পোস্ট টপিকঃ
বাদশাহ হুমায়ুন -এর জীবনী হুমায়ুননামা বই অবলম্বনে –
৫.১ পাগলা রাজা
হুমায়ুনের জীবনটা পাগলামি, আলস্য আর খামখেয়ালিতে পরিপূর্ণ। আফিমে বুঁদ হয়ে থাকতেন তিনি, করতেন উদ্ভট সব কাণ্ডকারখান, যা একজন বাদশাহের চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ যেন এক পাগলা রাজা, সমস্ত নিয়মনীতিকে উলটে দিয়ে যিনি চলেন তাঁর একান্ত নিজস্ব নিয়ম এবং ইচ্ছা অনুসারে।
জ্যোতিষশাস্ত্রে হুমায়ুনের গভীর পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি ফলিত জ্যোতিষের আলোচনায় অপরিসীম আনন্দ অনুভব করতেন। রাজদর্শনাভিলাষী ব্যক্তিদের অভ্যর্থনার জন্য সাতটি সুসজ্জিত কক্ষ করেছিলেন হুমায়ুন। সাতটা গ্রহের নামে এদের নামকরণ করেছিলেন তিনি। এই সকল কক্ষের গৃহসজ্জা, চিত্রাবলী এবং ভৃত্যদের পোশাকে সেই গ্রহের চিহ্ন আঁকা থাকতো। যে দিন যে গ্রহের প্রভাব বিদ্যমান থাকতো, সেদিন সেই গ্রহের নামানুসারে করা কক্ষে হুমায়ুন দরবার করতেন। রাজদর্শনাভিলাষী ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁর যে গুণের প্রাধান্য থাকতো, তাঁকে সেই গুণবিশিষ্ট গ্রহের নামে ডাকা কক্ষে উপস্থিত হতে হতো। কবি, পরিব্রাজক ও বিদেশী রাজদূত সোম কক্ষে, বিচারক, শাস্ত্রবেত্তা ও কার্য্যাধ্যক্ষরা বুধ কক্ষে এবং সৈনিক পুরুষেরা বৃহস্পতিকক্ষে রাজদর্শন করতেন।
হুমায়ুন রাজকার্য নির্বাহের জন্য চতুর্ভুতের নামানুসারে চারটি বিভাগ সৃষ্টি করেছিলেন। এগুলো হচ্ছে আতসী, হাওয়াই, আবি ও খাকি। এই চার বিভাগের কাজ সম্পাদন করার জন্য চারজন মন্ত্রী নিযুক্ত করেছিলেন। যে সব দ্রব্য প্রস্তুত করার জন্য অগ্নির আবশ্যক হতো, যেমন নানাবিধ যুদ্ধাস্ত্র এবং যন্ত্র, সেগুলোর নির্মানকাজ আতসী বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরিচ্ছদগৃহ, পাকশালা ও আস্তাবল, এগুলো হাওয়াই বিভাগের অধীন ছিল। সরবতখানা, সুজিখানা ও খাল, এগুলোর কাজ আবি বিভাগের তত্ত্বাবধানে সম্পাদিত হতো। কৃষি, পূর্ত, খালসা ভূমি ও কোনো কোনো গৃহকাজের জন্য খাকি বিভাগের সৃষ্টি হয়েছিল।
এগুলোকে খামখেয়ালি বলে চালানো যেতে পারে। কিন্তু, এক ভিস্তিওলাকে নিয়ে হুমায়ুন যা করেছিলেন, সেই রকম পাগলামি ইতিহাসে বিরল। চৌসার যুদ্ধের সময় বিশ হাজার মোগল সৈন্য নদীতে ডুবে যায়, হুমায়ুনের ঘোড়া নিহত হয় এবং তিনি নিজে জীবন বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সাঁতার না জানা এই বাদশাহকে এক ভিস্তিওলা তার মশকের সাহায্যে নদীর জলে ডুবে মরা থেকে বাঁচান। কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে এই ভিস্তিওলাকে তিনি দুই দিনের জন্য সত্যিকারভাবে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। গুলবদন এ বিষয়ে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ
“এই সময় একজন ভিস্তিকে (জলবাহক) সর্বদা বাদশাহের সঙ্গে দেখা যেত। এই ভিস্তি এক নিদারুণ বিপদের মুহুর্তে বাদশাহের প্রাণরক্ষা করেছিল। চুসা অঞ্চলের যুদ্ধে বাদশাহের ঘোড়া নিহত হয়, প্রাণ বাঁচাতে বাদশাহ গঙ্গায় ঝাঁপ দেন। তখন এই ভিস্তি তার মশক দিয়ে বাদশাহকে রক্ষা করেছিল। তার মশকের সাহায্য না পেলে বাদশাহ নদীতে হয়তো ডুবেই যেতেন। এই কাজের জন্য সন্তুষ্ট হয়ে বাদশাহ তাকে পুরস্কার স্বরূপ আগ্রার সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। এই ভিস্তিটির সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই আমি জানতাম না। কেউ কেউ তার নাম বলত নিজামাবার কেউ বলত সম্বল। হজরত বাদশাহের অমূল্যজীবন রক্ষার পুরস্কার হিসাবে সে সিংহাসনে বসার দুর্লভ সুযোগ লাভ করেছিল।”
এই সিংহাসনে বসানো যে শুধুমাত্র লোক দেখানো ছিল তা নয়, কিংবা তামাশাও নয়। ভিস্তিওয়ালা নিজামকে সত্যি সত্যি বাদশাহের সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে গুলবদন বলেছেন,
“বাদশাহ দরবারের সমস্ত আমির ওমরাহদের বলে দিয়েছিলেন যে তাঁরা বাদশাহকে যেমন মর্যাদা দিয়ে সালাম জানান, কুর্নিশ করেন, ভিস্তি নিজাম যখন সিংহাসনে আসীন হবেন তখন তাকেও যেন অনুরূপভাবেই সম্মান দেখান। গোলাম নিজাম সিংহাসনে বসে খুব দান খয়রাত ও পদ প্রদান করে।”
স্ক্রাইন অবশ্য ভিস্তি নিজাম যে দুই দিন সিংহাসনে আসীন ছিলেন, এটা মানেন নি। তার মতে মাত্র কয়েক ঘণ্টা স্থায়ীত্ব হয়েছিল এই ক্ষণিকের তরের বাদশাহি। তাঁর ভাষ্যে,
“এই ভিস্তিওয়ালা পুরস্কারপ্রার্থী হইয়া দিল্লীতে উপনীত হইলে হুমায়ুন তাহাকে বারো ঘণ্টার (কারো কারো মতে দুই ঘণ্টা) জন্য সিংহাসনে উপবিষ্ট করিয়ে পুরস্কৃত করেন। ভিস্তিওয়ালা এই অল্প সময়ের জন্য সর্বময় কর্তৃত্ব লাভ করে নিজের ও নিজের আত্মীয়স্বজনের ভরণপোষণের সুবন্দোবস্ত করে নিয়েছিল।“
হুমায়ুনের এই ছেলেমানুষি আচরণ পছন্দ করে নি তাঁর ভাইদের কেউই। যে দুইদিন ভিস্তিওলা নিজাম সিংহাসনে বসে ছিলেন, সেই দুই দিন মির্জা হিন্দোল দরবারে আসেন নি। সৈন্য সংগ্রহের কথা বলে লাহোর চলে যান তিনি। মির্জা কামরানও দরবারে আসেন নি। তিনি অবশ্য অসুস্থ ছিলেন এমনিতেই। তবে, তার মনোভাবও মির্জা হিন্দোলের মতোই ছিল। ভিস্তিওলাকে সিংহাসনে বসানোটাকে একদমই মেনে নিতে পারেন নি তিনি। তিনি বাদশাহকে বলেছিলেন যে, লোকটি যত উপকারই করে থাকুক না কেন, তার জন্য তাকে সিংহাসনে বসানো উচিত হয় নি। তাকে অন্য কোনো পুরস্কার কিংবা জায়গির দেওয়া যেতো। বিশেষত, শের খান যখন ক্রমশই আগ্রার দিকে এগিয়ে আসছে তখন হুমায়ুনের এই সব বালসুলভ কাজকর্মের কোনো অর্থ হয় না বলে বিষয়টাকে সমালোচনা করেছিলেন তিনি।
৫.২ মোগল হেরেমের অন্তরালে
মোগল ইতিহাস নিয়ে শত শত বই লেখা হয়েছে। কিন্তু, এই সব ইতিহাস বইতে শুধুমাত্র রাজকীয় পুরুষদের কথাই লেখা রয়েছে। তাঁরাই মূল চরিত্র, তাঁরাই সব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। খুব অল্প বইতেই, এবং খুব স্বল্প জায়গা জুড়েই মোগল রাজ পরিবারের মহিলা সদস্যদের বিস্তারিত বিবরণ আছে, তাঁদের জীবন, তাঁদের কর্মকাণ্ড এবং তাঁদের অর্জন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
মোগল যুগের সূত্রপাত থেকে আজ পর্যন্ত সমস্ত ইতিহাস বইতে সম্রাটদের জীবনের ঘটনাবহুলকে ঘটনাগুলোকে নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই সমস্ত ঘটনায় মোগল নারীদের সামান্য উল্লেখ করা হয়েছে অবশ্য, কিন্তু তাঁদের জীবনের একটা বিশাল অংশই অনুপস্থিত। বাবর এবং জাহাঙ্গীরের জীবনীগ্রন্থে অবশ্য তাঁদের সাথে সম্পৃক্ত নারীদের কিছু বিবরণ আছে, কিন্তু সেই একই কথা এখানেও প্রযোজ্য যে এই সমস্ত নারীদের বিস্তারিত কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। গুলবদনের হুমায়ুননামা এই একটা জায়গায় এগিয়ে আছে সবার থেকে। বাবর এবং হুমায়ুনের সময়কার মোগল হেরেমের অন্তরালে থাকা নারীদের বিশদ বিবরণ তুলে এনেছেন তিনি। সেই সময়কার বিদেশী ভ্রমণকারীদের কাছ থেকেও রাজকীয় নারীদের কিছু বিবরণ পাওয়া যায়, তবে তা গুলবদনের মতো এতো গভীরতাস্পর্শী নয়।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
মোগল হেরেমে বিশাল একটা সংখ্যক নারী থাকতো। বিভিন্ন জাতি, বিভিন্ন দেশ এবং বিভিন্ন সম্প্রদায় থেকে আসতো তাঁরা। শুধু মুসলমান নয়, এর বাইরে হিন্দু এবং খ্রিস্টান নারীরাও হেরেমে ছিল। বাবর এবং হুমায়ুনের হেরেম তুলনামূলকভাবে ছোট ছিল। মোগল রাজবংশের সূত্রপাতের সময় বলেই হয়তো এই আকারটা বিশাল হতে পারে নি। কিন্তু, পরবর্তীতে, বিশেষ করে আকবরের সময় থেকে, মোগল সাম্রাজ্য শক্তিশালী এবং বৃহৎ হবার সাথে সাথে হেরেমের আকারও বর্ধিত হয়েছে। আকবরের হেরেমে আনুমানিক পাঁচ হাজার নারী ছিল। জাহাঙ্গীর, শাহজাহান এবং এমনকি ধর্মভীরু আওরঙ্গজেবের হেরেমও ছিল বিশালাকৃতির। হকিন্সের মতে, জাহাঙ্গীরের তিনশত স্ত্রী ছিল, এর মধ্যে চারজন ছিল প্রধানা। টেরির হিসাব অনুযায়ী জাহাঙ্গীরের হেরেমে চারজন স্ত্রী ছিল, সেই সাথে ছিল অসংখ্য উপপত্নী।
হেরেমের কথা যখন বলা হয়, তখন সবাই এর বাসিন্দা বলতে বাদশাহের পত্নী, উপপত্নী, নর্তকী, গায়িকা এবং বান্দিদের কথাই চিন্তা করে। কিন্তু, হেরেম শুধু এদের দিয়েই গঠিত হতো না। এদের বাইরেও অসংখ্য অন্য নারীরা বাদশাহের হেরেমে বসবাস করতেন। বাদশাহের মা, সৎ মা, দাই মা, খালা, ফুফু, বোন, মেয়ে এবং অন্যান্য নারী আত্মীয়-স্বজনেরা হেরেমে থাকতেন। এমনকি পুরুষ বাচ্চারাও সাবালক হবার আগ পর্যন্ত হেরেমেই বসবাস করতো। এর বাইরেও নারী রক্ষী, নারী কর্মকর্তা, দাসি-বান্দি, নারী ভাগ্যগণনাকারীরা ছিল হেরেমের অপরিহার্য সদস্য। খোজা রক্ষীরা হেরেমের পাহারার দায়িত্বে থাকতো। এই খোঁজাদের মধ্যে কেউ কেউ এবং নারী সদস্যদের মধ্যে কেউ আবার বাদশাহের গোপন চর হিসাবে কাজ করতো। হেরেমের অভ্যন্তরের যাবতীয় খবরাখবর তারা বাদশাহের কানে পৌঁছে দিতো।
হেরেমের নারীদের কঠোর পর্দা মেনে চলতে হতো। হেরেম থেকে বাইরে বের হবার স্বাধীনতা তাদের ছিল না। কোনো কারণে বের হলে কঠোর পর্দা মেনেই তাদের বের হতে হতো। তবে, হেরেমের ভিতরে তাদের স্বাধীনতা ছিল প্রতুল পরিমাণে। বিলাসবহুল জীবন যাপনের জন্য যা যা প্রয়োজন, দামি জামা-কাপড়, গয়না-অলংকার, তার সবই তাদেরকে দেওয়া হতো। মানুচি এবং বার্নিয়েরদের মতো বিদেশী, যাঁরা সুযোগ পেয়েছিলেন হেরেমের অভ্যন্তরে যাবার, তাঁরা এই চাকচিক্যময় জমকালো জীবনের কথাই তুলে ধরেছেন।
মোগল সাম্রাজ্যের সময়ে, আজকের যুগে আমরা যেটাকে ফার্স্ট লেডি বলি, সেটা ছিলেন সাধারণত সম্রাটের মাতা, রানি নয়। ব্যতিক্রম হচ্ছে নূর জাহান এবং মমতাজমহল। বাদশাহের মায়ের মৃত্যুর পরেই শুধুমাত্র প্রধান রানি সাম্রাজ্যের প্রধানা ব্যক্তি হতে পারতেন। বাবর থেকে শুরু করে সকল মোগল সম্রাটই মায়ের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা দেখিয়েছেন। বাবরনামা এবং গুলবদনের হুমায়ুননামাতে এর অনেক উদাহরণ দেওয়া আছে। সিংহাসনে বসার পর বাদশাহের প্রথম কাজই হতো মায়ের সাথে গিয়ে দেখা করা। শুধু আপন মা-ই নয়, পালক মা বা দুধ মায়েরাও বাদশাহদের কাছে অনেক শ্রদ্ধা এবং সম্মানের আসন পেতেন। এগুলো বাদ দিয়ে সৎ মায়েরাও যথেষ্ট সম্মান পেতেন বাদশাহদের কাছ থেকে। দাদি বা নানি, খালা-ফুপু এবং অন্যান্য বয়ষ্কা আত্মীয় স্বজনেরাও উপযুক্ত সম্মান পেতেন এবং তাঁদের যথোপযুক্ত দেখভাল করা হতো। এই মহিলারাও অনেক সময়, বিশেষ করে বাদশাহের দুঃসময়ে তাঁদের সক্রিয় সহযোগিতা নিয়ে হাজির হতেন। বাবরনামায় বয়ষ্ক মহিলাদের প্রতি বাবরের শ্রদ্ধা-ভক্তির কথা বেশ কয়েক জায়গাতেই প্রকাশ পেয়েছে। গুলবদনের হুমায়ুননামাতেও বাবর সম্পর্কে এরকম ঘটনা শুনতে পাওয়া যায়।
“পিতা একাধারে চার বছর আগ্রাতে অতিবাহিত করেন। প্রত্যেক জুম্মাবারে তিনি নিজের ফুফু আম্মাকে সালাম আদাব জানানোর জন্য তাদের আস্তানায় গিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। একদিন চারিদিকে লু হাওয়া চলছিল। আমার পরম পুজনীয় মাতা আব্বা হুজুরকে বললেন, এত গরমের মাঝে আজকে এক শুক্রবার আপনার ফুফুদের না দেখতে গেলে তার মনে তেমন কোন কষ্ট নিবেন না। হযরত বাদশাহ আমার আম্মাকে বললেন, মহম, তুমি একি কথা বলছ? সুলতান আবু সাঈদ মির্জার কন্যাগণ আজ মা-বাবা ও ভাই হারা, আজ আমি যদি তাদের দেখা-সাক্ষাৎ না করি তাহলে কে করবে?”
শুধুমাত্র মা-খালা-ফুফু বা দাদি-নানিই নয়, মোগল বাদশাহদের ভালবাসা, শ্রদ্ধা এবং স্নেহ বোনদের জন্যও বরাদ্দ ছিল। গুলবদন তাঁর হুমায়ুননামাতে এর অনেক নমুনা পেশ করেছেন। বাবর তাঁর বড় বোন খানজাদা বেগমকে খুবই শ্রদ্ধা-ভক্তি করতেন এবং খানজাদা বেগমও তাঁর ভাইয়ের মঙ্গলের জন্য বহু কিছু করেছেন। গুলবদন হুমায়ুনের আপন বোন না হওয়া সত্ত্বেও হুমায়ুন তাঁকে প্রচণ্ড রকমের ভালবাসতেন। গুলবদনও এই ভালবাসার প্রতিদান দিয়েছেন আজীবন হুমায়ুনের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে। শুধু গুলবদন নয়, অন্য বোনদের প্রতিও হুমায়ুনের ভালবাসা প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান ছিল। কোনো বোনের কোনো বিপদ হলে, যেমন কেউ যদি বিধবা হতো, বাদশাহ তাঁর আশ্রয় দেবার জন্য পাশে থাকতেন। হুমায়ুনের বোন গুলচেহারা বেগম বিধবা হলে হুমায়ুন তাঁকে আগ্রায় ফেরত নিয়ে আসেন। বোনদের প্রতি বাদশাহ হুমায়ুনের ভালবাসা কী রকম ছিল, তা গুলবদনের এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়,
“বাদশাহ হুমায়ুন যতদিন হিন্দুস্থানে থাকতেন নিজেই আমাদের দেখতে আসতেন। কোনো রকম আড়ম্বর ছাড়াই খুব সাদাসিধাভাবে তিনি আমাদের কাছে আসতেন এবং আমাদের প্রতি প্রচুর অনুগ্রহ বর্ষণ করতেন। এই হতভাগিনীও তাঁর স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়নি। তিনি আমার বাড়িতেও আসতেন। এখানেই মাসুমা সুলতান, গুলরঙ বেগম, গুলচেহারা বেগমও এসে উপস্থিত হতেন। এঁরা সকলেই ছিলেন বিবাহিতা। এঁরাও নিয়মানুসারে আমাদের প্রিয় ভ্রাতাকে সালাম জানাতেন। মোটকথা, আমার মাতা আকাম ও পিতা হুজুরের ইন্তেকাল হওয়ার পর শোকার্ত, আশ্রয়হীনা এই কনিষ্ঠা ভগিনীর প্রতি বাদশাহ হুমায়ুন যে করুণার দৃষ্টি রেখেছিলেন, তার ফলেই আমার মনোকস্ট একেবারে দূর হয়ে যায়।“
মোগল পরিবারে যদিও কন্যা সন্তানের জন্মকে ছেলে সন্তান জন্মের চেয়ে কম আদরে বরণ কাসবহুকরা হতো, তবুও হেরেমে তাঁদের অবস্থান ছিল সুউচ্চ। মোগল বাদশাহরা কন্যা সন্তানদের যথেষ্ট ভালবাসেতেন, তাঁদের যথেষ্ট যত্ন নিতেন। তাঁদের শিক্ষার জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তাঁদের মেধা বিকাশের জন্য সব সুযোগ সুবিধা দেওয়া হতো। বিলাসবহুল জীবন যাপনের সুযোগ করে দেওয়া হতো তাঁদের জন্য। শের শাহের সাথে যুদ্ধে হুমায়ুনের এক কন্যা আকিকা বিবি নিহত হয়েছিল। এই কন্যা সন্তানের শোক হুমায়ুন দীর্ঘদিনেও ভুলতে পারেন নি। তিনি তাঁর ভাই মির্জা হিন্দালকে বলেছিলেন, “আগেরবার যুদ্ধের সময় আমার কন্যা আকিকা বিবিকে আমি হারিয়েছি, আজও সেই শোক কাটিয়ে উঠতে পারিনি।“
মোগল রাজকীয় পরিবারে বিয়েটা ছিল রাজনৈতিক বিষয়। এর মানে এই নয় যে তাঁরা কখনো প্রেম করে বিয়ে করে নি বা প্রেমে পড়ে নি। বাবর নিজেই লিখেছেন যে, মাসুমা-সুলতান বেগমের সাথে তাঁর বিয়েটা প্রেমের বিয়ে ছিল। আকবরের মা হামিদা বানুর সাথে হুমায়ুনের বিয়েটাও প্রেমেরই বিয়ে। মির্জা হিন্দালের হেরেমে হামিদা বানুকে দেখার পরেই তাঁর প্রেমে পড়ে যান হুমায়ুন। কিন্তু, হামিদা বানুকে পেতে বিস্তর ঘাম ঝরাতে হয়েছিল তাঁর। যেখানে প্রায় সব নারীই বাদশাহকে বিয়ে করার জন্য উদগ্রীব তাঁর সুউচ্চ অবস্থানের কারণে, সেখানে হামিদা বানু বিয়েতে বেঁকে বসেন হুমায়ুন বাদশাহ বলেই। গুলবদনের মাতা দিলদার বেগম তাঁকে অনেক করে বোঝান এবং বলেন যে,
“একদিন না একদিন তোমাকে শাদি করতেই হবে এবং একজন পুরুষের সঙ্গেই তোমার শাদি হবে। তাহলে বাদশাহের সঙ্গে শাদির প্রস্তাবে তুমি অরাজি কেন? বাদশাহের চেয়ে সুপাত্র তুমি কোথায় পাবে?” এর উত্তরে হামিদা বানু বলেছিলেন যে, “আপনি যথার্থই বলেছেন, আমাকে যে কোনো একজন পুরুষকেই শাদি করতে হবে। কিন্তু সে হবে এমন পুরুষ যাকে সহজেই আমার কাছে পাব। আমি যাকে সর্বক্ষণ কাছে পাব না, যাঁর দর্শন লাভের জন্য আমাকে রীতিমতো ধৈর্য ধরে সাধনা করতে হবে, তেমন মানুষকে আমি কোন দুঃখে শাদি করতে যাব?”
হামিদা বানু অবশ্য তাঁর মতে অবিচল থাকতে পারেন নি। চল্লিশ দিন ধরে তাঁকে বর্ষীয়সী মহিলারা ক্রমাগতভাবে বুঝিয়ে হুমায়ুনকে বিয়ে করতে সম্মত করে ফেলেন।
৫.৩ নিবর্তন
গুলবদনের হুমায়ুননামা হয়তো মহৎ কোনো সাহিত্য নয়, এমনকি এর সকল তথ্যও সঠিক নয়। তারপরেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁর স্মৃতিচারণায় শুধুমাত্র সেই সময়ের রাজনৈতিক ইতিহাসই উঠে আসে নি, মূর্ত হয়েছে ক্ষমতার অলিন্দে থাকা কিংবা থাকার চেষ্টা করা কিছু মানুষের ছবি। সহজ সরল আটপৌরে ভাষার মাধ্যমে তিনি আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তাঁর সময়ের সমাজকে, পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সেই সময়কার মানুষের নানা রঙের দিকগুলি। ইতিহাস লেখার উদ্দেশ্যে তিনি হুমায়ুননামা লেখেন নি, বরং বাদশাহ হুমায়ুন সম্পর্কে তিনি যা জানেন, তাই জানাতে চেয়েছিলেন বাদশাহ আকবরকে। কিন্তু, এটা করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই মোগল সাম্রাজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ের ইতিহাসকে তিনি তাঁর বইতে মূর্ত করে ফেলেছেন।
অন্যান্য পর্বগুলো পড়ুনঃ হুমায়ুননামা↑