মওলানা ভাসানীর আসল নাম হচ্ছে আবদুল হামিদ খান। আসামের ভাসানচরে আন্দোলন সংগ্রাম করার কারণে তিনি ভাসানী উপাধি পান। মাদ্রাসায় পড়ালেখা করার কারণে মওলানা উপাধিও জুটেছিল তাঁর। টুপি দাঁড়ি পরা এক মওলানা হলেও, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি বামপন্থী এবং একজন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হিসাবেই বেশি পরিচিত। কিন্তু, এই বহুল পরিচিতি যে একটা মিথ, তিনি অসাম্প্রদায়িক কোনো ব্যক্তি ছিলেন না, ছিলেন একজন ধর্মান্ধ মুসলমান, সেটার একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র আমি তুলে ধরতে যাচ্ছি এখানে।
মওলানা ভাসানীর সাম্প্রদায়িক চরিত্র প্রথম প্রকাশ্যে আসে ১৯৭০ সালের মার্চ মাসের ২১ তারিখে। পশ্চিম পাকিস্তানে এক রাজনৈতিক সফরে যাবার প্রাক্কালে ঢাকা বিমান বন্দরে তিনি বলেন,
“পূর্ববাংলার হিন্দু বামপন্থী নেতারা তাদের ভক্ত নগণ্য মুসলমান কর্মীদের সাথে নিয়ে ন্যাপ ও কৃষক সমিতিকে ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। পূর্ব বাংলার জনসংখ্যার শতকরা ৯৯ জনই মুসলমান, কাজেই তাদের এ ব্যাপারে বিভ্রান্ত করা সম্ভব নয়। ”
তাঁর এই বক্তব্য শুধু সাম্প্রদায়িকই নয়, একই সাথে তথ্যগত ভুলেও ভরা। সেই সময় পূর্ব বাংলার শতকরা ৯৯ জনই মুসলমান ছিলো না। তাঁর মাপের একজন লোক এ ধরনের ভুল তথ্য দেবেন, এটা আশা করা যায় না। কিন্তু, তিনি তাঁর মুসলমান প্রীতির চোখ দিয়ে দেখতে গিয়ে পূর্ব বাংলার মানুষদের শতকরা নিরানব্বই জনকেই মুসলমান হিসাবে দেখেছেন।
মওলানা ভাসানীর এই সাম্প্রদায়িক বক্তব্য হুট করে আসেনি। এর আগ থেকেই তিনি সমাজতন্ত্রেরও খৎনা করে ইসলামি সমাজতন্ত্র নামের এক অদ্ভুত সমাজতন্ত্রের প্রচার করে আসছিলেন। মওলানার এই সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেন বদরুদ্দীন উমর। তিনি এর প্রতিক্রিয়ায় লেখেন,
“এতদিন যাঁরা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে মাওলানা ভাসানীর সাথে একত্রে কাজ করছেন তাঁরাতো বটেই, এমনকি পূর্ব বাংলার সংগ্রামী জনগণও যে মাওলানার উক্তিতে লজ্জিত ও বিক্ষুব্ধ হবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বামপন্থী নেতাদেরকে ‘হিন্দু’ হিসেবে আখ্যায়িত করে মাওলানা ভাসানী যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন করতে চাইছেন, তা মূলতঃ মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্যে থেকে পৃথক নয়, বরং তা পরিপূরক।”
তাঁর এই বক্তব্য যে আকস্মিক কিছু নয়, বরং তিনি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ছেন, সেটাও উঠে এসেছে বদরুদ্দীন উমরের লেখায়। তিনি লেখেন,
“ঢাকা বিমান বন্দরে ২১শে মার্চ মাওলানা ভাসানী সাংবাদিকদের কাছে যে বিবৃতি দেন তা আকস্মিক অথবা উদ্দেশ্যহীন নয়। বস্তুত, বামপন্থী প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট থাকলেও বিগত এক বছর থেকে তিনি বেশ ভালভাবেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দিকে ঝুঁকেছেন।”
মওলানার বকচ্ছপ ইসলামি সমাজতন্ত্রেরও তীব্র সমালোচনা করেন বদরুদ্দীন উমর। এ প্রসঙ্গে তিনি লেখেন,
“১৯৬৯ সালে মার্চ মাসের গোড়া থেকেই মাওলানা ভাসানী ইসলামী সমাজতন্ত্রের প্রচারক। প্রায় পনেরো ষোল বছর রাজনীতি ক্ষেত্রে সেই প্রথম তাঁর ইসলাম আমদানী। সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে মাওলানার ইসলামী সমাজতন্ত্রের ধ্বনি আকস্মিক হলেও তার আসল উদ্দেশ্য জনগণের গণতান্ত্রিক অগ্রগতিকে রোধ করা।
মাওলানা নিজের দক্ষিণপন্থী পথ অনুসরণ করতে গিয়ে শুধু ইসলামী সমাজতন্ত্রের কথা বলেই ক্ষান্ত হননি। তিনি সাম্প্রদায়িক জিগীর তুলে বিগত ৩রা অক্টোবর আহমেদাবাদ ‘দাঙ্গা বিরোধী দিবস’ পালনেরও আহবান জানিয়েছিলেন। সেই আহবানের ফলে চারিদিকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি এবং তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহলের প্রতিবাদের মুখে পড়ে তাঁর সেই আহবান অবশ্য তাঁকে বাধ্য হয়ে প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছিল।
রাজনীতিতে ধর্ম টেনে আনার এর থেকে বড় উদাহরণ আর কি হতে পারে? এই কাজই তো এতদিন পর্যন্ত এদেশে মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী একটানাভাবে করে এসেছে। মাওলানা ভাসানীও একাজে শরীক হয়েছেন।”
বদরুদ্দীন উমর শুধু একা নন, ভাসানীর নিজ দলের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ তোয়াহাও তাঁকে একইভাবে সমালোচনা করেছিলেন। ১৯৭০ সালের মে মাসে তিনি দল থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানিয়ে তিনি একটা চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে তিনি বলেন,
“সমাজতন্ত্র অর্জন ছিলো ন্যাপের লক্ষ্য। সমাজতন্ত্রের অর্থ হইল এক সম্পূর্ণ শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু, ন্যাপের প্রেসিডেন্ট মাওলানা ভাসানী সংগঠনের সহিত কোনো আলাপ আলোচনা না করিয়াই ইসলামী সমাজতন্ত্রের বাণী প্রচার শুরু করিলেন।
অথচ মাওলানা সাহেব সে জন্য আন্দোলন করিতেছেন না। কার্যত তিনি আন্দোলন করিতেছেন এই শোষণ ও শাসন ব্যবস্থাকে বাঁচাইয়া রাখার জন্য।
ন্যাপের মূলনীতি ছিলো অসাম্প্রদায়িকতা। কিন্তু, মাওলানা সাহেবের বিভিন্ন বক্তৃতা ও বিবৃতিতে আজকাল সাম্প্রদায়িকতা প্রকাশ পাইতেছে।”
রাজনীতিতে ধর্মকে টেনে আনার কাজ স্বাধীনতার পরেও অব্যাহত রাখেন তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশে তখন সংবিধান রচিত হচ্ছে। সেই সংবিধান যাতে কোরান-সুন্নাহর আলোকে হয়, সেজন্য সরকারকে হুশিয়ারি দেন মওলানা। ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসের ৮ তারিখে ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসমাবেশ করেন তিনি। সেই জনসমাবেশে তিনি বলেন,
“কোরান, সুন্নাহ, ওয়াজেব, শরীয়ত ও হাদিসের খেলাফ করিয়া কোন শাসনতন্ত্র মুসলমানের উপর জোর করিয়া চাপাইয়া দেওয়া হইলে মুসলমানগণ একবিন্দু রক্ত থাকিতে তাহা মানিবে না।”
বাংলাদেশ হানাদার দখলমুক্ত হবার তিন মাসের মাথায় ভাসানী ‘জ্বালাও-পোড়াও নীতি’র পথ ধরেছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ার বিপরীতে বিপর্যস্ত করে তোলায় সক্রিয় হন। এমনকি অসংখ্য শহীদের রক্তের দামে কেনা দেশের নাম বদলানোর প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গেও কণ্ঠ মেলান তিনি। স্বাধীনতার পর বেআইনি ঘোষিত জামায়াত, নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও পিডিপির আত্মগোপনকারী নেতাদের একটা অংশ ভাসানীর ছত্রছায়ায় আশ্রয় নেয়।
তারাও ভাসানী ও ভুট্টোর প্রেরণা এবং উৎসাহ পেয়ে ‘মুসলিম বাংলা’ প্রতিষ্ঠার গোপন তৎপরতায় লিপ্ত হয়। মওলানা ভাসানী এসব অশুভ শক্তির গোপন তৎপরতার প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন দিয়ে বলেন, ‘মুসলিম বাংলার জন্য যারা কাজ করছে, তাদের আমি দোয়া করি, আল্লাহর রহমতে তারা জয়যুক্ত হবে।’
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
মওলানা ভাসানী নিজেও ‘ খোদাই খিদমতগার ↑ ’ নামে একটি সংগঠনের জন্ম দেন। তাঁর ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক অনুসারীরা এই সংগঠনের ছত্রছায়ায় ‘মুসলিম বাংলা’র পক্ষে তৎপরতা চালায়। এই সংগঠনে অধিকাংশই স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদর সদস্যরা ছিলো।
১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিল ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইলের সন্তোষে ‘মুসলিম সম্মেলনের’ আয়োজন করেন। এই সম্মেলনে যোগদানের জন্য প্রকাশিত লিফলেটের আর্জিতে ‘খাদেমুল ইনসান’ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী উল্লেখ করেছেন,
‘যে মুসলমান সমাজ এককালে বিশ্বের সেরা জাতি ছিল, দিল্লিতে সাতশ বছর জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের ন্যায়পরায়ণ বাদশা ছিল, আজ তাহারাই পথের কাঙাল হইয়া পড়িয়াছে। বিধর্মীরা কতিপয় হিন্দুস্থান সরকারের দালাল মুসলমানদের সহায়তায় রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে নিরপরাধ মুসলমানদিগকে অপমান, অপদস্থ ও মারপিট করিতেছে।
আমাদের ধর্মের বিধান ও আল্লাহর আদেশ- বিধর্মীরা যদি মুসলমানদের প্রতি অন্যায়ভাবে প্রথমে আক্রমণ না করে তাহা হইলে তাহাদের কখনও আক্রমণ করা যাইবে না। তাহাদের ধর্মের কোন প্রকার বিঘ্ন ঘটানোও যাইবে না। কিন্তু যদি তাহারা অন্যায়ভাবে মুসলমানদিগকে আক্রমণ করে, তাহা হইলে উহা কিছুতেই বরদাস্ত করিবে না, পাল্টা আক্রমণ করিয়া সমুচিত শাস্তির ব্যবস্থা করিতেই হইবে।’
মওলানার আবেদন তথা আর্জিতে আরো উল্লেখ করা হয়,
‘আমি কঠিন রোগে আক্রান্ত হইয়া অনেকদিন ঢাকার পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। বর্তমানে সন্তোষে ফিরিয়া আসিয়া জানিতে পারিলাম, টাঙ্গাইল জেলার এক শ্রেণীর ‘হিন্দুস্তানের দালালরা’ মুসলমানদের উপর নানাভাবে নির্যাতন চালাইতেছে। কিছু সংখ্যক উগ্রপন্থী হিন্দু আওয়ামী লীগ ইলেকশানে জয়লাভ করিবার পর হইতে মুসলমানদের উপর প্রকাশ্যভাবে নির্যাতনের স্টিম রোলার নির্বিবাদে চালাইয়া যাইতেছে। জানিতে পারিলাম, তাহারা একজন প্রবীণ মুসলমানের দাড়ি পর্যন্ত টানিয়া তুলিয়াছে।’
বাংলাদেশে বসবাসকারী হিন্দুদের সাবধান করে দিয়ে তিনি বলেন, তারা যদি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে তাদের নিরাপত্তা এবং স্বার্থরক্ষার নিশ্চয়তা পাবে বলে ভেবে থাকে, তবে সেটা ভুল ভাবনা। তিনি পরিষ্কার করে বলেন “জয় বাংলা অথবা আওয়ামী লীগ তোমাদের রক্ষা করতে পারবে না, তোমাদের ভাগ্য বিহারীদের মতোই হবে।’
এই হচ্ছে তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক লাল মাওলানার সাম্প্রদায়িক মনোভাবের সামান্য চিত্র। আসল চিত্র আরো গভীর। তাঁকে মহান বানানোর প্রক্রিয়ায় যাঁরা লিপ্ত রয়েছে, তাঁরা মাওলানার এই অংশটা প্রাণপণে ঢেকে রাখার চেষ্টা করেছে। এই চেষ্টাটা এখন আরো বেশি পরিমাণে দৃশ্যমান। শেখ মুজিবের পাল্টা একজন নেতা এই দেশে মুজিব বিরোধীদের জন্য খুব প্রয়োজন। সেই প্রয়োজনের স্বার্থে এক সময় জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানো হয়েছিলো। সময়ের বিবর্তনের জিয়াউর রহমান আবেদন হারিয়েছেন। তাই এখন ইতিহাসের ভাগাড় থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে একজন সাম্প্রদায়িক মানুষকে, যিনি প্রতি নিয়ত তাঁর নিজের অবস্থান বদলেছেন। তিনি নিজেই এক বিভ্রান্ত ধরনের মানুষ ছিলেন। এই বিভ্রান্তির কারণেই ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলেছেন তিনি। কখনো অসাম্প্রদায়িক কথা বলেছেন, কখনো সমাজতন্ত্রেরে ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছেন, আবার কখনো বা সাম্প্রদায়িক চেহারা দেখিয়েছেন, সমাজতন্ত্রীদের বিপক্ষে কথা বলেছেন। তাঁর এই সমস্ত বিভ্রান্ত কথামালা এবং আচরণকে বিশ্লেষণ করে, সঠিক ভাসানীকে তুলে আনার প্রয়োজন তাই এখন জরুরী। নইলে বহু সংখ্যক মানুষের কাল্পনিক নায়ক হয়ে ইতিহাসে ভুল জায়গায় বিচরণ করবেন তিনি। যার যোগ্য তিনি না, তাকে সেটাই বানানো হবে কল্পগল্প প্রচার করে করে।