জেমস হুইলার রচিত “The History of India from the Earliest Ages: Hindu Buddhist Brahmanical revival” অবলম্বনে সিকান্দার বাদশা ওরফে আলেক্সান্ডারের ভারত বিজয়ের অসাধারণ কাহিনী।
এক
খ্রীস্টজন্মের ৩২৭ বছর আগের কথা। ভারতবর্ষ। সুদূর ম্যাসিডোনিয়ার গ্রীক রাজা আলেকজান্ডার সৈন্যবাহিনী নিয়ে কাবুল নদী পার হয়ে দ্রুত সিন্ধুনদের দিকে ধাবমান। তার বয়স মোটে আঠাশ বছর, তবু তার পায়ের তলায় পশ্চিম ইয়োরোপ থেকে পারস্য পর্যন্ত। এশিয়াতে তার নাম লোকে একই সাথে শ্রদ্ধা ও ত্রাসের সাথে উচ্চারন করতো, তিনি ছিলেন তাদের কাছে দেবতার মতই। অন্য সাধারন তাতার কমান্ডারের মত তিনি শুধুই লুটপাটের জন্যে রাজ্য দখল করতেননা। কিংবা গ্রীক সংস্কৃতি দিকে দিকে ছড়িয়ে দেবার মহান দায়িত্বও তার ছিলনা। তার স্বপ্ন ছিল সারা দুনিয়াকে তার সাম্রাজ্যে পরিণত করা।
দারিয়ুসের [তৃতীয় দারিয়ুস, পারস্যের তৎকালীন রাজা] সিংহাসনে চড়ে তিনি প্রথম বুঝতে পারেন যে টাইটেলের বেইল নাই যদি উত্তর আর পূর্বের বর্বর জাতিগুলাকে হাতের মুঠোয় না আনা যায়। অতএব তিনি উত্তরে হানা দিলেন, পশ্চিম হিমালয় পার করে বলখ দখল করতে। এদিকে অক্সাস [অক্সাস অর্থাৎ আমু দরিয়া ] নদী পার হয়ে খিভা [খিভা অর্থাৎ খোরাসান নগর, বর্তমানে উজবেকিস্তানের শহর] আর জাক্সার্টেস [জাক্সার্টেস অর্থাৎ সির দরিয়া ] নদী পার হয়ে বুখারা পর্যন্ত দখল হল। ম্যাপের উত্তর দক্ষিন পশ্চিম সব কোণাকাঞ্চির জাতিগোত্র হাতের মুঠোয় এনে তিনি ভারতের পাঞ্জাবের দিকে নজর দিলেন। তার ধারণা ছিল পূর্ব সাগরের পারে সবশেষ পয়েন্ট ভারত, এরপরে আর কিছু নেই। তার মহান কল্পিত সাম্রাজ্যের পূর্ব প্রদেশ ছিল ভারতবর্ষ।
কিন্তু তার ম্যাসিডোনিয়ার সৈন্যবাহিনীর তেল ফুরিয়ে আসছিল। আলেকজান্ডার তার সাদা বন্ধুদের কথা বাদ দিয়ে বাদামী চাটুকারদের কথায় কান দেয়া শুরু করলেন, গ্রীক হেলমেটের বদলে তিনি পরা শুরু করলেন পারসীক মুকুট। আচার আচরনেও পরিবর্তন এলো তার। বাপ ফিলিপের মত তার নারী দেখলে জিভ দিয়ে পানি পড়তো না, কিন্তু ব্যাক্ট্রিয়ার[ব্যাক্ট্রিয়া অর্থাৎ পোখতার নগর। বর্তমানে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তানের কিছু এলাকা নিয়ে গঠিত ] সুন্দরী রোক্সানার প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করে ফেলেন তিনি। প্রেমের ব্যাপারটা অবশ্য গুজব হবারই সম্ভাবনা বেশি, আলেকজান্ডার নারী নয় মদে আসক্ত ছিলেন।
এদের পাল্লায় পড়ে আলেকজান্ডারের ভিতর মেয়েলী ঢং, প্রতিহিংসা, প্রশংসা আর চাটুকারিতার প্রতি দূর্বলতা ইত্যাদি এশিয়ান বদ স্বভাব গড়ে উঠলো। চাটুকারের দল তাকে বোঝাল তিনি অমর দেবতা টাইপ কিছু। খ্যাতি ও প্রতিপত্তি পাবার লোভে তিনি পাগল হয়ে উঠলেন, দিকে দিকে তার নামে পুজা আরম্ভ হয়ে গেলো। কতদূর সেই পূজা ছড়িয়েছিল তা বলা শক্ত, কিন্তু তা সারা ইরান তুরান সহ গোটা ভারতবর্ষে গভীর ছাপ ফেলে গেছে তা নিশ্চিত। আলেকজান্ডারের প্রাচ্য নাম সিকান্দার বাদশা এশিয়ান মুসলমানদের মধ্যে সেইরকম সম্মানের সাথে উচ্চারিত হয় যেমন আলেকজান্ডার নামটি পশ্চিমা জগতে।
সিকান্দার বাদশার ভারত দখলের প্ল্যানটি অল্প কথায় বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব। কাবুল নদীটি কাবুল, জালালাবাদ আর পেশোয়ার হয়ে আটক দূর্গের কাছে সিন্ধুনদে গিয়ে শেষ হয়। সিন্ধুর পূর্বপাড়ে সুফলা পাঞ্জাব, তাতে পানি দেয় সিন্ধু, ঝিলাম, চেনাব, রাভি, বিপাশা, শতদ্রু ও সরস্বতী নদী। আলেকজান্ডারের মতলব ছিল সিন্ধুর পশ্চিমে কাবুলসহ পুরো এলাকা দখলে নেয়া, তারপরে সিন্ধু পেরিয়ে আটক, তারপরে পাঞ্জাব দিয়ে মার্চ করে কোনাকুনি দক্ষিন পুর্বে এগোন। সবশেষে দিল্লী আগ্রা দিয়ে গঙ্গা যমুনা নদী পার হয়ে প্রাচীন নগর প্রাজ্ঞ ও গৌড়ের মাঝামাঝি পুরো মগধ বা পাটলিপুত্র সাম্রাজ্য জিতে নেয়া। ভারত কমপ্লিট।
প্ল্যানে কিছু সমস্যা ছিল। পথে পড়ে বিস্তর বজ্জাত ছোটখাট রাজ্য, যেমন কাবুলের ভেতর মাসাগা নগরী। মাসাগা ছিল আশাকান জাতির রাণীর শহর । সিন্ধুর ওইপাড়ে অন্তত তিনটে এলাকা ঝামেলা পাকানোর মতলবে ছিল;- সিন্ধু আর ঝিলামের মাঝামাঝি তাক্সিলা, ঝিলাম আর চেনাবের মাঝামাঝি পুরান পৌরব, চেনাব আর রাভির মাঝে নতুন পৌরব। পুরান পৌরব সবচাইতে শক্তিশালী শোনা যায়, কিন্তু তারা ছিল খুবই বন্ধু টাইপ জাতি। ডাইনে বাঁয়ে তাক্সিলা আর নতুন পৌরব বাবাজীদের সাথে তার মুখ দেখাদেখি বন্ধ। উত্তর দক্ষিনেও ছোটখাট রাজাদের সাথে কাইজা ছিল তাদের।
একটা ব্যাপার পরিষ্কার করা দরকার। এশিয়াতে সাম্রাজ্য ব্যাপারটা মোটের উপর একগাদা লোকাল রাজা বা সামন্ত প্রভুদের যোগফল, একক সম্রাট বলে কিছু নেই। এরা সবাই মাসে মাসে প্রভুদের চাঁদা দিত আর মিলিটারি পুষতো যদি যুদ্ধ লেগে যায় ওইজন্য। গৃহযুদ্ধ লাগানোর একবারে নিখুঁত ব্যবস্থা! তলোয়ার ছাড়া এই সিস্টেম বহাল রাখা অসম্ভব। আলেকজান্ডারের আগমনের সময় কাবুল আর পাঞ্জাবে এইরকম বেড়াছেড়া শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
আলেকজান্ডারের আক্রমন কোন সাধারন দস্যুর মত ছিলনা। তার নিজের ও সৈন্যবাহিনীর দক্ষতা সম্বন্ধে অতি উচ্চ ধারনা ছিল ঠিকই, কিন্তু খাঁটি সৈনিকের মত তিনি বুঝে পা ফেলতেন। যাকে বলে খুব খিয়াল কইরা। সম্মুখের শত্রুকে তিনি পরোয়া করতেননা, কিন্তু এশিয়ার অভিজ্ঞতা তাকে পেছনের শত্রু সম্বন্ধেও সাবধান হতে শিখিয়েছিল।
সিকান্দার বাদশার প্রথম পদক্ষেপ খুবই বুদ্ধিমানের মতন ছিল। কাবুল নদীতে পৌঁছে তিনি ঘাটে ঘাটে দূত পাঠিয়ে দিলেন যেন তারা এসে তার ক্যাম্পে কথা বলে যায়। পুরান পৌরবের শত্রু নগরীগুলো ভাবলো এইবার একটা শক্ত লোক পাওয়া গেছে, এর সাথে দোস্তি করে পুরান পৌরবকে ভর্তা বানানো যাক। তার ক্যাম্পে রাজাগজার লাইন পড়ে গেল, বিশেষত তাক্সিলার রাজা চরম দামী আর বিরল উপহারে ক্যাম্প ভরিয়ে দিলেন। তাক্সিলা রাজ্য সিন্ধুনদ আর পৌরবের মাঝখানে, পৌরব আক্রমনের মিলিটারি অপারেশনের জন্য চমৎকার। উত্তরে আলেকজান্ডার পিউকেলাটিস [পিউকেলাটিস ছিল অষ্টনগর, বর্তমান পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনের অন্তর্গত ] রাজ্য দখলে লোক পাঠিয়ে দিলেন, সৈন্যবাহিনীর সিন্ধুনদ পেরুতে তা দরকার ছিল।
অন্যান্য বিশেষ কিছু লেখা-
আলেকজান্ডার তখন কাবুলের উপজাতিদের বাঁশ দিতে মন দিলেন। কাবুলে আফগানীদের বাস। এরা যেকোন ভারতীয়দের তুলনায় যুদ্ধবাজ। এদের মাঠে হারিয়ে দিলে দেয়ালঘেরা শহরে গিয়ে ওঠে, শহরে হারিয়ে দিলে পাহাড়ে পালায়। বিরাট যন্ত্রনা। মাঝে মাঝে আলেকজান্ডারের বাহিনীর আসার খবর পেয়ে নিজেরাই শহর জ্বালিয়ে পাহাড়ে উঠে বসে থাকে, মহাবীর আলেকজান্ডার এসে দেখেন বেবাক ফাঁকা! অনেকগুলি ছোট যুদ্ধের পর তারা হার মেনে এদিকসেদিক ছিটিয়ে পড়লো। সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ছিল আশাকান জাতির রাণী ক্লিওফেস, মাসাগায় থাকতেন তিনি। সারা ভারত ছেঁকে সাত হাজার যোদ্ধা জড় করেছিলেন তিনি, যারা খোলা প্রান্তরে ম্যাসিডোনিয়ানদের যুদ্ধে আহবান করতো।
আলেকজান্ডার দূরে পালিয়ে যাবার ভান করে সরে যেতেন, তারপরে হঠাৎ দুম করে এগিয়ে আক্রমন করতেন। শেষে তারই বিজয় হয়, কিন্তু শহরের অধিকাংশ লোক পালিয়ে শহরে আশ্রয় নেয়। তুমুল যুদ্ধ চলে মাসাগায়, কিন্তু সেনাপ্রধানের মৃত্যুতে তারা পিছু হটে আর আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। যোদ্ধাদের ম্যাসিডোনিয়ান ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয় তাদের সৈন্য হিসেবে যোগ দেয়ার জন্য। কিন্তু আলেকজান্ডার খবর পান তারা গভীর রাতে পালাবার ধান্দা করছে, তার হয়ে লড়ে তারা রাণীর বিরুদ্ধে যেতে আগ্রহী নয়। তাদের মুন্ডু কর্তন হল। মাসাগার পতন হল পরদিন, রাণী আত্মসমর্পন করলেন।
কাবুল হাতের মুঠোয় আনার পর তিনি সিন্ধু পেরিয়ে পাঞ্জাব ঢুকলেন। পথে তাক্সিলায় থেমে একটু জিরিয়ে নিলেন, তারপর ঝিলাম নদীর পথ ধরলেন। পুরান পৌরব নদীর ওপারে হাতী ঘোড়া সৈনিক নিয়ে প্রস্তুত। শত্রুর সামনেই বৃষ্টিবাদলার মধ্যে নদী পার হতে হল আলেকজান্ডারকে, অন্ধকার ঝোড়ো রাতে তার বাহিনী ধীরে ধীরে এগুতে থাকলো। পাঁড়ে আসার কাছাকাছি বিদ্যুৎচমকের দ্রুত আলোয় তাদের আসার কথা টের পেয়ে যায় পৌরবরা, তাদের রাজা তার ছেলেকে ঘোড়ার রথবাহিনী দিয়ে পাঠিয়ে দেন। বৃষ্টিস্নাত কাদামাটিতে রথের চাকা আটকে বেকায়দায় পড়ে তারা, সবাই ধরা পড়ে। আলেকজান্ডার যুদ্ধে হারান তার ঘোড়া, পৌরবরাজ হারান তার ছেলে।
এই ভয়ংকর খবর পেয়ে রাজা তার শ্রেষ্ঠ বাহিনীকে যুদ্ধে পাঠান। ধুলোধূসরিত এক প্রকান্ড মাঠে তারা অবস্থান নেয়। সামনে ছিল দুইশ হাতী, একেকটি প্রায় একশ ফিট দূরত্বে। তার ঠিক পেছনেই সেনাবাহিনী, আর দুই পাশে ঘোড়সওয়ারের দল। আলেকজান্ডার দুই দিক থেকে আক্রমন করলেন। পৌরব ঘোড়ার দল কোণঠাসা হয়ে তাদের নিজেদের হাতীদের মধ্যে পড়ে গেল, বেচারা হাতী কি আর ঘোড়া চেনে…সে সামনে যে ঘোড়া পেল তাকেই গদাম দিতে থাকলো।
এরপরে হাতী দেখলো আরেক উৎপাত, ঘোড়ার পিঠের সৈন্য সে পৌরবই হোক আর গ্রীকই হোক তারা বর্শা দিয়ে হাতী খুঁচাতে শুরু করলো। আহত ভীত হাতীর দল দিল পিছন ফিরে ছুট, এইবার তাদের পায়ের তলায় ভর্তা হল পৌরব সেনাবাহিনী। পরাজিত হল পৌরব, তাদের রাজা আত্মসমর্পন করে রাজপুত প্রথা অনুযায়ী বন্ধুত্বের হাত বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেন। আলেকজান্ডার রাজি হলেন। দুদিন আগের দুই চরম শত্রু আজ শপথ নিলেন ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে।
দুই
পৌরববিজয় এক বিরাট ব্যাপার, এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব মহান সিকান্দার বাদশার খয়েরখাঁরা যতটা প্রচার করে তার চেয়ে অনেক ব্যাপক। হেরে গেলে সর্বনাশ হতো, পৌরবেরা অবশ্যই তাক্সিলা দখল করতে এগিয়ে যেত আর মহান আলেকজান্ডারকে কাবুলের বেতমিজ পাহাড়িদের এলাকা দিয়ে ফেরত যেতে হতো। এই বিজয়ে শুধু যে পৌরব হাতে এল তাই নয়, উপরন্তু পারস্যের সাথে সিন্ধু নদ আর ভারত মহাসাগরের মাধ্যমে নতুন কানেকশন খুলে গেল।
তিনি জাহাজ নির্মাণের জন্য কাঠ কাটার হুকুম দিলেন, উত্তরের বন থেকে কাঠ এনে জাহাজ বানিয়ে ঝিলম নদীতে ভাসানো হল। ঝিলামের দুই পাড়ে দুইটি নতুন শহর পত্তন করা হল, বুকাফালিয়া [তার প্রিয় মৃত ঘোড়া বুকাফালাস স্মরণে] আর নিকিয়া। শহর দুটোয় সিন্ধুনদ টহলের জন্য নৌবহর বসানোই ছিল আলেকজান্ডারের আসল ধান্দা, পদাতিক বাহিনীর পাশাপাশি নৌবাহিনীর গুরুত্ব তার কাছে ছিল অপরিসীম।
সিন্ধু নদটাও তার খুব ভালো লেগে যায় কোন কারণে, নদের কুমীর দেখে তিনি খুশিতে ডগমগ হয়ে ভাবেন আরে এই কুমীর তো নীলনদেও দেখেছি, তাইলে মনে হয় নীল নদই নামতে নামতে সিন্ধু হয়ে গেছে! তার এই ভুল অবশ্য পরে ভেঙেছিল।
আলেকজান্ডার চেনাব নদী পার হয়ে নতুন পৌরবে ঢোকেন। তাক্সিলার রাজার মতই এর রাজা পৌরবের পতনে মহা আনন্দিত ছিলেন, পুরান পৌরবের রাজা তার সম্পর্কে চাচা লাগেন। কিন্তু ভাতিজা যখন খবর পায় যে চাচা হেরে আবার আলেকজান্ডারের সাথে চরম দোস্তি করেছে তখন সে ভয়ে রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যায়। আলেকজান্ডার রাজ্য চাচার হাতে তুলে দেন।
ম্যাসিডোনিয়ানরা কিন্তু বিরক্ত হয়ে উঠছিল, আলেকজান্ডারের ভারত জয়ের মুলা তাদের আর পছন্দ হচ্ছিলোনা। কাদা পানির দেশে যুদ্ধ করে তারা ছিল অতিষ্ঠ, গঙ্গা নদীর বদলে তারা সটান গ্রীস ফেরত যেতে চাইলো। আলেকজান্ডার তাদের কতনা বোঝালেন, সোনা বাছা করে বললেন এইতো আরেকটু পরেই গঙ্গা, গঙ্গার পরেই ভারত মহাসাগর, আর কে না জানে ভারত মহাসাগর পেরোলেই কাস্পিয়ান সাগর! কে শোনে কার কথা, তারা শতদ্রু নদী পেরুতেই অসম্মতি জানালো। চোখের পানি মুছতে মুছতে আলেকজান্ডার ফেরার পথ ধরলেন।
আলেকজান্ডারের সাথের সাদা লোকেরা ভারি বুদ্ধিমান ছিল। তারা ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেশটাকে দেখে বুঝার চেষ্টা করেছিল। অবশ্য সাধারন লোকের জীবন তাদের কাছে ধরা দেয়নি, বাইরের জগতটাই তারা দেখতে পেরেছে। পাঞ্জাবে গোত্রগুলির মধ্যে তারা দেখে খুব কড়া কিছু আইন, যা তাদের চোখে অদ্ভুত ঠেকে। কিছু গোত্রে বক্সিং রেসলিং তীরন্দাজী ইত্যাদিতে হেরে গেলে কুমারী কন্যাকে পুরষ্কার হিসেবে দান করার রেওয়াজ ছিল।
অন্যকিছু গোত্রে একজোড়া হালের বলদের বদলে বউ কেনা জায়েজ ছিল, অতএব যতজোড়া বলদের পয়সা মরদের পকেটে ছিল সে ততটা বউ নিয়ে ফূর্তি করতে পারতো। তাক্সিলা শহরে একটা রীতি ছিল, কুমারী মেয়ের গরীব বাপ মেয়ের জন্যে স্বামী জোটাতে না পেরে তাদের বাজারে নিয়ে নিলামে ওঠাত। ঢাক ঢোলক বাজিয়ে লোক জড়ো করা হত তাদের আশপাশে, মেয়েদের গলা থেকে কাঁধ পর্যন্ত কাপড় নামিয়ে লোকে দেখত। কারো পছন্দ হলেই ইনস্ট্যান্ট শুভ বিবাহ।
দুইটি বর্ণের লোকদের গ্রীকদের মনে হয়েছিল উঁচুজাতের মানুষ। ব্রাহ্মন, অর্থাৎ জ্ঞানী লোক। এরা দার্শনিকও বটে। আরেকদল কাঠে, এরা সম্ভবত প্রাচীন ক্ষত্রীয়।
ব্রাহ্মনেরা নানাদিকে ছড়িয়ে ছিল। কিছু ছিল সরকারী কর্মচারী, এরা রাজার বুদ্ধিদাতা হিসেবে কাজ করতো। কিছু ছিল বিরাট তপস্বী টাইপ, এরা দিনের পর দিন খাড়া রৌদ্রে দাঁড়িয়ে সাধনা করতো। কেউ কেউ জ্ঞান বিতরনে মগ্ন ছিল। অনেকে আবার পরিবেশ স্টাডি করতো, ঝড়বাদল খরা রোগশোক এগুলির কারন বের করাই ছিল এদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য। কোন কাজ না থাকলে এদের অভ্যাস ছিল আজাইরা রাস্তাঘাট দোকানপাট মেরামত করা।
সাধারন মানুষ এদের ভারি সমঝে চলতো, যেকোন দোকান থেকে তারা যা খুশি তাই তুলে হাঁটা ধরতো। তারা প্রায় ন্যাংটোই ঘুরতো বলা চলে, কিন্তু যেকোন ঘরের অন্দরে এমনকি মেয়ে-মহলেও এদের অবাধ যাতায়াত। যখন যে ঘরে খুশি তারা ঢুকে গল্প জুড়ে দিত আর তাদের খাবার খেতে বসে যেত। এরকম দুইজন একবার সিকান্দার বাদশার টেবিলে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাবার খেতে শুরু করে, পাঞ্জাবী ব্রাহ্মনেরা কঠোর জাতপাতের নীতি তেমন মানতো বলে মনে হয়না। খাবার খেয়ে তারা কাছাকাছি একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে ধ্যান করা আরম্ভ করে রোদের মধ্যে। এরা রোগকে ঈশ্বরের শাস্তি মনে করতো, কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে নিজের গায়ে আগুন লাগয়ে দিত।
তাক্সিলার ব্রাহ্মনদের নিয়ে আলেকজান্ডারের কৌতূহল ছিল। আজকের হিসেবে যাকে ধর্ম বলা হয় তা আলেকজান্ডার বা তার গ্রীক বন্ধুরা কেউই পালন করতোনা, গ্রীসে মূর্তিপূজা আসলে ছিল উৎসবেরই নামান্তর। রাস্তাঘাটে মানুষ দৈববাণী শুনতে পেত বলে দাবী করতো কিন্তু সত্যকার ধর্মপালন বলতে যা বুঝায় তা ছিল অনুপস্থিত। তাই আলেকজান্ডারের এই ন্যাংটো ব্রাহ্মনদের ধর্মীয় পাগলামী বুঝতে ইচ্ছে করে। তিনি এদের ডেকে পাঠান। ব্রাহ্মনেরা জানায় তিনি যদি ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করতে চান তাহলে ওরা আসবেনা বরং তাকেই তাদের কাছে যেতে হবে। তাই তিনি ওনেসিক্রটাসকে [গ্রীক ইতিহাসবেত্তা] তাদের কাছে পাঠালেন।
সে এক আজব ইন্টারভিউ বটে। শহর থেকে দুই তিন মাইল দূরে সবুজ জঙ্গল। পনেরোটি ন্যাংটাবাবা, কেউ কেউ আবার মাথার উপর দুই হাতে কাঠের টুকরা ধরে এক পায়ে খাড়া। কেউ পাথরের উপর বসে বা শুয়ে। উন্মাদ ছাড়া এই কড়া ভারতীয় রোদে কেউ এই কাজ করে তা ভাবাই যায়না। সাদা ভাইয়া তার দোভাষী নিয়ে হাজির। তিনি বললেন, ওহে ভারতীয় বন্ধুরা, আমি আসছি মহান আলেকজান্ডারের পক্ষ থেকে। তিনি নিজেই এক দেবতা, আর তার কানে কালানোসের পান্ডিত্যের কথা গিয়েছে। তিনি তোমার কথা শুনতে আগ্রহী। পাথরের উপর শুয়ে থাকা ন্যাংটাবাবা কালানোস উত্তর দিলেন, “তোর গায়ের কাপড় প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ আর দেবতার অপমানও বটে। এইরকম অহংকার আর আমোদে দিন গুজরান করলে জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। সত্যযুগে ধুলার মত অফুরন্ত ছিল গম, পানির মত দুধ, মধু, মদ আর তেলের নহর বয়ে যেত। কিন্তু মানবজাতির আমোদফুর্তির বহরে দেবতারা রুষ্ট হন, আর সব কেড়ে নেয়া হতে থাকে। এইরকম চলতে থাকলে খরা দুর্ভিক্ষ লাগতে কি আর দেরি লাগবে? শুন, সত্যই শিখতে চাইলে যা কাপড় খুলে আয় আমার পাশে পাথরের উপর বস। দেখ কত শিখাই।”
গ্রীক ভাইয়া হাঁ করে তাকিয়ে থাকলো। ন্যাংটা ফাজিল বলে কি? মান্দানিস বলে আরেক সাধু কিন্তু কালানোসকে বকে দিল বিদেশির সাথে খারাপ ব্যবহার করার জন্য। তারপরে ওনেসিক্রটাসকে শুধালো, বুঝলাম আলেকজান্ডার বিরাট জ্ঞানের পিপাসু, সব রাজারা তার মত হলে দেশটা সগ্যে পরিনত হত। কিন্তু বল দেখি, তোমাদের দেশে কি এইটা মানে যে সত্য ধর্ম হল সেই শুদ্ধ আত্মার তালাশ যে আনন্দ অথবা কষ্ট কোনটাতেই বিচলিত হয়না?
ওনেসিক্রটাস বললেন পিথাগোরাস এরকম একটা মতের কথা বলে গেছেন বটে, যেখানে তিনি ছাত্রদের জন্য জীবহত্যা নিষিদ্ধ করে গেছেন, কারন তাদের প্রাণ আছে। মান্দানিস বললো, হ্যাঁ কথা ঠিক আছে…কিন্তু তারাও তো নিয়মের দাস! প্রকৃতির মাঝে ফিরে আসা চাই।
যাই হোক তাকে লোভ বা ভয় দেখিয়েও আলেকজান্ডারের কাছে আনা গেলনা। মান্দানিস আলেকজান্ডারের দেবতা হওয়ার খায়েশ নিয়ে ভারি তামাশা শুরু করলেন, বললেন তার কিছুই চাইনা আর কাউকে তার ভয়ও নেই। “আমি মরলে”, বললেন তিনি, “আমার আত্মা শরীরপিঞ্জর থেকে মুক্তি পাবে, আর এক মহান আনন্দময় স্থানে গমন করবে”। কালানোস কিন্তু পোল্টি খেলেন, তিনি ঠিকই আলেকজান্ডারের দরবারে গিয়ে হাজির। তাকে দরবারে নিয়মিতই দেখা গেল, আলেকজান্ডারের পিছুপিছু তিনি ভারতও ত্যাগ করেন একসময়। আলেকজান্ডারকে নিয়ে প্রশংসামূলক গীত রচনায় মেতে উঠেন তিনি। অবশেষে একদিন তিনি অসুখে পড়েন, আর রীতি অনুযায়ী নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে ভবলীলা সাঙ্গ করেন ন্যাংটা সাধু কালানোস।
জেমস হুইলার লিখিত “The History of India from the Earliest Ages: pt. 1. Mussulman rule” বই অবলম্বনে ভারতবর্ষের ইতিহাসের কিছু ব্যতিক্রমী কাহিনী নিয়ে লেখা “ভারতবর্ষের ইতিহাস পর্ব-১” এবং “ভারতবর্ষের ইতিহাস পর্ব-২” লেখা দুটি পড়ুন।