ফ্রাসোঁ পিয়ার্দের ডায়রী থেকে ” প্রাচীন বাংলা ” –
১.১
আজ থেকে চারশ বছর আগে ১৬০৭ সালে ফ্রাসোঁয়া পিরার্দ ঘুরতে ঘুরতে আমাদের চট্টগ্রাম আসেন। ফরাসী নাগরিক ফ্রাসোঁয়ার জবানীতে আমার পূর্বপুরুষের কথা শুনতে মন্দ লাগেনা কিন্তু। তাঁর বই “The Voyage of François Pyrard of Laval to the East Indies, the Maldives, the Moluccas, and Brazil” এর একটা অধ্যায় বাংলাদেশ নিয়ে, তারই ভাবানুবাদ দিলাম। মেলা দিন হয় বিদেশে আছি, অনুবাদের ভুলত্রুটি মার্জনীয়।
১.২
প্রায় মাসখানেক নৌযাত্রার পর আমরা চার্তিকান (বর্তমান চট্টগ্রাম) এসে পৌঁছালাম। স্থানীয় লোকজন আমাদের বেশ সাদরে বরন করে তাদের রাজার কাছে নিয়ে চললো। এই রাজা অবশ্য মহান বাংলার রাজা নন, ছোটখাট গভর্নর টাইপের মানুষ এখানে “রাজা” টাইটেল নিয়ে বসে থাকে। মহান বাংলার রাজা (এই রাজা সম্ভবত মগ রাজা, কিংবা আরাকান রাজা) থাকেন আরও উত্তরে, তিরিশ কি চল্লিশ লীগ (এক লীগ= সাড়ে তিন বা চার কিমি ) দূরে।
যাহোক রাজাসাহেব আমাকে অনেক যত্নআত্তি করে বললেন আমি যেমন খুশী চলতে পারি যা খুশী করতে পারি, পূর্ণ স্বাধীনতা! কিন্তু অল্প কিছুদিন পরেই আর ভালো লাগছিল না, কালিকটমুখী একটা ওলন্দাজ জাহাজ দেখে উঠে পড়লাম…হয়তো ফ্রান্সে যাবার একটা গতি হবে ওখান থেকে।
এই অল্প কদিনে তেমন কিছু দেখে উঠতে পারিনি বাংলা, তবু যা মনে পড়ছে লিখছি।
রাজ্য হিসেবে বাংলা বিশাল, কেউ কেউ বলে চারশ লীগ এর পরিধি। তা যদি সত্য হয়ে থাকে তবে মহান মোগল শাসকের পরেই বাংলার রাজার স্থান। আমি বাংলা ছেড়ে আসবার সময় বাংলার সাথে মোগল যুদ্ধ ঘোষনা করেছে, বাংলার রাজাও দুই লাখ সৈন্য আর দশ হাজার হাতী নিয়ে প্রস্তুত। বাংলারাজকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে আরাকানের রাজা, চৌলের (পর্তুগীজশাসিত ভারতের বড় শহর, বর্তমানে নিশ্চিহ্ন ) রাজাসহ প্রভূত ধনবান ব্যক্তি। অনার্য মুসলমানেরাও রাজা যুদ্ধে গেলে মেলা লোকলস্কর আর হাতীঘোড়া দেয়, হাজার হোক তারা ব্যবসায়ী মানুষ রাজাকে চটানোর মত বোকামী করা মানে বিরাট লোকসান।
দেশটা খুব স্বাস্থ্যকর আর উর্বরা, অনেক লোকে একবারে কিছু না করে বেঁচে থাকে। এরা এত চাল উৎপন্ন করে যে সারা বাংলার চাহিদা মেটানোর পরেও সমগ্র ভারতে এমনকি সুমাত্রা, মালাক্কা, সুন্দ দ্বীপপুঞ্জে (বর্তমানে মালয়েশিয়ার অন্তর্গত) এরা চাল রপ্তানী করে থাকে। মূলত একারনেই চার্তিকান বন্দরে নানান দেশের নানান সাইজের জাহাজের ভীড় লেগে থাকে।
গরু ছাগলের কোন অভাব নাই দেশটায়, বাজারে মাংস বেজায় সস্তা। ফল-ফ্রুটেরও একই অবস্থা। গেন্ডারী (আখ) দিয়ে দেশটা ভর্তি, এরা গেন্ডারি দিয়ে উৎকৃষ্ট চিনিও বানায় আবার অনেকে দেখি কাঁচাই খায়। তুলা উৎপাদন করতেও এদের জুড়ি নেই, কাঁচামাল হিসেবে রপ্তানীর পাশাপাশি এরা উঁচুমানের তুলাজাত কাপড় তৈরি করতে ওস্তাদ। শুধু তাই না সিল্কের কাজও এরা অসম্ভব ভালো জানে, মাঝে মাঝে এদের তৈরী সিল্কের কাপড় পরা মানুষ দেখলে মনে হয় কিরে বাবা ন্যাংটো নাকি!
এছাড়া এমব্রয়ডারী, সূক্ষ্ম তাঁতের কাজ, জাহাজ নির্মাণ, কাঠের কাজ এসব এরা চরম দক্ষতার সাথে করে থাকে। বাংলায় হাতী গুনে শেষ করা যায়না, সারা ভারতে এখানকার হাতী রপ্তানী হয়। আর আছে গন্ডার, শিংঅলা অদ্ভুত প্রানী। মোদ্দা কথা, সারা ভারতে এমন প্রাচুর্যময় দেশ আমি দেখিনি।
বাংলায় দাসব্যবসার বড় রমরমা। কখনো কখনও পিতারা সন্তানকে দাস হিসেবে রাজার কাছে উৎসর্গ করে শুনেছি। দাসব্যবসায়ীরা সাধারনত এদের অল্পবয়সে খোজা বানিয়ে ফেলে, পুরো প্রত্যঙ্গটাই কেটে ফেলে দেওয়া হয়। আমি এরকম অনেক দেখেছি, প্রস্রাব করবার একটা ছোট ফুটো আছে শুধু। এমন করা হয় কারন এদেরকেই বাড়ীর মহিলাদের দায়িত্ব দেয়া হয়, চাবিও এদের হাতেই থাকে। বাড়ীর কর্তা এদেরকে অসম্ভব বিশ্বাস করেন, কিন্তু নিজের বউদের একটুও না। বিশেষ করে মুসলমানদের এটাই রীতি, এরা তাই ঘন ঘন বউও বদল করে। সারা ভারতের আর কোথাও দাসপ্রথা এত প্রকট না।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
বাংলার মানুষ তেমন যুদ্ধবাজ না, চুপচাপ ব্যবসা করাই এদের পছন্দ। এরা একদিকে যেমন নরম, ভদ্র, বুদ্ধিমান ঠিক তেমনই এদের মধ্যে দুনিয়ার ঠগ, জোচ্চর আর মিথ্যাবাদী ভরা। এদেশে প্রচুর বিদেশী দেখা যায়; যেমন ইরানী, আরব, গোয়া আর কোচিনের পর্তুগীজ লোক। এক রাজার শাসনে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বাস, যেমন ইহুদী, মুসলমান, অনার্য তথা মূর্তিপূজকের দল। মহান বাংলার রাজা মূর্তিপূজারী, চার্তিকানের রাজা মুসলমান।
বাংলার লোক খাবার আর পানীয় অতি অসভ্যের মত হাত দিয়ে খায়। তাদের একগাদা কাজের লোক থাকে ঘরের কাজের জন্য, তিন/চারটা বউও রাখা তাদের জন্য স্বাভাবিক। চিনি দিয়ে এরা একরকম শরবত খায়।
প্রচুর পর্তুগীজ বাংলার সমুদ্রতীরবর্তী এলাকাগুলোতে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায়। কোন নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে এরা জিনিষপত্র একজায়গা থেকে অন্যজায়গায় পাচার করে। অতি অধার্মিক এরা, কোন পাদ্রীও নেই এদের। (এই পর্তুগীজের দল মূলতঃ নির্বাসিত অপরাধী, এদের জীবন কাটতো আধা জলদস্যু আধা রাজার ভাড়া খাটা সৈনিক হয়ে। এদের একজন, সেবাস্টিয়ান গনজালেজ টিবাও, মোগলদের বাংলা ও আরাকান আক্রমনের সময় নাম কুড়ায়। প্রথমে আরাকানের রাজার পক্ষে লড়ে পরে তারই বিপক্ষে গিয়ে আরাকান আক্রমন করে বসে।)
এই দেশের মানুষ গঙ্গা নদীর বড় ভক্ত। এরা মনে করে গঙ্গা একবারে স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে, এদের রাজারা অনেক চেষ্টা করেছে নদীর উৎপত্তিস্থল জানার জন্য, পারেনি। নদীভর্তি কুমির, মাছেরও অভাব নাই।
ভারতীয়রা গঙ্গাকে পবিত্র ভাবে, মনে করে অখানে একডুব দিলেই সব পাপ ধুয়েমুছে যায়। মুসলমানরাও তেমনটাই ভাবে, এই পানি তাদের কাছে মক্কার মুহাম্মদের মাজারের পানির মতই পবিত্র। (জম-জমের পানি)
এই মোটামুটি আমার অল্প সময়ে দেখা বাংলা।