দেখে সোজা মনে হয়। আসলে কিন্তু কাজটা খুবই কঠিন।
বলছি নারী-পুরুষ পার্থক্য করার কথা। অনেকে বলেন, যে বাচ্চার জন্ম দিতে পারে, সেই নারী। বাকি সবাই পুরুষ। সমস্যা হচ্ছে, অনেক জেনেটিক নারী নানান কারণে বাচ্চার জন্ম দিতে পারেন না। তারা কি তবে বাই ডেফিনিশন নারী নন? এই সংজ্ঞা বহুত সংকীর্ণ হয়ে যায়। কাজেই এই সংজ্ঞা বাদ।
আরেকটা থিওরি বলে, সন্তান জন্মদানের কাঁচামালের উপর ভিত্তি করে নারী-পুরুষ আলাদা করা উচিত। কাঁচামাল বলতে বোঝায় বীর্য আর ডিম্ব। বীর্য থাকে অণ্ডকোষে (Testes) আর ডিম্ব ডিম্বাশয়ে (Ovary)। সুতরাং যার অন্ডকোষ থাকবে, সে পুরুষ আর যার ডিম্বাশয় থাকবে, সে নারী। শিস্ন (Penis), স্তন, জরায়ু এগুলো সেকেন্ডারী বিবেচনা। এখন কারো যদি অণ্ডকোষ আর ডিম্বাশয় দুটোই থাকে তাকে আমরা কী বলবো? নারী না পুরুষ? প্রচলিত ভাষায় আমরা এদের হিজড়া বলে থাকি। কেউ কেউ ভদ্রতা করে নপুংশক বলেন। দুটো শব্দই যথেষ্ট ডেরোগেটোরি। কাজেই, আমি ইংরেজি ‘হার্মাফ্রোডাইট‘-ই ব্যবহার করবো এদের পরিচয় দানের ক্ষেত্রে।
হার্মাফ্রোডাইট শব্দটি এসেছে দুটো গ্রিক শব্দ থেকে। Hermes (জিউসের ছেলে) আর Aphrodite (প্রেমের দেবী, সৌন্দর্যের দেবী)-এর যুগলে এই শব্দের জন্ম। মিথ বলে, হার্মেস ও আফ্রোদিতির মিলনে যে সন্তানের জন্ম হয়, তার মধ্যে বাবা-মা দু’জনের বৈশিষ্ট্যই এতো প্রবলভাবে বিদ্যমান ছিল যে সন্তানটি ছেলে না মেয়ে তা নির্ণয় করা অসম্ভব ছিল।
বাইবেলের একটা চমৎকার ব্যাখ্যা আছে এদের নিয়ে। আদমের জীবন শুরু হয় হার্মাফ্রোডাইট হিসেবে। তারমধ্যে তখন একই সাথে স্ত্রী ও পুরুষ-দুটি সত্তাই বিরাজ করছিল। সোজা কথায়, তার দেহ ছিল একটি কিন্তু মন ছিল দুটো। একটি নারী মন আরেকটি পুরুষ মন। যে ঈভ আদমকে নিষিদ্ধ ফল খেতে প্ররোচিত করেছিল, সে আসলে আলাদা দেহধারী কোন সত্তা নয়। আদমের মগজে বসবাসকারী দুটি সত্তার একটি। স্বর্গ থেকে যখন আদমের পতন ঘটে, তখন থেকেই নারী ও পুরুষ ভিন্ন দেহে বসবাস কবা শুরু করে।
হার্মাফ্রোডাইট কারা এ নিয়ে যুগে যুগে অনেক কনফিউশন ও বিতর্ক চলে এসেছে। আইন প্রণেতারা একরকম সংজ্ঞা দিয়েছেন, ধর্মগুরুরা একরকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ফিজিশিয়ানরা আরেকরকম। বয়সের সাথে সাথে আমার নিজের ধারণায়ও পরিবর্তন এসেছে। ছোটবেলায় ভাবতাম, যাদের স্তন আছে, কিন্তু কথাবার্তা, আচার-আচরণ পুরুষদের মতো তারাই হার্মাফ্রোডাইট। একটু বড় হয়ে যখন মানুষের জন্ম প্রক্রিয়া বুঝতে শিখলাম, তখন ধারণা হলো, যাদের একই সাথে শিস্ন আর যোনি আছে, তারাই হার্মাফ্রোডাইট। সম্প্রতি এক বই পড়তে গিয়ে আরেকটা সংজ্ঞা পেলাম। জার্মান ফিজিশিয়ান থিওডোর আলব্রেখট ক্লেবস ১৮৭৬ সালে এই সংজ্ঞা চালু করেন। তিনিই প্রথম ট্রু হার্মাফ্রোডাইট ও ফলস হার্মাফ্রোডাইটের ধারণাও আনেন।
ট্রু হার্মাফ্রোডাইট তারাই, যাদের একই সাথে ডিম্বাশয় আছে, আবার অণ্ডকোষও আছে। ট্রু হার্মাফ্রোডাইটের এই সংজ্ঞাটি খুব বেশি রকমের সংকীর্ণ। এর ফলে দেখা যায়, প্রচলিত ধারণায় আমরা যাদের হার্মাফ্রোডাইট বলি, তাদের অনেকেই এই দলে পড়ছে না। নারী/পুরুষ বাইনারির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। এই সংজ্ঞা অনুসরণ করার ফলে তো এক সময় ইউরোপে অফিশিয়ালি হার্মাফ্রোডাইটের সংখ্যা মারাত্মক রকম কমে গিয়েছিল। কারণটা বলি।
ধরা যাক, আপনার মধ্যে নারী ও পুরুষের লিঙ্গ নির্ণায়ক অঙ্গগুলো একসাথে অবস্থান করছে। আপনার জরায়ু আছে, আবার একইসাথে গোঁফও আছে। কিংবা আপনার যোনী আছে, আবার অণ্ডকোষও আছে। তাও আপনাকে ট্রু হার্মাফ্রোডাইট বলা যাবে না। যদি এবং কেবল যদি আপনার ডিম্বাশয় ও অণ্ডকোষ থাকে, তবেই আপনাকে ট্রু ফার্মাফ্রোডাইট বলা যাবে। অন্য যেকোনো কম্বিনেশনের জন্য আপনি ফলস হার্মাফ্রোডাইট ক্যাটাগরিতে পড়ে যাবেন। নিচের ছবিটা মনোযোগ দিয়ে দেখলে ব্যাপারটা আরো ক্লিয়ার হবে।
এমনও কেস আছে, যে এক লোক স্বাভাবিক পুরুষ হিসেবেই জীবন-যাপন করছে। বয়স হবার পর সে খেয়াল করল, তার শিস্ন ঠিকমত কাজ করছে না। সে গেলো ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শরীরে ডিম্বাশয়ের অস্তিত্ব পেলেন। সংজ্ঞানুযায়ী, এই লোক ট্রু হার্মাফ্রোডাইট। অথচ চেহারায়, আচার-আচরণে সে স্বাভাবিক পুরুষ। এখন আপনি তাকে কোন দলে ফেলবেন?
এমা নামে একজনের কেস আছে। উনি নারী হিসেবেই বড় হয়েছেন। কিন্তু বিয়ের আগে বেশ ক’জন নারীর সাথে তার শারীরিক সম্পর্ক ছিল। সম্পর্কগুলো যথেষ্ট আনন্দদায়ক ছিল। এমা বিয়ে করেন এক পুরুষকে, যার সাথে তার খুব রেয়ারলি যৌন সম্পর্ক হতো। তার যৌনক্ষুধা মিটতো মূলত তার গার্লফ্রেণ্ডদের সাহায্যে। ডাক্তার তাকে অপারেশন করে পুরুষ হতে বললে তিনি তা রিফিউজ করেন। কারণ, পুরুষ হলে তাকে নিজে উপার্জন করে খেতে হবে। স্ত্রী হিসেবে সেই দায় তার নেই।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা –
এমন অসংখ্য ইন্টারেস্টিং কেস হিস্ট্রি পাওয়া যাবে হার্মাফ্রোডাইটদের ইতিহাস ঘাঁটলে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, হার্মাফ্রোডাইট জনগোষ্ঠীর আচরণও প্রায় সময়ই মানবিক ছিল না। ইহুদীরা হার্মাফ্রোডাইটদের নারীদের থেকে দূরে রাখতো, পিতার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতো, আদালতে বা অন্য কোথাও তাদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হতো না। ইহুদীরা তবু তাদের কিছু স্বীকৃতি দিয়েছিল। রোমানরা ছিল আরো বর্বর। হার্মাফ্রোডাইটদের এরা রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে গণ্য করতো এবং মেরে ফেলতো।
আমাদের উপমহাদেশের সমাজেও দেখা যায়, এদের মেইনস্ট্রীম সমাজ থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। কাজেই, এরা জীবিকার সংস্থান করতে না পেরে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়, চাঁদাবাজি করে। আমাদের নাটক-সিনেমাতেও এর রিফ্লেকশন পাবেন। বিয়েতে সন্তানের জন্মদিনে এরা নেচে গেয়ে পয়সা আদায় করছে। এটা উপমহাদেশের মুভির কমন দৃশ্য। হলিউড মুভিতে কি কখনো এরকম কিছু দেখেছেন? দেখেননি তো! তার মানে কি এই যে ইউরোপ-আমেরিকায় হার্মাফ্রোডাইট নেই? অবশ্যই আছে। এরা সমাজের মূল ধারার সাথেই মিশে আছে। প্রেম করছে, বিয়ে করছে, চাকরি-বাকরি করে জীবিকা অর্জন করছে। সমাজ এদের মূলধারা থেকে তাড়িয়ে দেয়নি। তাই, ইউরোপ-আমেরিকায় আপনি হারমাফড়োডাইটদের দল বেঁধে চাঁদাবাজি করতে দেখবেন না।
আধুনিক কালে জেন্ডার ক্লাসিফিকেশনে আরো পরিবর্তন এসেছে। নারী/পুরুষ বাইনারী কিংবা নারী/পুরুষ/থার্ড সেক্স এর ট্রাইনারি পেরিয়ে আমরা প্রবেশ করেছি পাঁচ লিঙ্গ ধারণার যুগে। লিঙ্গভেদে মানুষকে এখন পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়। নারী-পুরুষ ছাড়াও এতে আছে ট্রু হার্মাফ্রোডাইট, পুরুষ সিউডো হার্মাফ্রোডাইট (Merm: Abbreviation of Male Pseudo Hermaphrodite) ও নারী সিউডো হার্মাফ্রোডাইট (Ferm: Abbreivation of Female Pseudo Hermaphrodite)। এই ক্লাসিফিকেশনে ট্রু হার্মাফ্রোডাইটের সংজ্ঞা আগের মতই রাখা হয়েছে। মানে যাদের, ডিম্বাশয় আর অণ্ডকোষ আছে, তারাই ট্রু হার্মাফ্রোডাইট। পুরুষ সিউডো হার্মাফ্রোডাইট তারাই যাদের XY ক্রোমোসোম আছে, অণ্ডকোষও আছে কিন্তু এর সাথে স্ত্রী জননতন্ত্রের কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আভাস (যেমনঃ অবিকশিত জরায়ু) পাওয়া যায়। স্ত্রী সিউডো হার্মাফ্রোডাইটরা XX ক্রোমোসোম মানুষ, এদের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী জননতন্রের পাশাপাশি পুরুষ জননতন্ত্রের কিছু আভাস পাওয়া যায়।
ফর্ম ফিলাপ করার সময় জেন্ডার বা সেক্স এর ঘরে নারী/পুরুষ ছাড়াও অপশন হিসেবে থার্ড সেক্স কে আলাদা স্বীকৃতি দেবার জন্য পৃথিবীর নানা দেশেই জোরেশোরে আন্দোলন চলছে। অনেক জায়গাতেই দেখবেন নারী ও পুরুষদের জন্য আলাদা ওয়াশরুম রাখার পাশাপাশি Unisex চিহ্ন সম্বলিত ওয়াশরুমের বয়বস্থাও রাখা আছে। এটা সম্ভবত ঐ থার্ড সেক্সের মানুষদের কথা ভেবেই করা। অনেকে তো বলছেন যে কোন রকম ফরম ফিলাপ করার সময় জেন্ডাড় ঘরটিই উঠিয়ে দিতে। জেন্ডার বা সেক্স মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। জেন্ডারের ভিত্তিতে শুধু শুধু বৈষম্যই সৃষ্টি হয়। অবশ্য উন্নত দেশগুলোতে, যেখানে নারী-পুরুষের মধ্যে একটা বেসিক লেভেলে সমতা আছে, সেখানে এই স্বপ্ন দেখা সম্ভব। আমাদের মত দেশগুলোতে সেটা খানিকটা কল্পনাবিলাস হয়ে যায়।