মার্চ ১৩, ১৯৫৭। প্রেসিডেন্টের বাসভবনের উপর এক ভয়াবহ আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। বাতিস্তাকে হত্যা করে বিপ্লবী সরকার গঠন করাই এর মূল লক্ষ্য ছিলো। আক্রমণ পরিচালনা করেছিলো একটা আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি। হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান এবং প্রাক্তন ছাত্রদের নিয়ে গড়া হয়েছিলো এই আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টিটি। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট প্রায়োর অনুসারীরাও এতে অংশ নেয়। গার্ডরা যখন লাঞ্চ ব্রেকে ছিলো, তখন এরা একটা ট্রাক নিয়ে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদের একটা গেইট দিয়ে ঢুকে পড়েছিলো।
সেখান থেকে দোতলাতেও উঠে যায় তারা। এর বেশি উপরে যেতে পারে না তারা কারণ প্রতিটা সিঁড়িতে লোহার শক্ত দরজা লাগানো ছিলো। বাতিস্তা তিন তলায় ছিলেন। আক্রমণ হবার সাথে সাথে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই সাথে লিফটগুলোরও পাওয়ার অফ করে দেয় নিরাপত্তাকর্মীরা। চার ঘণ্টার লড়াইয়ের পর প্রাসাদে ঢুকে পড়া সব বিপ্লবীকেই হত্যা করে নিরাপত্তারক্ষীরা। আক্রমণ ব্যর্থ হবার পিছনে অন্যতম একটা কারণ হচ্ছে, আরেকটা গ্রুপ এই আক্রমণে ব্যাক আপ সাপোর্ট হিসাবে থাকার কথা ছিলো। তারা সময়মতো এসে পৌঁছায়নি।
প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ আক্রমণের অংশ হিসাবে ছাত্রদের আরেকটা অংশ হাভানার শহরতলীতে অবস্থিত সিএমকিউ ব্রডকাস্টিং স্টেশন দখল করে নিয়েছিলো। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে আক্রমণ সফল হলে, বাতিস্তা নিহত হয়েছে এবং তার সরকারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, এই ঘোষণা এখান থেকে দেবার কথা ছিলো। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের আক্রমণ ব্যর্থ হওয়ায় এরাও রেডিও স্টেশন থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু, এদের জন্য পুলিশ বাইরে অপেক্ষায় ছিলো। প্রতিটা বিপ্লবী ছাত্রই নিহত হয় পুলিশের গুলিতে।
ফিদেল ক্যাস্ট্রো এই সব ঘটনার কোনোটার সাথেই জড়িত ছিলেন না। বাতিস্তা সরকার উচ্ছেদের অন্যদের প্রচেষ্টায় তিনি নিজেকে কখনোই জড়াতেন না। বাতিস্তাকে নিজে উচ্ছেদ করবেন, বা হত্যা করবেন, পুরো কৃতিত্ব তাঁর একার হবে, এই মানসিকতা নিয়েই কাজ করে যাচ্ছিলেন তিনি।
প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের অসফল আক্রমণের অল্প দিনের মধ্যেই গ্রামা আক্রমণের মতো আরেকটি ইয়াট অবতরণ হয় কিউবাতে। ২৬জন বিপ্লবী নিয়ে কোরিন্থিয়া ইয়াট অবতরণ করে ওরিয়েন্তে প্রদেশে। গ্রামার মতো এটাও কিনে দিয়েছিলেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট প্রায়ো। শুধু ফিদেল ক্যাস্ট্রোর বাহিনীর মতো মেক্সিকোর বদলে এই বিপ্লবীরা এসেছিলো মায়ামি থেকে। ক্ষমতাচ্যুত হবার কিউবা থেকে পালিয়ে গিয়ে প্রেসিডেন্ট প্রায়ো তাঁর সদর দপ্তর খুলে বসেছিলেন সেখানে।
এই বিপ্লবীদের উদ্দেশ্য ছিলো অবতরণ করে সিয়েরা ক্রিস্টাল পর্বতে আশ্রয় নেওয়া এবং সেখান থেকে ফিদেল ক্যাস্ট্রো যেমন সিয়েরা মায়েস্ত্রা থেকে গেরিলা দল পরিচালনা করছেন, সেরকম গেরিলা দল তৈরি করা। এদের অবতরণ নিরাপদ হলেও, বাকি সব পরিকল্পনা করা হয়েছিলো খুব বাজেভাবে। কাছাকাছি অবস্থিত আর্মি পোস্টের সৈন্যদের দ্বারা এরা অবরুদ্ধ হয়ে যায় খুব দ্রুত। তারপর এদের সবাইকে খুন করা হয় ঠাণ্ডা মাথায়। এই আদেশ দিয়েছিলো বাতিস্তা আর্মির সবচেয়ে নৃশংস অফিসার কর্নেল ফারমিন কাউলি। এর কিছুদিন পর এর প্রতিশোধ হিসাবে স্থানীয় বিপ্লবীরা হত্যা করে কর্নেল কাউলিকে।
এর মধ্যে আরেক ঘটনা ঘটে। এটা কাঁপিয়ে দেয় বাতিস্তার স্বৈরশাসনকে। হাভানা থেকে ১৫০ মাইল দূরে সিয়েনফুয়েগসে নৌ সেনারা বিদ্রোহ করে। পুরো কিউবার নৌ সেনাদের বিদ্রোহ করার কথা ছিলো। এর পিছনে ক্যাস্ট্রোর ২৬শে জুলাই আন্দোলন বাহিনী এবং প্রেসিডেন্ট প্রায়োর দলও যুক্ত ছিলো। এর জন্য তারিখ ঠিক করা হয়েছিলো, কিন্তু পরে আবার সেই তারিখে বিদ্রোহের পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু, এই বাতিল হবার খবর সিয়েনফুয়েজসের ন্যাভাল গ্যারিসনে ঠিকমতো পৌঁছায়নি।
তারা আগের সময়সূচী অনুযায়ী বিদ্রোহ শুরু করে দেয়। ৪৫ মাইল দূরের সান্টা ক্লারা শহর থেকে আর্মি মুভ করে বিদ্রোহ দমন করতে। সাথে থাকে ট্যাংক। আকাশপথেও হামলা চালানো হয়। বিমানগুলোকে বলা হয়েছিলো শহরে বোমা ফেলতে। বেশ কয়েকজন বৈমানিক এই আদেশ অমান্য করে সাগরে বোমা ফেলে। এর জন্য পরবর্তীতে এদের কোর্ট মার্শাল হয়েছিলো। প্রত্যেকের ছয় বছর করে জেল হয়ে যায় আদেশ অমান্য করার অপরাধে।
সিয়েনফুয়েজসের নৌ বিদ্রোহের পরই বাতিস্তা বুঝে যান যে, এটা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা না। পুরো নৌবাহিনীই আসলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চেয়েছিলো। প্রতিটা ন্যাভাল পোস্টকেই সেনা দিয়ে অবরুদ্ধ করে ফেলেন তিনি। সিয়েনফুগসের বিদ্রোহের নেতা হোসে স্যান রোমানকে নির্মমভাবে অত্যাচার করে হত্যা করে ন্যাভাল ইন্টেলিজেন্স। বহু নৌসেনাকেও হত্যা করা হয়। তবে, এর মাঝ দিয়ে অনেক নৌসেনা পালিয়েও যায়। এরা আশ্রয় নেয় পাশের পাহাড় সিয়েরা দেল এসক্যামব্রেতে। এখানে তারা সুসংহত ও সক্রিয় হয় এবং বাতিস্তার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় সামরিক ফ্রন্ট চালু করে।
১৯৫৮ সালের মধ্যে দুটো বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়। বাতিস্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। একঃ শক্তি প্রয়োগ করে কিংবা বাতিস্তার অধীনে কোনো নির্বাচন দিয়ে এর থেকে মুক্ত হবার আর কোনো সুযোগ নেই। দুইঃ অনেক বিদ্রোহী এবং গেরিলা গ্রুপ বাতিস্তার বিরুদ্ধে মাঠে নামলেও ফিদেল ক্যাস্ট্রো নিজেকে অন্যতম একক নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
১৯৫৮ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে ফিদেল ক্যাস্ট্রো বাতিস্তার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেন। কম্যুনিস্টরা ফিদেলের এই ডাকে সাড়া দেয়নি বা একে সমর্থন করেনি। কম্যুনিস্টরা এর আগে ক্যাস্ট্রোকে বাতিস্তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইউনাইটেড ফ্রন্ট খোলার প্রস্তাব দিয়েছিলো। ক্যাস্ট্রো সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলো।
সেই ক্ষোভে কম্যুনিস্টরা এই সাধারণ ধর্মঘট থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে। সাধারণ ধর্মঘট চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়। বাতিস্তা মহাখুশিতে প্রচার করা শুরু করে যে বিদ্রোহীদের জ্বালানি শেষ হয়ে গিয়েছে। বাকি যেটুকু আছে, সেটাকেও নিঃশেষ করে দেবার জন্য দক্ষ জেনারেল ইউলোজিও ক্যান্টিলোকে দায়িত্ব দেন।
সিয়েরা মায়েস্ত্রার পাহাড়ি এলাকা থেকে শেষ বিদ্রোহীকেও শেষ করে দেবার জন্য জেনারেল ক্যান্টিলো তাঁর বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিদ্রোহীদের শেষ করার বদলে জেনারেলের বাহিনীর করুণ পরাজয় ঘটে। এটাই কিউবার বিপ্লবের টার্নিং পয়েন্ট হিসাবে আসে। এই বিজয়ের পর থেকেই বিদ্রোহীরা পাহাড় থেকে বের হয়ে এসে আক্রমণ করা শুরু করে। অক্টোবরের মধ্যেই তারা ওরিয়েন্তে প্রদেশের রাজধানী স্যান্টিয়াগো ডে কিউবার সাথে সারা দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
অক্টোবরেই ক্যাস্ট্রোর একটা বাহিনী, চে গুয়েভারার নেতৃত্বে একেবারে বিনা বাধায় লা ভিলার এসকাম্ব্রে পাহাড়ে চলে আসে। এর জন্য অবশ্য মূল কৃতিত্ব প্রাপ্য ফিদেল ক্যাস্ট্রো। কারণ তিনি উচ্চ পদস্থ আর্মি অফিসারদের প্রচুর টাকা ঘুষ দিয়ে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিলেন। শুধু নিষ্ক্রিয় না, এরা তাদের সৈন্যদের প্রত্যাখ্যান করে নিয়েছিলো গেরিলাদের আগমনকে বাধাহীন করার জন্য। এই অফিসারদের মধ্যে একজন ছিলেন বাতিস্তার সেনা প্রধান জেনারেল ফ্রান্সিসকো ট্যাবারনিলার আত্মীয় কর্নেল চ্যাভিয়ানো।
বাতিস্তা তাঁর আর্মি অফিসারদের এই বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি কর্নেল চ্যাভিয়ানোকে এর জন্য ডেকে নিয়ে কৈফিয়ত তলব করেন। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের এক পর্যায়ে বাতিস্তা কর্নেলের গালে চড়ও বসিয়ে দেন। তারপর তাঁর কোর্ট মার্শালের নির্দেশ দেন। সেনা প্রধান বাতিস্তার এই আদেশ অমান্য করে কর্নেল চ্যাভিয়ানোকে দেশ থেকে বের হয়ে যেতে সাহায্য করেন।
বড় দিনের আগেই বাতিস্তা সরকারের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে পড়ে। গুয়েভারার বাহিনী এসক্যাম্ব্রে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা শহর স্যাংকটি স্পিরিটাস দখল করে নেয়। সেখান থেকে প্রদেশের রাজধানী শহর সান্টা ক্লারাতে আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে।
ক্যাস্ট্রো বাহিনীর এই সব সাফল্যের পাশাপাশি গুজব রটে যায় যে, সেনা প্রধান জেনারেল ইউলোজিও ক্যান্টিলো ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সাথে গোপন সভা করছে। এগুলো পুরো কিউবান সেনাবাহিনীর যুদ্ধ করার মনোবলকে একেবারেই ভেঙে দেয়। ডিসেম্বরের একত্রিশ তারিখে সান্টা ক্লারা দখল করে নেয় ক্যাস্ট্রোর বিপ্লবী বাহিনী। পরের দিন অর্থাৎ ১৯৫৯ সালের প্রথম দিনেই সেনা প্রধান জেনারেল ক্যান্টিলোর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বাতিস্তা তাঁর পরিবার নিয়ে কিউবা থেকে পালিয়ে যান ডমিনিকান রিপাবলিকে।
বাতিস্তার পলায়নের খবরে তীব্র প্রতিক্রিয়া আসে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কাছ থেকে। তিনি জেনারেল ক্যান্টিলোকে বিশ্বাসঘাতক হিসাবে আখ্যা দেন এবং তাঁর সমস্ত কমান্ডিং অফিসারদের বিপ্লব শেষ হয়েছে এই ধারণায় সন্তুষ্টিতে না ভুগে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। বাতিস্তার সেনাবাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের আগ পর্যন্ত তাঁদের যুদ্ধ চলবে এই প্রত্যয় ঘোষণা করেন তিনি।
বাতিস্তার পক্ষে যেমন কোনো কিছুই অনুকূলে ছিলো না, ক্যান্টিলোর ক্ষেত্রেও তাই ঘটতে লাগলো। বেশির ভাগ আর্মি অফিসারই তখন আত্মসমর্পণ করে বসেছে বিপ্লবীদের কাছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি তাঁকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ পড়াতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। সেই রাতের শেষের দিকেই কর্নেল র্যামন পাইনস অব আইলের জেলখানা থেকে বের হয়ে এসে দ্রুতগতিতে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেছেন কিউবার সবচেয়ে বড় মিলিটারি পোস্ট ক্যাম্প কলাম্বিয়ার।
এখান থেকে কর্নেল র্যামন পরিষ্কারভাবে জেনারেল ক্যান্টিনোকে জানিয়ে দেন যে, তিনি হ্যাভানার সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব হাতে তুলে নিয়েছেন। তিনি বিপ্লবীদের একজন সমর্থক। সেই সাথে তিনি এটাও জানান যে, জেনারেল ক্যান্টিলোকে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মনোনীত ব্যক্তি ডঃ ম্যানুয়েল উরুতিয়ার কাছে প্রেসিডেন্সি হস্তান্তর করতে হবে। এই রকম বিপদজনক পরিস্থিতিতে জেনারেল ক্যান্টিলোর এই নির্দেশ অমান্য করার অবস্থা থাকে না। পরের দিনই তিনি ডঃ ম্যানুয়েল উরুতিয়ার কাছে কিউবার প্রেসিডেন্সি হস্তান্তর করেন।
স্বৈরশাসক বাতিস্তার বিরুদ্ধে ফিদেল ক্যাস্ট্রো এবং অন্যান্য বিদ্রোহীদের বিপ্লবের পরিসমাপ্তি ঘটে। যদিও ফিদেল ক্যাস্ট্রো তখনো হাভানা থেকে বহু দূরে।
অন্যান্য পর্বগুলো পড়ুন এখানে ⇑