মানুষের গল্পআশফাক আহমেদ

মানুষের ইতিহাস – পর্বঃ ৯

ভাবানুবাদঃ আশফাক আহমেদ

A Brief History of Humankind by Yuval Noah Harari – বই অবলম্বনে।

অর্থ বা সম্পদের গল্প

পাঁচশো বছর আগে গোটা পৃথিবীর মোট সম্পদের মূল্যমান ছিল ২৫০ বিলিয়ন ডলারের মত। আজ সেটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ ট্রিলিয়ন ডলার। কেবল মানুষ বেড়েছে বলেই কি সম্পদের এই বিস্ফোরণ? উহুঁ। সেসময় মাথা পিছু মানুষের উৎপাদন ছিল বছর প্রতি ৫৫০ ডলার। এখন যেটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ৮,৮০০ ডলার। এই যে ভয়ানক গ্রোথ, এর পেছনে কারণটা কী? কারণটা আর কিছুই না, আধুনিক অর্থনীতি। আধুনিক অর্থনীতি খুব জটিল একটা ব্যাপার। জটিল ব্যাপারকে সহজ করার জন্য একটা গল্প শোনাই বরং। অনেকগুলা ক্যারেক্টার আছে এই গল্পে। দেখবেন, ট্র্যাক হারিয়ে ফেলবেন না আবার!

সৈয়দ সাহেব খুবই উঁচু বংশের লোক। ঢাকা শহরে উনার একটা ব্যাঙ্ক আছে। চৌধুরী সাহেব ঢাকা শহরেরই একজন উঠতি কন্ট্র্যাক্টর। একটা প্রজেক্টে উনি বিরাট লাভ করলেন। সেই লাভের ১ কোটি টাকা উনি সৈয়দ সাহেবের ব্যাঙ্কে রাখলেন। তার মানে সেই ব্যাঙ্কে এখন ১ কোটি টাকার ক্যাপিটাল আছে। টমি মিয়া তখন ঢাকায় এলেন। এসে খেয়াল করলেন, তিনি শহরের যে অংশে থাকেন, ঐ অংশে কোন ভালো ভাতের হোটেল নাই। সব স্যান্ডউইচ, বার্গার আর ফ্রাইড রাইসে ভর্তি।। নিখাদ ভাত-মাছের দোকান নাই কোন। টমি মিয়া ঠিক করলেন, এইখানে একটা ভাতের হোটেল দিবেন। কিন্তু হোটেল যে দিবেন, তার জন্য তো টাকা লাগবে। সেই টাকা সে পাবে কই?

সে গেল ব্যাঙ্কের কাছে। ব্যাংকে ভুজুং ভাজুং দিয়ে বুঝাতে সক্ষম হলো, যে এইখানে ভাতের হোটেল দিলে বেশ চলবে। ব্যাঙ্ক তাকে ১ কোটি টাকা লোন দিল। সেই লোন দিয়ে সে কনট্রাক্টর ভাড়া করলো। কাকে করলো? সেই চৌধুরী সাহবেকে যে কিনা ব্যাঙ্কে টাকা রেখেছিল। চৌধুরী সাহেব সেই টাকা ব্যাঙ্কে ডিপোজিট করলো। এইখান থেকে সে দরকারমত চেক ভাঙিয়ে ইট-বালু, রড-সিমেন্ট যা দরকার কিনবে।

মজার ব্যাপার হলো, চৌধুরী সাহেবের টাকাই আবার তার এ্যাকাউন্টে ফেরত আসছে। ব্যাঙ্কের হিসাব খাতা দেখাচ্ছে, চৌধুরী সাহেবের এ্যাকাউন্টে এখন ২ কোটি টাকা আছে। সত্যিকার ক্যাশ কিন্তু ঐ ১ কোটিই রয়ে গেছে। টাকা কিন্তু বাচ্চা দেয় নাই।

ঘটনা এইখানেই শেষ না। ২ মাস শেষে কিছুদূর কাজ আগানোর পর কনট্রাক্টর সাহেবের মনে হলো, যে কাজটা শেষ করতে আরো টাকা লাগবে। সে আরো ১ কোটি টাকার বিল ধরায়ে দিল। টমি মিয়া বিল দেখে বেজার হলো। কিন্তু কাজ অনেকখানি আগায়ে গেছে। এখন আর ফেরৎ আসাও ঠিক হবে না। সে আবার ব্যাঙ্কে দৌড় দিলো। ম্যানেজারকে বুঝায়ে সুঝায়ে আরো ১ কোটি টাকা লোনের বন্দোবস্ত করলো। এই ১ কোটি কিন্তু সেই ১ কোটি যেটা কন্ট্র্যাক্টর রড-সিমেন্ট কিনবে বলে ব্যাঙ্কে ডিপোজিট করে রেখেছিল।

যাই হোক, এই লোনের টাকা সে আবার কন্ট্রাক্টরের এ্যাকাউন্টে পাঠালো। তো, কন্ট্রাক্টরের এ্যাকাউন্টে এখন কত টাকা হলো? ৩ কোটি টাকা। শুরুতে নিজের জমা করা ১ কোটি আর টমি মিয়ার দেয়া ২ কোটি। আর ব্যাঙ্কে সত্যিকার অর্থে ক্যাশ টাকা আছে কত? সেই ১ কোটিই। যেই ১ কোটি চৌধুরী সাহেব বহু আগে জমা করেছিল।

এই কাজটাই বর্তমান আমেরিকান ব্যাঙ্কিং সিস্টেমে ১০ বার করা যাবে। (বাংলাদেশের সিস্টেমে ক’বার করা যাবে আমি জানি না। কেউ জানলে জানাবেন, প্লিজ) মানে কন্ট্রাক্টরের এ্যাকাউন্টে ১০ কোটি টাকা দেখানোর জন্য ব্যাঙ্কের ভল্টে ১০ কোটি টাকা থাকা লাগবে না। ১ কোটি টাকা থাকলেই চলবে। সোজা কথা, আমাদের সবার এ্যাকাউন্টে যে পরিমাণ টাকা আছে, ঐ পরিমাণ ক্যাশ ব্যাঙ্কে নাই। এখন দেশে যদি একটা গুজব উঠে যে সামনে যুদ্ধ, ব্যাঙ্ক সব কল্যাপ্স করবে, ব্যাঙ্কে যার যত টাকা আছে সব উঠায়ে নেও আর দেশের সব মানুষ সেটা বিশ্বাস করে ব্যাঙ্কে টাকা উঠাতে যায়, ব্যাঙ্ক কিন্তু সবার টাকা ফেরত দিতে পারবে না। দিবে কোথ থেকে? থাকলে না দিবে!

এই ব্যাপারটাই ঘটেছিল It’s a wonderful life এর নায়কের সাথে। তার ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে শুনে সবাই টাকা উঠাতে চলে আসলো। এখন তার কাছে তো টাকা নাই। সে কাস্টোমারদয়ের বুঝাইতেই পারে না, যে সে কোন টাকার ম্যাশিন না। সে একটা সিস্টেম মাত্র। সে X এর টাকা Y কে, Y এর টাকা Z কে আর Z এর টাকা X কে ধার দিয়ে এই সিস্টেমটা চালু রেখেছে মাত্র।

এখন এইটাকে আপনি ভণ্ডামি বলতে পারেন। তাহলে গোটা আধুনিক অর্থনীতিই একটা বিরাট ভণ্ডামি। এক ভণ্ডামি না বলে বরং বলা যায়, ভবিষ্যতের উপর আমাদের অগাধ বিশ্বাস। সৈয়দ সাহেব বিশ্বাস করে যে, টমি মিয়ার হোটেল একবার চালু হয়ে গেলে সেখান থেকে লাখ লাখ টাকা মুনাফা আসবে। সেই প্রফিট থেকে সে আস্তে আস্তে তার ঋণ সুদাসলে শোধ করবে। এক বোল ভাতও সিদ্ধ হয় নাই তার আগেই সে তাই এই ঝুঁকি নিতে রাজি হয়েছে।

এই ব্যাপারটাকে আজ আমরা বলি Credit. ল্যাটিন Credo শব্দ থেকে এটা আসছে। এর মানে I trust you. বিশ্বাসটা যতটা না একজন মানুষের উপর আরেকজনের, তার চেয়ে অনেক বেশি একটা সুখী, সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের। ব্যাঙ্কার আর হোটেলওয়ালা দুই জনই একই স্বপ্নে বিশ্বাস করে বলেই এই গোটা সিস্টেমটা কাজ করছে। ঐ বিশ্বাসটুকু না থাকলে সিস্টেমটা মুহূর্তে ধ্বসে পড়বে।

ব্যাঙ্ক যদি টমি মিয়াকে লোন না দিত, তখন সে কী করতো? সে এমন কোন কনট্রাক্টর খুঁজে বের করতো, যে কিনা নিজের টাকায় তার হোটেলটা করে দিবে। পরে হোটেল লাভ করা শুরু করলে তার পেমেন্টটা নিবে। সমস্যা হলো, এমন কনট্রাক্টর পাওয়া ভূভারতে সম্ভব না। কাজেই, তার হোটেলও বানানো হবে না। হোটেল না হলে মানুষ খেতে আসবে না। তার ট্যাঁকে পয়সা আসবে না। পয়সা ছাড়া সে কন্ট্রাক্টর পাবে না। আর কনট্রাক্টর ছাড়া তার স্বপ্নের হোটেলও হবে না।

যুগের পর যুগ ধরে মানুষ ‘না হবার’ এই দুষ্টচক্রে বন্দী হয়ে ছিল। ইতালির কিছু মানুষ সামান্য Bench এ বসে ধার দেবার যে কালচার শুরু করেছিল, সেই কালচারই ফুলেফেঁপে Bank এর রূপ ধারণ করে মানুষকে এই দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত করেছে। আমরা মনে করি, যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ। ব্যাংকারদের ফিলোসফি উলটা। তাদের কথা হচ্ছে আজকের দিন যেমন তেমন, সামনের দিন সোনার মতন।

ব্যাঙ্কব্যংকগুলো আমাদেরকে টাকা ধার দেয় না। ধার দেয় স্বপ্ন। এই স্বপ্নের কেনাবেঁচা করেই আমরা গড়ে তুলি আধুনিক সভ্যতা। বর্তমানকে বিক্রি করে কিনি সোনালী ভবিষ্যৎ।


পুঁজিবাদের সংজ্ঞা

১৭৭৬ সালে আমেরিকা স্বাধীন হয়। ঐ বছরই এডাম স্মিথ একটা দুর্দান্ত বই লেখেন। বইয়ের নাম The Wealth of Nations, নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা বাদ দিলে এইটা আধুনিক পৃথিবীর সবচেয়ে গ্রুত্বপূর্ণ বই। এই বইয়ের আট নম্বর চ্যাপ্টারে স্মিথ একটা সম্পূর্ণ নতুন আইডিয়া নিয়ে হাজির হন।

আইডিয়াটা এমনঃ ধরা যাক, পুরান ঢাকার ফজলু মামার মত আপনার একটা ছোটখাটো পিঠার দোকান আছে। নিজেই পিঠা বানান, নিজেই সেটা বেঁচেন। পিঠা বেঁচে আপনার কিছু লাভও হলো। এখন এই লাভ দিয়ে আপনি কী করবেন? বিড়ি-সিগারেট খেয়ে শেষ করবেন? না দোকানের বেচাবিক্রি বাড়ানোর জন্য কোন পিচ্চি আকা কুদ্দুস আকা বাবুল নিয়োগ করবেন?

যুগ যুগ ধরে ফজলু মামারা লাভের টাকা দিয়ে গাঁজায় দম দিয়ে সেটা উড়িয়ে আসতো। এডাম স্মিথ এসে মামাকে বললেন, তুমি এই টাকা দিয়ে একটা এ্যাসিস্ট্যান্ট রাখো, ব্যবসা বড় করো। লাভের টাকা দিয়ে মৌজ না করে সেটা আবার ইনভেস্ট করো। তাহলে খালি তোমার একার লাভ তা না, আশেপাশের দশটা মানুষেরও লাভ।

শুনে মনে হতে পারে, আরে, এ আর এমন কী আইডিয়া! এই আইডিয়া তো আমিও দিতে পারি। এডাম স্মিথের জায়গায় আমি থাকলে আজকে আমি অর্থনীতির জনক হতে পারতাম। আমাদের এমনটা মনে হচ্ছে। কারণ, আমরা ঠিক এই ক্যাপিটালিস্টিক সমাজের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। প্রাচীন মানুষ কিন্তু একটু টাকাপয়সা হলেই এই মৌজমাস্তির খপ্পরে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছিল। সেটা রোম সম্রাট ক্যালিগুলা থেকে শুরু করে মোঘল বাদশা শাহজাহান পর্যন্ত সবাই। এডাম স্মিথ এসে এই দুষ্টচক্র ভাঙেন। তিনি আমাদের সূত্র দেনঃ সমাজের মোট সম্পদ স্ট্যাটিক কিছু না। বরং চেষ্টাচরিত্র করে একে বাড়ানো যেতেই পারে। নিউটনের তৃতীয় সূত্রের চেয়ে এই সূত্র তাই কোন অংশে কম শক্তিশালী না।

আমাদের ধর্মে, মিথোলজিতে সবসময়ই লোভকে খারাপ চোখে দেখা হয়েছে। বলা হয়েছে, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। স্মিথই প্রথম আমাদের বলেন Greed is good. তুমি যদি নিজের লাভের জন্য খাটো, লোভের জন্য খাটো তাহলে খালি নিজের না, সমাজেরই লাভ। আচ্ছা, আমার ইচ্ছা আমি গরিব থাকবো। কার কী সমস্যা?

সমস্যা আছে। আমি গরিব থাকলে আমি বাজারের সেরা মোবাইলটা কিনতে পারবো না। তাহলে যেই লোক কষ্ট করে মোবাইলটা বানিয়েছে, সেও গরিব থাকবে। কারণ তার তো বিক্রি হচ্ছে না। আর আমি বড়লোক হলে আপনিও বড়লোক হবেন। কারণ, আপনার বানানো জিনিস তখন আমি কিনতে পারবো। এটাকে বলে উইন উইন সিচুয়েশন।

ধনবানদের পাপী হিসেবে দেখা আমাদের আরেকটা ট্রাডিশন। ধন আর পাপ মোটামুটি সমার্থক ব্যাপার। স্মিথ এইসব ট্রাডিশনাল ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করেন। তিনি বলেন, বড়লোক মানেই পাপী না। বরং বড়লোকই ভালো। সে দশটা লোকের চাকরির বন্দোবস্ত করে দিচ্ছে। স্বর্গের দরজা যদি খোলা হয়, তবে এই লোকটাই সবার আগে ঢুকবে। দিনরাত ইবাদত করা লোকটা তার পেছনেই থাকবে।

আমাদের অবশ্য ধারণা, আমি বড়লোক হতে হলে আশেপাশের সবাইকে দাবায়ে বড়লোক হতে হবে। স্মিথ এটারও বিরোধিতা করেন। স্মিথ বলেন, চাইলেই তুমি আশেপাশের সবাইকে নিয়েই বড়লোক হতে পারবা। লাভের গুড়টা নিজের পকেটে না পুরে সেই গুড় দিয়ে ফ্যাক্টরির সাইজ বাড়াও। নতুন প্রোডাক্ট বানাও। নতুন প্রোডাক্ট নিয়ে আসলে মানুষ সেটা খাবেই। তুমি দুধ-চা বানাতে। একজন এ্যাসিস্ট্যান্ট রেখে মাল্টা চা-ও বানানো শুরু করো। দুধ চা-র বিক্রি তাতে কমবে না।

এইভাবে প্রোডাক্ট ডাইভার্সিটি তৈরি করে মানুষের কনজামশন বাড়ানো সম্ভব। এটাই ক্যাপিটালিজম। এটাই পুঁজিবাদ। পুঁজির সাথে সম্পদের এইখানে পার্থক্য। মিশরের ফারাওরা পুঁজিবাদী ছিলেন না। তারা ছিলেন সম্পদবাদী। স্প্যানিশ যে নাবিকটা আমেরিকায় এসে কাড়ি কাড়ি স্বর্ণ লুট করে গেছে, সেও পুঁজিবাদী না। যে লোকটা কষ্ট করে মাস শেষে কিছু টাকা জমিয়ে সেই টাকা আবার শেয়ার বাজারে রি-ইনভেস্ট করে, সেই প্রকৃত পুঁজিবাদী।

মধ্যযুগ পর্যন্ত এই পুঁজিবাদীদের দেখা পাওয়া ছিল বিরল। মধ্যযুগের বড়লোকদের দেখেন। কী জমকালো পোশাক পরে ঘুরে বেড়াতো। আর এখনকার টাকার মেশিনদের দেখেন। সামান্য জিন্স আর টি-শার্ট পরে ঘুরে বেড়ায়। অথচ আজকের জাকারবার্গদের সম্পদের পরিমাণ কিন্তু মিশরের যে কোন ফারাওর চেয়ে অনেক বেশিই হবে। সেসময় মানুষ দান খয়রাত করে পুণ্য কামাতো। পকেটে টাকা বেশি হয়ে গেলে বউয়ের জন্য তাজমহলো বানাতো। আজকের পুঁজিপতিরা সেটাই করে লাভের টাকা আবার খাটিয়ে। সমাজে টাকার ফ্লো-টা ঠিক রেখে।

অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-

ফলাফল মধ্যযুগে অভিজাত সমাজের কেন্দ্রে থাকা ডিউক আর নবাবদের সরিয়ে সেই জায়গাটা আজ দখল করে নিয়েছে ব্যবসায়ী আর পুঁজিপতিরা। যে মিডল ক্লাসের সুখ-দুঃখ আবেগ নিয়ে আমরা দিনরাত জিকির করি, সেই মিডল ক্লাসের জন্মও দিয়েছে আধুনিক পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় আছর পড়েছে বোধয় আধুনিক বিজ্ঞানের উপর। একটা রিসার্চ গ্রান্ট যখন লেখা হয়, তখন প্রথম যে প্রশ্নটা ফেস করতে হয়, তা হলো এই প্রজেক্টটার ইকোনমিক ইমপ্যাক্ট কী? এইটা সমাজকে নতুন কিছু দিবে কিনা। বিজ্ঞানের জন্য বিজ্ঞান তখন মন খারাপ করে সাইড বেঞ্চে বসে থাকে।

আজ আমেরিকা, চীন অলমোস্ট শূন্য থেকে টাকা ছাপায়ে বাজারে ছাড়ছে। এত যে টাকা ছাড়ছে সমাজে সেই পরিমাণ সম্পদ তো তৈরি হচ্ছে না। তারপরও তারা কেন এই ঝুঁকিটা নিচ্ছে? তার কারণও বিজ্ঞানের উপর এই অগাধ বিশ্বাস। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, শিগগিরই ল্যাবগুলো থেকে নতুন নতুন সব ব্রেকথ্রু টেকনোলজি বের হবে। জন্ম নিবে নতুনতর সব ইন্ডাস্ট্রি। সামনে বাবল অবশ্যম্ভাবী। আর তা ঠেকানোর পুরো দায়িত্ব এখন এই বিজ্ঞানীদের। সারা দুনিয়া তাই তাকিয়ে আছে এই ল্যাবগুলোর দিকে। কখন তারা নতুন কিছু নিয়ে আসবে আমাদের জন্য?

ব্যাঙ্কগুলো তো টাকা ছাপিয়েই খালাস। এই টাকার আসল মূল্য তৈরি করে বিজ্ঞানী আর ইঞ্জিনিয়াররাই।


বিনিয়োগের উপাখ্যান

উরোপেই প্রথম ব্যবসায়ীরা ক্ষমতার কেন্দ্রে আসতে শুরু করে। ব্যাপারটা এত সহজে হয়নি। এর পেছনে কাজ করেছে এদের ক্রেডিট ইকোনমির সাফল্য। কোন এক দুঃসাহসী লোক হয়তো মানুষজনের কাছে ধারকর্জ করে অজানার পথে পাড়ি দিল। সেখান থেকে সোনাদানা নিয়ে এসে আগের ধার ফেরত দিল। ফলে ব্যবসায়ী মহলে তার একটা ক্রেডিবিলিটি গড়ে উঠলো। পরে যখন সে আরো বড় অংকের ক্রেডিট এর জন্য এ্যাপ্লাই করলো, সেটা সহজেই মিললো। সেই টাকা দিয়ে আবার যাত্রা, আবারো লাভ, আবারো যাত্রা এইভাবে চলতেই থাকলো। এমনকি সে নিজের লাভের টাকা থেকে অন্যকে ধারকর্জ দিতেও শুরু করলো। এইভাবে গোটা সমাজে একটা ক্রেডিট ফ্লো গড়ে উঠলো।

যে ক্রেডিট সিস্টেমের কথা আমরা বলছি, সেই ক্রেডিট সিস্টেম যে ইউরোপীয়দের একক আবিষ্কার তা না। চায়না, ভারত এমনকি মুসলিম জাহানেও এর চল ছিল। আঠারো শতক পর্যন্ত তো পৃথিবীতে পুঁজির ভরকেন্দ্র এশিয়ার দিকেই হেলে ছিল। কিন্তু প্রাচ্যের সমাজে ক্রেডিট সেই সম্মানটা পায়নি, যা সে পেয়েছে পশ্চিমে এসে। প্রাচ্যের হিরো ছিল নাদির শাহের মত খুনী। কিংবা অটোম্যানদের মত ব্যুরোক্র্যাটেরা। যাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল জনগণের কাছ থেকে আদায় করা ট্যাক্স। ক্রেডিট আর বণিক দুটোকেই এখানে খুব হেয় চোখে দেখা হত।

ইউরোপের রাজারা ওদিকে প্রাচ্যের শাসকদের মত ‘খেয়ে ছেড়ে দিব’ টাইপ চিন্তাভাবনা থেকে সরে এসে ব্যবসায়ীদের মত চিন্তাভাবনা শুরু করেন। কোথায় ইনভেস্ট করলে লাভ হবে, কারে ধার দিলে সেটা দ্বিগুণ ফেরত আসবে এই ওয়েতে। রাষ্ট্রকে তারা আর স্রেফ রাষ্ট্র রাখলেন না। একে একটা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের আদলে চালাতে শুরু করলেন। যার মূল লক্ষ হচ্ছে প্রফিট।

শুরুটা করেন স্পেনের রাণী ইসাবেলা। কলম্বাসের যাত্রার পুরোটাই স্পন্সর করেন তিনি। কলম্বাস অবশ্য ফার্স্টেই ইসাবেলার দরবারে যাননি। তিনি গিয়েছিলেন পর্তুগাল রাজার দরবারে। পর্তুগাল সম্রাটকে কনভিন্স করতে ব্যর্থ হন তিনি। একজন সফল উদ্যোক্তার মতই তিনি থেমে যাননি। সাতঘাট ঘুরে অবশেষে ইসাবেলার মন জয় করতে সক্ষম হন তিনি। বোঝান, পৃথিবী গোল এই তত্ত্বে যেহেতু আমাদের ঈমান আছে, সেহেতু পশ্চিমে যাত্রা করলে একদিন ঠিকই স্বর্গের ভারতে যাওয়া যাবে।

আজ আমরা জানি, স্পেন সেইবার বাজিমাৎ করেছিল। কলম্বাসের সফল অভিযানের পর ব্যাংকাররা এইসব অভিযানে ইনভেস্ট করতে আরো সাহস পান। স্পেন পবশ্য বেশিদিন এই সেক্টরে রাজত্ব করতে পারেনি। স্পেনের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে কিছুদিনের মধ্যে স্পেনেরই অধীনস্থ ডাচরা এই ক্রেডিট সেক্টরে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। ডাচরা ছিল স্পেনের খুবই ছোট্ট একটা উপনিবেশ। কেউ তাদের গোণাতেই ধরতো না। ১৫৬৮ সালে তারা স্পেনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। মাত্র আট বছরের মধ্যেই তারা স্বাধীনতা তো পায়ই, সেই সাথে স্প্যানিশদের হটিয়ে পায় সমুদ্রপথে আধিপত্য।

এই আধিপত্য কোন নাদির শাহ বা কলম্বাস এনে দেয়নি ডাচদের। এনে দিয়েছে ডাচ ব্যাংকার আর ব্যবসায়ীরা। টাকাপয়সার ব্যাপারে ডাচদের একটা সুনাম ছিল ইউরোপে। ডাচরা ছিল ইউরোপের আল-আমিন। তাই কোন যাত্রা করার আগে তারা সহজেই ধার পেত। নিজেদের কোন স্থায়ী সৈন্যবাহিনী ছিল না তাদের। ধারের টাকা দিয়ে সৈন্যবাহিনী ভাড়া করতো তারা। যাত্রা শেষে লাভের টাকা দিয়ে ধার ফেরত দিত। এই করে করে তারা গোটা ইউরোপের মহাজনদের আস্থা অর্জন করে। স্পেনের রাজপরিবার যেখানে অযথা যুদ্ধবিবাদ করে সর্বস্বান্ত হচ্ছে, দেনার সমুদ্রে ডুবছে, ডাচরা সেখানে পুঁজির পাহাড় গড়ে তুলছে। ডাচ সাম্রাজ্য কোন রাজাধিরাজ গড়ে তুলেনি। তুলেছে এর ব্যাংকার আর ব্যবসায়ীরা।

কীভাবে? একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ধরা যাক, আপনার বাবা জার্মানির বিরাট মহাজন। উনি দেখলেন, ইউরোপের বাজার বড় হচ্ছে। কাজেই, তার ব্যবসাও বড় করা দরকার। তিনি আপনাকে পাঠালেন আমস্টারডাম আর আপনার ছোট ভাইকে পাঠালেন মাদ্রিদ। সাথে দিলেন ১০,০০০ করে স্বর্ণমুদ্রা আপনার ভাই তার টাকাটা স্পেনের রাজাকে ধার দিল। সে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, যুদ্ধের রসদপাতি লাগবে না? আর আপনি দিলেন হল্যান্ডের এক রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীকে। সে আটলান্টিকের ঐপারে ব্যবসা করে। তার ইচ্ছা, ম্যানহাটন নামে এক জায়গায় কিছু জমি কিনে রাখার। তার প্রেডিকশন বলে, কয় দিনের মধ্যেই এই জমির দাম হু হু করে বেড়ে যাবে। তখন সে বেশি দামে বেঁচে লাভ করবে।

ক্যালেণ্ডারের পাতা ওল্টালো। হাডসন নদীর তীর শূন্য বিরানভূমি থেকে জনবহুল ট্রেড রুটে পরিণত হলো। ডাচ ব্যবসায়ী কড়া দামে তার জমি বেঁচে ধারের টাকা ইন্টারেস্ট সহ ফেরত দিল। আপনি খুশি, আপনার বাপও খুশি। এদিকে স্পেনের রাজাও যুদ্ধে জিতেছে। কিন্তু এই ফাঁকে তুর্কীদের সাথে তার লেগে গেছে। তুর্কীদের একটা শিক্ষা দেয়া দরকার। তার যে ঋণ আছে এটা তার মাথায় আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে ঋণ শোধ করার চেয়ে তুর্কীদের সাইজ করাটা বেশি ইম্পর্ট্যান্ট।

আপনার ভাই ঠিকই চেষ্টাচরিত্র চালিয়ে যাচ্ছে টাকাটা উদ্ধার করার জন্য। রাজপ্রাসাদে তার যে লিঙ্ক-টিঙ্ক আছে, ওদের দিয়ে ট্রাই করে যাচ্ছে। এই করে তার পায়ের জুতাই ক্ষয় হলো কেবল, টাকা আর ফেরত এলো না। অবস্থা আরো খারাপ হলো যখন সে আপনার ছোট ভাইর আগের ঋণ তো শোধ করলোই না, উলটা আরো ১০,০০০ স্বর্ণমুদ্রা ধার চেয়ে বসলো। এখন জলে নেমে তো আর কুমিরের কথা অমান্য করলে চলে না। আপনার ছোট ভাই আপনার বাপকে বলে আরো ১০০০০ মুদ্রা আনায়ে রাজার হাতে তুলে দিল।

আপনার ব্যবসা এদিকে ভালোই যাচ্ছে। ধার দিচ্ছেন, ফেরত পাচ্ছেন। বেশ মোটা অংকের লাভ হচ্ছে মাসে মাসে। দিন তো আর সবসময় সমান যায় না। এক ক্লায়েন্ট আপনাকে কনভিন্স করলো যে, সামনে কাঠের জুতার ট্রেন্ড আসতেসে বাজারে। এই বাজার ধরতে হলে এখনই একটা কাঠের জুতার ফ্যাক্টরি দিতে হবে। আপনি তার কথায় ইম্প্রেসড হয়ে ধার দিলেন। দুর্ভাগ্যনকভাবে, কাঠের জুতা মানুষের মন জয় করতে ব্যর্থ হলো। সে ধার তো ফেরত দিতে পারলোই না। ফেরত চাইলে ধারের কথা বেমালুম অস্বীকার করলো।

আপনার পিতা মহাশয় গেলেন ক্ষেপে। তিনি আপনাদের দু’জনকেই বললেন আইনের আশ্রয় নিতে। কথামত আপনি আইনের দরবারে গেলেন। নেদারল্যান্ডের বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন। কাজেই, আইন আপনার কথা শুনলো। শুনে আপনার পক্ষেই রায় দিল। ঐ ব্যাটা জুতাখোরকে আপনার পয়সা ফেরত দিতে বাধ্য করলো। স্পেনে কী হলো? স্পেনের আইন আদালত তো আর সেপারেট কোন প্রতিষ্ঠান না। সবই রাজার অঙ্গুলি হেলনে চলে। বিচারক পয়সা ফেরতের কোন বন্দোবস্ত তো করলোই না, উলটা কয়দিন পর রাজা আপনার ছোট ভাইর কাছে ২০০০০ স্বর্ণমুদ্রা চাইলো। দিতে পারলে ভালো। না পারলে তাকে জেলে পুরে রাখবে। কোন কারণে তার ধারণা হয়েছে, আপনার ছোট ভাই হচ্ছে টাকার খনি। যখনই চাইবো, তখনই পাওয়া যাবে।

সব শুনে আপনার বাপ সিদ্ধান্ত নিলেন, ইনাফ ইজ ইনাফ। স্পেন দেশে আর কোন বিজনেস নয়। এইসব রাজাগজার সাথে তো নয়ই। উনি ছেলের মুক্তিপণটুকু দিয়ে স্পেন থেকে তার ব্যবসা উঠায়ে নিলেন। দুই ভাইকেই আমস্টারডামে বসালেন দুটো ব্রাঞ্চের দায়িত্ব দিয়ে। অবস্থা তখন এতই শোচনীয় তখন যে খোদ স্পেনের বণিকেরাও আর সেখানে ইনভেস্ট করার সাহস পাচ্ছে না। তারাও তাদের পুঁজি স্পেন থেকে সরিয়ে হল্যান্ডে এনে খাটাচ্ছে।

একটা শিক্ষা তো হলো। পকেটে টাকা থাকলেই সেই টাকা বাচ্চা দেয় না। কিন্তু আইনের শাসন থাকলে মানুষ এসে তোমার পকেট ভর্তি করে টাকা দিয়ে যাবে। ডাচরা তাদের এই সততা আর বিশ্বস্ততা দিয়েই হাডসনের তীরে একটা চমৎকার শহর গড়ে তুলেছিল। নিজেদের রাজধানীর নামে এর নাম দিয়েছিল নিউ আমস্টারডাম। চতুর ইংরেজরা পরে অবশ্য এটা দখল করে নেয়। আকিকা দিয়ে এর নতুন নাম রাখে নিউ ইয়র্ক। ব্রিটিশদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য ডাচরা শহরে একটা দেয়াল গড়ে তোলে। সেই দেয়ালের ধ্বংসাবশেষই কালক্রমে পরিণত হয়েছে আজকের দুনিয়ার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায়। যার নাম ওয়াল স্ট্রীট ।


মিথ্যা গাল-গপ্পো

ব্যবসায়ীদের হাতে, বা ব্যবসায়ী মাইন্ডেড লোকেদের হাতে দেশের পলিসি তুলে দেবার কিছু সমস্যাও আছে। গল্পের শুরুটা একটা জয়েন্ট স্টক কোম্পানি দিয়ে। কোম্পানির নাম মিসিসিপি কোম্পানি। মিসিসিপি তখন ছিল আটলান্টিকের ওপারের জলা জনমানবশূন্য একটা দেশ। এক কুমির ছাড়া এখানে বলার মত কিছু ছিল না।

এই জলা জনমানবহীন জায়গা নিয়েই এই কোম্পানি তখন কল্পকাহিনী ছড়াতে শুরু করে। একে তো আমেরিকা তখন মানুষের কাছে ল্যান্ড অফ অপরচিউনিটি। আর সেই সময় এই গালগপ্পো ভেরিফাই করার কোন উপায়ও ছিল না। কাজেই, ফ্রান্সের মানুষ গোগ্রাসে এই গপ্পো খেতে শুরু করে।

এই কোম্পানির যে ডিরেক্টর, উনি আবার ছিলেন ফ্রান্সের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের গভর্ণর। নিজের প্রভাব আর কানেকাশান খাটিয়ে উনি প্যারিস স্টক এক্সচেঞ্জে তার কোম্পানির শেয়ার ছাড়েন। মিসিসিপি হাইপ তখন চরমে। এই হাইপকে কাজে লাগিয়ে সেই শেয়ারের দাম হু হু করে বাড়িয়ে নেন। যে শেয়ারের দাম ছিল ১০০০ টাকা, তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০,০০০ টাকা। ফ্রান্সের এলিট শ্রেণী তো তার এই ফাঁদে পড়েই, সাধারণ মানুষ জায়গাজমি বেঁচে এই কোম্পানির শেয়ার কেনা শুরু করে। বড়লোক হবার এত সোজা রাস্তা পেলে কে ছাড়ে?

কিছুদিনের মধ্যেই প্যানিক শুরু হয়। বুদ্ধিমান দুই-একজন বুঝতে পারে, শেয়ারের দাম তো এত হবার কথা না। মিসিসিপিতে যত সোনাদানাই থাক না কেন, মানুষজন যে দামে শেয়ার কিনছে, এই পরিমাণ সম্পদ ওখানে নাই। তারা দাম বেশি থাকতে থাকতে শেয়ার বেঁচে দেয়া শুরু করে। তাদের দেখাদেখি আরো লোক দাম কমার আগেই শেয়ার হাত থেকে ঝেড়ে দিতে শুরু করে।

পুরো বাজারে একটা হিস্টিরিয়া তৈরি হয়। যে শেয়ারের দাম ১০,০০০ উঠেছিল, সেটা আবার ১০০০ এ নেমে আসলো। পাকা খেলোয়াড়রা তথা পুঁজিপতিরা ঠিকই তাদের আখের গোছায়ে নিল। ঠক খেলো সাধারণ মানুষ। অনেকে আত্মহত্যাও করলো। আমাদের শেয়ার বাজারের কথা মনে পড়ে কি?

মিসিসিপি বাবলের ফলাফল দুইটা। এক, এই যে ফ্রান্সের অর্থনীতি কল্যাপ্স করেছিল, প্রায় এক শতাব্দী তা আর এর ধকল কাটিয়ে উঠতে পারে নাই। ফ্রান্সের অভিজাতদের দেখে আমাদের ভুল ধারণা হতে পারে। সাধারণ মানুষের অবস্থা ছিল খুব খারাপ। খুব খারাপ মানে খুবই খারাপ। এক টুকরা রুটির জন্য একজন আরেকজনকে খুন করতো এই অবস্থা। এই ক্রাইসিসই পরে ফ্রেঞ্চ রেভোল্যুশনের রাস্তা তৈরি করে দেয়।

দুই, ফ্রেঞ্চ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর গোটা ইউরোপের আস্থা উঠে গেল। এরা আর আগের মত বড় বড় মহাজনদের কাছ থেকে ধার পেল না। ফলে, উপনিবেশ নিয়ে ফ্রান্স আর ব্রিটেনের মধ্যে যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছিল, তাতে আগায়ে গেল ব্রিটেন। কিছুদিনের মধ্যেই অর্ধেক পৃথিবীর সম্রাট হিসবে আবির্ভাব ঘটলো ব্রিটিশদের। ব্রিটিশ পুঁজিপতিরাও পৃথিবীকে শান্তি দেয়নি। ব্রিটিশ নাবিকেরা দেশে দেশে তাদের নৌতরী ভিড়িয়েছে। আর ব্রিটিশরাজ চোখ বুজে তার বণিকদের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। পলাশীর যুদ্ধের কাহিনী তো আমরা সবাই জানি। পলাশীর যুদ্ধ থাক। আজ আমরা আরেকটা যুদ্ধের গল্প শুনি।

ঊনিশ শতকের শুরুর দিক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন চায়নায় আফিম বেঁচে বেশ দুই পয়সা কামাচ্ছে। এক সময় দেখা গেল, গোটা জাতি আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। চাইনিজ সরকার নড়েচড়ে বসে। আইন করে আফিম নিষিদ্ধ করে। ব্রিটিশরা তো আর কারো কথা শুনে না। তারা চাইনিজদের মধ্যাঙ্গুল দেখিয়ে ঠিকই ড্রাগের চালান পাঠাচ্ছিল। গভর্ণমেন্ট তখন কঠোর অবস্থানে যায়। ব্রিটিশ জাহাজগুলোকে জব্দ করা শুরু করে। অনেকগুলো ধ্বংসও করে দেয়।

এদিকে ড্রাগ কোম্পানিগুলোতে এমপিদের একটা বড় শেয়ার ছিল। এমপিরা নিজের পেট বাঁচাতে একজোট হয়। ব্রিটিশরাজকে কনভিন্স করে চায়নার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। মুক্ত বাণিজ্যের নামে এ যুদ্ধ হলেও আসলে এটা ছিল অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। যার মূল বক্তব্য হলো আমি তোকে ভাত খাইতে বললে তুই ভাত খাবি। আর আমি তোকে গাঁজা খাইতে দিলে তুই গাঁজা খাবি। দিন শেষে আমার প্রোডাক্টই তোর বাজারে থাকবে।

অসম এ যুদ্ধে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশরা অনায়াসে জয়ী হয়। চাইনিজরা নাকে খত দিয়ে আফিমের অবাধ ট্রানজিট মেনে নিতে বাধ্য হয়। হংকং তো ব্রিটিশরা পুরোটাই দখল নিয়ে নেয়। দীর্ঘদিন এই হংকং ছিল চায়নায় ব্রিটিশ ড্রাগ কার্টেলের মূল বেস। পুঁজিবাদ এইভাবে গুটিকতক লোকের পকেট ভারি করতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে বলির পাঁঠা বানিয়েছে। কখনো খোলাখুলি প্রফিটের নামে করেছে। কখনো সেবার নামে। যদিও দুনিয়ায় নন প্রফিট অর্গানাইজেশন বলে কিছু নাই। সবই মানুষকে একটা বুঝ দিয়ে নিজেদের প্রফিট অর্গানাইজেশনের লাভ বাড়ানোর ধান্দা। ট্যাক্স না দেবার ধান্দা।

১৮৭৬ সালে বেলজিয়ামের রাজা মধ্য আফ্রিকার কঙ্গোয় একটা নন প্রফিট অর্গানাইজেশন খুলেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল আফ্রিকা নিয়ে গবেষণা করা আর এখানে যে দাস বাণিজ্য হয়, লাখ লাখ দাসকে যে জাহাজে করে আটলান্টিকের ঐপারে পাঠানো হয় তা বন্ধ করা। আফ্রিকার জনমানুষের জন্য স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল করাও ছিল এর অন্যতম লক্ষ্য।

কয়েক বছরের মধ্যে এই মানবিক প্রতিষ্ঠানটি দানবিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। যার মূল লক্ষ হয়ে দাঁড়ায় গ্রোথ আর প্রফিট। স্কুল-কলেজ লাটে উঠলো। তার জায়গায় বসানো হলো কয়লার খনি আর রাবার বাগান। রাবার ছিল কঙ্গোর প্রধান রপ্তানি পণ্য। পুঁজিবাদের নিয়ম অনুযায়ী, মালিকেরা প্রতি বছর রাবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বাড়াতো। আর লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে তার দায় মেটাতে হতো কৃষকদের তাদের জীবন দিয়ে।

ধারণা করা হয়, ১৮৮৫ থেকে ১৯০৮ সালের মধ্যে ৬০ লক্ষ লোকের মৃত্যু ঘটে বেলজিয়ান আর্মির হাতে। কারো কারো মতে, এই সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এইভাবে পুঁজিবাদ মানুষকে বারবার ব্যর্থ করেছে। তাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। তার পরও মানুষ পুঁজিবাদকে ছাড়তে পারেনি।

এর কারণ বোধ হয়, তার কাছে এর চেয়ে ভালো কোন অপশন এখনো আসেনি। কিংবা পুঁজিবাদ অনেকটা কৃষির মত একটা টেকনোলজি। শিকারী মানুষ যেমন একবার হাল ধরার পর শত অভাব-অভিযোগ সত্ত্বেও আর শিকারী জীবনে ফিরে যেতে পারেনি, আমরাও পুঁজিবাদের হাজারটা ফাঁক-ফোকড় জেনেও একে ডিভোর্স দিতে পারছি না।

আমাদের অর্থনীতি এখন এতই কমপ্লেক্স যে, চাইলেই আমরা ‘গ্রামে ফিরে যাই’ নীতিতে সবকিছু ছেঁড়েছুঁড়ে সহজ একটা জীবন যাপন করতে পারবো না। বড়জোর যেটা করতে পারি, পুঁজিবাদের গলদগুলোকে শুধরে বেটার কোন মডেলে পৃথিবীটাকে দাঁড় করাতে, যেন কঙ্গোর কালো মানুষটা কিংবা চা বাগানের শ্রমিকেরাও তাদের বেসিক চাহিদাগুলো মেটাতে পারে।


অন্যান্য পর্বগুলো পড়ুন এখানে ⇑

Related Articles

5 2 votes
Post Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
Back to top button
0
Rate & Give your feedback!x
()
x

পুলিন বকসী: প্রথমত শহীদ সাহেবের ডান পন্থার কারনে ভাসানী তার বিরোধীতা করেন নি। শহীদ সাহেবের তীব্র আমেরিকা প্রীতিই (সিয়াটো-সিন্টো চুক্তি) ন্যাপ গঠনের অনেকগুলো কারনের অন্যতম কারন।

দ্বিতীয়ত আপনি যেভাবে তাকে আইয়ুব খানের একজন প্রায় 'দালাল' বা 'চাটুকার' বানায়া দিলেন সেই ভাসানীই কিন্তু ৬৯ এ ব্যপক ভূমিকা রেখেছিল শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে। শুধু তাই না এই উনসত্তরের আন্দোলনের শুরুটাও ভাসানীদের হাত ধরে।

ধন্যবাদ।

Farid Ahmed: আমি বহু জনকে জিজ্ঞেস করেছি, কেউ আমাকে সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারে নাই কেনো মওলানা ভাসানী আইয়ুব খানের প্রতিনিধি হিসাবে চীনে গিয়েছিলেন। আশা করি আপনি আলোকপাত করতে পারবেন এ ব্যাপারে। তাঁর আইয়ুব প্রীতি আমার আবিষ্কার না। ষাটের দশকেই এ নিয়ে বিস্তর কথা উঠেছে। আমি আগের একটা লেখায় সব রেফারেন্স দিয়েছি। আমি ভাসানীকে এখনও দালাল কিংবা চাটুকার বলি নাই, যদিও বলা উচিত ছিলো আমার।

১৯৮৬-৮৭ সালে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন জালাল আহমেদ। ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি এরশাদের সাথে হাত মেলান। এরশাদ তাঁকে অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশ মিশনে সেকেন্ড সেক্রেটারি পদে নিয়োগ দেয়। জালাল আহমেদ সংগোপনে তাঁর গোপনে বিয়ে করা বউকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমান। এখন পর্যন্ত এই অপরাধে ছাত্রদল তাঁকে দালাল বলে। আমরাও তাঁকে এরশাদের দালালই বলতাম। দালালকে তো দালালই বলা লাগে, তাই না?

Marzia Prova: ফরিদ ভাই আইয়ুব শাসনের আমলে পাকিস্তানের জোরদার উন্নয়ন দেখা যাচ্ছিল৷ ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এর আগে তার উন্নয়নের দশক পালন করার প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছিল। ভাসানীর কথা ছিল, "পশ্চিম পাকিস্তান যদি পূর্ব পাকিস্তানের উপর শোষণ না বন্ধ করে, তবে পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম।" এখন তথাকথিত আইয়ুবের উন্নয়ন পূর্ব বাংলাতেও হয়েছিল। শোষণের বিপরীতে এই উন্নয়নকে যদি সফলতা হিসেবে দেখা হয়, তবে ভাসানী একজন পাকিস্তান নাগরিক হিসেবে সফল শাসক এর প্রতি মুগ্ধতা ছিলেন! তাই নয় কি?

আপনি জাস্ট এই বিষয়টা এখনকার বাংলাদেশের সাথে মিলান। উন্নয়ন দিয়ে সফলতাকে নির্ধারণ বাকি অনেক কিছুকে যখন আড়াল করা হয়, তখনও তো দেশের অনেক মানুষের সেই সফল শাসকের প্রতি মুগ্ধতা থাকে৷ সম্ভবত ভাসানীর আইয়ুব প্রীতি সে জায়গা থেকে। জাস্ট আপনার লেখা আর কমেন্ট পড়ে এইটা মনে হইল। এই মানসিকতা অবশ্যই দ্বান্দ্বিক এবং স্ববিরোধী কোন সন্দেহ নাই৷ হয়ত এই মানসিকতা না থাকলে ভাসানী অন্যভাবে স্মরণীয় থাকতেন।

Farid Ahmed: আইয়ুব খানের সাথে মওলানার ওই উন্নয়নমূলক মুগ্ধতার সম্পর্ক ছিলো না। উনি ৬৩-তে সরকারী একটা ডেলিগেশন টিমের প্রধান হিসাবে চিনে যান। আইয়ুব খান সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে তাঁর বিন্দুমাত্র বিবেকে বাধেনি, যেখানে ৬২-তে বিশাল এক ছাত্র আন্দোলন হয়ে গিয়েছিলো আইয়ুব খান সরকারের গণবিরোধী শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে।


মওলানা ভাসানী ৬৯ এ ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে। শুধু তাই নয়, এই উনসত্তরের আন্দোলনের শুরুটাও ভাসানীদের হাত ধরে। তাহলে তাকে আইয়ুব খানের একজন প্রায় 'দালাল' বা 'চাটুকার' হিসেবে দেখাটা কি যৌক্তিক?

এই বক্তব্যের মূল কারণ হচ্ছে আমি আমার লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে মওলানা ভাসানী আইয়ুব খানের প্রতি সহানুভুতিশীল ছিলেন, তাঁর সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে চীন গমন করেছিলেন এবং ১৯৬৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন দেবার প্রতিশ্রুতি দেবার পরেও মওলানা ভাসানী গোপনে আইয়ুব খানকে সমর্থন দিয়েছিলেন।

এই অভিযোগটির লজিক্যাল ফ্যালাসিটা আগে বলি। তারপর আমি আইয়ুবের সাথে ভাসানীর সখ্যতা ব্যাখ্যা করবো।

ঊনসত্তরে মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন, ঊনসত্তরের আন্দোলনের তাঁর দুর্দান্ত ভূমিকা ছিলো, এই তথ্য দিয়ে কি তাঁর অন্য কাজগুলোকে জাস্টিফাই করা যায়? যায় না। আমি গতকাল একটা অপরাধ করেছি, আর আজকে একটা ভালো কাজ করেছি। এখন যদি আমি যুক্তি দেই যে আমি তো আজকে ভালো কাজ করেছি, তারপরেও আমাকে আপনারা অপরাধী বানিয়ে দিলেন, সেটা কেমন লাগবে আপনাদের কাছে? তিনি তেষট্টিতে আইয়ুবের প্রতিনিধি হিসাবে চীনে গেছেন, এই অভিযোগ ঊনসত্তরের ভূমিকা দিয়ে আড়াল করাটা আর যাই হোক না কেনো যুক্তিসঙ্গত কোনো কাজ হতে পারে না। ঊনসত্তর নয়, মূলত আটষট্টি সাল থেকে আইয়ুবের সমালোচনায় নামেন মওলানা ভাসানী। কিন্তু তেষট্টি থেকে আটষট্টির আগ পর্যন্ত তাঁর ভূমিকা কী আইয়ুবের ব্যাপারে? আসুন, ইতিহাস থেকে দেখি আমরা তিনি কী করেছিলেন সেই সময়ে।

১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসের ৭ তারিখে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার মির্জা দেশে মার্শাল ল জারি করেন। তিনি যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং আইয়ুব খানকে সুপ্রিম কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ দেন। ইস্কান্দার মির্জার দুর্ভাগ্য, এর মাত্র তিন সপ্তাহ পরে অক্টোবর মাসের ২৭ তারিখে আইয়ুব খান তাঁকেই উৎখাত করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নেন। ইস্কান্দার মির্জা মার্শাল ল জারি করার পর ১২ তারিখে নিরাপত্তা আইনে মওলানা ভাসানীকে বন্দি করেন। দীর্ঘ চার বছর তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন।

১৯৬২ সালের ৩রা নভেম্বর তাঁকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর পরই তিনি আইয়ুব খানের সাথে দেখা করেন, যেটা প্রবলভাবে সমালোচিত হয়। দেওয়ান শামসুল আরেফিন তাঁর, “Bhashani, the maulana Bhashani, the comrade” বইতে লিখেছেন,

“After more than four years in prison, the Moulana was released on November 3 1962. A few days after his release, he met with President Ayub in Rawalpindi. The Ayub-Bhashani meeting created a mixed reaction among the left political circles.”

আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের সময় পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় মিত্র ছিলো যুক্তরাষ্ট্র। চীনের সাথে পাকিস্তানের সীমান্ত নিয়ে বেশ ঝামেলাই ছিলো বলা চলে। সীমান্ত বিরোধ নিয়ে ১৯৫৯ সালে চীনের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। দুই পাশে দুই শত্রু দেশ ভারত এবং চীনকে পুষে রাখাটা খুবই ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ এই বিবেচনা থেকে চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের দিকে অগ্রসর হয় পাকিস্তান। এর জন্য অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের রোষেরও শিকার হয় পাকিস্তান। কিন্তু, তারপরেও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীনকে প্রাধান্য দেবার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান। ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো চীন সফর করেন।

পঞ্চাশের দশক থেকেই মওলানা ভাসানীর সাথে চীনের সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো রাজনৈতিক কারণে। চীনের সাথে সম্পর্ক আরো দৃঢ় করার জন্য মওলানার সাহায্য কামনা করেন তিনি। ১৯৬৩ সালের অগাস্ট মাসে তিনি মওলানাকে রাওয়ালপিণ্ডিতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। পত্র-পত্রিকাতে আইয়ুব-ভাসানী আঁতাতের খবর প্রকাশিত হতে থাকে। ভাসানী এগুলোকে ‘স্বার্থান্বেষী মহলের ছড়ানো গুজব’ বলে উড়িয়ে দেন।

এই আঁতাত যে গুজব না, সেটা টের পাওয়া যায় পাকিস্তানের প্রেরিত ডেলিগেশন টিমের প্রধান হওয়ার মধ্য দিয়ে। জাতীয় স্বার্থে তিনি এই দলের প্রধান হিসাবে চীনে যাচ্ছেন বলে তিনি জানান।

সেপ্টেম্বর মাসের ২৫ তারিখে ঢাকা থেকে প্রথমে করাচি যান তিনি। সেখান থেকে রেঙ্গুন হয়ে চীনে পৌঁছান মওলানা ভাসানী। পিকিং এ উষ্ণ অভ্যর্থনা পান তিনি। চীনের প্রিমিয়ার চৌ এন লাই এর সাথে সাক্ষাতে আইয়ুবের সরকারের জন্য সমর্থন প্রত্যাশা করেন তিনি। তিনি বলেন,

“I am old, perhaps I will not have another chance to come to china; I hope you and your country’s government can fully work together with Ayub khan’s government and his representative General Raza.”

চীনের যাবার সুযোগ তাঁর আরেকবারও হয়েছিলো। যদিও পরবর্তী এই সফর খুব বেশি প্রচারণা পায়নি। দেওয়ান শামসুল আরেফিন তাঁর বইতে লিখেছেন,

“Abdul Hamid Khan Bhashani paid another low-profile visit to China in 1964. The second visit was, in fact, more significant than the first one. This time he had exclusive talks with Chairman Mao, Premier Chou and other leaders including Den-Tsiao-ping.”

অগাস্ট মাসে রাওয়ালপিণ্ডিতে আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাৎ, তার মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে সরকারী প্রতিনিধি দলের নেতা হয়ে চীন সফর অন্য দল এবং নিজের দলের মধ্যেও তীব্র সমালোচনার সুত্রপাত ঘটায়। ন্যাপ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পিকিংপন্থী অংশ ভাসানীর নেতৃত্বে থেকে যায়, অন্যদিকে মস্কোপন্থী অংশ কমরেড মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে আলাদা হয়ে যায়।

পিকিং থেকে ফিরে আসার পরে শুধু মওলানা ভাসানী একাই নন, চিনপন্থী কম্যুনিস্টদের একটা বড় অংশ আইয়ুব খানের ভক্ত বনে যায়। আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের মহিমা কীর্তন করা শুরু করেন তারা। বাষাট্টির এতো বড় ছাত্র আন্দোলনের পরে যেখানে আইয়ুবের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার কথা ছিলো তাঁর, সেখানে তিনি আইয়ুব খানকে বিরক্ত না করার সিদ্ধান্ত নেন। ডক্টর নুরুন নবী তাঁর “Bullets of ‘71: A freedom fighter’s story” বইতে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন,

“After that visit, Moulana Bhashani declared his infamous policy statement, “Don’t disturb Ayub”. Bengali people were stunned. That was the biggest mistake of Moulana Bhashani’s political career.”

তারিক আলী চীনপন্থী বাম ছাত্রনেতা ছিলেন। তাঁর একটা বই আছে। বইটার নাম “Pakistan, military rule of peoples power”। বইটা প্রকাশিত হয়েছে দিল্লি থেকে ১৯৭০ সালে। এই বইতে তারিক আলী পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সাথে মাওলানা ভাসানীর নিবিড় সখ্যের কারণ অনুসন্ধান করে তার পটভূমি আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি তাঁর বইতে লেখেন, ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইউব খান মাওলানা ভাসানীকে পাকিস্তানের সরকারী প্রতিনিধি করে চীনে পাঠাতে চাইলে মাওলানা রাজি হন। সেখানে চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুং এর সাথে তাঁর যে গোপন সলাপরামর্শ হয় তার একটা বিবরণ তিনি মাওলানার কাছ থেকেই গ্রহণ করেছিলেন টেপ রেকর্ডারে।

তারিক আলী মওলানাকে প্রশ্ন করেছিলেন, “When you went to China what did Mao discuss with you when you met him?” এর উত্তরে মওলানা বলেছিলেন,

“মাও সে তুং আমাকে বলেন, “আপনি যদি সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন তাতে রাশিয়া, আমেরিকা এবং ভারতের হাতই শক্তিশালী হবে। আপনার কাজে হস্তক্ষেপ করা আমাদের নীতি বিরুদ্ধ, তথাপি আমরা আপনাকে সাবধানে এবং ধীর গতিতে আন্দোলনে অগ্রসর হতে অনুরোধ করবো। আপনার সরকারের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব আরো গাঢ় করার সুযোগ দিন।”

আগেই বলেছি, চীন থেকে ফিরে আসার পরেই মওলানা এবং তাঁর অনুসারীরা আইয়ুব খানের ভক্ত হয়ে যায়। সাপ্তাহিক ‘জনতা’ ছিলো ন্যাপের মুখপত্র। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন আনোয়ার জাহিদ। তিনি তখন ভাসানীর ব্যক্তিগত সচিব। আনোয়ার জাহিদ নিজেও আশির দশকে সামরিক শাসক এরশাদের দালালি এবং গোলামি করেছেন। তাঁকে সবাই ঝাঁড়ুদার মন্ত্রী হিসাবেই চিনতো। কারণ, তিনি একবার প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, এরশাদ যদি বলে, তবে তিনি রাস্তা ঝাঁড়ু দিতেও আপত্তি করবেন না। এই আনোয়ার জাহিদ ১৯৬৫ সালে সাপ্তাহিক জনতায় লেখেন, “There were only two Imperialist voices in Pakistan – Ayub and Vashani.”

আনোয়ার জাহিদের বক্তব্য পরিষ্কার, তিনি তাঁর নেতা এবং আইয়ুব খানকে একই কাতারে দেখেছেন। মওলানা ভাসানীর এই সামরিক শাসকের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের ফলাফল কী হতে পারে, সে সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মফিদুল হক লেখেন,

“১৯৬৩ সালে কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর জেনারেল আইউব আয়োজিত চীন সফরের পর থেকেই মাওলানা ভাসানীর পদস্খলন ঘটতে থাকে। চীনা রাষ্ট্র-নেতাদের আত্মস্বার্থ-প্রণোদিত নীতির কাছে মাওলানা ভাসানীর আত্মসমর্পণ এদেশের বাম রাজনীতির জন্য বিরাট দুর্ভাগ্যের সূচনা করে। রাজনৈতিক বিভ্রান্তি থেকে তিনি যে পথে পা দিয়েছিলেন তা শুধু আইউবের শাসনের সহায়ক ভূমিকা পালন করেনি, মাওলানা তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে সামরিক শাসকচক্রের যে সংযোগ গড়ে ওঠে তা পরবর্তী সময়েও বহু দুর্ঘটনার কারণ হয়েছিল।”

মওলানার নিজের দলের লোক হাজী দানেশও মওলানার সাথে আইয়ুব খানের সমঝোতা ছিলো বলে মনে করেন। এ কারণে আইয়ুবের বিরুদ্ধে তিনি বাম শক্তিগুলোকে একত্রিত করেননি বলে অভিযোগ করেন তিনি। হাজী দানেশ ছিলেন ন্যাপের সহ-সভাপতি। মওলানার সাথে তাঁর কোন্দল এমন পর্যায়ে যায় যে তিনি সহ একটা বিরাট অংশ ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে ন্যাপ থেকে বের হয়ে যান। ১৯৭১ সালের ৮ই জানুয়ারি হাজী দানেশ এক খোলা চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে তিনি বলেন,

“আপনি বিশ্বাস করতেন যে ইস্কান্দর মির্জা ও আইউব খান দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করবে। আইউবের বিরুদ্ধে বামপন্থী শক্তিগুলোকে সংগঠিত করার ব্যাপারে আপনার অনীহা এটাই প্রমাণ করে যে, শোষক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে আপনার যোগ ছিল। আমি এটা বিশ্বাস করতে পারিনা যে, আপনার ও ন্যাপের এ ধরনের নীতির মাধ্যমে লাখ লাখ শোষিত মানুষের মুক্তি আসবে।”

 

Masudur Rahman: ১৯৭০-এর জানুয়ারিতে সন্তোষে কৃষক সম্মেলনে মাওলানা ভাসানী আরও বললেন, ‘আমাদের ভাগ্য আমাদেরই গড়ে নিতে হবে। পিন্ডির গোলামি ছিন্ন করতে হবে।’ ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বরের বঙ্গোপসাগরীয় সাইক্লোনের প্রেক্ষাপটে উনি আবার সরাসরি বললেন ‘স্বাধিকার স্বায়ত্তশাসন নয়, চাই স্বাধীনতা।’

ফরিদ, তোমার লেখা আমি গুরুত্ব সহকারে পড়ি; অনেক কিছু জানতে পারি, শিখতে পারি। কোন মানুষই ভুলের উর্ধ্বে নন, যেমন ভাসানী। কিন্তু, তাই বলে তাকে আইয়ুব ইয়াহিয়ার সহচর বানিয়ে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিলে! মওলানা ভাসানীকে নিয়ে তোমার লেখাগুলি পড়ে আমি সত্যি হতাশ!

Farid Ahmed: আমিতো কোনো সিদ্ধান্ত দেই নাই। সবই কোট করেছি আমি। তিনি আইয়ুবের সহচর ছিলেন, এই অভিযোগ তখনই উঠেছে।

আমার বিশ্লেষণ আমি বলতে পারি। যে আইয়ুব ক্ষমতা দখল করে তাঁকে কারাগারে পাঠালো, তিনি কারাগার থেকে বের হয়ে সেই আইউবের প্রতিনিধি হয়ে চীন যান ঠিক কী কারণে? কোন স্বার্থে? আপনি আমাকে একটা মাত্র যৌক্তিক কারণ বলবেন মাসুদ ভাই এ ব্যাপারে। আমি দ্বিতীয় যুক্তিও শুনতে চাইবো না।

তিনি সিআইএ-র রিপোর্ট ইয়াহিয়াকে দিয়েছেন? কেনো? যেখানে তিনি নিজেই বলছেন এই দলিলে দেখা যাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার ষড়যন্ত্র চলছে। উনি কি বিচ্ছিন্নতার বিপক্ষে ছিলেন? বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার একেকজনের একেক ধরনের কর্মপন্থা ছিলো, সেই পন্থা নিয়ে সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু এই দলিল হস্তান্তর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষেই তাঁকে দাঁড় করিয়ে দেয়।

ভাসানী একজন স্ববিরোধী মানুষ ছিলেন। উনি স্বাধীনতার পক্ষেও বহু কথা বলেছেন, আবার বিপক্ষেও বলেছেন। আপনারা শুধু পক্ষেরটা জানেন, বিপক্ষেরটা না। আমি উনি স্বাধীনতার বিপক্ষে কী কী বলেছেন সেগুলো নিয়েই আরেকটা লেখা লিখবো দুই একদিনের মধ্যেই।

Swapan Mahmud: "পাকিস্তান ওয়ালাইকুমআসসালাম" এটাই স্বাধীনতার প্রথম প্রতীকী ঘোষণা।

Farid Ahmed: ওই এক তথ্য নিয়েই পড়ে থাকেন। মোল্লাদের অন্ধত্ব এবং একদেশদর্শীতা আমাকে পীড়া দেয় না, কিন্তু, আপনাদেরটা দেয়। কারণ, প্রগতিশীল বলে দাবি করেন আপনারা। দাবি করেন, অথচ সব তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে আসেন না। পূর্বানুমান সিদ্ধান্ত নিয়েই বসে থাকেন।

১৯৬২ সালে ছাত্ররা আইউব খানের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করেছিলো শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে। ভাসানী কি জানতেন না যে এই দেশের ছাত্র এবং জনগণ আইউব জান্তাকে বাতিল করে দিয়েছে? সেই জান্তার প্রতিনিধি হিসাবে ১৯৬৩ সালে তিনি চীনে যান কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর আপনাদের মতো বায়াসড লোক কোনো দিনই দিতে পারবেন না, খালি ওই এক ওয়ালাইকুম সালাম নিয়েই পড়ে থাকবেন আপনারা।

Masudur Rahman: খন্ডিত বিশ্লেষণ করে প্রমান করা যাবে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য '৭০ এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন নাই। একটি বিষয় অন্তত আমার কাছে পরিষ্কার, ভাসানীর তুমুল জনপ্রিয়তা থাকা সত্যেও ক্ষমতার লোভ তার ছিল না। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে উনিও কষ্ট পেতেন ভাসানীর এই পোস্টমর্টেম দেখে কারন উনি জানতেন উনার বঙ্গবন্ধু হওয়া পিছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশী। বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা থেকে মুক্ত করার জন্য যে গন আন্দোলনের দরকার ছিল, তা ভাসানী ছাড়া আর কে করতে পারতেন? তুমি তো ১৯৬৩ সনেই আটকে থাকলা, ফরিদ!

Farid Ahmed: উনার সামরিক শাসক সখ্যতা নিয়ে বিস্তারিত আমি লিখেছি মাসুদ ভাই। শুধু ৬৩-তে আটকে থাকিনি। যদিও ওইটাই সবচেয়ে ভাইটাল মুহুর্ত। কোন কারণে তিনি আইয়ুবের প্রতিনিধি হয়ে চীনে গিয়েছিলেন, সেটা জানাটা খুবই জরুরী আমাদের জন্য। মওলানা বাদে অন্য কেউ হলে আমি এক বাক্যে তাঁকে আইয়ুবের দালাল বলে দিতাম। ব্যক্তিটা উনি বলে আমি এখনো এর একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা খুঁজছি।

১৯৭২-১৯৭৬

মওলানা ভাসানী ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক হক-কথা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করলেও মুজিব সরকারের জাতীয়করণ নীতি এবং ১৯৭২-এর সংবিধানের এর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। ১৯৭৩ সালে খাদ্যের দাবিতে ঢাকায় ১৫-২২ মে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ১৯৭৪-এর ৮ এপ্রিল হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি গঠন করেন। একই বছর জুন মাসে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলে টাঙ্গাইলের সন্তোষে গৃহবন্দি হন। ১৯৭৬-এর ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লং মার্চে নেতৃত্ব দেন। একই বছর ২ অক্টোবর খোদাই খিদমতগার নামে নতুন আর একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

— উইকিপেডিয়া থেকে

Supik Anwar: ৫০ বছর ধরে বহুমাত্রিক ভাবে গন মানুষ এর রাজনীতি করা একজনকে শুধু কয়েক বছরের রাজনীতি দিয়ে মুল্যায়ন কতটুকু যুক্তিযুক্ত!? ঐ সময়ে উনি হাসপাতালে ছিলেন।পরে ভাসানী হাসপাতালে থাকা অবস্তায় মোশতাক উনাকে একদিন দেখতে গিয়েছে। তখন উনি মোশতাককে বলেছিলেন "আমার মুজিবররে তোমরা মাইরা ফেললা"!

Farid Ahmed: আপনি আপনার রেফারেন্স দেন। আর আমি আমার রেফারেন্স দিচ্ছি।

Supik Anwar: একজন সাংবাদিক (নামটা মনে পড়ছে না) উপস্থিত ছিলেন অই সময়। পরে উনি সহ সবাইকে রুম থেকে বাইরে যেতে বলেন মোশতাক। মোশতাক বেশ কিছুক্ষণ ভাসানীর সাথে একান্তে কথা বলে।এগুলা ভাসানীকে নিয়ে লিখা একটা কলামে পড়েছিলাম।মনে হয় ইরফানুল বারীর। আর ৭৫ এর পর উনি অনেক অসুস্থ ছিলেন। এই সুযোগ এ মোশতাক তার লেজেটিমিসির জন্য উনাকে ব্যবহার করেছে। আর জাতির জনক কে উনি কথটা পছন্দ করতেন সেই কথা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আছে। এছাড়া উনি মোশতাক ১ং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক থাকার পর ও তাকে ডিঙিয়ে মুজিবকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করেন সামশুল হক এর অনুপস্থিতিতে। আর আগরতলা মামলায় তার প্রিয় মুজিবরকে জেল থেকে বের করার হুংকার এবং তার ফলাফল তো জানাই আছে।

Farid Ahmed: এটা কোনো রেফারেন্স হলো? আসেন এর বিপরীতে আপনাকে রেফারেন্স দেখাই। কয়েকটা পত্রিকার কাটিং দেখাচ্ছি। কারো মুখের কথার চেয়ে পত্রিকা অনেক বিশ্বাসযোগ্য।

doc

Supik Anwar: মওলানা ভাসানীকে নিয়ে কয়েকটা কৌতুহল জাগানো প্রশ্ন পেলাম, এমনকি আমার লেখা শেয়ার করা কিছু মানুষও এই সব মন্তব্য পেয়েছেন দেখলাম। একটা প্রশ্ন হলো, ভাসানী ১৫ অগাস্টের হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করেছেন। মোশতাককে সমর্থন দিয়েছেন। জিজ্ঞেস করলাম, জেনেছেন কোথায়?

— তখনকার দৈনিক পত্রিকায়। বড় করে ছাপা হয়েছে তো।

— কিন্তু তখন যে চারটা মাত্র পত্রিকা আমাদের খবরের উৎস, সেগুলো তো এর আগেই বাকশাল সরকার সরকারী মুখপাত্র বানিয়ে বাকি সবগুলো পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলো। মাওলানার প্রতিষ্ঠিত হক কথাকে নিষিদ্ধ করেছিল ১৯৭২ সালেই। ফলে মোশতাকের আমলে যে তথ্য আমরা খবরের কাগজ সূত্রে পেলাম, সেগুলোর নির্ভরযোগ্যতা কী? কিংবা, এইভাবে গণমাধ্যম কবজা করার পরিণাম যে মানুষের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের সুযোগ এবং অভ্যাস দুটোই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল বাকশালের মাধ্যমে, চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে, আরো নানান সব নিপীড়নমূলক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে, এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হলো যে দিনে-দুপুরে রক্ষীবাহিনীর হাতে খুন হলেও সে খবর আর পত্রিকায় ছাপা হবে না, যে হাতিয়ারগুলো ব্যবহার করেই মোশতাকের মন্ত্রীসভায় লীগের নেতাদের স্বেচ্ছায় কিংবা বলপ্রয়োগে অংশ নেয়ানো হলো, তার নিন্দা কখনো করেছেন? ৯৫ বছরের বুড়ো ভাসানী ১৫ অগাস্টের বহু আগে থেকেই গৃহে অন্তরীণ ছিলেন। এই বয়োবৃদ্ধ মানুষটিকে কারা গৃহবন্দি করে রেখেছিল? তার নিন্দা করেছেন? সেই ঘরে আটকে থাকা, দুনিয়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারিতে আটকে রাখা অসুস্থ মানুষটাকে হাসপাতালে মোশতাক দেখতে গিয়েছিলেন, আওয়ামী নেতাদের মত তিনি বঙ্গভবনে গিয়ে মোশতাককে সমর্থন জানান নাই। এই ছবিটিই ফলাও করে পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, এবং পত্রিকাতে বাকি সব যা জানি সেটাও বাকশালের সংস্কৃতিতে কবজা করা পত্রিকার ভাষ্য, ভাসানী কি বলেছেন তা সেখানে কিভাবে মিলবে?

অভিযোগ করার আগে অভিযোগের প্রেক্ষাপটা তাই মনে রাখলে বোঝা যায়, অভিযোগকারীই ভয়াবহ একটা পরিস্থিতির সমর্থক, যেখানে কারও মতামত জানারও উপায় ছিল না, এমনই ভয়াবহ ছিল বাকশালি শাসন। তবুও ভাসানী কী মনে করতেন, সেটা জানতে ভাসানীর ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বাসযোগ্য মানুষদের কাছেই যেতে হবে। তাদের অনেকের কাছেই শুনেছি, নিজের সমর্থকদের ওপর এত নিপীড়নের পরও, আওয়ামী লীগের এত গণবিরোধী অবস্থানের পরও ভাসানী ১৫ অগাস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে দারুণ ব্যাথা পেয়েছিলেন। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক বিরোধিতা তিনি যতই করুন না কেন, তাকে পুত্রের মতই দেখতেন। প্রতিহিংসাপরায়ণ তিনি ছিলেন না, যদিও জনগণের বলপ্রয়োগে গভীর আস্থা পোষণ করতেন। সেই বলপ্রয়োগের স্মরণীয়তম দৃষ্টান্তটার কথাই বরং বলি।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাতেই হয়তো শেখ মুজিবুর রহমানের ফাঁসি হয়ে যেতো বঙ্গবন্ধু উপাধি পাবার আগেই; কেউ তাকে উদ্ধার করার সাহস কিংবা স্পর্ধা দেখায়নি, বন্দি ছিলেন তিনি ঢাকা সেনানিবাসে। '৬৯ এর প্রবল অভ্যূত্থানের ওপর দাঁড়িয়ে ভাসানী হুমকি দিয়েছিলেন পাক সামরিক জান্তাকে: মুজিবকে না মুক্তি দেয়া হলে জনতাকে নিয়ে তিনি ক্যানটনমেন্ট থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসবেন। আগুন ঝরানো মাওলানা তার নাম এমনি এমনি হয়নি।

এই হলো ভাসানী। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ৫০ বছর পূর্তিতে তার প্রাবল্যকে বুঝতে হলে খুচরো খুচরো প্রশ্ন করে কাজ হাসিল হবে না। অনেক বড় অকৃতজ্ঞতা এবং নিমকহারামি থেকেই ভাসানীকে নিয়ে এই জাতীয় মিথ্যা গুজব মোসাহেবরা ছড়িয়ে থাকে।

— (ফিরোজ আহমেদ)

Farid Ahmed: এটা পড়েন। আগুণ ঝরানো মওলানার আসল পরিচয় পাবেন। মুদ্রার অপর পিঠের মওলানা ভাসানী : জাফর ওয়াজেদ ↑। অলি আহাদের একটা বই আছে। বইটার নাম হচ্ছে, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-১৯৭৫। সেই বইতেও শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডে ভাসানীর সমর্থনের কথা বলা আছে। ভাসানী হাসপাতালে ভর্তি হন নভেম্বরের ২১ তারিখে। তিনি তারবার্তা পাঠান শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরের দিনই। তখন তিনি সন্তোষে। হাসপাতালে তিনি খন্দকার মোশতাককে কী বলেছেন, সেটা কোনো পত্রিকায় আসেনি। তিনি যে খুনি সরকারকে অভিনন্দিত করেছেন, তাদের সমর্থন জানিয়েছেন, এগুলো সব পত্রিকাতেই এসেছে। তাঁর নামে এগুলো বানানো খবর হলে তিনি অবশ্যই আপসেট হতেন এবং এগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। এদেরকে সহযোগিতা দিতেন না। বাস্তবে কিন্তু তা হয়নি। ফারাক্কা লং মার্চের সামনের সারিতে তিনি ছিলেন। কিন্তু, এর পিছনের পুরোটাই সায়েমের অবৈধ সরকার তথা জিয়াউর রহমান ছিলো।

doc

Supik Anwar: শুধুমাত্র পত্রিকার কয়েকটি লিখার উপর ভিত্তি করে উনাকে বারবার কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন তাতে কি সঠিক ইতিহাস প্রতিফলিত হচ্ছে!? যেই মানুষ সারা জীবন এই অঞ্চল এর মানুষকে নিয়ে মুক্তি সংগ্রাম করেছেন সেই আসাম থেকে বাংলা। কংগ্রেস থেকে বের হয়ে চিত্তরঞ্জন দল, তার পর মুসলিম লীগ এর সাথে পাকিস্তান আন্দোলন, জমিদার বিরোধী আন্দোলন , ভাষা সংগ্রাম, কৃষক আন্দোলন, লাইনপ্রথা, আওয়ামীলীগ সৃষ্টি, যুক্তফ্রন্ট, পাকিস্তানকে ওলাইকুম বলা, কাগমারী সন্মেলন, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতা, ১৯ দফা,৬৯ এর গন-আন্দোলন, ৭০ এর প্রলয়কারী তুফান, ইলেকশন এ আওয়ামীলীগকে সমর্থন, স্বাধীনতা সংগ্রাম,লং মার্চ সহ আরো মাটি ও মানুষের জন্য অনেক সংগ্রাম করা মানুষকে ইতিহাস এর ক্রনলজিকাল পাঠ না করে শুধুমাত্র কয়েকটি ঘটনার খণ্ডিত পাঠ ইতিহাসকে অবজ্ঞা করার মতই।

রেফারেন্স —
মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডের খবর শুনে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ঘটনার কয়েক দিন পর তিনি চিকিৎসার জন্য পিজি হাসপাতালে ভর্তি হন। এ সময়ে খোন্দকার মোশতাক আহমদ তার সরকারী স্টাফদের সাথে নিয়ে হুজুরের সংগে দেখা করেন। সেই বহরে সাবিহউদ্দীন আহমদও ছিলেন। তিনি তখন তার পি আর ও ছিলেন। আমি হুজুরের কেবিন কক্ষেই ছিলাম। এর একটু আগেই ফনি ভূষণ মজুমদার তার কেবিনে ফিরে গেছেন। তিনি দিনে একবার হলেও হুজুরের শরীরের খবর নিতে আসতেন। হুজুরের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও ভক্তি দেখে অবাক হয়েছি। কেবিনে ফিরে যাবার সময়ে তিনি আমাকে হুজুরের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলতেন। হুজুরের শরীর তখন খুবই খারাপ ছিলো। এখানে আসার আগে তিনি কুমুদিনী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। খোন্দকার মোশতাক কেবিনে ঢুকলে হুজুর তার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকান। বসতেও বলেননি। এক সময়ে তিনি বলেই ফেললেন "আমার মজিবরকে তোমরা মেরেই ফেললে!" তিনি ক্ষোভের সঙ্গে তাকে আরো বলেন "দুই আনার মুড়ি খেয়ে সারাদিন দলের কাজ করেছে আর তোমরা নেতা হইছো!" রাগ ও ক্ষোভের মাত্রা বাড়তে থাকলে এক সময়ে মোশতাক আমাকে একটু বাইরে যেতে,বলেন। আমি হুজুরের ঔষুধ দিয়ে বরান্দায় এসে দাঁড়াই। চলবে... [একুশে পদক প্রাপ্ত ছড়াকার আবু সালেহ্ এর টাইম লাইন হতে]

মোস্তাককে সমর্থন দেয়ার বরাত সরকারী প্রচার মাধ্যম। তখন দেশের পত্রিকার সংখ্যা ছিল ৪টি এবং ৪টিই সরকারী। এ অবস্থায় ১৫ আগস্টের পরপর যখন বিবৃতিটি প্রকাশিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে, তখন সরকারি মালিকানাধীন দৈনিকের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে স্বাভাবিক কারণেই। শুধু তা-ই নয়, মওলানা ভাসানীর কথিত বিবৃতিটি উদ্ধৃত করা হয় ‘বিশ্বস্ত সূত্রের’ বরাত দিয়ে। সততা ও সদিচ্ছা থাকলে বিশেষ দৈনিকটি থেকে সরাসরিই বিবৃতিটি উদ্ধৃত করা সম্ভব ছিল এবং ইতিহাস গবেষণার দৃষ্টিকোণ থেকে তেমনটি করা প্রয়োজনও ছিল। কিন্তু সহজবোধ্য কারণে দৈনিকটির নাম পর্যন্ত বলা হয় না বরং আশ্রয় নেয়া হয় ‘বিশ্বস্ত সূত্রের'।
[শাহ আহমদ রেজা]

Farid Ahmed: আপনি ঝোপে ঝাড়ে বাড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছেন। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরেও মওলানা ভাসানী রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, রাজনীতির মাঠে ছিলেন। কারণ, ফারাক্কা মিছিলের মতো বিশাল এক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তাঁর মতো সাহসী লোক নিশ্চয় ময়দানে প্রতিবাদ করেছেন, মিছিল মিটিং করেছেন। জাস্ট, কোনো একটা পত্রিকার একটু কাটিং দেখান আমাকে এ ব্যাপারে। আমি সবই পাঠ করেছি। এই লোক শেষবেলায় একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করাতো দূরের কথা, বরং সেটাকে সমর্থন করেছেন। এটাও ইতিহাস পাঠেরই অংশ।

Adil Mahmood: ভাসানী যে রকম ফ্লিপ ফ্লপ স্ববিরোধী আচরণ পাকিস্তান আমল থেকে করে গেছেন ওনার পক্ষে ব্যাক্তিগত পর্যায়ে মোশতাককে এই ধরনের কথা বলা এমন কিছু অসম্ভব না। এতে কোন সন্দেহ নাই যে রাষ্ট্রপ্রধান মুজিবের প্রতি তার গভীর বিরাগ থাকলেও ব্যাক্তি মুজিবকে উনি আজীবনই স্নেহ করে গেছেন। ব্যাক্তি মোশতাককে তোমরা এইটা কি করলা বলা এবং একই মোশতাকের সরকারকে অভিনন্দন জানানও অন্তত মাওলানার পক্ষে অসম্ভব কিছু না। সরকার ষড়যন্ত্র করে বিবৃতি ছাপিয়েছে এই ধরনের যুক্তিতে ৭৫ এর পর রাতারাতি ভোল পালটানো সবাই সাফাই গাইতে পারে এবং গায়। যারা মোশতাক মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়েছিল সে সব লীগ নেতা দাবী করেছে তাদের বন্দুকের মুখে নেওয়া হয়েছিল। ভাসানী ছিলেন পরিষ্কার বঙ্গবন্ধু সরকার বিরোধী সোচ্চার কণ্ঠ এবং লক্ষণীয়ভাবে দিনে দিনে কট্টর দক্ষিণপন্থীতে বিবর্তিত। বঙ্গবন্ধু সরকারের পতনের পর ডানপন্থী মোশতাকের প্রতি তার রাজনৈতিক সমর্থন এমন কি অবাস্তব যে সেটাকে নানান ষড়যন্ত্র তত্ত্ব অমূকে এই শুনেছে সেইই শুনেছে যার ভিত্তিতে সত্য হতে পারে না এইসব দাঁড়া করাতে হবে সেটাই বুঝি না। ভাসানীর পূর্ন ব্যবচ্ছেদ করলে বরং আরও অনেক বিতর্কিত কাজকারবার পাকিস্তান আমল থেকেই দেখা যায় যেগুলির কাছে এই মোশতাক অধ্যায় এমন কিছু না।

বঙ্গবন্ধুর আরেক সিনিয়র রাজনৈতিক কলিগ ৫৬ সালের প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান যার কেবিনেটে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী ছিলেন সেই আতাউর রহমান খান বঙ্গবন্ধুর পতনের পর ১৫ই আগস্ট নাজাত দিবস ঘোষণা করেছিলেন। মজার ব্যাপার হল এই আতা খান সাহেবই মোটে ৪ মাস আগে বঙ্গবন্ধুর নানান গুণগান গিয়ে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। আমার তো মনে হয় বঙ্গবন্ধু আমলেও ওনার নামে সরকারী পত্রিকায় মিথ্যা বিবৃতি দেওয়ানো হয় আর মোশতাক আমলে তো আমরা জানিই যে পত্রিকায় যার নামে যা ছাপা হয়েছিল সবই বানানো।

Swapan Mahmud: ভাষাণী-মুজিব গুরু শিষ্য দুজনই নির্বিশেষে মানুষ।দুজনেরই ভুল ছিল। এখন তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় না রেখে এ বিষয়গুলো মোকাবেলা করতে গেলে বঙ্গবন্ধু কেও আওতায় আনতে হবে। ভিয়েতনাম দিবসে মতিউল-কাদের হত্যা (স্বাধীন বাঙলাদেশে রাজপথে প্রথম হত্যা), কমরেড সিরাজ শিকদার কে পুলিশি হেফাজতে হত্যা (বাঙলাদেশে প্রথম বিচার বহির্ভূত হত্যা),দিন দুপুরে জাসদ অফিস জ্বালিয়ে দেয়া (১৯৭৩)।এই বিষয়গুলোও সামনে নিয়ে আসলে কী জামাত-শিবির বলা শুরু হবে।(বিতর্ক করার জন্য কমেন্ট করছি না এবং এ প্রসঙ্গে আর কোন কথা আমি বাড়াব না)

Farid Ahmed: মুজিবের ভুল নিয়ে তো আমরা কথা বলি। এগুলোর কোনোটাতেই তো তাঁকে ছাড় দেওয়া হয় না। একটা অপরাধকে খণ্ডন করতে যখন আরেকটাকে আনা হয়, তখন আসলে সেই অপরাধকে ঢাকার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। আপনি মুজিবকে বাদ দিয়ে পরিষ্কার করে শুধু ভাসানীর অপরাধকে অপরাধ বলতে পারছেন না কেনো? মুজিবের অপরাধের আলাপ যখন আলাপ করা হবে, তখন না হয় মুজিবকে ধোলাই দেওয়া যাবে। অন্যের অপরাধকে এনে তুলনা কখন করা হয়, সেটা আপনার না জানা থাকার কথা না। তাঁর সরকারের সবচেয়ে কট্টর সমালোচক হবার পরেও, মওলানার ক্ষেত্রে শেখ মুজিব যে উদারতা এবং ভালবাসা দেখিয়েছেন, প্রতিদানে মওলানা তাঁর ধারে কাছেও যেতে পারেন নাই। অথচ বয়োজ্যেষ্ঠ হিসাবে উল্টো ভূমিকাটা নেবার কথা ছিলো তাঁর।

Adil Mahmood: বঙ্গবন্ধু বা মুজিব সরকারের ভুলের কারনে ভাসানীর ভুল যদি ব্যাখ্যা করা যায় তাহলে অবশ্যই স্বাধীন বাংলাদেশে ভাসানীর মূল্যায়নে তৎকালীন সরকারের ভুলগুলিও আমলে আনা উচিত; এতে সমস্যা নাই। কিন্তু তাই বলে ভাসানীর ভুল ব্যালেন্স করার জন্য মুজিব সরকারের ভুলও পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের খাতিরে আনতে হবে তাহলে সেটা যৌক্তিক বিশ্লেষণ বলা যায় ন। এটা হয়ে যায় এখনকার প্রচলিত "অমুক ঘটনার সময় আপনি কোথায় ছিলেন" জাতীয় এগ্রিসেভ ডিফেস। এই ধরনের আক্রমণাত্মক ডিফেন্স সাজানো হয় নিজের পছন্দের দল বা ব্যাক্তির সমালোচনা আড়াল করার লক্ষ্য নিয়ে - আমি হয়ত খারাপ কিন্তু অপরপক্ষ তো আরো খারাপ। সে নিয়ে বল না কেন!

Iftakhar Ahmed Babu: আপনার এই পেপার কাটিং এর সত্যতা পাওয়া যায়নি ৷ সেরকম কোন বিবৃতি পাঠান হয়নি ৷

Farid Ahmed: পেপার কাটিং এর সত্যতা মানে কী বাবু ভাই? পত্রিকায় ছাপা হয়নি এই বিবৃতি, নাকি পত্রিকাওয়ালারা উনার নামে মিথ্যা বিবৃতি লিখেছে?

Iftakhar Ahmed Babu: বঙ্গভবন থেকে কেউ মিস কোট করেছিল ইচ্ছাকৃত ভাবেই l এটা নিয়ে অনেক অনুসন্ধান হয়েছে ৷ যে কোন তারবার্তা রেকর্ড রাখা হয় ৷ খোঁজা হয়েছে , কোন প্রমান পাওয়া যায় নাই ৷

Farid Ahmed: উনি কি এর পাল্টা বিবৃতি দিয়েছিলেন কোনো? অনুসন্ধানটা কাঁরা করেছিলো? সেটার রেফারেন্স কী?

Swapan Mahmud: তারপর দেখা যাচ্ছে খবরটা জানাচ্ছে বাসস।বাসস তো রাষ্ট্রীয় সংস্থা এরা প্রপাগান্ডাও ছড়াতে পারে।

Farid Ahmed: ভাসানী বামপন্থী ছিলেন বলে কি আপনাদের এই অবিশ্বাস? সেটা হলে লজিক্যাল কিছু হলো না। এর পাল্টা বিবৃতি কোথায়, মুজিব হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা করে ভাসানীর কর্মকাণ্ড কী? তিনি কি এর বিরুদ্ধে কখনো কিছু বলেছেন? এগুলো আনতে হবে আপনাদের সামনে। শুধু বাসস, বলেছে বলে অবিশ্বাস করে গেলে পক্ষপাতিত্ব হয়ে যাবে।

Swapan Mahmud: বামপন্থী ব'লে সাত খুন মাফ হ'য়ে যায়না।আমি শুধু একটা সম্ভাবনার কথা বলেছি।অপ্রাসঙ্গিক হ'লেও বলি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথম মিছিল ক'রে ছাত্র ইউনিয়ন।এই কিছুদিন আগে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলছিলেন উনি তখন এক আওয়ামীলীগ নেতার সাথে এ বিষয়ে আলাপ করতে হেলে ঐ নেতা বলেন "সেলিম এখনি মিছিল টিছিল করার দরকার নাই শেষে আওয়ামীলীগ সরকারকেই (মোশতাক ক্যাবিনেট) নিষিদ্ধ করে দেবে।"

Farid Ahmed: আওয়ামী লীগের নব্বইভাগ নেতাই স্বেচ্ছায় কিংবা ভয়ে মোশতাকের সাথে ছিলো। এগুলো প্রমাণিত। এই কাপুরুষদের ডিফেন্ড করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। সেলিম সাহেব যেটা বলেছেন, সেটা যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য।শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে দুজন লোকের করার সামর্থ্য ছিলো। এর একজন হচ্ছে জেনারেল ওসমানী এবং আরেকজন হচ্ছেন মওলানা ভাসানী। এই দুই ব্যক্তির গ্রহণযোগ্যতা ছিলো সারাদেশব্যাপী। দুঃখজনক হচ্ছে, তাঁরা দুজনেই এই কাজটা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

আমি একটা জিনিস দেখাচ্ছি এখানে আপনাদের। এটা সরাসরি কোনো প্রমাণ নয়। কিন্তু, ঘটনাটা তাৎপর্যপূর্ণ। অনেক না বলা জিনিস এখান থেকে বের করে আনা সম্ভব। ২১ তারিখ দুপুরবেলা সন্তোষ থেকে অসুস্থ ভাসানীকে নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। ভর্তি করা হয় পিজি হাসপাতালে। সন্ধ্যাবেলাতেই মোশতাক তাঁকে দেখতে হাসপাতালে যায়। পরের দিন এই খবরটা প্রতিটা সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় গুরুত্বের সাথে ছাপা হয়। ভাসানী যদি এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতেন, মোশতাকের মতো একটা লোকের তাঁর প্রতি এই সৌজন্যতা দেখানোর কথা নয় এবং পত্রিকাগুলোতে এটাকে এভাবে হাইলাইট করারও কথা নয়। আমি শুধু দৈনিক বাংলার খবরটা দিচ্ছি।

mostaq-vasani

রেকর্ডের স্বার্থে আরেক তালেবর পাপা টাইগারের চরিত্রটাও এই সুযোগে তুলে ধরি।

zia-osman

Swapan Mahmud: গোটা আওয়ামীলীগ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একটা প্রতিবাদ মিছিল করলো না।সুর সুর করে মোশতাকপন্থী হয়ে গেল। ওসমানী তো বাকশাল বিরোধীতা করে আওয়ামীলীগ ছেড়ে দিয়েছেন। ভাসানী ও আওয়ামীলীগ এ নেই। দায়ী হয়ে গেলেন তারা। আওয়ামীলীগ বরাবরই নপুংসক ও বিট্রেয়ারদের নেতৃত্ব পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেন ও ভারতে গিয়ে সাহায্য চান কাদের সিদ্দিকী, লতিফ সিদ্দিকী,সুলতান মনসুর। সুলতান ভাই'র কাছে সেই সব দিনগুলোর কথা অনেকবার শুনেছি। আজ তাদের তিনজনকেই আওয়ামীলীগ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তবে আমি জাতীয় চার নেতা, রাজ্জাক, তোফায়েল, সামাদ, আজাদ সহ যারা জেলে ছিলেন তাদের কথা বলছি না।তারা প্রকৃতই দেশপ্রেমী ও বঙ্গবন্ধুর কর্মী ছিলেন।বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথম মিছিল করতে হল বামপন্থি ছাত্র ইউনিয়ন কে। (আপনারা যাদের ঠাট্টা করে বলেন বামাতি) যে দল নিজের প্রতিষ্ঠাতাই শুধু নন জাতির পিতার ও হত্যার প্রতিবাদ করার হিম্মত রাখেনা তাদের কাছে দেশ মাতৃকার কোন মূল্য থাকতে পারেনা!

Farid Ahmed: আপনার এই পুরো বক্তব্যটাই অযৌক্তিক, অপ্রাসঙ্গিক এবং অপরিসীম খেদোক্তির বহিঃপ্রকাশ মাত্র । আমরা আওয়ামী লীগ নিয়ে আলোচনা করছি না, বা আওয়ামী লীগের সাথে কারো তুলনাও করছি না। এখানে স্পেসিফিক ইস্যু হচ্ছে খুনি সরকারে প্রতি ভাসানীর সমর্থন দেওয়া। আওয়ামী লীগের লোকেরা তো সমর্থন দিয়েছেই। মোশতাকও আওয়ামী লীগেরই লোক ছিলো। সেগুলো বললে কি ভাসানীর অপরাধ কমে যাবে? আপনি বলেন আপনি মুক্তমনের মানুষ, কিন্তু বামদের বিরুদ্ধে গেলেই আর আপনার মুক্তমনে কোনো কিছুই ঢোকে না। এটা খুবই দুঃখজনক। এতখানি ব্রেইন ওয়াশড হওয়া ঠিক না।

Swapan Mahmud: আমি বলেছি সব দায়ভার ভাসানীর হয়ে গেল!

Farid Ahmed: ভাসানীর সব দায়ভার এটাওতো কেউ বলে নাই, আমিও বলি নাই। তিনি খুনে সরকারকে সমর্থন দিয়েছেন, তাদের সাথে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। এতো বড় একজন রাজনীতিবিদ হয়ে, শেখ মুজিবের গুরুস্থানীয় হয়েও, শেখ এবং শেখ পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি কী করেছেন? মোশতাক তাঁর শয্যাপাশে গেলে কি একবারও বলেছেন, আমি খুনির সাথে হাত মেলাই না। বলেন নাই। এমন একটা নিম্নস্তরের লোককে ডিফেন্ড করেন কীভাবে আপনি, সেটাই তো আমি বুঝি না। নারী, শিশু হত্যা যাকে সামান্যতম বিচলিত করে না। আমি আওয়ামী লীগ করেছি, এই সব আকাম করা কোনো আওয়ামী লীগারকে সমালোচনা করতে আমি তো দ্বিধায় ভুগি না সামান্যতমও। সেটা করতে গিয়ে অমুক তমুক কী করেছে, কার দায় বেশি কম সেটা বিবেচনায় নেওয়া হবে না।