এক
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মাত্র নয় মাসের, কিন্তু এর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। সেই সংগ্রামেরও অনেকগুলো ধাপ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম একটা হচ্ছে ১৯৫৭ সালে অনুষ্ঠিত কাগমারীর সম্মেলন। এই সম্মেলন এক বিশেষ তাৎপর্যবাহী জাতীয় সম্মেলন যা পরবর্তীতে পাকিস্তানের বিভক্তি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বিশেষ ইঙ্গিতবহ ভূমিকা রেখেছিল। কারণ এখানেই প্রথম পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের দাবি তোলা হয়। আর সেই দাবি প্রথম তোলেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।
ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখ থেকে এক সপ্তাহের জন্য এই সম্মেলন ডাকা হয়। এর মধ্যে ৭ এবং ৮ তারিখ ছিলো আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন। মওলানা ভাসানী তখন আওয়ামী লীগের সভাপতি আর শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক।
কাগমারি সম্মেলন উপলক্ষ্যে ১৩ই জানুয়ারি একটা ব্যক্তিগত প্রচারপত্র প্রচার করেন মওলানা ভাসানী। সেখানে তিনি বলেন,
“দেশের নানাবিধ সমস্যার সমাধানের উপায় উদ্ভাবন এবং আন্দোলনকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য আমি আগামী ৭ ফেব্রুয়ারী হইতে সপ্তাহব্যাপী সনোতাষ কাগমারীতে এক বিরাট সম্মেলন আহ্বান করিয়াছি। দল-মত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে উক্ত সম্মেলনে যোগদান করিয়া জনগণের দাবী আদায়ের আন্দোলন জোরদার করুন।”
৩রা ফেব্রুয়ারিতে কাগমারীর ডাক নামে তিনি আরেকটা প্রচারপত্রও ছাড়েন। সেই প্রচারপত্রে বুলেট আকারে পাঁচটা পয়েন্ট ছিলো। তাঁর প্রথম পয়েন্টই ছিলো “সাড়ে চার কোটি বাঙালির বাঁচার দাবী আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের ডাক।”
পাকিস্তানের কেন্দ্র এবং পূর্ব বাংলা, দুই জায়গাতেই আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায়। কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। দুটি প্রধান প্রধান বিষয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মওলানা ভাসানীর মতপার্থক্য শেষ পর্যন্ত মিমাংসার অযোগ্য বিরোধে পর্যবসিত হয়। যার একটি অবহেলিত শোষিত পূর্ব বাংলার পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আর অপরটি সকল সামরিক চুক্তি বাতিল করে জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ। এই দুটি বিষয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন আপোষ প্রবণ ও নমনীয়। পক্ষান্তরে, মওলানা ভাসানী ছিলেন অনড় ও আপোষহীন। তিনি কাগমারী সম্মেলনে বলেন,
একুশ দফা ওয়াদার মূল দফা এবং আওয়ামী লীগ ম্যানিফেস্টোরও প্রধান দফা হল পররাষ্ট্র, মুদ্রা এবং দেশরক্ষা বিভাগ ছাড়া আর সকল বিভাগের ভার প্রদেশকে দিতে হবে। কারণ, যতদিন না পূর্ব পাকিস্তান তার অর্জিত বৈদিশিক মুদ্রা খরচ করার পূর্ণ ক্ষমতা পাচ্ছে, যতদিন না শিল্প ও বাণিজ্য, রেলওয়ে, পোস্ট অফিস প্রভৃতি বিভাগগুলির পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থানীয় সরকারের হাতে আসছে, যতদিন না পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক বিচারে দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ইউনিট বলে স্বীকার করা হচ্ছে- ততদিন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল সম্ভব নয়।” তিনি তাঁর ভাষণের এক পর্যায়ে গিয়ে বলেন, “পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের শোষণ যদি বন্ধ না হয় তবে অদূর ভবিষ্যতে এমন দিন আসিবে, যখন পূর্ব পাকিস্তান হয়ত পশ্চিম পাকিস্তানকে জানাইবে ‘আসসালামো আলায়কুম’।
মওলানার ভাষণের বিপরীতে সোহরাওয়ার্দী বলেন,
স্বায়ত্তশাসনের দাবীর বাস্তব ভিত্তি নাই। কারণ, স্বায়ত্তশাসন মোতাবেক এই দাবীর শতকরা ৯৮ ভাগই স্বীকার করিয়া লওয়া হইয়াছে। এমন কতকগুলি ব্যাপার যেমন বৈদেশিক সাহায্য, কেন্দ্রীয় অর্থ বণ্টন বিষয়ে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন রহিয়াছে।
ভাসানীর ওই ‘আসসালামো আলায়কুম’ বক্তব্যকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্নতার মতলব হিসাবে ধরে সেটার কঠোর সমালোচনা করে মুসলিম লীগের মুখপত্র ‘দৈনিক আজাদ’। সেখানে লেখা হয়,
“পাকিস্তান সম্পর্কে কোন পাকিস্তানীর মুখে পাকিস্তান বিচ্ছেদের মারাত্মক কথা যে এমন হালকাভাবে উচ্চারিত হইতে পারে, ইহা কে কবে ভাবিতে পারিয়াছিল? এমন কথা মুখে উচ্চারণ করিতে পারেন মাত্র তাঁরাই, যাঁরা পাকিস্তানের সংহতির কোন গুরুত্বই উপলব্ধি করিতে পারেন না। পাকিস্তানের উভয় অংশ যদি খোদা না করুন, পৃথক হইয়া পড়ে, তাহা হইলে পাকিস্তানের অস্তিত্ব থাকিবে কী? আর থাকিলেও বিশ্ব রাজনীতিতে তার কোন গুরুত্ব থাকিবে কি? পশ্চিম পাকিস্তান বিদ্বেষে এমন কথা কোন পাকিস্তানী উচ্চারণ করিলে তাতে তার পূর্ব পাকিস্তান নীতি হয়ত প্রকাশ পাইতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানের প্রতি ইহা রাষ্ট্রদ্রোহকর উক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাছাড়া মওলানা ভাসানীর দলই যখন বর্তমানে রাষ্ট্রতরণীর কর্ণধার তখন এমন উক্তির মাত্র একটাই অর্থ হইতে পারে, এবং তা হইতেছেঃ যিনি এমন উক্তি করেন, পাকিস্তান হিসাবে এই রাষ্ট্রের টিকিয়া থাকা তাঁর কাম্য নয়।”
১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মওলানা ভাসানী স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলেছেন, সেটা না হলে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার ইঙ্গিত সবার আগে দিয়েছেন, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু, এই স্বায়ত্তশাসনের দাবি তিনি একা ব্যক্তিগতভাবে করেননি। তাঁর বক্তব্যেই পরিষ্কারভাবে উল্লেখ ছিলো এটা আসলে আওয়ামী লীগের দলীয় দাবি ছিলো। এবং সেটা আরো তিন বছর আগেই দলীয় দাবি হিসাবে গৃহীত হয়েছে। তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসাবে পুরনো সেই দলীয় দাবিটাকে কাগমারী সম্মেলনে তুলে ধরেছিলেন, আচমকা নতুন কিছু বলেননি।
এর মাত্র দুই মাসের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবস্থাপক সভায় স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব আনেন মহিউদ্দিন আহমেদ। প্রস্তাব আনতে গিয়ে তিনি বলেন,
“মিস্টার স্পিকার, স্যার আমি এখানে যে প্রস্তাবটা উত্থাপন করেছি তার জন্য আমি নিজেকে গৌরাবান্বিত মনে করছি। তার কারণ গত ১৯৫৪ সালে যে নির্বাচন হয়ে গিয়েছে এবং যার মারফৎ একটা প্রতিক্রিয়াশীল যুগের অবসান ঘটিয়ে নবযুগের সূচনা করেছিলাম সেই যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার ভিতর সর্বশ্রেষ্ঠ যে দফা ছিল সেটা হল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন।”
আশাবুদ্দিন আহমেদ বলেন,
“স্যার, স্বায়ত্তশাসনের দাবীর উপরেই পাকিস্তানের ভিত্তি। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবেও স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয়েছে। তাই এখন স্বায়ত্তশাসনের দাবীর বিরোধিতা করা লাহোর প্রস্তাব ও পাকিস্তানেরই বিরোধিতা করা হবে।”
শেখ মুজিবুর রহমান বলেন,
“ মিঃ স্পিকার, স্যার, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি আমরা যে শুধু এই পরিষদে পাশ করছি তাই নয়, এটা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবী। এই দাবীর ভিত্তিতে আমরা গত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করেছিলাম। পূর্ব পাকিস্তানের সকল শ্রেণীর লোক এই দাবী সমর্থন করেছেন। জাতীয় পরিষদে যখন শাসনতন্ত্র তৈরী হচ্ছিল তখন আমরা আওয়ামী লীগের ১২ জন সদস্য স্বায়ত্তশাসনের দাবী নিয়ে সংগ্রাম করেছিলাম।”
কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর স্বায়ত্তশাসনের দাবি এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামো আলায়কুম জানানোর গুরুত্বকে বিন্দুমাত্র খাটো করছি না আমি। এর গুরুত্ব আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অপরিসীম। কিন্তু, যেভাবে বলা হয় মওলানা ভাসানী একাই সর্বপ্রথম এই দাবি নিয়ে এসেছিলেন, সেটা কে একটু আবেগী কথাই বলা চলে। ১৯৫৭ সালের অনেক আগেই, সেই ১৯৫৪ সালের জানুয়ারি মাসে নির্বাচনের সময় যুক্তফ্রন্ট যে একুশ দফা নির্বাচনী ইশতেহারে এনে প্রচার করেছিলো, সেই একুশ দফার ঊনিশ নম্বর দফাতে পরিষ্কারভাবে স্বায়ত্তশাসনের কথা লেখা ছিলো।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
অবশ্য, সেখানেও মওলানার ভূমিকা ছিলো। এই দাবি যাঁরা একুশ দফাতে যুক্ত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন তিনি। সহজ ভাষায় বললে, স্বায়ত্তশাসনের দাবি আওয়ামী লীগের দলীয় দাবি ছিলো চুয়ান্ন সাল থেকেই। মওলানা এটাকে আবিষ্কার করেন নাই সাতান্নতে গিয়ে প্রথমবারের মতো। জনগণ অনেক আগে থেকেই স্বায়ত্তশাসন চাচ্ছিলো, যার কারণে যুক্তফ্রন্ট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এই দাবি সংযোজন করেছিলো। যুক্তফ্রন্টের সেই উনিশ দফাটা ছিলো এরকমঃ
“লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববংগকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌমিক করা হইবে এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত আর সমস্ত বিষয় (অবশিষ্টাত্বক ক্ষমতাসমূহ) পূর্ববংগ সরকারের হাতে আনয়ন করা হইবে এবং দেশরক্ষা বিভাগের স্থল-বাহিনীর হেডকোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তান, নৌবাহিনীর হেড-কোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করা হইবে এবং পূর্ব-পাকিস্তানে অস্ত্র নির্মাণের কারখানা নির্মাণকরতঃ পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হইবে। আনসার-বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হইবে।”
যে মওলানা ১৯৫৭ সালে পাকিস্তানকে আসসালামো আলায়কুম জানিয়েছিলেন, সেই মওলানাই পরবর্তীতে অখণ্ড পাকিস্তানের প্রতি অজ্ঞাত কারণে ভালবাসা দেখিয়েছেন। সেই প্রসঙ্গ আমি পরের পর্বে আনবো। সোহরাওয়ার্দীর সাথে দ্বন্দ্বে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাপ গঠন করেন তিনি ১৯৫৭ সালে। সোহরাওয়ার্দীর ডানঘেষা নীতির সাথে বামঘেষা মওলানা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেননি। ফলে, বামদের নিয়ে তিনি ন্যাপ নামের নতুন একটা দল গঠন করেন। এখান থেকেই মওলানার রাজনৈতিক জীবন ভিন্ন এক দিকে ধাবিত হয়। বিচিত্র কোনো কারণে আজীবনের সংগ্রামী এক জননেতা সামরিক শাসকদের প্রতি কোমলপ্রাণ হয়ে ওঠেন।
দুই
১৯৫৭ সালের জুলাই মাসে নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনে দেওয়া মওলানার ভাষণেও এর উল্লেখ দেখতে পাই। তিনি সেখানে বলেন,
“১৯৫৫ সনে শাসনতান্ত্রিক কনভেনশন নিয়া দেশে বিতর্কের সময়ে জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিজে হাতে লিখিয়া দিয়াছিলেন যে, মন্ত্রিত্বে থাকাকালে তিনি ২১-দফা মোতাবেক পুর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য প্রচেষ্টা করিবেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়া শহীদ সাহেব কি তাঁহার নিজ হাতে লিখিত সেই দায়িত্বের কথা ভুলিয়া গিয়াছেন?”
যে দাবি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনী ইশতেহারে লিপিবদ্ধ করেছে, ১৯৫৫ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রী হলে সেটা পূরণের জন্য চেষ্টা করবেন বলে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেই দাবি ১৯৫৭ সালে মওলানা প্রথম কাগমারীতে করেছেন, এই বক্তব্যের আসলে ভিত্তি নেই। মওলানার প্রতি অন্ধ আবেগ থেকে কিংবা ইতিহাস বিষয়ে অজ্ঞতা থেকে মওলানাকে এই কৃতিত্ব দেওয়া হয়। বাস্তবতা হচ্ছে, কাগমারীতে মওলানা যখন স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলেছেন, তখন এই দাবি একটা প্রতিষ্ঠিত দাবি। নতুন করে কিছু তিনি উদ্ভাবন করেননি।
কাগমারী সম্মেলনের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে বামপন্থীদের নিয়ে ন্যাপ গঠন করেন তিনি। মূলত সোহরাওয়ার্দীর ডান ঘেঁষা নীতির সাথে তুমুল দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন মওলানা। ফলে, আওয়ামী লীগের বিভাজন ছিলো খানিকটা অনিবার্যই। ন্যাপ এবং আওয়ামী লীগের আদর্শগত এই দ্বন্দ্ব আমাদের রাজনীতিকে কোথায় নিয়ে যেতো, সেটা বোঝার আগেই ১৯৫৮ সালে রঙ্গমঞ্চে আইয়ুব খানের আবির্ভাব ঘটে। আইয়ুব খানের সময়ে মওলানার এক বিশাল পরিবর্তন ঘটে। আজীবনের লড়াকু এক মজলুল জননেতা, সামরিক শাসকদের প্রতি প্রেমের দৃষ্টিতে তাকাতে শুরু করেন।
মওলানার এই প্রেম শুরুতেই শুরু হয়নি। আইয়ুব ক্ষমতা দখল করেই জেলে পুরে দেন মওলানাকে। প্রায় পাঁচ বছর জেলে থাকেন তিনি। ১৯৬৩ সালে জেলের মধ্যে অনশন ধর্মঘটে যান মওলানা। তখনই তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি পাবার পরে অদ্ভুত এক কাজ করেন মওলানা। তিনি আইয়ুবের প্রতিনিধি হিসাবে সরকারী সফরে চীনে যান। আইয়ুব খান তখন পররাষ্ট্রনিতিতে চীনের দিকে ঝুঁকছে। চীনের কম্যুনিস্ট শাসকদের সাথে সহজে আলাপ আলোচনার জন্য একজন কম্যুনিস্টকে প্রয়োজন ছিলো তাঁর। মওলানা এই জায়গাটাতে চমৎকারভাবে খাপ খাইয়ে যান। এই সামরিক শাসক যে জোর করে ক্ষমতা দখল করে রেখেছে, এর কারণে তিনি পাঁচ বছর জেলে কাটিয়েছেন, তার সবকিছু ভুলে গিয়ে আইয়ুব খানকে সেবা দিতে আন্তরিকভাবে মাঠে নেমে পড়েন তিনি। চীনে গিয়ে তিনি মাও সে তুং এবং চৌ-এন-লাই এর সাথে সাক্ষাৎ করেন।
মওলানা পিকিং থেকে ফিরে আসার পরে শুধু মওলানা ভাসানী একাই নন, চিনপন্থী কম্যুনিস্টদের একটা বড় অংশ আইয়ুব খানের ভক্ত বলে যায়। আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের মহিমা কীর্তন করা শুরু করে তারা।
তারিক আলী চীনপন্থী বাম ছাত্রনেতা ছিলেন। তাঁর একটা বই আছে। বইটার নাম “Pakistan, military rule of peoples power”। বইটা প্রকাশিত হয়েছে দিল্লি থেকে ১৯৭০ সালে। এই বইতে তারিক আলী পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সাথে মাওলানা ভাসানীর নিবিড় সখ্যের কারণ অনুসন্ধান করে তার পটভূমি আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি তাঁর বইতে লেখেন, ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইউব খান মাওলানা ভাসানীকে পাকিস্তানের সরকারী প্রতিনিধি করে চীনে পাঠাতে চাইলে মাওলানা রাজি হন। সেখানে চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুং এর সাথে তাঁর যে গোপন সলাপরামর্শ হয় তার একটা বিবরণ তিনি মাওলানার কাছ থেকেই গ্রহণ করেছিলেন টেপ রেকর্ডারে।
মওলানা ভাসানীর এই সামরিক শাসকের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের ফলাফল কী হতে পারে, সে সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মফিদুল হক লেখেন,
“১৯৬৩ সালে কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর জেনারেল আইউব আয়োজিত চীন সফরের পর থেকেই মাওলানা ভাসানীর পদস্খলন ঘটতে থাকে। চীনা রাষ্ট্র-নেতাদের আত্মস্বার্থ-প্রণোদিত নীতির কাছে মাওলানা ভাসানীর আত্মসমর্পণ এদেশের বাম রাজনীতির জন্য বিরাট দুর্ভাগ্যের সূচনা করে। রাজনৈতিক বিভ্রান্তি থেকে তিনি যে পথে পা দিয়েছিলেন তা শুধু আইউবের শাসনের সহায়ক ভূমিকা পালন করে নি, মাওলানা তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে সামরিক শাসকচক্রের যে সংযোগ গড়ে ওঠে তা পরবর্তী সময়েও বহু দুর্ঘটনার কারণ হয়েছিল।”
১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘোষণা করেন আইয়ুব খান। তবে, সেই নির্বাচন প্রত্যক্ষ ভোটে ছিলো না। আইয়ুব খান প্রনীত মৌলিক গনতন্ত্র নামের ইলেকটোরাল কলেজের মাধ্যমে এই নির্বাচন হবার কথা ছিলো। মৌলিক গণতন্ত্রীরা প্রথমে এলাকাভিত্তিক ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলো। এখন এদের ভোটেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবে।
আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে পাঁচটি রাজনৈতিক দল এককভাবে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই ধারণার জনক ছিলেন মুসলিম লীগের খাজা নাজিমুদ্দিন। এই পাঁচটি দল ছিলো আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ, ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (ওয়ালী খান) এবং নিজাম-এ-ইসলাম পার্টি।
জেনারেল আজম খানকে আইয়ুবের যোগ্য প্রার্থী হিসাবে শুরুতে বিবেচনা করা হয়েছিলো। কিন্তু, মওলানা ভাসানী তাঁর সামরিক শাসন সংশ্লিষ্টতা এনে তাঁকে বাতিল করে দেন। তাঁর নিজেরই ইচ্ছা ছিলো আইয়ুবের বিরুদ্ধে প্রার্থী হবার। অন্যদিকে ইসলামি দলগুলো আরেক মওলানা মওদুদীকে প্রার্থী করার জন্য চাপ দিচ্ছিলো। এই দুই মওলানাই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলো না। ফলে, তাঁদের প্রার্থীতা বাতিল হয় যায়। যোগ্য প্রার্থীর অভাবে যখন অচলাবস্থা চলছে, সেই সময়ে সীমান্ত গান্ধী আব্দুল গাফফার খান প্রার্থী হিসাবে জিন্নাহ-র বোন ফাতেমা জিন্নাহ-র নাম প্রস্তাব করেন।
ফাতেমা জিন্নাহ-র ক্লিন ইমেজের কারণে সবাই তাঁকে সানন্দে মেনে নেয়। সমস্যা বাধে তাঁকে রাজি করাতে গিয়ে। তিনি সহজে রাজি হতে চান না। এক পর্যায়ে গিয়ে রাজি হন। কিন্তু, শর্ত জুড়ে দেন যে মওলানা ভাসানী যদি নিশ্চয়তা দেন যে তিনি তাঁকে সহায়তা দেবেন, তাহলেই শুধু তিনি প্রার্থী হবেন, নইলে নয়। এর মানে হচ্ছে, ভাসানীর ব্যাপারে ফাতেমা জিন্নাহ-র আস্থা ছিলো না। ভাসানী তাঁর দাঁড়ি ছুয়ে প্রতিজ্ঞা করেন যে নির্বাচনে তিনি ফাতেমা জিন্নাহকে সহযোগিতা দেবেন। বাস্তবে তা অবশ্য ঘটে না। তিনি গোপনে তাঁর ইলেকটোরাল কলেজদের নির্দেশনা দেন আইয়ুব খানকে ভোট দিতে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহ হেরে যান, আইয়ুব খান তাঁর সামরিক পোশাককে আড়াল করে জনগনের নির্বাচিত বেসামরিক প্রেসিডেন্ট হয়ে যান।