স্নেক আইল্যান্ড
ব্রাজিলের সাও পাওলো থেকে ৩৩ কিমি দূরে সাগরের বুকে রয়েছে অদ্ভুত একটা দ্বীপ। সারাবিশ্বে যেটি পরিচিত স্নেক আইল্যান্ড নামে। একশো দশ একরের ছোট্ট এই সবুজ দ্বীপটি বর্তমানে জনমানবশূন্য। মালিক হিসাবে তাই সারা দ্বীপে এখন ছড়ি ঘোরায় সাপেরা।
দ্বীপটির সম্পূর্ণ নাম ‘ইলহা দা কুয়েইমাদা গ্রান্দে‘। এরকম আজগুবি লম্বা নাম এলো কোত্থেকে! আসলে কথা হলো নামটা পর্তুগীজ। ব্রাজিলে একটাসময় ভালোই রাজত্ব বাণিজ্য করেছে পর্তুগীজরা। তখন দ্বীপটি অবশ্য জনবিরল ছিলো না। কিছু আদিবাসী ছিল। তাঁরা জুমচাষ টাইপ কাজ কর্মের জন্য প্রায়শই সবুজ দ্বীপের এখানে-ওখানে আগুন ধরিয়ে দিত। এই আগুন ধরানো মানে- To Burn থেকেই দ্বীপটির নাম কুয়েইমাদা। পর্তুগীজ Queimada অর্থ আগুন লাগানো ।
দ্বীপটি থেকে মানুষ চলে যাওয়া শুরু করে সেই উনিশ শতকেই। ১৯০৯ সালে একটা বাতিঘর বানানো হলো, যাতে হতভাগা জাহাজরা পথ ভুলে আত্মহত্যা থেকে বাঁচতে পারে। পরে বাতিঘরটা স্বয়ংক্রিয় করা হলে, সেখানে পেটের দায়ে পড়ে থাকা অল্প কিছু কর্মচারী পগারপার হন!
কিন্তু আসল কথায় আসি। কেনো দ্বীপটির নাম স্নেক আইল্যান্ড? ওরফে সাপের দ্বীপ? কি স্পেশালিটি এতে? সোনালী ল্যান্সহেড পিট ভাইপার, বৈজ্ঞানিকভাবে যার নাম Buthrops Insularis – এরা হলো দ্বীপটির অলিখিত বর্তমান রাজা। সংখ্যায় দু-তিনহাজারের বেশি হবেনা, তবুও এদের দাপট ভারী। এর কারণও আছে।
বলা হয়ে থাকে পৃথিবীতে যে কয় জাতের সাপ মহাবিপন্ন, তারমাঝে এই ল্যান্সহেডরা অন্যতম। সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হওয়া থেকে মাত্র দুই ধাপ দূরে দাড়িয়ে আছে তারা। বৈজ্ঞানিকভাবে যাকে বলে ক্রিটিকালি এনডেনজারড প্রজাতি (Critically Endangered Species)। আরো কষ্টের ব্যাপার হলো এই দ্বীপটি ছাড়া আর কোথাও তাদের পাওয়া যায়না, বিশ্বের কোথাও না। একপ্রকার এন্ডেমিক তারা। এন্ডেমিক মানে হলো যারা একটি নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ। অন্য কোনো দেশে তাদের পাবেননা।
যেমন আমাদের বোস্তামী কচ্ছপ[ছবি দেখুন]। এরা বাংলাদেশ ও উত্তর পূর্ব ভারতের এন্ডেমিক। কিংবা ঘড়িয়াল। এরা ভারতীয় উপমহাদেশের সন্তান। অন্য মহাদেশে এদের চোখে পড়েনা। এজন্য ব্রাজিল সরকার বেশ সাবধানের সাথে সংরক্ষণ করছে এই সাপদের। সেখানে মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। ব্রাজিলিয়ান নেভির অধীনে পুরো দ্বীপটি। বছরে বছরে চেকিংয়ের জন্য কিছু জীববিদকেই কেবল পাঠানো হয়! খুব ভালো মানের সরিসৃপবিদ না হলে, কিংবা গবেষণার জন্য বেশি দরকারি না হলে দ্বীপে ঢুকার অনুমতি পাওয়া যায়না।
রিপ্লি থেকে’র অন্যান্য কিছু লেখা-
আরো একটা কারণ আছে অবশ্য। সোনালী ল্যান্সহেড পিট ভাইপার বেশ ভালো রকমেরই বিষধর। এনার বিষ হেমোটক্সিন। মানে রক্ত জমাটে বাঁধা দেয়া, রক্ত চলাচলে বিঘ্ন ঘটানো, অক্সিজেন শোষণে বাঁধা, টিস্যু জায়গামতো গলিয়ে ফেলা- অর্থাৎ রক্ত সংবহনতন্ত্র ও কিছুটা পেশীতন্ত্রেরও বেশ ভালোমতন ক্ষতি করে এই সাপের বিষ।তাই সাইজে মাত্র দুই ফুট হলেও একইসাথে ভয় আর করুণা আদায় করে গোটা এক দ্বীপ বাগিয়ে ফেলা চাট্টিখানি কথা নয়! সোনালী ল্যান্সহেড পিট ভাইপার সেটাই করে দেখিয়েছে। মানুষ নামক দৈত্যের হাত থেকে এটলিস্ট একটা সবুজ দ্বীপ তো বাঁচিয়েছে ওরা, মন্দ কি!
ইস্টার দ্বীপের কথা
ফেলিপ গন্জালেজ যখন ভাসতে ভাসতে প্রশান্তের দক্ষিণে ইস্টার দ্বীপে পৌঁছালেন ততক্ষণে তাঁর চোখ কপালে উঠে গেছে। সারি সারি পাথরের মানুষ যেনো কূলে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে দেখছে তাঁদের জাহাজ! আতঙ্ক ঘিরে ধরলো ডেকে দাঁড়ানো সব নাবিককে, নোঙরের আগেই।
সালটা সতেরোশো সত্তর। আমাদের পলাশীর যুদ্ধের তেরো বছর পর। দ্বিতীয়বারের মতো কোনো বিদেশী জাহাজ ভিড়লো ইস্টার দ্বীপের কূলে। দুটি স্প্যানিশ জাহাজ- সান লরেন্জো আর সান্তা রোজালিয়া। দুটোই ছিলো ক্যাপ্টেন ফেলিপ গোন্জালেজের অধীনে। ইস্টার দ্বীপের কূলব্যাপী দাঁড়ানো শয়ে শয়ে পাথরের বিশাল মূর্তি গুলো তখনই ভালোভাবে নজরে আসে স্প্যানিশদের। তীরবর্তী সবকটি মূর্তির মুখ ছিলো সাগরের দিকে ঘোরানো। যেনো একসাথে পাহারা দিচ্ছে দ্বীপকে। যাচাই করছে কে আসলো কে গেলো।
প্রতিটা মূর্তি ছিলো পাথরের তৈরী। পরবর্তীতে বিজ্ঞানীদের গবেষণায় জানা যায় পাথরগুলো আনা হয়েছিলো দ্বীপের মধ্যবর্তী ‘রানো রারাকু’ (Rano Raraku) নামের এক আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে। অর্থাৎ আগ্নেয় শিলার তৈরি সব। তাছাড়া একেকটা মূর্তি প্রায় বারো থেকে তেরো ফুট লম্বা আর ওজন প্রায় বারো টন। অর্থাৎ উচ্চতায় দুজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ আর ওজনে প্রায় দুইশোজন মানুষের সমান!
এই মূর্তিগুলো নিয়ে এরপর শুরু হলো জব্বর গবেষণা। বাঘা বাঘা আর্কিওলজিস্ট, খননবিদ, ইঞ্জিনিয়ার, রিসার্চাররা ভীড় করলেন দ্বীপে। সম্মিলিত খোঁজখবরে জানা যায় বারোশো সালের দিকে পলিনেশীয় আদিবাসীরা ভাসতে ভাসতে আশ্রয় নেয় এই দ্বীপে। দ্বীপটাকে তারা ডাকতো রাপা নুই- তাদের ভাষায় দেয়া নাম। নিজেদের মৃত পূর্বপুরুষ দের আদলেই নাকি তারা বানিয়েছিলো এই বিশাল বিশাল মূর্তিগুলো। তাদের ধারণা ছিলো এই মূর্তিগুলো তাদের সমুদ্রের বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করবে!
কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে আস্তে আস্তে বিলুপ্তির মুখে এসে দাঁড়ায় এই দ্বীপের আদিবাসী রা। অনেকেই পাড়ি জমায় আশপাশের দ্বীপে। ধীরে ধীরে বৃক্ষশূন্য প্রাণীশূন্য হয়ে পড়ে পুরো দ্বীপ। অবশেষে ইউরোপিয়ানরা পা রাখার পর একপ্রকার নিঃশেষই হয়ে গেলো স্থানীয় দ্বীপবাসী রা। অনেক গবেষণা খোঁড়াখুড়ি চললেও এখনো জানা যায়নি অনেক প্রশ্নের উত্তর।
কোনোরকম আধুনিক প্রযুক্তি ছাড়াই কিভাবে প্রায় নয়শোর মতো মূর্তি বানানোর কাজ করলো পলিনেশীয়রা? আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে মাইলের পর মাইল বয়ে কিভাবে মূর্তিগুলো নিয়ে আসলো দ্বীপের কূলে? যেখানে প্রতিটি মূর্তির ওজন দশ টনের বেশি! মূর্তিগুলোর পা নেই কেনো? মাথা এতো অস্বাভাবিক বড়ই বা কেনো? এই অদ্ভুত আকৃতির কারণ কী? পুরো দ্বীপে কোনো বড় গাছ বা প্রাণী নেই কেনো? কোন অভিশাপে হারিয়ে গেলো তারা?
এত এত কেনোর উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছেন রিসার্চাররা। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মূর্তি নাড়াতে বা সড়াতে গিয়েই গলদঘর্ম হয়েছেন ইঞ্জিনিয়াররা! তাই প্রশ্ন জাগে আজ হতে আট শতাব্দী আগের সেই একাকী জনবর্জিত দ্বীপে কিভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলো দ্বীপবাসী রা?
এই প্রশ্নের উত্তর আজও মিলেনি। তবে বিজ্ঞানের কাছে বিশ্রাম বলতে কোনো শব্দ নেই। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে উত্তর মিলবে সব রহস্যের। ততদিন পর্যন্ত চিলির অধীনস্থ প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে ছোট্ট এই রাপা নুই ওরফে ইস্টার দ্বীপ মানুষের কাছে রহস্য হয়েই থাকুক। যেমনটা রহস্য হয়ে আছে তার অধিবাসী শয়ে শয়ে পাথরের নীরব পাহারাদার আর তাদের হারিয়ে যাওয়া স্রষ্টারা!