একটা সংখ্যারেখার একপ্রান্তে যদি ধর্ম বসান, আর আরেক প্রান্তে বিজ্ঞান, তাহলে সংখ্যারেখাটির মাঝামাঝি কোন জায়গায় পাবেন সিউডোসায়েন্স। সিউডো হল মিথ্যা, সায়েন্স হল বিজ্ঞান, মোট কথা জিনিসটা হল অপবিজ্ঞান। এখন কথা হল এটার কাজ কী?
আমি একটা জিনিস বিশ্বাস করি, ঠিক মত কথা সাজালে যে কাউকে যে কোনো কিছু্র প্রতি কনভিন্স করা যায়। হ্যারি হুডিনির জীবনীতে দেখেছিলাম এমন ভণ্ড প্রেতসাধক ছিল, যারা অনেক সায়েন্টিস্টকেও বোকা বানিয়েছে। মানুষ মনে করে জ্ঞান বাড়ালে, শিক্ষিত হলে ধোঁকা খাওয়ার ভালন্যারিবিলিটি কমে। আমার মতে কমে না, নতুন টেকনিক দরকার হয়, অশিক্ষিত মানুষ যেসব কথায় বোকা হবে, শিক্ষিত মানুষ সেগুলো খাবে না।
কোন মানুষকে কিছু কনভিন্স করাতে হলে দেখতে হবে, সে কোন লাইনে পড়াশোনা করছে, কোন পত্রিকার কোন কোন পাতা পড়ে, ফেইসবুকে কোন কোন ব্যক্তি বা পেইজের সাবস্ক্রিপশন আছে- মোদ্দা কথা, তার শব্দভাণ্ডারে কোন কোন শব্দ যোগ হচ্ছে, কোন কোন শব্দের উপস্থিতি দেখলে সে কোন পিস অভ রাইটিং-কে গুরুত্ব সহকারে পড়বে। অ্যান্ড দ্যাট’স হোয়্যার সিউডো-সায়েন্স কামস ইন!
বুঝুক বা না বুঝুক, শিক্ষিত মানুষ বিজ্ঞান জিনিসটাকে সমীহ করে। তাই মানুষ দৈনিক পত্রিকার বিজ্ঞানের পাতায় যেসব শব্দের সাথে ফ্যামিলিয়ার হয়, সেসব শব্দ ব্যবহার করে আপনি যে কোন ভুংচুং বিষয়কে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধের চেহারা দিতে পারবেন। সেটাই মূলত অলীক-বিজ্ঞান। সেসব শব্দের একটা ছোটখাট লিস্ট দিলামঃ
কোয়ান্টাম ফিজিক্স, আর্থ ম্যাগনেটিক ফিল্ড, কসমিক রশ্মি, ইউনিভার্সাল অবজার্ভার, ব্রেইনওয়েভ, মেটাবলিজম, রেস্পিরেশন, হরমোন প্রবাহ, পরিপাকের এনজাইম, নার্ভ স্টিমুলেশন, অর্গানিক, জেনেটিক, তরঙ্গের আয়োনাইজেশন, টাইম-স্পেস, মানুষের শরীরের উপর গ্রহ-নক্ষত্রের মাধ্যাকর্ষণ ক্রিয়া, অবচেতন মন ইত্যাদি ইত্যাদি। এই শব্দগুলোর দুই ধরণের ব্যবহারকারী আছে, তাদের নিয়ে আলাদা করে আলোচনা করছি।
প্রথম বলি ব্যবসায়ীদের কথা। যেমন বিভিন্ন মেডিটেশন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, হার্বাল প্রসাধনী আর ওষুধের কোম্পানি, স্পর্শ চিকিৎসক বা অলৌকিক ক্ষমতার দাবীদার বৈদ্য, জ্যোতিষবিদ, অকাল্টিস্ট ইত্যাদি।
অনেক অ্যানশিয়েন্ট নলেজের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল এবং কিছুকিছু আমি নিজের জীবনে প্রয়োগ করতেও আগ্রহী। আমার মতে, মানুষ নিজ-নিজ ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী অ্যানশিয়েন্ট নলেজের দ্বারপ্রার্থী হতেই পারে, মেডিটেশন করে যদি মনের ব্যায়াম করে, যোগব্যায়াম করে স্ট্রেচিং করে, প্রাণায়াম করে স্ট্যামিনা বাড়ায়- এখানে তো সমস্যা নাই। সমস্যা হল যখন এসব নলেজের অত্যুৎসাহী ডিসাইপল বা ব্যবসায়ী কাটতি বাড়ানোর জন্য প্রাচীন জ্ঞানকে আধুনিক বিজ্ঞানে ইন্টারপ্রেট করতে গিয়ে গোঁজামিল ঢুকায়। অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসায় মানুষের ভরসা কমে যাওয়ায় যে গ্যাপটা সৃষ্টি হয়েছে, তাঁরা স্রেফ সেটার সুযোগ নেন। এটা দুঃখজনক, অনেক মানুষকেই এসব বিপথে নেয়, বিভ্রান্ত করে।
এক্ষেত্রে হুমায়ুন আহমেদের একটা ঘটনা মনে পড়লো। তিনি চীনে একটা বিখ্যাত হার্বাল চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে গেছেন। ওখানকার চিকিৎসক তাঁকে দেখেই বলে দিলেন তাঁর বাইপাস সার্জারি হয়েছে, শুনে তিনি অবাক। পরে তাঁর স্ত্রীর কথায় বুঝতে পারলেন, সার্জারির জন্য হাত থেকে যে ভেইন নেয়া হয়েছে-সেই কাটা দাগটা রয়ে গেছে। সেটা দেখে যে কেউ বাইপাস সার্জারির কথা অনুমান করতে পারবে। কয়েকদিন আগেও বাংলাদেশে মেটাল রিস্টব্যান্ড বিক্রি করা হত, এই কথা বলে যে, মানুষের বাত ব্যথার কারণ হল সেলফোনের তরঙ্গ, আর সেই রিস্টব্যান্ড তরঙ্গের কুপ্রভাব থেকে রক্ষা করবে।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা –
আধুনিক মেডিসিন হার্বালেরই ডেরিভেটিভ। প্রকৃতিতে যেসব উপাদানের ঔষধি গুণ আছে, সেসবই সংগ্রহ করে মূল ক্রিয়াশীল পদার্থটাকে চিহ্নিত করা হয়, প্রয়োজনে সেটাকেই মডিফাই করে আরও উন্নত করা হয়, আর এভাবেই আমরা অ্যালোপ্যাতির ওষুধ পাই।
সিউডোসায়েন্সের দ্বিতীয় যে গ্রুপটা আছে, সেটা হল অনলাইনের ওয়ানা-বি অ্যাকটিভিস্ট। ইদানিং ট্রেন্ড শুরু হয়েছে কন্সপিরেসি চর্চা, অ্যান্টি-ভ্যাকসিন, অ্যান্টি জিএমও, অ্যান্টি-বিগ ফার্মা ইত্যাদি। ওয়ানা-বি অ্যাকটিভিস্টদের বেশিরভাগেরই কাজ হল প্যানিক মংগারিং। আমি এসব আন্দোলনের বিরুদ্ধে কথা বলছি তা না, আমি তাদের সিউডোসায়েন্স ব্যবহারের বিরুদ্ধে।
প্রথম কারণটা অবভিয়াস, মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। দ্বিতীয়টা হল, এতে তাদের নিজেদেরই উদ্দেশ্যটা খর্ব হচ্ছে। কিভাবে? অনলাইনের আন্দোলনকারীরা অ্যানোনিমাস। ধরেন, তাদের মধ্যে প্রো-জিএমও, প্রো-বিগ ফার্মারা মিশে গিয়ে সিউডোসায়েন্সের ভড়ং ব্যবহার করে বিভিন্ন ইস্যুর প্রচার করলো। তারপর আসল ওয়ানা-বি অ্যাকটিভিস্টরা না বুঝে সেগুলো লুফে নিলো আর সেগুলোর প্রচার করা শুরু করলো। সেসব ভুয়া ইস্যু ভালো পাবলিসিটি পাওয়ার পর প্রো-জিএমও, প্রো-বিগ ফার্মারা স্বরূপে আবির্ভূত হয়ে বৈজ্ঞানিক যুক্তি দেখায়ে ইস্যুগুলা খণ্ডন করে দিলো। যারা নিউট্রাল, তারা এসব দেখে অ্যাকটিভিস্টদের ধুয়ে দিলো, আর শেষমেষ দাঁড়ালো কী? অ্যাকটিভিস্টদের যেসব অরিজিনাল ইস্যু ছিল সেগুলা চাপা পড়ে গেলো।
যেমন যারা অ্যান্টি-জিএমও বা অর্গানিক কৃষির সমর্থনকারী, তারা বলাবলি করছিলো জেনেটিক্যালি মডিফায়েড অর্গানিজম বা খাদ্যশস্য খেলে এই হবে, সেই হবে, হরমোনাল প্রবলেম হবে। পরে রিসার্চে প্রমাণিত হল, জিএমও খেলে অসুবিধা নাই, তখন অ্যান্টি-জিএমওদের আসল ইস্যু চাপা পড়ে গেল। যেমন রাসায়নিক কীটনাশক, সার ব্যবহারে পরিবেশের ক্ষতি, জিএমও নিয়ে খাদ্য রাজনীতি ইত্যাদি। এইচএসসির বইতে পড়ানো হয়, জেনেটিক্যালি মডিফাইড সুপার রাইস দিয়ে এমনেশিয়া শিশুদের ভাইটামিন-এ এর অভাব পূরণ করা হবে, কিন্তু বলা হয় না গ্রামেগঞ্জের রাস্তাঘাটে কুড়িয়ে পাওয়া সবজিতেই ভাইটামিন-এ এর সোর্স আছে। মাঝখান দিয়ে জিএমও ল্যাবের লাভ, মিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট।
জিএমও কোম্পানির কাজ লাভ তোলা, মানুষের পুষ্টি বা খাদ্য উৎপাদন তাদের মূল লক্ষ্য না, ওষুধ কোম্পানির কাজ লাভ তোলা, মানুষের স্বাস্থ্য আদৌ কই গেল সেটা তাদের কাছে সেকেন্ডারি। কিন্তু সিউডোসায়েন্স এসবের বিকল্প হতে পারে না।
আপনি কন্সপিরেসি থিওরি চর্চা করতে চান, ইউ আর ওয়েলকাম, ইওর ইন্টেলেকচুয়াল সার্ভিস ইজ ওয়েলকাম। কিন্তু ইন্টারনেটে ভিত্তিহীন সিউডোসায়েন্স আর্টিকেল পড়ে সময় নষ্ট করবেন না। আপনি বিজ্ঞান শিখেন, ইকোনমিকস শিখেন, সোশ্যাল ডাইনামিকস শিখেন। তার আগে গড়ে তুলেন র্যাশনাল নির্মোহ চিন্তাভাবনা করা, জার্নালে পাবলিশ করা পেপারের সাথে মিলিয়ে দেখার চর্চা, কঠিন কঠিন লেখা হজম করার চর্চা। A reminder to me, first and foremost.