারা অপরাধী বানিয়ে দিলেন, সেটা কেমন লাগবে আপনাদের কাছে? তিনি তেষট্টিতে আইয়ুবের প্রতিনিধি হিসাবে চীনে গেছেন, এই অভিযোগ ঊনসত্তরের ভূমিকা দিয়ে আড়াল করাটা আর যাই হোক না কেনো যুক্তিসঙ্গত কোনো কাজ হতে পারে না। ঊনসত্তর নয়, মূলত আটষট্টি সাল থেকে আইয়ুবের সমালোচনায় নামেন মওলানা ভাসানী। কিন্তু তেষট্টি থেকে আটষট্টির আগ পর্যন্ত তাঁর ভূমিকা কী আইয়ুবের ব্যাপারে? আসুন, ইতিহাস থেকে দেখি আমরা তিনি কী করেছিলেন সেই সময়ে।

১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসের ৭ তারিখে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার মির্জা দেশে মার্শাল ল জারি করেন। তিনি যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং আইয়ুব খানকে সুপ্রিম কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ দেন। ইস্কান্দার মির্জার দুর্ভাগ্য, এর মাত্র তিন সপ্তাহ পরে অক্টোবর মাসের ২৭ তারিখে আইয়ুব খান তাঁকেই উৎখাত করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নেন। ইস্কান্দার মির্জা মার্শাল ল জারি করার পর ১২ তারিখে নিরাপত্তা আইনে মওলানা ভাসানীকে বন্দি করেন। দীর্ঘ চার বছর তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন।

১৯৬২ সালের ৩রা নভেম্বর তাঁকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর পরই তিনি আইয়ুব খানের সাথে দেখা করেন, যেটা প্রবলভাবে সমালোচিত হয়। দেওয়ান শামসুল আরেফিন তাঁর, “Bhashani, the maulana Bhashani, the comrade” বইতে লিখেছেন,

“After more than four years in prison, the Moulana was released on November 3 1962. A few days after his release, he met with President Ayub in Rawalpindi. The Ayub-Bhashani meeting created a mixed reaction among the left political circles.”

আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের সময় পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় মিত্র ছিলো যুক্তরাষ্ট্র। চীনের সাথে পাকিস্তানের সীমান্ত নিয়ে বেশ ঝামেলাই ছিলো বলা চলে। সীমান্ত বিরোধ নিয়ে ১৯৫৯ সালে চীনের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। দুই পাশে দুই শত্রু দেশ ভারত এবং চীনকে পুষে রাখাটা খুবই ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ এই বিবেচনা থেকে চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের দিকে অগ্রসর হয় পাকিস্তান। এর জন্য অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের রোষেরও শিকার হয় পাকিস্তান। কিন্তু, তারপরেও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীনকে প্রাধান্য দেবার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান। ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো চীন সফর করেন।

পঞ্চাশের দশক থেকেই মওলানা ভাসানীর সাথে চীনের সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো রাজনৈতিক কারণে। চীনের সাথে সম্পর্ক আরো দৃঢ় করার জন্য মওলানার সাহায্য কামনা করেন তিনি। ১৯৬৩ সালের অগাস্ট মাসে তিনি মওলানাকে রাওয়ালপিণ্ডিতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। পত্র-পত্রিকাতে আইয়ুব-ভাসানী আঁতাতের খবর প্রকাশিত হতে থাকে। ভাসানী এগুলোকে ‘স্বার্থান্বেষী মহলের ছড়ানো গুজব’ বলে উড়িয়ে দেন।

এই আঁতাত যে গুজব না, সেটা টের পাওয়া যায় পাকিস্তানের প্রেরিত ডেলিগেশন টিমের প্রধান হওয়ার মধ্য দিয়ে। জাতীয় স্বার্থে তিনি এই দলের প্রধান হিসাবে চীনে যাচ্ছেন বলে তিনি জানান।

সেপ্টেম্বর মাসের ২৫ তারিখে ঢাকা থেকে প্রথমে করাচি যান তিনি। সেখান থেকে রেঙ্গুন হয়ে চীনে পৌঁছান মওলানা ভাসানী। পিকিং এ উষ্ণ অভ্যর্থনা পান তিনি। চীনের প্রিমিয়ার চৌ এন লাই এর সাথে সাক্ষাতে আইয়ুবের সরকারের জন্য সমর্থন প্রত্যাশা করেন তিনি। তিনি বলেন,

“I am old, perhaps I will not have another chance to come to china; I hope you and your country’s government can fully work together with Ayub khan’s government and his representative General Raza.”

চীনের যাবার সুযোগ তাঁর আরেকবারও হয়েছিলো। যদিও পরবর্তী এই সফর খুব বেশি প্রচারণা পায়নি। দেওয়ান শামসুল আরেফিন তাঁর বইতে লিখেছেন,

“Abdul Hamid Khan Bhashani paid another low-profile visit to China in 1964. The second visit was, in fact, more significant than the first one. This time he had exclusive talks with Chairman Mao, Premier Chou and other leaders including Den-Tsiao-ping.”

অগাস্ট মাসে রাওয়ালপিণ্ডিতে আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাৎ, তার মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে সরকারী প্রতিনিধি দলের নেতা হয়ে চীন সফর অন্য দল এবং নিজের দলের মধ্যেও তীব্র সমালোচনার সুত্রপাত ঘটায়। ন্যাপ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পিকিংপন্থী অংশ ভাসানীর নেতৃত্বে থেকে যায়, অন্যদিকে মস্কোপন্থী অংশ কমরেড মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে আলাদা হয়ে যায়।

পিকিং থেকে ফিরে আসার পরে শুধু মওলানা ভাসানী একাই নন, চিনপন্থী কম্যুনিস্টদের একটা বড় অংশ আইয়ুব খানের ভক্ত বনে যায়। আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের মহিমা কীর্তন করা শুরু করেন তারা। বাষাট্টির এতো বড় ছাত্র আন্দোলনের পরে যেখানে আইয়ুবের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার কথা ছিলো তাঁর, সেখানে তিনি আইয়ুব খানকে বিরক্ত না করার সিদ্ধান্ত নেন। ডক্টর নুরুন নবী তাঁর “Bullets of ‘71: A freedom fighter’s story” বইতে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন,

“After that visit, Moulana Bhashani declared his infamous policy statement, “Don’t disturb Ayub”. Bengali people were stunned. That was the biggest mistake of Moulana Bhashani’s political career.”

তারিক আলী চীনপন্থী বাম ছাত্রনেতা ছিলেন। তাঁর একটা বই আছে। বইটার নাম “Pakistan, military rule of peoples power”। বইটা প্রকাশিত হয়েছে দিল্লি থেকে ১৯৭০ সালে। এই বইতে তারিক আলী পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সাথে মাওলানা ভাসানীর নিবিড় সখ্যের কারণ অনুসন্ধান করে তার পটভূমি আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি তাঁর বইতে লেখেন, ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইউব খান মাওলানা ভাসানীকে পাকিস্তানের সরকারী প্রতিনিধি করে চীনে পাঠাতে চাইলে মাওলানা রাজি হন। সেখানে চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুং এর সাথে তাঁর যে গোপন সলাপরামর্শ হয় তার একটা বিবরণ তিনি মাওলানার কাছ থেকেই গ্রহণ করেছিলেন টেপ রেকর্ডারে।

তারিক আলী মওলানাকে প্রশ্ন করেছিলেন, “When you went to China what did Mao discuss with you when you met him?” এর উত্তরে মওলানা বলেছিলেন,

“মাও সে তুং আমাকে বলেন, “আপনি যদি সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন তাতে রাশিয়া, আমেরিকা এবং ভারতের হাতই শক্তিশালী হবে। আপনার কাজে হস্তক্ষেপ করা আমাদের নীতি বিরুদ্ধ, তথাপি আমরা আপনাকে সাবধানে এবং ধীর গতিতে আন্দোলনে অগ্রসর হতে অনুরোধ করবো। আপনার সরকারের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব আরো গাঢ় করার সুযোগ দিন।”

আগেই বলেছি, চীন থেকে ফিরে আসার পরেই মওলানা এবং তাঁর অনুসারীরা আইয়ুব খানের ভক্ত হয়ে যায়। সাপ্তাহিক ‘জনতা’ ছিলো ন্যাপের মুখপত্র। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন আনোয়ার জাহিদ। তিনি তখন ভাসানীর ব্যক্তিগত সচিব। আনোয়ার জাহিদ নিজেও আশির দশকে সামরিক শাসক এরশাদের দালালি এবং গোলামি করেছেন। তাঁকে সবাই ঝাঁড়ুদার মন্ত্রী হিসাবেই চিনতো। কারণ, তিনি একবার প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, এরশাদ যদি বলে, তবে তিনি রাস্তা ঝাঁড়ু দিতেও আপত্তি করবেন না। এই আনোয়ার জাহিদ ১৯৬৫ সালে সাপ্তাহিক জনতায় লেখেন, “There were only two Imperialist voices in Pakistan – Ayub and Vashani.”

আনোয়ার জাহিদের বক্তব্য পরিষ্কার, তিনি তাঁর নেতা এবং আইয়ুব খানকে একই কাতারে দেখেছেন। মওলানা ভাসানীর এই সামরিক শাসকের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের ফলাফল কী হতে পারে, সে সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মফিদুল হক লেখেন,

“১৯৬৩ সালে কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর জেনারেল আইউব আয়োজিত চীন সফরের পর থেকেই মাওলানা ভাসানীর পদস্খলন ঘটতে থাকে। চীনা রাষ্ট্র-নেতাদের আত্মস্বার্থ-প্রণোদিত নীতির কাছে মাওলানা ভাসানীর আত্মসমর্পণ এদেশের বাম রাজনীতির জন্য বিরাট দুর্ভাগ্যের সূচনা করে। রাজনৈতিক বিভ্রান্তি থেকে তিনি যে পথে পা দিয়েছিলেন তা শুধু আইউবের শাসনের সহায়ক ভূমিকা পালন করেনি, মাওলানা তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে সামরিক শাসকচক্রের যে সংযোগ গড়ে ওঠে তা পরবর্তী সময়েও বহু দুর্ঘটনার কারণ হয়েছিল।”

মওলানার নিজের দলের লোক হাজী দানেশও মওলানার সাথে আইয়ুব খানের সমঝোতা ছিলো বলে মনে করেন। এ কারণে আইয়ুবের বিরুদ্ধে তিনি বাম শক্তিগুলোকে একত্রিত করেননি বলে অভিযোগ করেন তিনি। হাজী দানেশ ছিলেন ন্যাপের সহ-সভাপতি। মওলানার সাথে তাঁর কোন্দল এমন পর্যায়ে যায় যে তিনি সহ একটা বিরাট অংশ ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে ন্যাপ থেকে বের হয়ে যান। ১৯৭১ সালের ৮ই জানুয়ারি হাজী দানেশ এক খোলা চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে তিনি বলেন,

“আপনি বিশ্বাস করতেন যে ইস্কান্দর মির্জা ও আইউব খান দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করবে। আইউবের বিরুদ্ধে বামপন্থী শক্তিগুলোকে সংগঠিত করার ব্যাপারে আপনার অনীহা এটাই প্রমাণ করে যে, শোষক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে আপনার যোগ ছিল। আমি এটা বিশ্বাস করতে পারিনা যে, আপনার ও ন্যাপের এ ধরনের নীতির মাধ্যমে লাখ লাখ শোষিত মানুষের মুক্তি আসবে।”

 

Masudur Rahman: ১৯৭০-এর জানুয়ারিতে সন্তোষে কৃষক সম্মেলনে মাওলানা ভাসানী আরও বললেন, ‘আমাদের ভাগ্য আমাদেরই গড়ে নিতে হবে। পিন্ডির গোলামি ছিন্ন করতে হবে।’ ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বরের বঙ্গোপসাগরীয় সাইক্লোনের প্রেক্ষাপটে উনি আবার সরাসরি বললেন ‘স্বাধিকার স্বায়ত্তশাসন নয়, চাই স্বাধীনতা।’

ফরিদ, তোমার লেখা আমি গুরুত্ব সহকারে পড়ি; অনেক কিছু জানতে পারি, শিখতে পারি। কোন মানুষই ভুলের উর্ধ্বে নন, যেমন ভাসানী। কিন্তু, তাই বলে তাকে আইয়ুব ইয়াহিয়ার সহচর বানিয়ে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিলে! মওলানা ভাসানীকে নিয়ে তোমার লেখাগুলি পড়ে আমি সত্যি হতাশ!

Farid Ahmed: আমিতো কোনো সিদ্ধান্ত দেই নাই। সবই কোট করেছি আমি। তিনি আইয়ুবের সহচর ছিলেন, এই অভিযোগ তখনই উঠেছে।

আমার বিশ্লেষণ আমি বলতে পারি। যে আইয়ুব ক্ষমতা দখল করে তাঁকে কারাগারে পাঠালো, তিনি কারাগার থেকে বের হয়ে সেই আইউবের প্রতিনিধি হয়ে চীন যান ঠিক কী কারণে? কোন স্বার্থে? আপনি আমাকে একটা মাত্র যৌক্তিক কারণ বলবেন মাসুদ ভাই এ ব্যাপারে। আমি দ্বিতীয় যুক্তিও শুনতে চাইবো না।

তিনি সিআইএ-র রিপোর্ট ইয়াহিয়াকে দিয়েছেন? কেনো? যেখানে তিনি নিজেই বলছেন এই দলিলে দেখা যাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার ষড়যন্ত্র চলছে। উনি কি বিচ্ছিন্নতার বিপক্ষে ছিলেন? বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার একেকজনের একেক ধরনের কর্মপন্থা ছিলো, সেই পন্থা নিয়ে সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু এই দলিল হস্তান্তর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষেই তাঁকে দাঁড় করিয়ে দেয়।

ভাসানী একজন স্ববিরোধী মানুষ ছিলেন। উনি স্বাধীনতার পক্ষেও বহু কথা বলেছেন, আবার বিপক্ষেও বলেছেন। আপনারা শুধু পক্ষেরটা জানেন, বিপক্ষেরটা না। আমি উনি স্বাধীনতার বিপক্ষে কী কী বলেছেন সেগুলো নিয়েই আরেকটা লেখা লিখবো দুই একদিনের মধ্যেই।

Swapan Mahmud: "পাকিস্তান ওয়ালাইকুমআসসালাম" এটাই স্বাধীনতার প্রথম প্রতীকী ঘোষণা।

Farid Ahmed: ওই এক তথ্য নিয়েই পড়ে থাকেন। মোল্লাদের অন্ধত্ব এবং একদেশদর্শীতা আমাকে পীড়া দেয় না, কিন্তু, আপনাদেরটা দেয়। কারণ, প্রগতিশীল বলে দাবি করেন আপনারা। দাবি করেন, অথচ সব তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে আসেন না। পূর্বানুমান সিদ্ধান্ত নিয়েই বসে থাকেন।

১৯৬২ সালে ছাত্ররা আইউব খানের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করেছিলো শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে। ভাসানী কি জানতেন না যে এই দেশের ছাত্র এবং জনগণ আইউব জান্তাকে বাতিল করে দিয়েছে? সেই জান্তার প্রতিনিধি হিসাবে ১৯৬৩ সালে তিনি চীনে যান কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর আপনাদের মতো বায়াসড লোক কোনো দিনই দিতে পারবেন না, খালি ওই এক ওয়ালাইকুম সালাম নিয়েই পড়ে থাকবেন আপনারা।

Masudur Rahman: খন্ডিত বিশ্লেষণ করে প্রমান করা যাবে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য '৭০ এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন নাই। একটি বিষয় অন্তত আমার কাছে পরিষ্কার, ভাসানীর তুমুল জনপ্রিয়তা থাকা সত্যেও ক্ষমতার লোভ তার ছিল না। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে উনিও কষ্ট পেতেন ভাসানীর এই পোস্টমর্টেম দেখে কারন উনি জানতেন উনার বঙ্গবন্ধু হওয়া পিছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশী। বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা থেকে মুক্ত করার জন্য যে গন আন্দোলনের দরকার ছিল, তা ভাসানী ছাড়া আর কে করতে পারতেন? তুমি তো ১৯৬৩ সনেই আটকে থাকলা, ফরিদ!

Farid Ahmed: উনার সামরিক শাসক সখ্যতা নিয়ে বিস্তারিত আমি লিখেছি মাসুদ ভাই। শুধু ৬৩-তে আটকে থাকিনি। যদিও ওইটাই সবচেয়ে ভাইটাল মুহুর্ত। কোন কারণে তিনি আইয়ুবের প্রতিনিধি হয়ে চীনে গিয়েছিলেন, সেটা জানাটা খুবই জরুরী আমাদের জন্য। মওলানা বাদে অন্য কেউ হলে আমি এক বাক্যে তাঁকে আইয়ুবের দালাল বলে দিতাম। ব্যক্তিটা উনি বলে আমি এখনো এর একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা খুঁজছি।

১৯৭২-১৯৭৬

মওলানা ভাসানী ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক হক-কথা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করলেও মুজিব সরকারের জাতীয়করণ নীতি এবং ১৯৭২-এর সংবিধানের এর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। ১৯৭৩ সালে খাদ্যের দাবিতে ঢাকায় ১৫-২২ মে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ১৯৭৪-এর ৮ এপ্রিল হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি গঠন করেন। একই বছর জুন মাসে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলে টাঙ্গাইলের সন্তোষে গৃহবন্দি হন। ১৯৭৬-এর ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লং মার্চে নেতৃত্ব দেন। একই বছর ২ অক্টোবর খোদাই খিদমতগার নামে নতুন আর একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

— উইকিপেডিয়া থেকে

Supik Anwar: ৫০ বছর ধরে বহুমাত্রিক ভাবে গন মানুষ এর রাজনীতি করা একজনকে শুধু কয়েক বছরের রাজনীতি দিয়ে মুল্যায়ন কতটুকু যুক্তিযুক্ত!? ঐ সময়ে উনি হাসপাতালে ছিলেন।পরে ভাসানী হাসপাতালে থাকা অবস্তায় মোশতাক উনাকে একদিন দেখতে গিয়েছে। তখন উনি মোশতাককে বলেছিলেন "আমার মুজিবররে তোমরা মাইরা ফেললা"!

Farid Ahmed: আপনি আপনার রেফারেন্স দেন। আর আমি আমার রেফারেন্স দিচ্ছি।

Supik Anwar: একজন সাংবাদিক (নামটা মনে পড়ছে না) উপস্থিত ছিলেন অই সময়। পরে উনি সহ সবাইকে রুম থেকে বাইরে যেতে বলেন মোশতাক। মোশতাক বেশ কিছুক্ষণ ভাসানীর সাথে একান্তে কথা বলে।এগুলা ভাসানীকে নিয়ে লিখা একটা কলামে পড়েছিলাম।মনে হয় ইরফানুল বারীর। আর ৭৫ এর পর উনি অনেক অসুস্থ ছিলেন। এই সুযোগ এ মোশতাক তার লেজেটিমিসির জন্য উনাকে ব্যবহার করেছে। আর জাতির জনক কে উনি কথটা পছন্দ করতেন সেই কথা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আছে। এছাড়া উনি মোশতাক ১ং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক থাকার পর ও তাকে ডিঙিয়ে মুজিবকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করেন সামশুল হক এর অনুপস্থিতিতে। আর আগরতলা মামলায় তার প্রিয় মুজিবরকে জেল থেকে বের করার হুংকার এবং তার ফলাফল তো জানাই আছে।

Farid Ahmed: এটা কোনো রেফারেন্স হলো? আসেন এর বিপরীতে আপনাকে রেফারেন্স দেখাই। কয়েকটা পত্রিকার কাটিং দেখাচ্ছি। কারো মুখের কথার চেয়ে পত্রিকা অনেক বিশ্বাসযোগ্য।

doc

Supik Anwar: মওলানা ভাসানীকে নিয়ে কয়েকটা কৌতুহল জাগানো প্রশ্ন পেলাম, এমনকি আমার লেখা শেয়ার করা কিছু মানুষও এই সব মন্তব্য পেয়েছেন দেখলাম। একটা প্রশ্ন হলো, ভাসানী ১৫ অগাস্টের হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করেছেন। মোশতাককে সমর্থন দিয়েছেন। জিজ্ঞেস করলাম, জেনেছেন কোথায়?

— তখনকার দৈনিক পত্রিকায়। বড় করে ছাপা হয়েছে তো।

— কিন্তু তখন যে চারটা মাত্র পত্রিকা আমাদের খবরের উৎস, সেগুলো তো এর আগেই বাকশাল সরকার সরকারী মুখপাত্র বানিয়ে বাকি সবগুলো পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলো। মাওলানার প্রতিষ্ঠিত হক কথাকে নিষিদ্ধ করেছিল ১৯৭২ সালেই। ফলে মোশতাকের আমলে যে তথ্য আমরা খবরের কাগজ সূত্রে পেলাম, সেগুলোর নির্ভরযোগ্যতা কী? কিংবা, এইভাবে গণমাধ্যম কবজা করার পরিণাম যে মানুষের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের সুযোগ এবং অভ্যাস দুটোই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল বাকশালের মাধ্যমে, চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে, আরো নানান সব নিপীড়নমূলক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে, এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হলো যে দিনে-দুপুরে রক্ষীবাহিনীর হাতে খুন হলেও সে খবর আর পত্রিকায় ছাপা হবে না, যে হাতিয়ারগুলো ব্যবহার করেই মোশতাকের মন্ত্রীসভায় লীগের নেতাদের স্বেচ্ছায় কিংবা বলপ্রয়োগে অংশ নেয়ানো হলো, তার নিন্দা কখনো করেছেন? ৯৫ বছরের বুড়ো ভাসানী ১৫ অগাস্টের বহু আগে থেকেই গৃহে অন্তরীণ ছিলেন। এই বয়োবৃদ্ধ মানুষটিকে কারা গৃহবন্দি করে রেখেছিল? তার নিন্দা করেছেন? সেই ঘরে আটকে থাকা, দুনিয়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারিতে আটকে রাখা অসুস্থ মানুষটাকে হাসপাতালে মোশতাক দেখতে গিয়েছিলেন, আওয়ামী নেতাদের মত তিনি বঙ্গভবনে গিয়ে মোশতাককে সমর্থন জানান নাই। এই ছবিটিই ফলাও করে পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, এবং পত্রিকাতে বাকি সব যা জানি সেটাও বাকশালের সংস্কৃতিতে কবজা করা পত্রিকার ভাষ্য, ভাসানী কি বলেছেন তা সেখানে কিভাবে মিলবে?

অভিযোগ করার আগে অভিযোগের প্রেক্ষাপটা তাই মনে রাখলে বোঝা যায়, অভিযোগকারীই ভয়াবহ একটা পরিস্থিতির সমর্থক, যেখানে কারও মতামত জানারও উপায় ছিল না, এমনই ভয়াবহ ছিল বাকশালি শাসন। তবুও ভাসানী কী মনে করতেন, সেটা জানতে ভাসানীর ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বাসযোগ্য মানুষদের কাছেই যেতে হবে। তাদের অনেকের কাছেই শুনেছি, নিজের সমর্থকদের ওপর এত নিপীড়নের পরও, আওয়ামী লীগের এত গণবিরোধী অবস্থানের পরও ভাসানী ১৫ অগাস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে দারুণ ব্যাথা পেয়েছিলেন। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক বিরোধিতা তিনি যতই করুন না কেন, তাকে পুত্রের মতই দেখতেন। প্রতিহিংসাপরায়ণ তিনি ছিলেন না, যদিও জনগণের বলপ্রয়োগে গভীর আস্থা পোষণ করতেন। সেই বলপ্রয়োগের স্মরণীয়তম দৃষ্টান্তটার কথাই বরং বলি।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাতেই হয়তো শেখ মুজিবুর রহমানের ফাঁসি হয়ে যেতো বঙ্গবন্ধু উপাধি পাবার আগেই; কেউ তাকে উদ্ধার করার সাহস কিংবা স্পর্ধা দেখায়নি, বন্দি ছিলেন তিনি ঢাকা সেনানিবাসে। '৬৯ এর প্রবল অভ্যূত্থানের ওপর দাঁড়িয়ে ভাসানী হুমকি দিয়েছিলেন পাক সামরিক জান্তাকে: মুজিবকে না মুক্তি দেয়া হলে জনতাকে নিয়ে তিনি ক্যানটনমেন্ট থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসবেন। আগুন ঝরানো মাওলানা তার নাম এমনি এমনি হয়নি।

এই হলো ভাসানী। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ৫০ বছর পূর্তিতে তার প্রাবল্যকে বুঝতে হলে খুচরো খুচরো প্রশ্ন করে কাজ হাসিল হবে না। অনেক বড় অকৃতজ্ঞতা এবং নিমকহারামি থেকেই ভাসানীকে নিয়ে এই জাতীয় মিথ্যা গুজব মোসাহেবরা ছড়িয়ে থাকে।

— (ফিরোজ আহমেদ)

Farid Ahmed: এটা পড়েন। আগুণ ঝরানো মওলানার আসল পরিচয় পাবেন। মুদ্রার অপর পিঠের মওলানা ভাসানী : জাফর ওয়াজেদ ↑। অলি আহাদের একটা বই আছে। বইটার নাম হচ্ছে, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-১৯৭৫। সেই বইতেও শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডে ভাসানীর সমর্থনের কথা বলা আছে। ভাসানী হাসপাতালে ভর্তি হন নভেম্বরের ২১ তারিখে। তিনি তারবার্তা পাঠান শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরের দিনই। তখন তিনি সন্তোষে। হাসপাতালে তিনি খন্দকার মোশতাককে কী বলেছেন, সেটা কোনো পত্রিকায় আসেনি। তিনি যে খুনি সরকারকে অভিনন্দিত করেছেন, তাদের সমর্থন জানিয়েছেন, এগুলো সব পত্রিকাতেই এসেছে। তাঁর নামে এগুলো বানানো খবর হলে তিনি অবশ্যই আপসেট হতেন এবং এগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। এদেরকে সহযোগিতা দিতেন না। বাস্তবে কিন্তু তা হয়নি। ফারাক্কা লং মার্চের সামনের সারিতে তিনি ছিলেন। কিন্তু, এর পিছনের পুরোটাই সায়েমের অবৈধ সরকার তথা জিয়াউর রহমান ছিলো।

doc

Supik Anwar: শুধুমাত্র পত্রিকার কয়েকটি লিখার উপর ভিত্তি করে উনাকে বারবার কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন তাতে কি সঠিক ইতিহাস প্রতিফলিত হচ্ছে!? যেই মানুষ সারা জীবন এই অঞ্চল এর মানুষকে নিয়ে মুক্তি সংগ্রাম করেছেন সেই আসাম থেকে বাংলা। কংগ্রেস থেকে বের হয়ে চিত্তরঞ্জন দল, তার পর মুসলিম লীগ এর সাথে পাকিস্তান আন্দোলন, জমিদার বিরোধী আন্দোলন , ভাষা সংগ্রাম, কৃষক আন্দোলন, লাইনপ্রথা, আওয়ামীলীগ সৃষ্টি, যুক্তফ্রন্ট, পাকিস্তানকে ওলাইকুম বলা, কাগমারী সন্মেলন, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতা, ১৯ দফা,৬৯ এর গন-আন্দোলন, ৭০ এর প্রলয়কারী তুফান, ইলেকশন এ আওয়ামীলীগকে সমর্থন, স্বাধীনতা সংগ্রাম,লং মার্চ সহ আরো মাটি ও মানুষের জন্য অনেক সংগ্রাম করা মানুষকে ইতিহাস এর ক্রনলজিকাল পাঠ না করে শুধুমাত্র কয়েকটি ঘটনার খণ্ডিত পাঠ ইতিহাসকে অবজ্ঞা করার মতই।

রেফারেন্স —
মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডের খবর শুনে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ঘটনার কয়েক দিন পর তিনি চিকিৎসার জন্য পিজি হাসপাতালে ভর্তি হন। এ সময়ে খোন্দকার মোশতাক আহমদ তার সরকারী স্টাফদের সাথে নিয়ে হুজুরের সংগে দেখা করেন। সেই বহরে সাবিহউদ্দীন আহমদও ছিলেন। তিনি তখন তার পি আর ও ছিলেন। আমি হুজুরের কেবিন কক্ষেই ছিলাম। এর একটু আগেই ফনি ভূষণ মজুমদার তার কেবিনে ফিরে গেছেন। তিনি দিনে একবার হলেও হুজুরের শরীরের খবর নিতে আসতেন। হুজুরের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও ভক্তি দেখে অবাক হয়েছি। কেবিনে ফিরে যাবার সময়ে তিনি আমাকে হুজুরের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলতেন। হুজুরের শরীর তখন খুবই খারাপ ছিলো। এখানে আসার আগে তিনি কুমুদিনী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। খোন্দকার মোশতাক কেবিনে ঢুকলে হুজুর তার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকান। বসতেও বলেননি। এক সময়ে তিনি বলেই ফেললেন "আমার মজিবরকে তোমরা মেরেই ফেললে!" তিনি ক্ষোভের সঙ্গে তাকে আরো বলেন "দুই আনার মুড়ি খেয়ে সারাদিন দলের কাজ করেছে আর তোমরা নেতা হইছো!" রাগ ও ক্ষোভের মাত্রা বাড়তে থাকলে এক সময়ে মোশতাক আমাকে একটু বাইরে যেতে,বলেন। আমি হুজুরের ঔষুধ দিয়ে বরান্দায় এসে দাঁড়াই। চলবে... [একুশে পদক প্রাপ্ত ছড়াকার আবু সালেহ্ এর টাইম লাইন হতে]

মোস্তাককে সমর্থন দেয়ার বরাত সরকারী প্রচার মাধ্যম। তখন দেশের পত্রিকার সংখ্যা ছিল ৪টি এবং ৪টিই সরকারী। এ অবস্থায় ১৫ আগস্টের পরপর যখন বিবৃতিটি প্রকাশিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে, তখন সরকারি মালিকানাধীন দৈনিকের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে স্বাভাবিক কারণেই। শুধু তা-ই নয়, মওলানা ভাসানীর কথিত বিবৃতিটি উদ্ধৃত করা হয় ‘বিশ্বস্ত সূত্রের’ বরাত দিয়ে। সততা ও সদিচ্ছা থাকলে বিশেষ দৈনিকটি থেকে সরাসরিই বিবৃতিটি উদ্ধৃত করা সম্ভব ছিল এবং ইতিহাস গবেষণার দৃষ্টিকোণ থেকে তেমনটি করা প্রয়োজনও ছিল। কিন্তু সহজবোধ্য কারণে দৈনিকটির নাম পর্যন্ত বলা হয় না বরং আশ্রয় নেয়া হয় ‘বিশ্বস্ত সূত্রের'।
[শাহ আহমদ রেজা]

Farid Ahmed: আপনি ঝোপে ঝাড়ে বাড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছেন। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরেও মওলানা ভাসানী রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, রাজনীতির মাঠে ছিলেন। কারণ, ফারাক্কা মিছিলের মতো বিশাল এক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তাঁর মতো সাহসী লোক নিশ্চয় ময়দানে প্রতিবাদ করেছেন, মিছিল মিটিং করেছেন। জাস্ট, কোনো একটা পত্রিকার একটু কাটিং দেখান আমাকে এ ব্যাপারে। আমি সবই পাঠ করেছি। এই লোক শেষবেলায় একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করাতো দূরের কথা, বরং সেটাকে সমর্থন করেছেন। এটাও ইতিহাস পাঠেরই অংশ।

Adil Mahmood: ভাসানী যে রকম ফ্লিপ ফ্লপ স্ববিরোধী আচরণ পাকিস্তান আমল থেকে করে গেছেন ওনার পক্ষে ব্যাক্তিগত পর্যায়ে মোশতাককে এই ধরনের কথা বলা এমন কিছু অসম্ভব না। এতে কোন সন্দেহ নাই যে রাষ্ট্রপ্রধান মুজিবের প্রতি তার গভীর বিরাগ থাকলেও ব্যাক্তি মুজিবকে উনি আজীবনই স্নেহ করে গেছেন। ব্যাক্তি মোশতাককে তোমরা এইটা কি করলা বলা এবং একই মোশতাকের সরকারকে অভিনন্দন জানানও অন্তত মাওলানার পক্ষে অসম্ভব কিছু না। সরকার ষড়যন্ত্র করে বিবৃতি ছাপিয়েছে এই ধরনের যুক্তিতে ৭৫ এর পর রাতারাতি ভোল পালটানো সবাই সাফাই গাইতে পারে এবং গায়। যারা মোশতাক মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়েছিল সে সব লীগ নেতা দাবী করেছে তাদের বন্দুকের মুখে নেওয়া হয়েছিল। ভাসানী ছিলেন পরিষ্কার বঙ্গবন্ধু সরকার বিরোধী সোচ্চার কণ্ঠ এবং লক্ষণীয়ভাবে দিনে দিনে কট্টর দক্ষিণপন্থীতে বিবর্তিত। বঙ্গবন্ধু সরকারের পতনের পর ডানপন্থী মোশতাকের প্রতি তার রাজনৈতিক সমর্থন এমন কি অবাস্তব যে সেটাকে নানান ষড়যন্ত্র তত্ত্ব অমূকে এই শুনেছে সেইই শুনেছে যার ভিত্তিতে সত্য হতে পারে না এইসব দাঁড়া করাতে হবে সেটাই বুঝি না। ভাসানীর পূর্ন ব্যবচ্ছেদ করলে বরং আরও অনেক বিতর্কিত কাজকারবার পাকিস্তান আমল থেকেই দেখা যায় যেগুলির কাছে এই মোশতাক অধ্যায় এমন কিছু না।

বঙ্গবন্ধুর আরেক সিনিয়র রাজনৈতিক কলিগ ৫৬ সালের প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান যার কেবিনেটে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী ছিলেন সেই আতাউর রহমান খান বঙ্গবন্ধুর পতনের পর ১৫ই আগস্ট নাজাত দিবস ঘোষণা করেছিলেন। মজার ব্যাপার হল এই আতা খান সাহেবই মোটে ৪ মাস আগে বঙ্গবন্ধুর নানান গুণগান গিয়ে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। আমার তো মনে হয় বঙ্গবন্ধু আমলেও ওনার নামে সরকারী পত্রিকায় মিথ্যা বিবৃতি দেওয়ানো হয় আর মোশতাক আমলে তো আমরা জানিই যে পত্রিকায় যার নামে যা ছাপা হয়েছিল সবই বানানো।

Swapan Mahmud: ভাষাণী-মুজিব গুরু শিষ্য দুজনই নির্বিশেষে মানুষ।দুজনেরই ভুল ছিল। এখন তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় না রেখে এ বিষয়গুলো মোকাবেলা করতে গেলে বঙ্গবন্ধু কেও আওতায় আনতে হবে। ভিয়েতনাম দিবসে মতিউল-কাদের হত্যা (স্বাধীন বাঙলাদেশে রাজপথে প্রথম হত্যা), কমরেড সিরাজ শিকদার কে পুলিশি হেফাজতে হত্যা (বাঙলাদেশে প্রথম বিচার বহির্ভূত হত্যা),দিন দুপুরে জাসদ অফিস জ্বালিয়ে দেয়া (১৯৭৩)।এই বিষয়গুলোও সামনে নিয়ে আসলে কী জামাত-শিবির বলা শুরু হবে।(বিতর্ক করার জন্য কমেন্ট করছি না এবং এ প্রসঙ্গে আর কোন কথা আমি বাড়াব না)

Farid Ahmed: মুজিবের ভুল নিয়ে তো আমরা কথা বলি। এগুলোর কোনোটাতেই তো তাঁকে ছাড় দেওয়া হয় না। একটা অপরাধকে খণ্ডন করতে যখন আরেকটাকে আনা হয়, তখন আসলে সেই অপরাধকে ঢাকার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। আপনি মুজিবকে বাদ দিয়ে পরিষ্কার করে শুধু ভাসানীর অপরাধকে অপরাধ বলতে পারছেন না কেনো? মুজিবের অপরাধের আলাপ যখন আলাপ করা হবে, তখন না হয় মুজিবকে ধোলাই দেওয়া যাবে। অন্যের অপরাধকে এনে তুলনা কখন করা হয়, সেটা আপনার না জানা থাকার কথা না। তাঁর সরকারের সবচেয়ে কট্টর সমালোচক হবার পরেও, মওলানার ক্ষেত্রে শেখ মুজিব যে উদারতা এবং ভালবাসা দেখিয়েছেন, প্রতিদানে মওলানা তাঁর ধারে কাছেও যেতে পারেন নাই। অথচ বয়োজ্যেষ্ঠ হিসাবে উল্টো ভূমিকাটা নেবার কথা ছিলো তাঁর।

Adil Mahmood: বঙ্গবন্ধু বা মুজিব সরকারের ভুলের কারনে ভাসানীর ভুল যদি ব্যাখ্যা করা যায় তাহলে অবশ্যই স্বাধীন বাংলাদেশে ভাসানীর মূল্যায়নে তৎকালীন সরকারের ভুলগুলিও আমলে আনা উচিত; এতে সমস্যা নাই। কিন্তু তাই বলে ভাসানীর ভুল ব্যালেন্স করার জন্য মুজিব সরকারের ভুলও পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের খাতিরে আনতে হবে তাহলে সেটা যৌক্তিক বিশ্লেষণ বলা যায় ন। এটা হয়ে যায় এখনকার প্রচলিত "অমুক ঘটনার সময় আপনি কোথায় ছিলেন" জাতীয় এগ্রিসেভ ডিফেস। এই ধরনের আক্রমণাত্মক ডিফেন্স সাজানো হয় নিজের পছন্দের দল বা ব্যাক্তির সমালোচনা আড়াল করার লক্ষ্য নিয়ে - আমি হয়ত খারাপ কিন্তু অপরপক্ষ তো আরো খারাপ। সে নিয়ে বল না কেন!

Iftakhar Ahmed Babu: আপনার এই পেপার কাটিং এর সত্যতা পাওয়া যায়নি ৷ সেরকম কোন বিবৃতি পাঠান হয়নি ৷

Farid Ahmed: পেপার কাটিং এর সত্যতা মানে কী বাবু ভাই? পত্রিকায় ছাপা হয়নি এই বিবৃতি, নাকি পত্রিকাওয়ালারা উনার নামে মিথ্যা বিবৃতি লিখেছে?

Iftakhar Ahmed Babu: বঙ্গভবন থেকে কেউ মিস কোট করেছিল ইচ্ছাকৃত ভাবেই l এটা নিয়ে অনেক অনুসন্ধান হয়েছে ৷ যে কোন তারবার্তা রেকর্ড রাখা হয় ৷ খোঁজা হয়েছে , কোন প্রমান পাওয়া যায় নাই ৷

Farid Ahmed: উনি কি এর পাল্টা বিবৃতি দিয়েছিলেন কোনো? অনুসন্ধানটা কাঁরা করেছিলো? সেটার রেফারেন্স কী?

Swapan Mahmud: তারপর দেখা যাচ্ছে খবরটা জানাচ্ছে বাসস।বাসস তো রাষ্ট্রীয় সংস্থা এরা প্রপাগান্ডাও ছড়াতে পারে।

Farid Ahmed: ভাসানী বামপন্থী ছিলেন বলে কি আপনাদের এই অবিশ্বাস? সেটা হলে লজিক্যাল কিছু হলো না। এর পাল্টা বিবৃতি কোথায়, মুজিব হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা করে ভাসানীর কর্মকাণ্ড কী? তিনি কি এর বিরুদ্ধে কখনো কিছু বলেছেন? এগুলো আনতে হবে আপনাদের সামনে। শুধু বাসস, বলেছে বলে অবিশ্বাস করে গেলে পক্ষপাতিত্ব হয়ে যাবে।

Swapan Mahmud: বামপন্থী ব'লে সাত খুন মাফ হ'য়ে যায়না।আমি শুধু একটা সম্ভাবনার কথা বলেছি।অপ্রাসঙ্গিক হ'লেও বলি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথম মিছিল ক'রে ছাত্র ইউনিয়ন।এই কিছুদিন আগে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলছিলেন উনি তখন এক আওয়ামীলীগ নেতার সাথে এ বিষয়ে আলাপ করতে হেলে ঐ নেতা বলেন "সেলিম এখনি মিছিল টিছিল করার দরকার নাই শেষে আওয়ামীলীগ সরকারকেই (মোশতাক ক্যাবিনেট) নিষিদ্ধ করে দেবে।"

Farid Ahmed: আওয়ামী লীগের নব্বইভাগ নেতাই স্বেচ্ছায় কিংবা ভয়ে মোশতাকের সাথে ছিলো। এগুলো প্রমাণিত। এই কাপুরুষদের ডিফেন্ড করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। সেলিম সাহেব যেটা বলেছেন, সেটা যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য।শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে দুজন লোকের করার সামর্থ্য ছিলো। এর একজন হচ্ছে জেনারেল ওসমানী এবং আরেকজন হচ্ছেন মওলানা ভাসানী। এই দুই ব্যক্তির গ্রহণযোগ্যতা ছিলো সারাদেশব্যাপী। দুঃখজনক হচ্ছে, তাঁরা দুজনেই এই কাজটা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

আমি একটা জিনিস দেখাচ্ছি এখানে আপনাদের। এটা সরাসরি কোনো প্রমাণ নয়। কিন্তু, ঘটনাটা তাৎপর্যপূর্ণ। অনেক না বলা জিনিস এখান থেকে বের করে আনা সম্ভব। ২১ তারিখ দুপুরবেলা সন্তোষ থেকে অসুস্থ ভাসানীকে নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। ভর্তি করা হয় পিজি হাসপাতালে। সন্ধ্যাবেলাতেই মোশতাক তাঁকে দেখতে হাসপাতালে যায়। পরের দিন এই খবরটা প্রতিটা সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় গুরুত্বের সাথে ছাপা হয়। ভাসানী যদি এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতেন, মোশতাকের মতো একটা লোকের তাঁর প্রতি এই সৌজন্যতা দেখানোর কথা নয় এবং পত্রিকাগুলোতে এটাকে এভাবে হাইলাইট করারও কথা নয়। আমি শুধু দৈনিক বাংলার খবরটা দিচ্ছি।

mostaq-vasani

রেকর্ডের স্বার্থে আরেক তালেবর পাপা টাইগারের চরিত্রটাও এই সুযোগে তুলে ধরি।

zia-osman

Swapan Mahmud: গোটা আওয়ামীলীগ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একটা প্রতিবাদ মিছিল করলো না।সুর সুর করে মোশতাকপন্থী হয়ে গেল। ওসমানী তো বাকশাল বিরোধীতা করে আওয়ামীলীগ ছেড়ে দিয়েছেন। ভাসানী ও আওয়ামীলীগ এ নেই। দায়ী হয়ে গেলেন তারা। আওয়ামীলীগ বরাবরই নপুংসক ও বিট্রেয়ারদের নেতৃত্ব পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেন ও ভারতে গিয়ে সাহায্য চান কাদের সিদ্দিকী, লতিফ সিদ্দিকী,সুলতান মনসুর। সুলতান ভাই'র কাছে সেই সব দিনগুলোর কথা অনেকবার শুনেছি। আজ তাদের তিনজনকেই আওয়ামীলীগ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তবে আমি জাতীয় চার নেতা, রাজ্জাক, তোফায়েল, সামাদ, আজাদ সহ যারা জেলে ছিলেন তাদের কথা বলছি না।তারা প্রকৃতই দেশপ্রেমী ও বঙ্গবন্ধুর কর্মী ছিলেন।বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথম মিছিল করতে হল বামপন্থি ছাত্র ইউনিয়ন কে। (আপনারা যাদের ঠাট্টা করে বলেন বামাতি) যে দল নিজের প্রতিষ্ঠাতাই শুধু নন জাতির পিতার ও হত্যার প্রতিবাদ করার হিম্মত রাখেনা তাদের কাছে দেশ মাতৃকার কোন মূল্য থাকতে পারেনা!

Farid Ahmed: আপনার এই পুরো বক্তব্যটাই অযৌক্তিক, অপ্রাসঙ্গিক এবং অপরিসীম খেদোক্তির বহিঃপ্রকাশ মাত্র । আমরা আওয়ামী লীগ নিয়ে আলোচনা করছি না, বা আওয়ামী লীগের সাথে কারো তুলনাও করছি না। এখানে স্পেসিফিক ইস্যু হচ্ছে খুনি সরকারে প্রতি ভাসানীর সমর্থন দেওয়া। আওয়ামী লীগের লোকেরা তো সমর্থন দিয়েছেই। মোশতাকও আওয়ামী লীগেরই লোক ছিলো। সেগুলো বললে কি ভাসানীর অপরাধ কমে যাবে? আপনি বলেন আপনি মুক্তমনের মানুষ, কিন্তু বামদের বিরুদ্ধে গেলেই আর আপনার মুক্তমনে কোনো কিছুই ঢোকে না। এটা খুবই দুঃখজনক। এতখানি ব্রেইন ওয়াশড হওয়া ঠিক না।

Swapan Mahmud: আমি বলেছি সব দায়ভার ভাসানীর হয়ে গেল!

Farid Ahmed: ভাসানীর সব দায়ভার এটাওতো কেউ বলে নাই, আমিও বলি নাই। তিনি খুনে সরকারকে সমর্থন দিয়েছেন, তাদের সাথে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। এতো বড় একজন রাজনীতিবিদ হয়ে, শেখ মুজিবের গুরুস্থানীয় হয়েও, শেখ এবং শেখ পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি কী করেছেন? মোশতাক তাঁর শয্যাপাশে গেলে কি একবারও বলেছেন, আমি খুনির সাথে হাত মেলাই না। বলেন নাই। এমন একটা নিম্নস্তরের লোককে ডিফেন্ড করেন কীভাবে আপনি, সেটাই তো আমি বুঝি না। নারী, শিশু হত্যা যাকে সামান্যতম বিচলিত করে না। আমি আওয়ামী লীগ করেছি, এই সব আকাম করা কোনো আওয়ামী লীগারকে সমালোচনা করতে আমি তো দ্বিধায় ভুগি না সামান্যতমও। সেটা করতে গিয়ে অমুক তমুক কী করেছে, কার দায় বেশি কম সেটা বিবেচনায় নেওয়া হবে না।